চক্ষুদান



স্বপ্নময় চক্রবর্তী

যমকে বাঁচিয়ে রেখেছে যদু, কারণ যমই বাঁচিয়ে রেখেছে যদুকে। যদুর হাতের পলিথিন ব্যাগে গুটিশুটি হয়ে আছে যমরাজা।

যদু চিত্রকর পটুয়া হলে কী হবে, পট আঁকে না আর। ওর বাবা আঁকত। পিলচুহাড়াম পট, সীতাহরণ পট, জগন্নাথ পট, সিধু-কানু পট, চক্ষুদান পট, আরও কত। বাবার সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে গান গেয়ে সিধে নিত। গত বিশ-পঁচিশ বছর ধরে ও-সব আঁকে না আর। লোকে আর আমোদ দেখে না। লোকে পারলে সিনেমা দেখে, ভিডিয়ো দেখে, টিভি দেখে। পুরনো সব পটগুলো ন্যাতা-কানি হয়ে হারিয়ে গেছে।


যদু চিত্রকরের হাওয়াই চটিতে এখন লাল ধুলো। জংলা রাস্তা উজিয়ে যজমান বাড়ি যাচ্ছে যদু। খবর এসেছে বুরুডি গাঁয়ের সাধু হাঁসদা মারা গেছে। যদু নিয়ে যাচ্ছে যমরাজার ছবি আর চক্ষুদান পট। সাধুর বাড়িতে গিয়ে পটে চোখ আঁকবে, তাতে মরা সাধুর মুক্তি হবে।

যম কাউকে তুলে নিলে সেই বাড়ি গিয়ে একটা যমপট দেখায় যদুরা। যম বন্দনা হলে চোখদানের পট দেখায়। যে মরল, তার চোখ দান করে। তাতে মরা মানুষের মুক্তি হয়। যমপটে গোঁপওলা যমরাজার ছবি আছে। পুরনো পটটা নষ্ট হয়ে গেছে বলে বছরখানেক আগে নতুন একটা পট আঁকিয়েছে যদু ওর ছেলে গগনকে দিয়ে। ছেলেটার পা দুটো বেঁকা, কিন্তু হাত ভাল। ও এ বার যমরাজার চোখে চশমা দিয়ে দিয়েছে। যদু বলেছিল, আমার দিগের চোদ্দ পুরুষ বিঁতে গেল কেউ যমরাজার চখে চশমা পসায়নি, তু কি করলি ইটে? গগন বলেছিল, যম বুঢ়া হঁইছে কিনো, চখে দিশে না ভাল, তাই পঁসাঞে দিলম।

যদুর ভাগে এখন সাতটা গ্রাম আছে। ও-সব গ্রামে কোনও ‘হড়’ মানে মানুষ মরে গেলে যদু খবর পায়। তখন পট নিয়ে যায়। প্রথমেই পা ধোওয়ার জল পায়, পা মোছার নতুন গামছা পায়, জল বাতাসা পায়। উঠোনে এক গাবল মানুষ জড়ো হয়, হাত জোড় করে জোহার জানায়। যদু পট দেখায়, যম দেখায়। সাঁওতালি ভাষায় বলে মৃত্যু ছাড়া গতি নেই। আমাদের পিতৃপুরুষরা সব যেখানে গেছেন, সবাইকেই যেতে হবে সেখানে। সেখানে ভাল জায়গা আছে, খারাপ জায়গাও আছে। বাঘ-সাপ-পোকামাকড় ভর্তি জায়গা যেমন আছে, ফলের গাছ ভর্তি বাগানও আছে। সেখানে পেট ভরা খাবার, মিষ্টি জলের ঝরনা, আরাম করার পাথর শয্যা আছে। যে হড়টি মারা গেল, ও পারে গিয়ে তাকে খুঁজে নিতে হবে সব ভাল কিছু। এ জন্য চাই চোখ। মরা মানুষের চোখ থাকে না।

এর পর একটা মানুষের ছবি দেখায় যদু পটুয়ারা। দুটো হাত দু’পাশে ছাড়ানো। চোখ নেই, চোখের জায়গাটা সাদা।

এ বার ঝোলা থেকে বের করে নিমকাঠিতে লাগানো ভেড়ার লোমের সরু তুলি। ছোট কৌটায় আনা তেল আর ভুষো কালির রং তুলিতে জড়িয়ে চোখ আঁকতে আঁকতে বলে, মেৎ তে ঞেলমে। তিরপিৎ কঃ মে। গড়ো আলে মে...। চক্ষুদান হও, সম্পূর্ণ হও, আমাদের সহায় হও...।


তাই বলে যদু সাঁওতালি বলতে পারে না। কয়েকটা কথা জেনে রেখেছে শুধু। কাদা মানে বাত, দারে মানে গাছ, দাঃ মানে জল— এ রকম কিছু। চক্ষুদানের সাঁওতালি মন্ত্রটা ওর পূর্বপুরুষের কাছে শেখা। এটা মুখস্থ মাত্র। নিজের সন্তানদের শিখিয়ে যাবে, যেতে হবে। নতুন কোনও চক্ষুদানের আগেই চোখটাকে আবার সাদা করে দিতে হয়। যদু যাচ্ছে বুরুডি গাঁয়ে। চুনকি নদী পেরিয়ে আর এক ঘণ্টা হাঁটলে পিচরাস্তা। তার পর বাসে তিন টাকা ভাড়া দিয়ে হাতা, আবার তিন বিড়ির হাঁটাপথ।

নদী পেরুলেই ডাহি ডুংরি। ন্যাড়া রাস্তা। গাছ নেই, ছায়া নেই, ডান দিকে ‘হেদান বুড়হি’র থান। হেদানবুড়ি হলেন ক্লান্তির দেবী। হেদানবুড়ি সহায় থাকলে পথ চলার কষ্ট থাকে না। রাস্তা থেকে পাথর কুড়িয়ে বুড়ির থানে ফেলে দেয় যদু। বুড়ি ক্লান্তি গ্রহণ করেন। বুড়ির থানের চার দিকে এ রকম কত কষ্ট পাথর হয়ে পড়ে আছে।

লাল রাস্তাটা মিশেছে কালো পিচ রাস্তায়। ওই রাস্তা দিয়ে টাটা যাওয়া যায়, রাঁচি যাওয়া যায়। ওই রাস্তায় বাস যায়, ট্রাক যায়। ট্রাকে কাটা জঙ্গল শহরে যায়। এখানে কয়েকটা দোকান আছে। চা-নাস্তার, সাইকেল সারাইয়ের, খইনি-বিড়ি-পানের। ধোঁয়া-ভরা খড়ের চালের চা দোকানের সামনে একটা সাদা মোটরগাড়ি দাঁড়ানো। দোকানের ভিতরে পিয়ালের তক্তায় ক’জন ফরফরা লোক বসে চা খাচ্ছে।

দোকানির নাম নেতা মহাতো। যদুর সঙ্গে ওর চেনাজানা আছে। যদু বলল, গরম কি আছে গ?নেতা বলল— গুলগুলা ভাঁজেছি। ভাল।যদু বলল— দাও তবে এক খামচা।শালপাতার ডোনায় খানছয়েক গুলগুলা তুলল নেতা। বলল, চখ দান করতে যাচ্ছ বুঝি?

— হ।

— কোন গাঁ?

— বুরুডি।

— হড়টা কি ছিল?

— হোমগাড পুলুশ্‌।

— তবে তো কামাই ভালই হব্যে। ফিরার সময় মালপুয়া লিও।বাবুদের এক জন বলল, বাংলা বলছেন দেখছি। আপনারা বাঙালি?

নেতা মহাতো বলে— বাংলাই তো এ দিগরের কথা। কিন্তু আমরা বুইলতে পারি, পড়তে লারি, লিখতে লারি।

— আচ্ছা, গুলগুলাটা কী জিনিস?

— গুড়-আটার বড়া। দিব? গরম আছে।

— না, থাক।


লোকগুলো যদুকে লক্ষ করতে থাকে। ওর পরনে পাজামা আর তালি দেওয়া আলখাল্লা ধরনের পোশাক। চোখ দান করতে গেলে এই পোশাকটাই পরে।লোকটি যদুকে বলে, তুমিও বাঙালি?

— পটুয়া বটি। চিত্রকর।

— কী ভাষায় কথা বল?

— সব ভাষায় বলি। হিন্দি, ওড়িয়া, সাদরি, বাংলা...

— মাতৃভাষাটা কী?

— আজ্ঞে?

— মাতৃভাষা, মাতৃভাষা। ঘরে বউ-বাচ্চাদের সঙ্গে কী ভাষায় কথা বল?

— সিটা তো বাংলাই বটে।

নেতা মহাতো বলে, ইধারে ত বাংলাই ছিল বটে। পটকা, নারানপুর, সিনি, কুমডি সব। ই সব আগে বিহার ছিল। ইখন ঝাড়খণ্ড হইছে। আগে ইস্কুলে বাংলা পঢ়াপঢ়ি হইত। ইখন নাই। ঘরে শুধু বলাবলি হয়। আপনাদিগের পরিচয় আইজ্ঞা?

লোকটি চোখ থেকে কালো চশমাটি খুলে বলে— আমরা টিভি-র লোক। টেলিভিশন। কলকাতা থেকে বদলি হয়ে এখন রাঁচিতে। আমার নাম বিক্রম রায়।

— টিভি? বাপ্পুস্‌!

— সকালে টাটায় একটা কাজ ছিল। বিকেলে আপনাদের মন্ত্রী আসবেন চাইবাসায়। টিভি-তে দেখাতে হবে। এই যে ইনি ক্যামেরাম্যান।

ক্যামেরাম্যানের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল নেতা মহাতো। বলল, আপনিই তবে আসল লোকটি বটেন। কী আজব কল। ক্যামরার খিঁচা ফটোক ঘর ঘর পহুচ যাইছে। ওরা দু’জনে ক্যামেরাম্যানটিকে দেখতে থাকে। ক্যামেরাম্যানের কালো দাড়ির ভিতরে সাদা হাসি ইলিকঝিলিক করে। নেতা মহাতো কাঠের বেঞ্চির উপর পড়ে থাকা মাছি বসা মটরদানাটা আর দু’চারটে ছড়ানো মুড়ি ন্যাতা দিয়ে সাফ করে দেয়। এর চেয়ে বেশি সেবা আপাতত করতে পারে না।

বিক্রমের পকেটে বাজনা বেজে ওঠে— সারে যাঁহা সে আচ্ছা। বাজনাটাকে ও বলল সিগন্যাল। এ জঙ্গুলে জায়গায় এত ক্ষণ কোনও মাথা ধরার ওষুধ পায়নি, কিন্তু সিগন্যাল পেয়ে গেল বলে আনন্দ পেল। ফোনে কথা বলল, ইংরেজি আর হিন্দি মিশিয়ে। কথার মধ্যে ‘পটুয়া’ শব্দটা কয়েক বার ছিল, আর ছিল ‘ইনডিপেনডেন্স ডে’।

বিক্রম যদু পটুয়াকে বলল— কয়েকটা পট দেখাও দেখি।যদুটা যেন লজ্জা পেল। বলল, কিছু তো নাই আইজ্ঞা, শুধু চখদান খান আছে।পট দেখে বিক্রম আশ্চর্য। ওটা কী?— ইটায় মরা মানুষ। চখ নাই। আমরা চখ দান করি।

— কোথায় যাচ্ছ?

— হাতা। তার পর বুড়ুডি।

— আমাদের গাড়িতে যেতে পারো। আমরা হাতা হয়েই যাব।

এ রকম তোয়ালে ঢাকা তুলতুলা সিটে যদু জীবনে প্রথম। বিক্রম ক্যামেরাম্যানকে সামনে বসিয়ে যদুকে পিছনে বসাল। দু’জনের মাঝে সিটের উপর কাপড় ঢাকা ক্যামেরা। বিক্রম বলল, একটা দরকারি কথা বলি। স্বাধীনতার পট আঁকতে পারবে? যদু অবাক হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকায়। গাড়ির জানালায় পাহাড়ের পাড় বসানো আকাশ।

— স্বাধীনতা জানো তো?

— হ। গোটে পরব বটে।

— কী পরব?

— ঝাণ্ডা পরব।

— ওই পরব মানাও?

— না আইজ্ঞা।

— শোন। একটা পট আঁকবে। পটে গাঁধীজি, নেহরু, ভগত সিং, নেতাজি সুভাষ এঁদের আঁকবে। আর ওঁদের নিয়ে গান বাঁধবে। টিভি-তে দেখাব স্বাধীনতার দিন। টাকা পাবে। পারবে? মাথা চুলকোতে থাকে যদু।তোমরা এ সব পট আঁকো না?মাথা নাড়ায় যদু।

বিক্রম বলে— মেদিনীপুরের পটুয়ারা এ সব পারে। ওরা কত রকম পট বানায়। ভোটের পট, পোলিও পট...। তো, একটা করে দাও না ভাল করে। সিধো-কানু পটটা পারবে তো?

— পারতাম।

— এখন পারো না?মাথা চুলকোয় যদু।

— গাঁয়ে ক’ঘর পটুয়া আছে?

— উটা তো পোটোদের গাঁ আইজ্ঞা। গাঁয়ের নামই তো হল পটকা। আমহাদিগরকে পটিকার বুলা হইত কিনা। কিন্তু ইখন কুন পটো আর পট আঁকে না আইজ্ঞা। শুধু এই চক্ষুদান পট।

— পট ছেড়ে কী কর তবে?

— সব গতর খাটা কাম করি আইজ্ঞা।

— জমি আছে?

— আমরা সব বিপলা আইজ্ঞা।

— বিপলা মানে?

— বিপলাদিগের রেশনে কম পয়সা লাগে।বিক্রম বুঝতে পারল ও বলতে চাইছে, বি পি এল। বিলো পভারটি লেভেল।

আজ চক্ষুদানের কিছু বাইট নিয়ে রাখতে পারত। উপায় নেই। মন্ত্রীর কভারেজ। স্বাধীনতা দিবসের কভারেজটা ওরই এ বার। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে থাকবে পটুয়াদের গ্রামে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন। ফ্রেমটা কল্পনা করে বিক্রম। পিছনে ঝুপড়িঘরগুলো, সামনে পাথরের চাঙড়, পাথরের উপর বসে আছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। পটেতে বিরসা মুণ্ডা বা সিধো-কানু বা তিলকা মাঝির কাহিনি। একটা ফ্ল্যাগও দরকার। ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ, টিলা-পাথর থেকে সোজা আকাশে উজিয়েছে। পতাকাটা কিন্তু একদম গর্জাস হবে না, একটু দুবলা। বিপলা বিপলা। ব্যাকগ্রাউণ্ডে বাঁশিতে জনগণমন। জমে যাবে।

বিক্রম বলে, যা হোক করে একটা বিরসা বা সিধো-কানু ম্যানেজ কর। কেউ না কেউ ঠিক জানে। কী, পারবে না? টাকা পাবে। যদু ঘাড় কাত করে কাপড় ঢাকা ক্যামেরাকে বলে কত পাব আইজ্ঞা? বিক্রম বলে, পাঁচশো তো পাবেই কম সে কম। পাঁচশো শব্দটা কেমন যেন আশ্চর্য শোনাল। যেন দিনের বেলায় প্যাঁচার ডাক। তাই আর এক বার শুধোল— কত বললেন। পাঁচশো?

— পাঁচশো তো বটেই, চেষ্টা করব আরও দিতে, যদি আর এক জন গায়।কুকড়া ডেকে উঠল। শালফুল ফুটল। ছৌ নাচের ধামসা বাজল। হাড়িয়া-পেঁয়াজি-কটকটি-কাঁকই-লালফিতে সাজানো হাঁকডাক সমেত একটা গোটা হাট যেন পটের ফ্রেম হয়ে গেল। সেখানে যদু পটুয়ার হাতে একটা মস্ত বড় ঝোলায় যা মন চায়।

পরথমে বন্দন করি টিভি-র নন্দন।
পাঁচশ’ টাকা দিব্যে বলে পুষ্প বরষণ ।।

ওই তো, গান মরেনি? টিভি-র ছেলেটার দিকে তাকায় যদু। চাদর ঢাকা ঘুমন্ত ক্যামরার দিকে তাকায়। অঞ্জলিবদ্ধ হয় সেই ক্যামরার কাছে। যে ওর ভাত মেরেছে। বিক্রম বলে, শোন, আজ শনিবার তো, ঠিক আগামী বৃহস্পতিবার, মানে গুরুবার তোমাদের গ্রামে যাচ্ছি। কী ভাবে যাব বল। যদু গাড়ি যাবার রাস্তা বুঝিয়ে দেয়। বিক্রম হিপ পকেটের পার্স থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে বলে, টাকাটা রেখে দাও। একটা ফ্ল্যাগ বানিয়ে রেখো, ঝাণ্ডা। দেখেছো তো? মাথা নাড়ে যদু। তিনরঙা।

বেশ। বাঁশের মাথায় ঝাণ্ডা রেখো, পটও বানিয়ে রেখো। গুরুবার আসব। রবিবার স্বাধীনতা দিবস। ক’দিন আগেই শুটিং করে নেব। রবিবার দেখাতে হবে কিনা। হাতায় নামিয়ে দেয় যদুকে। যদু টিভি-কে নমস্কার করে।

বাইশ ঘর পটুয়ার কেউ তিলকা মাঝির গান জানে না। সব চেয়ে বয়স্ক যে, পর্বত চিত্রকর, সে উঃ, লারছি লারছি কুথায় যে হারায়ে গেল বলে দু’হাতে ছিড়ছে খাংলা চুল। আর এক জন গুরুপদ, দু’হাত দিয়ে কল্পিত পট সামনে রেখে গান গাইছে যেন, কান্না। কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ফিট রোগের পর ওর কথা বোঝা যায় না। ওই অবোধ্য ধ্বনির ভিতর থেকে কেউ যেন কিছু আবিষ্কার করে। হ! হ! সিদু মাঝি। হ, মহেশ দারোগা। পর্বত চিত্রকর হঠাৎ বলে উঠল—

সিদু কানু চাঁদ ভৈরব চারি ভাই ছিল।
ভাগলা দিহি গ্রামে উদের জনম হঞে ছিল ।।

বিপিন চিত্রকর জুড়ল--

—মহেশ দারোগা আসে জঙ্গল মহালে।
নানা অত্যাচার তারা করে সাঁওতালে ।।
এক দিন সিদু কানু ঘরে শুঞে ছিল।
সাদা রঙা ভগবান আইসে দেখা দিল ।।
দশখানা আঙুল ছিল তাঁর প্রতি হাতে।
বিশটি কাগজ টুকরা ধরা ছিল তাতে ।।
এ বার আরও দুটি কণ্ঠ যুক্ত হয়ে গেল। শোনা গেল—
তাহাতে রয়েছে লিখা দেবতার বাণী।
গ্রামে গ্রামে ইহা ক্রমে হ’ল জানাজানি ।।
সিদু বলে শুন সবে ছাড়িও না হাল।
স্বাধীন করিতে হবে জঙ্গল মহাল ।।

মাটি খুঁড়ে কন্দ তোলার মতো কথা তুলছে ওরা। যেন বালি খুঁড়ে জল। হৃদয় জুড়ে বেদনা। ওদের চোখে জল।

যদুর ছেলে গগন পট আঁকতে গিয়ে ভাবে সিদু মাঝি কার মতন হবে? ও কখনও সিদু-কানুর পট দেখেনি। সিদুকে ওর বাবার মতো আঁকে। কাঁধে রামের মতো তীর ধনু। কানুকে আঁকে বিপিন খুড়ার মতো। মহেশ দারোগা যেন বংশী রজক। যে পটুয়াদের জাত তুলে গাল দেয়। আর হুলের যে পতাকাগুলো, তার রং সবুজ। সবুজ পতাকার মিছিলই তো দেখেছে ভোটের আগে। শিবু সোরেনের।

ভোটের পুরনো পতাকা পাওয়া গেল। সবুজ। সাদা কাপড়ও জোগাড় হল। গেরুয়া তো বজরঙবলির কিংবা পদ্ম পার্টির। পাওয়া গেল, পলিথিনের। ওটা সেলাই হবে না। সাদা কাপড় গেরি মাটিতে ছুপে নিল। সেলাই হল হাতে।

এ বার একটি নকল স্বাধীনতা উৎসব হবে। পাঁচশো টাকা পেলে পটোপাড়ায় বুঁদিয়া বিলি হবে, যদু বলেছে। সবাই জড়ো হয়েছে স্বাধীনতা থানে। যদুদের বেশ মনে হয় এটা যেন নতুন কোনও গরাম থান। যেন ঝাণ্ডার গায়ে আশা-আকাঙ্ক্ষার ঢিল বেঁধে দেওয়া যায়। পাথর উজিয়ে ওঠা বি পি এল পতাকাটা যেন আবেগে কাঁপছে। সে কি পটোপাড়ায় বহুদিন পর গান লেখা হল বলে?

সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। পতাকার ছায়া পড়েছে পাথর শানে। ওরা রাস্তার দিকে চোখ উঁচিয়ে বসে আছে। স্বাধীনতাবাবুরা আসছে না। পর্বত চিত্রকর হঠাৎই বলল, পতাকার চখ কই? চখ? চখ ছাড়া পতাকা তো ন্যাতা কানি। অনেকেই সায় দিল। বটে, বটে। মাঝখানে একটা গোল মতো চখ থাকে যে...।

নিয়ে আসা হয় ভুষোকালি আর তুলি। গগন চোখ আঁকবে। গগন কালি তুলে নেয় তুলিতে। মাঝখানে আঁকতে থাকে পতাকার চক্র চোখ। যদু চক্ষুদানের মন্ত্র পড়ে— মেৎ তে ঞেলমে। তিরপিৎ কঃ মে....। চক্ষুদান হও সম্পূর্ণ হও। আমাদের সহায় হও....। এরা অপেক্ষা করছে। ওরা আসেনি এখনও। সন্ধ্যা হবে। হাওয়া বয় শন শন, পতাকা কাঁপে।



লেখক পরিচিতি : 
স্বপ্নময় চক্রবর্তীর জন্ম কোলকাতায় ১৯৫২ সালে।

স্কুল-কলেজে বিজ্ঞানের ছাত্র। পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ.।

দেশলাই-এর সেলসম্যান হিসেবে কর্মজীবন শুরু। নানা জীবিকা বদলে আকাশবাণীর সঙ্গে যুক্ত হন।
সত্তর দশুকের মাঝামাঝি থেকে লেখালেখির শুরু। প্রথম গল্প ' অমৃত' পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও ছোট পত্র-পত্রিকাতেই লিখেছেন বেশি। প্রথম গল্প সংকলন'ভূমিসূত্র। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে। প্রথম উপন্যাস চতুষ্পাঠী প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পূজা সংখ্যা ১৯৯২ সালে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিশিষ্ঠ লেখকরূপে চিহ্নিত হয়েছিলেন।
অবন্তীনগর উপন্যাসের জন্য ২০০৫ সালে পেয়েছেন বঙ্কিম পুরস্কার। এছাড়াও পেয়েছেন মানিক স্মৃতি পুরস্কার, তারাশঙ্কর স্মৃতি পুরস্কার, গল্পমেলা, ভারতব্যাস, ইত্যাদি পুরস্কার।
লেখালেখি ছাড়াও গণবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। স্বপ্নময় চক্রবর্তী এ সময়ের একজন প্রধান লেখক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ