স্বকৃত নোমান
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
শুরু করেছিলেন উপন্যাস লিখে। ইতিহাস তাঁর প্রিয় বিষয়। ইতিহাসকে দেখেন এ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। এ ক্ষেত্রে তার ভাবনার মধ্যে গোলমাল নেই। গুপ্ত হিংসা নয়--মুক্ত ভাবনার চোখ নিয়ে তার ইতিহাস যাত্রা। মানুষই তার আখ্যান। উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি এখন নিয়মিত লিখছেন গল্প। পেশায় সাংবাদিক। থাকেন ঢাকায়। স্বকৃত নোমান গল্পপাঠের কাছে দু'পর্বে লিখিত আকারে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।--গল্পপাঠ।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
১. গল্প লিখতে শুরু করলেন কেন?
―আমার ঝোঁক সাধারণত উপন্যাসের প্রতি। আমার প্রথম গ্রন্থও উপন্যাস। উপন্যাসের পরিসর অনেক বড়। এই শিল্পমাধ্যমে ইচ্ছেমতো অনেক কথা বলা যায়, অনেক জটিল বিষয়-আশয় নিয়ে লেখা যায়। কিন্তু এমন কিছু কথা লিখতে চাই, যা বিস্তৃত পরিসরে সম্ভব নয়, ছোট পরিসরে লিখতে হয়, ঠিক উপন্যাসের আঙ্গিকে ধরা যায় না। ধরতে গেলে লেখক হিসেবে আমি তো বটেই, পাঠকরাও পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। মূলত এই কারণেই গল্প লিখতে শুরু করি।
ঐতিহাসিক বা ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস লেখার জন্য প্রস্তুতিটা আমি এভাবেই নিয়েছি বা নেই। তারপর লেখা শুরু করি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেবিলে পড়ে থাকি। কোনো ইনফরমেশান ভুল হলো কিনা সতর্ক থাকি। এ ধরনের উপন্যাসের তথ্য তো নির্ভুল হওয়া চাই। মীরজাফরকে বা খন্দকার মোশতাককে তো দেশপ্রেমিক বানিয়ে দিলে হবে না! উপন্যাসের পটভূমি সুন্দরবন অঞ্চল, কিন্তু শব্দ ব্যবহার করব নোয়াখালী অঞ্চলের তা তো হবে না। শিল্পের সত্য আর ইতিহাসের সত্য এক নয় এটা ঠিক। কিন্তু কেউ যখন ইতিহাসকে বিষয় করে শিল্প রচনা করবেন, তখন তো আর ইতিহাসকে উল্টে দিতে পারবেন না।
৯. কার জন্য গল্প লেখেন? আপনি কি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখেন? লিখলে কেনো লেখেন? আর যদি পাঠকের কথা মনে না রেখে লেখেন তাহলে কেনো পাঠককে মনে রাখেন না লেখার সময়ে?
―একটি গল্প যখন আমার মাথায় ভ্রুণ আকারে থাকে, তখনো মনে হয় ওই ভ্রুণটি আমার। ভ্রুণটি যখন ধীরে ধীরে বড় হয় তখনও মনে হয় সেটি আমারই। গল্পটি যখন মাথা থেকে শব্দ-অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বন্দী হয়, তখনো আমি মনে করি গল্পটি নিজের জন্যই লিখছি। কিন্তু লেখা শেষে মনে হয়, না, এটি শুধু আমার তৃপ্তির জন্য নয়, এই গল্পটি আমি অন্যদেরও জানাতে চাই। মানে পাঠকদের। তখন আমার কাছে পাঠকই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বস্তুত পাঠক ছাড়া তো আমর লেখার কোনো সার্থকতা নেই।
১০. এখন কি লিখছেন?
―একটি উপন্যাস। সুন্দরবনের ধারঘেঁষা শিঙার নদী তীরবর্তী একটা গ্রামের ধর্মীয় সঙ্কট নিয়ে একটা উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছি। এক পর্ব লিখেছি মাত্র। ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ভূক্ত এক স্কুল মাস্টার হঠাৎ মুসলমান হয়ে যায়। তাকে এবং তার পরিবারকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত। সাম্প্রদায়িক সঙ্কট, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন ইত্যাদি বিষয় উপন্যাসটিতে প্রাধান্য পাবে।
১১. আগামীতে কি লিখবেন?
―বেশ কটি গল্প দীর্ঘদিন মাথায় ফেরি করে বেড়াচ্ছি। যেমন ধরুন, সাভারের ভবন ধস নিয়ে একটা গল্প লেখার কথা ভাবছি ওই ঘটনার পর থেকে। প্রতিদিনই ভাবি আজই গল্পটা লিখে ফেলব, অথচ হয়ে উঠছে না। এরকম আরো কয়েকটি গল্প লেখার ইচ্ছে আছে। পাশাপাশি উপন্যাস তো আছেই। গল্প-উপন্যাসের বাইরে অন্য কিছু লেখার কথা ভাবি না।
লেখক পরিচিতি
স্বকৃত নোমান
প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ ঔপন্যাসিক। ১৯৮০’র ৮ নভেম্বর ফনীর পরশুরাম উপজেলার বিলোনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। দৈনিক আজকের কাগজের মাধ্যমে সাংবাদিকতার শুরু। ‘কয়েকটি জোব্বার মহাপ্রয়াণ’ শীর্ষক একটি নিবন্ধের মাধ্যমে প্রয়াত নাট্যকার ড. সেলিম আল দীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তীকালে তাঁর একান্ত সচিব হিসেবে যোগ দেন। তাঁর কাছেই বিশ্বসাহিত্যের পাঠ নেন নোমান। সেলিম আল দীনের মৃত্যুর পর আবার সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। বর্তমানে তিনি নিউজপোর্টাল ঢাকারিপোর্টটোয়েন্টিফোর.কম ও সাপ্তাহিক ধাবমান-এর এক্সিকিউটিভ এডিটর। ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস নাভি। এরপর প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ‘ধুপকুশী’ (পরিবর্তিত নাম ‘বংশীয়াল’), ‘জলেস্বর’, ‘রাজনটী’ ও ‘হীরকডানা’। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত গল্প লিখছেন। ইতিহাস, ইতিহাসের মানুষ, বিশাল বাংলার মিথ, লোকজীবন, লোকসংস্কৃতি, বঞ্চিত মানুষদের সুখ-দুঃখের পাঁচালি তাঁর গল্প-উপন্যাসে ভিন্ন রকমের মাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়। তাঁর উপন্যাসের ভাষা ও আঙ্গিক একেবারেই আলাদা, নিজস্ব। কথাসাহিত্যে তিনি এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।”
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
শুরু করেছিলেন উপন্যাস লিখে। ইতিহাস তাঁর প্রিয় বিষয়। ইতিহাসকে দেখেন এ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। এ ক্ষেত্রে তার ভাবনার মধ্যে গোলমাল নেই। গুপ্ত হিংসা নয়--মুক্ত ভাবনার চোখ নিয়ে তার ইতিহাস যাত্রা। মানুষই তার আখ্যান। উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি এখন নিয়মিত লিখছেন গল্প। পেশায় সাংবাদিক। থাকেন ঢাকায়। স্বকৃত নোমান গল্পপাঠের কাছে দু'পর্বে লিখিত আকারে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।--গল্পপাঠ।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
―আমার ঝোঁক সাধারণত উপন্যাসের প্রতি। আমার প্রথম গ্রন্থও উপন্যাস। উপন্যাসের পরিসর অনেক বড়। এই শিল্পমাধ্যমে ইচ্ছেমতো অনেক কথা বলা যায়, অনেক জটিল বিষয়-আশয় নিয়ে লেখা যায়। কিন্তু এমন কিছু কথা লিখতে চাই, যা বিস্তৃত পরিসরে সম্ভব নয়, ছোট পরিসরে লিখতে হয়, ঠিক উপন্যাসের আঙ্গিকে ধরা যায় না। ধরতে গেলে লেখক হিসেবে আমি তো বটেই, পাঠকরাও পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। মূলত এই কারণেই গল্প লিখতে শুরু করি।
২. শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?
―মোটেই ভালো ছিল না। আমি প্রথম গল্প লিখি সম্ভবত ২০০১ সালে, ‘জনান্তিকে পথচারী’ নামে। তখন মনে হয়েছিল, এটিই পৃথিবীর সেরা গল্প, আর আমিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গল্পকার! গল্পটি পত্রিকায় ছাপতে পাঠাই, কিন্তু কেউ ছাপল না। খুব মন খারাপ হলো। তারপর লিখলাম ‘কলা রহস্য’ নামে আরেকটি গল্প। অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজে তখন ‘রবিবারের সাহিত্য’ নামে একটা পাতা বের হতো। তরুণদের লেখা ছাপা হতো ওই পাতায়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর এক রবিবারে আমার গল্পটি ছাপ হলো। এতে সাহসটা বাড়ল, নতুন গল্প লেখার প্রতি আগ্রহও বাড়ল। নতুন গল্প লেখার চেষ্টা করি। লিখেছিও বেশ কটি। অখ্যাত পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে।
কিন্তু একটা সময়ে এসে খেয়াল করি, যে গল্পগুলো আমি লিখেছি সেগুলো ঠিক গল্প হয়ে ওঠেনি, হয়েছে একেকটা ভৌতিক কাহিনী! ভাবলাম, নাহ্, আমাকে দিয়ে গল্প লেখা হবে না। গল্প লেখার কলাকৌশল, অনেক বড় বিষয়কে ছোট পরিসরে উপস্থাপন করার জন্য যে যোগ্যতার প্রয়োজন সেটি আমি অর্জন করতে পারিনি। ফলে গল্প লেখা ক্ষ্যান্ত দেই। তা ছাড়া উপন্যাস লেখায় বেশি সময় ব্যয় করাটাও বেশ ক’বছর গল্প না লেখার একটা কারণ।
৩. গল্প লেখার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছেন? নিলে সেগুলো কেমন?
―প্রস্তুতি তো নিশ্চয় নিতে হয়েছে। নতুন উদ্যমে গল্প লিখতে শুরু করি বছর দুয়েক আগে। এর আগে প্রস্তুতি হিসেবে পৃথিবীর সেরা গল্পকারদের বেশ কিছু গল্প পাঠ করি। তাঁদের গল্পের আঙ্গিক, ভাষা, খুঁটিনাটি নানা কলাকৌশল ধরবার চেষ্টা করি। পড়তে পড়তে একটা সময় মনে হলো, আমার প্রস্তুতিপর্ব মোটামুটি সম্পন্ন হয়েছে, এবার আমি গল্প লিখতে পারব।
৪. আপনার গল্পলেখার কৌশল বা ক্রাফট কি?
―আমি প্রথমে গল্পের বিষয় নিয়ে ভাবি। একেবারে নতুন বিষয়, যে বিষয় নিয়ে ইতোপূর্বে কেউ গল্প লেখেননি―এমন বিষয় খুঁজি। বিষয় সিলেকশান করতে পারলে আঙ্গিক নিয়ে ভাবি। তারপর গল্পের শুরু এবং শেষটা কেমন হবে এ নিয়ে ভাবি। প্রারম্ভ এবং পরিণতির বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারলেই লিখতে শুরু করি। আবার কখনো কখনো এমনও হয়েছে যে, পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই হঠাৎ একটা গল্প লিখে ফেললাম। যেমন ‘হুজুরিয়ানা’ গল্পটির কথাই ধরা যাক। রাত তখন এগারোটা। টেলিভিশনে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ গানটি বাজছে। হঠাৎ মাথায় খেলে গেল গল্পটি। সঙ্গে সঙ্গে কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়ি। পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে গল্পটি লেখা শেষ করে ওঠি।
কাগজে-কলমে একটি গল্প লিখতে বড় জোর ঘণ্টা দেড়ক সময় লাগে। তারপর এটিকে কম্পিউটারে কম্পোজ করি। কম্পোজ করতে করতে কিছুটা এডিট হয়ে যায়। কম্পোজ শেষে একটা প্রিন্ট নিয়ে আবার এডিট করতে বসি। প্রতিটি গল্প লিখার পর পাঁচ-ছ’বার এডিট করে তারপর কোথাও ছাপতে দেই। কিংবা দেই না। পড়ে থাকে মাসের পর মাস। তারপর হঠাৎ একদিন গল্পটি আবার পড়ি। পড়তে পড়তে আরো কিছু সম্পাদনা করি।
৫. আপনার নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজের বিবেচনা কি কি?
―নিজের গল্পের বিবেচনা নিজে করাটা খানিকটা কঠিন। তবে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে, পৃথিবীখ্যাত গল্পকারদের কাছে আমি একেবারেই তুচ্ছাতিতুচ্ছ। আমার মনে হয়, আমার গল্পের বিষয়গুলো খানিকটা ব্যতিক্রম। কিন্তু আঙ্গিকটা এখনো নিজস্বতায় নিয়ে যেতে পারিনি। ভাষাও না। আঙ্গিক ও ভাষা নিয়ে আরো এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে। আমি সবে গল্প লিখতে শুরু করেছি। পরীক্ষা-নীরিক্ষার মধ্য দিয়ে অনেক দূর যাওয়ার ইচ্ছে আছে।
৬. আপনার আদর্শ গল্পকার কে কে? কেনো তাঁদেরকে আদর্শ মনে করেন?
―প্রথমত সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। তিনি আমার নমস্য গল্পকার। তার গল্পে আমি অখণ্ড বাংলাকে পাই, বাংলাভাষাভাষী মানুষকে পাই। শব্দের মধ্য দিয়ে তিনি গ্রামবাংলার চিত্র এঁকেছেন। প্রান্তিক জনজীবন নিয়ে এত শক্তিশালী গল্পকার বাংলা ভাষায় খুব বেশি নেই। তারপর সন্দ্বীপন চট্টোপাধ্যায়। দুজনকে আমি এভাবে দেখি যে, গল্পকার হিসেবে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ অজগাঁয়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মাতবর, আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় নগরের ক্ষমতাবান মেয়র। সিরাজের গল্পের ভূমি গ্রাম, সন্দীপনের নগর। সিরাজের গল্পে হাজামজা খাল-বিল, গহীন বন-জঙ্গল, অথৈ নদ-নদী আর বিস্তীর্ণ তৃণভূমি ইত্যাদি চরিত্র হয়ে আসে; আর সন্দীপনের গল্পে আসে অলিগলি, পার্ক, রেস্তোরাঁ, রেলিং, ড্রয়িং ইত্যাদি।
―মোটেই ভালো ছিল না। আমি প্রথম গল্প লিখি সম্ভবত ২০০১ সালে, ‘জনান্তিকে পথচারী’ নামে। তখন মনে হয়েছিল, এটিই পৃথিবীর সেরা গল্প, আর আমিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গল্পকার! গল্পটি পত্রিকায় ছাপতে পাঠাই, কিন্তু কেউ ছাপল না। খুব মন খারাপ হলো। তারপর লিখলাম ‘কলা রহস্য’ নামে আরেকটি গল্প। অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজে তখন ‘রবিবারের সাহিত্য’ নামে একটা পাতা বের হতো। তরুণদের লেখা ছাপা হতো ওই পাতায়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর এক রবিবারে আমার গল্পটি ছাপ হলো। এতে সাহসটা বাড়ল, নতুন গল্প লেখার প্রতি আগ্রহও বাড়ল। নতুন গল্প লেখার চেষ্টা করি। লিখেছিও বেশ কটি। অখ্যাত পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে।
কিন্তু একটা সময়ে এসে খেয়াল করি, যে গল্পগুলো আমি লিখেছি সেগুলো ঠিক গল্প হয়ে ওঠেনি, হয়েছে একেকটা ভৌতিক কাহিনী! ভাবলাম, নাহ্, আমাকে দিয়ে গল্প লেখা হবে না। গল্প লেখার কলাকৌশল, অনেক বড় বিষয়কে ছোট পরিসরে উপস্থাপন করার জন্য যে যোগ্যতার প্রয়োজন সেটি আমি অর্জন করতে পারিনি। ফলে গল্প লেখা ক্ষ্যান্ত দেই। তা ছাড়া উপন্যাস লেখায় বেশি সময় ব্যয় করাটাও বেশ ক’বছর গল্প না লেখার একটা কারণ।
৩. গল্প লেখার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছেন? নিলে সেগুলো কেমন?
―প্রস্তুতি তো নিশ্চয় নিতে হয়েছে। নতুন উদ্যমে গল্প লিখতে শুরু করি বছর দুয়েক আগে। এর আগে প্রস্তুতি হিসেবে পৃথিবীর সেরা গল্পকারদের বেশ কিছু গল্প পাঠ করি। তাঁদের গল্পের আঙ্গিক, ভাষা, খুঁটিনাটি নানা কলাকৌশল ধরবার চেষ্টা করি। পড়তে পড়তে একটা সময় মনে হলো, আমার প্রস্তুতিপর্ব মোটামুটি সম্পন্ন হয়েছে, এবার আমি গল্প লিখতে পারব।
৪. আপনার গল্পলেখার কৌশল বা ক্রাফট কি?
―আমি প্রথমে গল্পের বিষয় নিয়ে ভাবি। একেবারে নতুন বিষয়, যে বিষয় নিয়ে ইতোপূর্বে কেউ গল্প লেখেননি―এমন বিষয় খুঁজি। বিষয় সিলেকশান করতে পারলে আঙ্গিক নিয়ে ভাবি। তারপর গল্পের শুরু এবং শেষটা কেমন হবে এ নিয়ে ভাবি। প্রারম্ভ এবং পরিণতির বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারলেই লিখতে শুরু করি। আবার কখনো কখনো এমনও হয়েছে যে, পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই হঠাৎ একটা গল্প লিখে ফেললাম। যেমন ‘হুজুরিয়ানা’ গল্পটির কথাই ধরা যাক। রাত তখন এগারোটা। টেলিভিশনে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ গানটি বাজছে। হঠাৎ মাথায় খেলে গেল গল্পটি। সঙ্গে সঙ্গে কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়ি। পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে গল্পটি লেখা শেষ করে ওঠি।
কাগজে-কলমে একটি গল্প লিখতে বড় জোর ঘণ্টা দেড়ক সময় লাগে। তারপর এটিকে কম্পিউটারে কম্পোজ করি। কম্পোজ করতে করতে কিছুটা এডিট হয়ে যায়। কম্পোজ শেষে একটা প্রিন্ট নিয়ে আবার এডিট করতে বসি। প্রতিটি গল্প লিখার পর পাঁচ-ছ’বার এডিট করে তারপর কোথাও ছাপতে দেই। কিংবা দেই না। পড়ে থাকে মাসের পর মাস। তারপর হঠাৎ একদিন গল্পটি আবার পড়ি। পড়তে পড়তে আরো কিছু সম্পাদনা করি।
৫. আপনার নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজের বিবেচনা কি কি?
―নিজের গল্পের বিবেচনা নিজে করাটা খানিকটা কঠিন। তবে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে, পৃথিবীখ্যাত গল্পকারদের কাছে আমি একেবারেই তুচ্ছাতিতুচ্ছ। আমার মনে হয়, আমার গল্পের বিষয়গুলো খানিকটা ব্যতিক্রম। কিন্তু আঙ্গিকটা এখনো নিজস্বতায় নিয়ে যেতে পারিনি। ভাষাও না। আঙ্গিক ও ভাষা নিয়ে আরো এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে। আমি সবে গল্প লিখতে শুরু করেছি। পরীক্ষা-নীরিক্ষার মধ্য দিয়ে অনেক দূর যাওয়ার ইচ্ছে আছে।
৬. আপনার আদর্শ গল্পকার কে কে? কেনো তাঁদেরকে আদর্শ মনে করেন?
―প্রথমত সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। তিনি আমার নমস্য গল্পকার। তার গল্পে আমি অখণ্ড বাংলাকে পাই, বাংলাভাষাভাষী মানুষকে পাই। শব্দের মধ্য দিয়ে তিনি গ্রামবাংলার চিত্র এঁকেছেন। প্রান্তিক জনজীবন নিয়ে এত শক্তিশালী গল্পকার বাংলা ভাষায় খুব বেশি নেই। তারপর সন্দ্বীপন চট্টোপাধ্যায়। দুজনকে আমি এভাবে দেখি যে, গল্পকার হিসেবে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ অজগাঁয়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মাতবর, আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় নগরের ক্ষমতাবান মেয়র। সিরাজের গল্পের ভূমি গ্রাম, সন্দীপনের নগর। সিরাজের গল্পে হাজামজা খাল-বিল, গহীন বন-জঙ্গল, অথৈ নদ-নদী আর বিস্তীর্ণ তৃণভূমি ইত্যাদি চরিত্র হয়ে আসে; আর সন্দীপনের গল্পে আসে অলিগলি, পার্ক, রেস্তোরাঁ, রেলিং, ড্রয়িং ইত্যাদি।
শিল্পের সকল শর্ত মেনেই, আঙ্গিক ও ভাষার স্বকীয়তার মধ্য দিয়েও সিরাজের গল্প সাবলিল, সন্দীপনের জটিল। সিরাজের গল্প দিনের আলোয় পড়া যায়, সন্দীপনের গল্প পড়ার জন্য প্রয়োজন রাত্রির গভীর নৈঃশব্দ। তবু সিরাজের গল্প পড়াশেষে বোধের দরজায় ধাক্কাটা আসে সমুদ্রের ভয়াল মৌজের মতো, আর সন্দীপনের বর্ষার খরস্রোতা নদীর মতো। সিরাজ তাঁর গল্পের ভীত সমকালে রেখে ভবিষ্যতের দিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন, কিন্তু সন্দীপন সমকালকে অনেকটা অস্বীকার করে ভীত গড়তে চেয়েছেন ভবিষ্যতে। ফলে দ্বিতীয়োক্তজনের গল্প পাঠকের কাছে জটিল ঠেকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সমকালে তো ওড়াচ্ছেনই, ভবিষ্যতেও দুজন বাংলা সাহিত্যে ঝাণ্ডা ওড়াবেন। দুজনের গল্প পাঠ শেষে মোটামুটি এই সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছি যে, গল্পকার হিসেবে সন্দীপনের চেয়ে সিরাজই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ। সিরাজই আমার আদর্শ।
বাংলা ভাষার গল্পকারদের মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, হাসান আজিজুল হক, আবুবকর সিদ্দিক ও শওকত আলীকে আমার খুবই শক্তিশালী গল্পকার বলে মনে হয়। এছড়া গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের গল্পও আমাকে বেশ টানে। আমি যখন লিখতে বসি তখন উপরোক্ত গল্পকারগণ আমার সামনে হাজির থাকেন।
৭. ঐতিহাসিক উপন্যাস বা ইতিহাসকে আশ্রয় করে লেখা উপন্যাস বাংলাদেশে খুব বেশি নেই। অথচ বাংলাদেশ ইতিহাস সমৃদ্ধ। যে সব লেখা হয়েছে সেখানে ইতিহাসের উপকরণের চেয়ে আবেগের পরিমাণটাই বেশি। এর কারণ কি বলে মনে করেন।
―হ্যাঁ, বাংলাদেশে ঐতিহাসিক উপন্যাস বা ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস খুব কমই লেখা হয়েছে। বাংলাদেশ যে ইতিহাস সমৃদ্ধ একটা ভুখণ্ড তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সাতচল্লিশের দেশ ভাগ এত বড় একটি ঘটনা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ ছাড়া এ নিয়ে ঠিক ওভাবে আরেকটা উপন্যাস এখনো লেখা হলো না। ‘খোয়াবনামা’য় দেশভাগ খুব ভালোভাবেই প্রসঙ্গ হয়ে এসেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ আরেকটি বড় ঘটনা, অথচ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস নেই। এটা বিস্ময়ের। অনেক উপন্যাসে মুক্তিযু্দ্ধ বিচ্ছিন্নভাবে প্রসঙ্গ হয়ে এসেছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে পটভূমি রেখে, বিস্তৃত পরিসরের কোনো উপন্যাস রচিত হলো না। যেসব উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ হয়ে এসেছে সেগুলোতেও থরোথরো আবেগ। এর কারণ, এখন বাংলাদেশের যারা খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক তারা প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। তাদের ভেতরে সেই আবেগটা এখনো রয়ে গেছে। ফলে তারা নিরপেক্ষ জায়গায় দাঁড়িয়ে লিখতে পারেন না। সুতরাং এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে তাদের দিয়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস লেখা হবে না। হবে নতুন প্রজন্মের হাত দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যাদের প্রত্যক্ষ আবেগ নেই। এবং সেটাই হবে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। নিশ্চয়ই তরুণ প্রজন্মের কেউ না কেউ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখতে এগিয়ে আসবেন।
তাছাড়া সুলতানি আমল, মোঘল আমল, নবাবী আমল; কিংবা ধরুন মুসলিম সাম্রাজ্যবাদী বখতিয়ার খলজীর লুটপাট, ধংসযজ্ঞ নিয়েও একটা বিশালায়তনের উপন্যাস হতে পারত। হয়নি। শওকত আলী ঐতিহাসিক উপাদান নিয়ে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লিখেছেন। কালের বিচারে উপন্যাসটি টিকে গেছে। জাকির তালুকদার কৈবর্ত সম্প্রদায় নিয়ে লিখেছেন ‘পিতৃগণ’। এটাও হয়ত টিকে যাবে। এখনো ঠিক বলা যাচ্ছে না। এধরনের হাতে গোনা কটি উপন্যাসের বাইরে আর যেগুলোকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বা ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস বলে দাবি করা হয়, দাবিদারদের সঙ্গে আমি একমত নই।
ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা না হওয়ার পেছনে আমি মূলত দুটি কারণকে দায়ী করি। একাত্তর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে এক ধরনের অস্থিরতা গেছে। সেই অস্থিরতা লেখকদেরও গ্রাস করেছে। ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার জন্য যে স্থিরতার প্রয়োজন তা লেখকরা পাননি। এরপরও কি স্থিরতা এসেছে? আসেনি তো। রাজনৈতিক সংঘাত লেগেই আছে। অথচ দেখুন কলকাতায় ঠিকই একের পর পর ঐতিহাসিক উপন্যাস রচিত হচ্ছে। কারণ সেখানে মারাত্মক কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক অস্থিরতা নেই। লেখকরা মোটামুটি একটা স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে থাকেন।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে অর্থনীতি। ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার জন্য যে গভীর অনুসন্ধানের প্রয়োজন তা তো লেখকরা করতে পারেন না। লেখককে দিনের বেশিরভাগ সময় রুটিরুজির পেছনে দৌড়াতে হয়, গবেষণার সময় কোথায়? ঐতিহাসিক উপন্যাস তো আর টেবিলে বসলেই লেখা যায় না।
৮. শাহজাদা দারাশুকো লিখতে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় পাঁচ বছর ধরে পড়াশুনা করেছেন। গবেষণার জন্য গবেষক রেখেছেন। বানী বসুর মৈত্রেয় জাতক লিখতে একটা টিম তাকে সহযোগতিতা করেছেন। সুনীলের সেই সময় সিরিজের ক্ষেত্রেও এ রকম প্রস্তুতি ছিল। ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে গিয়ে আপনই কি ধরনের প্রস্তুতি নেন।
―শাহজাদা দারাশিকো লেখার জন্য শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় পাঁচ বছর পড়াশোনা করেছেন ঠিক আছে। কিন্তু গবেষণার জন্য গবেষক রেখেছেন এটা এক ধরনের বিলাসিতা, লোকদেখানো ব্যাপারই বলব আমি। ঐতিহাসিক উপন্যাস কোনো ফরমায়েশি কাজ নয় যে ঔপন্যাসিক গবেষক রেখে গবেষণা করাবে। ঔপন্যাসিককেই গবেষক হওয়া চাই। নিজের গবেষণার মধ্যে যেভাবে লীন হওয়া যায়, যেভাবে গভীরে ডুব দেয়া যায়, ভাড়াটিয়া গবেষক রেখে তা যায় না। কেউ যদি বলেন আমি উপন্যাস লেখার জন্য গবেষক নিয়োজিত করেছি, তাহলে আমি এটাকে স্রেফ ফালতু কথাই বলব। এটাকে বাহবা পাওয়ার চেষ্টা বলব। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিসিউ’ লিখতে কতজন গবেষক নিয়োজিত করেছিলেন? ওটা কি ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়? কিংবা ‘ওয়ার এন্ড পীস’-এর কথাই ধরুন। কত বড় ঐতিহাসিক উপন্যাস! এটি লেখার সময় কি কোনো সহযোগী গবেষক কাজ করেছিল? আমার জানা নেই। অথবা জগদ্বিখ্যাত ঔপন্যাসিক মিখাইল শলোখভের ‘এন্ড কোয়ায়েট ফ্লোজ দি ডন’ লেখার সময় কি লেখক গবেষক নিয়োগ করেছিলেন? এই তথ্যও আমার জানা নেই। গবেষক নিয়োগ করে আর যাই হোক, উপন্যাস লেখা হয় না। উপন্যাস একটা শিল্প। এই শিল্পের অধিকর্তা-অধিশ্বর শিল্পী নিজেই।
আমার ‘হীরকডানা’ ও ‘রাজনটী’কে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা হয়। পাঁচ-ছয় বছর ধরে আমি ‘হীরকডানা’ উপন্যাসের কাহিনী মাথায় ফেরি করে বেড়িয়েছি। উপন্যাসটির পটভূমি দক্ষিণ-পূর্ববাংলা ও ত্রিপুরা। আমার বাড়ি দক্ষিণ-পূর্ববাংলায়, ফেনীর ত্রিপুরা সংলগ্ন এলাকায়। ‘রাজনটী’ লেখার আগে চোরাইপথে দু-বার ত্রিপুরায় গিয়েছি। ‘হীরকডানা’ লেখার সময় ভিসা নিয়ে গিয়েছি দুবার। ‘হীরকডানা’ লেখার আগে নবাবী আমল, ইংরেজ আমলের বাংলা-ভারতের ইতিহাসটা আমাকে জেনে নিতে হয়েছে। মগ-ফিরিঙ্গি-বর্গীদের উৎপাত সম্পর্কে বিষদ জানতে হয়েছে। জেনেছি বই পড়ে, ফিল্ডওয়ার্ক করে, লোকমুখে শুনে। আমার কোনো সহযোগী ছিল না, দরকারও মনে করিনি। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘বেগানা’ লেখার সময়ও আমি একা কাজ করেছি। রোহিঙ্গা অধ্যূষিত এলাকা ভ্রমণ করেছি। সঙ্গী হয়ত ছিল। কিন্তু তিনি গবেষণায়ে কোনো সহযোগিতা করেননি। রোহিঙ্গাদের ইতিহাস-সংস্কৃতিকে বুঝেছি তাদের সঙ্গে থেকেই।
কিংবা ধরুন, এখন যে উপন্যাসটি লিখছি এটাও এক ধরনের ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস। লেখা শুরু করার আগে দু-বার সুন্দরবন ভ্রমণ করেছি। আরো কয়েকবার যেতে হবে। উপন্যাসটি যে পটভূমির, সেখানাকার মানুষদের ভাষা, সংস্কৃতি, লোকইতিহাস, ভুগোল ইত্যাদি বিষয় আমার জানা থাকা চাই। এছাড়াও এই সংক্রান্ত প্রচুর বই জোগাড় করেছি। যেমন ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’ কিনলাম সেদিন, বারো শ টাকা দিয়ে। আহমদিয়া মুসলিম জামায়াতও এই উপন্যাসের একটা বিষয়। এই সম্প্রদায়ের উপর বই খুঁজছি। পেয়ে যাব নিশ্চয়ই।
বাংলা ভাষার গল্পকারদের মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, হাসান আজিজুল হক, আবুবকর সিদ্দিক ও শওকত আলীকে আমার খুবই শক্তিশালী গল্পকার বলে মনে হয়। এছড়া গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের গল্পও আমাকে বেশ টানে। আমি যখন লিখতে বসি তখন উপরোক্ত গল্পকারগণ আমার সামনে হাজির থাকেন।
৭. ঐতিহাসিক উপন্যাস বা ইতিহাসকে আশ্রয় করে লেখা উপন্যাস বাংলাদেশে খুব বেশি নেই। অথচ বাংলাদেশ ইতিহাস সমৃদ্ধ। যে সব লেখা হয়েছে সেখানে ইতিহাসের উপকরণের চেয়ে আবেগের পরিমাণটাই বেশি। এর কারণ কি বলে মনে করেন।
―হ্যাঁ, বাংলাদেশে ঐতিহাসিক উপন্যাস বা ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস খুব কমই লেখা হয়েছে। বাংলাদেশ যে ইতিহাস সমৃদ্ধ একটা ভুখণ্ড তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সাতচল্লিশের দেশ ভাগ এত বড় একটি ঘটনা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ ছাড়া এ নিয়ে ঠিক ওভাবে আরেকটা উপন্যাস এখনো লেখা হলো না। ‘খোয়াবনামা’য় দেশভাগ খুব ভালোভাবেই প্রসঙ্গ হয়ে এসেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ আরেকটি বড় ঘটনা, অথচ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস নেই। এটা বিস্ময়ের। অনেক উপন্যাসে মুক্তিযু্দ্ধ বিচ্ছিন্নভাবে প্রসঙ্গ হয়ে এসেছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে পটভূমি রেখে, বিস্তৃত পরিসরের কোনো উপন্যাস রচিত হলো না। যেসব উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ হয়ে এসেছে সেগুলোতেও থরোথরো আবেগ। এর কারণ, এখন বাংলাদেশের যারা খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক তারা প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। তাদের ভেতরে সেই আবেগটা এখনো রয়ে গেছে। ফলে তারা নিরপেক্ষ জায়গায় দাঁড়িয়ে লিখতে পারেন না। সুতরাং এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে তাদের দিয়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস লেখা হবে না। হবে নতুন প্রজন্মের হাত দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যাদের প্রত্যক্ষ আবেগ নেই। এবং সেটাই হবে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। নিশ্চয়ই তরুণ প্রজন্মের কেউ না কেউ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখতে এগিয়ে আসবেন।
তাছাড়া সুলতানি আমল, মোঘল আমল, নবাবী আমল; কিংবা ধরুন মুসলিম সাম্রাজ্যবাদী বখতিয়ার খলজীর লুটপাট, ধংসযজ্ঞ নিয়েও একটা বিশালায়তনের উপন্যাস হতে পারত। হয়নি। শওকত আলী ঐতিহাসিক উপাদান নিয়ে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লিখেছেন। কালের বিচারে উপন্যাসটি টিকে গেছে। জাকির তালুকদার কৈবর্ত সম্প্রদায় নিয়ে লিখেছেন ‘পিতৃগণ’। এটাও হয়ত টিকে যাবে। এখনো ঠিক বলা যাচ্ছে না। এধরনের হাতে গোনা কটি উপন্যাসের বাইরে আর যেগুলোকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বা ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস বলে দাবি করা হয়, দাবিদারদের সঙ্গে আমি একমত নই।
ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা না হওয়ার পেছনে আমি মূলত দুটি কারণকে দায়ী করি। একাত্তর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে এক ধরনের অস্থিরতা গেছে। সেই অস্থিরতা লেখকদেরও গ্রাস করেছে। ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার জন্য যে স্থিরতার প্রয়োজন তা লেখকরা পাননি। এরপরও কি স্থিরতা এসেছে? আসেনি তো। রাজনৈতিক সংঘাত লেগেই আছে। অথচ দেখুন কলকাতায় ঠিকই একের পর পর ঐতিহাসিক উপন্যাস রচিত হচ্ছে। কারণ সেখানে মারাত্মক কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক অস্থিরতা নেই। লেখকরা মোটামুটি একটা স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে থাকেন।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে অর্থনীতি। ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার জন্য যে গভীর অনুসন্ধানের প্রয়োজন তা তো লেখকরা করতে পারেন না। লেখককে দিনের বেশিরভাগ সময় রুটিরুজির পেছনে দৌড়াতে হয়, গবেষণার সময় কোথায়? ঐতিহাসিক উপন্যাস তো আর টেবিলে বসলেই লেখা যায় না।
৮. শাহজাদা দারাশুকো লিখতে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় পাঁচ বছর ধরে পড়াশুনা করেছেন। গবেষণার জন্য গবেষক রেখেছেন। বানী বসুর মৈত্রেয় জাতক লিখতে একটা টিম তাকে সহযোগতিতা করেছেন। সুনীলের সেই সময় সিরিজের ক্ষেত্রেও এ রকম প্রস্তুতি ছিল। ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে গিয়ে আপনই কি ধরনের প্রস্তুতি নেন।
―শাহজাদা দারাশিকো লেখার জন্য শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় পাঁচ বছর পড়াশোনা করেছেন ঠিক আছে। কিন্তু গবেষণার জন্য গবেষক রেখেছেন এটা এক ধরনের বিলাসিতা, লোকদেখানো ব্যাপারই বলব আমি। ঐতিহাসিক উপন্যাস কোনো ফরমায়েশি কাজ নয় যে ঔপন্যাসিক গবেষক রেখে গবেষণা করাবে। ঔপন্যাসিককেই গবেষক হওয়া চাই। নিজের গবেষণার মধ্যে যেভাবে লীন হওয়া যায়, যেভাবে গভীরে ডুব দেয়া যায়, ভাড়াটিয়া গবেষক রেখে তা যায় না। কেউ যদি বলেন আমি উপন্যাস লেখার জন্য গবেষক নিয়োজিত করেছি, তাহলে আমি এটাকে স্রেফ ফালতু কথাই বলব। এটাকে বাহবা পাওয়ার চেষ্টা বলব। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ‘হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিসিউ’ লিখতে কতজন গবেষক নিয়োজিত করেছিলেন? ওটা কি ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়? কিংবা ‘ওয়ার এন্ড পীস’-এর কথাই ধরুন। কত বড় ঐতিহাসিক উপন্যাস! এটি লেখার সময় কি কোনো সহযোগী গবেষক কাজ করেছিল? আমার জানা নেই। অথবা জগদ্বিখ্যাত ঔপন্যাসিক মিখাইল শলোখভের ‘এন্ড কোয়ায়েট ফ্লোজ দি ডন’ লেখার সময় কি লেখক গবেষক নিয়োগ করেছিলেন? এই তথ্যও আমার জানা নেই। গবেষক নিয়োগ করে আর যাই হোক, উপন্যাস লেখা হয় না। উপন্যাস একটা শিল্প। এই শিল্পের অধিকর্তা-অধিশ্বর শিল্পী নিজেই।
আমার ‘হীরকডানা’ ও ‘রাজনটী’কে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা হয়। পাঁচ-ছয় বছর ধরে আমি ‘হীরকডানা’ উপন্যাসের কাহিনী মাথায় ফেরি করে বেড়িয়েছি। উপন্যাসটির পটভূমি দক্ষিণ-পূর্ববাংলা ও ত্রিপুরা। আমার বাড়ি দক্ষিণ-পূর্ববাংলায়, ফেনীর ত্রিপুরা সংলগ্ন এলাকায়। ‘রাজনটী’ লেখার আগে চোরাইপথে দু-বার ত্রিপুরায় গিয়েছি। ‘হীরকডানা’ লেখার সময় ভিসা নিয়ে গিয়েছি দুবার। ‘হীরকডানা’ লেখার আগে নবাবী আমল, ইংরেজ আমলের বাংলা-ভারতের ইতিহাসটা আমাকে জেনে নিতে হয়েছে। মগ-ফিরিঙ্গি-বর্গীদের উৎপাত সম্পর্কে বিষদ জানতে হয়েছে। জেনেছি বই পড়ে, ফিল্ডওয়ার্ক করে, লোকমুখে শুনে। আমার কোনো সহযোগী ছিল না, দরকারও মনে করিনি। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘বেগানা’ লেখার সময়ও আমি একা কাজ করেছি। রোহিঙ্গা অধ্যূষিত এলাকা ভ্রমণ করেছি। সঙ্গী হয়ত ছিল। কিন্তু তিনি গবেষণায়ে কোনো সহযোগিতা করেননি। রোহিঙ্গাদের ইতিহাস-সংস্কৃতিকে বুঝেছি তাদের সঙ্গে থেকেই।
কিংবা ধরুন, এখন যে উপন্যাসটি লিখছি এটাও এক ধরনের ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস। লেখা শুরু করার আগে দু-বার সুন্দরবন ভ্রমণ করেছি। আরো কয়েকবার যেতে হবে। উপন্যাসটি যে পটভূমির, সেখানাকার মানুষদের ভাষা, সংস্কৃতি, লোকইতিহাস, ভুগোল ইত্যাদি বিষয় আমার জানা থাকা চাই। এছাড়াও এই সংক্রান্ত প্রচুর বই জোগাড় করেছি। যেমন ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’ কিনলাম সেদিন, বারো শ টাকা দিয়ে। আহমদিয়া মুসলিম জামায়াতও এই উপন্যাসের একটা বিষয়। এই সম্প্রদায়ের উপর বই খুঁজছি। পেয়ে যাব নিশ্চয়ই।
ঐতিহাসিক বা ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস লেখার জন্য প্রস্তুতিটা আমি এভাবেই নিয়েছি বা নেই। তারপর লেখা শুরু করি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেবিলে পড়ে থাকি। কোনো ইনফরমেশান ভুল হলো কিনা সতর্ক থাকি। এ ধরনের উপন্যাসের তথ্য তো নির্ভুল হওয়া চাই। মীরজাফরকে বা খন্দকার মোশতাককে তো দেশপ্রেমিক বানিয়ে দিলে হবে না! উপন্যাসের পটভূমি সুন্দরবন অঞ্চল, কিন্তু শব্দ ব্যবহার করব নোয়াখালী অঞ্চলের তা তো হবে না। শিল্পের সত্য আর ইতিহাসের সত্য এক নয় এটা ঠিক। কিন্তু কেউ যখন ইতিহাসকে বিষয় করে শিল্প রচনা করবেন, তখন তো আর ইতিহাসকে উল্টে দিতে পারবেন না।
৯. কার জন্য গল্প লেখেন? আপনি কি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখেন? লিখলে কেনো লেখেন? আর যদি পাঠকের কথা মনে না রেখে লেখেন তাহলে কেনো পাঠককে মনে রাখেন না লেখার সময়ে?
―একটি গল্প যখন আমার মাথায় ভ্রুণ আকারে থাকে, তখনো মনে হয় ওই ভ্রুণটি আমার। ভ্রুণটি যখন ধীরে ধীরে বড় হয় তখনও মনে হয় সেটি আমারই। গল্পটি যখন মাথা থেকে শব্দ-অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বন্দী হয়, তখনো আমি মনে করি গল্পটি নিজের জন্যই লিখছি। কিন্তু লেখা শেষে মনে হয়, না, এটি শুধু আমার তৃপ্তির জন্য নয়, এই গল্পটি আমি অন্যদেরও জানাতে চাই। মানে পাঠকদের। তখন আমার কাছে পাঠকই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বস্তুত পাঠক ছাড়া তো আমর লেখার কোনো সার্থকতা নেই।
১০. এখন কি লিখছেন?
―একটি উপন্যাস। সুন্দরবনের ধারঘেঁষা শিঙার নদী তীরবর্তী একটা গ্রামের ধর্মীয় সঙ্কট নিয়ে একটা উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছি। এক পর্ব লিখেছি মাত্র। ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ভূক্ত এক স্কুল মাস্টার হঠাৎ মুসলমান হয়ে যায়। তাকে এবং তার পরিবারকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত। সাম্প্রদায়িক সঙ্কট, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন ইত্যাদি বিষয় উপন্যাসটিতে প্রাধান্য পাবে।
১১. আগামীতে কি লিখবেন?
―বেশ কটি গল্প দীর্ঘদিন মাথায় ফেরি করে বেড়াচ্ছি। যেমন ধরুন, সাভারের ভবন ধস নিয়ে একটা গল্প লেখার কথা ভাবছি ওই ঘটনার পর থেকে। প্রতিদিনই ভাবি আজই গল্পটা লিখে ফেলব, অথচ হয়ে উঠছে না। এরকম আরো কয়েকটি গল্প লেখার ইচ্ছে আছে। পাশাপাশি উপন্যাস তো আছেই। গল্প-উপন্যাসের বাইরে অন্য কিছু লেখার কথা ভাবি না।

লেখক পরিচিতি
স্বকৃত নোমান
প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ ঔপন্যাসিক। ১৯৮০’র ৮ নভেম্বর ফনীর পরশুরাম উপজেলার বিলোনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। দৈনিক আজকের কাগজের মাধ্যমে সাংবাদিকতার শুরু। ‘কয়েকটি জোব্বার মহাপ্রয়াণ’ শীর্ষক একটি নিবন্ধের মাধ্যমে প্রয়াত নাট্যকার ড. সেলিম আল দীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তীকালে তাঁর একান্ত সচিব হিসেবে যোগ দেন। তাঁর কাছেই বিশ্বসাহিত্যের পাঠ নেন নোমান। সেলিম আল দীনের মৃত্যুর পর আবার সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। বর্তমানে তিনি নিউজপোর্টাল ঢাকারিপোর্টটোয়েন্টিফোর.কম ও সাপ্তাহিক ধাবমান-এর এক্সিকিউটিভ এডিটর। ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস নাভি। এরপর প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ‘ধুপকুশী’ (পরিবর্তিত নাম ‘বংশীয়াল’), ‘জলেস্বর’, ‘রাজনটী’ ও ‘হীরকডানা’। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত গল্প লিখছেন। ইতিহাস, ইতিহাসের মানুষ, বিশাল বাংলার মিথ, লোকজীবন, লোকসংস্কৃতি, বঞ্চিত মানুষদের সুখ-দুঃখের পাঁচালি তাঁর গল্প-উপন্যাসে ভিন্ন রকমের মাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়। তাঁর উপন্যাসের ভাষা ও আঙ্গিক একেবারেই আলাদা, নিজস্ব। কথাসাহিত্যে তিনি এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।”
3 মন্তব্যসমূহ
আকর্ষণ আছে কথাগুলোর ভেতর।
উত্তরমুছুনযেমনটি আমি এইমুহুর্তেই জানতে চাই ঠিক সেইবিষয়গুলিই কি করে যেন তিনি বলে ফেললেন।
কাকতালীয় যে, গুগল সার্চ থেকে অনেক আবর্জনা ঘেঁটেঘুটে কি করে যে এই পাতায় চলে এসেছি!
আরো আকর্ষণ বোধ করছি তার লেখাগুলো পড়তেও।
আশা করি সেটা পড়াও হবে।
তার সাথে আলোচনা করারও খুব ইচ্ছে আছে।
ভালো লাগলো বেশ
উত্তরমুছুনকাহিনী পাঠ করার আগ্রহ বাড়লো।
উত্তরমুছুন