হাসানআল আব্দুল্লাহ
১.
সাহিত্য নিয়ে আলাপ কালে আমি প্রায়ই যে কথাটি বলার চেষ্টা করি তা হলো, কোনো লেখার ভেতরে কবিতা না থাকলে সেই লেখা শিল্পোত্তীর্ণ হতে পারে না। বোঝাতে চাই আর্টের মধ্যে কবিতা থাকাটা জরুরী।কবিতা থাকা মানে চিত্রকল্প, উপমা, অনুপ্রাসের ব্যবহারই শুধু নয়, বুননের পরিমিতি বোধ আঙ্গিকের সুনির্দিষ্ট সৌষ্ঠব এবং ভাষা নিয়ে নতুন ভাবে খেলা করতে করতে নিজস্ব একটি সৃষ্টিশীল অধ্যায় গড়ে তোলা, যার ভেতর দিয়ে শিল্পের সাফল্য জ্বলজ্বল করে ওঠে। আমার বলবার বিষয় আরেকটু স্পষ্ট করতে নিম্নোক্ত বাক্যখানা পড়ে দেখতে চাই।
“অথচ তারপরে, তুমি সেই সৃষ্টিকে ভাঙ্গলে, ছাড়ালে, কণায় কণায় আমার অঙ্গে ছড়িয়ে দিলে [,] আর সেই অজস্র কণা তোমার দু’চোখে আকুল হয়ে থিরথির করে কাঁপতে লাগলো।”
এর ভেতরে কবিতা আছে--তার মানে, আছে চিত্রকল্প, আছে নিজস্ব ভাষা ভঙ্গি, বুননের অমিয় সৌন্দর্য এবং আবেগকে ঘনীভূত করে শিল্প নির্মাণের সফল আয়োজন। একথাও সত্য যে এই বাক্যখানা অনায়াসে যে কোনো আধুনিক কবিতার শরীর হয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু না, কবিতার শরীরে নয়, থিতু হয়েছে গল্পের আরক্ত অঙ্গ সঞ্চালনে। আর এই গল্পের লেখক অন্য কেউ নন; তিনি জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, একদা যিনি গল্প ও কবিতার ভেদরেখা তুলে দিতে চেয়েছিলেন। সেটা হয়তো প্রতীকি, কিন্তু শিল্পের উচ্চতায় পৌঁছুতে—তার অলিগলি ধরে হাঁটতে, ঘোরানো প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে মনে হয় এর কোনো মাধ্যমের সাথে কোনো মাধ্যমের ফারাক বস্তুত নেই। আজকের দিনে, এই উত্তরাধুনিক কালখণ্ডে দাঁড়িয়ে এ কথা আরো বেশী স্পষ্ট।
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত বাংলা ভাষার একজন শক্তিশালী গল্পকার। আবির্ভাবের সময় বিবেচনয় তিনি ষাট দশকের লেখক কুলের অন্তর্গত। শিল্প সাহিত্যের নানা অঙ্গনে এই দশকটি বেশ গুরুত্ব বহন করে। নতুন করে দেখা এবং লেখার প্রবণতা সমন্বিত হয়ে ওঠে অনেকের মাঝেই। তবে, শেষ পর্যন্ত মনে হয় কবিতার অঙ্গন থেকে কথা সাহিত্য কিম্বা প্রসারিত বলয়ে গদ্যের অর্জন অনেক বেশী। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, হুমায়ুন আজাদ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, শওকত আলী, মাহমুদুল হক; বাংলা গদ্যে এই উজ্জ্বল নামগুলো অনবরত দ্যুতি ছড়ায়, যদিও হুমায়ুন আজাদকে আলাদা করে দেখা দরকার—তিনি গল্প না লিখলেও প্রবন্ধ ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে অভাবনীয় অবদান রেখেছেন, অন্যদিকে কবিতায় পঞ্চাশের ধারাবাহিকতা বিবেচনায় তিনি প্রধান কবির মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। তবে, উল্লিখিত প্রতিটি নামই স্ব-স্ব লেখনিতে উজ্জ্বল। এই উজ্জ্বলতার বড়ো অংশীদার জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। এবং শুরু থেকেই তিনি বিশিষ্ট। গল্প বলার জন্যে তিনি লেখেননি, শিল্প নির্মাণই তাঁর কাছে সর্বদা মুখ্য হয়ে ধরা দিয়েছে। একই সাথে জটিল মনস্তাত্ত্বিক বৃত্ত-বলয় তৈরির পাশাপাশি তিনি সহজতর বোধের বিন্যাসেও ধাবিত হয়েছেন।
“তখন গ্রামের বাইরের সড়কে থালা হাতে খবিরুদ্দি, জলধর তাদের সৃষ্টি সমূহ কোলে পিঠে-কাঁধে নিয়ে, এবং আমেনা, মেনকা ঐ জাতীয় আরেকটিকে বুকে ধরে শুকনো মাই টানতে টানতে দেশের সকলের সঙ্গে গঞ্জের দিকে যেতো।”
‘মন্বন্তর’গল্পে এই উপস্থাপন শৈল্পিক সৌন্দর্যে যেমন সম্ভাব্য সুষমা নিয়ে আবির্ভূত হয় তেমনি একটি জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রামের দলিল হয়ে ওঠে। এবং সেই সংগ্রামে খবিরুদ্দি, জলধর, আমেনা, মেনকা ও তাদের ‘সৃষ্টিসমূহ’ —হিন্দু মুসলমান, নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো—মিলেমিশে এগিয়ে যায়। অন্যদিকে বর্ণিত ‘শুকনা মাই’আধুনিকতায় বোদলেয়ারীয় সৃষ্টি সম্ভারের সমন্বয় ঘটায়। এই গল্পে গ্রাম ছেড়ে যাওয়া একটি বালকের কথা ফিরে ফিরে আসে, যার সমান্তরাল উপস্থাপনায় পাওয়া যায় জীবন-জীবিকার জন্যে অভিবাসী এক প্রাপ্ত বয়স্ককে; এবং আমরা, মানুষেরা—আস্তে আস্তে পরিচিত চারপাশ, খোয়া-ওঠা রাস্তা ইত্যাদি ছেড়ে চলে যেতে থাকি—এমনকি সভ্যতার এক নির্মাণ থেকে অন্য নির্মাণে; কালান্তের এক পরিধি থেকে অন্য পরিধিতে ছিটকে পড়তে থাকি; এই গল্প যেনো সেই সত্যই প্রকারান্তরে বুনে চলে।
“...কোনো কথা না বলেই কিছুক্ষণ বসে থাকে তারা। স্টেশনের ওপারে দেয়াল, তারপরে বিবর্ণ দালানের ওপর দিক দেখা যায়।”
এই দালান ও পরবর্তী অলিখিত অংশের ‘ওপর দিক’ স্তরে স্তরে আমাদের সভ্যতার পুনর্বিন্যাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি অতোটা বর্ণনা প্রবণ নন, কবিতার মতো অল্প কথায় তাঁর গল্পের অনেক জমিন বোনা হয়ে যায়, এবং তারপরেও দেখা যায় যে সেই জমিন থেকে সামান্য টিকটিকিও বাদ পড়েনি, অভাব হয়নি দার্শনিক দিক নির্দেশনার, বা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাহিনীর ভেতরে প্রবেশ করার; অতএব “আমার আব্বা বলতেন, তোরা সবাই কুকুর-বিড়াল, বোধ হয় সত্যি”—এতোবড়ো সত্যকে বিনা প্রতিবাদে পাঠকের মেনে নিতে হয়; এর আটপৌরে উপস্থাপনায় মনেই হয় না ডারুইনয়ের সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে সমাজের অনেকটা কলুষই এখানে ধরা দিয়েছে। বিধৃত আবিস্কৃতি হয়েছে “কঠিন, জমাট, নিরেট পাথরের মতো”অন্ধকার। সহজ বুননে আপাত সরল একটি গল্প ‘আজীবন দিনরাত্রি’ টানটান উত্তেজনার ভেতর দিয়ে জীবনের কতো কঠিন সত্যকেই না ছুঁয়ে যায়, এবং প্রয়োজন অনুসারে পাঠক গল্প কিম্বা দর্শন যেটা তাকে হাতছানি দেয় অনায়াসে তুলে নিতে পারেন। ওদিকে ধীমান গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ‘অনুভূতিগুলোকে ওজন’ করতে করতে, মানুষেরা ‘পরিবর্তিত অবস্থার দাস’ মেনে নিয়ে, জীবনবৃক্ষের বাড়তি ডালপালা ছেঁটে দৈনন্দিনতার ঘাটে ঘাটে ‘পায়ের দাগ রেখে’ যান। তাই তাঁর লেখা গল্পগুলো নানা ভাবে মূল্যবান হয়ে ওঠে। নির্মাণ কৌশলে,বলার ঢং-এ, প্রকাশের মাধুর্যে, বর্ণনার নিপুণতায়, গদ্যে কবিতায় একাকার হয়ে তিনি নতুনত্বের ঘণ্টা বাজান।
২.
চোখ মেলে দেখলো কান ফেলে শুনলো বাক্যটিকে এভাবে কবিতার মতো সাজিয়ে দিলে স্পষ্টতই বোঝা যায় “মেলে”ও “ফেলে”শব্দ দু’টির ব্যবহার সৃষ্টিশীল চিন্তার বহিপ্রকাশ: কাব্য নির্মাণের সমন্বয়ক। তাঁর গল্পে এমন কাব্য ঘেঁষা বাক্য অহরহ চোখে পড়ে। কিন্তু কবিতার আবহ তৈরীই কি গল্পের প্রধান কাজ? তা হয়তো নয়, তবে আঙ্গিক ও বুননের সমন্বিত ব্যবহারে একটি প্রতীয়মান পারিপার্শ্বিকতা নির্মাণ করা যার ভেতর দিয়ে ফুটে ওঠে প্রবহমান অনেকগুলো চিত্র; কিছু অসহায় মানুষের সামগ্রিক সংগ্রামের ঢেউ--যা প্রকারান্তরে স্মরণ করিয়ে দেয় সমাজ বাস্তবতাকে। অবশ্য গল্পের ভেতর কতোটুকু কাহিনীর সন্নিবেশ ঘটবে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ” রাবীন্দ্রিক সেই মূল্যায়ন থেকে বর্তমান বিশ্বের গল্প হেঁটে গেছে অনেকটা দূর। চীনা ঔপন্যাসিক গাও সিঙজান নোবেল পুরস্কার পান তাঁর রচনায় গল্প-প্রবন্ধ-আত্মজীবনী ইত্যাদির সমন্বয় ঘটানোর জন্যে। অন্যদিকে আফ্রিকার লেখক চিনুয়া আচেবে, ন’গুগি ওয়াথুঙ্গে প্রমুখ উপনিবেশিক শাসকদের শ্রেণী বিন্যাসের বিপরীতে যে ছবি আঁকেন; কিম্বা একেবারে হালের ঝুম্পা লাহিড়ী, যিনি বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষকে একই পাটাতনে উপস্থাপনের মাধ্যমে বস্তুত প্রমাণ করতে চান যে পৃথিবীর সব কেন্দ্রের জনগোষ্ঠীর অবস্থা মূলত এক; কিম্বা বিশ্ব সাহিত্যে বিপুল আলোড়ন তোলা গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ যিনি জাদু বাস্তবতার ঘেরাটোপে জীবনের সমান্তরাল জাল তৈরী করে আলো কেটে কেটে সামনের দিকে যখন এগিয়ে যান, তখন এইসব গল্পকারের সামর্থ্য ও সার্থকতার বিবেচনায় বাংলা গল্প—বাংলাদেশের গল্পকেও দাঁড় করিয়ে দেয়া যায়। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, শওকত ওসমান, শওকত আলী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আল মাহমুদ, মাহমুদুল হক, পূরবী বসু, মনিরা কায়েস, ইমতিয়ার শামীম প্রমুখ গল্পকার মধ্যবিত্তের জীবনালেখ্য মূল্যায়নে নিজস্ব একটি গোত্র তৈরী করে ফেলেন, যদিও চুলচেরা বিশ্লেষণে এঁরা পরস্পর থেকে আলাদা। অন্যদিকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, শহীদুল জহির, মামুন হুসাইন, আনোয়ার শাহাদাত, নাজনীন সীমন প্রমুখ ভাষা নির্মাণের কৌশলগত শক্ত অবস্থানে ভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টির ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন। ফলতঃ, বাংলাদেশের গল্পের এই দুই বিভাগকে—ওয়ালিউল্লাহ ধারা ও ইলিয়াস ধারা—বিবেচনায় আনলে প্রথম ভাগের উপস্থাপন যতোটা সহজতর মনে হয়, দ্বিতীয় ভাগে কিন্তু তা নয়। শেষোক্ত কাতারের লেখকেরা ভাষা, শব্দ ও এ দুইয়ের সমন্বয়ের নতুন নতুন সম্ভাব্যতা নিয়ে খেলা করেন। গল্প বলা থেকে আঙ্গিক ও গল্প-বাস্তবতা তৈরীতে তাঁরা যতোটা আত্মনিয়োগ করেন, প্রথম ভাগের গল্পকারেরা ততোটাই নিমজ্জিত হন অতিক্রান্ত সময়কে তুলে ধরতে। সেই তুলে ধরার ভেতরেও ভিন্ন মাত্রার শিল্প বোধের রূপায়ন দেখা যায়। তবে একথা তো সত্যি যে কবিতা আর গল্পের মধ্যকার ভেদরেখা উপড়ে ফেলা কিছুতেই সম্ভব নয়, যদিও গল্প কবিতার কাছাকাছি আর কবিতা গল্পের আঙ্গিনায় ঢুকে যেতে পারে। এই অনুপ্রবেশের কাজ জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত করেন নিজস্ব উপায়ে।
“কেবল সতেজ রৌদ্রকরে এবং পবনের দাক্ষিণ্যে আমরা সুসলিলা পৃথিবীতে আশৈশব স্পন্দিত হয়েছিলাম।” অথবা “আরো কয়েকটি ক্রীড়ারত পুতুল এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়লো এবং তখন সেই মোহন অন্ধকারে দুষ্কৃতিগুলি ধরা পড়তে লাগলো—যারা প্রতিকারহীন।” কিম্বা “রজব আলী বললো হুজুর, আপনার ঘরে বড়ো অন্ধকার।”এইসব বুননেন ভেতর দিয়ে তিনি নিজস্বতা রেখে যান।“অন্ধকার” তাঁর প্রিয় বিষয় হয়ে ওঠে, এই অর্থে নয় যে তিনি অন্ধকারকে ভালবাসেন, বরং সমাজের অলিগলিতে যার ব্যাপ্তি তার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে তিনি সদা সঞ্চারমান। ফলতঃ তাঁর অনেকগুলো গল্পের শুরু এবং বেড়ে ওঠায় থাকে এই অন্ধকার। তাছাড়া ছেড়ে যাওয়ার বেদনাও তাঁর গল্পে ফিরে ফিরে আসে।
“গোলাপকে যতবার চোখে দেখা যায় তত বেদনা বাড়ে।” এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে, এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে, এক ভূখণ্ড থেকে অন্য ভূখণ্ডে বাস্তবিক সংক্রমণ তাঁকে বিবেক-আক্রান্ত চিন্তিত বিমর্ষ করে তোলে। আবার এও সত্য, সন্তের মতো গল্প বুনে যাবার প্রক্রিয়ায় কোথাও কোনো আক্রোশ ফুটে উঠতে দেখা যায় না। আন্দোলনরত মানুষের মিছিল থিতু হয়ে এলে শুরু হয় তাঁর গল্প বলার পর্ব। বেরিয়ে আসে ওইসব ঘটনার পেছনের বাস্তবতা। পরিপৃক্ত অন্ধকার, নির্বাসিত গোলাপ, প্রতিশ্রুতির অপূর্ণতা, বিকলাঙ্গ বাসনা, মানবিক সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি নিয়ে ডালপালা ছড়াতে থাকে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের গল্প। অল্প বলেও বেশী বলার ভেতর দিয়ে তিনি এগিয়ে যান। তাঁর এই এগিয়ে যাওয়া আমাদের কথা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে, আমরা নতুন উচ্চতার সন্ধান পাই।
সম্পাদক: শব্দগুচ্ছ
প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা: ২৪
প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা: ২৪
0 মন্তব্যসমূহ