রোশনাই চিহ্নিতকরণ প্রকল্প

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর

ভিড় দেখে, ভিড় ঠেলে, ভিড়ে ডুব সাঁতার দিতে-দিতে মনা মিয়া মেইন- গেইটের এক্কেবারে সিনা বরাবর পৌঁছে। খানিকক্ষণ দাঁড়ায়। তা-ই দেখেন হলুদ-পাগড়িঅলা-মুদি। বাতাস-জব্দ-করার-মতো, গোয়েন্দা-পুলিশের-মতো, মার্চপাস্টের-মতো খবখব করে হাসেন তিনি। তারও পর জনরব পেরিয়ে খানিক ভিতরে যেতেই আটকা পড়ে সে। তাকে যে দলটির সামনে পড়তে হয় তারা গেইটের সার্বিক সৌন্দর্যবৃদ্ধিতে উৎসর্গিত। ওর এক্কেবারে বাঁ কান ঘেঁষে একটা হাসি নেশায় পড়ার মতো ভেসে-ভেসে আসে। নাকে গলায় জিবে একটা ভাপ টের পায়। এটিকে গাঁজার গন্ধ বলেশন্ক্ত করার ফাঁকেই হাসিটি ধীরে ধীরে মিঁইয়ে যেতে থাকে। গাঁজার জ্যান্ত প্রেরণায় একসময় তা হয়ত নিভে আসে। কতিপয় অনিশ্চিত কণ্ঠ তার আশপাশে ঘুরঘুর করে-যা কিছু পারেন খুঁইজা লন, খামাকা সময় লস কইরেন না। দলটির একেবারে পিছনে দাঁড়ানো মানুষটিই কি সৃতির বাপ? পুরাদলটিকে আবারও করতে গিয়ে ভয়ের ভিতর আটকে যায় সে; এতকিছু দেখার-জানার-বলার থাকলেও সৃতির বাপের মতো দেখতে পাওয়া লোকটার ব্যাপারে জানতে চাইলে হলুদ-পাগড়িঅলা-মুরিদ হাঁ-হুতাশের ভিতর তাকে দেখেন এবং তাঁর মোবাইল ফোনে অনবরত ম্যাসেজ পাঠ ক্ষণকালেল জন্য স্থগিত রাখেন। অতঃপর তার একেবারে কাছে এসে গুপ্তচরকে কন্ট্রোল করার মতোই বলতে থাকেন-- ভাইসাহেব কি দুনিয়ারদারীর কোনো খবরই রাখেন না! কোন্ খবরটা তার অজানা এমন একটা ধারণা মনা মিয়ার তৈরি হতে চাইলে হলুদ-পাগড়িঅলা-মুরিদ আবারও বলে যান--তামাম দুনিয়া এখন ম্যাসেজের আন্ডারে আছে, জানেন না? মনা মিয়া তার নিজেরও এক ম্যাসেজ উদ্ধারের তাগিদেই বলে ফেলে --হুজুর, আমি কিন্তু একজনরে খুঁজতেই আইছি। তখনই হলুদ-পাগড়িঅলা-মুরিদ গলা-বুক-নাড়িভুঁড়ি থেকে বদ-ওম খালাস করার মতোই বলতে থাকেন-এটুকুর জন্য অতদূর আসলেন? আরে ভাই, এখন তো মাজারের তামাম ফজিলত সারাদেশেই ছড়াইয়া দিলাম হোঃ হোঃ হোঃ, ভাইসাহেব কিছুই জানেন না! --হুজুর একটু খোলা সা করে বলেন। --আসেন ভাইসাহেব, আমার সাথে আসেন, মিছা-দুনিয়ার ফজিলত দেখেন। মনা মিয়ার সামনে মোবাইল ফোনের ম্যাসেজসমূহ ঝিরঝির আসতে থাকে। হলুদ-পাগড়িঅলা-মুরিদ এবার কলরব নিয়ন্ত্রণে আনার মতোই বতে থাকেন--এই যে ম্যাসেজগুলো দেখলেন, কী বুঝলেন বলেন দেখি। --বুঝলাম, মনে করেন ... তার কথা হলুদ-পাগড়িঅলা মুরিদের দাপটে ক্ষয় হয়ে আসে। হলুদ-পাগড়িঅলা-মুরিদই আবার বলতে থাকেন -- হরতাল বলেন আর বোমা- গ্রেনেড-ডাকাতি- বেশরম মাগীপুন্দানী -ধুম বৃষ্টিপাত কিংবা হুমকি-ধামকিতে তামাম মুল্লুক বন্দি হলেও রূহানি তেজ কি মিশমার হওয়ার কোনো পথ আছে? তারে কে নিভায়? অতঃপর তিনি তামাম মুল্লুকে ছড়াইয়া দেয়া বড়ো হুজুরের ইশারা, রূহানি তেজ বিবৃত করতে থাকেন। মনা মিয়া তবু আশাশই দেখে। ৮/১০ জনের সামনের দলটির সবাইকে ডানে-বায়ে সামনে-পিছনে সরিয়ে একজনকে বের করাটা যে একদম জায়েজই। তা হলে তার মায়ের বা পরিবারের, এমনকি তার নিজের একটা বড়ো চেষ্টা-তদ্বির বিসমিল্লাতেই মিটে যায়। কিন্তু যেভাবে সৃতির বাপরূপী মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে, পাশের অন্য কে পাগড়িঅলার সাথে ঠাট্টা মসকরা শেয়ার করছে, তাতে ওকে পিছন থেকে ঝাপ্টে ধরার বাসনা স্তিমিত হয় মনা মিয়া। আরও দুই চারজনকে ব্যাপারটা বলে দেখা যায়। পুলিশ-টুলিশ কোন দিকে? নাকি তারা শুধু তবারকই খেয়ে বেড়ায়? তার এ-সব ভাবনার ভিতরই আবারও হলুদ-পাগড়িঅলা-মুরিদের গলা শোনা যায়--সামনে চলেন ভাইসাহেব। বাঁ পাশের দুইজন পরের লোকটি মনা মিয়ার মানুষ খোঁজার খায়েশকে ঘাবড়ে দেয়ার জন্যই যেন বলে ওঠেন--নিজেদের পাহাড়া নিজেদের দেয়ার মতন সুখ ইহজনমে আর নাই। এখন সে কি করবে, সৃতির বাপরূপী মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে, বলবে--বহুত কচরামি করছ নডিড় পুত, অহন আমার লগে থানাতে চল; ৩২০ ধারা ঠেলা বুঝিছ। এমন চিন্তাচেতনার ভিতর নিজেকে রাখতে না-রাখতেই শরীরে একটা চিকন--ঘাম টের পায় মনা মিয়া। লোকটাকে খপ্ করে ধরে ফেলবে এমন ভাব- চেতনার ভিতর পুরাদলকে সরিয়ে সৃতির বাপটার দিকে এগুতে থাকলেই মনা মিয়ার কৌশলটি মহিমান্বিত হওয়ার স্কোপ পায়। কিন্তু সেই হলুদ-পাগড়িঅলা-মুরিদের ইশারায় কথা বিনিময় হয় সৃতির বাপরূপ লোকটার! সারাটা শরীরে মনা মিয়া এক খিচ-ধরা--ভাব টের পায়। একপর্যায়ে পৌষ মাইস্যে ঘাম তার শরীর থেকে রক্তের ফোঁটার মতোই ঝরতে থাকে। গেইটের মুখের নীল- পোষাক-পরা নিরাপত্তা রক্ষী দুইনও সরে গিয়ে তাকে আড়ালহীন করলে সে তার নিজস্ব ভ্যাবাচ্যাকা ভাটি লুকাতে পারে না। এ-ভাবেই নিরাপত্তা রক্ষীটি ভিতরের দিকে সরে যেতে থাকে যেন কেউ এখনই তাক করেছে তাদের সবার সম্মিলিত ছবি তোলার জন্য। যে মানুষটি এখন মনা মিয়ার কানে কানে ঘ্যানর ঘ্যানর করছে, তার কাজই যেন কণ্ঠটাকে যত সম্ভব নিচু তালে নিয়ে কথা শেষ করা। অথবা এমনও মনে হতে পারে, মানুষটি আসলে আজন্ম ধীরলয়েরই। তবে সে এও স্মরণ করায়, নএই মাজারের অতীতের রূপটি আর পাওয়অ যাবে না। তার কথা এ-টুকু যে, মনা মিয়া যেন ভুলেও পূবদিকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়টা ভাবনায় না-রাখে। এখন যারা এখানে দাঁড়িয়ে আছে তাদের নেশা এবং পেশাই হলো, মাজারবিষয়ক ভুলে-যাওয়া-সৃতিকে পুনরায় মনে করে। এও যেন দপ্তরবিষয়ক ইশারাই!






আবারও গাঁজার গন্ধ বেদিশা করে তাকে। সামনে দুই-কদম চলতে গিয়েই তার রাগ প্রথমেই নিযুক্ত হয় মা-টার ওপর। ৩/৪টা বছর ধরে কী যে প্যানর-প্যানর শুরু করেছে। কী এক ঘ্যানর-ঘ্যানর--পুতরে মানতটার কতা একটু চিন্তা করিস। আরে ধুর, মানত-মুনত কিচ্ছু না, তার বুঝে-আসে আসলে অন্যাকিছু। এই শহরে এলেই যেন সৃতির বাপটাকে পেয়ে যাবে। কিন্তু সে যে-যে শহর-পাহাড়-বন-জঙ্গল ফেলে এসেছে আবার তা ফেরত পাওয়ার কোনো আলামতই তো নাই মনে হয়। মা তো জানে না যে এই শহরের নিয়মই হচ্ছে কোনো কিছু জানানোর চেয়ে না-জানানোর। আর মা-টাতো ধরে নিয়েছে এই শহর মানে শুধু সৃতির বাপে ঠাসা। কী ঢকের কথা-- দেহিছরে পুত, আল্লার রকমতে ১০ কদমও হাডা লাগদো না, আতের দ্বারোঅই পাইয়া যাইবি তারে। হারামির পয়দাডারে এক্কেবারে লাল দলানে লুহাইয়া দিছ। ১০ কদম তো দূরের কথা এই শহরের ৩০ মাইল দূরে এসেও লোকটার সন্ধান পাওয়া গেল কই! মানুষের এই টসটসে স্রোত ধরে-ধরে কি সামনের শাপলা মতন বড়ো মাজারটায় একবার দেখে আসবে নাকি! ওটাই আসল মাজার? কিন্তু মানুষের ঠেলাঠাক্কা আর রোখা পূর্ণমাত্রাই পশ্চিমদিকের মাজারটার দিকেই। পশ্চিমদিকে হাঁটা শুরুকরলেও তার নজরটা দূর থেকেওপূবদিকেই দিয়ে রাখে। মাজারটার গা কী আচানক শাদাগো! পৌষের শীত শীত কুয়াশাভেজা শাদা প্লাস্টারের পুরোটাই যেন নিজের শরীরটাতে টেনে নিয়েছে।






এত লোক থাকতে হলুদ-পাগড়িঅলা-মুরিদ আবার তাকেই কেবল হাত ধরে টানে। কেন? এরা উত্তর দিকে যাবে মানে! একদম পশ্চিমদিকের ভিতরের সাইডের মাজারটাকে গেলে কী হয়? তাতে হুজুরের এ চেলাটার কী অসুবিধা! সে বলেই চলে--মনে করেন ভাইজান, এই দুনিয়ার সিজিল-উজিল তো আছে, নাকি? উত্তরের অপেক্ষা না-করে বরং ওই অঞ্চলটি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা দেখার দিকেই তার নজর ষোলআনা। তার বর্ণনায় এখন সালু কাপড় দিয়ে ঘেরাও করা যে চোঙার মতো মাজারটি আছে, তারও পিছনে-ভিতরে যে আরও একটা ঘর আছে, ওইটার দিকে। এক্কেবারে আন্ধার-ঘর। দিনের বেলা তো লাইট থাকেই না, রাতের বেলা ২শ পাওয়ারের ইলেকট্রিক বাত্তিও খাটাসের মতো ঝিমায়। সেই ঘরে গাজা-ভাং-হিরোইনই সেবনই শুধু চলে না, কিংবা বাজি ধরে তাস-উস খেলায় হয় না; জিকিরের খেয়াল ধরে-ধরে মেয়েমানুষও হুঁশ-দিশ হারায়। আব্দুল কুদ্দুস নামের ইন-চার্জটির সাহস দেখে তারও টাসকি লাগার মতো অবস্থা হয়। বেটার দেব-ধর্মের ভয় নাই একআনা। শরীর ওর রসের আখড়া-- মেয়েমানুষ তো মেয়েমানুষ, রাইতের আন্ধারে কচি-কচি ছেলেপেলেরে সমানে ফিট করে। মনা মিয়ার কানে কানে এত ধীরে তিনি কথা বলেন যে তা যেন তার মেজাজ আরও চাঙা হয়। মানুষের দুড়মুড় চলাচল, বড়ো হারামজাদা নাকি বড়ো হুজুরের কোন তরফেরর কুটুমই হয়, না হলে কবেই কুত্তা জব্বরকে দিয়ে মাজারের গেইট পার করতাম। এখন তিনি তার হাতটি একেবারে বুকের কাছে ধরে আতরের গন্ধের মতো গন্ধ নেয়ার তদ্বির চালাতে থাকেন।






আঙুলে-কনুইয়ে-গিরায়-পায়ে-পায়ে-মখে-নাকে-কপালে-মাথায় এখনও ওজুর শীতল গুঞ্জন লেগে আছে। তবে এইখানে পৌঁছার পর সেই হলুদ-পাগড়িঅলা-মুরিদের আর খবর নাই। পাঞ্জাবির জেব থেকে রুমাল নিয়ে মুখটুকু মুছে নিলেও ক্লান্তি পুরাপুরি শেষ হয় না তার। কাতারে কাতারে মানুষজন ওজু করে ভিতরে ঢুকে। ওজুর কলরবে পুকুরটি গবগব করে। হঠাৎই নাকের কাছে বাঁ হাতের চেটো চলে আসে, আতরের গন্ধ এখনও জ্যান্ত হয়ে আছে! এই গন্ধ ছাড়িয়ে হঠাৎ কেন যে তিনবাচ্চার মা জাহেরাকেই মনে পড়ে গেল! শুধু মনে পড়ার ভিতর থাকলে তো তার কাঁপাকাঁপিটা শুরু হতো না। বেশরম মেয়েমানুষটা ন্যাংটা হয়ে বিছানায় যাওয়ার ইশারা মারে। এ ভাবযাতনাকে স্বল্পজীবী করতে গিয়ে আরও আউলাজাউলা লাগে তার। তাহলে কি নিজ-কলবই আজও সাফ হয়নি!


হুজুরের ওম-ওম জ্যান্ত পরশে মনা মিয়া আবারও আঁতকে ওঠে। তাঁর হাতের রেখা স্পষ্ট, উষ্ণ আর অত নরম যে, যেন ২৪টা ঘন্টাই তাতে নরম-পালক জড়ানো, যেন একমনে এক নিয়তে তা চলে--জীবন কী আর জীবনগো বাপধন, এ সবই তো নূরেরঅচিন খেলা। আদম-সুরতকে না চিনলে কী আর চলে। হুজুর সারাটি এলাকা ঘুরে দেখারও পরামর্শ দেন। তিনিও জানান মানুষের এই কষ্ট ভবিষ্যতে আর থাকবে না, কারণ প্রতিটি দুয়ারে দুয়ারে এর মাজেজা পৌঁছে যাব। মনা মিয়ার দৃষ্টিতে এখন চৌদিক আসে। মাজারের মাঝখানের মোটা খাম্বাটা কী ঠান্ডা! এত পিছ/রা; আর কী মসৃণ! মরণের পরের জীবনেও এত মাজেজা! মৃত্তিকা, অনল, জল আর পবনের যৌথটান এখানেও টের পায় সে? মোমের হুলস্থুল আলো আর লোবানের ঝিরঝিরে ঘ্রাণে ঝিমুনি ভাব নেমে আসে। একেবারে কানের পর্দা বরাবর মনুষ্যনির্মিত শ্বাসে চমকে ওঠে সে; খেদমতগার বলেন--এই সব কী তুচ্ছ লেনদেনের বিষয় যে ডাইরেক্ট হুজুররে দিতে বলেন? তিনারা এই সব ছাতা-মাতা নিয়ে জিন্দেগি গুজরান করেন! দয়াল মুর্শিদের সাথে যাদের ডাইরেক্ট কানেকশন তারা এই সবে মন দিয়া পারেন? এত এক্সট্টা-টাইম কোথায় তাঁদরে। হুজুর বেয়াদবি একদম বরদ্স্ত করেন না। কিছু কথা থাকলে আমাদের হুজুর আছেন, খলিফা আছেন, তাদের সাথে বলেন। আরে মিয়াসাব এই সব বাদ দিয়া ম্যাসেজ পাঠানোয় মনে দেন। রুহানি তেজে দেশটা সাজানো ফরজ। তিনি যেমন নরম সৌরভ আর আদব- লেহাজে কথা বলতে থাকেন তাতে মনে হতে পারে, তার জীবনের যাবতীয় লেনদেন কণ্ঠ নির্মানেই ব্যয় করে ফেলছেন। কিন্তু মা বা তার বউটা যেভাবে প্যানর প্যানর করে অনেককিছু জানালো ওই-সবের তো এখানে কিছুই নাই। খেদমতগারের পিঠ বরারবর দানবাক্সের ওপর তাঁর ছায়াটা এমন ঘন হয়। তার দেয়া পাঁচশ টাকার জ্যান্ত নোটটা তার চোখের সামনে নজরানার ডালার একেবারে ওপরটাতে জ্বলজ্বল করতে থাকে। এই জায়গাটা থেকে বিদায়ের সময়ে নিজ হাতে দেয়া টাকাগুলো নজরে এলে বিশ্রামজনিত কারণে সারাটা শরীর নুয়ে আসে। আবারও খেদমতগার মনে করিয়ে দিতে থাকেন-- লেনদেন বড়োকিছু না, মনে করেন হাতের ময়লা। আসল কাজ হলো খেদমত করে যাওয়া; কামিয়াব হওয়া কী আর যেই- সেই কথা। গলাটা তার শুকিয়ে ঘ্যাসঘ্যাসে হয়ে আসে। খেদমতগার তার জিবের ভারে শুকনা অংশকে ভিজিয়ে নিতে গিয়ে আবারও কামড়ে ধরে। বেশরম বউটা তার বিছানাকাতর শরীর নিয়ে তাকে কী কাঁপায়! নাদান মেয়েছেলের জ্ঞান-গরিমা এই জনমে আর হবে না।






সুগার মিলের ডেসপাচ ক্লার্কের ৯-৫টা ডিউটি--চিঠি এন্ট্রি, কখনো ড্রাফট করা, অফিসিয়াল নম্বর বসানো, পিয়ন বুক মেইনটেন করা; এ-সব করতেই দু’পয়সার জিন্দেগিটা সাবাড় করে দিল। বাসায় গিয়েও কী এক ফোঁটা স্বস্তি পায়! নিজের তিনটা বাচ্চার ওপর আবার অচল বোনটার ১টা মেয়ে। এ-সব নিয়ে বউটা খোঁটা দিতে কী সময়-অসময় বোঝে! চ্যাৎচ্যাৎ করে আর বলে--তুমার লাগান এমুন মেনি বিলাই আল্লার আলমে আর আছেনি? এই সুগার মিলে চাকরি কইরা কত মানুষ লাল অইয়া গেছে, পাঁচ তালা বিল্ডিং তুলে; তুমি কিডা ছিড়ছো? এই মুহূর্তে তার নীরবতা ধরে টান দেয় আরেক খেদমতগার--জনাব কি এইবারই প্রথম কদম মোবারক রাখলেন এইখানে?--জ্বী।--আসছেন যখন বাবার দরবারে পরকালের কিছু কামাই- রোজগার করে যান। --হুজুর, আপনার পরিচয় মোবারকখান জানতে চাইছিলাম। --ছিঃছিঃ, কেন্ শরমিন্দা বানান, এই অধমদের কি কোনো পরিচয় আছে জনাব? আমরা তো ধরতে গেলে ফকির মিসকিনই। মনা মিয়াকে আবারও ঘাবড়ে যেতে যেতে অবাক হতে হয়। তার মানে কি হতে পারে, তারা একফোঁটাও তুষ্ঠ নয় তার ওপর?-- হুজুর একটু খোলাসা করেন, কী বললেন ঠিক বুঝলাম না। --আরে মরণের ওইপাড়ের কথা বলি আর-কি। --তা হুজুর দান-খয়রাত করতেই চাইছিলাম, আমার একখানা মানতও আছে। আচ্ছা, এইখানে ওরিজিনাল ভিক্ষুক কই। এবার খেদমতগার দুজন শরমে একেবারে বেতাল হয়ে পড়ে--এই ভাবে বলবেন না। এখানে সবাই ফকির। বাবার মাজেজা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আউডিয়া থাকলে এমন বেসাইজ জবান পেশ করতেন না। আমাগো আদব- লেহাজ বাঁচানোর জন্য কিছু দেন। খেদমতগার তার স্বনির্মিত হাসিটা ৫০ টাকার নোটের ওপর ছেড়ে দিয়ে তা-ই দীর্ঘজীবী করতে থাকে। সৃতির বাবাটাকে কি এখানেও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, জিজ্ঞেস করে দেখবে নাকি?






---------------


সানকির বেশুমার ¯তূপ আর ভাত- গোশতের বড়ো বড়ো ডেকচি দেখে মনা মিয়ার ক্ষুধা একেবারে ঠোঁটের কোনায় দাপাদাপি করতে থাকে। ক্ষুধার চেয়েও আচানক কারবার হলো এত বিশাল সাইজের ডেকচি তো বাপের জন্মে সে দেখেনি। খানাপিনা সার্ভ-করনেঅলা একজনকে জিজ্ঞেস করতেই ওপরে আঙুল তুলে ইশারা করলেও বিষয়টা আরও ঝামেলায় ফেলে ফের বলতে থাকে--আরে ভাইসাহেব, আমরা ছোটখাট খেদমতহার, আমরা অত বড়ো মাজেজা কী করে ঠাহর করি বলেন দেখি। সব জানেন দয়াল বাবা। খানাপিনার জন্য বানানো লম্বা এ ঘরটার চার চারটা সারিতে আশেকানে ঠাসা। শ্বাসের উপরে শ্বাসের চাপাচাপিতে তার বমি বমি ভাব হয় আবারও। মুখ-কাটা- ছোট ছোট ড্রাসে ৪/৫ জন সমানে হাত ধোয়াচ্ছে। হাত ধোয়ানো স্টার্ট করার আগেই তো ভাত খাওয়ানোর স্লিপ জোগাড় করা দরকার। ১০ টাকা দিয়ে তাই এনে একটা কোনায় বসে এক বেশুমার ধাক্কা মারে। উরুর ফাঁক দিয়ে ঝিরঝিরে উষ্ণ পচাবাতাস প্রথমেই দুই ঠ্যা!য়ের উপরদিকে যায় এবং তারও পর পরশ দেয় পাজামায়; ধরতে গেলে সারাটা শরীরেই স্যাঁতসেঁতে ঘ্রাণ বিলাতে থাকে। পেট খালি হলে পেটের ক্ষুধাটাও নতুন করে চাগিয়ে ওঠে। গোলআলুর বড়ো দুটি টুকরা আর একটুকরা গরুর গোশতের পুরাটাই পাতলা সুরুয়ার ভিতর পড়ে আছে। মাঝে মাঝে কাঁকড়ের দানাযুক্ত মোটা লালচে ভাত মুখে দেয় সে। মুখের লালায় তা-ই ভিজে আসে। বাইরে আসার মুহূর্তেই খাবারের স্লপ- দেনেঅলা লোকটি তার হাত ধরেই বলতে থাকে--স্যার, পরিবারের মানুষের জন্য একটা স্লিপ ইস্যু করেন, গরম-গরম তবারক বাবাজির দোয়ায় আপনার মোকামেই পৌঁছে যাবে। --কী বলছেন, ২শ মাইল দূর থেকে গরম তবারক কী করে পৌঁছবে। সেই হলুদ-পাগড়িঅলার ঢঙেই লোকটি বলতে থাকে--কী বলেন স্যার! কোন্খানে বাবার বরকত নাই?






আন্দাজহীন- বেরহম বউটা ফের মগজের কোনাখামচিতে উঁকিঝুঁকি মারে। কী যে বেদিশা লাগে! এ-সবকে সমূলে ভ্যানিশ করার মতলবেই একজনকে জিজ্ঞাস করে ফেলে -- আচ্ছা ভাইসাহেব, এইখানে জেনানা আওরাতের কোনো গোর নেই। অত বড়ো রওজা কমপ্লেক্সে জেনানাবিষয়ক বেপর্দা ধাঁচের কথাটায় লোকটি অতিমাত্রায় ক্ষেপে যায় এবং ঝাঁজের ভিতরই স্মরণও করিয়ে দিতে থাকেন যে তিনারাও অনেক বুজুর্গান মনে করবেন, তবে পর্দা না-মানলে তো চলে না, তাই তাদের গোর আলাদা রাখা আছে। সে আবার তার রাগটাকে জুৎমতো মা-টর ওপর নিয়োগ করতে থাকে। কেমন আক্কেল মেয়েমানুষটার, দুনিয়াদারির বেবাক ঠাঁই-ঠিকানা জানার যেন নোটিশ জারি করে তাকে অত দূর পাঠিয়ে বসে আছে! বুদ্ধিসুদ্ধি এই সমস্ত মানুষের জিন্দেগিতেও আর হবে না। তবে এই মুহূর্তে তার এই নিয়ে এক্সটা ভাবনার সময় আছে! তার খেয়াল এখন তাদের ঝিল বাংলা সুগার মিলের কেউ এেল কি না তার দিকেই। একটা হারামজাদাকে যদি তে। বেটারা দেখুক না এ-সব দুনিয়াদারির তেলেসমাতি। খালি কী মিছা বন্দেগিতে লাইফটা বরবাদ করে দিলে চলে। তাঁকে দেখেও কি মানুষগুলো কিছু শিখবে না! এ-দিকে নজর থাকবে কেন, পারে শুধু আ-রাস্তা কুরাস্তাই গু-গোবর কামাতে।






পূর্ব পাশের মাজারে এসে তার রীতিমতো টাসকি লেগে যায়। সুগারমিলের সুপারিটেন্ডেন্ট চাচা যে চিত্রটা তাকে দিয়ে দিয়েছিল এর সাথে তো সামনের মাজারটির কোনো আলামতই মিলছে না। কোথায় গেল সেই মাজার! --তা ভাইসাহেব, সেই মাজারটি কোথায়? বইপত্র বিক্রি করনেঅলা হুজুর মিহিসুরে হাসেন -- সবই ঠিক আছে, আপনেই বদলাইয়া গেছেন, মানুষের ভেল্কিবাজির শেষ নাই। মনু মিয়ার দাঁড়ানোর বিষয়টা দেখেই তিনি বিশ টাকা হাদিয়ার একটা কিতাব বের করেন, যার উপরে খোদাই করার মতো লেখা ‘আজব পুকুরের লীলাকীর্তন’। কিতাবটি তার হাতে দিতে-দিতেই তিনি পুকুরের গল্পে ঢুকেন, যেখানে একটা জনপদ বোমা বা গ্রেনেড, এমনকি মর্টারের শেলের আঘাতে একসময় এলাকাটি একদম আলাদা হয়ে পড়ে। -- ওই যে একটা পুকুর দেকতাচেন, ওইখানেই রোজ- কেয়ামতের আলামতটা ঘটনা। বই-বিক্রেতা অতঃপর মাজারের অন্য অংশ থেকে এটি আলাদা হওয়ার কথা বলেন। এতে গভীর রাতের গায়েবি রোশ্নাইয়ের গল্পও থাকে। এরপর থেকে এই এলাকাটি আলাদা হয়ে একালের উপযুক্ত রূপে তামাম মুল্লুক ক্যাপচার করার গায়েবি আয়োজনে নামে।






-- আচ্ছা তহেলে সেই শাপলাহুজুর কতদিন হলো মারা গেছেন? ঝকঝকে পাজামা-পাঞ্জাবি পড়া মাজার শরীফের বই বিক্রেতাটি এ-কথায় চমকে যেতে-যেতে তাকান এবং পরবর্তীতে আরও চুপ হয়ে যান। জনরোলের ওপর ভর করেই তার কথা শুরু করেন -- ভাই সাহেব, এমন বদগন্ধের ঢকে কতা কয়েন না ত। সুন্দর বাতচিতে তিনারাও খুশী, দয়াল মুর্শিদও খুশী। এইডা কেমুন বেইনসাফী কথা? -- কোনটা মিঞাসাহেব? “ আরে ওই যে কইলেন শাপলাহুজুরের মরনের কথাখান। -- কেন ভাই? -- আবার কয় কেন ভাই! আপনেরা মনে করতাছেন মইরা গেছেন, কিন্তু তিনারা কোনোদিন ইন্তেকাল পর্মান নাই। আপনি আমি পাপী বান্দা, আমরা দেকতাছি সব শেষ, আসলে কিচ্ছু না। এক্কেরে ঠাডা জিন্দা, খালি রূপ বদলায়। শরীরখানই নাই, কিন্তু নূরের রোশ্নাই আলবত আছে। তিনি না থাকলে আপনেরা কেন্ আসেন? আসেন কেন!






কিন্তু তিনি তো দুনিয়াতে নাই ঠিক ত? -- ভুল কথা, কোথায় যাইবাইন তাইনে, এই মোকাম কার হেফাজতে রাখবেন তাইনে? -- মানুষ যে বলে ১৬/১৭ বছর আগেই না কি তিনি মইরা গেছেন -- বেকুব আদম এই সব বোঝে কোন ইশারায়? তা অইলে শোনেন বিত্তান্ত। আরে হুজুরের শেষ বিদায়ের সময় আমিই ত থাকতাম তাইনে সঙ্গে ছায়ার মতন। এই যে, অত বড়ো মাজার, অত মানুষের সমাগম; সব ত আমার হাত দিয়অই অইতো। চারপাশের মগ্ন-জটলাটাকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে ফের কথা শুরু করেন -- সেই ইংরেজি নাইনটিন এইট্টি এইটের কথা, বেশিদিন আগের কথা ত না; ওই যে আমানতখানা দেখতাছেন, এরও ধরেন ৫০ হাত দূরে আছিলো হুজুরের অ্যাকচুয়েল বৈঠকখানা। তা হুজুর আমারে কইলেন ...






গলা তার ভিজে আসে। চোখের চিকন রগসমূহ নোনতা ঝাঁজে তিরতির করে কাঁপে -- এইরে পাগলা, দরজাখান দিয়া দে; কএক্কেবারে কমপ্লিট তালা মাইরা রাখ। আমি ঘুমামু। কোনো গ্যাপ না- দিয়েই তিনি আবার জাদুময়তা ছড়িয়ে দেয়ার মতোই বলেন -- কী মিঞাছাবরা বুঝলেন কিছু!


জটলার নীরবতা বাড়ে। এ-সব বোঝার ক্ষমতা তাদের কোত্থেকে হয়; এমন ভাবনার ভিতর সবাইকে ডুবিয়ে রেখে তিনি মিটমিট করে হাসেন -- বুঝলে না? বুঝবেন কেমনে। আমার পরানডায় কিন্তু সেই সময়তেই বেতাল একখান কামুড় দিছিলো। এরপর হুজুর গেলেন রাঙামাটি শহরেরও দুই মাইল উত্তরে, পাহাড়ের ভিতর সাইডে দিলেন আখেরী জলসা। যেই সেই জলসা! সেইখানেই তিনি বলা শুরু করলেন, আমি রেস্ট নিবো। শহরের সিথানে পৌঁছতেই স্টার্ট দিলো বুকে গায়েবি-ব্যথা। কী যে ব্যথা, একেবারে কাহিল অবস্থা। ভর্তি করাইলাম পোর্টের দিকের এক্কেবারে বড়ো হাসপাতালের বড়ো কেবিনটাতে। ডাক্তারবেডাদের দৌড়াদৌড়ি যদি দেখতাইনগো ভায়েরা। এ্যাই সেলাইন, হোই ইঞ্জিকশান, ঐ অক্সিজেন; কী যে তিলিলসমতি কারবার। বাবার চোখতো বন্ধ। বেকুব ডাক্তাররা মনে করছে সব শেষ। দয়াল মুশ্যিদের কী লীলা; বাবা ঠাস করে চোখ মেইল্যে চাইন। আবার ডাক্তাররা দৌড় লাগায়। আবারও বাবা চুপ। কতোক্ষণ পর বাবায় মিটমিডাইয়া হাসুইন। সব ডাক্তাররা পড়লো বাবার পায়ে -- বাবা আমাদের কী ভুল দেখলেন, মাফ করেন বাবা। কথা কী আর বলবেন বাবা; খালি গলা ছাইড়ে হাসেন। এর বাদে বাবা বৈকালবেলা তিনার বড়োপোলারে নিয়া বাইর অইলেন টাউন দেখতে। ঘুরেন আর ঘুরেন। আগ্রাবাদ, হালিশহর, হাজীক্যাম্প, পাহাড়তলী, ওয়ারলেস কলোনি, ওয়ার সেমিট্রি, নিউ মার্কেটম লালদীঘিরপাড়, পাঁচলাইশ, ষোলশহর সবখানে ঘুরলেও বাবার মনে একরতি শান্তি নাই। এই মাটির দুনিয়া তিনার আর ভালো লাগে না। নুরীজাতে শুভমিলনের নেশায় দয়ালপাক টানেন। আবার যা তিনি হাসপাতালে। সবাইকে ক’ন চোখ বন্ধ করতে। বাবা সবাইরে কলে-কয়ে এক্কেবারে গেলেন। এর বাদে আমরা তিনারে এইখানে শোয়াইয়া দেই। যত মাজার দেখেন বাবার ওপরে একটাও নাই। তিন কোটি না কত যেন খরচ পড়ছে এইহানেই। কী মনে করেন।






কিন্তু ভাই, উত্তরের ঐ মাজার শরীফের একজন যে কইলো তাদেরটাই না কি নাম্বার ওয়ান।


তিনি তখন গায়েবি তালে মুখের হাসি যেন কন্ট্রোলই করতে পারছেন না। দিল-খোলাসা করে বলতে থাকেন--আরে মিয়ারা, নফসের পয়দা নিজের ছাওয়াল বড়ো না হি ভাইচতা বড়ো? মাথা না গর্দান বড়ো? তা অইলে হুনেন আমাগো হুজুরের কেরামতি। একদিন হুজুর বাদ-মাগরেব তিনার ভক্ত-আশেকানরারে কল করলাআইন। তিনি তাইনেরারে নিয়ত কইরা কইলেন, তোমরা কে কে আমার জোগানদার হইয়া বেহেশতে যাবার যাও? যারা যেতে যাও, আমার ডানহাত ধর। সবাই ডানহাত ধরল। তাইনেঅই আরেকবার কইলেন, তোমরা কে কে আমার সঙ্গে দোজখে যেতে যাও, বামহাত ধর। কি কারবার দেহেন। কেউ ধরে না। খালি একজন হুজুরের বাম আত চাইপ্যা ধরলো। ভক্ত আশেকানরা খালি হাসে, বেকুব ঝাড়–দার কী বুদ্ধি লইয়া জিন্দেগি তামাদি করলো। কিন্তু সেই ঝাড়–অলা কী কইলো জানেন, হুজুররে আই এগলা গরিয়ারে দুজকত যাইত্ ন-দিঁয়ুম। কী বুঝলেন। খোঁজ নিয়া দেহেন হেই ঝাড়–অলা এখন কত বড়ো আউলিয়া, কত তার মুরিদান!


হুজুর নিজের পরিচয়টা যদি দিতেন। দরবার আছে আপনার?


আমার কী পরিচয়, সব তো বাবার।


না, তবু ধরেন কিছু একটা আছে কিনা?


আহারে, আবার প্যাঁচাল, আসলে ভাইজান আপনে বড়ো প্যাঁচাইল্যে মানুষগো।


ভুল অইলে মাফ কইরে দিয়েন, আচ্ছা ভাইসাব দেশ- গেরামে যান না?


কই আর ইস্কোপ পাইলামরে ভাই। কত জায়গার থাইক্যা ভক্ত-পাগল আসে। তাগোরে সেবা করতে করতেই জিন্দেগী পার কইরা দিলাম। দেখি বাবাই কি দেইন। বাবার ওর্ডার পাইলে যায়-টায় আর কি। -- দেশ মুরিদান আছে হুজুর?


এবার হুজুর হাসির ভিতর তার কথাগুলোকে গুঁজে দেন -- আপনাগো ময়মুরুব্বির দোয়ায় আছে, নিজের দ্যাশ কিশুরগঞ্জেই মুরদানদের চাপটা একটু বেশি।






আবার সামনে এগোয় মনা মিয়া। ওরসে মানুষের আন্ধাগুন্ধা চলাচলতি, জয়সুরি বাদ্য-বাজনা, গরু-মইষের গোবর- পেশাবের গন্ধে আবারও বমি বমি লাগে। মইষে সয়লাব হয়ে আছে মাজার এলাকা। মাজারের পড়া-ঠান্ডাপানি খেলে ভিতরটা ভেজা- ভেজা লাগে। মানুষের ভিড়সহ আবারও সামনে এগোতে থাকে। তাকে এভাবেই চমকে উঠতে হবে তা হিসেবের মধ্যে আনতে পারেনি। সৃতির বাবাটা মাজারটার একেবারে বুক বরাবর একটা জটলা নিয়ে বসে আছে! এই লোকটার সন্ধানের জন্য চেষ্টাটা কি কম করেছিল ওরা! মানুষের কথার কোনো শেষ নাই, কেউ বলে দেশেই নাই মানুষটা, কেউ বলে মাগীর দালালি করে -- সমানে পাকিস্তান, ইন্ডিয়া, হংকং কিংবা ব্যাংককে যুবতী মেয়েছেলে পাচার করে। আরেক জন রাজস্বাক্ষীর মতোই রায় দিতে থাকে, আদম-ব্যবসা করে লাল হয়ে গেছে; চট্টগ্রাম শহরে পাঁচতলা বিল্ডিং করে ২৪টা ঘন্টা মাইয়াছেলে নিয়া ফূর্তি ফার্তি করে। কিন্তু সেই মানুষটা মানে সৃতির বাপটা মাজারের বুক বরাবর জলসায় বসে কী বলে?! এত সাহস। তার বোনটাকে মেরে ফেলার কোনো চিন-পরিচয় কি পাওয়া যাবে না? নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। রক্তময়-গন্ধ নাকে এসে লাগে!






মনা মিয়া কখন যে মাজারের একেবারে উপরের সিঁড়িতে পৌঁছে গেছে তা নিজেই খেয়াল রাখতে পারছে না। বুকটার দুপদুপের ভিতর কাঁপতে কাঁপতে একটা ভলান্টিয়ারবেক বলে সৃতির বাপটাকে ডাকতে। হঠাৎই মাজারের বুকে গোল হয়ে বসা লোকগুলোর যেন ধ্যান ভাঙে, একসাথে হৈরৈ করে এদিকে মানে ওর দিকে তাকায়। জেলখানার পাগলা-ঘন্টির মতো ঢংঢং চিৎকার তৈরি হয়। মেইন- গেইটের সেই শনাক্ত -করা-মানুষটিই ৭/৮ জনকে সরিয়ে সামনে আসতে থাকলে মনে হবে মজলিসটি যেন রেডি হয়েই ছিল কখন তাকে পথ করে দিতে হবে। ম্যাসেজ জ্বলে উঠে কুরুর-কুরুর করে। তার দিকে আসতে আসতে চিৎকার করে লোক জড়ো করার মতো হুকুমনামা জারি করে -- ওই ত, ধশ্শালারে, জুতা পায়ে দিয়া বাবার বুকে পা রাখে! শালারে ধর। মনা মিয়ার বকে দ্রুমদ্রুম হাঁ-হুতাশ বাজে। সেও জোরে চিৎকার দেয় -- কী কইলিরে খুনীর বাচ্চা ... বাক্যটি অপূর্ণই থাকে; সব কেড়ে নেয়ার মতো ধ্বনি তৈরি হয়। মাজারের লোকগুলোর কলধ্বনিতে তার চিৎকার থেঁৎলে যায়। রড, লাঠি, বাঁশের টুকরার আঘাতে রক্তের স্রোতে বাড়েই; তার পাম্পসুও ভিজে ঝুপঝুপে হয়ে আসে। শরীর জ্যান্ত রক্তে ভিজতে থাকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ