অদিতি ফাল্গুনী
‘ইস্কান্দার যে! অনেকদিন পর!’
শাদা ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ইস্কান্দারের চেহারা আজও খুবই সুন্দর। ফর্সা, হাল্কা-পাতলা আর মাঝারির চেয়ে কিছুটা বেশি লম্বা। একটা চোখে কালো ঠুলি। না, যুদ্ধ ত’ ওকে অন্ধ বা খঞ্জ করেনি। তবে চোখে ঠুলি কেন? হাতে একটা লাঠি। ইস্কান্দারের পাশে সালোয়ার-কামিজ পরা এক ফুটফুটে তরুণী। ইস্কান্দার আমাকে চিনলো। যুদ্ধের সময় ভারতের লক্ষ্ণৌয়ের সেন্ট্রাল মিলিটারি কমান্ড হাসপাতালে আমরা কয়েক মাস পাশাপাশি বেডে ছিলাম।
আমার আঘাত নিরাময়যোগ্য হলো না বলে দেশে ফিরলাম হুইল চেয়ারে। ইস্কান্দার সুস্থ হয়েই ফিরেছে। এই রেস্ট হাউসে মাঝে মাঝে আসত বা আসে ইস্কান্দার। ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে’ই চাকরি করে। কিন্তু চোখে কী হয়েছে?
আমার আঘাত নিরাময়যোগ্য হলো না বলে দেশে ফিরলাম হুইল চেয়ারে। ইস্কান্দার সুস্থ হয়েই ফিরেছে। এই রেস্ট হাউসে মাঝে মাঝে আসত বা আসে ইস্কান্দার। ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে’ই চাকরি করে। কিন্তু চোখে কী হয়েছে?
‘তোমার চোখে ওটা কী পরেছো? কী হয়েছে?’
ইস্কান্দার উত্তর করলো না। উত্তর করলো ওর সাথে আসা মেয়েটি,
‘আঙ্কেল, আব্বুর রিসেন্টলি ব্রেইন টিউমার ধরা পড়েছে। একটা চোখ হঠাৎ করেই আই সাইট লস করেছে। গলার স্বরও হঠাৎ করেই প্যারালাইজড্ হয়ে যাওয়ায় কথা বলতে পারছেন না। আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করুন।’
ইস্কান্দার আমার দিকে তাকিয়ে পরিচিতের হাসি হাসলো। আমাদের এই বিশ্রামাগারে হাতের বাম দিকের অংশে আমরা থাকি। আর ডান দিকে একটা ছোট অফিস রুম। অফিস রুমের পাশেই একটা টিভি রুম। যেখানে পাশাপাশি কয়েকটা সোফা। অসুস্থ দিন-রাতের বেশ কিছুটা সময় এই টিভি রুমে চলে যায়।
‘তুমি ইস্কান্দারের মেয়ে? তোমাকে কি আগে দেখেছি মা?’
‘আব্বুর সাথে নানা কাজে-কর্মে আমার ছোট ভাইয়াই আসে। ভাইয়ার রিসেন্টলি বগুড়ায় একটা জব হওয়ায় ঢাকায় নেই। তাই আমাকেই আব্বুর সাথে বের হতে হচ্ছে। আমি শায়লা। ইউডায় বিবিএ থার্ড ইয়ারে অনার্স পড়ছি।’
‘বসো।’
হাত দেখিয়ে বসতে বলি ওদের অফিস রুমের সোফায়। যুদ্ধে আধাআধি অসুস্থ প্রাক্তন সৈনিকেরা কখনো সরকারের কাছে ওষুধ খরচ, ডিসএ্যাবিলিটির পার্সেন্টেজ অনুযায়ী ভাতার পরিমাণ নিয়ে দর-দস্তুর ইত্যাদি নানা আবেদন নিয়ে তেজগাঁওয়ের ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট’ অফিস থেকে অসংখ্য সিল-ছাপ্পড় যুক্ত নানা চিঠি এনে চলে আসে এই বিশ্রামাগার অফিসের ইন-চার্জের কাছে। আবার ইন-চার্জের কাছ থেকে নতুন সিল-ছাপ্পড় ভরা চিঠি নিয়ে ছোটে কল্যাণ ট্রাস্ট অফিসে। এই বিশ্রামাগারও কল্যাণ ট্রাস্টেরই আওতাধীন। আমার মতো সম্পূর্ণ হুইলচেয়ার বন্দীরা থাকে সম্বৎসরকাল। ঢাকার বাইরের আধা অসুস্থ যোদ্ধারা বছরে এক/দু’বার চেক-আপ করতে আর যুদ্ধে পুরোপুরি চলৎশক্তি হারানো পুরনো সাথিদের দেখতে আসে এখানে। চেক-আপের সময়টা বিশ্রামাগারের অফিসেই তারা ডাক্তার পায়। ডাক্তার তাদের প্রেসক্রিপশন দেখে প্রয়োজনে ওষুধের রদ বদল করেন। ঢাকায় অন্য কোন হোটেল বা আত্মীয় বাড়ি থাকার চেয়ে এই বিশ্রামাগারেই ক’দিন থেকে খেয়ে দিব্যি চলে তাদের। আসলে যুদ্ধে একবার আহত হলে…আমাদের মতো সম্পূর্ণ পঙ্গু না হলেও…শরীরটা আর কখনোই স্ববশে থাকে না। যত দিন যায় ততই ডিসএ্যাবিলিটির পার্সেন্টেজ বাড়তে থাকে। যার হয়তো দশ বছর আগেও হাতে, কোমরে বা পায়ে পাঁচ পার্সেন্ট ডিসএ্যাবিলিটি ছিল, দশ বছর পরে সেই ডিসএ্যাবিলিটি হয়তো বেড়ে পনেরো বা কুড়ি পার্সেন্টে দাঁড়ায়। যুদ্ধের পরও লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারা কেউ কেউ ১৯৮০-৮১ সাল নাগাদ হুইল চেয়ার বন্দী হয়ে এখানে চলে আসে নি বাকি জীবনের মতো? ঢাকার ভেতরেও যারা আধা অসুস্থ যোদ্ধা…যারা জীবনের স্রোত থেকে আমাদের মতো পুরোপুরি ছিটকে পড়েনি… তারাও কখনো কখনো চেক-আপ বা প্রেসক্রিপশন আপডেট রাখতে কি কখনো আমাদের মতো সম্পূর্ণ অচল হয়ে যাওয়া সাথিদের দেখতে চলে আসে। ইস্কান্দার সুস্থ, সবল মানুষ। দিব্যি চাকরি করছিল। তার হঠাৎ কী হলো? মনে আছে লক্ষ্ণৌয়ের সেন্ট্রাল মিলিটারি কমান্ড হাসপাতালে আমি ওর দিন পনেরো আগেই ভর্তি হয়েছিলাম। আমি আর মধু। ইস্কান্দার…ভিন্ন সেক্টর আর ভিন্ন এলাকা…১১ নম্বর সেক্টর আর টাঙ্গাইল থেকে যুদ্ধে আহত হয়ে এখানে এসেছিল। প্রথমে অবশ্য ওকে পাঠানো হয়েছিল মেঘালয়ের ‘তুরা টেন্টস্ হাসপাতালে।’ ইস্কান্দার আসার আগের দিনই দক্ষিণ ভারতীয় নার্স শ্রীলেখা আমাদের বলেছিল, ‘এ্যানাদার বাংলাদেশী বয় ইজ কামিং টুমরো ইন ইওর ওয়ার্ড।’ তামিল শ্রীলেখা কখনোই আমাদের সাথে হিন্দিতে কথা বলে নি। শ্রীলেখাই জানালো যে এই নতুন ছেলেটি অলরেডি এই হাসপাতালের পোস্ট অপারেটিভ সেকশনে বিশ্রামে আছে। আরো জানা গেল যে ‘তুরা টেন্টস্ হাসপাতালে’ পাঁচ দিন অচেতন থাকার পর সামরিক হেলিকপ্টারে করে লক্ষ্ণৌ হাসপাতালে গত পরশু দুপুর বারটায় পৌঁছানোর পরই কোমর আর মেরুদণ্ডের নিচে যেখানে গুলি লেগেছে সেখানে অপারেশন করে গুলি সরানো হয়েছে। দু’দিন ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে থাকার পর আগামীকাল সন্ধ্যায় তাকে আমাদের এই ওয়ার্ডে আনা হবে। আসলে লক্ষ্ণৌয়ের হাসপাতালে বসে আমরা সবসময়ই অপেক্ষা করতাম বাংলাদেশ থেকে, মুক্তিবাহিনী থেকে নতুন কেউ আসে কিনা!
…আহত হয়ে লক্ষ্ণৌ হাসপাতালে পড়ে থাকার ঐ দিনগুলোয় মুক্তিবাহিনীর কতজনই ত’ আহত হয়ে আসছে গেছে। ইস্কান্দারের আসার কথা এ কারণে মনে আছে যে ওর ঝোলায় ছিল ‘রূপসী বাংলা।’ স্ট্রেচারে করে সন্ধ্যায় যেদিন প্রথম আনা হলো তখন ওর হাতে স্যালাইন। অবশ্য সেন্স আছে। স্যালাইন তার খোলা হলো আর পরদিন সন্ধ্যায়। সেদিন আমাদের ওয়ার্ডের জানালা থেকে সন্ধ্যার রক্তবর্ণ আকাশ দেখে আমি কি ওর পাশের বেডে গুনগুন করে উঠেছিলাম: ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা!?’ সেই অবর্ণণীয় সঙ্কট মূহূর্তেও কি সুর ভেঁজেছিলাম?
…ইস্কান্দার তার সদ্য স্যালাইনের সুঁই মুক্ত হাত কিন্তু ব্যান্ডেজ বন্দি কোমর নানা কসরতে নাড়িয়ে বেডের পাশের টেবিল থেকে ওর ব্যাগ হাতড়ে একটা বই বের করলো। আমার দিকে বাড়িয়ে দিল, ‘এটা দ্যাখো!’
‘কি এটা? আরে ‘রূপসী বাংলা!’ও মিটিমিটি হাসে, ‘আমার মনে হয় আমি সেন্সলেস হবার পর আমাকে তুরায় পাঠানোয় সময় কল্যাণই আমার ব্যাগে জামা-কাপড়ের সাথে এটা দিয়ে দিয়েছে।’
‘কল্যাণ কে?’
‘টাঙ্গাইলের সাদত কলেজে আমরা একসাথে পড়তাম। একই সাথে যুদ্ধেও নাম লিখিয়েছি। একই ক্যাম্পে থাকতাম।’
‘দারুণ। তুমি কবিতা পড়ো?’
‘আকাশটা দ্যাখো। কেমন লাল!’
‘কল্যাণ কে?’
‘টাঙ্গাইলের সাদত কলেজে আমরা একসাথে পড়তাম। একই সাথে যুদ্ধেও নাম লিখিয়েছি। একই ক্যাম্পে থাকতাম।’
‘দারুণ। তুমি কবিতা পড়ো?’
‘আকাশটা দ্যাখো। কেমন লাল!’
ইস্কান্দার বইয়ের পাতা হাতড়ায়:
‘আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে
বসে থাকি; কামরাঙা-লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো
গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে- আসিয়াছে শান্ত অনুগত
বাংলার নীল সন্ধ্যা- কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে:’
বসে থাকি; কামরাঙা-লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো
গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে- আসিয়াছে শান্ত অনুগত
বাংলার নীল সন্ধ্যা- কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে:’
‘চমৎকার কবিতা পড়ো ত’ তুমি!’
‘এ আর কি? আমাদের সাঈদ ভাইয়ের আবৃত্তি যদি শুনতে?’
‘সাঈদ ভাই কে?’
‘আমাদের ক্যাম্পের টুআইসি ছিলেন। ফুলপুর থানা অপারেশনে আমাকে বাঁচাতে গিয়ে…’
‘কী হলো?’
‘কী আর হবে? আমি তার বন্ধুর ছোট ভাই বলে আমাকে আগলাতে গিয়ে নিজে মরলো। শুধু যদি মরতো! আমার চোখের সামনে মানুষটার নাড়ি-ভুড়ি সব তিন হাত কাছের কাঁঠাল গাছটায় জড়িয়ে গেল…পাঞ্জাবিদের শেলিংয়ে…অদ্ভুত ব্যপার কী জানো? মৃত্যুর আগের রাতে ‘রূপসী বাংলা’ থেকে আমাদের আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন…বিশেষ করে ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও’ কবিতাটি। দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে আবৃত্তি করে মৃত্যুর আগের রাতে যে ঘুমাতে গেল,পরের দিন সকালে একটা কাঁঠাল গাছেরই ডাল-পালা আর পাতায় রক্ত ও নাড়ি-ভুড়ি ছিটকে সে মারা গেল!’
‘এ আর কি? আমাদের সাঈদ ভাইয়ের আবৃত্তি যদি শুনতে?’
‘সাঈদ ভাই কে?’
‘আমাদের ক্যাম্পের টুআইসি ছিলেন। ফুলপুর থানা অপারেশনে আমাকে বাঁচাতে গিয়ে…’
‘কী হলো?’
‘কী আর হবে? আমি তার বন্ধুর ছোট ভাই বলে আমাকে আগলাতে গিয়ে নিজে মরলো। শুধু যদি মরতো! আমার চোখের সামনে মানুষটার নাড়ি-ভুড়ি সব তিন হাত কাছের কাঁঠাল গাছটায় জড়িয়ে গেল…পাঞ্জাবিদের শেলিংয়ে…অদ্ভুত ব্যপার কী জানো? মৃত্যুর আগের রাতে ‘রূপসী বাংলা’ থেকে আমাদের আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন…বিশেষ করে ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও’ কবিতাটি। দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে আবৃত্তি করে মৃত্যুর আগের রাতে যে ঘুমাতে গেল,পরের দিন সকালে একটা কাঁঠাল গাছেরই ডাল-পালা আর পাতায় রক্ত ও নাড়ি-ভুড়ি ছিটকে সে মারা গেল!’
‘দেখি, বইটা দাও ত’ আমাকে!’ আমি পাশের বেড থেকে হাত বাড়িয়েছিলাম।
ইস্কান্দার আমাকে বইটা দিলে আমি চোখ বুলাই,
‘তোমরা যেখানে সাধ চ’লে যাও- আমি এই বাংলার পারে
র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে
ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে
নেচে চলে- একবার- দুইবার- তারপর হঠাৎ তাহারে
বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে;’
র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে
ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে
নেচে চলে- একবার- দুইবার- তারপর হঠাৎ তাহারে
বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে;’
‘তোমাদের এই অপারেশনটা ঠিক কোথায় হয়েছিল?’
‘আসলে দ্যাখো, টাংগাইলের ফুলপুর থানাটা যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজিক কারণেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই থানার পাশেই ঘাপটি মেরেছিল পাঞ্জাবি, বিহারী আর রাজাকাররা। থানার একদম মুখোমুখি মুক্তিবাহিনীর‘চর বাংলা’ ক্যাম্প। এপ্রিল থেকে টানা যুদ্ধ চলছে। তখন ছিল নভেম্বর মাস। আসলে ১১ নম্বর সেক্টরের ছেলেদের প্রশিক্ষণ মেঘালয়ের তুরা পাহাড়েই হয়েছিল। নভেম্বর থেকেই মিত্র বাহিনী তার আড়াল সরিয়ে সরাসরি মুক্তিবাহিনীর ব্যাক-আপ করছে। কোন কোন জায়গায় সেপ্টেম্বর কি অক্টোবর থেকেই মিত্র বাহিনীর সরাসরি সাপোর্ট শুরু হয়েছে। তার আগে বর্ডার এলাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধই বেশি চলেছে। ১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর বেশির ভাগ ছেলেই কলেজের ছাত্র। এর ভেতর করটিয়ার সাদত কলেজের ছাত্ররা সবচেয়ে বেশি হারে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। টাংগাইলের আছিমতলায় ’৭১-এর ৪ঠা এপ্রিল ছাত্র-জনতার প্রথম সঙ্ঘবদ্ধ ও সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধেও কলেজের ছেলেরা অনেকেই ছিল।
‘আসলে দ্যাখো, টাংগাইলের ফুলপুর থানাটা যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজিক কারণেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই থানার পাশেই ঘাপটি মেরেছিল পাঞ্জাবি, বিহারী আর রাজাকাররা। থানার একদম মুখোমুখি মুক্তিবাহিনীর‘চর বাংলা’ ক্যাম্প। এপ্রিল থেকে টানা যুদ্ধ চলছে। তখন ছিল নভেম্বর মাস। আসলে ১১ নম্বর সেক্টরের ছেলেদের প্রশিক্ষণ মেঘালয়ের তুরা পাহাড়েই হয়েছিল। নভেম্বর থেকেই মিত্র বাহিনী তার আড়াল সরিয়ে সরাসরি মুক্তিবাহিনীর ব্যাক-আপ করছে। কোন কোন জায়গায় সেপ্টেম্বর কি অক্টোবর থেকেই মিত্র বাহিনীর সরাসরি সাপোর্ট শুরু হয়েছে। তার আগে বর্ডার এলাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধই বেশি চলেছে। ১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর বেশির ভাগ ছেলেই কলেজের ছাত্র। এর ভেতর করটিয়ার সাদত কলেজের ছাত্ররা সবচেয়ে বেশি হারে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। টাংগাইলের আছিমতলায় ’৭১-এর ৪ঠা এপ্রিল ছাত্র-জনতার প্রথম সঙ্ঘবদ্ধ ও সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধেও কলেজের ছেলেরা অনেকেই ছিল।
…কী বলতে কী বলা? নভেম্বর থেকেই মিত্রবাহিনী প্ল্যান করলো যে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলে হালুয়াঘাট থানা থেকে অপারেশন শুরু হবে। তারই অংশ হিসেবে ফুলপুর থানার পাশের ঘাঁটিকে টার্গেট ঠিক করা হয়েছিল। টুআইসি কমাণ্ডার আবু সাঈদ ভাই তার এই অল্পবয়সী সাবোর্ডিনেট যোদ্ধাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের কী ক্ষতিটাই না করলেন।
‘আমাকে সামনে আগাইতে দ্যান্’
‘ না- না- তুমি বাচ্চা ছেলে! আমার বন্ধুর ছোট ভাই- সরো!’
…জানো, আগের রাতে ক্যাম্পে রাতের খাবারের পর রেডিওতে কিছুক্ষণ ‘আকাশবাণী’র খবর আর‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’র চরমপত্র শুনবার পর এই আবু সাঈদ ভাই-ই আমাদের জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা থেকে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। গলাটা ভালই ছিল তাঁর; ক্যাম্পে রাতে খাওয়া-দাওয়ার শেষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’ কি ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ বা ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ গাইতে শুরু করলে আমরা ওর দোহার হতাম। সাঈদ ভাইই ছিল মূল গায়েন! বয়সে আমাদের বছর ছয়েকের বড়। আমরা সবে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছি আর আবু সাঈদ ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে তার জন্ম শহর টাঙ্গাইলে ছুটি কাটাতে এসেছে। মাস্টার্সের রেজাল্ট হতে আরো কয়েক মাস বাকি। চাকরি খোঁজা শুরুর আগেই হঠাৎই তো সেই ছোট বেলায় রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পড়া ডাকাত দলের মতো হা-রে-রে-রে করে আমাদের সবার ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়ল এই যুদ্ধ। আমাদের‘চর বাংলা’ ক্যাম্পে প্রায় পাঁচ/ছয় জন ছাত্র ছিল। ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও’ পড়ার পর সবাই মিলে তাকে বললাম:
‘সাঈদ ভাই, ‘যতদিন বেঁচে আছি’টা একটু পড়েন!’
‘আরে আমি একাই পড়বো নাকি? আসো, সবাই মিলে পড়ি!’
আমরা সবাই একসাথে আবৃত্তি করেছিলাম,
‘…আমি যে দেখিতে চাই,- আমি যে বসিতে চাই বাংলার ঘাসে;পৃথিবীর পথে ঘুরে বহুদিন অনেক বেদনা প্রাণে স’য়ে
ধানসিঁড়িটির সাথে বাংলার শ্মশানের দিকে যাব ব’য়ে,যেইখানে এলোচুলে রামপ্রসাদের সেই শ্যামা আজো আসে,…’
ধানসিঁড়িটির সাথে বাংলার শ্মশানের দিকে যাব ব’য়ে,যেইখানে এলোচুলে রামপ্রসাদের সেই শ্যামা আজো আসে,…’
…অপারেশনের দিনের সকালটা ছিল কুয়াশা ঢাকা। ফুলপুর থানা ক্যাম্পাসের চারপাশটা ছিল আম,জাম, কাঁঠাল আর হিজল গাছে যাওয়া। কেউ যেন ‘রূপসী বাংলা’র চরণগুলো সাজিয়েই রেখেছে। মাথার উপর ধূ ধূ নীল আকাশ। আকাশ যেখানে অপরাজিতার মতো আরো নীল হয়ে আকাশে হারিয়ে গেছে।…আমারও কোমর আর মেরুদণ্ডের নিচে গুলি লেগেছিল। আমি জ্ঞান হারাতে হারাতেই টের পেলাম আবু সাঈদ ভাই স্পট ডেড। অচেতন আমাকে কারা ‘তুরা টেন্টস্ হাসপাতাল’-এ পাঠালো কে জানে? সেখান থেকে আবার লক্ষ্ণৌয়ে মিলিটারি সেন্ট্রাল কমান্ড হাসপাতাল! আমার ব্যাগটা গুছিয়ে দেবার সময় আমাদের দলের কল্যাণ ‘রূপসী বাংলা’ও ব্যাগে দিয়ে দিতে ভোলে নি। তা’ হাসপাতাল মানেই ওষুধ, ইঞ্জেকশনের ভাঙ্গা এ্যাম্পুল, ডেটল-স্যাভলন-ফিনাইলের মিলিত গন্ধ, স্টিলের ট্রে-তে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যার খাবার, শাদা জামা পরা কবুতরের মতো নার্সের দল! সত্যিই এই বাংলা ছেড়ে আমাদের সাঈদ ভাইয়ের আর কোথাও যাওয়া হলো না!’
…বাতাসের চেয়ে দ্রুতগামী কে? মন। নয়তো আজ প্রায় বছর খানেক পর ইস্কান্দারকে বিশ্রামাগারের অফিস রুমে বিকাল পাঁচটার দিকে ঢুকতে দেখে…আমি যখন মাত্রই আমার হুইল চেয়ারটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অফিস রুমের পাশের টিভি রুমে ঢুকবার চেষ্টা করছিলাম…ওকে দেখে অফিস রুমেই হুইল চেয়ারটা সামান্য ঘুরিয়ে ঢুকে দু’একটা কথা না হতেই পুরনো এত কথা ধাঁ করে মনে পড়ে গেল?
‘শায়লা…আব্বুর ব্রেন টিউমার…ডাক্তার কী বলছে?’
‘আঙ্কেল…আব্বুকে ত’ একটা ক্লিনিকে ভর্তি করেছিলাম। গত পনেরো দিনে প্রায় ৬১/৬২ হাজার টাকা নানা মেডিকেল ইনভেস্টিগেশনেই শেষ হয়ে গেছে। ক্লিনিক থেকে ফোর্সড রিলিজ দেওয়ায় আব্বুকে বাসায় নিয়ে এলাম। এখন রিলেটিভদের কাছে যদি টাকা পয়সা কিছু ধার করা যায়,তাহলে আবার…আবার ভর্তি করবো…আর তেজগাঁর কল্যাণ ট্রাস্ট অফিস থেকেই আমাদের বললো এখানে এসে আব্বুর মোস্ট রিসেন্ট অসুস্থতার কাগজ-পত্র জমা দিতে। যদি চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা পাওয়া যায়! কিন্তু তেজগাঁ থেকে চিঠি পেতেই তিনটা বেজে গেল। পথে এত জ্যাম। এখানে আসতে আসতেই ত’ পাঁচটা বেজে গেল।’
‘হ্যাঁ, তোমাকে কাল সকালে আর একবার আসতে হবে। তোমাদের বাড়ির দখল নিয়ে কিছু ঝামেলা ছিল। ওটা মিটেছে?’
‘না, আঙ্কেল। সরকার থেকে সেই চুরাশি সালে জাকির হোসেন রোডে বিহারিদের একটা ফেলে যাওয়া বাড়ি আমাদের দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আজো ত’ সেটা কাগজ-কলমেই। আমরা ত’ এখনো তার দখল বুঝে পাই নি।’
‘একদিক থেকে তোমার আব্বু অনেক লাকি। ভারতের লক্ষ্ণৌয়ের হাসপাতালে আমরা পাশাপাশি বেডে ছিলাম। দু’জনেই তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। আমি সারা জীবনের মতো পঙ্গু, হুইল চেয়ার বন্দি হয়ে ফিরলাম। তোমার আব্বু অবশ্য সুস্থ হয়ে গেলেন। মনের জোরও ছিল। দেশে ফিরে ইন্টারমিডিয়েট- অনার্স-মাস্টার্স করে কল্যাণ ট্রাস্টে চাকরিও নিল। বিয়েও করলো। দিব্যি সুস্থ,স্বাভাবিক জীবন। শেষ জীবনে এমনটা ঘটলো কেন?’
‘সবই আল্লাহর ইচ্ছা, আঙ্কেল। আজ উঠি।’
বাবার হাত ধরে তাকে সাবধানে ওঠায় শায়লা। একটা কথাও বলতে না পারা…গলার স্বর ও এক চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলা ইস্কান্দার…লক্ষ্ণৌ হাসপাতালের বেডে সন্ধ্যা বেলায় কামরাঙা লাল আকাশ দেখে গঙ্গাসাগরে ডুবে যাওয়া মৃত মুনিয়ার কবিতা পড়া ইস্কান্দার…আমার দিকে তাকিয়ে অসহায় হেসে হাত নাড়ে।
লেখক পরিচিতি
অদিতি ফাল্গুনী
গল্পকার।
প্রবন্ধকার।
বই : অপৌরুষেয় ১৯৭১। নক্ষত্র, শাপলা, স্পার্টাকাস ও ভাসান যাত্রার গল্প। চিহ্নিত বারুদ বিনিময়। খঞ্জ হংসীর গান। অধিবর্ষ অপরিচয়ের । প্রবাল দ্বীপে টিয়া টিটো। মহাবিহারে টিয়া টিটো। কিফু কান দিন অথবা লক্ষ্ণী পাঁচালি ও ব্রতকথা। বাংলার নারী সংগ্রামের ইতিহাস। বানিয়ালুকা ও অন্যান্য গল্প।প্রবন্ধকার।
0 মন্তব্যসমূহ