বসন্ত বেদনা

আনোয়ার শাহাদাত

ছোঁট্ট মফস্বল শহর। আনন্দে ফুলে-ফেঁপে উঠছে। নদীগুলো জোয়ারের স্রোতের আগে যেমন ফুলে ওঠে ভাটির টান থাকতেই। সে জোয়ার আসার আনন্দে যেনো। এ শহরেও শিগগিরই জোয়ার আসবে। বসন্ত উৎসব হবে। চৈত্রের শেষলগ্নে পূর্ণিমার রাতে উৎসব শুরু। যখন নদী ও খালেরা প্লাবিত হবে জোয়ারের জলে। আনন্দ উৎসব চলবে দিনরাত। নবমী থেকে পূর্ণিমা অব্দি।

শহরের ঘরে ঘরে এখন একটি আলোচনা। বিষয়, আসছে বসন্ত উৎসব। এই ধারণা কার মাথা থেকে বেরিয়েছে তারও একাধিক দাবিদার এখন। ভাঙা টেবিল চেয়ার সর্বস্ব রেস্তোরাঁ, মাস্টার আজিজ ভাই লেখা সাইনবোর্ডের টেইলরিং, খোঁচা দাড়ি গোঁফ বিশিষ্ট সদাই চন্ডির জীর্ণ হেয়ারকাটিং সেলুন, সবই আলোচনায় মুখরিত। কে কিভাবে বসন্ত উৎসব করাবে সে পরিকল্পনা সার কথা।

বিকেলে শহরের প্রায় সবগুলো বাড়ির উঠোনে মেয়েদের আড্ডা জমে ওঠে। বেতফল, তেতুল, আচার আর বিলিকাটা নিয়ে চলে যায় সেই সব বিকেলগুলো। কে কোন শাড়ী, কোন সাজে, কোন টিপ, কোন খোঁপা বাঁধবে। মহিলা কলেজ সরকারি কলেজ, ও বড় স্কুলগুলোতে বিশেষ দেয়ালপত্রিকা বেরুনো ‘বসন্তোৎসব’সংখ্যা নামে। দেয়াল পত্রিকাণ্ডলোর সবগুলো কবিতা বসন্ত উৎসব নিয়ে। গল্পও সে রকম উৎসব চলাকালে কিশোর ও কিশোরীর কিংবা তরুণ ও তরুণীর পরিচয়। সে থেকে মন দেয়া-নেয়া। বাবা-মা পরিবারের আপত্তি, এক বন্ধুর সহযোগিতায় প্রণয়। অতোপর সুখে এ দম্পতির বসবাস। পরিশেষে বসন্তোৎসবকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।

শহরের অধিকাংশ বাড়ির দেয়াল ও টিনের ঘর বিভিন্ন রঙের দেয়াল লিখনে ভরে উঠেছে। যেখানে কদিন আগেও ছিলো পৌরসভা নির্বাচনের শ্লোগান-বদনা মার্কায় আলম ভাইকে ভোট দিন অথবা কুড়াল আছে যেখানে আমরা আছি সেখানে। সেসব জায়গায় নতুন শ্লোগান পরেছে বসন্তৎসব নিয়ে। ‘এ কোনো নষ্টামী নয় জাগতিক স্বর্গের মতো বসন্ত ঋতুতে হাসি খেলা।’ ‘এসো বসন্ত উৎসব করি’। অথবা কোথাও--‘এ বসন্ত যদি এতো ফুল ফোটাতে পারে এ বসন্তে যদি এতো পাখী গাইতে পারে আমরা কোনো নয়’।

একজন যুবক নিজ উদ্যোগে একটি মাইক ভাড়া করে। পুরো শহর ঘুরে ঘোষণা করতে থাকে একজন নাম করা খবর পাঠকের ঢং-এ। আপনারা জানেন সুগন্ধা নদীর তীরে এ শহর। এ নদীর নামকে আমরা কোনোদিন সম্মান দেখাতে পারিনি। জীবনানন্দ দাশ যে সম্মান দেখিয়েছেন ধানসিড়ি নদীকে। আজ আমরা এই বসন্ত উৎসবে এর মধ্যদিয়ে এই নদী, এই শহরকে শ্রদ্ধা জানাতে যাচ্ছি। কবি জীবনানন্দ দাশ আজ বেঁচে থাকলে তিনিও ঈর্ষা বোধ করতেন। এভাবে যুবক-মন ভরে কথা বলে। একসময় ক্লান্ত হয়ে রিকশাওয়ালাসহ ঘোলমুড়ি খায়। আবার নেমে পড়ে। অবিরাম ঘোষণা।

শহরের সবচেয়ে বড় কাপড়ের ব্যবসায়ী সাত্তার হাওলাদার ঘোষণা দিলেন, তিনি অনুষ্ঠানের জন্যে দেড়শো বাসন্তি রং শাড়ী দেবেন। ব্যবসায়ী সমিতি ভাল করে নিলো--কোন খাতে কিভাবে, কোন টাকা খরচ তারা করবে। কুমার বাড়িতে আদেশ গেলো হাজার সড়া ও হাঁড়ি বানানোর। তাতে আলপনা এঁকে সাজানো হবে উৎসব এলাকা।

শহর প্রশাসক অনুষ্ঠানের অনুমতি দিয়েছেন। অবস্থা বুঝে তিনি প্রধান অতিথি হতে চাননি। ঠোঁট কাটা একজন সংগঠক বললেন, স্যার আমরা তো ফিতা কাটার কোনো ব্যবস্থা রাখছিনা। অবশ্য সরকারি দলের স্থানীয় এমপি চেয়েছিলেন শুরুর দিন উপস্থিত ভাইবোনদের উদ্দেশ্য বক্তৃতা করবেন। এমপি সাহেব এ ধরনের মনোভাব ব্যক্ত করার পর ঠোঁঠকাটা সেই বসন্ত উৎসব কমিটির সংগঠক বললেন, গাজী ভাই বক্তৃতারতো কোনো ব্যবস্থা নাই, আমরা কাজে বিশ্বাস করি বক্তৃতায় নয়--আপনার নেতাই তো এই সব কথা বলতেন। তারা চলে গেলে এমপি সাহেব বললেন, এই চুল বড় নোংরা পোশাকের লোকগুলো যারা এই সব যাত্রাফাত্রা করে একটু বেয়াদপ ধরনের হয়। এমপির চ্যালা চামুণ্ডাদের একজন বললেন, ‘স্যার একটু না পুরাটাই বেয়াদব হয়’। অপর একজন সাফারি পরিহিত কালো চশমা বললো--‘গাজী ভাই দিয়া দিমু না হি এক লাছা’।

খালি লাছা দেওনের তালে আছেন, এটটু বুইজা সুইজা দিতে চাইয়েন, ওনাগো দিতে গেলে আমারে আবার অন্য হান দিয়া দেবে আনে।’

রাধেশ্যামের কাঠপট্টির রেস্তোরাঁয় খুব সকালে ক’ জন বুড়োর আড্ডা হয়’ চা-পরাটা খেতে’ খেতে আজকালকার যুবক-যুবতী চর্চা এ বুড়োদের আড্ডার প্রধান বিষয়। এরাও আনন্দিত বসন্ত উৎসব সামনে নিয়ে। দু’তিন কাপ চা, দিনে বেড়ে গেছে।

বুড়োরা পেছনে ফিরে যান। অবস্থার তুলনা করেন আয়ুব খানের শেষের দিনগুলোর আগে। শেখ সাহেব যখন জেলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামি হয়ে, এক বুড়ো অপরজনকে বলেন, খেয়াল করছো--সত্তুর এর বন্যার পর নির্বাচন হবে। পাবলিকের কি উল্লাস। ধ্যাধা বুড়ো বলেন, ‘ও মেয়ারা আর একটা জিনিস নজর করছ কিনা’ শেখের বিরুদ্ধে আগর তলা ষড়যন্ত্রের মামলা হয়েছিলো রাষ্ট্রদ্রোহিতার আর এই মহিলার বিরুদ্ধেও সেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা সুতরাং এইবার হবে রাজাকারদের বিচার যেমন সে সময় হয়েছিলো দেশ স্বাধীন।

এই আড্ডা থেকে একজন প্রস্তাব করেন--পোলাপাইনডিরে কইয়া দেবা নাকি এবার শহীদ আবু তালেবের নামে একটা স্মৃতিসৌধ বানাইতে। শহীদ আবু তালেব এ শহরের প্রথম শহীদ। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একজন বাঙালী যুবক কিভাবে শহীদ হয়েছিলো তার বর্ণনা অপ্রয়োজন। শহরের প্রথম শহীদের কবর হয়েছিলো আগের কলেজ বিল্ডিং-এর দক্ষিণ মুখে। কলেজটি ছিলো সুগন্ধা নদী লাগোয়া। শহর তখনো পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে যায়নি। সুগন্ধা নদীর পশ্চিম দিক পাড় ভাঙার নিয়মে ভাঙতে থাকে এক সময়। ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি কলেজের সামনে শহীদ আবু তালেবের কবর ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। তখন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের একজন নেতাকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো আবু তালেবের কবরটা রক্ষার ব্যবস্থার জন্য। কমান্ডার প্রস্তাবকারীকে বললেন, অত ফালাফালি করতাছো ক্যান, আমাগো নেতা হে-ই মুক্তিযুদ্ধা দিলো না, যা তোমরা মনে করছো। বেশি ফালাফালি করলে ট্যাংরি ভাইঙ্গা ফালামু’ এরপর একদিন অতি নিভৃতে শহীদ আবু তালেবের কবর সুগন্ধা নদীদে ভেসে যায়। ব্যবস্থা হয়েছে বসন্ত উৎসবে নৌকার বাইচ হবে। শহীদ আবু তালেবের ঘাট থেকে বিশখালী নদী পর্যন্ত। শহর সাজানো শুরু হয়েছে যার যার মতো করে। তরুণ-তরুণীরা স্বপন দেখছে। হলে হতেও পারে এই বসন্তে ভালোবাসা জাতীয় কিছু। দু’একজন নাকি কানাকানি করছে, কেনো ঘটা করে এতো বসন্ত উৎসব। এ নাকি মগের মুল্লুকের মতো। হিন্দুয়ানী বসন্ত ঘটা করে এতো বাড়াবাড়ি কিসের। লাগলোটা কি। গণ্ডগোলের পরওতো এতো চ্যাতে নাই। এ সব কানাকানি করে বেড়াচ্ছে হাজী জিলালুর রহমান। এই কথা শুনে তাগড়া যুবকরা হই হই করে উঠেছে--ধর বেটাকে। পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ওভাবে গণধরাধরিতে কাজ নেই। তাতে একটা কাণ্ড হয়ে যেতে পারে। তার চেয়ে বসন্ত উৎসব কমিটির পক্ষ থেকে মজিদ মাওলানা ও আউয়াল হাজী যাবে। পরিস্থিতি হাজী জিলালকে বোঝাবে। মজিদ মাওলানার মুখে ‘রস কষ’ নেই। যখন মাহফিলে ওয়াজ করেন,তখনও নির্জলা কথা বলেন। শুরু করার ভূমিকা করেন। বেরাদারাণে ইসলাম, বেসুমার গরীব ঘরে আমার জন্ম। তাই জন্মের সময় আমার মুখে মধুতো দূরের কথা একটু খেজুরের রসও দেয়া সম্ভব হয়নি। তাই বিষাক্ত কথার মধুর মাখনের মতো মধু আমার গুদামে নাই।

সেই মজিদ মাওলানা হাজি জিলালুর রহমানকে সরাসরি বললেন, ‘হাজী সাব বছর পঁচিশের আগে। পয়লা বৈশাখে কেমনে মাল কোছা মাইরা ঘোড় শওয়ার হইতেন তা কি মনে আছে? তহনকি আপনেরে বাপে আপনের হিন্দু পয়দা করছিলো। যাক হেইসব কথা না, ছেলেপুলেরা কি বলেছে তার সবটা বলবো না। সবটা বললে আপনে ভিরমী খাইবেন, তাই কমাইয়া বলি। তারা বলছে, আপনার পাছার কাপড় উদলা কইরা জোতা পেটা করবে যদি ফের আপনে বসন্ত উৎসব নিয়ে বুঝে কথা বলেন।’ আউয়াল হাজী বললেন, ‘ভাই সাহেব হুঁস রেখে কথাবার্তা বলবেন, পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেলে আমাদের কিছু করার থাকবে না।

দিন ঘনিয়ে আসছে বসন্ত উৎসবের। ভুবন দাস সার্কাস কোম্পানি নিজেই প্রস্তাব দিয়েছে কম দামে সার্কাস দেখাবে। ভুবন দাস এক সময়ের সার্কাস রাজা লক্ষণ দাসের শিষ্য ছিলো। ভুবন দাসের আসল নাম মোহাম্মদ আলী। লক্ষণ দাসের সার্কাস বন্ধ হয়ে গেলে মোহাম্মদ আলী শুরু করে। কিন্তু মোহাম্মদ আলীর সার্কাস নামে হলে সে ব্যবসা চলবে না তাই তার সার্কাস কোম্পানির নাম ভুবন দাস।

উৎসবে পুতুল নাচ থাকবে। ঘোড় দৌড় থাকবে। আছে যাত্রা পালাও ‘এজিদ বধ জয়নাল উদ্ধার’ ও‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘পালা।

পূর্ণিমার রাতরে অনুষ্ঠান শুরু হবে ঠিক সন্ধ্যার পর। যখন পশ্চিম আকাশে কিছুটা লালচে আভা থাকবে। পথ ভোলা কিছু পাখী তখনও ঘরে ফিরবে। পূর্বাকাশে ভরা চাঁদ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। নদীতে জোয়ার ফিরবে। ভেসে থাকা কচুরীগুলো স্থির হয়ে পড়বে অদ্ভুত রহস্যময়তা নিয়ে। সবগুলো হ্যাজাক বাতি নিভে যাবে। অতপর।

অনুষ্ঠানের স্থান নির্ধারণ হয়েছে সুগন্ধ্যা নদীর পাড়। বিস্তীর্ণ প্রান্তর। চারদিকে ভীষণ সবুজ কলাইর ক্ষেত।

যে কোনো অনুষ্ঠানে একজন বিশিষ্ট থাকে। এটাই দেখে আসছে এতদিন শহরবাসী। বসন্ত উৎসবে কে থাকবে। এনিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। ঢাকা থেকে একজন কবি আনলে কেমন হয়। বড় কবিরা কি এ সময় এতো দুরের শহরে আসবেন। এখন কবিরা ভীষণ ব্যস্ত। ফাগুন, কবিতা উৎসব, বই প্রকাশের মৌসুম। একজন তরুণ কবিকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা ওঠে। রাজনৈতিক কবিতা লিখে সম্প্রতি তিনি খুব বিখ্যাত হয়েছেন। এ কবির কৈশোর কেটেছে এ শহরে। তার বাবা এ শহরের হাকিম ছিলেন। অনুরোধ করলে তিনি আসতে পারেন, এ রকম কথাবার্তা হয়।

কবি শুনে ধা-ধা করে ওঠেন। কেনো যাবো না। ওতো আমার ভিঞ্চি শহর। কবে যেতে হবে। আমি যাচ্ছি। সেই বসন্তের এক প্রত্যুষে কবি এলেন। নদীর ঘাটে উদীচীর স্থানীয় শিল্পীরা এসেছে তাজা ফুলের মালা নিয়ে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান কৌশলীর স্ত্রী ছেলেমেয়েদের ডেকে বলেন আমার এবারের ফুলের বাগানের সমস্ত ফুল তোমাদের বসন্ত উৎসবের জন্য। সেই বাগানের তাজা ফুলের মালা পরানো হলো কবিকে। কবি আবেগে নির্বাক হলেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন। যেনো এমনিতেই।

কবির থাকার জায়গা ঠিক করা হয়েছে সরকারি বিশ্রামাগারে। বসন্তের সেই সকালে তিনি তার বিশ্রামাগারে গেলেন না। পায়ে হেঁটে চললেন তাদের পুরনো বাসার দিকে। যেখানে এক সময় থাকতেন। তরুণ-তরুণীরা অনুরোধ করেছিলো রিকশায় চড়তে। এ হয়না বলে তিনি হেঁটে চলেছেন। তারপর বাবার অফিসের দিকে। পথে যেতে দু’ কিশোরীকে দেখলেন ভোরের পূজোর ফুল তুলে ফিরছে। কবি কিশোরদীদের ঝুড়ি থেকে একটি জবা তুলে নিলেন। দু’একজনের কাছে বিষয়টি ধরা পড়লো--কবির মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। কি প্রশ্ন যেনো তার আছে বা তিনি খুঁজছেন কিছু। না জানতে চাচ্ছেন, না তার কাংক্সিক্ষত মানুষকে দেখতে পাচ্ছেন। কবির কৌতূহলী চোখ আর অভিব্যক্তি যেনো আঘাত পাচ্ছে শুরু থেকে। যখন থেকে তিনি নদীর ঘাটে নামলেন।

আসলে কবি আর একজন কবিকে খুঁজছেন। যাতে তিনি বড় কবি মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের মতো। যিনি ছিলেন এক সময় তার শিক্ষক। কবিতার গুরু। বাবার অফিস সহকারী। স্বাধীনতা উত্তরকালে কবি সিকান্দার- এর সংস্পর্শে তিনি আসেন। পড়া শেষে শিক্ষক ছাত্রকে কবিতা শোনাতেন। কবিতা শুনে ছাত্র কাঁদত। শিক্ষক বলতেন, ‘বুঝলে কিনা, কবিতা শুনে কাঁদতে নেই’। এরপরই কবি সিকান্দার আবার বলতেন, অবশ্য কবিতা শুনে হাসতে নেই। এইভাবে কবিতার প্রতি এবং কবি সিকান্দারের প্রতি ছাত্র কবি অনুরক্ত হয়ে পড়ে।

সিকান্দারের ঘটনাবহুল কবিজীবন। যুদ্ধপূর্বকালে দু’দিনের ছুটি নিয়ে গেলেন বরিশাল। আরজ আলী মাতব্বর নামক এক প্রথাগত শিক্ষাহীন মানুষের কাছে। পাকিস্তানী সরকার কদিন আগে তাকে জেলে পুড়েছিলেন ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে। তার প্রশ্নগুলো নাকি ধর্মকে আঘাত করেছে।

কবি সিকান্দার ফিরে কবিতা লিখলেন। আরজ আলী মাতব্বরের মতো তাকেও যেতে হলো জেলে। এরপর অনেকদিন চুপ থাকতে হয়েছে তাকে। আবার রব হয়েছিলেন দেশ স্বাধীনের পর। কবি সিকান্দার বিয়ে করেছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন নারী। তার আত্মীয় স্বজন তাকে এ ‘অপরাধে’ বর্জন করেছে। দু’একজন খুশী হয়েছেন--আনন্দিত হয়েছেন যারা বিশ্বাস করেন একজন অন্যধর্মীকে স্বধর্মে ধর্মান্তরিত করতে পারলে ১৪ প্রজন্ম স্বর্গবাসী হবে। সিকান্দার দোলার প্রথম ছেলে সন্তানের নাম রাখেন সেতু। এ সন্তান দু’ধর্মের সেতুবন্ধনের ফসল বলে নাম রাখা হলো সেতু। কিন্তু স্বাধীনতার পর তারা ছেলের নাম পাল্টে রাখলেন স্বাধীনতা। কারণ ধর্মীয় মিলনের চেয়েও স্বাধীনতা অনেক বড় কথা।

আজকের বিখ্যাত কবি একদিন অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কবি সিকান্দারের কাছ থেকে। বলতেন, বুঝলে কবি হতে হবে। কবিরা আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো নন। তারা জাগতিক কাজের জন্যে শুধু এ দুনিয়ায় জন্মান না। জগৎকে অর্থপূর্ণ করার জন্যেই কবিদের জন্ম। হয় কিভাবে?

আহা সে কোনো জটিল বিষয় নয়। যে কোনো মানুষের মধ্যেই কবিত্ব থাকে সুপ্ত। তাকে জাগিয়ে তুলতে হয়। তোমার মধ্যেও আছে। তুমিও একজন কবি। কোনো কবি ছাড়া কবিতার কথা শোনে না। পরদিন ছাত্র একটি কবিতা লিখে ফেলে। সে কবিতা শুনে কবি সিকান্দার চোখ বন্ধ করে বড় চুলগুলো কানের দু’পাশে ঠেলে মাথা দুলিয়ে উপলব্ধি করতে থাকেন নতুন কবির কবিতা, আ-হা-হা। মফস্বল শহরের এ বসন্ত উৎসবে কবি সিকান্দারের সঙ্গে তার দেখা হবে। এ আশা তার ছিলো। অনেকদিন পর গুরুকবির দেখা! সেকি আনন্দের। সুখের। অথচ দেখা হচ্ছে না। অনেকের সঙ্গে দেখা হচ্ছে কেবল সেই কবি নেই। কেউতো এমন কথা বলেনি। একজনকে জানতে চায় কবি সিকান্দার। ওহো তার কথা বলছেন, তিনিতো আজকাল ওসব ছেড়ে দিয়েছেন, কোথাও যাননা, কারো সঙ্গে কথা বলেন না। তিনি হারিয়ে গেছেন। খুব ভোরে তাকে একবার দেখা যায়। হেঁটে হেঁটে নদীর ধারে যান, আবার ফিরে যান ঘরে। চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন অনেকদিন আগে।

কোনো এক অজানা ভয়ে কবি সিকান্দার সম্পর্কে আর কিছু জানতে চান না। কেনো যেনো মনে হয় বুকটা মুষড়ে যাওয়ার মতো কিছু হতে পারে। বসন্ত উৎসবের পূর্ণিমা পর্বের অনুষ্ঠান শুরু হয়। তরুণ কবি হাহাকার করেন একজন মানুষের জন্যে। সব আছে তবুও কি যেনো নেই।

কবি উৎসবের পূর্ণিমা পরদিন চলে যাবেন ঢাকায়। রেস্ট হাউজে রাত কাটে নির্ঘুম। সাতসকালে কবি সেদিন চলে যান, যে পথে হাঁটেন এ সময় কবি সিকান্দার। দেখা হয় দু’ কবির। যেনো এটার ছিলো স্বাভাবিক। পাশাপাশি হাঁটেন দুজন। জেলা বোর্ডের মাঠ পেরিয়ে নদীর দিকে, শহীদ আবু তালেবের ঘাটে।

সম্ভবত এ সময় দুজন মানুষ কাঁদেন। সেই ছন্দে আবার তারা ফিরে আসেন হাইওয়ের দিকে। সকালের নীরবতা ভেঙে দোয়েল যেমন ডাকে তেমন নীরবতা ভাঙেন কবি সিকান্দার--

ও কিছু নয়। জানি কবি আপনি জানতে চাইবেন কেনো আজ এমন। আমি একজন বিখ্যাত কবির সঙ্গে কথা বলছি তাই আপনি করে কথা বলছি। আচ্ছা কবি আপনার কি মনে আছে গত বছর দুয়েক আগে এ শহরে কিচু দুষ্কৃতকারী শহীদ মিনার ভেঙেছে। সে সময় জনতার প্রতিরোধে দু®কৃতকারীদের একজন নিহত হয়েছে। তা কি আপনার মনে আছে? প্রিয় কবি নিহত সেই তরুণের নাম রাখা হয়েছিলো সেতু ও স্বাধীনতা। যার সঙ্গে আমার সম্পর্ক পিতা ও পুত্রের।

কবি সিকান্দার এরপর তার একসময়ের ছাত্রকে পথ দেখিয়ে বলেন--এ পথে গেলেই হাতের বাম দিকের গলি পেরিয়ে তোমার রেস্টহাউস।

এরপর আবার ফিরলেন তরুণ কবির দিকে বললেন, জানি আমাকে তুমি ভুল বুঝবে, তবুও বলছি এ আমার পুত্রশোক নয়, এ শোক আমার ব্যর্থতার, কি করে সে তরুণ শহীদ মিনার ভাঙ্গার আদর্শে অনুপ্রাণিত হলো।

লঞ্চের নাম সাগর। বিশাল লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে বিখ্যাত কবি। ঘাট ছেড়ে ছোট ছোট ঢেউ ভেঙ্গে চলছে। সে সময়ে নদীর তীরে শহরের আগের কলেজের ওখানে একজন লোককে দেখা পেলো বাসন্তি রঙের একটি রুমাল উড়াচ্ছে লঞ্চের দিকে ফিরে। বৈশাখ এসেছে। দক্ষিণা বাতাসের জোর বেড়েছে। সে বাতাসের মধ্যে ডেকের উপর দাঁড়ানো দুঃসাধ্য। অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। দক্ষিণের চরের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ঘরে ফেরা এক ঝাঁক বলাকা। ডেকের রেলিং এর হাতল ধরে দাঁড়িয়ে তরুন কবি কাঁদছেন দুঃস্বপ্নের মতো*



লেখক পরিচিতি
আনোয়ার শাহাদাত
জন্ম বরিশালে। কৃষক পরিবারে।
গল্পগ্রন্থ : ক্যানভেসার গল্পকার, পেলেকার লুঙ্গী।
উপন্যাস : সাঁজোয়া তলে মুরগা।
চলচ্চিত্র : কারিগর। 




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ