ওরহান পামুক
অনুবাদ: মোজাফ্ফর হোসেন
তুমি কার জন্যে লেখো? গত ত্রিশ বছর ধরে—যখন থেকে লেখালেখি শুরু করেছি— এই প্রশ্নটা আমি পাঠক ও সাংবাদিকদের কাছ থেকে হরহামেশা শুনে আসছি। উদ্দেশ্যটা স্থান-কালের ওপর খানিকটা নির্ভর করে, কিন্তু তারা সবাই একই রকম সন্দেহবাতিক ও অনুসন্ধিৎসু ভঙ্গিতে প্রশ্নটা করেন।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে—যখন আমি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা আঁটছি—প্রশ্নটার একটা প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল সামগ্রিক ফিলিস্তিনের শিল্প ও সাহিত্য সম্পর্কিত ধারণার ওপর। তারা বিশ্বাস করতো—শিল্প ও সাহিত্য সৌখিনতার প্রতীক। ইউরোপের বাইরের দরিদ্র দেশগুলোর আধুনিকতার দিকে যে যাত্রা তা বড্ড
বেমানান। মানে তার উপযুক্ত সময় হয়ত এখনো আসেনি। সেখানে পরামর্শ দেওয়া হতো যারা শিক্ষিত ও কিছু করবার মতো ক্ষমতা রাখে তাদের জাতির জন্যে দরকারি কিছু করা উচিৎ; যেমন ডাক্তাররা মহামারীর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন, ইঞ্জিনিয়াররা সেতু বানিয়ে যেমনটি করছেন। (দার্শনিক সাঁৎ ১৯৭০-এর গোঁড়ার দিকে এই কথায় কান দিয়ে বলেছেন যে তিনি উপন্যাস লেখার কারবারে জড়াতেন না যদি তিনি বায়াফ্রার্ন বুদ্ধিজীবী হতেন)।
বিগত কয়েক বছরে এই প্রশ্নটা নিয়ে অনেক ভেবেছি কোন শ্রেণির পাঠক আমার বই পড়বেন এবং প্রশংসা করবেন সেটা নির্ণয় করতে। আমি জানতাম প্রশ্নটার মধ্যে একটা রাজনৈতিক গন্ধ আছে। যদি-না আমি বলতাম যে আমি সমাজের সবচেয়ে গরীব ও অবহেলিত মানুষদের জন্যে লিখি তাহলে সবাই ধরে নিতো আমি তুর্কির ভূস্বামী ও ধনিক শ্রেণিদের শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার জন্যে লিখি। এবং আমাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হতো যে শুদ্ধ চিন্তার ও মহৎ মনের অধিকারী লেখকরা যারা দাবী করেন যে তারা শ্রমজীবী ও নিুবিত্তদের জন্যে লেখেন তারা কেবলই কোনো রকমে লিখতে পড়তে জানে তাদের জন্যে লেখেন। সত্তর দশকে, যখন আমার মা জানতে চাইলেন আমি কার জন্যে লিখি—তাঁর থমথমে ও ভুরুকুচকানো ভাব দেখে মনে হল বিষয়টা তার কাছে বেশ গুরুত্বের—আরও জানতে চাইলেন আমি কীভাবে নিজেকে চালানোর কথা ভাবছি। এবংযখন বন্ধুরা জানতে চাইতো আমি কার জন্যে লিখি—তাদের বিদ্রুপটাকণ্ঠস্বরই বলে দিতো যে তারা বলতে চাইছে কেউ কোনদিন আমার মতো মানুষের লেখা বই পড়বে না। ত্রিশ বছর থেকে এই প্রশ্নটা আমি আরও বেশি করে শুনে আসছি। এটার কারণ হলো আমার উপন্যাস ইতোমধ্যে চলি−শটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিশেষ করে গত দশ বছরে আমার অসংখ্য সাক্ষাৎকার গ্রহীতা ভেবেছেন যে আমি তাদের প্রশ্নটা ঠিকভাবে নাও নিতে পারি তাই তারা যোগ করেছেন—আপনি তো তুর্কি বসে লেখেন, কাজেই আপনি কি শুধুই তুর্কিদের জন্যে লেখেন নাকি এখন যেহেতু নানান ভাষায় আপনার লেখা অনুবাদ হচ্ছে কাজেই সেই সব পাঠকদের কথাও আপনাকে ভাবতে হচ্ছে? আমরা তুর্কির ভেতর কিংবা বাইরে যেখানেই বসে বলি না কেনো প্রশ্নটা সবসময় সেই সন্দেহ ও অনুসন্ধিৎসু ভঙ্গিমায় আসে বলে বলতে বাধ্য হয় যে, যদি আমিপ্রার্থনা করি আমার লেখা সত্যি এবং খাঁটি শিল্প হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাক তাহলে আমাকে বলতেই হবে যে, আমি শুধুমাত্র তুর্কিদের জন্যে লিখি।
এখন শুধু প্রশ্নটাকে একটু খুঁটিয়ে দেখার আগে—আমাদের মনে রাখতে হবে যে উপন্যাসের উত্থানের সাথে সাথে জাতি-সত্তার বা রার্ষ্টের ও উত্থান ঘটেছে। যখন উনবিংশ শতকের মহৎ উপন্যাসগুলো লেখা হয়েছে, সবদিক থেকেই উপন্যাসের শিল্পটা ছিল একটা জাতীয় শিল্প। ডিকেন্স, দ¯য়— ভস্কি এবং তল¯য়— লিখেছিলেন উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণিদের জন্যে। উনিশ শতকে গুরুত্বপূর্ণ লেখদের উপন্যাসগুলো জাতীয় দৈনিকগুলোর শিল্প ও সাহিত্য পাতায় প্রম প্রকাশিত হতো কারণ মনে করা হতো তাঁরা সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে কিছু বলছেন। তাঁদের উপন্যাসের বক্তাদের মধ্যে একধরনের সচেতন দেশপ্রেমিকের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায় যাদের মূল কামনা হল দেশ ও দশের সমৃদ্ধি। উনিশ শতকের শেষ দিকে এসে উপন্যাস লেখার ও পড়ার বিষয়টা হয়ে দাঁড়ালো জাতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আজ উপন্যাস লেখার অর্থ সম্পূর্ণ ভিনড়ব। পড়ার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।
পরিবর্তনের সূচনাটা হয় বিংশ শতকের প্রম অংশ জুড়েই, যখন উপন্যাস হয়ে উঠলো আধুনিক এবং শিল্পের সর্বচ্ছ মর্যাদা পেল। যেভাবে গত ত্রিশ বছরে যোগাযোগের তাৎপর্য পাল্টে গেছে—বিশ্ব গণমাধ্যমের যুগে সাহিত্যিকরা আর প্রম শ্রেণির বক্তা হিসেবে বিবেচিত হয় না। তাঁরা আজ আর শুধু নিজ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বক্তা হিসেবেই বিবেচিত হন না, বরং তাঁরা এখন বিশ্বের সমগ্র পাঠকদের বক্তা। আজ সাহিত্য পাঠকরা
অপেক্ষা করেন মার্কেজ, কোয়েৎজি, অস্টারের একটি নতুন বইয়ের জন্যে যেভাবে তাদের পূর্বসূরিরা অপেক্ষা করেছে নতুন ডিকেন্সের। বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় একজন উপন্যাসিকের বাইরের পাঠকের সংখ্যা তাঁর নেটিভ পাঠকের থেকে অনেক বেশি। যদি সাধারণ অর্থে বলি—লেখকরা কার জন্যে লেখেন?—তাহলে বলতে হয় তাঁরা
তাঁদের আদর্শ ও যোগ্য পাঠকদের জন্যে লেখেন, তাঁদের কাছের মানুষ ও নিজেদের জন্যে লেখেন, আর কারও জন্যে নয়। এটাই সত্য, তবে আংশিক সত্য। কেননা আজকের সাহিত্যিকরা যারা তাঁদের পড়ে তাদের জন্যেও লেখেন। এখান থেকে বলাযেতে পারে, আজকের বিশ্বের সাহিত্যিকরা তাদের স্বদেশী মেজোরিটির জন্যে ণমেই
কম লিখেছেন (যারা তাদের পড়ে না)। তাঁরা লিখছেন বিশ্ব ব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাঠককুলের জন্যে যারা তাঁদের পড়ে।
বিষয়টাকে যারা বাঁকা চোখে দেখছেন তারা হলেন মতাদর্শ আরোপকারী এবং পশ্চিমের বাইরের মানুষ দ্বারা গঠিত বিভিনড়ব সংগঠন। বিশ্বে নিজেদের অবস্থান নিয়ে তারা যেমন অনিশ্চিত, তেমনই তারা চলমান জাতীয় সমস্যা বা ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় নিয়ে আলোচনায় বসতে অনিচ্ছুক—উপন্যাসিকদের মধ্যে এই দলের প্রতিনিধি যারা, যারা মনে করেন ইতিহাস ও জাতীয়তাবাদকে বাইরে থেকে দেখতে হবে তারা স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহবাতিক। তাদের মতে, যে সকল উপন্যাসিকরা তাদের জাতীয় পাঠকদের জন্যে লেখেন না তারা নিজেদের দেশকে অপরিচিত করে তুলে ধরে অন্যদেশের ভোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। এবং তারা এমন কিছু সমস্যার উত্তরণ ঘটাচ্ছে যার কোনো বা¯ব— ভিত্তি নেই। একই ধরনের সন্দেহ পশ্চিমেও আছে যেখানে অনেক পাঠক মনে করে যে সাহিত্য আঞ্চলিক, শুদ্ধ ও জাতীয় কেন্দ্রভিত্তিক হওয়া বাঞ্জনীয়। তাদের গোপন শঙ্কাটা হবে পৃথিবীর লেখক হয়ে অন্যদের ঐতিহ্য থেকে উপাদান সংগ্রহ করে নিজের খাঁটি হওয়ার সম্ভাবনা বানচাল না হয় সেই দিকে। এইভয়ে সবচেয়ে বেশি ভীত হয় একজন পাঠক যে বই খোলার সময় মনে মনে প্রার্থনা করে এবং পৃথিবী থেকে বিচ্ছিনড়ব একটা জগতে প্রবেশ করে, সে সেই জগতেরমানুষগুলোর হট্টগল এমন করে দেখতে চায় যেমন করে একজন পাশের বাড়ির বিবাদশোনে। যদি কোনো লেখক অন্য কোনো ভাষাভাষী পাঠকদের উদ্দেশ্য করে কিছুলেখেন তাহলেও এই ফ্যান্টাসিটা আর থাকে না।
কেননা প্রত্যেক লেখকের ভেতরে আকাঙ্ক্ষা থাকে খাঁটি হওয়ার, তাই এত বছরপরেও আমি খুশি হই কেউ জিজ্ঞেস করলে—আমি কার জন্যে লিখি। কিন্তু একজন লেখকের খাঁটি হওয়া না হওয়া নির্ভর করে সে তার পাশের জগতের সাথে কতটা মানিয়ে নিতে পারলো তার ওপর, মানে সে যত বেশি তার নিজের অবস্থান পরিবর্তন সম্পর্কে সজাগ হবে সে তত বেশি খাঁটি হবে। একজন আদর্শ পাঠক বলে আসলে কিছু নেই, ঠিক তেমনি একজন আদর্শ উপন্যাসিক বলেও কিছু নেই। কিন্তু সে স্বদেশী বাভিনদেশী যেখানকারই হোক না কেন, একজন উপন্যাসিক তার আদর্শ পাঠকদের জন্যেই লেখেন। প্রথমে তার অস্তিত্ব মনে মনে কল্পনা করে নেন এবং পরে মনের ভেতর তার উপস্থিতি ধরে নিয়ে লিখতে থাকেন।
তুমি কার জন্যে লেখো? গত ত্রিশ বছর ধরে—যখন থেকে লেখালেখি শুরু করেছি— এই প্রশ্নটা আমি পাঠক ও সাংবাদিকদের কাছ থেকে হরহামেশা শুনে আসছি। উদ্দেশ্যটা স্থান-কালের ওপর খানিকটা নির্ভর করে, কিন্তু তারা সবাই একই রকম সন্দেহবাতিক ও অনুসন্ধিৎসু ভঙ্গিতে প্রশ্নটা করেন।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে—যখন আমি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা আঁটছি—প্রশ্নটার একটা প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল সামগ্রিক ফিলিস্তিনের শিল্প ও সাহিত্য সম্পর্কিত ধারণার ওপর। তারা বিশ্বাস করতো—শিল্প ও সাহিত্য সৌখিনতার প্রতীক। ইউরোপের বাইরের দরিদ্র দেশগুলোর আধুনিকতার দিকে যে যাত্রা তা বড্ড
বেমানান। মানে তার উপযুক্ত সময় হয়ত এখনো আসেনি। সেখানে পরামর্শ দেওয়া হতো যারা শিক্ষিত ও কিছু করবার মতো ক্ষমতা রাখে তাদের জাতির জন্যে দরকারি কিছু করা উচিৎ; যেমন ডাক্তাররা মহামারীর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন, ইঞ্জিনিয়াররা সেতু বানিয়ে যেমনটি করছেন। (দার্শনিক সাঁৎ ১৯৭০-এর গোঁড়ার দিকে এই কথায় কান দিয়ে বলেছেন যে তিনি উপন্যাস লেখার কারবারে জড়াতেন না যদি তিনি বায়াফ্রার্ন বুদ্ধিজীবী হতেন)।
বিগত কয়েক বছরে এই প্রশ্নটা নিয়ে অনেক ভেবেছি কোন শ্রেণির পাঠক আমার বই পড়বেন এবং প্রশংসা করবেন সেটা নির্ণয় করতে। আমি জানতাম প্রশ্নটার মধ্যে একটা রাজনৈতিক গন্ধ আছে। যদি-না আমি বলতাম যে আমি সমাজের সবচেয়ে গরীব ও অবহেলিত মানুষদের জন্যে লিখি তাহলে সবাই ধরে নিতো আমি তুর্কির ভূস্বামী ও ধনিক শ্রেণিদের শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার জন্যে লিখি। এবং আমাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হতো যে শুদ্ধ চিন্তার ও মহৎ মনের অধিকারী লেখকরা যারা দাবী করেন যে তারা শ্রমজীবী ও নিুবিত্তদের জন্যে লেখেন তারা কেবলই কোনো রকমে লিখতে পড়তে জানে তাদের জন্যে লেখেন। সত্তর দশকে, যখন আমার মা জানতে চাইলেন আমি কার জন্যে লিখি—তাঁর থমথমে ও ভুরুকুচকানো ভাব দেখে মনে হল বিষয়টা তার কাছে বেশ গুরুত্বের—আরও জানতে চাইলেন আমি কীভাবে নিজেকে চালানোর কথা ভাবছি। এবংযখন বন্ধুরা জানতে চাইতো আমি কার জন্যে লিখি—তাদের বিদ্রুপটাকণ্ঠস্বরই বলে দিতো যে তারা বলতে চাইছে কেউ কোনদিন আমার মতো মানুষের লেখা বই পড়বে না। ত্রিশ বছর থেকে এই প্রশ্নটা আমি আরও বেশি করে শুনে আসছি। এটার কারণ হলো আমার উপন্যাস ইতোমধ্যে চলি−শটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিশেষ করে গত দশ বছরে আমার অসংখ্য সাক্ষাৎকার গ্রহীতা ভেবেছেন যে আমি তাদের প্রশ্নটা ঠিকভাবে নাও নিতে পারি তাই তারা যোগ করেছেন—আপনি তো তুর্কি বসে লেখেন, কাজেই আপনি কি শুধুই তুর্কিদের জন্যে লেখেন নাকি এখন যেহেতু নানান ভাষায় আপনার লেখা অনুবাদ হচ্ছে কাজেই সেই সব পাঠকদের কথাও আপনাকে ভাবতে হচ্ছে? আমরা তুর্কির ভেতর কিংবা বাইরে যেখানেই বসে বলি না কেনো প্রশ্নটা সবসময় সেই সন্দেহ ও অনুসন্ধিৎসু ভঙ্গিমায় আসে বলে বলতে বাধ্য হয় যে, যদি আমিপ্রার্থনা করি আমার লেখা সত্যি এবং খাঁটি শিল্প হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাক তাহলে আমাকে বলতেই হবে যে, আমি শুধুমাত্র তুর্কিদের জন্যে লিখি।
এখন শুধু প্রশ্নটাকে একটু খুঁটিয়ে দেখার আগে—আমাদের মনে রাখতে হবে যে উপন্যাসের উত্থানের সাথে সাথে জাতি-সত্তার বা রার্ষ্টের ও উত্থান ঘটেছে। যখন উনবিংশ শতকের মহৎ উপন্যাসগুলো লেখা হয়েছে, সবদিক থেকেই উপন্যাসের শিল্পটা ছিল একটা জাতীয় শিল্প। ডিকেন্স, দ¯য়— ভস্কি এবং তল¯য়— লিখেছিলেন উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণিদের জন্যে। উনিশ শতকে গুরুত্বপূর্ণ লেখদের উপন্যাসগুলো জাতীয় দৈনিকগুলোর শিল্প ও সাহিত্য পাতায় প্রম প্রকাশিত হতো কারণ মনে করা হতো তাঁরা সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে কিছু বলছেন। তাঁদের উপন্যাসের বক্তাদের মধ্যে একধরনের সচেতন দেশপ্রেমিকের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায় যাদের মূল কামনা হল দেশ ও দশের সমৃদ্ধি। উনিশ শতকের শেষ দিকে এসে উপন্যাস লেখার ও পড়ার বিষয়টা হয়ে দাঁড়ালো জাতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আজ উপন্যাস লেখার অর্থ সম্পূর্ণ ভিনড়ব। পড়ার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।
পরিবর্তনের সূচনাটা হয় বিংশ শতকের প্রম অংশ জুড়েই, যখন উপন্যাস হয়ে উঠলো আধুনিক এবং শিল্পের সর্বচ্ছ মর্যাদা পেল। যেভাবে গত ত্রিশ বছরে যোগাযোগের তাৎপর্য পাল্টে গেছে—বিশ্ব গণমাধ্যমের যুগে সাহিত্যিকরা আর প্রম শ্রেণির বক্তা হিসেবে বিবেচিত হয় না। তাঁরা আজ আর শুধু নিজ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বক্তা হিসেবেই বিবেচিত হন না, বরং তাঁরা এখন বিশ্বের সমগ্র পাঠকদের বক্তা। আজ সাহিত্য পাঠকরা
অপেক্ষা করেন মার্কেজ, কোয়েৎজি, অস্টারের একটি নতুন বইয়ের জন্যে যেভাবে তাদের পূর্বসূরিরা অপেক্ষা করেছে নতুন ডিকেন্সের। বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় একজন উপন্যাসিকের বাইরের পাঠকের সংখ্যা তাঁর নেটিভ পাঠকের থেকে অনেক বেশি। যদি সাধারণ অর্থে বলি—লেখকরা কার জন্যে লেখেন?—তাহলে বলতে হয় তাঁরা
তাঁদের আদর্শ ও যোগ্য পাঠকদের জন্যে লেখেন, তাঁদের কাছের মানুষ ও নিজেদের জন্যে লেখেন, আর কারও জন্যে নয়। এটাই সত্য, তবে আংশিক সত্য। কেননা আজকের সাহিত্যিকরা যারা তাঁদের পড়ে তাদের জন্যেও লেখেন। এখান থেকে বলাযেতে পারে, আজকের বিশ্বের সাহিত্যিকরা তাদের স্বদেশী মেজোরিটির জন্যে ণমেই
কম লিখেছেন (যারা তাদের পড়ে না)। তাঁরা লিখছেন বিশ্ব ব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাঠককুলের জন্যে যারা তাঁদের পড়ে।
বিষয়টাকে যারা বাঁকা চোখে দেখছেন তারা হলেন মতাদর্শ আরোপকারী এবং পশ্চিমের বাইরের মানুষ দ্বারা গঠিত বিভিনড়ব সংগঠন। বিশ্বে নিজেদের অবস্থান নিয়ে তারা যেমন অনিশ্চিত, তেমনই তারা চলমান জাতীয় সমস্যা বা ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় নিয়ে আলোচনায় বসতে অনিচ্ছুক—উপন্যাসিকদের মধ্যে এই দলের প্রতিনিধি যারা, যারা মনে করেন ইতিহাস ও জাতীয়তাবাদকে বাইরে থেকে দেখতে হবে তারা স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহবাতিক। তাদের মতে, যে সকল উপন্যাসিকরা তাদের জাতীয় পাঠকদের জন্যে লেখেন না তারা নিজেদের দেশকে অপরিচিত করে তুলে ধরে অন্যদেশের ভোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। এবং তারা এমন কিছু সমস্যার উত্তরণ ঘটাচ্ছে যার কোনো বা¯ব— ভিত্তি নেই। একই ধরনের সন্দেহ পশ্চিমেও আছে যেখানে অনেক পাঠক মনে করে যে সাহিত্য আঞ্চলিক, শুদ্ধ ও জাতীয় কেন্দ্রভিত্তিক হওয়া বাঞ্জনীয়। তাদের গোপন শঙ্কাটা হবে পৃথিবীর লেখক হয়ে অন্যদের ঐতিহ্য থেকে উপাদান সংগ্রহ করে নিজের খাঁটি হওয়ার সম্ভাবনা বানচাল না হয় সেই দিকে। এইভয়ে সবচেয়ে বেশি ভীত হয় একজন পাঠক যে বই খোলার সময় মনে মনে প্রার্থনা করে এবং পৃথিবী থেকে বিচ্ছিনড়ব একটা জগতে প্রবেশ করে, সে সেই জগতেরমানুষগুলোর হট্টগল এমন করে দেখতে চায় যেমন করে একজন পাশের বাড়ির বিবাদশোনে। যদি কোনো লেখক অন্য কোনো ভাষাভাষী পাঠকদের উদ্দেশ্য করে কিছুলেখেন তাহলেও এই ফ্যান্টাসিটা আর থাকে না।
কেননা প্রত্যেক লেখকের ভেতরে আকাঙ্ক্ষা থাকে খাঁটি হওয়ার, তাই এত বছরপরেও আমি খুশি হই কেউ জিজ্ঞেস করলে—আমি কার জন্যে লিখি। কিন্তু একজন লেখকের খাঁটি হওয়া না হওয়া নির্ভর করে সে তার পাশের জগতের সাথে কতটা মানিয়ে নিতে পারলো তার ওপর, মানে সে যত বেশি তার নিজের অবস্থান পরিবর্তন সম্পর্কে সজাগ হবে সে তত বেশি খাঁটি হবে। একজন আদর্শ পাঠক বলে আসলে কিছু নেই, ঠিক তেমনি একজন আদর্শ উপন্যাসিক বলেও কিছু নেই। কিন্তু সে স্বদেশী বাভিনদেশী যেখানকারই হোক না কেন, একজন উপন্যাসিক তার আদর্শ পাঠকদের জন্যেই লেখেন। প্রথমে তার অস্তিত্ব মনে মনে কল্পনা করে নেন এবং পরে মনের ভেতর তার উপস্থিতি ধরে নিয়ে লিখতে থাকেন।
1 মন্তব্যসমূহ
somriddho holam...
উত্তরমুছুন