শওকত
আলী। বাংলাদেশের সাহিত্য-জগতে এক উজ্জ্বল নাম, বাংলা ভাষার
একজন শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে গল্প ও উপন্যাস লিখে তিনি
খ্যাতি অর্জন করেন। দীর্ঘদিন শিক্ষকতার পর বর্তমানে অবসরে আছেন। জন্মগ্রহণ করেন ১২
ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬, পশ্চিমবঙ্গের থানাশহর রায়গঞ্জে। মা
মোসাম্মৎ সালেমা খাতুন, বাবা খোরশেদ আলী সরকার। বাবা-মার
তৃতীয় সন্তান। তাঁর বয়স এখন ৭৮। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস প্রদোষে প্রাকৃতজন। এছাড়া রয়েছে ওয়ারিশ, দলিল, উত্তরের খেপ, নাঢ়াই, মাদারডাঙ্গার
কথা। সম্প্রতি তাঁর ছোট ছেলে গালিব শওকতের বাসায় বসে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কবি ও
প্রাবন্ধিক রাহেল রাজিব।
―সময়ের এই প্রান্তে এসে আপনার
জীবনের সঙ্গে কথাশিল্পের যে সম্পর্ক তা প্রায় পাঁচ দশক পার করতে চলেছে।
কথাপ্রবাহের এই সূতোয় কোথাও কী রঙ লাগাতে ইচ্ছে করে?
শওকত আলী: জীবনে রঙ লাগাতে কে না চায়; বলো? আজ তোমাকেও যদি এই প্রশ্ন করি তুমিও চাইবে রঙ লাগাতে। তবে এটা ঠিক বয়স ও অভিজ্ঞতার একটা সমন্বয় যখন ঘটে যায় তখন অনেক কিছুই হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়। শ্রীরামপুরে অর্থাৎ রায়গঞ্জের জীবন পার করে দিনাজপুরে আসি, এখানে পড়াশুনা শুরু করি―আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে যাই, জেল খাটি, ঢাকায় আসি। আবার ঠাকুরগাঁয়ে ফিরে যাই। সেখান থেকে আবার ঢাকায় ফিরি। বাকিটা জীবন ঢাকাতেই পার করলাম। এখন তো শুধু দিনগুজরান করা ছাড়া কোন উপায় নেই। শরীরে নানান অসুখ বাসা বেধেছে; অনেক কিছু ভুলে গেছি। সবমিলিয়ে চলছে, ঘটছে অনেককিছু। কিন্তু আমি সেই আগের মতো নেই। যে জীবনে গতি নেই সেই জীবনের ভেতরে ঢুকে গেছি। সবাই যেমন যায়। তবে রঙ লাগানোর কথা যদি বলো তাগলে আক্ষেপের পাল্লাই ভারি হবে। কতকিছু করতে চেয়েছি, লিখতে চেয়েছি। পারিনি। হয়তো আর পারবোও না। কিন্তু যদি পারতাম তাহলে মন্দ হতো না। এই যে আজকের সকাল―এটিকেও তো আর ফিরে পাবো না। কেউ পাবে না। তাই বলে আক্ষেপও হবে না।
―কবিতার কাছে নতজানু হয়ে লেখা শুরু করেছিলেন। প্রথম উপন্যাস পিঙ্গল আকাশ প্রকাশিত হওয়ার পর বোদ্ধামহলে ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিলেন। কিন্তু গল্পে হাত দিলেন। গল্পকথায় এলেন কেন?
শওকত আলী: আমার মনে হয় প্রতিটি মানুষের ভেতরে একজন শিল্পী বাস করে। কবিতার লেখার একটা বয়স সবাইকেই পার করতে হয়। জীবনের প্রথম দিকে তাই আমিও দুএক লাইন লিখেছি। বিশেষত সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়ার সময়, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। কিন্তু আমার মধ্যে দিনাজপুরের সেই নিরবিচ্ছিন্ন জীবন তাড়া করে ফিরতো; সেখানকার নদী-জল-আহাওয়া সব মিলিয়ে মৃত্তিকালগ্ন মানুষের জীবনকথা। এবং এই কথা বলবার একটা তাগিদ নিজের ভেতর অনুভব করতাম। দেখলাম কবিতায় সেই কথাগুলো বলে মন ভরছে না। হঠাৎই গদ্যে আসা। ঠাকুরগাঁয়ে গিয়ে অখ- অবসর। কিছু করার নেই। খাতা কলম নিয়ে বসে গেলাম। পিঙ্গল আকাশ লেখা হয়ে গেল। অনেকটা আকস্মিকভাবেই। ঢাকায় ফিরতে হলো। পূবালী পত্রিকার বিশেষ একটা সংখ্যায় [নাম মনে পড়ছে না] উপন্যাসটা ছাপা হলো। ইতিমধ্যে জগন্নাথ কলেজে যোগদান করেছি। সবাই পিঙ্গল আকাশ-এর খুব প্রশংসা করেছে। কিন্তু গল্পলেখা হলো অনেকটা ঘটা করে। জাফর ভাই (সিকানদার আবু জাফর) ও হাসান ভাই (হাসান হাফিজুর রহমান) বারবার বললেন তোমার গদ্যের হাত ভালো। গল্প লেখ। ভাল করবে। বলা ভালো তাদের প্রেরণায় গল্প লেখা। উন্মূল বাসনা প্রকাশিত হওয়ার পেছনে এই দুজনের অবদান কম না।
―পিঙ্গল আকাশ প্রকাশের পর গল্পে ঝুঁকলেন। বলা ভালো দীর্ঘসময় উপন্যাস থেকে দূরে থাকলেন। কেন?
শওকত আলী: উন্মূল বাসনা প্রকাশিত হওয়ার পর পুরস্কারও পেয়ে গেলাম। তাই গল্প লেখাটা একধরণের চাপে পরিণত হলো। সবাই শুধু গল্প চাইতে লাগল। আমারও তখন বেহাল দশা। গল্পও আসছে দু’হাত ভরে। লিখলাম।
―উন্মূল বাসনা প্রকাশিত হওয়ার পর প্রতিক্রিয়া কেমন পেয়েছিলেন?
শওকত আলী: উন্মূল বাসনা প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এটার আলোচনা বেরিয়েছিল। আমার শিক্ষক মুনীর চৌধুরীও কোথায় যেন একটা আলোচনা করেছিলেন। সবমিলিয়ে অভিনন্দনের জোয়ার! এর সাথে যুক্ত হলো বাংলা একাডেমীর পুরস্কার।
―আবদুল মান্নান সৈয়দের সত্যের মতো বদমাশ, আবদুশ শাকুরের ক্ষীয়মাণ, রাহাত খানের অমল ধবল চাকরি, সেলিনা হোসেনের নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি, হাসান আজিজুল হকের আত্মজা ও একটি করবী গাছ এবং আপনার উন্মূল বাসনা সবমিলিয়ে এই দশকটি গল্পদশক বলা যায় কিনা?
শওকত আলী: তুমি যাদের নাম করলে তারা প্রত্যেকেই বাংলা ভাষার গুণি লেখক। তাদের সঙ্গে আমার নাম উচ্চারণ করাতে গর্ববোধ হচ্ছে। আসলে একষট্টির পর থেকে ঢাকাসহ সারাদেশের চরিত্র পাল্টে গেল। বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে সকলের সম্পৃক্ততা বাড়তে লাগলো। আমরা যারা লিখছিলাম তাদের মধ্যে এক ধরণের প্রবণতা কাজ করতে থাকলো- এটা আমার ধারণা। প্রথম নামটি মান্নান সৈয়দ তত্ত্ব নিয়ে গল্পে দেখাল, হাসান (হাসান আজিজুল হক) দক্ষিণের জীবনকে আনলো- এছাড়া অন্যান্যরাও নিজের মতো করে গল্প লিখে জায়গা তৈরি করে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। দশক-টশক বলবে কি না, বলা যাবে কি না এটা পাঠক-সমালোচকরা বলতে পারবেন। তবে হ্যাঁ, এই সময়ে অনেকগুলো উৎকৃষ্ট গল্প লেখা হয়েছে।
―আপনার সমগ্র কথাসাহিত্যে ‘আত্মজৈবনিক আবহ’-এর প্রভাব প্রকট। বলা ভালো শৈশব কৈশোরের প্রীতিময় স্মৃতিময় যাপিত জীবনের অনুরণন আপনার কথাসাহিত্য। এবিষয়ে বলুন।
শওকত আলী: দ্যাখো তুমি যে বিশেষণ ব্যবহার করলে- এটা মাথায় রেখে কোনদিন লিখি নি। হয়তো কোন লেখকই লেখেন না। লিখতে গেলে নিজের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির প্রভাব আসতেই পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক। মানুষ নিজের জীবনের বাইরের জগতকে নিজের সঙ্গে মেলাতে চাইবে―এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আমার লেখার মধ্যেও হয়তো কোনভাবে এসেছে। আসতেই পারে। পৃথিবীর সব লেখকের মধ্যেই এই বিষয়টা আসে। মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতি সবার লেখার মধ্যেই এটা পাবে।
―শৈশবে কী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন?
শওকত আলী: আমার বাবা ডা. খোরশেদ আলী সরকার; তিনি চেয়েছিলেন আমি ডাক্তার হই। আমার একভাই ডাক্তার। আমিও বাবার কথার অবাধ্য হই নি। কিন্তু সময় সবকিছু পাল্টে দিল।
―জিসি দেবের পরামর্শে মানবিকে ভর্তি হওয়ার পর কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন- সুভাষ দত্ত ও নিতুন কুণ্ডু তো আপনার সুহৃদজন...।
শওকত আলী: সাতচল্লিশের পর আমি দিনাজপুরে চলে আসি। আমাদেও পুরো পরিবারও চলে আসে। বিজ্ঞানে ভর্তি হওয়ার কথা। কিন্তু সময় পার হয়ে গেছে এবং বিজ্ঞানে কোন সিটও খালি ছিল না। অধ্যক্ষের পরামর্শে মানবিকে ভর্তি হলাম। সুভাষ ও নিতুন আমার কাছের মানুষ। আমরা একসাথেই ঢাকার জীবন শুরু করি। আমাদেও কিছুই ছিল না। শুধু শিল্পের সঙ্গে চলেছি।
―ঠাকুরগাঁও গেলেন কেন?
শওকত আলী: এম. এ পাশ করার পর হঠাৎই প্রস্তাব পেলাম। চাকরির খুব দরকার ছিল। কোন কিছু না ভেবে চলে গেলাম। গিয়ে ভুল করিনি। সবুজময় উত্তরে নিজেকে প্রচুর সময় দিতে পারলাম।
―ফিরলেন কেন? কোনও তাগিদ ছিল?
শওকত আলী: ফেরার তাড়া আমার যতটা না ছিল তারচেয়ে বেশি আমার ঘনিষ্টজনদেও ছিল। আমি ওখানে আছি। জাফর ভাই (সিকানদার আবু জাফর) ও হাসান ভাই (হাসান হাফিজুর রহমান) বারবার বলছিল শওকত তুমি ঢাকায় চলে আসো। এখানে কিছু একটা ব্যবস্থা হবে। এর মধ্যে বিয়ে করে ফেলেছি। বউ জেলারের মেয়ে। শওকত আরা। ও চাচ্ছিল ঢাকায় চলে আসি। সবমিলিয়ে ঢাকায় আসা। জাফর ভাই (সিকানদার আবু জাফর) ও হাসান ভাই (হাসান হাফিজুর রহমান) কাছের ব্যবস্থা কওে দিলেন। সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হলাম। সবমিলিয়ে কোনমতে সংসার চলছিল। এখানে আসার ফলে যোগাযোগ বাড়লো।
―জগন্নাথ কলেজে যোগদানের বিষয়টি নিয়ে কিছু বলুন।
শওকত আলী: জাফর ভাই (সিকানদার আবু জাফর) আমাকে জগন্নাথ কলেজে আবেদন করতে বললে বিস্মিত হই। কারণ সেখানে বিদগ্ধ অধ্যাপক ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আবেদন করবেন। আমার মতো নবীনকে সেখানে কেন নেবে! সাক্ষাৎকারের দিনে গিয়ে দেখি কলেজের অধ্যক্ষও আবেদন করেছে। সাক্ষাৎকার দিলাম। বেশ ভাল ভাইভা দিয়েছি। জাফর ভাইও কয়েকজনকে বলে রেখেছিলেন। সবমিলিয়ে চাকরিটা হলো।
― বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন একেবারে তরুণ বয়সে। পুরস্কার পেলেন গল্পে; কিন্তু আপনি ফিরলেন উপন্যাসে। এবং উপন্যাস লিখলেন ধারাবাহিকভাবে। প্রথম দশ বছর গল্পও লিখেছেন; ‘লেলিহান সাধ’, ‘শুন হে লখিন্দর’, ‘বাবা আপনে যান’ এই সময়ে প্রকাশিত হয়। সমান্তরালে উপন্যাস লিখলেন বেশি। কারণ কি?
শওকত আলী: আমার প্রথম প্রকাশিত বড় কোন কাজ কিন্তু উপন্যাস। ‘পিঙ্গল আকাশ’। কিন্তু দ্বিতীয়বার ঢাকায় আসার পর কোথাও ঠিক স্থায়ীভাবে থাকতে পারিনি। জগন্নাথে চাকরি হওয়ার পর একটু নিশ্চিন্ত জীবন এবং তখনই গল্পগুলো একবারে লেখা। গল্প লিখে পুরস্কার পেলাম। পুরস্কার, তারপর আবার এত তরুণ বয়সে এবং প্রথম পুরস্কার, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি! সবমিলিয়ে গল্প লেখার ঝোঁকও কাজ করছিল। অন্যদিকে ফেলে আসা বিশাল গ্রামীণ জীবন আমাকে বারবার টানছিল। মনে হচ্ছিল. গল্পে পুরো জীবনটা কোনভাবে আসছে না। পুরো জীবনটাকে আনতে গেলে আমাকে বড় কিছু লিখতে হবে। উপন্যাস লেখার অভিজ্ঞতা ছিল, কিন্তু সেটা নিতান্তই সাধারণ। নিজেকে তৈরি করার জন্য গল্প লেখার অভিজ্ঞতা বড় একটা ভুমিকা পালন করেছে। উপন্যাস লিখতে গিয়ে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলাম। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লিখে ফেললাম দীর্ঘ পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে। সবার দৃষ্টি কাড়লো। আলোচনা-সমালোচনার ঝড়ের পাশাপাশি পুরস্কারও পেলাম। সুধীজনের পরামর্শ ও কাছের মানুষদের কাছে উৎসাহও পেলাম।
―‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’-এর প্রসঙ্গ যখন এলোই, এই উপন্যাস নিয়ে ভূয়সী প্রশংসার সমান্তরালে এর ভাষা নিয়ে তীর্যক সমালোচনাও আছে। আপনার সমসাময়িক অধিকাংশ গদ্যকারগণ যখন বর্তমান নিয়ে উপন্যাস লিখছেন; ঠিক সেই সময়ে আপনি ইতিহাস নির্ভও উপন্যাস লিখলেন কেন?
শওকত আলী: ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহ সবসময়েই ছিল। ইতিহাস তো বারবার ফিওে আসে। আর বাঙালির যে ইতিহাস সেখানে সংগ্রাম ও লড়াই এর একটা বড় জায়গা। আমাকে এই বিষয়টি অনেক ভাবাতো। আমি চেষ্টা করছিলাম বাঙালির এই নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসকে কোনভাবে আমার লেখায় তুলে আনতে। হলায়ুধ মিশ্রের ‘শেখ শুভোদয়া’ অনুবাদ করতে গিয়ে এই বিষয়টি আমাকে অনেক বেশি আলোড়িত করে। সংস্কৃত ভাষার প্রতি আমার আবেগ একটু বেশিই। সংস্কৃত সাহিত্য আমাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। যখন পড়তে পারতাম সংস্কৃত সাহিত্য পড়েছি বিস্তর। ফলে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লিখতে গিয়ে একটা কৃত্রিম ভাষার প্রয়োজন তো ছিলই। আমি সংস্কৃতর আশ্রয় নেই। তের শতকের জীবনকে ধরতেও এটা জরুরি ছিল। সমালোচনার কাজ পণ্ডিদের। আমি পণ্ডিত নই, লেখক। তারা অনেক কথা বলেন। পড়েছিও দু’একটা। আমি আমার কাজ করেছি। এখন এই সময়ে এসে এই সব কথা আমার কাছে অনেকটাই অর্থহীন। লেখকের কাজ লেখা। আমি সারাজীবন সেটাই করার চেষ্টা করেছি। শওকত ওসমান ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস লিখেছেন; সেলিনা হোসেন তো ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস লিখে গেল। এটা খুব কঠিন। কেননা ইতিহাসটা পাঠকের নখদর্পণে- সেটার বিপরীতে উপন্যাস পাঠ করতে গিয়ে পাঠককে লেখকের মতো চলতে হয়। এখানেই লেখকের চাতুর্যময় চলনশক্তি দেখা যায়। কিছুদিন আগে একটা উপন্যাস হাতে পেলাম ‘মুসলমানমঙ্গল’, লেখকের নাম মনে করতে পারছি না। ইতিহাস নির্ভর লেখা। বেশ ভাল কাজ। পুরোটা পড়তে পারিনি; পড়ার মতো সামর্থ্য চোখের নেই। কিন্তু উল্টে পাল্টে যতটুকু দেখলাম তাতে মনে হলো বেশ গভীরতা আছে।
―দীর্ঘ লেখক জীবনে ফরমায়েসি লেখা লিখতে হয়েছে নিশ্চয়। সেটা কিভাবে সামলাতেন।
শওকত আলী: হাসান ভাই ও জাফর ভাইয়ের পর তো সেরকম বড় মাপের কোন সাহিত্য সম্পাদক চোখে পড়েনি। তাদের সময়ে একটা চাপ ছিল। কেননা তারা শিল্প-সাহিত্য বুঝতেন। কিন্তু হালের পত্রিকাগুলো পাতা ভরার কাজ করে। তারা লেখক বোঝে না, লেখাও পড়ে না। বেশকিছুদিন আগে একটা উপনাসের নাম পর্যন্ত ভুল ছেপেছে। তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। সময়টাই এখন এরকম। মানুষ খুব ব্যস্ত। কিন্তু ধ্রুপদি জীবনের ছোঁয়া সবার জীবনেই আসে। তখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আসে। আর লেখার চাপের কথা যদি বলো, তাহলে শোন, লেখার জন্য কখনোই চাপ নিতাম না। চাপের মধ্যে কখনো ভাল লেখা আসে না। অনন্ত আমার আসে নি। তাই সামলানোর বিষয়ও আসে নি। আমি প্রতিদিন সময় কওে লিখতাম। এটা আমার কাছে সাধনার বিষয়।
―পুরস্কারের ঝাঁপিতে তো অনেক মহার্ঘ্য সম্মান ও পুরস্কার আছে। সেটাকে কিভাবে দেখেন? এছাড়া আপনি তো সভা-সমিতিতে যেতেন না। কেন?
শওকত আলী: পুরস্কার প্রেরণা। কিংবা কাজের এক ধরণের মূল্যায়ণ। আমি সেভাবেই দেখেছি। ফিলিপস পুরস্কার দু’বার পেয়েছি। কিংবা রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক। আমার কাছে সবসময় একটা বিষয় খুব নাড়া দিয়েছে, এই যে লিখছি, এখানে যারা আছে, যাদের কথা আছে, যাদের জীবন আছে―সেটা যেন জীবন ঘনিষ্ট হয়। আমি কখনোই অদেখা জীবন নিয়ে লিখিনি। লেখার চেষ্টাও করিনি। আমার ভেতরে এটা কখনোই কাজ করেনি। সভা-সমিতির কথা যদি বলো―এগুলোকে এড়িয়ে যেতেই ভাল লাগতো। বড় বড় তত্ত্বকথা বলতে ও শুনতে পছন্দ করতাম না। সাধারণ সাদামাটা একটা জীবন আমার। নিজের মধ্যে থাকতেই পছন্দ করতাম। লেখা ও পড়ার জন্য প্রচুর সময় দিতাম। হাঁটতে খুব ভাল লাগতো। অনেক সময় হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতাম। গলি গলি ঘুরে বাড়ি ফেরার আনন্দ আছে। পুরানো ঢাকার গলি কিংবা মতিঝিলের গলি―সব গলিই আমার কাছে একারণে চেনা। শ্রীরামপুরেও এভাবে ঘুরতাম। বলা ভালো শৈশবের অভ্যাস।
―কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলেন; পরে আর কখনো কবিতা লিখেন নি। শিশু কিশোরদের জন্য লিখেছেন। কথাসাহিত্য নিয়েই রইলেন। কখনো কবিতায় ফিরতে মন চায় নি?
শওকত আলী: কবিতা তো সবার মনেই আসে। আমিও লিখতে চেয়েছি। পারিনি। কথার চাপে কবিতা হয়তো আসে নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বেশকিছু কবিতা লিখেছি। কিন্তু ‘পিঙ্গল আকাশ’ প্রকাশিত হওয়ার পর সবকিছু পাল্টে গেল। ‘উন্মূল বাসনা’র গল্পগুলোও কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। মুনীর স্যার (মুনীর চৌধুরী), গাফ্ফার চৌধুরী (আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী), হাসান ভাই (হাসান হাফিজুর রহমান), জাফর (সিকানদার আবু জাফর) ভাই, সুভাষ (সুভাষ দত্ত), নুরুল হুদা (মুহম্মদ নুরুল হুদা) সবাই আমাকে গল্পে ঝুঁকতে বলেছিলেন। আমারও ভেতরে সেই তাড়নাই কাজ করছিল। এই সত্যটা আমিও অস্বীকার করতে পারিনি। তাই কবিতা লেখা হয়ে ওঠে নি। এবং একারণে আমার কোন আক্ষেপও নেই।
শওকত আলী: জীবনে রঙ লাগাতে কে না চায়; বলো? আজ তোমাকেও যদি এই প্রশ্ন করি তুমিও চাইবে রঙ লাগাতে। তবে এটা ঠিক বয়স ও অভিজ্ঞতার একটা সমন্বয় যখন ঘটে যায় তখন অনেক কিছুই হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়। শ্রীরামপুরে অর্থাৎ রায়গঞ্জের জীবন পার করে দিনাজপুরে আসি, এখানে পড়াশুনা শুরু করি―আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে যাই, জেল খাটি, ঢাকায় আসি। আবার ঠাকুরগাঁয়ে ফিরে যাই। সেখান থেকে আবার ঢাকায় ফিরি। বাকিটা জীবন ঢাকাতেই পার করলাম। এখন তো শুধু দিনগুজরান করা ছাড়া কোন উপায় নেই। শরীরে নানান অসুখ বাসা বেধেছে; অনেক কিছু ভুলে গেছি। সবমিলিয়ে চলছে, ঘটছে অনেককিছু। কিন্তু আমি সেই আগের মতো নেই। যে জীবনে গতি নেই সেই জীবনের ভেতরে ঢুকে গেছি। সবাই যেমন যায়। তবে রঙ লাগানোর কথা যদি বলো তাগলে আক্ষেপের পাল্লাই ভারি হবে। কতকিছু করতে চেয়েছি, লিখতে চেয়েছি। পারিনি। হয়তো আর পারবোও না। কিন্তু যদি পারতাম তাহলে মন্দ হতো না। এই যে আজকের সকাল―এটিকেও তো আর ফিরে পাবো না। কেউ পাবে না। তাই বলে আক্ষেপও হবে না।
―কবিতার কাছে নতজানু হয়ে লেখা শুরু করেছিলেন। প্রথম উপন্যাস পিঙ্গল আকাশ প্রকাশিত হওয়ার পর বোদ্ধামহলে ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিলেন। কিন্তু গল্পে হাত দিলেন। গল্পকথায় এলেন কেন?
শওকত আলী: আমার মনে হয় প্রতিটি মানুষের ভেতরে একজন শিল্পী বাস করে। কবিতার লেখার একটা বয়স সবাইকেই পার করতে হয়। জীবনের প্রথম দিকে তাই আমিও দুএক লাইন লিখেছি। বিশেষত সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়ার সময়, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। কিন্তু আমার মধ্যে দিনাজপুরের সেই নিরবিচ্ছিন্ন জীবন তাড়া করে ফিরতো; সেখানকার নদী-জল-আহাওয়া সব মিলিয়ে মৃত্তিকালগ্ন মানুষের জীবনকথা। এবং এই কথা বলবার একটা তাগিদ নিজের ভেতর অনুভব করতাম। দেখলাম কবিতায় সেই কথাগুলো বলে মন ভরছে না। হঠাৎই গদ্যে আসা। ঠাকুরগাঁয়ে গিয়ে অখ- অবসর। কিছু করার নেই। খাতা কলম নিয়ে বসে গেলাম। পিঙ্গল আকাশ লেখা হয়ে গেল। অনেকটা আকস্মিকভাবেই। ঢাকায় ফিরতে হলো। পূবালী পত্রিকার বিশেষ একটা সংখ্যায় [নাম মনে পড়ছে না] উপন্যাসটা ছাপা হলো। ইতিমধ্যে জগন্নাথ কলেজে যোগদান করেছি। সবাই পিঙ্গল আকাশ-এর খুব প্রশংসা করেছে। কিন্তু গল্পলেখা হলো অনেকটা ঘটা করে। জাফর ভাই (সিকানদার আবু জাফর) ও হাসান ভাই (হাসান হাফিজুর রহমান) বারবার বললেন তোমার গদ্যের হাত ভালো। গল্প লেখ। ভাল করবে। বলা ভালো তাদের প্রেরণায় গল্প লেখা। উন্মূল বাসনা প্রকাশিত হওয়ার পেছনে এই দুজনের অবদান কম না।
―পিঙ্গল আকাশ প্রকাশের পর গল্পে ঝুঁকলেন। বলা ভালো দীর্ঘসময় উপন্যাস থেকে দূরে থাকলেন। কেন?
শওকত আলী: উন্মূল বাসনা প্রকাশিত হওয়ার পর পুরস্কারও পেয়ে গেলাম। তাই গল্প লেখাটা একধরণের চাপে পরিণত হলো। সবাই শুধু গল্প চাইতে লাগল। আমারও তখন বেহাল দশা। গল্পও আসছে দু’হাত ভরে। লিখলাম।
―উন্মূল বাসনা প্রকাশিত হওয়ার পর প্রতিক্রিয়া কেমন পেয়েছিলেন?
শওকত আলী: উন্মূল বাসনা প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এটার আলোচনা বেরিয়েছিল। আমার শিক্ষক মুনীর চৌধুরীও কোথায় যেন একটা আলোচনা করেছিলেন। সবমিলিয়ে অভিনন্দনের জোয়ার! এর সাথে যুক্ত হলো বাংলা একাডেমীর পুরস্কার।
―আবদুল মান্নান সৈয়দের সত্যের মতো বদমাশ, আবদুশ শাকুরের ক্ষীয়মাণ, রাহাত খানের অমল ধবল চাকরি, সেলিনা হোসেনের নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি, হাসান আজিজুল হকের আত্মজা ও একটি করবী গাছ এবং আপনার উন্মূল বাসনা সবমিলিয়ে এই দশকটি গল্পদশক বলা যায় কিনা?
শওকত আলী: তুমি যাদের নাম করলে তারা প্রত্যেকেই বাংলা ভাষার গুণি লেখক। তাদের সঙ্গে আমার নাম উচ্চারণ করাতে গর্ববোধ হচ্ছে। আসলে একষট্টির পর থেকে ঢাকাসহ সারাদেশের চরিত্র পাল্টে গেল। বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে সকলের সম্পৃক্ততা বাড়তে লাগলো। আমরা যারা লিখছিলাম তাদের মধ্যে এক ধরণের প্রবণতা কাজ করতে থাকলো- এটা আমার ধারণা। প্রথম নামটি মান্নান সৈয়দ তত্ত্ব নিয়ে গল্পে দেখাল, হাসান (হাসান আজিজুল হক) দক্ষিণের জীবনকে আনলো- এছাড়া অন্যান্যরাও নিজের মতো করে গল্প লিখে জায়গা তৈরি করে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। দশক-টশক বলবে কি না, বলা যাবে কি না এটা পাঠক-সমালোচকরা বলতে পারবেন। তবে হ্যাঁ, এই সময়ে অনেকগুলো উৎকৃষ্ট গল্প লেখা হয়েছে।
―আপনার সমগ্র কথাসাহিত্যে ‘আত্মজৈবনিক আবহ’-এর প্রভাব প্রকট। বলা ভালো শৈশব কৈশোরের প্রীতিময় স্মৃতিময় যাপিত জীবনের অনুরণন আপনার কথাসাহিত্য। এবিষয়ে বলুন।
শওকত আলী: দ্যাখো তুমি যে বিশেষণ ব্যবহার করলে- এটা মাথায় রেখে কোনদিন লিখি নি। হয়তো কোন লেখকই লেখেন না। লিখতে গেলে নিজের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির প্রভাব আসতেই পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক। মানুষ নিজের জীবনের বাইরের জগতকে নিজের সঙ্গে মেলাতে চাইবে―এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আমার লেখার মধ্যেও হয়তো কোনভাবে এসেছে। আসতেই পারে। পৃথিবীর সব লেখকের মধ্যেই এই বিষয়টা আসে। মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতি সবার লেখার মধ্যেই এটা পাবে।
শওকত আলী: আমার বাবা ডা. খোরশেদ আলী সরকার; তিনি চেয়েছিলেন আমি ডাক্তার হই। আমার একভাই ডাক্তার। আমিও বাবার কথার অবাধ্য হই নি। কিন্তু সময় সবকিছু পাল্টে দিল।
―জিসি দেবের পরামর্শে মানবিকে ভর্তি হওয়ার পর কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন- সুভাষ দত্ত ও নিতুন কুণ্ডু তো আপনার সুহৃদজন...।
শওকত আলী: সাতচল্লিশের পর আমি দিনাজপুরে চলে আসি। আমাদেও পুরো পরিবারও চলে আসে। বিজ্ঞানে ভর্তি হওয়ার কথা। কিন্তু সময় পার হয়ে গেছে এবং বিজ্ঞানে কোন সিটও খালি ছিল না। অধ্যক্ষের পরামর্শে মানবিকে ভর্তি হলাম। সুভাষ ও নিতুন আমার কাছের মানুষ। আমরা একসাথেই ঢাকার জীবন শুরু করি। আমাদেও কিছুই ছিল না। শুধু শিল্পের সঙ্গে চলেছি।
―ঠাকুরগাঁও গেলেন কেন?
শওকত আলী: এম. এ পাশ করার পর হঠাৎই প্রস্তাব পেলাম। চাকরির খুব দরকার ছিল। কোন কিছু না ভেবে চলে গেলাম। গিয়ে ভুল করিনি। সবুজময় উত্তরে নিজেকে প্রচুর সময় দিতে পারলাম।
―ফিরলেন কেন? কোনও তাগিদ ছিল?
শওকত আলী: ফেরার তাড়া আমার যতটা না ছিল তারচেয়ে বেশি আমার ঘনিষ্টজনদেও ছিল। আমি ওখানে আছি। জাফর ভাই (সিকানদার আবু জাফর) ও হাসান ভাই (হাসান হাফিজুর রহমান) বারবার বলছিল শওকত তুমি ঢাকায় চলে আসো। এখানে কিছু একটা ব্যবস্থা হবে। এর মধ্যে বিয়ে করে ফেলেছি। বউ জেলারের মেয়ে। শওকত আরা। ও চাচ্ছিল ঢাকায় চলে আসি। সবমিলিয়ে ঢাকায় আসা। জাফর ভাই (সিকানদার আবু জাফর) ও হাসান ভাই (হাসান হাফিজুর রহমান) কাছের ব্যবস্থা কওে দিলেন। সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হলাম। সবমিলিয়ে কোনমতে সংসার চলছিল। এখানে আসার ফলে যোগাযোগ বাড়লো।
―জগন্নাথ কলেজে যোগদানের বিষয়টি নিয়ে কিছু বলুন।
শওকত আলী: জাফর ভাই (সিকানদার আবু জাফর) আমাকে জগন্নাথ কলেজে আবেদন করতে বললে বিস্মিত হই। কারণ সেখানে বিদগ্ধ অধ্যাপক ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আবেদন করবেন। আমার মতো নবীনকে সেখানে কেন নেবে! সাক্ষাৎকারের দিনে গিয়ে দেখি কলেজের অধ্যক্ষও আবেদন করেছে। সাক্ষাৎকার দিলাম। বেশ ভাল ভাইভা দিয়েছি। জাফর ভাইও কয়েকজনকে বলে রেখেছিলেন। সবমিলিয়ে চাকরিটা হলো।
― বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন একেবারে তরুণ বয়সে। পুরস্কার পেলেন গল্পে; কিন্তু আপনি ফিরলেন উপন্যাসে। এবং উপন্যাস লিখলেন ধারাবাহিকভাবে। প্রথম দশ বছর গল্পও লিখেছেন; ‘লেলিহান সাধ’, ‘শুন হে লখিন্দর’, ‘বাবা আপনে যান’ এই সময়ে প্রকাশিত হয়। সমান্তরালে উপন্যাস লিখলেন বেশি। কারণ কি?
শওকত আলী: আমার প্রথম প্রকাশিত বড় কোন কাজ কিন্তু উপন্যাস। ‘পিঙ্গল আকাশ’। কিন্তু দ্বিতীয়বার ঢাকায় আসার পর কোথাও ঠিক স্থায়ীভাবে থাকতে পারিনি। জগন্নাথে চাকরি হওয়ার পর একটু নিশ্চিন্ত জীবন এবং তখনই গল্পগুলো একবারে লেখা। গল্প লিখে পুরস্কার পেলাম। পুরস্কার, তারপর আবার এত তরুণ বয়সে এবং প্রথম পুরস্কার, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি! সবমিলিয়ে গল্প লেখার ঝোঁকও কাজ করছিল। অন্যদিকে ফেলে আসা বিশাল গ্রামীণ জীবন আমাকে বারবার টানছিল। মনে হচ্ছিল. গল্পে পুরো জীবনটা কোনভাবে আসছে না। পুরো জীবনটাকে আনতে গেলে আমাকে বড় কিছু লিখতে হবে। উপন্যাস লেখার অভিজ্ঞতা ছিল, কিন্তু সেটা নিতান্তই সাধারণ। নিজেকে তৈরি করার জন্য গল্প লেখার অভিজ্ঞতা বড় একটা ভুমিকা পালন করেছে। উপন্যাস লিখতে গিয়ে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলাম। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লিখে ফেললাম দীর্ঘ পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে। সবার দৃষ্টি কাড়লো। আলোচনা-সমালোচনার ঝড়ের পাশাপাশি পুরস্কারও পেলাম। সুধীজনের পরামর্শ ও কাছের মানুষদের কাছে উৎসাহও পেলাম।
―‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’-এর প্রসঙ্গ যখন এলোই, এই উপন্যাস নিয়ে ভূয়সী প্রশংসার সমান্তরালে এর ভাষা নিয়ে তীর্যক সমালোচনাও আছে। আপনার সমসাময়িক অধিকাংশ গদ্যকারগণ যখন বর্তমান নিয়ে উপন্যাস লিখছেন; ঠিক সেই সময়ে আপনি ইতিহাস নির্ভও উপন্যাস লিখলেন কেন?
শওকত আলী: ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহ সবসময়েই ছিল। ইতিহাস তো বারবার ফিওে আসে। আর বাঙালির যে ইতিহাস সেখানে সংগ্রাম ও লড়াই এর একটা বড় জায়গা। আমাকে এই বিষয়টি অনেক ভাবাতো। আমি চেষ্টা করছিলাম বাঙালির এই নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসকে কোনভাবে আমার লেখায় তুলে আনতে। হলায়ুধ মিশ্রের ‘শেখ শুভোদয়া’ অনুবাদ করতে গিয়ে এই বিষয়টি আমাকে অনেক বেশি আলোড়িত করে। সংস্কৃত ভাষার প্রতি আমার আবেগ একটু বেশিই। সংস্কৃত সাহিত্য আমাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। যখন পড়তে পারতাম সংস্কৃত সাহিত্য পড়েছি বিস্তর। ফলে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লিখতে গিয়ে একটা কৃত্রিম ভাষার প্রয়োজন তো ছিলই। আমি সংস্কৃতর আশ্রয় নেই। তের শতকের জীবনকে ধরতেও এটা জরুরি ছিল। সমালোচনার কাজ পণ্ডিদের। আমি পণ্ডিত নই, লেখক। তারা অনেক কথা বলেন। পড়েছিও দু’একটা। আমি আমার কাজ করেছি। এখন এই সময়ে এসে এই সব কথা আমার কাছে অনেকটাই অর্থহীন। লেখকের কাজ লেখা। আমি সারাজীবন সেটাই করার চেষ্টা করেছি। শওকত ওসমান ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস লিখেছেন; সেলিনা হোসেন তো ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস লিখে গেল। এটা খুব কঠিন। কেননা ইতিহাসটা পাঠকের নখদর্পণে- সেটার বিপরীতে উপন্যাস পাঠ করতে গিয়ে পাঠককে লেখকের মতো চলতে হয়। এখানেই লেখকের চাতুর্যময় চলনশক্তি দেখা যায়। কিছুদিন আগে একটা উপন্যাস হাতে পেলাম ‘মুসলমানমঙ্গল’, লেখকের নাম মনে করতে পারছি না। ইতিহাস নির্ভর লেখা। বেশ ভাল কাজ। পুরোটা পড়তে পারিনি; পড়ার মতো সামর্থ্য চোখের নেই। কিন্তু উল্টে পাল্টে যতটুকু দেখলাম তাতে মনে হলো বেশ গভীরতা আছে।
―দীর্ঘ লেখক জীবনে ফরমায়েসি লেখা লিখতে হয়েছে নিশ্চয়। সেটা কিভাবে সামলাতেন।
শওকত আলী: হাসান ভাই ও জাফর ভাইয়ের পর তো সেরকম বড় মাপের কোন সাহিত্য সম্পাদক চোখে পড়েনি। তাদের সময়ে একটা চাপ ছিল। কেননা তারা শিল্প-সাহিত্য বুঝতেন। কিন্তু হালের পত্রিকাগুলো পাতা ভরার কাজ করে। তারা লেখক বোঝে না, লেখাও পড়ে না। বেশকিছুদিন আগে একটা উপনাসের নাম পর্যন্ত ভুল ছেপেছে। তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। সময়টাই এখন এরকম। মানুষ খুব ব্যস্ত। কিন্তু ধ্রুপদি জীবনের ছোঁয়া সবার জীবনেই আসে। তখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আসে। আর লেখার চাপের কথা যদি বলো, তাহলে শোন, লেখার জন্য কখনোই চাপ নিতাম না। চাপের মধ্যে কখনো ভাল লেখা আসে না। অনন্ত আমার আসে নি। তাই সামলানোর বিষয়ও আসে নি। আমি প্রতিদিন সময় কওে লিখতাম। এটা আমার কাছে সাধনার বিষয়।
―পুরস্কারের ঝাঁপিতে তো অনেক মহার্ঘ্য সম্মান ও পুরস্কার আছে। সেটাকে কিভাবে দেখেন? এছাড়া আপনি তো সভা-সমিতিতে যেতেন না। কেন?
শওকত আলী: পুরস্কার প্রেরণা। কিংবা কাজের এক ধরণের মূল্যায়ণ। আমি সেভাবেই দেখেছি। ফিলিপস পুরস্কার দু’বার পেয়েছি। কিংবা রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক। আমার কাছে সবসময় একটা বিষয় খুব নাড়া দিয়েছে, এই যে লিখছি, এখানে যারা আছে, যাদের কথা আছে, যাদের জীবন আছে―সেটা যেন জীবন ঘনিষ্ট হয়। আমি কখনোই অদেখা জীবন নিয়ে লিখিনি। লেখার চেষ্টাও করিনি। আমার ভেতরে এটা কখনোই কাজ করেনি। সভা-সমিতির কথা যদি বলো―এগুলোকে এড়িয়ে যেতেই ভাল লাগতো। বড় বড় তত্ত্বকথা বলতে ও শুনতে পছন্দ করতাম না। সাধারণ সাদামাটা একটা জীবন আমার। নিজের মধ্যে থাকতেই পছন্দ করতাম। লেখা ও পড়ার জন্য প্রচুর সময় দিতাম। হাঁটতে খুব ভাল লাগতো। অনেক সময় হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতাম। গলি গলি ঘুরে বাড়ি ফেরার আনন্দ আছে। পুরানো ঢাকার গলি কিংবা মতিঝিলের গলি―সব গলিই আমার কাছে একারণে চেনা। শ্রীরামপুরেও এভাবে ঘুরতাম। বলা ভালো শৈশবের অভ্যাস।
―কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলেন; পরে আর কখনো কবিতা লিখেন নি। শিশু কিশোরদের জন্য লিখেছেন। কথাসাহিত্য নিয়েই রইলেন। কখনো কবিতায় ফিরতে মন চায় নি?
শওকত আলী: কবিতা তো সবার মনেই আসে। আমিও লিখতে চেয়েছি। পারিনি। কথার চাপে কবিতা হয়তো আসে নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বেশকিছু কবিতা লিখেছি। কিন্তু ‘পিঙ্গল আকাশ’ প্রকাশিত হওয়ার পর সবকিছু পাল্টে গেল। ‘উন্মূল বাসনা’র গল্পগুলোও কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। মুনীর স্যার (মুনীর চৌধুরী), গাফ্ফার চৌধুরী (আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী), হাসান ভাই (হাসান হাফিজুর রহমান), জাফর (সিকানদার আবু জাফর) ভাই, সুভাষ (সুভাষ দত্ত), নুরুল হুদা (মুহম্মদ নুরুল হুদা) সবাই আমাকে গল্পে ঝুঁকতে বলেছিলেন। আমারও ভেতরে সেই তাড়নাই কাজ করছিল। এই সত্যটা আমিও অস্বীকার করতে পারিনি। তাই কবিতা লেখা হয়ে ওঠে নি। এবং একারণে আমার কোন আক্ষেপও নেই।
―অনেকেই বলে থাকেন, কথাসাহিত্যিক
শওকত আলী যতটা পাঠকের কাছে; ব্যক্তি শওকত আলী ঠিক ততটাই
দূরের। কেন?
শওকত আলী: আমি নিজের জগতের বাইরে কখনোই যাই নি। যেতে মনও টানে নি। বিভিন্ন ফিল্ম উৎসবে ছবি দেখতে গেছি- দর্শক হিসেবে। ছবি প্রদর্শনীতে গিয়েছি। ’৯৮-৯৯ সাল পর্যন্ত নিয়মিত সব জায়গায় যেতাম কিন্তু কথা বলার জন্য না। নিজের জন্য যেতাম। দেখতে শুনতে পড়তে ঘুরতে। পাঠকের কাছাকাছি কখনোই যাওয়া হয়নি। বইমেলাতেও সেভাবে যেতাম না। গেলে আড্ডা দিতেই যেতাম।
―লিখতে গিয়ে পরিবারের (স্ত্রী-সন্তান-আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে) সঙ্গে কোন দূরত্ব তৈরি হয়েছে কি?
শওকত আলী: আমার ও আমার স্ত্রীর নাম একই। ওর নাম শওকত আরা। বিয়ের কিছুদিন পড়েই ও বুঝেছে আমি লেখা ছাড়া কোনও জগত নেই। ছেলেরাও একসময় বুঝতে শিখেছে। আত্মীয়-স্বজনদের স্ত্রী-ই সামলে নিয়েছে। ফলে পরিবার আমার লেখার ক্ষেত্রে কোনও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারেনি, বা হয় নি। দূরত্বের ব্যাপার তো ঘটেই নি।
―ঢাকা পূর্ব আপনার জীবন অনেক বেশি বর্ণিল। ঢাকায় থিতু হওয়ার পর লেখায় এটিই আশ্রয় হলো। এটাকে কিভাবে দেখেন?
শওকত আলী: রায়গঞ্জের জীবন, দিনাজপুরের জীবন, কিংবা ঠাকুরগাঁওয়ের জীবন প্রকৃত অর্থেই বর্ণিল! সে এক অদ্ভুত জীবন। শৈশব ও কৈশোরের ভেতরেই তো লেখক-শিল্পীরা বাঁচেন। ঢাকায় স্থায়ী হওয়ার পর- সেইসব জীবন খুব বেশি টানতো। শৈশব ও কৈশোর স্মৃতি খুব বেশি নাড়া দিত। লেখার ক্ষেত্রেও তাই এটির প্রভাবও বেশি। আর প্রথমদিকেই বলেছি যে জীবন আমি দেখি নি সে জীবন নিয়ে আমি কখনো লিখিনি।
―পেশাগত জীবনে শিক্ষক- মানুষ তৈরির কারিগর। নিজে লেখক, তরুণ শিক্ষার্থীদের ভেতরে লেখক সত্তার উন্মেষ ঘটানোর কাজটা কী করতেন?
শওকত আলী: দ্যাখো, আমি শিক্ষকতা করেছি এমন একটা প্রতিষ্ঠানে যেখানে রথী-মহারথী গুণি শিক্ষকরা শিক্ষকতা করেছেন। তাদের ছত্রছায়ায় নিজেকে শাণিত করতাম। এটা যতটা না দ্বিপাক্ষিক তার চেয়ে বেশি একপাক্ষিক; অর্থাৎ আমার দিক থেকে এটা অনেক বেশি আগ্রহের জায়গা ছিল। আমার শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এটা ঘটেছে কিনা এখন সেভাবে মনে করতে পারছি না। অনেক কিছু ভুলে গেছি বয়সের কাছে হার মেনে। যদি সততার সঙ্গে বলি তাহলে বলবো, চেষ্টা তো অবশ্যই ছিল। বিভিন্নভাবে আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখার জগতের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ কওে দেওয়ার কোন ত্রুটি ছিল না।
―‘যাত্রা’, ‘নাঢ়াই’, ‘দলিল’, ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘অপেক্ষা’সহ আপনার অনেকগুলো উপন্যাসই মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক। তেভাগা আন্দোলন নিয়েও লিখেছেন, ভাষা আন্দোলন নিয়ে সেভাবে কিছু লিখেন নি। কেন?
শওকত আলী: এর জবাব তোমাকে আগেই দিয়েছি। ভাষা আন্দোরনের উত্তাপ বোঝার মতো বয়স তখন হয়নি। পরে এর ব্যাপকতা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ আমার দেখা শ্রেষ্ঠ সংগ্রাম- গত শতকে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই একটি ঘটনা সারা পৃথিবীকে আলোড়িত করেছে। এই ঘটনা শুধু বাঙালির নয়- সমগ্র পৃথিবীকে বিশেষত ক্ষমতাধর দেশগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করেছিল। এটার আবেদন তাই সমগ্রতাস্পর্শী। আমার ভেতরে এই বিষয়টি সবসময় কাজ করেছে। লিখতে গিয়ে চোখে দেখা দুঃসহ স্মৃতিগুলোকে ভুলতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধ স্বতঃস্ফূতভাবেই আমার লেখায় এসেছে। আর তেভাগা আন্দোলনের বিষয়টি আমার কাছে দূরবীণ দিয়ে দেখার মতো। ঠাকুরগাঁওয়ে থাকার সময় তেভাগা আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়- তাদের সঙ্গে মিশে গেছি, তাদের জীবন-যাপন এবং অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজেকে কিভাবে যেন একাত্মবোধ করে ফেলেছি, বুঝতে পারিনি। তারা বলতো চার হাতি লাঠি তৈরি করো, তারা বন্দুকের বিপরীতে তাদের তীর ধনুক নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ নিজেদের আজন্মকালের ব্যবহৃত অস্ত্রকেই তারা হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে। এটা একটা বিশাল উপলব্ধি। একাত্তরেও আমাদের সেই একই উপলব্ধি হয়েছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি বিরুদ্ধে আমরা আমাদের যা কিছু ছিল, তাই নিয়েই লড়াই করেছি। এখন টেলিভিশন দেখে সময় কাটে। কদিন আগে দেখলাম তরুণ ছেলেমেয়েরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে শাহবাগে আন্দোলন করছে। ওদের হাতে কোনও অস্ত্র নেই। ওরা যে এক হয়ে এক জায়গায় একটা স্বর তৈরি করতে পেরেছে- এটাই বড় অস্ত্র। পৃথিবীর সকল দেশে এই উপলব্ধিজাত বিষয়কে উপেক্ষা করার মতো দুঃসাহস কোন প্রতিষ্ঠান, কোনও দল কোনও জাতি, কোনও রাষ্ট্র দেখাতে পারেনি। মৃত্তিকালগ্ন মানুষ বারবারই এই কথাই আমি বলার চেষ্টা করেছি। বিশেষত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় পড়ার সময় এই উপলব্ধি আমার খুব হয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ে থাকার সময় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় খুব পড়েছি। বলা ভালো তার একটা প্রভাবও আমার ভেতওে আছে। ঢাকায় আসার পর এইসব প্রতিক্রিয়া সামলাতে পারিনি। আমার দেখা ঐসব তেভাগা আন্দোলনের কথা ও অভিজ্ঞতার খুব সামান্যই হয়তো আমার লেখায় এসেছে। কিন্তু তাদের এই আন্দোলন ও প্রাণময় সংগ্রামকে ধারণ করার যোগ্যতা আমার কোথায়! তবু যতটুকু পেরেছি, এনেছি।
―আপনার সঙ্গে ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’-এর সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলুন?
শওকত আলী: বদরুদ্দীন উমর ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় দীর্ঘদিনের- তার প্রেরণা এবং ইলিয়াস; যার সঙ্গে আমার পথচলা প্রায় চার দশকের। ইলিয়াসই আমাকে জোর করে একদিন নিয়ে যায়। সেই থেকে শুরু। ইলিয়াস আমার সহদোরতুল্য। ওর কোন কথা ফেলতে পারতাম না। ওদের পত্রিকা ‘তৃণমূল’-এর সম্পাদনা করেছি কয়েক সংখ্যা, যদিও ওরাই খুব গুছিয়ে কাজ করে। আমি শুধু দেখে দিয়েছি, কিংবা চোখ বুলিয়েছি। ইলিয়াস প্রয়াত হওয়ার পর ওদের কার্যক্রম অনেকটা স্তিমিত। এটা হওয়ার কথা ছিল না।
―ইলিয়াসের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক, সমঝোতা―সবকিছু মিলিয়ে একটি সেতুময় সম্পর্কের কথা আমরা সকলেই জানি। তার লেখা ও ব্যক্তি ইলিয়াস নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাই।
শওকত আলী: ইলিয়াসের নাম আগে থেকেই জানতাম। পরিচয়ও ছিল একটু আধটু। জগন্নাথে সহকর্মী হলো। আমিও কষ্টে-সৃষ্টে হাটখোলার বাড়িটা দোতলা করেছি। উপরতলায় আমি পরিবার নিয়ে থাকি। নিচতলা খালি। তখন ঢাকা তো এত ঘিঞ্জি ছিল না। ইলিয়াসের বিয়ের পর থাকার জায়গা দরকার ছিল। আমাকে বললো। আমি বললাম, চলে এসো। সেদিনই চৌকি, মাদুর কিনে এনে ওরা উঠে পড়লো। আমার একটা টেবিল ছিল, অব্যবহৃত। সেটা দিলাম। মজার বিষয় ওর একটা চেয়ার দরকার ছিল, খুব স্বাভাবিক। ছাদে একটা চেয়ার ছিল তেপায়া! অর্থাৎ একটা পা ভাঙ্গা। ইলিয়াস সেটাই ব্যবহার করতে লাগলো। আমাদের মধ্যে একধরণে যোগসূত্র ছিল। আমি ওকে শাসন করতাম, ও আমাকে। লেখার ব্যাপারে তো বটেই। ওর লেখার প্রাথমিক পাঠক-সমালোচক ছিলাম আমি- আমার ক্ষেত্রে ও। আমাদের পরস্পরের সমালোচনায় কত লেখাকে যে কাটছাট করতে হয়েছে। কিংবা পুনরায় লিখতে হয়েছে- তার ইয়ত্তা নেই। হাসান ভাই ও জাফর ভাইয়ে পর ইলিয়াসের সঙ্গেই এই সম্পর্ক আমৃত্যু বিদ্যমান ছিল। ইলিয়াসের লেখার মূল্যায়ণ করতে গেলে সারাদিন ফুরিয়ে যাবে। শুধু এতটুক বলবো, অনুবীক্ষণ যন্ত্রে ফেলে ইলিয়াস চরিত্র তৈরি করতো। ওর মতো লেখক বাঙালি পাঠক খুব একটা পায় নি।
―আপনার আত্মজীবনী ‘পেছনের দিগন্ত’ দুই কিস্তি ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’-এর পত্রিকা ‘তৃণমূল’-এ ছাপানো হয়েছে। বাকি অংশটা লিখবেন না? এটাতো শেষ করা উচিৎ।
শওকত আলী: তুমি দীর্ঘদিন ধরে আমাকে চেন। ভাল করেই জান আমি লিখতে পারছি না। চোখ ও মস্তিষ্ক সায় দেয় না। লেখার জন্য যে শারীরিক সুস্থতা তা আমার নেই বলতে গেলে। আত্মজীবনীটা লিখে শেষ করার ইচ্ছে আছে। পারবো কি না জানি না। তবে চেষ্টা করবো। তবে মিথ্যে বানোয়াট কথা লিখে যেতে চাই না। তাই যতটুকু মনে আসবে, স্মৃতি সায় দেবে ঠিক ততটুকুই লিখবো। নচেৎ নয়।
শওকত আলী: আমি নিজের জগতের বাইরে কখনোই যাই নি। যেতে মনও টানে নি। বিভিন্ন ফিল্ম উৎসবে ছবি দেখতে গেছি- দর্শক হিসেবে। ছবি প্রদর্শনীতে গিয়েছি। ’৯৮-৯৯ সাল পর্যন্ত নিয়মিত সব জায়গায় যেতাম কিন্তু কথা বলার জন্য না। নিজের জন্য যেতাম। দেখতে শুনতে পড়তে ঘুরতে। পাঠকের কাছাকাছি কখনোই যাওয়া হয়নি। বইমেলাতেও সেভাবে যেতাম না। গেলে আড্ডা দিতেই যেতাম।
―লিখতে গিয়ে পরিবারের (স্ত্রী-সন্তান-আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে) সঙ্গে কোন দূরত্ব তৈরি হয়েছে কি?
শওকত আলী: আমার ও আমার স্ত্রীর নাম একই। ওর নাম শওকত আরা। বিয়ের কিছুদিন পড়েই ও বুঝেছে আমি লেখা ছাড়া কোনও জগত নেই। ছেলেরাও একসময় বুঝতে শিখেছে। আত্মীয়-স্বজনদের স্ত্রী-ই সামলে নিয়েছে। ফলে পরিবার আমার লেখার ক্ষেত্রে কোনও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারেনি, বা হয় নি। দূরত্বের ব্যাপার তো ঘটেই নি।
―ঢাকা পূর্ব আপনার জীবন অনেক বেশি বর্ণিল। ঢাকায় থিতু হওয়ার পর লেখায় এটিই আশ্রয় হলো। এটাকে কিভাবে দেখেন?
শওকত আলী: রায়গঞ্জের জীবন, দিনাজপুরের জীবন, কিংবা ঠাকুরগাঁওয়ের জীবন প্রকৃত অর্থেই বর্ণিল! সে এক অদ্ভুত জীবন। শৈশব ও কৈশোরের ভেতরেই তো লেখক-শিল্পীরা বাঁচেন। ঢাকায় স্থায়ী হওয়ার পর- সেইসব জীবন খুব বেশি টানতো। শৈশব ও কৈশোর স্মৃতি খুব বেশি নাড়া দিত। লেখার ক্ষেত্রেও তাই এটির প্রভাবও বেশি। আর প্রথমদিকেই বলেছি যে জীবন আমি দেখি নি সে জীবন নিয়ে আমি কখনো লিখিনি।
―পেশাগত জীবনে শিক্ষক- মানুষ তৈরির কারিগর। নিজে লেখক, তরুণ শিক্ষার্থীদের ভেতরে লেখক সত্তার উন্মেষ ঘটানোর কাজটা কী করতেন?
শওকত আলী: দ্যাখো, আমি শিক্ষকতা করেছি এমন একটা প্রতিষ্ঠানে যেখানে রথী-মহারথী গুণি শিক্ষকরা শিক্ষকতা করেছেন। তাদের ছত্রছায়ায় নিজেকে শাণিত করতাম। এটা যতটা না দ্বিপাক্ষিক তার চেয়ে বেশি একপাক্ষিক; অর্থাৎ আমার দিক থেকে এটা অনেক বেশি আগ্রহের জায়গা ছিল। আমার শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এটা ঘটেছে কিনা এখন সেভাবে মনে করতে পারছি না। অনেক কিছু ভুলে গেছি বয়সের কাছে হার মেনে। যদি সততার সঙ্গে বলি তাহলে বলবো, চেষ্টা তো অবশ্যই ছিল। বিভিন্নভাবে আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখার জগতের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ কওে দেওয়ার কোন ত্রুটি ছিল না।
―‘যাত্রা’, ‘নাঢ়াই’, ‘দলিল’, ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘অপেক্ষা’সহ আপনার অনেকগুলো উপন্যাসই মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক। তেভাগা আন্দোলন নিয়েও লিখেছেন, ভাষা আন্দোলন নিয়ে সেভাবে কিছু লিখেন নি। কেন?
শওকত আলী: এর জবাব তোমাকে আগেই দিয়েছি। ভাষা আন্দোরনের উত্তাপ বোঝার মতো বয়স তখন হয়নি। পরে এর ব্যাপকতা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ আমার দেখা শ্রেষ্ঠ সংগ্রাম- গত শতকে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই একটি ঘটনা সারা পৃথিবীকে আলোড়িত করেছে। এই ঘটনা শুধু বাঙালির নয়- সমগ্র পৃথিবীকে বিশেষত ক্ষমতাধর দেশগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করেছিল। এটার আবেদন তাই সমগ্রতাস্পর্শী। আমার ভেতরে এই বিষয়টি সবসময় কাজ করেছে। লিখতে গিয়ে চোখে দেখা দুঃসহ স্মৃতিগুলোকে ভুলতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধ স্বতঃস্ফূতভাবেই আমার লেখায় এসেছে। আর তেভাগা আন্দোলনের বিষয়টি আমার কাছে দূরবীণ দিয়ে দেখার মতো। ঠাকুরগাঁওয়ে থাকার সময় তেভাগা আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়- তাদের সঙ্গে মিশে গেছি, তাদের জীবন-যাপন এবং অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজেকে কিভাবে যেন একাত্মবোধ করে ফেলেছি, বুঝতে পারিনি। তারা বলতো চার হাতি লাঠি তৈরি করো, তারা বন্দুকের বিপরীতে তাদের তীর ধনুক নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ নিজেদের আজন্মকালের ব্যবহৃত অস্ত্রকেই তারা হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে। এটা একটা বিশাল উপলব্ধি। একাত্তরেও আমাদের সেই একই উপলব্ধি হয়েছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি বিরুদ্ধে আমরা আমাদের যা কিছু ছিল, তাই নিয়েই লড়াই করেছি। এখন টেলিভিশন দেখে সময় কাটে। কদিন আগে দেখলাম তরুণ ছেলেমেয়েরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে শাহবাগে আন্দোলন করছে। ওদের হাতে কোনও অস্ত্র নেই। ওরা যে এক হয়ে এক জায়গায় একটা স্বর তৈরি করতে পেরেছে- এটাই বড় অস্ত্র। পৃথিবীর সকল দেশে এই উপলব্ধিজাত বিষয়কে উপেক্ষা করার মতো দুঃসাহস কোন প্রতিষ্ঠান, কোনও দল কোনও জাতি, কোনও রাষ্ট্র দেখাতে পারেনি। মৃত্তিকালগ্ন মানুষ বারবারই এই কথাই আমি বলার চেষ্টা করেছি। বিশেষত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় পড়ার সময় এই উপলব্ধি আমার খুব হয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ে থাকার সময় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় খুব পড়েছি। বলা ভালো তার একটা প্রভাবও আমার ভেতওে আছে। ঢাকায় আসার পর এইসব প্রতিক্রিয়া সামলাতে পারিনি। আমার দেখা ঐসব তেভাগা আন্দোলনের কথা ও অভিজ্ঞতার খুব সামান্যই হয়তো আমার লেখায় এসেছে। কিন্তু তাদের এই আন্দোলন ও প্রাণময় সংগ্রামকে ধারণ করার যোগ্যতা আমার কোথায়! তবু যতটুকু পেরেছি, এনেছি।
―আপনার সঙ্গে ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’-এর সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলুন?
শওকত আলী: বদরুদ্দীন উমর ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় দীর্ঘদিনের- তার প্রেরণা এবং ইলিয়াস; যার সঙ্গে আমার পথচলা প্রায় চার দশকের। ইলিয়াসই আমাকে জোর করে একদিন নিয়ে যায়। সেই থেকে শুরু। ইলিয়াস আমার সহদোরতুল্য। ওর কোন কথা ফেলতে পারতাম না। ওদের পত্রিকা ‘তৃণমূল’-এর সম্পাদনা করেছি কয়েক সংখ্যা, যদিও ওরাই খুব গুছিয়ে কাজ করে। আমি শুধু দেখে দিয়েছি, কিংবা চোখ বুলিয়েছি। ইলিয়াস প্রয়াত হওয়ার পর ওদের কার্যক্রম অনেকটা স্তিমিত। এটা হওয়ার কথা ছিল না।
―ইলিয়াসের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক, সমঝোতা―সবকিছু মিলিয়ে একটি সেতুময় সম্পর্কের কথা আমরা সকলেই জানি। তার লেখা ও ব্যক্তি ইলিয়াস নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাই।
শওকত আলী: ইলিয়াসের নাম আগে থেকেই জানতাম। পরিচয়ও ছিল একটু আধটু। জগন্নাথে সহকর্মী হলো। আমিও কষ্টে-সৃষ্টে হাটখোলার বাড়িটা দোতলা করেছি। উপরতলায় আমি পরিবার নিয়ে থাকি। নিচতলা খালি। তখন ঢাকা তো এত ঘিঞ্জি ছিল না। ইলিয়াসের বিয়ের পর থাকার জায়গা দরকার ছিল। আমাকে বললো। আমি বললাম, চলে এসো। সেদিনই চৌকি, মাদুর কিনে এনে ওরা উঠে পড়লো। আমার একটা টেবিল ছিল, অব্যবহৃত। সেটা দিলাম। মজার বিষয় ওর একটা চেয়ার দরকার ছিল, খুব স্বাভাবিক। ছাদে একটা চেয়ার ছিল তেপায়া! অর্থাৎ একটা পা ভাঙ্গা। ইলিয়াস সেটাই ব্যবহার করতে লাগলো। আমাদের মধ্যে একধরণে যোগসূত্র ছিল। আমি ওকে শাসন করতাম, ও আমাকে। লেখার ব্যাপারে তো বটেই। ওর লেখার প্রাথমিক পাঠক-সমালোচক ছিলাম আমি- আমার ক্ষেত্রে ও। আমাদের পরস্পরের সমালোচনায় কত লেখাকে যে কাটছাট করতে হয়েছে। কিংবা পুনরায় লিখতে হয়েছে- তার ইয়ত্তা নেই। হাসান ভাই ও জাফর ভাইয়ে পর ইলিয়াসের সঙ্গেই এই সম্পর্ক আমৃত্যু বিদ্যমান ছিল। ইলিয়াসের লেখার মূল্যায়ণ করতে গেলে সারাদিন ফুরিয়ে যাবে। শুধু এতটুক বলবো, অনুবীক্ষণ যন্ত্রে ফেলে ইলিয়াস চরিত্র তৈরি করতো। ওর মতো লেখক বাঙালি পাঠক খুব একটা পায় নি।
―আপনার আত্মজীবনী ‘পেছনের দিগন্ত’ দুই কিস্তি ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’-এর পত্রিকা ‘তৃণমূল’-এ ছাপানো হয়েছে। বাকি অংশটা লিখবেন না? এটাতো শেষ করা উচিৎ।
শওকত আলী: তুমি দীর্ঘদিন ধরে আমাকে চেন। ভাল করেই জান আমি লিখতে পারছি না। চোখ ও মস্তিষ্ক সায় দেয় না। লেখার জন্য যে শারীরিক সুস্থতা তা আমার নেই বলতে গেলে। আত্মজীবনীটা লিখে শেষ করার ইচ্ছে আছে। পারবো কি না জানি না। তবে চেষ্টা করবো। তবে মিথ্যে বানোয়াট কথা লিখে যেতে চাই না। তাই যতটুকু মনে আসবে, স্মৃতি সায় দেবে ঠিক ততটুকুই লিখবো। নচেৎ নয়।
জুলাই 8, 2013
0 মন্তব্যসমূহ