ছোটগল্পের সবচেয়ে বড় দুঃখ লেখকদের নিরীক্ষাপ্রবণতা, সুখ এখনো রাবীন্দ্রিক; ব্যতিক্রমও আছে। অনুকারক নিরীক্ষাপ্রবণ লেখক আর পরিশ্রমী
অনুশীলনঅন্ত লেখকের পার্থক্য এখানে। এখানেই তাদের স্বাতন্ত্র্য। প্রতিভাবানরা ক্রমাগত
অনুশীলনের মাধ্যমে নিজের অভিজ্ঞতা, কল্পনা, প্রজ্ঞার সমন্বয়ে গল্পের অবয়ব ও প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।
দুর্বলরা অন্ধ অনুকরণের পথে হেঁটে হেঁটে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হন। তবু সাহিত্য
জগতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অনুকরণসর্বস্ব লেখাকে নিরীক্ষাপ্রবণ লেখা বলে
চালিয়ে দিতে চান। এ প্রসঙ্গে হোসেন উদ্দীন হোসেনের মতে --যারা অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে অক্ষম তারাই প্রকাশের
পথ না পেয়ে নিরীক্ষা করে থাকেন। সাহিত্যে কোনো নিরীক্ষার পথ নেই-- আছে প্রকাশক্ষমতা। একজন লেখক কীভাবে রূপ দেবেন, সেটা নির্ভর করে লেখকের ক্ষমতার ওপর। অক্ষমের জন্যে
এই শিল্প নয়-- এই শিল্পের যিনি শিল্পী তার জন্য অনুকরণ নয়-- অনুশীলনই হচ্ছে মূলকর্ম। বিশ শতকের অন্তিমে ল্যাটিন আমেরিকার কথাসাহিত্যের
অনুরকরণে কেউ কেউ গল্পহীন গল্প বলার চেষ্টা করেছেন। ওই সব রচনা এত বেশি অনুকরণসর্বস্ব
যে, অনুবাদ বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। এসব লেখক মূলত হোসেনউদ্দীন
হোসেন কথিত অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে অক্ষম। ফলে নিরীক্ষার নামে
অনুকরণেই শ্রম ক্ষয় করেন। আর প্রকৃত স্রষ্টা প্রচল পথকে স্বীকার করে, প্রচল পথে হাঁটতে হাঁটতেই নিজস্ব পথ তৈরি করেন। যারা
প্রথার ভেতরে থেকেই প্রথাভাঙার জটিল কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্তও তাদের
একজন। তার নাম আলাদাভাবে উচ্চারণ করতে হয়। এর মূল কারণ, এই শিল্পী সকল লোকের মাঝে বসেও নিজের মুদ্রাদোষে আলাদা হতে জানেন। তাঁর গল্পভাষা, গল্পপরিবেশ, সংলাপ ও শৈলী যেমন স্বতন্ত্র, তেমনি বিষয়বস্তুতেও। সবচেয়ে বড় কথা-- গল্পগুলো মূলত একরৈখিক। বহুরৈখিকতার নামে ছোটগল্পকে অহেতুক পারম্পর্যহীন প্রলাপে
পর্যবসিত করেন না তিনি।
শিল্পের তৃষ্ণায় যেমন, তেমনি মানবপ্রবৃত্তির বিভিন্ন দিক আবিষ্কার ও উপলব্ধির জন্যও লেখকের কলম চলে। মূলত
সমাজ ঘিরেই লেখকের চিন্তা ও কল্পনা আবর্তিত। অভিজ্ঞতার সঙ্গে চিন্তার ও কল্পনার বিরোধ
কখনো কখনো ঘটে; তবে প্রজ্ঞা ও যুক্তিবোধের সম্মিলনে তার মীমাংসা লেখক
করে নেন। কারণ, শিল্পের উদ্দেশ্য আর যাই হোক, শিল্পপিপাসুকে ধাঁধায় ফেলার কোনো চালাকি শিল্পী করেন
না। কথা-শিল্পীর লক্ষ্য মূলত পাঠকের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ স্থাপন, ভাবনাবিনিময়। এই বিনিময় চলে নীরবে, লিখন, পুনঃলিখন, পুনঃলিখন এবং পঠন-পাঠনের ভেতর দিয়ে। এ ক্ষেত্রে পাঠক
নয়, লেখকেরই দায় বেশি। অবাধ বাণিজ্যিকীকরণের এই যুগে শিল্পের
যে শাখার অর্থমূল্য নেই, তার ভোক্তা নেই।
ওই অর্থে গল্প-কবিতা-গান প্রভৃতিও এক ধরনের লেখালেখিও পণ্য; অন্তত পণ্যসম্মত। লেখাশিল্প যদি পণ্যসম্মত হয়, পাঠক তার ভোক্তা মাত্র। সুতরাং ভোক্তার রুচি বুঝে
পণ্যসৃষ্টির দায় স্রষ্টার। পাশাপাশি ভোক্তারুচি গঠনের দায়ও তার। জ্যোতিপ্রকাশ ভোক্তারুচি
গঠনের কাজটি করেছেন সন্তর্পণে প্রায় নীরবে।
তার গল্পের বিষয় যেমন মানবজীবেরন গূঢ়ৈষা তেমনি গৃহস্থালীও। সাংসারিক
মানুষের দৈনন্দিন জীবনপ্রণালী অঙ্কনে তার মুনশিয়ানা উল্লেখ করার মতো। এ ধারা সার্থক
গল্প সরল সংসার। সমাজজীবনে মানুষ যেসব ক্ষেত্রে উঁচু-নীচু বংশের সহাবস্থান করতে বাধ্য
হয়, তার মধ্যে দাম্পত্য জীবনও একটি। বংশের মর্যাদাগত পার্থক্যের
কারণে অনেক সময় একে-অন্যকে সমীহ করে না, দেখায় না বিন্দুমাত্র সম্মানও। আর এ থেকে মনোমালিন্যও লেগে থাকে সংসার জীবনে। তবে
এ ক্ষেত্রে বংশমর্যাদা যার অবস্থান, নিুবর্গে, তার মধ্যে যদি অসীম সহ্যশক্তি থাকে, তবে সংসারে ফাটল ধরে কম। কিন্তু পরস্পরকে ব্যঙ্গ করার
প্রবণতা থেকে যায়। পরস্পরের প্রতি অপ্রেম সত্ত্বেও সংসার টিকিয়ে রাখার মোক্ষম অস্ত্র
হল-- জীবনসঙ্গীর সব উপেক্ষা-অবজ্ঞা গায়ে না মাখা। তাহলেই
কেবল একটি সরল সংসার বাস্তব। সরল সংসার গল্পে লেখক এমন চিত্রই এঁকেছেন। গল্পের প্রধান চরিত্র সেনমশায়। তার শ্বশুর সরলতাকে
সংজ্ঞায়িত করেন এভাবে, সুযোগ পেলে তার ব্যবহার
করা অসারল্যের লক্ষণ নয়। আসলে তুমি যখন ঠকে গেলে তখুনি সরে দাঁড়াচ্ছ, আর মন থেকে মুছে ফেলছ সবকিছু, তখন তুমি সরল। অর্থাৎ ডারউইন কথিত সার্ভাইব করাটাই সরল জীবন। এ গল্পের প্রধান চরিত্র যদিও সেনমশায়
হয়, তাহলে তার স্ত্রী নন্দরানীকেও প্রধানের কাতারে রাখতে
হয়। কারণ সেনমশায় মূলত নন্দরানীদের আশ্রিত এবং নিজে নিুবর্গের। পুরোগল্পের ভেতর নন্দরানী
ও সেনমশায়ের সংসার ধর্মের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সম্পর্ক, আচরণ ও কর্মপরিধি চিত্র রয়েছে। আর আছে তাদের কাজের ছেলে, নিতাই। যে সেনমশায়দের সংসারে কাজের বিনিময়ে দুবেলা
দুমুঠো ভাত আর একবেলা স্কুলে যাওয়ার সুযোগটুকু পায়। নন্দরানী নিতাইকে দিয়ে সময়-অসময়ে
গৃহস্থালী কাজ তো করিয়ে নেয়, পারলে তার স্কুলের
সময়টুকুতেও। নন্দরানী নিজে ধনীর মেয়ে বলে নিজেকে উঁচুতলার এবং প্রভু ভাবতে পছন্দ করে
সে। সমাজের নিুবর্গের মানুষকে সে মনে করে কাকের মতো। তার বিশ্বাস নিুবর্গের কাজই হলো
উচ্চবর্গের ডাকে সাড়া দেওয়া আর প্রতিবাদহীন-ক্লান্তিহীন-অভিযোগহীন পরিশ্রম করা। কারণ
যে পরিশ্রম করতে পারবে না তার ঠাঁই সমাজে নেই। কেন না, গরিবরা তো কাকের মতো, আর একজন টিকে থাকতে না পারলে আরেকজন হুমড়ি খেয়ে পড়বে।
নন্দরানী বিশ্বাস করে এবং তা প্রচারও করে। বলে, ভাত ছিটালে কাকের অভাব হবে না। সুতরাং এসব জেনে-শুনে-বুঝে নিতাই কেন নন্দরানীর
অবাধ্য হবে? কারণ নিতাই নিজেই কাক। অতএব জানে ভাতের লোক কী বস্তু। এগল্পের মূল কথা এটুকু নয়, আরও একটু আছে। নন্দরানী একসময় সন্তানলাভের আশায় এক
জাদুকরি প্ররোচনায় ধরা পড়ে। জাদকরির শর্তানুসারে পাঁচটা ডিম মন্ত্রপূত হলে পর ভর সন্ধ্যেবেলায়
নদীর পাড়ে যে দুই-মুখওয়ালা গর্তে সাপ থাকে, সেই গর্তে রেখে আসতে হবে। শর্তানুসারে নিতাই ডিমগুলো নিয়ে নদীর পাড়ে যায়। কিন্তু সে গর্তে রেখে আসে তা সাপের
গর্ত নয়, ইঁদুরের। বিষয়টা জানার সুযোগ হয় না কোনোদিন নন্দরানীর
কিন্তু সেনমশায় নিজেই নিতাই-ননীগোপালের কথোপকথন শুনে এসেছেন। তাই তিনি জানেন সত্যটা
কী? তিনি বুঝতে পারেন কখন, কাকে, কে কীভাবে ঠকায়। আর এই ঠকানোর বিষয়টি কীভাবে মন থেকে মুছে যেতে হয়। সেনমশায় শ্বশুরের
শেখানো সারল্যের অর্থ উপলব্ধি করতে শুরু করেন; নিজের দোকানে বসে তার মনে হয়, যেন আবার তিনি সরললেখাটার ওপরে এসে দাঁড়ালেন। পুরোগল্পে মূলত সংসারের টিকে থাকা অর্থাৎ অস্তিত্ববাদী
চেতনার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক।
অনেক সময় লেখকরা গল্পের ভেতর এক ধরনের স্বপ্নসর্বস্ব ভুবন সৃষ্টি
করেন। সে ভুবনে ঘোরের ভেতর প্রবেশ করলে এক ধরনের আনন্দ মেলে। কিন্তু ওই ঘোর কেটে গেলেই
সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়। পাঠকমনে ক্ষণিকের আনন্দ এক সময় বিষাদে পরিণত হয়। গল্পের চিত্র
পাঠক সমাজে কখনো দেখতে পায় না, অথচ পঠন-পাঠন শেষে পাঠলব্ধ ধারণার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার স্বাভাবিক অভিপ্রায় জাগে
তার। কিন্তু তার স্বপ্নে সঙ্গে বাস্তবতার মিল প্রায় হয় না। অর্থাৎ সাহিত্যে চিত্রিত
জীবনের সঙ্গে বাস্তব জীবনের পার্থক্য স্পষ্ট থাকে। অথচ লেখকের কাজ সমাজের প্রতিচিত্র
অঙ্কন করা। কাজী আবদু ওদুদ বাংলা সাহিত্যের চর্চা প্রবন্ধে লিখেছেন, পাড়াগাঁয়ের ব্যাপারী যেন আলাউদ্দিনের প্রদীপের দৈত্যের
সাহায্যে রাতারাতি হয়ে উঠেছে বিশ্বের বন্দরের সওদাগর!-- গ্রাম্য-সমাজের অন্ধ গতানুগতির পরিবর্তে জগৎ সমাজের
ধর্মতত্ত্ব সৌন্দর্য বিজ্ঞান সমাজনীতি রাজনীতি তার অবলম্বন ও উপজীবিকা!... বাংলার সাধারণ
জীবনের সঙ্গে বাংলার সাহিত্য জীবনের এই প্রভেদ।’ যে জীবনে সমাজ যাপন করে না, লেখক সে জীবনের স্বকপোলকল্পিত চিত্র আঁকতে গেলে কেবল পাঠকের সঙ্গে চাতুরিই করে
না, উপরন্তু মেধার অপচয়ও করে। জ্যোতিপ্রকাশের গল্পে এই
আলাদিনের চেরাগ নেই, নেই সেই দৈত্যও।
পুরোটাই মাটির মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের চিত্র।
তাই বলে মনোবিকলন যে নেই তা নয়। তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোর মধ্যে
যেমন মহত্ত আছে,
তেমনি আছে হিংসা, দ্বেষ, প্রতিহিংসাপরায়ণতাও। পিতৃঘœ গল্পে সৎমায়ের অবহেলা আর বাবার কাছ থেকে প্রায়ত্যাজ্য খোকা বেড়ে
ওঠে অন্যের আশ্রয়ে। নিজের চেষ্টায়-পরিশ্রমে। এ নিয়ে খোকার মনে ক্ষোভ-প্রতিপরায়ণতা কাজ
করে। মনে মনে প্রতীজ্ঞা করে বাবার ওপর একদিন প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু তার প্রতিশোধ নেওয়া
হয় না। ওদিকে ছেলের প্রতিষ্ঠায় বাবার বুক গর্বে ফুলে ওঠে। বাবা গ্রামের দশজনকে ছেলের
বেড়ে ওঠা, প্রতিষ্ঠার গল্প করেন। আশ্লাঘায়ও ভোগেন। গল্পের কথক
খোকা, মাতৃহারা, বাবা ও সৎমায়ের অবহেলায় নিজের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত। তাই তার ভেতরে এক ধরনের ক্ষোভের
জš§ হয়, যে ক্ষোভ থেকে সে বাবাকে কিছু কথা শুনিয়ে দিতে চায় বারবার। চায় কিছু অপমান করতেও।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারে না। এদিকে বাবা চরিত্রটিও বড় অদ্ভূত। যে সন্তানকে নিজে প্রতিষ্ঠিত
করতে পারেন না, সে সন্তানের সাফল্যেই তার বুক ভরে ওঠে। এ গল্পে পটভূমি
গ্রামের, জীবনচিত্রও গ্রামীণ। আবহমান গ্রামবাংলার চিরাচরিত
চিত্র এইÑ মৃত স্ত্রীর সন্তানকে বর্তমান স্ত্রীর সামনে স্নেহমমতা দিয়ে আগলে রাখতে পারেন না কোনো বাবা, বিশেষত নিুবর্গে। সন্তানরা প্রায় অনাদরে বেড়ে ওঠে।
এক সময় প্রতিষ্ঠিত হলে বাবা-সৎমাকে ওই সন্তানের আয়ের ওপরই নির্ভর করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের
গ্রামীণজীবন এমন পারিবারিক-ধর্মীয় অনুশাসনের শৃঙ্খলে নিয়ন্ত্রিত যে সন্তান চাইলেও তার
প্রতি অবহেলা কিংবা নির্যাতনের প্রতিশোধ সে নিতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে বাবা আর নিগৃহীত
সন্তানকে প্রায় অবদমিতই থাকতে হয়।পিতৃঘœ গল্পে এ সত্যই ফুটিয়ে তুলেছেন জ্যোতিপ্রকাশ।
রজব আলী ও কথক, এই দুই চরিত্রের মধ্যকার কিছু প্রশ্ন কিছু বাস্তব আর কিছু রহস্যের মিথস্ক্রিয়ায়
লেখা হয়েছে সারাজীবন। রজব আলীর একটাই প্রশ্ন : দুঃখ কী? সে তার প্রশ্নের উত্তরের সমর্থনে কিছু তথ্য উপস্থাপন
করে। কিন্তু প্রতিবারই কথক বলে, দুঃখ আরও গভীর কিছু। এই আরও গভীর কিছুর প্রতীক কথকের ঘরে থাকা, একটি ট্রাঙ্ক। যার কোনো চাবি নেই। ট্রাঙ্ক খোলে কেবল
নির্ভেজাল দুঃখী মানুষের স্পর্শে। একদিন দুঃখী মানুষেরও সন্ধান মেলে। রজব আলীর খুব
দুঃখের সময় ট্রাঙ্কে হাত রাখে সে। অমনি ট্রাঙ্ক খুলে যায়। রজব ঢুকে পড়ে এর ভেতরে। তখন
সারাজীবন প্রশ্ন করে যে সেই রজব আলীই উত্তর দেয় : হুজুর জীবনটা যদি এমন হতো! আমাদের
বড় দুঃখ। অর্থাৎ দুঃখের সংজ্ঞা ও পরিচয় তারা পেয়ে যায় একদিন। এই গল্পে লেখক দেখিয়েছেন, সুখী মানুষ যেমন সুখ কী বস্তু সহজে বুঝতে পারে না, তেমনি অনন্ত দুঃখে যাদের জীবন গড়া, তারাও দুঃখ কী বস্তু সহজে বুঝতে পারে না। এই উভয় শ্রেণীর
জন্য দরকার বিশেষ পরীক্ষাব্যবস্থা। একটা বিশেষ পরীক্ষালব্ধ সত্য, যা থেকে তারা জীবনের সবচে রূঢ় প্রশ্নের উত্তর খুঁজে
পাবে।
আজীবন দিন-রাত্র গল্প উত্তম পুরুষে লিখিত। গল্পে চরিত্র সংখ্যা তিন। কথক, রবি আর রীনা। এই তিন জনের জটিল সম্পর্কের বিবরণ এ
গল্প। কথক চরিত্রের মানসগঠন যতটা জটিল ও সংশয়পূর্ণ অন্য চরিত্র ততটা নয়। তাদের আচরণ
স্বাভাবিক এবং বাস্তবনিষ্ঠ। সন্দেহপ্রবণতা, মনোবিকলন সবই কথকের চরিত্রে স্পষ্ট। এদিক থেকে কথক, আধুনিক, সময়ের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলা চরিত্র, বাকি চরিত্ররা অবদমিত কিঞ্চিৎ কপটচারীও। নিজের মধ্যেকার সম্পর্ককে তারা স্পষ্ট
করে তোলে না, নিজেদের কাক্সক্ষা প্রকাশ করে না সবার সামনে। সামাজিক
প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে, তারা সমাজের কানুনের
অধীন, সমাজকে উপেক্ষা করে নিজেদের মনোদৈহিক কাক্সক্ষাকে
তাকে মূর্ত করে তোলে না। বিপরীতে সমাজের কানুনের ভেতরে বসবাস করেও কথন কিছুটা মনোবিকারের
কারণে সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। একই সমাজে এই দু’ধরনের মানুষের সহ-অবস্থান সমাজস্বীকৃত। ফলে লেখক একই সঙ্গে দুই বিপরীত চরিত্রের
সমাবেশ ঘটিয়েছেন। যা গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য ও সমাজনিষ্ট করে তুলেছে।
কুক্কুরাধম নিুবর্গ থেকে পরিশ্রম ও আচরণগত-কৌশলে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা মানুষের গল্প। এ গল্পে
লেখক দেখিয়েছেন,
কী করে একজন মানুষ নিজের মেরুদণ্ডের
অস্তিত্ব ভুলে যায়, কী করে কাক্সিক্ষত
লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য মানুষের কৃপাধন্য হতে হয়। একজন সুবিধাবাদী-পরিশ্রমী মানুষ অর্থ
উপার্জনের পর নিজস্ব কিছু স্বপ্ন দেখতে থাকে, ওই স্বপ্নগুলো পূরণের জন্য সে কিছু পরিকল্পনাও করে। এসব স্বপ্ন-পরিশ্রম আর কৌশলের
মিলিত রূপ কুক্কুরাধ।
পুনরুদ্ধার একজন আশাবাদী মানুষের সংকল্প ও পরিকল্পনার গল্প। এ গল্পে জ্যোতিপ্রকাশ দেখিয়েছেন, জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে মানুষ যেমন শহরমুখী হয়, তেমনি শহর ছেড়ে গ্রামমুখীও হয়। শহরে জন্মালেই কেবল শহরে বসবাসের অধিকার পায় না মানুষ। শহরে
থাকতে গেলে, ব্যক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা ও রুচিসম্মত পেশা চাই।
সবার একই রকম সৌভাগ্য হয় না। ফলে কিছু মানুষকে যেমন পেশাগত কারণে গ্রাম থেকে শহরে ছুটে
যেতে হয়, তেমনি কাউকে কাউকে শহর থেকে গ্রামমুখীও হতে হয়। পুনরুদ্ধার গল্পের কথক দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ। পেশা শিক্ষকতা।
কর্মস্থল গ্রাম। মন তার পড়ে থাকে শহরে। কিন্তু জীবিকার টানে তাকে থাকতে হয় গ্রামে।
গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার কিংবা নিজের নগরজীবনের স্বাদ ফিরে পেতে উপায় খুঁজতে থাকে কথক।
এক সময় পেয়ে যায়। অনেক পরিকল্পনার পর, গ্রামের সাধারণ মানুষের আবহমানকালের প্রিয় হাডুডুকে বেছে নেয় সে। ছাত্ররা এই খেলার
মাধ্যমে একদিন নিজেদের ক্রীড়ানৈপুণ্যের প্রমাণ রাখতে শহরে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। প্রস্তুত
হতে থাকে তারা। হাডুডুকে কেন্দ্র করে ছাত্র-শিক্ষক সবাই স্বপ্ন দেখে। উভয়পক্ষের স্বপ্ন
এক নয়, যদি উপায় এক। ছাত্রদের স্বপ্ন নিজেদের স্কুল, গ্রাম অঞ্চলের সম্মান অর্জনের, কথকের স্বপ্ন নিজের শহর জয়ের। ছাত্রদের স্বপ্ন বৃহত্তর
স্বার্থে, কথকের স্বপ্ন আÍকেন্দ্রিক। একজন স্বপ্নবাজ মানুষের পরিশ্রম, স্বপ্ন, কৌশল ও বাস্তবায়নের এক চমৎকার বিবরণ এই গল্প।
জ্যোতি প্রকাশদত্ত রচিত গল্পে তুলনায় এখানে আলোচ্য গল্প সংখ্যায়
অত্যল্প। তবু এ সামান্য কয়টি গল্পপাঠেই বোঝা যায়, তাঁর ভাষা, পটভূমি, সৃজনীকৌশল, চরিত্রসৃষ্টি, কাহিনির প্রবহমানতায় তিনি অনন্য। তার গল্পের ভাষা প্রায় অলঙ্কারমুক্ত। সহজ-সরল
বাক্যে প্রতিটি গল্পের শুরু এবং শেষ। কোনো ঘটনার ঘনঘটা নেই, নেই কোনো অহেতুক ঘোরপ্যাঁচ। গল্পগুলো একরৈখিক এবং
বিষয় স্পষ্ট। গল্পকে ধাঁধায় পর্যবসিত করার চেষ্টা তার নেই, আবার একেবারে সাংবাদিক প্রতিবেদন রচনায় লেখক অনীহ।
সংলাপে অকৃত্রিমভাব বজায় রেখেছেন, জোর করে কোনো সংলাপ চরিত্রকে দিয়ে উচ্চারণ করান না লেখক। সাবলিলভাবে পরিবেশ ও চরিত্র
অনুযায়ী সংলাপ রচনায় তার লেখক পারদর্শী।
ছোটগল্পের প্রধান গুণ এবং কঠিন শর্ত এর একরৈখিকতা। এ শর্ত মেনে
গল্পসৃষ্টি অনেকের পক্ষেই অসম্ভব হয়ে ওঠে। এর কারণ, ‘কোনো একটি সমস্যাকে কেন্দ্রবিন্দু করে একরৈখিক আলোর মধ্যে তাকে
যথাযথভাবে নির্দিষ্ট করা শর্তটি পালন করা সৃজনশীল লেখকের পক্ষে দিন দিন কঠিন হয়ে পড়েছে।
একজন মানুষকে একটিমাত্র অনুভূতি না সমস্যা দিয়ে চিহ্নিত করা এখন অসম্ভব। লেখকের কলম
থেকে বেরুতে না বেরুতে এখনকার চরিত্র বেয়াড়া হয়ে যায়, একটি সমস্যার গয়না তাকে পরিয়ে দেয়ার জন্য লেখক হাত
তুললে সে তা ছুড়ে ফেলে দিয়ে গায়ে তুলে নেয় হাজার সংকটের কাঁটা।’ (বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে? : আখতারুজ্জামান ইলিয়াস)। আর এই বেয়াড়া চরিত্রগুলোকে
বাগে এনে নিজের মতো চালিত করা শক্তিমান লেখকের স্বভাব। চরিত্রকে স্বাধীনতা দিতে হয়
ততটুকু, যতটুকু একজন স্রষ্টার পক্ষে সৃষ্টিকে দেওয়া সম্ভব।
এর ব্যত্যয়ে স্রষ্টার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়। প্রশ্নবিদ্ধ হয় তার মৌলিকত্বও। আখতারুজ্জামান
ইলিয়াস গল্পের চরিত্র বেয়াড়া হয়ে ওঠার সম্ভাবনার কথা বলেছেন, সঙ্গে এও বলেছেন, এর ফলে সৃষ্টি হয় হাজার সংকট। লেখক যখন এসব সংকট উজিয়ে মৌলিকত্ব বজায় রেখে বহুরৈখিকতার
দিকেও দৃষ্টিপাত করেন, তখন তাতেও সায় থাকে
শিল্পের। কেবল বেয়াড়া চরিত্রকে বশ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে নানারকম সংকটের কাঁটার স্তূপ
করলে তখন গল্পের পরিবর্তে নানা ধরনের সমস্যাকীর্ণ সাংবাদিক প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। জ্যোতিপ্রকাশ
দত্ত সম্ভবত একারণেই গল্পকে একরৈখিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। এছাড়া তার গল্পের
বিষয় সমাজঘনিষ্ট এবং বাস্তবানুগ। ফলে গল্পপাঠে সমাজের চিত্র পাওয়া যায়। কোনো কল্পলোকে
ভাসতে হয় না। তাঁর সার্থকতা এখানেই।
লেখক পরিচিতি
মোহাম্মদ নূরুল হক
জন্ম : জুন ১২, ১৯৭৬।
জন্ম : জুন ১২, ১৯৭৬।
কবি। গল্পকার। প্রন্ধকার।
সাংবাদিক।
সাংবাদিক।
2 মন্তব্যসমূহ
জ্যোতি প্রকাশের গল্পের মৌলিক প্রবণতাগুলোর অসাধারণ বিশ্লেষণ।
উত্তরমুছুন''লেখক যখন এসব সংকট উজিয়ে মৌলিকত্ব বজায় রেখে বহুরৈখিকতার দিকেও দৃষ্টিপাত করেন, তখন তাতেও সায় থাকে শিল্পের। কেবল বেয়াড়া চরিত্রকে বশ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে নানারকম সংকটের কাঁটার স্তূপ করলে তখন গল্পের পরিবর্তে নানা ধরনের সমস্যাকীর্ণ সাংবাদিক প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত সম্ভবত একারণেই গল্পকে একরৈখিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। এছাড়া তার গল্পের বিষয় সমাজঘনিষ্ট এবং বাস্তবানুগ। ফলে গল্পপাঠে সমাজের চিত্র পাওয়া যায়। কোনো কল্পলোকে ভাসতে হয় না। তাঁর সার্থকতা এখানেই।'' জ্যোতি প্রকাশের গল্প সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হক শেষপর্যন্ত যে সিদ্ধান্ত টেনেছেন, এটা তার ব্যক্তিগত মত হলেও গল্পের লেখক-পাঠক ও সমালোচকদের কাছে তার একটা আলাদা গুরুত্ব থাকবে বলে মনে করি। তবে আলোচনাটি জ্যোতি প্রকাশের সমস্ত গল্পের নিরিখে হলে আরও ভালো লাগত। আলোচককে অনুরোধ করব, জ্যোতি প্রকাশের সমগ্র গল্প নিয়ে যেন একটি আলোচনা তিনি লেখেন।
উত্তরমুছুনসুমন কুমার সাহা
রাজশাহী।