সর্পকাল

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
ধনা মিঞা পরিপূর্ণ মনোযোগসহ আবারও সাপের গল্পেই ঢুকে পড়ে এবং তা চলে দীর্ঘসময়। অবশেষে সে সেজদাতে যাওয়ার মতোই নির্জনতো তৈরি করে। পিয়ন-জমাদার রহমান মিয়া তখনও এক্সইএন, স্যারের চেম্বারের সামনের টুলটাতে বসে গল্প শুনে আর হাতের পিছনে ফুলে উঠা আঁকাবাঁকা রগে ঘষা মারতে মারতে বিড়বিড় করে বলে--রফিক্যে ভাই, ধনা মিঞা কী ক’ তে? রফিক এরই জবাবে ধনা মিঞাকে শুনিয়ে শুনিয়ে অন্তত ১০ গজ দূর থেকে বলে--আরে মিয়া রাহো তুমার জেনারেল স্যারের বালের কিচ্ছা, এক ফিতা কয়বার চালাইবা? তবু ধনা মিঞা মানুষ আর সাপের আজীবনের খাতির-প্রণয়জনিত বাঁকবদলহীন অবয়বই অনবরত তৈরি করে এবং বলে--আরে ছাগলের দল, আপের লগে মাইনষের দুস্তি কি আইজকাইলের? মাইনষের শইল্যের ঘেরাণ ছাড়া জাতিলা আপের চক্ষুও ফুডে না। যেমনে-অই ওক, মাইনষের ঘেরাণ তাইনেরার চাইই। তে অইলে বুঝো, আশরাফুল মকলুকাতের কতো কেরামতি। কিশোরগঞ্জ--৬ আসনের অহিদুল কেবল মাথা ঝাঁকায়, ভাবে এবং একসময় কথাও বলে --কী ক’ রে খানহির পুতে! চেটটার অত তেড়িবেড়ি কিন্তুক ছুডাইয়া লাইয়াম। রফিক মিঞা খানক চুপচাপের ভিতর তার পরবর্তী পরিকল্পনা ব্যক্ত করে এভাবে--এমপি চাচারে দে হালার নামে জনস্বাথ্যের নুটিশ আনুম। বগুড়ার বছিরন আর নোয়াখালির পরিমলও তার কথার কবলে পড়ে এবং মিটিমিটি হাসির প্রবাহে কাজে-কামে মন ঘষে। ধনা মিঞা তবু তীব্র রোদের মতো ফটফট অরর হাসে। একসময় কার্ফু জরির মতো তাদের সরবতা থেঁতলে দিয়ে অফিসটা দেয় আর বলতে থাকে--হালারা বেকতে বুদাই, ইতানে আমর বালডা জানো। তার কথার দাপটে পড়ে অনেকের ভিতর সম্মিলিত নীরবতা ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এবং তা গল্পের সারাটা সময়ই বিরাজ করে। এর সাথে যোগ হয় রায়হান ফেরদৌস স্যারের বন্ধু জাহেদুল সাহেবের গুসুর-ফুসুর আসা-যাওয়া। দুনিয়ার তামাম বান্দা বাদ দিয়ে ধনা মিঞার সাথে তার দুই-চারটা কথা থাকেই। রায়হান ফেরদৌসকেও বিচলিত ভাবনায় পড়তে হয়। বহরমপুর থানার প্রকৌশলী হিসাবে এ-সবের উপর গুরুত্ব দেয়কে ভুলে থাকতে পারেন না তিনি। এ-সব যে রাষ্ট্রীয় হুকুমতনামার অন্তর্ভুক্ত তা জানর জন্য কনফিডেন্সিয়াল ফাইল খোলারও প্রয়োজন নে করেন না। এর ফেভারে আন্তর্জাতিক মানের একটা সেমিনারে অ্যাটেন্ড করতে পারলেই তিনি প্রোজেক্ট কমিটির রিপ্রোজেন্টেশন খুব পছন্দ করেন। সে-সব দেশে একবার যেতে পারলে সাপখোপের এমন কিচ্ছা-কাহিনী আর তার না-শুনলেও চলবে।






ধনা মিঞার সাপবিষয়ক জাগতিক সম্ভাবনাকে জনস্রোতে মিশিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটাও আছে। মাত্র ৪ দিন আগেই চল্লিশা পার হলো আঃ ছাত্তারের বড়োছেলেটার। এ ধরনের দাওয়াতে খুব একটা যান না রায়হান ফেরদৌস। কিন্তু এবার তো তাঁকে যেতেই হলো। হাইয়ার অথোরিটি থেকে কড়া আদেশ--সাপ সংক্রান্ত কোনো বিষয়েই আর অবহেলা করা যাবে না। হরিধন পুরকায়স্থকেও দোনোমোনা করার মিনিমাম স্কোপই দেন না তিনি। ধনা মিঞার সাপবিষয়ক বহুমুখী বিচরণ এখন অনেকেরই শুতে হয়। এই যে আঃ ছাত্তারের ১০ বছরের ছেলেটা হুট করে মরে গেল--সেইটা কেন? মিঞা সাবরা বলেন, এর মারফতি কি? সাপের সাথে বেয়াদবি করার জন্যই তো? কমসে কম ৫০টা বছর এ গল্প হোসেনপুরের মৃধাবাড়ির ধূলাবালির সাথে মিশে থাকবে। এই তল্লাটে মাসের পর মাস যত হাউজফুল সিনেমা চলে; কএর চারআনাই সাপের ছবি। কান নেই প্রাণীটির তবু বিন বাজানোর কী জয়জয়কার! জিব দিয়ে তামাম এরিয়াটা কেমন কন্ট্রোলে নিয়ে ফেলে! এই সিম্বলিক বিষয়সমূহ এরা কিঞিৎ ভেবেও দেখে না।






জেনারেল স্যার কোনো একসময় তার কর্মস্পৃহার সিংহভাগ নিবেদন করেছিলেন সাপ সংক্রান্ত মধুরতা খুঁজে বের করতে। জীবনের সার্বিক মাপজোখ করে ফাইনাল সুরাহা তো ওইভাবেই হতো। তিনি সর্পবিষয়ক একটি জাতীয় মেলার আয়োজনের নিমিত্তে খুবই পেরেশানিতে ছিলেন তখন। আমির-উমরহ, উজির-নাজির, পাইক- পেয়াদা সব একপায়ে খাড়া বাদশা নামদারের ফরমান তামিল করতেন। কত গুণ সাপের -- পা নেই একটাও তবু জলে, স্থলে, বৃক্ষে, অন্তরীক্ষে দিব্যি চষে বেড়ায়। চিন্তাশীল আর বিবেচনাশীল প্রাণী বলেই তো এরা জন্মের পরপরই স্বাবলম্বী। কোথায় নিজের মা-বাপ কিসের কী! তাঁর পেশকৃত ভাবনা এমনই সমৃদ্ধ ছিল যাতে মানবজাতির বাচ্চাকাচ্চারাও জন্মের পরপরই বেবাক কাজকর্ম স্বউদ্যোগেই করতে পারে এবং তাদের স্মৃতিতে যেন বাবা-মার ট্রাডিশনাল আইডিয়াটাই পাল্টে যেতে পারে। সর্পকূল তাদের যদি ভর্য়ে হলো তাহলে ঈশ্বর এ নিয়ে এমন চুপচাপ থাকতে পারতেন? সাপ সাপ নিয়ে যত ষড় যন্ত্র সব ঐ বিধর্মীদের। এ সব থেকে মহা জাতিকে উদ্ধার করা দরকার। কিন্তু ধনা ঞিার সেই জেনারেল স্যারের খুঁতসমূহ এরা খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে বের করার ধান্ধায় থাকত তখন। শালাগোর কথা কী নমুনা -- ৫/৬টা বছর ধরেই তো জেনারেলের চামচারা ঝোপঝাড়, বনজঙ্গল, নদীনালা, পুকুর ডোবা-নালা খুব পয়পরিষ্কার করছে, তা হলে অত সাপখোপ আসে কোত্থেকে? দুপয়সার রেকমান চৌকিদারও মিলিটারি স্যারের মর্দানিশক্তি নিয়ে ইশারায় কথা বলতে চাইত -- স্যারের মাসুম বাচ্চাটা নাকি স্যারের নয়। সবাই জানে পির বাবার খাস রহমতেই শুকনা জমিনে ফল ধরল। বাবার খাস রহমতেতর উপর কথা চলে! এমনকি তার নেতার সাইকেলে চেপে অফিসে যাওয়ার স্মৃতি পুনর্জাগরণ হবে কিনা; এ-সব বিষয়ের প্রতিও একালে তাদের খেয়াল থাকে না। তারপর কেমন হলো? চাপাতি-জহরালী যখন সেকেন্ডের ভিতর ালার চৌকিদারের কোমরটা ভেঙে দিল পর দিনই; কীকরতে পারল ওরা? এখন পর্যন্ত একটা চার্জশিট দিতে পারল? যার আগ্রহ নিয়ে ধনা মিঞা এ-সব গল্পে প্রবেশ অরর তাতে মনে হতে পারে এ তল্লাটে এর চেয়ে বলার মতো আর একটিও গল্প নাই। বিনাখরচে সরকারি চিসিা, চাকরি-বাকরির অবস্থা, লাকসাম থেকে কর্ড-লাইন ঢাকার সাথে যোগ দিবে কিনা কিংব উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যমুনা সেতু দিয়ে গ্যাস যোগাযোগ কবে নাগাদ ুরু হবে -- এ-সব বিষয়াদি তার গল্পের কাছে-কিনারে ঘেঁষথে পারে না। পরিমল, কামরুল আর ড্রইংম্যান রহমানের আজেবাজে পাইকারি ভাবনা-চিন্তা, রাস্তাঘাটের বুঝ-পরামর্শ ধনা মিঞার কোলাহলে থেমে যায়। যখন সে খেয়াল অরর চেম্বারটিতে রায়হান সাহেবের বন্ধু জাহেদুল রহীম শুধু বসেই নেই, তার পরবর্তী কার্যপদ্ধতি আন্দাজ করে মিটমিট করে হাসছেনও। ধনা মিঞার ভাবনামুনা আবারও সমুদয় জীবনপ্রণালীর অংশ হয়ে ওঠে।






আজই পিঠ খোলা অফিসিয়াল জিপটাকে গ্যারেজের একেবারে বাঁ পাশের রুমটাতে রাখতে গিয়েই অবাক হয়ে যান রায়হান ফেরদৌস -- এক্স.এ.এন. স্যারের গাড়িটা এখানে কেন? এমন ভাবনায় বেশিক্ষণ জড়িয়ে রাখতে পারেন না, কারণ এর পরপরই চকলেট কালারের ইটালিয়ান একজোড়া চকচকে শু নামে গাড়িটার পেট খালাস করে। ড্রাইভার কুদ্দুস জিপের দরজাটা বন্ধ করলে হুস করে একপশলা বাতাস ফিনকি দিয়ে বেরয়। এ সকালে রোড্স এন্ড হাইওয়ের জেলা-অফিসে গোঁয়ার- রোদ মেখে গাড়িটা কেন ঝাঁজ বিলায়? স্যারের তো এ সময় ইন্সপেক্শনে আসার প্রশ্নই আসে না। সারাটা দেশ তুমুল রোদে সয়লাব হয়ে গেল, আর এখন তিনি এখনে আসবেন কী করতে? অনবরত ভয় গজায় তার। পাছায় বাঁশ দেয়ার লোকের কি অভাব আছে! কে কোন্দিকে স্যারের কান ভারি করবে কে জানে। শুধু নিজের অফিস খেয়াল রাখলেই তো চলে না। রিপোর্টাররা যে কত অিরর ধান্ধায় থাকে, তা তিনি বুঝেন না? এত বড়ো খামখেয়ালি কেন তিনি করতে যাবেন। ১০টা বছর ধরে একই স্থানে পোস্টিং নিয়ে আছেন কী করতে, এক্স.ই.এন. স্যার বিষয়ক এই সাধারণ আইডিয়াটা তাঁর মাথায় নেই!






আচ্ছা, ধনা মিঞা এ সময়ে যাবে কোথায়? চা খেথে তো বাইরে যাবেই না সে, ৩৫ নম্বর ব্রিজের কন্ট্রাক্টারের মোটর বাইকেও বাইরে যায়নি, তার কোনো গেস্টও আসেনি -- সারাটা জীবন সেন্ট পার্চেন্ট প্ল্যান- প্রোগ্রাম নিয়ে চলা মানুষটি যাবে কোন্দিকে! হেডকোয়াটারের পিয়ন পরিমলকে দিয়েই তা হলে চা-নাস্তা আনাতে হবে? এ-সব পার্সোনাল স্টাফকে আচ্ছামতো টাইট না-দিলে আর চলছে না। কালাম, বছিরণ, রফিক, খইরাতালী এ,নকি ও.এস. কে তো কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ১টা বাজতে তো আরও সোয় এক ঘন্টা বাকি, এত আগেই এরা যাবেই বা কোথায়? ইটস অ্যান ইনসাবোর্ডিনেশন! এদের বিরুদ্ধে কেনো অ্যাকশনে যাওয়র ভাবনা বেজায় ঘুরপাক খায়। কিন্তু ধনা ঞিা যে তালে ঘুরাফেরা শুরু করেছে তাতে এ ভাবনাচিন্তাকেও বাদই দিতে হয়। বহরমপুর থানার ব্রিজ ওয়অশ-আউটের লিস্ট আনার কথটা ওএস. কেও বলতে যাবেন, তখনই এক্সইএন স্যারের গাড়িটার কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। ঝামেলাট তবে কোথায়! প্রথমেই ও.এস. কে এত্তেলা দেন তিনি। কিন্তু লোকটাআবর মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে কেন? ও জানবে না এ-সব? এমনকি ও.এসের চুপচাপের ধরন দেখে তাঁকেও আজ চমকে যেতে হয়। এ ক্সই.এন. স্যারের পাকুন্দিয়ার ব্রিজগুলো ইন্সপেকশনে যাওয়ার কথা তো আর কয়েকদিন পর। তার চেখে সামনে ঝুলানো এনগেইজমেন্ট বোর্ডে গোলাপি চকের দাগ তো এখনো স্পষ্টই। তা হলে? দক্ষিণের জানালার পর্দা সরাতে গেলে র্ফ র্ফ শব্দে তা চেম্বারের দুলে ওঠে। মাথার পিছন দিককার জানালটির পর্দা সরাতে গিয়েই দ্বিতীয়বারের মোত চমকে ওঠেন তিনি। রোদের হিসহিসে তেজে তাঁর চেম্বারের রঙেরই অদলবদল ঘটতে শুরু অররছে। এখানে এখনও জলপাই রং ছড়ানো? অফিসটার নিজস্ব রং ভুলে যাওয়ার আন্ধাচক্করে ঢুকতে গিয়ে রায়হান ফেরদৌস আবারও তাঁর চেয়ারে নিজেকে ছেড়ে দেন। এখন তার চেম্বারে নির্জনতাঘেঁষা যে গম্ভীর্য গজিয়ে উঠছে তা তার পরিচিত নয়। পরিমল একটু আগেই যে খবরটা রেকর্ড সাপ্লায়ার কাশেদের কাছ থেকে শুনে এসেই রায়হাস ফেরদৌসকে জানাল, তাতেই নানা কিসিমের ভাবনা হুড়মুড় করে আসতে থাকে। হেড কোয়াটারের এ.এ.এন. সাহেবকো তিনি তখনই যে ফোনটা করেন, তা-ও ওই অবাক হওয়ারই অংশ। এ কেমন শরীর-কাঁপানো-হিসহিসে শব্দ জমে আছে ফোনের পেটজুড়ে! ফোনে যে আরও নানাবিধ কণ্ঠ পেঁচানো আছে, এরই ভিতর তিনি ডুবে যেতে থাকেন। তাতে তার এমনই বোধ হয়, শুধু তারের ভিতর বিস্তৃত হতে থাকা এ কণ্ঠস্বরসমূহই নয়, রিভভিং চেয়ার থেকে বেরিয়ে আসা হুসহুস শব্দ, সোফাসেট, চেয়ার-টেবিল, এমনকি তাঁর পাজরঘেঁষা দীর্ঘশ্বাস ও কেঁপে-উঠা-ভাবনাইও জলপাই রং বিছানো। মুখ, ঘাড়, গলা থেকে বিনবিন করে ঝরতে থাকা ঘাম মুছতে পরলে তার ক্লান্তির কিছুটা লাঘব হতে পারত। আবারও ধনা মিঞার ভাবনা জেগে ওঠে। ও ঠিক কখন অফিস থেকে বের হয়েছে এ খবরটি না জানলেও, তা যে এক্স.ই.এন. সাহেবের গাড়িটি ভিতরে আসর পরের ঘটনা এ ব্যাপারে পরিমলও নিশ্চিত। কারণ ধনা মিঞা যখন জোব্বা এবং কিস্তিটুপির ভিতর নিজেকে গুছিয়ে দক্ষিণমুখে হাঁটা দেয় তখন তর সঙ্গে যে লোকটি ছিল, সে-ই লোকটিই একটু আগে গাড়িটি থেকে বেরয়!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ