
ছোটগল্পের বিষয় কী হবে____ এ নিয়ে তর্ক উঠতে পারে, সে তর্ক মীমাংসাহীনও হতে পারে। তবে তর্ক তোলার আগে লেখক-মানস ও তার সামাজিক পটভূমিও মনে রাখতে হবে। না হলে গল্পের রস উপলব্ধির ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে; ভুল ধারণা জন্মবে লেখকের প্রতিও। গল্পের বিষয়-আশয় থেকে শুরু করে আঙ্গিক____ প্রতিটা বিষয়ে গল্পকারকে থাকতে হয় সচেতন। বাংলাদেশের ছোটগল্প প্রসঙ্গে বলতে গেলে উপর্যুক্ত বিষয়গুলো আগে বিবেচনায় নিতে হয়। সে সঙ্গে এও মনে রাখতে হয়, গল্পের সঙ্গে সামাজিক বাস্তবতার সম্পর্ক কতটা নিবিড়।
গল্পের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক কেমন হবে, তা নির্ভর করে লেখকের অভিজ্ঞতা এবং মানসপ্রকৃতির ওপর। লেখক কেবল কল্পনার ওপর নির্ভর করে গল্প বলেন না, সমাজ থেকে আহরিত অভিজ্ঞতার সঙ্গে চিন্তা ও কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে গল্পের কাঠামো ও বিষয় ঠিক করেন। নিজের সমাজ ও যাপিত জীবনকে সম্পূর্ণরূপে উপো করে কাল্পনিক গাথা রচনা করা সৎ লেখকের পে সম্ভব নয়; উচিতও নয়। কারণ____ ‘ছোটগল্প ও উপন্যাস অর্থাৎ কথাশিল্প সব সময় প্রত্যভাবে জীবন-নির্ভর, তা কোনো আকাশকুসুম বা অবৃন্তক ফুল নয়, বিশেষ দেশ-কালের সঙ্গে তার সম্বন্ধ থাকেই, এমনকি প্রতীক-প্রতিমা-প্রধান গল্প-উপন্যাসেও যাকে এড়ানো অসম্ভব।’ (আবদুল মান্নান সৈয়দ : ভূমিকা, বাংলাদেশের নির্বাচিত ছোটগল্প, তৃতীয় খণ্ড, বিশ্বাসাহিত্য কেন্দ্র, জুলাই ১৯৮৯)। যেকোনো শিল্পীর নিজের অঞ্চলেই সিদ্ধি। অন্যত্র কেবল কল্পনা ও অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হয় তাকে। ফলে লেখককে সৎ থাকতে গেলে, যথাযথ জীবনচিত্র আঁকতে গেলে প্রত্য অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণার অধিকারী হতে হয়। লেখকের সামাজিক দায় রয়েছে। সে দায় থেকে যারা লেখেন তাদের গল্পে সমাজের ছাপ থাকে নিশ্চিত। মনে রাখা ভালো____ছোটগল্প কেবল লেখকের কল্পনা-প্রসূত কাহিনির ঘনঘটা নয়।
ভিন্ন ধরনের গল্পও রয়েছে। সেসব গল্পে মনভোলানো কথার ফুলঝুরি ছাড়াও নতুন চিন্তার বীজও লুকিয়ে থাকে। ফলে এ ধরনের গল্প পাঠ শেষে পাঠকের চিন্তার ভরকেন্দ্রে আমূল পরিবর্তনের ঢেউ জাগে। কোনো কোনো ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্কের জটখোলার চেষ্টা পাঠকের থাকে। সময়ে ব্যবধানে একই গল্পের তখন ভিন্ন ভিন্ন পাঠ ও ব্যাখ্যাও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ফলে এসব গল্পে কাহিনির চেয়ে, কাহিনির সূত্র, চরিত্রের আচরণের চেয়ে অবদমন প্রধান ভূমিকা পালন করে। গল্পকার যখন কোনো গল্পের বিষয়কে চরিত্রের আচরণ ও মনস্তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলেন, তখন পাঠক স্বাধীনভাবে চরিত্র নির্বাচনের সুযোগ পান। ব্যাপারটা অনেকটা চিত্রকলার মতোই। ছবি যেমন নিজে কথা বলে না, দর্শককে দিয়ে বলিয়ে নেয়, তেমনি এসব গল্পের চরিত্রগুলো নিজে কথা না বললেও পাঠক সে সব চরিত্রের ভেতর নিজেকে খুঁজে পায়। এ ধরনের গল্পে পাঠকের অনুধ্যান আর চরিত্রের নৈপুণ্য ঐকান্তিক হয়ে ওঠে। গল্পের ভেতর বুদ্ধির মুক্তি ঘটে। লেখকের স্বভাবই তার সৃষ্ট চরিত্রের আচরণে প্রকাশ পায়। সঙ্গত কারণে লেখক চরিত্র সৃষ্টির সময় কোনো একটি বিশেষ চরিত্রের প্রতি পক্ষপাত দেখান না।
বাংলাদেশের কৃষি-ব্যবস্থা অনেকটাই প্রকৃতির খামখেয়ালীপনার ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃতির লীলার কাছে আত্ম-সমর্পিত জনপদে বিশ্বাসের খুঁটিটা খুবই ভঙ্গুর ও ক্রমবিবর্তনশীল। যে মানুষ নিজের হঠাৎ সাফল্যে বৈজ্ঞানিক যুক্তিকে বড় করে দেখানোর সুযোগ হাত ছাড়া করতে চান না; সে মানুষই প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে গোপনে ও প্রকাশ্যে অলৌকিকতায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং সর্বশক্তিমানের কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ফলে এখানকার মানুষের বিশ্বাসের ভূ-মণ্ডলকে আচ্ছন্ন করে রাখে অনেকটা দ্বান্দ্বিক পরিবেশ ও প্রকৃতির নানা রঙ্গলীলা। আমাদের প্রগতিশীল সাহিত্যিক মাত্রই বিজ্ঞানমনস্ক বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন, কিন্তু গোপনে লালন করেন অসংখ্য কুসংস্কার ও অপবিশ্বাসের নানারূপ। সে বিষয়টি গল্পে অনুল্লিখিত থাকে বলেই গল্প বিশ্বস্ততার পথে অগ্রসর হতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের গল্পের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়____ মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের গল্পপাঠের সময় কিছু বৈশিষ্ট্য ল করা যায়। বৈশিষ্ট্যগুলো হলো____
১. মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা এবং যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ
২. বিভিন্ন স্তরের জনগোষ্ঠীর জীবন-যাপনের চিত্র আঁকার চেষ্টা
৩. বিদেশি গল্পের অনুকরণ
৪. নিছক কাহিনি বর্ণনার মাধ্যমে একরৈখিক গল্প বলার চেষ্টা
৫. জটিল ডিটেইলের বর্ণনায় আচ্ছন্ন থাকা
৬. ব্যক্তির বহিরাঙ্গের চেয়ে অন্তর্জগত চিত্রায়নের চেষ্টা
৭. সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থাপন
৮. ধর্মীয় বিষয়ে উদাসীনতা এবং যৌনতার প্রশ্নে দ্বিধাহীন
৯. দেশপ্রেম ও আন্তর্জাতিকতাবোধ
১০. বিজ্ঞানমনস্কতা
১১. জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যপ্রীতি
১২. বিষয় নির্বাচনে মধ্যবিত্ত ও নিুবিত্তের প্রাধান্য
১৩. সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের জীবন-যাপন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর যাদের গল্পে কমবেশি রয়েছে, তারা হলেন, আতা সরকার, আবু সাইদ জুবেরী, আলমগীর রেজা চৌধুরী, আহমদ বশীর, ইমদাদুল হক মিলন, ইসহাক খান, জাফর তালুকদার, তাপস মজুমদার, বারেক আবদুল্লাহ, বুলবুল চৌধুরী, ভাস্কর চৌধুরী, মঈনুল আহসান সাবের, মঞ্জু সরকার, মনিরা কায়েস, মুস্তাফা পান্না, রেজোয়ান সিদ্দিকি, সৈয়দ ইকবাল, শাহরিয়ার কবীর, শেখর ইমতিয়াজ, সুশান্ত মজুমদার, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, হরিপদ দত্ত, হুমায়ূন আহমেদ, আশোক কর, ইমতিয়ার শামিম, ওয়াসী আহমেদ, ওয়াহিদ রেজা, কাজল শাহনেওয়াজ, জাহিদুর রহিম, ঝর্ণা রহমান, তপন বড়ুযা, তারেক শাহরিযার, দেবাশিষ ভট্টাচার্য, নাসরিন জাহান, পারভেজ হোসেন, প্রলয় দেব, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, মহীবুল আজিজ, মাখরাজ খান, মামুন হুসাইন, মুসা কামাল মিহির, শহীদুল আলম, শহীদুল জহির, সামসুল কবির, সঞ্জীব চৌধুরী, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, সেলিম মোরশেদ, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ, হামিদ কায়সার, হুমায়ুন মালিক, ইমতিয়ার শামীম, হামিদ কায়সার, হুমায়ুন মালিক। আন্দালিব রাশদী, আবদুল আউয়াল চৌধুরী, আহমাদ কামরুল মীজান, ইশতিয়াক আলম, জাহিদ নেওয়াজ, মনীষ রায়, মনি হায়দার, মাহবুব রেজা, মোস্তফা হোসেইন, মুজতাহিদ ফারুকী, রাশেদ উন নবী, শরীফ খান, শহীদ খান, শাহ নিসতার জাহান, স্বপ্না রেজা, সারওয়ার-উল-ইসলাম, সিরাজুল ইমলাম মুনির, হাসান জাহিদ, নাজিব ওয়াদুদ, নাসিমা সুলতানা, রফিকুর রশিদ, অদিতি ফাল্গুনী, আকমল হোসেন নিপু, আকিমুন রহমান, আদিত্য কবির, আনোয়ার শাহাদাত, আবু জাফর রাজীব, আহমাদ মোস্তফা কামাল, আহসান ইকবাল, কামরুল হুদা পথিক, খোকন কায়সার, চঞ্চল আশরাফ, জহির হাসান, জাকির তালুকদার, জামশেদ বাবুন্টু, জিয়া হাশান, জিয়াউদ্দিন শিহাব, নজরুল কবীর, নাসিমা সেলিম, নাফিজ আশরাফ, পাপড়ি রহমান, প্রশান্ত মৃধা, ফয়জুল ইসলাম, ব্রাত্য রাইসু, মশিউল আলম, মামুন সিদ্দিকি, মাসুদুল হক, মাসুমুল আলম, মাহবুব মোর্শেদ, মোহাম্মদ হোসেন, মির্জা তাহের জামিল, শামীম কবীর, শাহাদুজ্জামান, শাহীন আখতার, শাহনাজ মুন্নী, শহিদুল ইসলাম, শিবব্রত বর্মন, শিমুল মাহমুদ, সরকার আশরাফ, সরকার মাসুদ, সাদ কামালী, সালাম সালেহউদ্দিন, সুমন লাহিড়ী, সেলিম মোজাহার, ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ, রনি আহম্মেদ, রবিউল করিম, রাজা সহিদুল আসলাম, রোকন রহমান, রাজীব নূর, রাখাল রাহা, রায়হান রাইন প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের পরপরই যারা গল্প লেখা শুরু করেছেন, তাদের লেখার এক বিপুল অংশ____মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের পরে এ ধরনের গল্পের প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল জাতিকে, পাঠককে জাগিয়ে তোলার, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং দাসত্ব থেকে মুক্তির চেতনায় উজ্জীবিত করার ইতিহাস জানানোর। সে দায় থেকে লেখকেরা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছোটগল্প লিখেছেন। কিন্তু তারও একটা সীমা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির জন্য বিপুল গৌরবের বিষয়। সে গৌরবজনক অধ্যায়কে সারাণ মস্তিষ্কের কোষে কোষে সঞ্চরণশীল রাখলে মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা বা মাহাত্ম্য বিন্দু মাত্র বাড়ে না। বরং দুর্বল গাঁথুনির গল্প কিংবা রগড় কাহিনি সর্বস্ব গল্পে পর্যবসিত হলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও চেতনাকে অসম্মান করা হয়। এর কারণ____একাত্তরের কথা লিখতেই হবে, নইলে আমার মান থাকবে না লেখক হিসেবে____এরচেয়ে আত্মঘাতী কথা আর কিছু হতে পারে একজন সৃষ্টিশীল লেখকের পক্ষে’ (গল্পের বিষয় হিসেবে একাত্তর : সৈয়দ শামসুল হক)। একাত্তর বা একাত্তর পরবর্তীকালের বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে একাত্তর বিষয়ক লিখিত গল্পের সংখ্যা কম নয়। অগ্রজ লেখকদের পাশাপাশি ওই সময়ে আবির্ভূত লেখকেরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন। এর মধ্যে হূমায়ূন আহমেদের ‘উনিশ শ একাত্তর’, মঞ্জু সরকারের ‘শরণার্থী ও বেহাল নৌকা’, ‘অপারেশন জয়বাংলা’, ‘রাজাকারের ভূত’, ‘মশিউল আলমের ‘অযোদ্ধা’, ‘শিহাব সরকারের ‘কুয়াশার কাল’, মঈনুল আহসান সাবেরের ‘কবেজ লেঠেল’ ও ‘রেল স্টেশনে শোনা গল্প’, নাজিব ওয়াদুদের ‘ মেঘভাঙা রোদ’, মনিরা কায়েসের ‘জলডুবি গাঁও’ উল্লেখযোগ্য।
গ্রামীণ জীবন চিত্রায়নের েেত্র আতা সরকার, আবু সাইদ জুবেরী, আলমগীর রেজা চৌধুরী, সুশান্ত মজুমদার, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, হরিপদ দত্ত, হুমায়ূন আহমেদ, আশোক কর, ইমতিয়ার শামিম, মহীবুল আজিজ, হুমায়ুন মালিক, ইমতিয়ার শামীম, হামিদ কায়সার, আন্দালিব রাশদী, নাজিব ওয়াদুদ, নাসিমা সুলতানা, রফিকুর রশিদ, আকমল হোসেন নিপু, আকিমুন রহমান, আহমাদ মোস্তফা কামাল, আহসান ইকবাল, খোকন কায়সার, পাপড়ি রহমান, প্রশান্ত মৃধা, মশিউল আলম, শাহনাজ মুন্নী, শহিদুল ইসলাম, শিমুল মাহমুদ, সাদ কামালী, সালাম সালেহউদ্দিন প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। তাদের গল্পে গ্রামীণ জীবন অবিকৃত ও অবিকলভাবে চিত্রায়িত। সেখানে বাহুল্য নেই। গ্রামীন জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতসহ নিম্নবর্গের মানুষের আনন্দবেদনার দিনলিপি তাদের গল্প। এই লেখকেরা বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলার প্রতি অনীহ। কেউ কেউ গল্প বলার প্রথাসিদ্ধ রীতি এড়িয়ে চলারও চেষ্টা করেছেন। প্রথাগত রীতিকে মান্য করে ব্যক্তিবিশেষের মনোবিকার ও বিকৃত যৌনবিকারের চিত্র এঁকে গল্পকে সীমিত পাঠকের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন দু-একজন। গ্রামীণ জনপদের আর্থিক নিরালম্ব শিতি যুবকের জৈবিক ক্ষুধা মেটানোর জন্য শিশু ছাত্রীকে ধর্ষণের কৌশলের চিত্র আঁকেন মহীবুল আজিজ ‘মাছের মা’ গল্পে। এ গল্পে লেখক দরিদ্র বেকার যুবকের যৌন ক্ষুধা মেটানোর কৌশলকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। শিশু ছাত্রীকে ধর্ষণের জন্য মানসিকভাবে বিভ্রান্ত করে সাঁতার শেখার জন্য প্রস্তুত করে গৃহশিক। সাঁতার শিখতে গেলে মাছের ঘাত-প্রতিঘাত পাওয়ার মতো অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে____এই বিশ্বাস চারিয়ে দেয় ছাত্রীর মনে। ফলে জলের নিচে শিকের কলাকৌশলকে শিশুছাত্রীর মনে মাছের কর্মকাণ্ড হিসেবে ছায়াপাত করে।
নাজিব ওয়াদুদের গল্পের নাম ‘কাক ও কারফিউ’, ‘নষ্টকাল অথবা হৃদয়ের অসুখ’। নামকরণেই স্পষ্ট তিনি সমকালীন সমাজব্যবস্থা দেখে শংকিত ও সমাজ পরিবর্তনে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তার গল্পে সংলাপ যেমন বিশ্বস্ততার বহন করে, তেমনি পটভূমিও বাস্তবতাকে প্রমাণ করে। তার চরিত্র নির্মাণে কোন কৃত্রিমতা নেই। সাধারণ চিরাচরিত চরিত্রগুলোই তার গল্পে কথা বলে। তার ‘আবাদ’ গল্পটি বাংলাসাহিত্যের জীবনঘনিষ্ট যে কোন শ্রেষ্ঠ গল্পের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। এগল্পে লেখক দেখিয়েছেন কী করে নানামতের মানুষের মধ্যেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হয়। আবার অজান্তেই সে সম্পর্কের সূত্রধরে সমকালের বিবদমান পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। এখানে ফসলী জমি ও নারীকে একই অর্থে বিবেচনা করা হয়েছে। নারী ও জমি প্রকৃতির নিয়মেই সৃজনশীল অনুষঙ্গ এসত্য নাজিব ওয়াদুদ প্রতীকী অর্থেই পাঠককে বোঝাতে চেয়েছেন। রফিকুর রশিদও গ্রামীন জীবনের বিবদমান পরিস্থিতিকে গল্পের বিষয় করে তুলতে জানেন। তার গল্পে কিছু অসঙ্গতি বাদ দিলে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কথা বলে কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে চাকরীজীবী পর্যন্ত তার গল্পে কথা বলে। মনিরা কায়েসের মতো তিনিও সাধারণ পাঠকের গল্পকার নন। অথচ এসময়ের গল্পকার জীবন পাঠ না করে গ্রামীণ কি শহুরে জীবনের যে বানানো গল্প পাঠককে শোনাতে চান, তাতে পাঠক তাতে রূপকথার কল্প শোনার মতই মুগ্ধ হয় সত্য, মোহ কেটে গেলে নিজেরাই চমকে ওঠে, গল্পের আজগুবি বয়ান পুনঃস্মরণ করে।
আধুনিক যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য ধর্ম____ গতি। গতির ছায়া চিত্রকলা, সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রের অঙ্গনেও লেগেছে। গল্পের সঙ্গে চিত্রকলার সম্পর্ক অনেকটাই দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব-মধুর সম্পর্ক। চিত্রকলার রেখা ও রঙের প্রয়োগের মতোই ছোটগল্পে জীবনের নানাদিক লেখক অংকন করেন। কবি ও চিত্রকরকে ভোগবাদী সমাজে সমাজ-বিচ্ছিন্ন-উন্নাসিক, বাউল ভাবলেও গল্পকারের ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটে না। কবি ও চিত্রকর সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। সাধারণ মানুষ কবি ও চিত্রকরের সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করেন, সেখানে তারা যতটা সংবেদনশীল, ঠিক ততটা বৈদগ্ধ্যের অধিকারী নন। কিন্তু গল্পকারের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা পোষণ করেন। কারণ গল্পকার সমাজ ও সমাজের রুচি পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে তার গল্প রচনায় ব্যাপ্ত হন। গল্পকার মানব জাতির প্রাত্যহিক জীবনের নানা তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা পরম্পরাকে অস্বীকার না করে, মানবেতর জীবন-যাপন থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতার মিথস্ক্রিয়ায় সমাজ পরিবর্তনের জন্য ঈঙ্গিতপূর্ণ সাহিত্য রচনা করেন। সে সৃষ্টিকর্ম আপামর জনতাকে আলোড়িত করে না; দু’একজনকে আন্দোলিত করে মাত্র। সে দু’একজনই সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে ব্রতী হন____ শিল্পের অন্তঃশীল প্রেরণায়। গল্পের মৌল ধর্ম হলো____সংবেদনশীল মানুষের মনে সংরাগ সৃষ্টি করে সংবেদনশীলতাকে প্রণোদিত করা। প্রথাগত ধারণার বিপরীতে নতুন উপলব্ধি কিংবা চিন্তার কিংবা বৈচিত্র্যপূর্ণ সৌন্দর্য চেতনার শিল্পিত প্রকাশ সবার পে সম্ভব হয় না। প্রায় কোন নির্দিষ্ট কালখণ্ডের একাধিক গল্পকারের গল্পের স্বর, কাহিনী এবং শৈলী অভিন্ন হয়ে যেতে পারে। তবুও সে অভিন্ন স্বরের সম্মিলিত উচ্চারণ কোরাসে পর্যবশিত হয়ে যায়। কোন ব্যতিক্রম সুর স্বতন্ত্র হয়ে বেজে উঠে না। বেজে না উঠার জন্য দায়ী ঐ বিশেষ কালখণ্ডের লেখকগোষ্ঠীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধহীন নির্বিশেষ ভাষাভঙ্গি ও অভিন্ন চেতনার উপলব্ধিজাত বিশ্বাস ও ধারণার অভিন্নকরণ প্রক্রিয়া। অগ্রজ ও সমকালীন অপরাপর গল্পকারের ভাষাশৈলী ও লব্ধ ধারণা থেকে ভিন্নতর শৈলী ও ধারণায় উপনীত হতে না পারলে কেবল গল্প বলার কান্তিহীন অভ্যাস মানব মনের অদম্য আকাক্সাকে পরিতৃপ্ত করা যায় না। তার জন্য চাই____যৌক্তি ঘটনা পরম্পরার বিশ্বাসযোগ্য পটভূমি নির্মাণে। যে চরিত্র বাস্তবজগতের কোন অঞ্চল কিংবা পরিবেশে নেই, কেবল নিজের অজ্ঞতাকে ঢেকে রাখার জন্য বিমূর্ততার অজুহাতে প্রগলভতার চর্চাকে প্রশ্রয় দিলে গল্পকার তার অনভিজ্ঞতার কালো দাগ গল্পের শরীরে আঁকার ব্যর্থ আস্ফালনই প্রমাণ করতে পারবেন মাত্র; তাতে গল্প পাঠকের মনে স্থায়ী কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। আলাদা স্বর নির্মাণের নামে গল্পের রীতিসিদ্ধ শৈলীকে অস্বীকার করে গল্পহীন গল্প বলার ব্যর্থ কসরৎ করেন, নয় রূপকথার যুগের যুক্তিহীন ভাবলুতাসর্বস্ব কাহিনী বয়ানের চেষ্টা করেন মাত্র।
যে সমাজ ব্যবস্থা ও জনপদ এবং শ্রেণীর মানুষের সম্পর্কে বিন্দু-বিসর্গ ধারণা লেখকের নেই, সে সমাজ ও মানবগোষ্ঠীর জীবনাচার নিয়ে গল্প বলার ব্যর্থ চেষ্টা না করাই উচিত। ছোটগল্প লেখকেরা গ্রামীণ জীবনের ছবি আঁকতে গিয়ে অনেকটা সৌখিন পর্যটকের কৌতূহলী চোখে দূরবীণের অস্পষ্ট আলোয় দেখা তাকেই গল্পে রূপান্তরের চেষ্টা করেন। আবার নাগরিক জীবনকে দেখেন কল্পিত যান্ত্রিক ও দ্রুতগতি সম্পন্ন হৃদয়হীন অসভ্য শিতি____মেকি আভিজাত্যের আভরণের ভেতর। কিন্তু সুলুকসন্ধানী চোখের বিপরীতে কেবল কৌতূহলী চোখের চাপল্যে শুধু জলের উপরিভাগের তাৎণিক সৃষ্ট ফেনা আর হালকা বুদ্বুদই দৃশ্যমান হয়; তাতে জলের নিচের চোরা ঘূর্ণি আর অন্তঃশীল স্রোতের বেগ বোঝা সম্ভব হয় না। তার জন্য চাই নিশ্চিতভাবে জলের গভীরে ডুব দিয়ে অবগাহন আর ডুবুরির অন্তর্দৃষ্টি। এর ব্যতিক্রমে একজন গল্পকার ক্রমাগতভাবে কেবল আত্মপ্রতারিতই হবেন। যাপিত জীবন সম্পর্কে লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গল্পকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে বিশিষ্ট করে তুলতে পারে। তার জন্য চাই____ লেখকের প্রগাঢ় শিল্পপবোধসম্পন্ন মন ও গভীর জীবনবোধ। সঙ্গে প্রচূর অভিজ্ঞতাও। এ সবের সুষম সমন্বয় এ সময়ের গল্প লেখকরা কতটা নৈপুণ্যের সঙ্গে সাধন করতে পেরেছেন সে প্রশ্নটাই এ মুহূর্তে সবার আগে জরুরি। এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে আমাদেরকে আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রোপটের সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক পটভূমির নির্মাণ কৌশলটি নিরূপণ করা প্রয়োজন। প্রতেক্যে লেখক সৃষ্ট চরিত্রগুলোর ভেতর নিজের ছায়াটিই সন্তর্পনে আঁকবেন____এটাই স্বাভাবিক। আগে নারী ছিল সহিংসতার শিকার; এখন পুরুষ নারীদের বলির পাঁঠা। কিন্তুবিষয়টি এ সময়ের লেখকেরা এড়িয়ে যান। এর কারণ সম্ভবত দুটো। প্রথমত, প্রতিক্রিয়াশীলতার তালিকাভুক্ত হওয়ার ভয়। দ্বিতীয়ত, সাম্রাজ্যবাদী ও নারীবাদীদের সঙ্গে আদর্শিক সংঘর্ষ ও মতোবিরোধ এড়িয়ে চলার জন্য। ফলে এ বাস্তব ও যুক্তিনিষ্ঠ আর্থ-সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক চিত্রটি এ সময়ের ছোটগল্পে অনালোকিতই থেকে গেল। বাংলা ছোটগল্পের প্রাথমিক রূপকারদের মতো এ সময়ের ছোটগল্প লেখকেরাও নারীকে করুণাপ্রার্থী করে রূপায়ন করেছেন। নারীকে নারী আর পুরুষ পুরুষরূপের ভেতরে বরাবর রূপায়নের শিকার হতে হচ্ছে। এর বিপরীতে নারী-পুরুষ মানুষ পরিচয়ে গর্বিত হতে পারছে না। এ দায়ভার কার? গল্প লেখকদের? না সমাজচিন্তকদের?
বাংলাদেশের লেখকদের কোনো কোনো গল্প পাঠে মনে হয়____গল্পের উদ্দেশ্য নিছক কোনো কাহিনি বর্ণনা মাত্র। যে কাহিনি গ্রামের কোনো প্রখর স্মৃতিধর প্রবীণের মুখেও শোনা যায়। এর জন্য দীতি মানুষের সযত্ন প্রয়াসের প্রয়োজন হয় না। এসব গল্পের বিষয় মানুষের দৃষ্টিগ্রাহ্য আচরণের পরম্পরা। কখনো কখনো আকস্মিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে নির্বাচিত ঘটনাও এসব গল্পের কাঠামো তৈরিতে ভূমিকা রাখে। যেমন হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, মনি হায়দার, সিরাজুল ইসলাম মুনির প্রমুখ। তবে হুমায়ূন আহমেদ নিছক গল্প বললেও সেখানে কাহিনির সঙ্গে একটি মানবিক সূত্রও থাকে। বিষয় আহরিত হয় প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা থেকেই। কোনো কাল্পনিক জগতের রূপকথা নয় তার গল্প। হুমায়ূন আহমেদ গল্পে জীবনকে চিত্রায়িত করেন। ফুটিয়ে তোলেন সমাজ-রাষ্ট্র ও ব্যক্তির বহিরাঙ্গ ও অন্তর্লোকের বিষয়-আশয়। তবে সমাজের বহিরাঙ্গ চিত্রায়নের চেয়ে ব্যক্তির মনোবিকলন অংকনে তাঁর আগ্রহ বেশি। (হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প : জটিল জীবনের সহজ গাথা : মোহাম্মদ নূরুল হক)। এবং তাঁর গল্পে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনও ভাষা অবিকৃতভাবেই গৃহীত।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন সময়ে নির্যাতিত হতে হয়েছে। তাদের জীবন-যাপন, সংস্কৃতি-নির্ভর গল্প যারা লিখেছেন, তাদের মধ্যে মনিরা কায়েস, প্রশান্ত মৃধা ও রাজীব নূরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাজীব নূরের ‘বাংলার মুখ’ গল্পে সংখ্যালঘুদের জীবনচিত্র এবং তাদের ওপর নির্যাতনের চিত্র রয়েছে। এই লেখকদের গল্পে সংখ্যালঘুদের সামাজিক চিত্রই যে কেবল রয়েছে, তা নয়। তাদরে প্রতি আন্তকিতাও প্রকাশ পেয়েছে। সমকালীন প্রোপট যারা তুলে এনেছেন, তাদের অগ্রগণ্য হলেন, নাজিব ওয়াদুদ, আতা সরকার, আকমল হোসেন নিপু, আহমাদ মোস্তফা কামাল প্রমুখ। আহমাদ মোস্তফা কামালের ‘বিজ্ঞান ও মানুষে গল্প’ আকমল হোসেন নিপুর ‘আমরা খুব খারাপ সময়ে বেঁছে আছি’ গল্পে সমকালীন সমাজচিত্র ফুটে উঠেছে সার্থকভাবে।
এ সময়ের গল্পে নারী-পূরুষের প্রেম-ভালবাসা, বিরহ-বেদনা, সুখ-দুঃখের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক প্রোপটে নৈরাশ্যবোধকে অনিবার্য করে তোলার পাশাপাশি নিরালম্ব শিতি বেকার যুবক-যুবতীর জন্য ছিনতাই, সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে পেশা হিশেবে অনিবার্য করে তোলা হয়েছে। তাদের গল্পে পাঠক কেবল সমাজের কদর্যরূপটিই প্রত্য করবেন; আদর্শগত কল্যাণময় দিকটি পাঠকের মনে অনালোকিতই থেকে যাবে। অনেকাংশে, বস্তুতপে সকল ছোটগল্পকারের ক্ষেত্রে সত্য যে, এদের অভিজ্ঞতা যতটা না অর্জিত, তারও বেশি আরোপিত আর ধার করা। তারা যখন গ্রামের গল্প রচনা করেন, তখন কেবল গ্রামের কদর্যরূপ আর গ্রাম্যতাই দেখেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে মানুষের জীবন যাত্রায় সে পরিবর্তনের হাওয়া গ্রামের মাঠে মাঠে নুয়ে পড়া অশীতিপর বৃদ্ধ কৃষক থেকে শুরু করে স্কুলগামী শিশু কিশোরদের মনেও যে লাগতে পারে সে খবর বোধ হয় আমাদের লেখকেরা রাখেন না। যে টুকু সংবাদ তারা জানেন তার প্রায় ষোলআনাই খবরের কাগজের মফঃস্বল পাতা ও গ্রামগঞ্জের খুন, ধর্ষণ, ভূমিগ্রাসের সাংবাদিক প্রতিবেদন মাত্র। ফলে তারা জানতেই পারেন না, গ্রামের মানুষ শহরের তথাকথিত শিতি____অভিজাত শ্রেণীর চেয়েও অনেক সভ্য; প্রজ্ঞা ও মণীষা নিয়েও যে গ্রামীণ শিতিযুবক গ্রামের আলো____হাওয়ায় জীবন যাপন করেই বিশুদ্ধ বাতাসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। গ্রামীণ মানুষের জীবনের এই বাস্তবতা, তাদের রাজনীতি শ্লিষ্ট জীবনযাপন, নাগরিক জীবনের আদর্শহীন সমাজকাঠামোর বিপরীতে স্বচ্ছন্দ্য, সে বিষয়টি এ সময়ের গল্পে প্রায় অনুপস্থিত। এছাড়া এ সময়ের গল্পে প্রায় সস্তা প্রেমের খিস্তিখেউর আর অনৈতিক সম্পর্কের সুড়সুড়ি সর্বস্ব কাহিনীর সমাবেশ দেখা যায়। তাদের গল্পপাঠে আমাদের বাংলাদেশকে পাওয়া যায় না। এদের গল্পে আলু পটল চাষের যে বানানো পটভূমি নির্মিত হয়, সে পটভূমি লাটিন আমেরিকার কোনো অচেনা গ্রাম; যা আমাদের গল্পকাররা বিশ্বসাহিত্য পাঠে জানতে পেরেছেন। আর শহরের যে চিত্র তা তারা অঙ্কন করেন তাদের গল্পে, সে সব শহরের সমকামিতাও অবাধ যৌনাচারের যে বর্ণনা থাকে তাতে মনে হয় ফ্রান্স কিংবা আমেরিকার কোন খোলা উদ্যান আর নাইটকাব অধ্যূষিত কোনো মহানগরের ভেতর দিয়ে পাঠক হেঁটে যাচ্ছে। তাদের গল্পের সৃষ্ট চরিত্রগুলো প্রায় কথা বলে____ অশুদ্ধ বাংলা আর অশুদ্ধ ইংরেজির মিশেলে। শুভবাদী দর্শনের স্থানে ব্যাপক নৈরাশ্য আর সহিংসতার ছড়াছড়ি দেখে মনে হতে পারে বাংলাদেশে কোনো সুস্থ স্বাভাবিক, মঙ্গালাক্সী মানুষ নেই। এ সব গল্পের নায়কদের প্রায় অতিমানবিক গুণ সম্পন্ন আর খল নায়কদের প্রায় অ-মানবিক বৈশিষ্ট্য ছাড়া কোনো ব্যতিক্রম খুব একটা চোখে পড়ে না। প্রায় গল্পে দেখা যায়, গ্রামীণ জনপদের ভূস্বামীরা ভূমিগ্রাসী আর নারী লোলুপ। তাদের আকক্সা আর লালসা চরিতার্থ করার জন্য দারিদ্র্য পীড়িত নায়ককে হামলা-মামলায় জড়িয়ে কিংবা বিভিন্ন রকম সালিশ দরবারের প্রহসন সৃষ্টি করে ভিটেমাটি ছাড়া করার বানোয়াট কাহিনিই বার বার ঘুরেফিরে আসে। নায়করা প্রায় উদ্বাস্তু আর উন্মুল জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। তারা কেবল স্বপ্ন দেখে; মজুরি খাটে, ন্যায্য অধিকার পায় না। তারা কঙ্কালসার আর অস্থিমজ্জাহীন। দেখে শুনে মনে হয় বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে আধুনিক শিক্ষার আলো আদৌ পৌঁছেনি। এ বৃত্ত ভেঙে নতুন চিন্তা ও চেতনার আলোয় গল্পকে প্রায় পর্ণো কাহিনির জগদ্দল পাথর থেকে মুক্ত করা জরুরি। যারা পরাধীন দেশে ঔপনিবেশিক মানসিকতা নিয়ে গল্প লিখতে এসে, নায়ককে মহৎ আর আত্মদানকারী বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অশিতি, গ্রাম্য আর দুর্বল ক্ষীণ স্বাস্থ্যের করে সৃষ্টি করেছেন, তাদের দেখানো পথ ধরে স্বাধীন ভূ-খণ্ডে যারা গল্প লিখতে শুরু করেছেন, তাদের মধ্যেও জীবন সংগ্রামের গল্প লেখার ছলে এসব উদ্বাস্তু জীবনের উম্মুল মানুষের প্রতি করুণা মিশ্রিত বানানো কাহিনি বলার প্রবণতা শোচনীয়ভাবে সংক্রমিত হয়েছে। তবে একথা অস্বীকার করা যায় না____‘আমাদের অর্জন খুব সামান্য নয়। জীবন ও পৃথিবীর চেনা-অচেনা কোণে আমাদের লেখকরা ক্রমাগত আলো ফেলেছেন এবং ফেলছেন____এ কাজটি কেন গুরুত্বপূর্ণ হবে না? আমার মনে হয় আমাদের পুরো গল্প নিয়ে গর্ব করতে পারি আমরা।’ (বাংলাদেশের ছোটগল্প : উত্তরাধিকারে পরিপ্রেক্ষিত: আহমাদ মোস্তফা কামাল)।
সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের আলোকে অনেকের গল্পই পাঠযোগ্য। কিন্তু শিল্প ও সমাজ এবং সাধনার সমন্বয়ে যারা সামাজিক ব্যবস্থপনা ও চিত্রকে শিল্প করে তুলেছেন, তারা হলেন, আতা সরকার, মঈনুল আহসান সাবের, মঞ্জু সরকার, নাজিব ওয়াদুদ, মনিরা কায়েস, রফিকুর রশিদ, আকমল হোসেন নিপু, আমহম মোস্তফা কামাল, শাহনাজ মুন্নী, রাজীব নূর, রাখাল রাহা, প্রশান্ত মৃধা প্রমুখ। তবে এই লেখকদের সবাই শিল্পমানে সমান____এমন দাবি করা যাবে না। তবে এখানে কিছু নাম একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে। এর কারণ কোনো কোনো লেখকের ব্যাপ্তি এত বেশি যে বিষয়ভিত্তিক আলোচনায়, একাধিকবারই তাঁদের নাম উল্লেখ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
লেখক পরিচিতি
মোহাম্মদ নূরুল হক
জন্ম : জুন ১২, ১৯৭৬।
জন্ম : জুন ১২, ১৯৭৬।
কবি। গল্পকার। প্রন্ধকার।
সাংবাদিক।
সাংবাদিক।
0 মন্তব্যসমূহ