অনিন্দ্য আসিফ
ওর আচরণ ঠিক আমাদের অনুমানকেই সমর্থন করে। নইলে যেন চরিত্রটা ঠিক ওর ব্যক্তিগত মনে হয় না। আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে সিঁড়ির পাঁচ দশ ধাপ মাড়িয়ে উঠে আসে এবং দশ মিনিটের প্রায় সবটাই ব্যক্তিগত বানিয়ে নেয়। কথা বলে চিবিয়ে চিবিয়ে, দ্রুত ও ধীরলয়ে, উচ্চ ও নিম্নতালে। তারপর সে নেমে যায় ঝড়ো বৃষ্টির ব্যস্ততায়। যেন সে একাধারে পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক। যেন এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা অথবা সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক।
সে বলে যায় যুক্তি অযুক্তির যৌথ মিশ্রনে। আমরা শুনে ও মেনে যাই ধর্মান্ধের মতো। আমরা বিরক্ত হতে পারতাম যদি না মনে পড়ত যে, এমনটিতে আমরা অনেক আগে অভ্যস্ত হয়েছিলাম। সে নিচে নেমে যাওয়ার পর আমাদের মুখোমুখি ঠোঁটটেপা হাসি জানিয়ে দেয়, এখনও অভ্যস্ত আছি।
কিন্তু মান্নাকে এই কথা বলার সুযোগ পাই না যে, আমরা একটি জটিল বিষয় সমাধানের জন্য বেরিয়েছি। তোমার কি সময় হবে?
আমি, খোকা ভাই আর পারভেজ দৃঢ়চিত্তে রাস্তায় নেমে পড়ি। আশুদা’কে খুঁজে বের করতে হবে। একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার দরকার। ব্যাপারটা কেবল প্রেস্টিজ ইস্যু নয়, বিজয়েরও।
আশুদা’কে খুঁজে বের করতে আমরা পথ হাঁটি ধীরে ও পা টেনে টেনে। দৃষ্টিগুলো কাছে ও দূরে সারিবদ্ধভাবে ছড়িয়ে। একদল গোয়েন্দার মতো সমবায় অফিসের সামনে, রং লিপির ভেতরে, ছোট ছোট চা’র দোকানে। আশুদা এই শহরের কোনও আড্ডার সাথে সংশি¬ষ্ট না। কখনও কখনও তবু চা’র আড্ডার ফাঁকে বিশেষ চোখ মেরে নিজেরাই নিজেদের দৃষ্টি নিজের মাঝে প্রতিফলিত করি। তারপর যখন হাঁপিয়ে উঠি তখন আড্ডা এড়িয়ে কখনও ব্যস্ততায়, কখনও বিড়ালের মতো পা ফেলে সতর্ক দৃষ্টিতে খুঁজি। একটা সময় পা দুটো শরীরের চেয়েও ভারি মনে হলে জাহাঙ্গীরের মোড়ে এসে আজহার বিল্ডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে আমি চোখ বন্ধ করে ধ্যানী মানুষের মতো দীর্ঘ নিঃশ্বাস টানি।
ছোট একটা হাই আড়াল করে পারভেজ বলে, এইটুকুতেই ঝিমিয়ে পড়েছ?
আমি চোখ বন্ধ রেখেই বলি, ঠিক ঝিমিয়ে পড়া নয়। বলতে পার কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকে পর্যবেক্ষণ করা। আচ্ছা, আশুদা’র শরীরের গন্ধটা কেমন? তেতো, আঁশটে, মিষ্টি, কোনটা?
ছবির মতো জ্যাম হয়ে থাকা নিজেদের মুখ দেখে টের পাই অনুসন্ধানে আমরা কতোটা মনযোগী ছিলাম। শরীরের স্বাদ বিষয়ক আমার উচ্চারিত বাক্য অনেকক্ষণ পরে পরস্পরের মুখে প্রাঞ্জলের মতো হাসির একটা উপলক্ষ এনে দেয়।
খোকা ভাই বলে, কবির শরীরের গন্ধ। অতএব কোমল ও বিদ্রোহী।
আমি বলি, চলুন বাসায় যাই।
খোকা ভাই বলে, আমি কখনও যাইনি।
আমি বলি, আমিও না।
পারভেজ বলে, অনেক আগে একবার গিয়েছিলাম।
‘অনেক আগে’-র উপর ভিত্তি করে কর্তব্য পালনকারীর মনোভাব নিয়ে পা চালাতে থাকি আমরা। আশুদা’র বাসার অদূরে বত্রিশের মূল রাস্তার পাশে আলো আঁধারিতে এসে দাঁড়াই। আমাদের শরীর ও দৃষ্টিতে রেসিং শেষে ঝিমুনোরত ঘোড়ার ক্লান্তি নামে। এবং ক্লান্তিটা ধীরে ধীরে নিকোটিনের মতো শরীরের কোষগুলোকে জ্যাম কিন্তু কামুক করে তোলে। আমাদের ভঙ্গিটা তাই বিচিত্র। যেন তিনজন একনিষ্ঠ মাতাল নিশাচর রমণীর অপেক্ষায় মনযোগী চোখ পেতে আছি। চোখ পেতে আছি রাস্তায়, তিনতলার বেলকনিতে, গলির ভেতর, দূরে ও অদূরে।
আমরা পরস্পর কী যেন বলে যাই। কিন্তু অদূরেই পুকুরের ওপাশে কীর্ত্তনের উচ্চশব্দের সাথে শহরের নানা প্রকার শব্দ মিলে অন্য সুর হয়ে বাজে আমাদের কানে। বিড়বিড় করে যাওয়া আমাদের ঠোঁটগুলো চলচ্চিত্রের অভিনেতাদের মতো কেবল নড়ে চলে। শব্দ যে বের হয় না তা কিন্তু না। তবু আমরা যেন প্রত্যেকেই আলাদা জাতি ও ভাষার লোক। কেউ কারোর কথা বুঝি না।
পারভেজ বিজলীর মতো দিয়াশলাই জ্বালিয়ে একটা সিগেরেট ধরায়। তারপর আগুন এবং আলোটা নিভে যেতেই যেন ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়ে গলির ভেতর।
আমি বলি, চিনবে তো?
পারভেজ কিছু বলে না। খোকা ভাইও নীরব থাকে একনিষ্ঠ নামাজীর মতো। নিরবতা তবু সে-ই ভাঙ্গে। দ্যোদুল্যমান কণ্ঠে বলে, এই গলিটা এতো অন্ধকার কেন? একটা বাল্ব দেয়া উচিত।
গলিটা আসলেই গুরুত্ব দিয়ে বলার মতো বেশ অন্ধকার এবং নির্জন। শহরের চাকচিক্য থেকে দূরে এক চিলতে মেঠোপথের মতো, যা নৈঃশব্দের সাথে অন্ধকার আর ঝিঁ ঝিঁ’র শব্দ মিলে শরৎচন্দ্রামলের বিদ্যুৎহীন রাতের গ্রাম হয়ে আছে।
আমি বলি, ভালই তো। শহরের ভেতর গ্রামের আস্ফালন।
সাথে সাথে গুনগুনিয়ে উঠি, অন্ধগলির এই যে আঁধার ...
সম্ভবত ওরা হাসে। হাসিগুলো পরিলক্ষিত হয় না। পারভেজ কুকুরের মতো বেশ সাবলীলভাবেই অন্ধকার জয় করে হেঁটে চলে। আমরা সিগেরেটের মাথায় আগুন দেখে দেখে গলির দু’একটা বাঁকের সাথে সম্পৃক্ত হই। তারপর উপলক্ষ ছাড়া প্রলাপের মতো করে বলে যাই, পুরনো এক উপন্যাসে পড়েছিলাম, সামনেই একটা বটগাছ। বটগাছকে কেন্দ্র করে সামনের দু’দিকে দুটো রাস্তা গেছে গ্রামের ভেতর। উত্তরের রাস্তাটা খানিক মাড়ালেই চোখে পড়ে পুরনো একটা মসজিদ। মসজিদের বাম দিকে যে রাস্তাটা আছে তার একপাশে একটা বড় পুকুর। পুকুরের বিপরীত দিকে চিকন আইলের মতো রাস্তাটার মাথায় একটা বড় কড়ই গাছ। তার দক্ষিণ পাশে যে টিনের বাড়িটা চোখে পড়ে সেখানে থাকে গল্পের নায়ক।
মনে হয় এবারের উপলক্ষটা শক্তিশালী। তাই খোকা ভাই আর পারভেজের পরিলক্ষিত হাসিটা বেশ শব্দায়িত হয়।
আমরা একটা মোড়ের মতো জায়গায় একটা বাল্বের আলোর পাশে এসে দাঁড়াই। পারভেজ আধপোড়া সিগেরেটটা আমার দিকে এগিয়ে বলে, আপাতত আর নেই।
আমরা তিনজন কোনও ব্যান্ডটিমের সদস্যদের মতো করে মুডি এবং ত্রিভূজাকৃতিতে দাঁড়াই। আমাদের দীর্ঘ ছায়ার মাঝখানটা একটা ড্রেনে ভেঙে তরলের মতো গড়িয়ে পড়ে রাস্তার ওপাশে।
সিগেরেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ভেতরে রেখেই আমি শীতল কণ্ঠে বলি, বিষয়টা ভালো করে ভাবার দরকার।
পারভেজ না বোঝার ভান করে শিশুর মতো প্রশ্ন করে, কোনটা?
আশুদা’কে সম্মান করতে আগ্রহী না এমন লোকেরাই তাঁকে পদক দিতে যাচ্ছে। ঠিক বলতে গেলে পদক শব্দের মৌলিক অর্থটাই যারা অনুধাবনে অক্ষম অথবা অনাগ্রহী।
আমি কথাগুলো বলি সহজ ও নীরবে। মান্না হলে উত্তপ্ত ও উত্তেজিত হতে পারতো। এই কথাগুলোর প্রেক্ষাপটে নানা প্রকার প্রসঙ্গ টেনে কাউকে সুযোগ না দিয়ে একাই বলে যেতে পারতো অনেকক্ষণ। চুল, চশমা, গোঁফ রেখে যারা নিজেদের ব্রাক্ষ্মন্যবাদীতার দায়ভার দারুণ কূটচালে ব্রাত্যজীবনের উপর চাপিয়ে দিতে চায় তাদের ফাঁকা চরিত্রটা তুলে আনতো নিখুঁত কিন্তু প্রকাশ্যে। বলতো, এরা পূর্বপ্রজন্মের কুফল এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য হুমকি। উল্টোটাও যে হতে পারতো না তেমন না। বলতে পারতো, ওদের নাকের ডগা দিয়ে আশুদা স্বীকৃতি আদায় করে নিবে, ভালতো। মন থেকে না হোক বিবেকের চাপ ওরা হজম করতে পারেনি, সেটাতো ইতিবাচকই। তাছাড়া ওটুকুই কোথায় পেলেন তিনি?
হ্যাঁ, সত্তর দশকের অন্যতম কবি পাওয়ার মতো করে পেলেন আর কী? তবু পদকটা প্রহসন হয়ে উঠলে তার আঘাতে হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ বইবে তা তো আজীবন বহমানই থেকে যাবে।
এখন রাত দশটা। যেভাবেই হোক আজ রাতেই আশুদা’কে নিয়ে বসতে হবে। একটা শিল্পিত সমাধান দরকার। আয়োজক কমিটি বিগত দিনের অক্ষমতাগুলো স্বীকার করে নিচ্ছে, ন্যূনতম এই বিষয়টা পরিষ্কার হওয়ার দরকার।
পারভেজ বলে, এখন তবে কী করা উচিত?
কীর্ত্তনের শব্দটা হঠাৎ থেমে যায়। এতোক্ষণ ওটাই ছিল জেগে থাকা শহরের প্রধান নমুনাপত্র। এই রাত দশটা এখন গভীর রাতের নির্জন অক্ষর। আশেপাশের বাসাগুলোর আনুষঙ্গিক ক্ষুদ্রতম শব্দগুলোও শ্র“তিগোচর হয় সহজে।
খোকা ভাই হঠাৎ উচ্চারণ করে বসে, পদক বর্জন।
আমরা দু’জন কম্পমান জলের মতো নড়ে উঠি। প্রথমে আমরা দু’জন পরস্পরের দিকে, পরে খোকা ভাইয়ের দিকে বিষ্ময়ের দৃষ্টিতে তাকাই। খোকা ভাইকে ব্যক্তিত্বের মতো গম্ভির মনে হয়।
পারভেজ বলে, কথাটা ক্লিয়ার না।
আশুদা’কে মৌলিক বিষয়টা জানানো উচিত। তারপর ঠিক উদ্বুদ্ধ না, পরামর্শ দেয়া দরকার যে আপনি পদক বর্জন করুন।
মান্না থাকলে সম্ভবত ক্ষেপে উঠতো। কিন্তু আমরা যেমন জানি, খোকা ভাইও জানে যে, আশুদা’র এমন সাহস নেই। সারা জীবন যে ব্যক্তিটি কবিতার জন্য ঘুড়ির মতো ছুটেছেন তিনি ন্যূনতম একটা পদক, একটা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেতেই পারেন। মান্না যে বিষয়টি ক্ষেপে গিয়ে বলতে পারতো আচমকা আমারও তাই বলতে ও ভাবতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পদকটি যে তারা দিচ্ছে না, হাত ফসকে যাচ্ছে, এই বিষয়টি আশুদা’কে বোঝানো উচিত।
একটা লোক পায়চারীর মতো করে আমাদের অতিক্রম করার সময় পারভেজ জিজ্ঞাসা করে, ভাই, আশুতোষ ভৌমিকের বাসা কোনটা?
লোকটা ডান হাতের সিগেরেটটা অগত্যাই দু’ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দিয়ে হাত নাড়িয়ে নাকে নাকে বলে, এই গলির মাথায় গিয়ে দেখবেন বামে আরেকটা চিপা গলি গেছে, তার মাথায় ডান দিকের বাসাটা ওনার।
আমরা এই গলি শেষ করে চিপা গলিতে শিকারির মতো সতর্ক পা ফেলি। এগুতে এগুতে পারভেজের উদ্দেশে বলি, একদিন রাত দুটোয় তোমার বাসায় গিয়ে উঠেছিলাম। মনে আছে?
আছে। এতো রাতে তোমাকে দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
এই রকম চিপাগলিতে থাকতে তোমরা। মেসে উঠে আমি নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এতো রাতে কোনোরকম ভুল ছাড়াই চিনে ফেললাম কীভাবে?
আমরা একটা লম্বা টিনচাল বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়াই। বিল্ডিংটির সামনে গ্রামের বাড়ির মতো বড় উঠোন। সবটা উঠোন অতিক্রম করে চাঁদের আলোর মতো আমাদের দীর্ঘ শীতল ছায়া পড়ে। অগত্যা কেন জানি মনে পড়ে প্রাচীনকালের তিনজন জ্ঞানীর কথা, যাঁরা সুদূর পথ হেঁটে শিশুপুত্র যিশুকে দেখতে বেথেলহেমে এসেছিলেন।
অন্তত আমি এবার বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি। এতোক্ষণ নিষ্ঠাবান শিষ্যের মতো যাকে খুঁজেছি, মনে হয় এবার তাকে পেয়ে যাব। মনে হয় আশুদা ঘরের ভেতরেই আছেন।
পারভেজ কড়া নীল দরজাটায় তিনবার টোকা দিয়ে আজানের মতো ডাক দিয়ে বলে, দাদা বাসায় আছেন?
ভেতর থেকে কোনও উত্তর আসে না। আমরাও রাজু ভাস্কর্যের মতো শরীরে গাম্ভীর্য্য এনে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকি। মিনিট খানেকের মধ্যে ভেতরের দিকে দরজার মুখে পায়চারির আওয়াজ শুনতে পাই। আমাদের দৃষ্টিগুলো পরস্পরের দিকে প্রশ্নবোধক হয়ে আঁচড়ে পড়ে।
আমাদের অযাচিত সংশয় আর উৎকণ্ঠাকে ম্লান করে আশুদা বেরিয়ে এলে আমরা তাকে প্রণামের ভঙ্গিতে অনেকটা প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো মাথা নত করে কোরাস কণ্ঠে বলি, গুরু কেমন আছেন? আমরা আপনাকে খুঁজছি।
আশুদা সম্ভবত রূপক ও ব্যাপকার্থে উচ্চারণ করেন, এখানে একজন দজ্জাল মহিলা আছে।
আমরা আমাদের ছায়াকে অতীতের মতো পেছনে ফেলে বত্রিশের মোড়ে এলে মনে হয়, অগত্যাই তখন গলিগুলোকে জটিল জ্যামিতিক বানিয়ে ফেলেছিলাম।
আমরা একটা ভাঙা হোটেলে আশুদা’কে উদ্দেশ্য এবং একটা টি-টেবিলকে কেন্দ্র করে পৌর্ণমাসী চাঁদের মতো গোল হয়ে বসি। এবং খুব শীঘ্রই আশুদা ‘এই শহরের কোনও আড্ডার সাথে সম্পৃক্ত না’ কথাটা ভিত্তিহীন পর্যায়ে নেমে আসে। কেননা নানান প্রসঙ্গপাতে তার প্রচলিত নিভৃতচারী আত্মাটা মুক্ত বাতাসের মতো উচ্ছ্বাসের ঢঙে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তিনি তার ডান হাতের তালুতে থুতুনি ডুবিয়ে নীরব কণ্ঠে বলেন, হ্যাঁ, বলছিলে আমাকে খুঁজছো। কেন?
টেবিলে চার কাপ চা রেখে হোটেলবয় মনযোগী ছাত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। যদিও প্রিয় চলচ্চিত্রের মতো এই আলোচনা তার ভাল লাগবে না অথবা অনুধাবন করতে পারবে না তবু পারভেজ বাম হাতের ইশারায় তাকে ভাগিয়ে দেয়। ডান হাতের পাঁচ আঙ্গুল কাপের মাথার সমান গোল করে ধীরে ধীরে এক পাক ঘুরিয়ে বলে, শুনেছেন তো, আপনাকে পদক দেয়া হচ্ছে?
আশুদা’র উচ্ছ্বাসটা বাতাসে কুপি বাতির মতো দপ করে নিভে যায়। একটা হাত চেয়ারের পেছনে রেখে যেন আমরা শুনতে পাইনি এমন নিচু এবং করুণ কণ্ঠে বলেন, হ্যাঁ, তন্ময় নাকি বাসিরুল এসে একবার বলে গেল। আর এটাও বলে গেল যে জাহাঙ্গীরের খুব একটা মত ছিল না যতোটা চাপে রেখেছে বাসিরুল।
আয়োজক কমিঠির নানা পর্যায়ের সুতো কারা টানছে, জানেন তো?
আশুদা কিছু বলেন না। তাঁর চোখে কী যেন কী, যা আগে কখনও দেখিনি, খেলা করে। বিষণ্নতা কাটিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, হ্যাঁ।
আমি ভাঙ্গা ব্রিজের মতো ঝুঁকে বলি, ভেবেছেন কিছু?
হ্যাঁ, ভাবছি, যাবো কি-না।
আমাদের প্রত্যেকের রঙধনুর মতো বাঁকা পিঠ সোজা হয়ে ওঠে। নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে ধরেই নিই পদকপ্রদান অনুষ্ঠানে আশুদা যাচ্ছেন না। অর্থ্যাৎ তিনি পদক বর্জন করছেন।
দীর্ঘ দিন থেকে অবহেলিত থাকার অভিমানেই হোক আর আয়োজক কমিটির কৃত্রিমতার কারণেই হোক, আশুদা পদক বর্জন করছেন ভেবে আমরা শ্যাম্পুমাখা চুলের মতো ফ্রি হই। তার লতার মতো জড়ানো শরীরে প্রবল ব্যক্তিত্ববোধের স্পষ্ট ছায়া আর চিন্তায় প্রহসনমূলক পদকের প্রতি অনীহা দেখে দারুণ লাগে।
এরকম সময়ে যেখানে দ্বিধাগ্রস্থ থাকার কথা সেখানে আশুদা’র খুব সাবলীল এবং নিশ্চিন্তে চা খাওয়ার দৃশ্য দেখে মনে হয়, ‘হ্যাঁ, ভাবছি, যাবো কি-না’ বাক্যটা দীর্ঘ সময় ধরে তার ওপর ভারি কোনও পাথর হয়ে ছিল। তিনি চা’এ চুমুক দিয়ে চাঁদের মতো মুখ তুলে বলেন, তারপর তোমাদের মধ্যে থেকেই তো একজন বলে বসবে, দাদা কাজটা কিন্তু ঠিক করলেন না।
আমার ভেতরটা কাপের ভেতর চা’র মতো মোচড় দিয়ে ওঠে। আমরা নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় প্রাক্কালে লক্ষ করি পরস্পরের চোখে যুগপৎ রহস্য আর সংশয়ের এক জটিল মিশ্রণ রোমন্থন করে। আশুদা কি সত্যিই এমন কিছু আন্দাজ করছেন? তাই যদি হয় তবে কে এমন প্রশ্ন করতে পারে?
আশুদা চা’র কাপ রেখে শীতের রাতের মতো দু’হাত গায়ে জড়িয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেন। তাকে অবিচল আর স্মিতহাস্য দেখায়। কোনও উদ্বেগ নেই, উষ্মা নেই, কোনও কিছুর তাড়া নেই, ‘ভবিষ্যত একটি তন্ময়াচ্ছন্ন শব্দ’ তার চোখে এমন কোনও জিজ্ঞাসাও নেই । এ যেন দ্যা ভিঞ্চি’র বিখ্যাত ‘লাস্ট সাপার’-এর সংশোধিত অথবা পুনঃচিত্র।
রাত এগারোটা’র দিকে আমরা আশুদাকে ছেড়ে আসি। তাকে খুঁজতে গিয়ে যে ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল তাতে মনে করেছিলাম আলোচনায় একটা ঘাপলা থেকেই যাবে। কিন্তু খুব সহজেই আমরা বদ্দমূল এই বিশ্বাস নিয়ে ফিরি যে আশুদা পদক বর্জন করছেন। তবু আমাকে একান্ত নীরব দেখে পারভেজ বলল, তোমাকে খুব বিষণ্ন লাগছে।
তখন কিছু বলতে হবে বলেই বলে ফেলি, পদকতালিকায় আশুদা’র নাম অন্তর্ভুক্তিতে যদি মুখলেছের বড়ো কোনও ভূমিকা থেকে থাকে তবে পদকবর্জনে তার ইগোতে খুব লাগবে।
খোকা ভাই বলে, ও ট্যালেন্ট। ব্যাপারটা বুঝবে।
আমি আশ্বস্ত হই। তবু আমরা প্রথম একনিষ্ঠ মাতালের মতো যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে এসে আমি ঢুলুঢুলু ভোরের মতো নীরব ও মাতাল কণ্ঠে বলি, কী মনে হয়, আশুদা পদক বর্জন করবেন?
1 মন্তব্যসমূহ
Dear Asif
উত্তরমুছুনKARL MARX wrote on“Communist Manifesto” in Chapter-IV
“The proletarians have nothing to lose but their chains.”
Well done & keep it up