সমীর আহমেদ
বাংলাদেশের সন্তান হলেও এ দেশে দীর্ঘদিন উপেক্ষিত থেকে গেছেন অসামান্য কথাসাহিত্যিক জগদীশ গুপ্ত। এই মাটির সন্তানকে মাটির কাছে ফিরিয়ে এনেছেন গল্পকার মনি হায়দার এবং বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ড. সরকার আবদুল মান্নান। তাঁরা সম্পাদনা করেছেন 'জগদীশ গুপ্তের শ্রেষ্ঠ গল্প' নামের চমত্কার একটি সংকলন।
এই ধরনের সম্পাদিত গ্রন্থ পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে একটি সুলিখিত ও তথ্যসমৃদ্ধ ভূমিকার জন্য। এ ক্ষেত্রে সম্পাদকদ্বয় সমীহ জাগানো ভূমিকা লিখেছেন জগদীশ গুপ্ত এবং তাঁর গল্প সর্ম্পকে। অনুসন্ধিত্সু ও সুলুকসন্ধানী এই ভূমিকা থেকে গল্পকার ও ঔপন্যাসিক জগদীশ গুপ্ত সর্ম্পকে সম্যক ধারনা অর্জন করা যায় অনায়াসে। প্রায় পঞ্চাশ পৃষ্ঠার ভূমিকায় জগদীশ গুপ্তের গল্প ও গল্পের জগতকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে—যৌন-জটিলতা ও যৌন-অপরাধমূলক গল্প; স্বার্থসর্বস্ব মানুষের নিষ্ঠুরতার গল্প; নিষ্ঠুর নিয়তি ও অতিপ্রাকৃত গল্প এবং কৌতুকরস ও রোমান্টিক গল্প।
সংকলনটিতে রয়েছে তেইশটি গল্প। ক্রমানুসারে এগুলো হলো:বিধবা রতিমঞ্জরী, দিবসের শেষে, পয়োমুখম, শশাঙ্ক কবিরাজের স্ত্রী, চন্দ্র সূর্য যতদিন, আদি কথার একটি, অরূপের রাস, শঙ্কিত অভয়া, হাড়, পাইক শ্রীহরি প্রামাণিক, চার পয়সায় এক আনা, বোনঝি গুঞ্জমালা, কলঙ্কিত সম্পর্ক, রসাভাসা, আঠারো কলার একটি, গুরুদয়ালের অপরাধ, মায়ের মৃত্য দিন, যাহা ঘটিল তাহাই সত্য, তৃষিত আত্মা, প্রলয়ঙ্করী যষ্ঠী, পুরাতন ভৃত্য, আমি ও দেবরাজের স্ত্রী এবং পামর।
জগদীশ গুপ্তের গল্পের জগত্ নির্মম, নিষ্ঠুর আর মর্মান্তিক। তাঁর গল্প মানে মানুষের ভেতরের পাথর-আত্মার সংশ্লেষণ, রুক্ষ ও রক্তাক্ত বোধের মৃতু, যেখানে মানবিকতার কোনো লেশ নেই। অথচ তাঁর গল্পের আখ্যানজুড়েই মানুষ। কিন্তু মানবিক মানুষ নেই। মনে হয়, মানুষের অতীত অন্য এক কামুক, ভণ্ড, প্রতারক জগতের গল্প লিখেছেন তিনি। তাঁর গল্প পড়তে পড়তে মনে আসতে পারে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি। আর তা হতে পারে দিল্লির দামিনী কিংবা ঢাকার বিশ্বজিতের ঘটনা। জগদীশ গুপ্ত এই চিরকালের বর্বরতার গল্পই লিখেছেন। আমরা মনুষত্ব, মানবিকতা, মানবাধিকার—ইত্যাদি শব্দের নামে দারুণ ভণ্ডামি করছি। আমাদের চারপাশে ভণ্ড আর প্রতারকের ছড়াছড়ি। মুখোশে সাঁটা যেন আরেকটা মুখোশ। জগদীশ গুপ্ত তাঁর গল্পে সেই কালের মানচিত্র আঁকতে গিয়ে এঁকেছেন সব কালের মুখোশ সমেত মানচিত্র।
'জগদীশ গুপ্তের শ্রেষ্ঠ গল্প' গ্রন্থের ভূমিকার তের পর্বের শুরুতে জগদীশ গুপ্তের গল্পের পটভূমি, চিন্তা, ধারণা ও ধ্যান সর্ম্পকে সম্পাদকদ্বয় লিখেছেন, 'জগদীশ গুপ্ত তাঁর ছোটগল্পে আমাদের গ্রামীণ জীবনের স্বাভাবিক নকশাটিই গ্রহণ করেছেন, যেখানে স্বামী স্ত্রী, পিতা পুত্র, মাতা-ভগিনী এবং পাড়া-পড়শি নিয়ে সর্ম্পকের কাঠামোটি চির পরিচিত ও পুরাতন। কিন্তু এই সংসারিক ও সামাজিক সম্পর্কের অন্তরালে চিরকাল ধরে চলছে যে অশুভ চিন্তা ও কর্মকোলাহল, বিকৃত ও ধ্বংসাত্মক অভিপ্রায়ের নিয়ত প্রবাহ—এই অনিচ্ছাকৃত জগত্ই জগদীশ গুপ্তের প্রতিপাদ্য। অভ্যস্ত জীবনের পেলব সম্পর্ক, সাংসারিক জীবনের আনন্দিত অধ্যায়, যে তাঁর গল্পে আসেনি, তা নয়, কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই সুখের আয়োজন যেন মানুষের পরবর্তীকালের অসহায়ত্বকে তীব্র তীক্ষ ও গভীর করে তোলার জন্যই। ফলে সামগ্রিকভাবে জগদীশ গুপ্তের গল্পগুলোতে মানুষের আত্যন্তিক বিনাশের এক নিরুপাধিক স্বরূপ উঠে এসেছে।' (পৃষ্ঠা:৪০)
গ্রামের মানুষ কি মানুষ নয়? মানুষ হলেই তার ক্রোধ থাকবে, লোভ থাকবে, গ্রাস করার আকাঙ্ক্ষা থাকবে। আর শহরের মানুষগুলো গ্রামের চৌহদ্দি পার হয়েই তো? শহুরে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের মানুষ ও জীবনের ওপর এই অলংকার চাপিয়ে দেওয়ার মানে নিজেকে অস্বীকার করা, একটা মিথ্যা মিথ তৈরির প্রাগলভতা। এই মিথ্যা ও প্রপঞ্চময় মিথকে গুঁড়িয়ে দিলেন গল্পকার জগদীশ গুপ্ত। 'মায়ের মৃতু দিন' গল্পটাই যদি বিশ্লেষণ করি, জগদীশ গুপ্তের গল্পের জগত্ উদ্ভাসিত হবে।
কেশবলাল ও রামলাল দুই ভাই। গ্রামের বাড়িতে থাকে কেশবলাল। শহরে চাকরি করে রামলাল। কেশবলাল চরিত্রে একজন অর্থপিশাচ। তাদের মা মৃত্যুশয্যায়। মায়ের আছে অলংকারের একটি বাক্স। মা সেটা নিজের রুমে রাখে। কেশবলাল চাওয়া, মায়ের মৃত্য যেন রামলাল আসার আগেই হয়। তাহলে সে মায়ের গয়না আত্মসাত্ করতে পারে। এ জন্য যত নাটকীয় ও কদর্য কসরত করে কেশবলাল, তা যেমন নিষ্ঠুর, তেমনি মানুষ্য চরিত্রের গোপন কিন্তু আসল রূপ।
মায়ের মৃত্যদেহ উঠোনে রেখেই কেশবলাল মায়ের সম্পদ লুণ্ঠন করে এ জন্য যে, ছোট ভাই এসে পড়লে তাকে ভাগ দিতে হবে। জগদীশ গুপ্ত আমাদের চারপাশের কেশবলালদের গল্প লিখেছেন নির্মোহ ভঙ্গিতে, পাথরের কালিতে। প্রতিটি গল্প আমাদের হননের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
অনন্য সাহিত্যিক গল্পকার জগদীশ গুপ্ত আমাদের জমিনে, নিজের জমিনে প্রকাশিত হলেন। আগেই বলেছি, তাঁকে নতুন করে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন সম্পাদকদ্বয়। তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। 'জগদীশ গুপ্তের শ্রেষ্ঠ গল্প' গ্রন্থের সম্পাদকদ্বয় গল্পকার মনি হায়দার এবং প্রবন্ধকার ড. সরকার আবদুল মান্নানকে অভিনন্দন।
মনন প্রকাশ বইটি প্রকাশ করে মননশীল প্রকাশনা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। প্রায় চারশ পৃষ্ঠার বইটিতে কোথাও কোথাও যত্নের অভাব লক্ষ করা গেছে। বাঁধাই খুব ভালো নয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পাঠ্য জগদীশ গুপ্ত। সেটা লক্ষ করে আরও একটু যত্নবান হওয়া উচিত ছিল প্রকাশকের।
শিক্ষার্থীদের কথা মনে রেখে সম্পাদকদ্বয় গ্রন্থপঞ্জি ও পরিশিষ্ট সংযোজন করেছেন গ্রন্থের শেষে। তবে এটি মননশীল পাঠকদের জন্যও বাড়তি পাওনা। পরিশিষ্টে হাসান আজিজুল হকের 'জগদীশ গুপ্ত :কথাসাহিত্যে বিপরীত স্রোত' এবং সুবীর রায় চৌধুরীর 'জগদীশ গুপ্ত' নামে ভিন্নচিন্তা ও মননের দুটি লেখা সংযুক্ত করে আরও বলিষ্ঠ সম্পাদনার স্বাক্ষর রেখেছেন। বোঝা যায়, জগদীশ গুপ্তকে প্রামাণ্যকরণের চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখেননি সম্পাদকদ্বয়। বাংলা সাহিত্যের এই গুরুত্বপূর্ণ বইটি পাঠক পাঠ করবেন—আশা রাখি।
1 মন্তব্যসমূহ
পড়ে ভালো লাগলো। আরও জানার আগ্রহ রইল।
উত্তরমুছুন