স্বপ্নসম্ভব

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

সাবমেরিনটা পুরো এসি। ভিতরে লাল গদির চেয়ার। ডিজিটাল স্টিরিয়োফোনিকে মিউজিক বাজছে। মিউজিকটা চেনা। টাইটানিকের। সাবমেরিনের দেওয়ালে কাচের ওয়াটার-টাইট জানালা। জানালার বাইরে লাল মাছ-নীল মাছ। সাবমেরিনের ভিতর একটা সোফায় বসে আছেন নেতাজি। নেতাজি মানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। মিলিটারি পোশাক, বুকে নানা রকম স্টার লাগানো। নেতাজির গা থেকে খুব ভাল ওডিকোলনের গন্ধ আসছে, রাকেশ সাকসেনার বাবার গায়ে যেমন। নেতাজির ঠিক পাশেই বসে আছে সন্দীপ। সন্দীপ কী করে নেতাজির সঙ্গে সাবমেরিনে চাপল, সন্দীপ জানে না। কারণ, এটা স্বপ্ন তো, স্বপ্নের সব জানা যায় না। তবে সন্দীপ জানে নেতাজি এখন জাপান যাচ্ছেন।


নেতাজি এত ক্ষণ খবরের কাগজ পড়ছিলেন। খবরের কাগজ থেকে মুখ উঠিয়ে সন্দীপকে দেখলেন। দেখে একটু মুচকি হাসলেন। এই মুচকি হাসিটার মানেই হচ্ছে হাই। সন্দীপ জানে। নেতাজি তো আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েননি— কটকের স্কুলটা কি ইংলিশ মিডিয়াম ছিল?

নেতাজি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম কী খোকা?
সন্দীপ বলল, স্যাণ্ডি।
নেতাজি বললেন, এ আবার কেমন নাম? কে রেখেছে?
সন্দীপ বলল, স্কুলের ফ্রেণ্ডসরা।
—ও। তোমার বাবা-মা কী নাম রেখেছিলেন?
—সন্দীপ।
—ও। বুঝেছি, বুঝেছি। তা কোন স্কুলে পড়?
—সেন্ট জোসেফ স্কুল, খর্সিয়ং।
—তোমার বাবা কার্শিয়াং-এ রেখে পড়াচ্ছেন? বাবা কী করেন?
—বিজনেস।
—বাঃ! বাঙালির তো বিজনেস-এ আসা উচিত। তুমিও বড় হয়ে ব্যবসা কোরো। ইণ্ডাষ্ট্রি তৈরি করবে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তো, তোমার বাবার কীসের বিজনেস?
একটা ঢোক গিলে সন্দীপ বলল— ইঞ্জিনিয়ারিং বিজনেস।
—তোমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার বুঝি?

সন্দীপ এমন ভাবে মাথা নাড়াল, তাতে মোটামুটি হ্যাঁ-ই বোঝায়। নেতাজি পকেট থেকে দুটো চুইংগাম বার করে দিলেন সন্দীপকে। জার্মান চুইংগাম। সন্দীপ ট্রাউজারের হিপ পকেট থেকে একটা টুকরো কাগজ বার করে নেতাজির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, অটোগ্রাফ প্লিজ।

নেতাজি মুচকি হেসে বললেন, সরি, অটোগ্রাফ দেওয়া যাবে না। আমি খুব গোপনে জাপান যাচ্ছি তো।

সন্দীপ ব্যাপারটা বুঝল। বলল, নো প্রবলেম।

নেতাজি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বাড়ি কোথায়?

সন্দীপের দমদম বলতে লজ্জা করল। সন্দীপ বলল, সল্টলেক।

—কোন ক্লাসে পড়?

—এইট্থ্।

—খেলাধুলো কর?

—ওহ্, ইয়েস।

নেতাজি বললেন, তোমার সঙ্গে কথা বলে খুব খুশি হয়েছি। তোমার সাহসেরও প্রশংসা করি। কী সুন্দর একা একা জাপান যাচ্ছ। এই নাও জাপানের হাতখরচ। এক গোছা ডলার তুলে দিলেন সন্দীপের হাতে। সন্দীপের এত আনন্দ হল যে, থ্যাংকিউ বলতেই ভুলে গেল।

এর পর তো জাপানে পৌঁছে গেল সন্দীপ। ডলার পকেটে সন্দীপ সোজা গেল জাপানের মার্কেটে। ওঃ! কত জিনিস! স্তূপ করে রাখা ইলেকট্রনিক গুডস। একটা দারুণ মোবাইল সেট কিনল। ছবি তোলা যায়, টিভি দেখা যায়, কালার্ড। ওটায় আবার তিন মিনিটের ভিডিয়ো তোলা যায়। চিজ বড়ি হ্যায়, মস্ত্ মস্ত্। নীনাকে একটা এস এম এস করল— নীনা, আই অ্যাম ইন দ্য ইলেকট্রনিক প্যারাডাইস। টেল মি হোয়াট ডু আই ডু। বাবাকে এস এম এস— আই অ্যাম সো নাইস ইন জাপান। সো মেনি থিংস অ্যারাউণ্ড। ট্রাইং টু ফাইণ্ড এ মোবাইল সেট ফর ইউ। ইয়োর সেট ইজ অবসোলিট নাউ।... কিন্তু এত লেখা যাবে না। বাবা এত ইংরেজি বোঝে না। বাংলায় আবার এস এম এস হয় না। সন্দীপও বাংলা লিখতে পারে না ভাল।

কত কী কিনল সন্দীপ! ডিজিটাল ক্যামেরা, মিনি ভিসিডি প্লেয়ার, মিনি রেকর্ডার, জিন্স, পারফিউম...। কসমেটিকস-এর ডিপার্টমেন্টে গিয়ে মনে হল ওর সে রকম বেশি গার্লফ্রেণ্ড নেই। তবু কিনল একগাদা। মা আগে পরত না, আজকাল পরছে। মায়ের চারটে। বাকি লিপস্টিকগুলো মেয়েদের ভলিবল খেলার মাঠে ছড়িয়ে দেবে। ব্যাগ ভর্তি। এ বার কিনল এক আজব জিনিস। ইলেকট্রনিক উইংগ্স। ডানা। ওখানে একটা ছোট্ট কী-বোর্ড আছে। ডেসটিনেশনটা টাইপ করে দিলেই স্ক্রিনে ওখানকার ল্যাটিচিউড-লংগিচিউড ফুটে উঠবে। তার পর এন্টার মারলেই উড়তে শুরু করে দেবে, নিয়ে যাবে যেখানে যেতে চায় সেখানে।

সন্দীপ টাইপ করে দিল কলকাতা। সন্দীপ উড়তে লাগল আকাশে। ও দু’হাতে আঁকড়ে ধরে আছে ওর শখের জিনিস ভর্তি ব্যাগ। সব বড় বড় হাইরাইজ পেরিয়ে সমুদ্রের উপরে উঠে এল সন্দীপ। আশেপাশে মেঘ। এমন সময় মেঘের আড়াল থেকে চার-পাঁচ জন ফ্লাইংম্যান ওর কাছে চলে এল। ওকে ঘিরে নিল। ওদেরও ও রকম জাপানি ডানা। ওরা সন্দীপের ব্যাগটা ছিনতাই করে নিয়ে উড়ে গেল। সন্দীপ মহাকাশে একা ভ্যাঁ করে কাঁদছে।

নিজের কান্নার শব্দেই ঘুম ভেঙে গেল সন্দীপের। হোস্টেলের ঘরে পাশের বেডে রুমমেট রাকেশ ঘুমোচ্ছে। ভাগ্যিস ও জাগেনি। কাচের শার্সিতে শিশির পড়েছে। একটু একটু ভোর। তা হলে এটা শেষ রাতের স্বপ্ন। শেষ রাতের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। সত্যি যেন আসে ডলার আর জাপান মার্কেট।

পাশ ফিরে শোয় সন্দীপ। শার্সিগড়ানো শিশির কান্নার মতো লাগছে। সব কিছু পেয়েও হারাতে হল। একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল। জাপান মার্কেটে পিস্তল কেন খুঁজল না। পিস্তলই বা কেন, আরও কত অ্যানিহিলেটর আছে, হিম্যানদের মতো, স্পাইডারম্যানদের মতো। ওদের বন্দুক থেকে একটা রে বের হয়, আর সেই রে যার গায়ে লাগে সে ভ্যানিশ হয়ে যায়। ও রকম একটা বন্দুক যদি কিনে নিত, তা হলে ওই সব কসমিক পাইরেট্সদের ভ্যানিশ করে দিত। তার চেয়ে গুলি করে দেওয়াই বেটার। পড়ে যেত সমুদ্রে, শার্করা খেয়ে নিত। সব জিনিসপত্র নিয়ে সেফলি চলে আসত, রাকেশ-টাকেশরা ট্যারা হয়ে যেত। ভুল হয়ে গেছে। দ্যাট ওয়াজ এ গ্রেট মিসটেক। এ বার থেকে স্বপ্নে বন্দুক কিনবে। বেল বাজল। ঘুম ভাঙানোর বেল। মুখ ধুয়েই জগিং-এ যেতে হবে। বারান্দায় বেরতেই পাইন-পাহাড়-কুয়াশা সাঁতরানো পাখি বলল, গুড মর্নিং।

সন্দীপের বাবা সুভাষবাবুর সঙ্গে চা খাচ্ছেন। সুভাষবাবুর মাথায় সাদা রঙের গোল টুপি। ইনি সুভাষ চক্রবর্তী। মন্ত্রী। একটু আগে এসেছেন। মুড়ি-নারকোল খেয়েছেন। এখন চা। বললেন, এখন দমদম কেমন দেখছেন?

সন্দীপের বাবা বললেন, দারুণ! কত ফ্ল্যাট! কারখানাগুলোর ধুলো-ধোঁয়া আর নেই। কলোনিতে এখন বিউটি পার্লার, সাইবার কাফে। যশোর রোড চওড়া হয়ে গেছে। শুধু এ পাশে এখনও একটাও ফ্লাইওভার নেই। ওটা হলেই এলাকার ইজ্জত বেড়ে যাবে। সুভাষবাবু মুচকি হাসতে লাগলেন।

সন্দীপের বাবার নাম মনোতোষ দাস। পাড়ায় মনু বলেই সবাই চেনে। ট্যারা মনু। দমদম এলাকার একটা বড় অঞ্চলে জমির দালালির একচ্ছত্র অধিকার মনুর। প্রোমোটারদের মেটিরিয়ালও সাপ্লাই করেন। ভাড়াটে তোলারও কনট্রাক্ট নেন। মস্তান ফিট আছে। গডফাদারও ফিট আছে। কলোনিতে থাকতেন, দু’বছর আগে বাগজোলা খালের ধারে একটা বাড়ি ভাড়াটে সমেত কিনেছিলেন, চমকে ভাড়াটে উঠিয়ে দিয়েছেন। এক তলায় ওঁর অফিস এবং ঠেক। দেওয়ালে কালী ও বিবেকানন্দ। এখানে সুভাষবাবুর মতো মানুষ কেন এলেন, কী ভাবে এলেন মনু জানেন না। কারণ, এটা স্বপ্ন তো, স্বপ্নের সব জানা যায় না।

মনুবাবু ঠিক সুভাষদা বলতে ভরসা পাচ্ছেন না। কখনও এত সামনাসামনি কথা হয়নি তো, দূর থেকেই দেখেছেন। সুভাষদা জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেমেয়ে কটা?

—একটা।

—কী করছে?

—কার্শিয়াং-এর সেন্ট জোসেফে দিয়েছি।

—অনেক তো খরচ ওখানে। কী রকম খরচ লাগে?

—সেভেন থাউজেণ্ডের মতো...

—আপনার সাহস আছে তো...

হ্যাঁ। একমাত্র ছেলেকে মানুষ করতে কোনও কঞ্জুসি নয়। এ পাড়ায় অফিসার আছে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার আছে। কোনও শালার হিম্মত নেই ছেলেকে দার্জিলিং-দেরাদুন-কার্শিয়াং-এ রেখে পড়াবার। খালি পয়সা থাকলেই হয় না, দিল চাই, হিম্মত চাই। মনুর স্যাটিসফ্যাকশন আছে ওঁর মাকে শ্বেতপাথর বসানো ঠাকুরঘর করে দিতে পেরেছেন। পেতলের সিংহাসনে ফিলিপস-এর লাইট কষ্টিপাথরের কৃষ্ণকে ফোকাস মারছে। ঠাকুরঘরের জন্য আলাদা মিউজিক সিসটেম। সেখানে অনুপ জালোটা, অমৃক সিং অরোরা তার পর কী যেন লক্ষ্মী, সবার ভজন-টজন মন্ত্রের গান স্টক আছে। মা বহুত কষ্ট করেছেন এক সময়। এখন মা মৃত্যুর আগে দেখে যাচ্ছেন ওঁর নাতি সাহেব-স্কুলে পড়ছে। বাড়িতে এলে ইংলিশ গান গায়।

এ-পাড়ায় অনেকের বাচ্চাই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, কিন্তু ওঁর ছেলের মতো ইংলিশ কেউ বলতে পারে না। এমন গড়গড় করে বলে যে, ওর বন্ধুরাও বুঝতে পারে না। ভগবান যদি সহায় থাকে ছেলেকে ফরেন পাঠাবেন। তা হলে তো আবার মেম আসবে ঘরে। তখন কি এই বাড়িটা পছন্দ হবে? পাড়াটা একটু ইয়ে মতো। বাড়ির সামনে খালের ধারে ঝুপড়ি। নোংরা। সব সময় খিস্তা-খিস্তি। তা ছাড়া, এ-পাড়ায় ফ্লাইওভার কই? পার্ক? ফোয়ারা? অন্য বাড়ি করাও সম্ভব নয়। ছেলের পিছনে কাঁড়ি কাঁড়ি খরচ। কারবারটাও মন্দা চলছে। খালি জমি শেষ। সুতরাং জমির দালালিও শেষ। দালালির কাজ হত খুচখাচ ফ্ল্যাটে। এখন সব বিগ বিগ ক্যাপিটালের ফ্ল্যাট। যত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, ওই সব জমিতে ফ্ল্যাট হচ্ছে। হাই লেভেলের ব্যাপার। কোটি কোটি টাকার খেলা। ওদের ফ্ল্যাট বিক্কিরি করতে দালাল লাগে না। খবর কাগজে গাছ-পাখি-ফুল আর সুইমিংপুল মিশিয়ে একটা ছবি ছেপে দেয়, খদ্দেররা চেক বুক বুকে চেপে লাইন দেয়।

এখন অন্য লাইন ধরতে হবে। দালালকে ভাল কথায় বলে ব্রোকার। এখন ব্রোকারির দিনও শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ বার এজেন্ট হতে হবে। কিছু একটার। এক বার রিকোয়েস্ট করবে নাকি সুভাষদাকে। কিন্তু তার আগেই সুভাষবাবু বলে ফেলেন, একটা রিকোয়েস্ট করব, মনুবাবু?

মনুবাবু অবাক!— আমাকে রিকোয়েস্ট?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—কী রিকোয়েস্ট?

—এক বার বাইরে আসবেন?

—নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই।

—আচ্ছা মনুবাবু, আপনার এক বারও মনে হয়নি, আমি কেন এখানে এলাম?

—মনে হয়েছিল, কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে সাহস হয়নি।

—তবে বলি। আমি একটু দোলনা চড়ব। কেউ জানবে না। শুধু আপনি আর আমি। আমায় একটু দোল দেবেন?

মহা আতান্তরে পড়েন মনু। মাথা চুলকোতে থাকেন। সুভাষবাবু বলেন, এ-পাড়ায় একটু একা একা ঘুরছিলাম। গোপনে। সুযোগ তো পাই না, সব সময় লোক ঘিরে থাকে। আপনাদের বাড়ির উল্টো দিকে বটগাছের ডাল থেকে ঝোলানো দোলনাটা দেখে খুব লোভ হল। কত কাল...। একটু দোল দেবেন?

খালধারের ঝুপড়ির বাচ্চারা বটগাছের ডালে দড়ি বেঁধে দোলনা করেছে। ওখানে সুভাষবাবু বসলেন। মনু দোল দিতে লাগল। দোল দিতে দিতেই ভাবছিল এ বারই কথাটা পাড়বে। বলবে সুভাষদা, বাড়ির সামনের ঝুপড়িগুলো উঠিয়ে দিন। আপনি তো কী সুন্দর অপারেশন সানশাইন করেছিলেন। এটাও করে দিন। মেয়রের সঙ্গে কথা বলুন। বুলডোজার দিয়ে এক ঘণ্টায় সাফ হয়ে যাবে সব। আমি আপনারই লোক। আপনাকে দোল দিচ্ছি, আমাদের পাড়ায় এখন ডব্লিউ বি সি এস অফিসার এসেছে অনেক। এ বার পাড়াটাকে পরিষ্কার করে দিন, ঝুপড়ি উঠিয়ে খালধারে একটা পার্ক...। এখন দোল দিচ্ছি, দোল...

ধাক্কা মারছ কেন? কী হল? মনুবাবুর বউ ঝাঁজিয়ে উঠল। মনু বুঝল স্বপ্ন দেখছিল। আর একটু দেখতে পারলে ভাল হত। কথাটাই পাড়তে পারল না। ইস। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে, কাচের শার্সিতে জল গড়াচ্ছে, কান্নার মতো লাগছে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ