যুগল ডিঙির মতো করপুট জোড়া বুক বরাবর তুলে
মোনাজাত করছেন তিনি। মুদিত দুচোখ; আসরের নামাজ শেষ প্রায়। আট বছর বয়সে মায়ের কাছে নামাজ শেখেন তিনি।
শুকনো বাঁশপাতার মতো তামাটে
দুই ঠোঁট বিড়বিড় করে কাঁপছে।
সামনের জানালা খোলা—পীতবর্ণের গ্রিল ভেদ করে তাঁর চোখেমুখে আছড়ে
পড়ছে মৃদু বাতাসের উড়াল; সাদা
শাড়ির আঁচলটুকু দোল খাচ্ছে বার বার। বাইরে আমসুপুরির ঘনবন।
দূরে টলটলে পানির স্বচ্ছ
পুকুর—পাড়ে
বাঁশঝাড়,
নারকেল গাছের সারি, সবুজ ধানক্ষেত ; এক পলকে চোখে পড়ে।
তাঁর পেছনে পুরোনো খাটের
এক কোণায় বসে পড়ে টোটন।
দীর্ঘ মোনাজাত মেজদাদির
সারা জীবনের অভ্যেস ।
বাবামা ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী ও দেশবাসীর জন্যে প্রতিনিয়ত
দোয়া করেন তিনি,
দোয়া করতে থাকেন তিনি। ১ লাখ ৬৮ হাজার মাখলুকাতের জন্যে শুভ কামনা
করেই না তাঁর এই দোয়া শেষ হয়।
দাদির এই দীর্ঘ মোনাজাতের পূর্বসূত্র সে
বোঝে না। আশিকচাচুর কী কোন অসুবিধে, আসিফচাচু কী আবার কোন নতুন চাকুরির জন্যে
ছুটছে -তার জন্যে তো আমরা পাত্রী খুঁজছি।
তারপরও দাদির এই মোনাজাত
সহজে ফুরোয় না কেন ? কারো
কোন পরীক্ষা আসন্ন কিনা,
কেউ নতুন করে মামলা মোকাদ্দমায় জড়িয়ে পড়ল কিনা, কাছের দূরের আত্মীয়স্বজনের কেউ অসুস্থ হয়ে
পড়ল কিনা এসব বিষয় টোটন মনে করতে চেষ্টা করে।
মাঝে মাঝে সকালে সাড়ে
আটটা-নয়টার দিকেও তাঁকে নামাজে দেখা যায়, এত নামাজ কিসের টোটন তা বোঝে না। একদিন সে মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিল সকালের
এই নামাজের নাম কী ? মা
তাকে উল্টো ধমক দিয়ে বলেন এসব জেনে তোর কোন লাভ নেই।
পরে সে ঠিকই জেনে নেয়
এটি চাশতের নামাজ—নফলি এবাদত। সে পাশের টেবিলে, খাটের কিনারে আর শোকেসের উপরে চোখ বুলোয়
বার বার। না, পিতলের ঝকঝকে পানের বাটাটা কোথাও দেখে না
সে। এক
টুকরো সুপুরি চিবুলে মুখের ভেতো গন্ধটা দূর হত বলে মনে হয় তার।
সে আবার দাদির দিকে তাকায়-এখনো গভীর মোনাজাতে নিমগ্ন।
সে ধীরে ধীরে ঘরের বারান্দায়
আসে;
মনের অজান্তে উঠোনে এসে
দাঁড়ায়। বকুলচাঁপার ছায়ায় দাঁড়িয়ে সামনে মেইন রোডের দিকে তাকিয়ে থাকে
সে।
টোটন বোঝে দাদা মারা যাবার পর মেজদাদি হঠাৎ
যেন বদলে গেলেন। গভীর
মমতায় তাঁর দুহাত এখন প্রসারিত-লোটন আর শিরু সারা দিন তাঁর সঙ্গে সময় কাটায়, তাঁর সঙ্গে খায়, তাঁর সঙ্গে ঘুমোয়।
সে যখন প্রথমে স্কুলে
যাওয়া বন্ধ করে দেয় তাতে তিনি নাখোশ হন। তার মা আর জাফরচাচাকে ডেকে বার বার বলে দেন
সে যেন আবার ক্লাসে ফিরে যায়। সপ্তাহ খানেক টোটনের সাথে কথা বলা বন্ধ রাখেন
তিনি;
লোটন ও শিরু আর স্কুল
ছাড়েনি -
এই ফাঁকে দাদির সঙ্গে
ছোট দুই ভাইবোনের হৃদ্যতা বাড়তে থাকে।
এদিকে সে তেমন আসে না— দাদির কোন ফুট ফরমাস থাকলে আবার মায়ের অনুরোধে
নিজেদের প্রয়োজনে তাকে আসতে হয়।
কাঠবাদাম গাছের নিচে খালি পায়ে ময়লা লুঙ্গি
পরে একা দাঁড়িয়ে আছে সে। ১৩-১৪ বছরের এই শিশুটি এখন স্কুলে থাকার
কথা। কপাল
ভাঙ্গলে যা হয়—দুই বছর আগে বাবা মারা গেলে আজ তার এই দশা।
অসময়ে বাবা মারা যাওয়ায় তাদের বিড়ম্বনা বেড়েছে আরো বেশি।
মুসলিম ফারায়েজ মতে দাদার আগে বাবা মারা
যাবার কারণে পৈত্রিক বিষয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী তারা হয়নি।
টোটন, তোমার বাবা কই ? চাচা জাফরকে খুঁজতে আসে এনজিও কর্মী মতিন
সাহেব। টোটনরা
পারিবারিক রেওয়াজ মাফিক চাচাদের ‘বাবা’ বলেই
ডাকে। আর
বাবাকে বলে আব্বু।
না, সে অনেকের মত এখন আর স্কুলে যায় না।
অবহেলা ও নিয়তির শেকলে
বন্দি বলেই এই কক্ষচ্যূতি —যারা দল বেঁধে পাহাড়ে কাঠ কাটতে যায়, খালে বিলে মাছ ধরতে যায় অথবা শহুরে টোকাইর
মত গ্রামের পথে মাঠে বিলে ঘুরে ঘুরে গোবর সংগ্রহ করে, তাদের জন্যে অপেক্ষা করে সে।
কাদের, কালাম, বেলায়েত ও আসমারা কখন বাড়ি ফিরবে এই প্রত্যাশায়
সে প্রহর গোনে। সে
হয়তো তাদের সঙ্গে যায় না-তারপরও
কৈশোরের এই সময়টুকু তেমন কোন কাজের কাজে ব্যয় করে না সে।
সে কখনো কোদাল হাতে বেরিয়ে
পড়ে ঘেঁচু খুঁড়তে যায়। কোন দিন ভাঙ্গাখালির ডোবা হতে শাপলাশালুক
তুলে আনে আবার
সাগর পাড়ে ঘুরে ঘুরে ঝিনুকশামুক কুড়োয় । কিশোরকালে এতিম হওয়ায় যারা পড়ালেখা করে না
অথবা ছেড়ে দিয়েছে তাদের সঙ্গেই টোটনের দিন দিন সখ্য বেড়ে ওঠে ।
সন্ধ্যায় শফিমামার দোকানে
বসে কিশোরতরুণদের মিলনমেলা—স্যাটেলাইট চ্যানেল নয়; ডিভিডি প্লেয়ারে চলে হিন্দি ছবির উদ্দাম
নৃত্য। সেখানে
তার সময় কিছুটা ভালো লাগে; এক স্বপ্নহীন বিভ্রান্তির মাঝে জীবন কাটে।
সবার অগোচরে একদিন দাদুবাড়ির
বাগান হতে সুপুরি
নারকেল বিক্রি শুরু করে সে। এখন সে একটি মোবাইল ফোনের মালিক। এতে বন্ধুদের মাঝে তার কদর যে একটু বেড়েছে-সে তা বেশ বুঝতে পারে।
‘আঁর টোটার ভাগ কেঅ নফাইব, আঁই ইতারার ভাগ ফাই ফাই গরি লেকি দিয়ম।’—দাদু হাজি আবদুল মাবুদ এই কথা হরহামেশা বলে
থাকলেও তা’ তিনি তা করে যেতে পারেন নি।
টোটনের বাপ—বড়ছেলে মোস্তফা মারা যাবার সাড়ে চার বছর
পর তিনি বুকব্যথায় আকষ্মিকভাবে মারা যান। হ্যাঁ, বেলি—টোটনের মা, এখনো মোস্তফাদের বাড়িতেই আছে।
টোটন, লোটন ও শিরুকে নিয়ে দক্ষিণের বারান্দায়
কুঁকড়ে পড়ে থাকে সে। সে জানে ভাইদের সংসারে তাদের কোন আশ্রয় হবে
না। ঘরের উঠোনে, খালেবিলে হাস মুরগি পালে এবং বাড়ির পাশে
এক চিলতে উঁচু জায়গায় বেগুন শিমের ক্ষেত করে ।
জাফর আর জা হাসিনার দয়ার
উপর ভর করে সে আকালটুকু সময় পার করে।
এই তিনজন ছেলেমেয়েকে নিয়ে
বেলির সময় যেন কাটে না।
রাতজাগা নিঃসঙ্গ ডাহুকির
মত শরীর আর মন অকস্মাৎ এক সঙ্গে কেঁদে ওঠে। এই
বিড়ম্বিত জীবনের জন্যে অবচেতন মনে বাবার কঠোরতা
আর নিয়তিকে দায়ি করে আর ভাবতে থাকে আশিকের কথা।
তখন তার অফুরন্ত অবসর। এসএসসি পরীক্ষা সবে শেষ—ফল বেরোতে এখনো দুই মাস বাকি। প্রতিবেশী নাহিদা আপুর বিয়ের অনুষ্ঠান- পাশের
গ্রামের আশিককে দেখে সে সংবিৎ হারিয়ে ফেলে । সারা
শরীর শির শির করে জেগে ওঠে, বুকের ভেতর শূন্য
বিরানভূমি আড়মোড়া ভেঙ্গে বাজপড়া মাটির মতো কাঁপতে থাকে । আর তার চোখেমুখে যেন অন্য এক অনুভূতি ফুটে
ওঠে। সে বুঝতে পারে না কীভাবে এগিয়ে যাবে—পরিচিত হবে— নিজেকে উন্মোচন করবে অজানা এই তরুণের কাছে। যখন সবাই বিয়ের আনন্দ আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে
মশগুল একসময় তারা বিয়েবাড়ির ছাদে এককোণায় বসে প্রাণখুলে হৃদয়ের লেনদেনের দিকে এগুতে
থাকে। রফিকমামা- ধ্যানমগ্ন বক পাখি; বিষয়টি পরখ
করেন। দুজনের শিক্ষা ও সুনামের কথা ভেবে তিনি তা
কাউকে বলেননি তখন।
পরে মামার হস্তক্ষেপ আর
বাবার কঠোর সিদ্ধান্তে পড়ালেখায় ছেদ পড়ে। বিয়ের
পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয় বেলি।
সে বারবার বলেছে, বোঝাতে
চেষ্টা করেছে যে সম্পর্কটি গড়ে ওঠেনি ; অঙ্কুরে যার মৃত্যু তার জন্যে এ রকম কঠোর শাস্তি
কেন?
সকালে হাসান সাহেব বাজারে যাচ্ছেন। প্রতিদিনের মত বেলির হাত থেকে ফর্দটি নিয়ে
পকেটে পুরে রওয়ানা হন তিনি।
গন্তব্য ইকবালের মুদির
দোকান। সহকারির পাশেই বসে আছেন ইকবাল সাহেব। সহকারি ফর্দটি হাতে নিয়ে যেন আকাশ থেকে পড়ল। নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ির চালকের মত খেই হারিয়ে
ফেলে সে। আর এটি আমতা আমতা করে পড়ে ইকবাল সাহেবের
দিকে এগিয়ে দেয়। ইকবালও একবার চোখ বোলালেন আর হাসান সাহেবকে
ফেরত দিয়ে বললেন—‘চাচা,
সরি; এটি বাজারের ফর্দ নয়।
বাজারফর্দ নিয়ে আবার আসবেন।’—তারপর দীর্ঘদিন বাবামেয়ের সকল সম্পর্ক যেন চিরতরে
বন্ধ। সেদিন সকালে বাজারফর্দ মনে করে আশিকের কাছে
লেখা চিরকুটটুকু বেলি বাবার হাতে তুলে দেয় ভুলে। উর্ঘুম রাতের বিভ্রান্তি আর সকালের তন্দ্রামগ্নতা
তার জীবনকে স্বপ্নহীন-ছন্দহীন মরা কাঠে পরিণত করে।
আশিক জানে - এবারের জো-তে পানি বেড়েছে পাঁচগুণ বেশি।
শত শত চিংড়িঘের রাক্ষুসী
জোয়ারে তলিয়ে গেছে। ফসলিজমিতে পানি আটকে আছে দেড়মাস ধরে।
প্রতিদিন সকালে তাঁরা
হালের বলদ আর লাঙ্গল নিয়ে মাঠে যায়-পানির এই অনড় অবস্থান দেখে ম্লানবদনে ফিরে
আসেন। কৃষক ও মাছচাষিরা চোখে মুখে যেন সর্ষে ফুল
দেখছেন। যাঁরা
সমবায়ের নামে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে চিংড়িঘের গড়ে তুলেছেন, ফসলিজমি আগাম নিয়েছেন-তাঁদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
তাঁরা জানে এনজিও কর্মীদের
কাছে এসব বলে পার পাবার কোনো উপায় নেই। সপ্তাহ শেষে কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না
পারলে চোখের সামনে গোয়লের গরু বা চালের টিন
নিয়ে টানাটানি করতেও তাঁদের রুচিতে বাঁধবে না।
হেতালিয়া, বাটাখালি, পানখালি ও রামপুরার চিংড়িঘেরের মালিকদের
এই দুঃখ বোঝার কেউ নেই।
পূর্ণিমা আর অমাবশ্যায়
পানি বাড়ে । সমুদ্রের
ঢেউ পাগল হয়ে আছড়ে পড়ে উপকূলে- অরক্ষিত গ্রামগুলোতে, ধানক্ষেতে ও চিংড়িঘেরে।
এর জন্যে তাঁদের প্রয়োজনীয়
প্রস্তুতিও থাকে। মজুরি
দেয়ার বাড়তি টাকা হাতে রাখে;
পাহাড়িকাঠের গোড়ালিও তাঁরা
মজুদ করে। না
এবারের পানি কোন চেষ্টা ফিকির মানেনি। বেড়িবাধ ভেঙ্গে মাটির সাথে একাকার হয়ে মিশে
গেছে ছোট বড় শতশত চিংড়িঘের, বিলের পর বিল ধানিজমি স্রোতের তোড়ে ভেসে
গেছে। তাঁরা
প্রতি শুক্রবারে জুমার নামাজে মসজিদে মসজিদে সিরনি দেন, পিরদরবেশদের দরগায় মাজারে মানতের পর মানতের
হিড়িক পড়ে- না, এবারের যাত্রায় তাঁরা কেউ রেহাই পায়নি। গত দুই দশকের বিরূপ প্রকৃতি উপকূলে নিয়ে
এসেছে বিপর্যয় বিপত্তির দীর্ঘ ধারা-অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ঝড় ও ভূমিকম্পের অসহনীয় দুর্যোগ দিন দিন
বেড়ে চলছে। এবার
যুক্ত হয়েছে আর এক নতুন নাম—সুনামি আতঙ্ক।
এখানে পাহাড়ের কোলে ঢালু ভাঁজে গড়ে ওঠেছে
বসতি। এঁরা
অনেকেই মূলদ্বীপের আদি অধিবাসী নয়। সোনাদিয়া, ধলঘাট, মাতারবাড়ি, উজানটিয়া, কালাপাড়া আর কুতুবদিয়ার ঘূর্ণিপীড়িত উদ্বাস্তু
লোকজন গ্রামের মূল স্রোতের অদূরে অনুচ্চ পাহাড়ের টিলায় টিলায় বসতি গড়ে তোলে।
এখন তা বাড়তে বাড়তে পাহাড়ি
গ্রামের সংখ্যা প্রায় সমতলের গ্রামের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি।
শন আর মাটির দেয়ালে তৈরি
এই বাড়িগুলো সবুজ গাছ গাছালিতে ঢাকা - প্রতিটি পাড়ায় বেশ কিছু টিনের ঘরও সহজে চোখে
পড়ে। গ্রামের
পাহাড়গুলোয় মাঝে মাঝে লোকজন ব্যক্তিগত তদারকিতে জন্মিয়েছে নানা জাতের বনজফলজ গাছের
বাগান । ফাঁকে
ফাঁকে পানের বরজ আলাদা সৌন্দর্যে পাহাড়ের ঢালে ঢালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
আশিকের মনে আছে-পনের বিশ বছর আগেও পাহাড়গুলোর গহন বনে মানুষের
যাতায়াত ছিল একান্ত কষ্টসাধ্য। তার চাচুরা তখন দল বেধে হরিণ শিকারে যেত।
বিভিন্ন বুনোপ্রাণীতে
এই পাহাড়ি বন ছিল ঠাসা-বানর, হরিণ, বনমোরগ, বনবেড়াল ,শুকর, হাতির অভয়ারণ্য ছিল দ্বীপের এই উঁচু নিচু
পাহাড়ের দীর্ঘ সারি।
পাহাড়ের ভেতরে গহীন অরণ্য
ছিল বনবিভাগের সেগুনবাগিচায় ঠাসা।
পাহাড়গুলোতে গামারি, গর্জন, সেগুন ও কড়াই গাছের ঘন অন্ধকারে যে কারো
দিক হারিয়ে যেত। এই পাহাড়ি বন ভেঙ্গে আড়াআড়ি গিরিপথে দুতিন
ঘণ্টা হাঁটলে দ্বীপের পূর্ব প্রান্তে শাপলাপুর। সেখানেই ছিল বড়ফুফুদের বাড়ি।
বনের কাঠ দিয়ে তৈরি হতো
ডিঙি,
পালতোলা নাও, মাছধরার নৌকা আর যাত্রীবাহী বিশাল সাম্পান। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন পাক হানাদারবাহিনী
যখন শত শত বাড়িঘরে আগুন দেয়- হরিয়ারছড়া, পুঁইছড়া, পদ্মপুকুরপাড়া, বড়ছড়ার হিন্দুনারীদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে
দিবানিশি পাশবিক নির্যাতন চালাতে থাকে-দ্বীপের দীর্ঘপাহাড়, গভীরবন স্বাধীনতাকামী নারীপুরুষকে মায়ের
ভালোবাসায় বুকে আগলে রেখে আশ্রয় দেয়; রক্ষা করে ।
আশিকদের চোখের সামনে সময়ে
সময়ে রাজনীতির ভোল পাল্টিয়ে তাদের পরিচিত লোকজন—বশির হাশেম রাজ্জাক মনু নেয়ামতরা বছরের পর
বছর এই বন উজাড় করেছে। এই লোভী মানুষগুলোর সর্বভূক নেশায় উঁচু নিচু পাহাড়ের সুদীর্ঘ সারি ন্যাড়া মাথায় ঠায়
দাঁড়িয়ে আছে। এই
লোকগুলোর—
চেয়ারম্যান,
এমপি ও থানাপুলিশের সাথে দহরম মহরম ভাব—হাত অনেক লম্বা।
এই দ্বীপের চারপাশে যেন সোনার খনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে-উপকূলের প্যারাবন কেটে তারাই তো গড়ে তোলে
চিংড়িঘের। হাজার
হাজার একর ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এভাবে উজাড় হয়- উপকূলীয় মানুষের জীবনে নেমে আসে ঘূর্ণিঝড়।
আশিক কখনো ভুলবে না ১৯৯১
সালের ২৯ শে এপ্রিলের ভয়াল রাতের নারকীয় তাণ্ডবের
করুণ কাহিনি। বাতাসের গতি দ্রুত বাড়ে; সমুদ্রে ওঠে উত্তাল
সাইক্লোন। সাগরের ঢেউগুলো ফুলতে ফুলতে বিশাল বিপুল
পাহাড়ের মতো দেখায়,
ভয়াল গর্জনে গোঙাতে গোঙাতে ফুসতে ফুসতে উপকূলে আঘাত হানে।
নিমিষেই তলিয়ে যাওয়া গ্রামগুলো
লাশের স্তুপে মৃত্যুপুরীতে রূপ নেয়। আকাশে ফড়িঙের মত ওড়তে থাকে ছাইরঙের
ভিনদেশি হেলিকপ্টার। সরকার নড়ে চড়ে বসে।
এনজিওগুলোর প্রতি ছুটতে
থাকে বুভুক্ষু মানুষের মিছিল –এ সবই উপকূলীয় মানুষের
নির্মম নিয়তির অবিচ্ছিন্ন অংশ ।
উফ, কয়লা নাকি; অঙ্গারের মতো ঝলসে যাওয়া হাইব্রিড
কইমাছের টুকরোটি বোনপ্লেটে রেখে দেয় সে। করলাভাজির প্লেটটি পুরোপুরি উপুড় করে ঢালে
ভাতের পাতে। এক
খণ্ড লেবু চেপে কাঁচা মরিচ মুখে দিয়ে খাবার চেষ্টা করে আশিক।
তরকারির বাটির এক কোণায়
একখণ্ড আলু আর দুচামচ ঝোল অবশিষ্ট রেখে ক্যাফেটেরিয়া ত্যাগ করে সে।
লাঞ্চ শেষে যখন সে শহিদ
বুদ্ধিজীবী হোস্টেলের ৮০৯ নম্বর রুমের দিকে পা বাড়ায়- লিফটের বাটন চাপার সাথে সাথে মোবাইল ফোনটি
বেজে ওঠে। রিংটোনের
সুর শুনে সে সহজে বুঝতে পারে এটি মায়ের ডাক। সে দ্রুত রিসিভ করতে চেষ্টা করে।
—‘অফুত আজিয়া চল্লিশ বেয়াল্লিশ দিন ধরি বিষ্টি
আর বিষ্টি।
বিষ্টি ত আর ন থামের।
আঁরার ভাইগ্যত কী আছে আঁই ন বুজির।’
—মায়ের এই কথাটুকু শেষ হতে না হতেই নেটওয়ার্ক
ডিসকানেক্ট হয়ে যায়। আশিক তার মায়ের সাথে কথা শেষ করতে পারেনি।
তাপানুকূল মিলনায়তন। সামনের সারির মাঝামাঝি এক আসনে বসে নিবিড়
মগ্নতায় লেকচার শুনছে আশিকই ইলাহি। দ্বাদশতম মড্যুলের তৃতীয় লেকচার আজ- ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট এন্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ।
স্মার্ট বোর্ডে দৃশ্যমান
সি লেবেল রাইজিং এন্ড গ্লোবাল ওয়ার্মি বিষয়ক নানাবিধ তথ্য উপাত্ত। ভিডিও ক্লিপস আর
স্পিকারের বক্তব্যের সঙ্গে
সঙ্গে ৩০ জন কর্মকর্তার হৃৎপিন্ডের ধুকপুক
ধ্বনি ক্রমাগত বাড়ছে। বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রামের কর্মকর্তাদের মুখে
কালোমেঘের ধূম্রছায়া নেমে এসেছে। কোন কোন উৎকণ্ঠিত কণ্ঠের প্রশ্নমালায় বার
বার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বক্তব্যের গতি। একটি বিশাল মানচিত্র—সমুদ্রপৃষ্ঠের পানি ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে
দেশের এক তৃতীয়াংশ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সুন্দরবন, চট্টগ্রাম বন্দর, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত হারিয়ে গেছে সমুদ্রের
গভীরে- এই পানির অবারিত স্রোতে রাজধানী ঢাকার মানচিত্র
পাল্টে গেছে। ‘উন্নতবিশ্বের যান্ত্রিক সুবিধাভোগী মানুষের
বেপরোয়া জীবনযাত্রার ফলে দুই
মেরুর বরফ গলছে অধিক মাত্রায়; অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণে বৈশ্বিক উষ্ণতা
বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন; এতে
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মত দেশগুলোর নিয়তি
হবে ভয়াবহ । নীল নিমজ্জনের নিরন্তর প্রতীক্ষায় প্রহর
গুনছি যেন আমরা।’—ভিডিও ক্লিপসের নিচে স্ক্রলে বাক্য তিনটি
বার বার ঘুরে ঘুরে আসছে।
বাবার মৃত্যুর পর ১৫ বছর ধরে মা গ্রামে একা
থাকেন। দুই ছেলে চার মেয়ের মধ্যে আশিক দ্বিতীয় হলেও সে-ই পরিবারের বড় ছেলে।
চাকুরি আর সংসারের এই
ব্যস্ত নাগরিক জীবনে কখনো তার মায়ের সাথে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়নি।
বরং এই মা-ই তাদের সকল বিপদ বিপর্যয়ে সহায় ও শক্তি
হয়ে প্রেরণা যুগিয়েছেন। মাঝে মাঝে এক প্রচণ্ড বেদনাবোধে তাড়িত হয়
সে-
মায়ের এই নিঃসঙ্গ জীবনে
তাঁর পাশে অবস্থানের চরম প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ।
তখন সে খেতে পারে না, ঘুমুতে পারে না- কোন কাজে তার মন বসে না।
সময়ের নির্মম চাকায় পিষ্ট
হতে হতে আবার সে সব ভুলে গিয়ে প্রাত্যহিক কাজে জড়িয়ে পড়ে।
মা সব বোঝেন- বুকের সব ব্যথা অগোচরে লুকিয়ে রাখেন তিনি।
মাঝে মাঝে অদ্ভুদ অলৌকিক স্বপ্ন দেখেন মা।
আবার তিনি নিজেই এই স্বপ্নগুলো
ব্যাখ্যা করেন। অবিশ্বাস্য
হলেও সত্যি যে তাঁর এই ব্যাখ্যা বেশ মিলে যায়।
তিনি এ নিয়ে কেউ কথা বলুক
তা আবার পছন্দ করেন না। আশিক যখন মাদ্রাসার সবক চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভর্তি হচ্ছে তখন তাকে নিয়ে দেখা এক স্বপ্নের কথা মা তাকে বলেছিলেন- আশিকের পরবর্তী জীবনে তা হবহু মিলে যায়।
এ সব কথা— মনে পড়লে তার শরীর এখনো কাঁটা দিয়ে ওঠে, শিরশির করে—সে ভাবতে চায় না ।
তবু বার বার মনে পড়ে— স্বপ্নের কথা, আশঙ্কার খণ্ডখণ্ড ছবি—যা ভুলে যেতে চায়।
মায়ের এই রহস্যময় স্বপ্নের
সাথে তাঁর ছেলেমেয়ে সবাই পরিচিত।
পরিচিত তাঁর ভাইবোন ও
নিকটজনেরা। আত্মীয়
স্বজন সবার মাঝে এই বিশ্বাসটুকু গেঁথে আছে যে মৌলানা শাহ শরাফত উল্লাহর দুই ছেলে তিন
মেয়ের মধ্যে একমাত্র এই মহিয়ষী মা-ই তাঁর বাবার আধ্যাত্মিক শক্তির একমাত্র
উত্তরাধিকারী। তাঁর
সবর, সাধুতা ও ন্যায়পরতার কাছে সবাই আনত।
দাম্পত্য জীবনের স্মৃতিধন্য
বাড়িঘর, গাছপালা, পুকুর, বাগান ও ফসলিজমি যেন বুকের মাঝে আগলে ধরে
সময় পার করছেন তিনি ।
ছয় ছেলেমেয়ের পড়ালেখা শেষ ; পাঁচজনে নিজেদের সংসার শুরু করেছে; তাঁর
একমাত্র অপেক্ষা ছোট ছেলে আসিফ কখন বিয়ে করে সংসারী হবে।
পারিবারিক জায়গাজমি ভাগবাটোয়ারা
করে দিয়ে তবেই তিনি শেষ যাত্রার জন্যে তৈরি হবেন।
বাংলাদেশের অন্য কোন দ্বীপের সাথে এর তুলনা
মেলে না। একেবারে দক্ষিণে মৈনাক পাহাড়ের চূড়োয় দাঁড়িয়ে
আছে আদিনাথ মন্দির। মন্দিরের পূর্ব উত্তরে একটু এগোলে দেখা যায়
এই বিশাল পাহাড়টি যেন কেউ প্রচণ্ড আক্রোশে এককোপে কেটে ফেলেছে দেশের মূলভূখণ্ড থেকে।
হ্যাঁ, ইতিহাসের বরাতে বলা যায়—প্রকৃতির নির্মম বৈরিতায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে—এটি মূলভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে ১৫৫৯ সালে।
এখন তা দ্বীপ হয়ে বঙ্গোপসাগরের
প্রান্ত ছুঁয়ে মূলভূমির পাশে ভাসছে। এই দ্বীপে ২০০ বছর আগে আশিকের পূর্বপুরুষগণ
বসতি স্থাপন করেন আরেক দ্বীপ কুতুবদিয়া থেকে এসে। তাঁরা সাগর চেনেন, ঢেউ ভালোবাসেন, সাগরের বুকে পাল তুলে সুদূরের ডাকে ছুটতে
চান। তার
বুকের ভেতর একটি ভারি পাথর যেন চেপে বসেছে- দুপুর থেকে।
কিছুতেই সে কোন কাজে মন
বসাতে পারছে না। এক
পাহাড় অসংলগ্ন চিন্তাতরঙ্গ আর ভাবনাবলয়ে বুঁদ
হয়ে আছে সে। সেলফ
থেকে নোটবুকটি খুঁজে নেয় । কয়েক পাতা উল্টিয়ে সাদা পাতার মাঝে লিখতে
থাকে- ‘মা, তোমাকে বাঁচতে হবে অনেক দিন-আমার জন্যে, আমাদের জন্যে, আশিক অয়ন অপূর্বা সৌরভ কুসুম অন্তরিক্ষ
নিটোল নোবেল নিনাদের জন্যে। তোমাকে বাঁচতে হবে-টোটন, লোটন, শিরুর জন্যে; যে ডাহুকমাতা আমাদের পুকুরপাড়ে পাঁচছয়টি
ছানা নিয়ে চরে বেড়ায় প্রত্যুষে ও গোধূলির শেষ লগ্নে, তুমি বেঁচে থেকো তাদের
সাথি হয়ে। দ্বীপকন্যা, তুমি সকল বিপদ বিপর্যয় জয় করে সর্বংসহা
ঈশ্বরের মতো অক্ষত থেকো, লাখকোটিনিযুত
বছর। মা, তুমি অতুল অনুপ।’—কথা ক’টি
সে আলতোভাবে অটোগ্রাফের ঢঙে লিখে নিচে স্বাক্ষর করে।
আশিক
বারবার চেষ্টা করেও কোন নেটওয়ার্ক পায় না। দ্বীপের
সব গাছপালা,
পশুপাখি, পাহাড়টিলা, চিংড়িঘের, লবণমাঠ, মন্দিরমসজিদ, স্কুলমাদ্রাসা, ধানক্ষেত, পানবরজ, কচুঘেঁচু, শাপলাশালুক, ঝিনুকশামুক, শঙ্খশেওলা চেনাঅচেনা সকল কিছুর ছবি বার
বার তার চোখে ভাসছে; ভেসে
ওঠছে,
সব কিছুর জন্যে মন কাঁদছে।
নোটবুকের দ্বিতীয় পাতায়
সে বাংলাদেশের মানচিত্রটি দেখে আবার আঁতকে ওঠে।
বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালি, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাটি এ ছয় জেলার উপর হাত বোলাতে থাকে, লাল কালিতে রাঙিয়ে তোলে- ভাবতে থাকে।
কাঁপতে থাকে সে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা
পাঁচ মিটার বাড়লে এই জেলাগুলো বঙ্গোপসাগরে তলিয়ে যাবে।
আবার, ছয়টি জেলা ছয় টুকরো করে কাটে।
সব কটি টুকরো বুকপকেটে
নেয়—বাম
হাতের উপর ডান হাত রেখে পকেটটি সজোরে চেপে ধরে।
এরপর টেনে টেনে কয়েকটি
গভীর নিঃশ্বাস নেয়, আবার
ছাড়ে। তারপরও বুকের ভেতরটুকু হালকা হয় না তার।
তারপর এ ছটি জেলাকে স্বল্পতম
জনসংখ্যার ছয় জেলার সাথে প্রতিস্থাপন করে। সে এখন অধিক সাইক্লোনপীড়িত অঞ্চলগুলোর ওপর
লালদাগ টানে–এটি একটি ফানেলের মত দেখায়; এর পরিধি বরগুনা, পটুয়াখালি, বরিশাল, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত। মনের অজান্তে তার চোখ ভিজে যায়; গণ্ড বেয়ে
ঝরে পড়ে কয়েকটি সফেদ মুক্তোদানা। সে ভুলে যেতে চায় এসব অলক্ষুনে বিষয় আশয়। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়—ওই সেমিনারের ছবিগুলো, জলবায়ু বিষয়ক বক্তব্যগুলো—সুনামি সতর্কবার্তা ।
মেজদাদি, মেজদাদি-দরজা খোল। জোরে কড়া নাড়ছে টোটন। টোটনের এই হঠাৎ চিৎকারে কোন এক নির্ঘাত বিপদের
আঁচ করেন তিনি । দরজা খোলার সাথে সাথে
টোটন এক নাগাড়ে হুড়হুড় করে বলতে থাকে-
‘চুনামি
আইয়ের—উডন। বেউন
ফারত গেইঅই। ঘরত তালা লাগন। আঁই গরুয়ুন ছাড়ি দি’—বলে সে গোয়ালের দিকে ছুটে গিয়ে গোলাপি আর শেফালিকে ছেড়ে দেয়।
একজোড়া কাপড়, দুপ্যাকেট বিস্কুট ও নগদ টাকাগুলো ব্যাগে
ভরে তৈরি হয়ে যান তিনি।
গলায় ঝুলছে সাদা আঙুরের
মত তসবিদানার মায়াবী মালা। হাতে মোবাইল ও একবোতল পানি।
মুহূর্তের মধ্যে বেলি
লোটন শিরু এরা সবাই চলে এসেছে উঠোনে।
মাইকিং শুরু হয়ে গেছে। দূর থেকে ভেসে আসছে রেডক্রস কর্মী আলম ভাইয়ের
চেনা কণ্ঠ—
‘চুনামি, চুনামি আইয়ের —সাগরের ফানি ফালাই ফালাই কুলত উডি যাইবই।
অনারা বাড়ি ঘরত তালা লাগাই ফারত উডন গই।
তাড়াতাড়ি ফারত উডন গই।
গরু মইশ ছাড়ি দন, বাড়ি ঘরত তালা লাগাই ফারত উডন গই।
চুনামি, চুনামি।
চুনামি আইয়ের।
সাগরত
ভূমিকম্ফ অইয়ে—দরিয়ার
ফানি ফালাই ফালাই কুলত উডি যাই বই। চুনামি চুনামি।’ সুনামির এটি তৃতীয় পূর্বাভাস—এ বছর আরো একবার এই পূর্বাভাস প্রচারিত হয়েছে।
আতঙ্কিত মানুষের মিছিল
যূথবদ্ধ পিঁপড়ের মত পাহাড়ের দিকে ছুটেছে ঊর্ধশ্বাসে।
উপরে আরো উপরে পরিবার
পরিজনসহ সবাই ছুটছে। পাহাড়শৃঙ্গে উঠেও তারা নির্ভয় নয়।
এ কী নিয়তি ? নাকি মানুষের অনাসৃষ্টির অভিশাপ ?— মেজদাদি তা বোঝেন না, তিনি তো বিশ্বাস করেন— আল্লাহ মানুষকে ভয় ও বিপদ দিয়ে পরীক্ষা
করেন। চার ঘণ্টা পর টোটনের হাত ধরে বাড়ি ফিরছেন
মেজদাদি; সঙ্গে লোটন ও শিরু।
পেছনে বেলি—তাঁর মেটোম্লান মুখটি পাকা নারকেলের মত শুকিয়ে গেছে আজ। পথেই আনন্দপাঠ আবাসিক বিদ্যালয়। প্রধান ফটক খোলা। হেডমাস্টার আজমগির সাহেব খালি পায়ে একা দাঁড়িয়ে
আছেন। পাহাড়ফেরত ক্লান্ত মুখগুলো তিনি দেখছেন, আর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়ে
খুঁড়ে আনমনে কী যেন ভাবছেন। ঘর্মাক্ত শরীরে সাদা পাঞ্জাবিটা তাঁর গায়ে ভিজে লেপ্টে আছে।
‘আস্
সালামু আলাইকুম। খালাম্মা, আপনি একেবারে হাঁপিয়ে গেছেন, চলুন একটু জিরিয়ে নিন।’
‘বাবা, একটুও চলতে পারি না।
আর কত।
বাড়িটা একদম ফাঁকা।’— টোটনের হাত ধরে ধীরে ধীরে অফিসে গিয়ে বসেন
তিনি। ‘বাবা, দূর থেকে আপনাকে দেখেই ঠিক করেছি এবার আপনাকে
দেখেই যাব—বড়
বিপদে আছি; একটু
বিরক্ত করব। এবার
বলুন, এই টোটারে কী করবেন? আমি বেলিকে বলেছি, জাফরকে বলেছি—কেউ রাজি হল না তাকে নিয়ে স্কুলে আসতে, এরা সবাই আপনাকে ভয় পায়।
আমি তাকে এবার হোস্টেলে
দিয়ে যাব,
আপনার জিম্মায় থাকবে; আপনাকে একটু কষ্ট দেব। বাবা, অন্তরের সুনামি কেউ তো দেখে ।’
‘খালাম্মা, আপনি যে কী বলেন।
মোস্তফাভাই তো আমার একান্ত
বন্ধু ছিলেন, আপনার তা অজানা নয়।
আশিকও আমাকে এ ব্যাপারে
কয়েকবার বলেছেন। আমি
আসলে এই ক্ষণটার প্রতীক্ষায় ছিলাম।’
টোটনকে হোস্টেলে দিয়ে
বেলির হাত ধরে বাড়ি ফিরছেন মেজদাদি। বেলির কনককপোল বেয়ে নেমে পড়ছে বাদলমোতির
উষ্ণউছল ধারা। লোটন
ও শিরুর কোমলমুখে আনন্দআভা ঝিকিমিকি খেলছে।
পুনশ্চঃ মৃগয়া
গভীরবন। ঘনঘুমে অচেতন এক শিকারী।
দোনলা
বন্দুকটা
ডান
হাতে
বুকের
সঙ্গে
জড়িয়ে
আছেন তিনি।
গত
দুরাত
আকাশির
হাম্বা
হাম্বা
ডাকে
চোখের
পাতা
দুটো
এমনিতেই জোড়া
লাগেনি
তাঁর—বকনা বাছুরটি মায়ের জন্যে কাঁদছে আর কাঁদছে।
মা
বাতাসিকে
দুদিন
ধরে
খুঁজে
খুঁজে মনটা বেশ খারাপ।
রাজ্যের
ক্লান্তি
ও
অবসাদ
যেন
ফুরোবার
নয়।
তারপর
বনে
বাদাড়ে
সারা
দিনের
দৌড়ঝাঁপ।
কয়েকটি
বনমোরগ
আর
শেয়াল
বানর
ছাড়া কোথাও কোন শিকারের চিহ্ন চোখে পড়েনি আজ। হঠাৎ বিকট অচেনা শব্দে ঘুম ভাঙ্গে তাঁর । শব্দের ঢেউ অনুসরণ করে পাহাড় ভেঙ্গে নিঃশব্দে এগিয়ে যান তিনি।
নিবিড়
ছায়ায়
কদমগাছের নিচে বাতাসি দাঁড়িয়ে আছে—একটি অপরূপ শিলাখণ্ডের উপর ওলান ঠেকিয়ে বাট থেকে দুধ ঢালছে; চারপাশের জায়গাটুকু বেশ ভেজা। বাতাসি আর শিলাখণ্ডটি নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি ।
রাতেই
স্বপ্নে
দেখেন; এক মহাপুরুষ তাঁকে বলছেন—
‘তুমি কী এই শিলাখণ্ডটি চেন?’
‘না, আমি এ রকম শিলা কখনো দেখিনি, এর অপূর্ব সৌন্দর্য আমাকে দিশেহারা করে দেয়।’—ভয়ে কাঁপতে থাকেন তিনি।
‘এ শিলাখণ্ডটি একটি দেববিগ্রহ। এ বিগ্রহ যেখান থেকে নিয়ে এসেছ সেখানে রেখে এস- সেখানে একটি মন্দির নির্মাণ করে পাপ মোচনের চেষ্টা কর।’
‘হ্যাঁ, জ্বী, আমি ওখানে একটি মন্দির করব। আমাকে ক্ষমা করুন মহাশয়।’
‘শিবের
নামে
এ
মন্দিরের
নাম
হবে
আদিনাথ
মন্দির।’
পর দিন শিকারি নুর মোহাম্মদ শিকদার সেখানে একটি মন্দির গড়ে তোলেন।
আদিনাথ
বা
শিবের
১০৮ টি নামের অন্যতম নাম মহেশ ।
আর
এই
মহেশ
নাম
হতেই
খাল
সংলগ্ন
এ
দ্বীপটি
পরবর্তী সময়ে
মহেশখালী
নামে
পরিচিতি
পায়।
এইসব কিংবদন্তি, বিশ্বাসবিগ্রহ, জলবায়ুবিদ্যা, প্রণয়পরিবেশ, স্বার্থসংকট আশিক ভাল বোঝে না, বুঝতে চেষ্টা করে। আবার বুঝেও বোঝে না। তখন এক নীল নিমজ্জনের শঙ্কায় কাঁপতে থাকে
সে—দুর্বোধ্য
আঁধারে ঘড়ির দোলকের মতো দুলতে থাকে তার সারা
শরীর।
2 মন্তব্যসমূহ
পুরাণ ও প্রণয়ের সঙ্গে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা নিয়ে রচিত গল্প 'নীল নিমজ্জনে' পাঠককে আলাদা আনন্দ দেবে।
উত্তরমুছুনপ্রিয় কথাশিল্পী Rajib Noor,
উত্তরমুছুনআপনার মন্তব্যের জন্যে অশেষ ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।