------------------------------------------------------------------------------------------------------------
তিনি জনপ্রিয় কথাশিল্পী। শুরুতেই গল্প লিখে সাড়া ফেলেছিলেন। লিখেছেন ছোটো কাগজে। এখন বড় কাগজের অনিবার্য লেখক। সঙ্গ পেয়েছেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এবং মহাশ্বেতা দেবীর। আর আছেন তাঁর দাদা নাট্যজন মনোজ মিত্র। কিন্তু লিখছেন নিজের মত করেই। ধ্রুবপুত্র উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সর্বভারতীয় সাহিত্য-একাডেমি পুরস্কার। গল্পপাঠের সঙ্গে অমর মিত্র নিজের গল্পের ভুবন তিন দফায় জানিয়েছেন।--গল্পপাঠ
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
১. গল্প লিখতে শুরু করলেন কেন?
এখন আর মনে করতে পারব না কেন গল্প লিখতে শুরু করলাম। আমি নাটক লিখতে চেয়েছি আরম্ভে। চেখভের একটি গল্প নাট্যরূপ দিয়েছিলাম। কেউ কেউ ভাল বলেছিল। পরবরতী কালে আমি রেডিও ড্রামা লিখেছি নিজের গল্পের। টিভি স্ক্রিপ্ট করেছিলাম। কিন্তু গল্প লিখে যে আনন্দ পেয়েছি, এখনো পাই, তা আর কোথাও পাই না। নিজের কথা বলতে পারি। শুরুটা করেছি আপনাআপনি। এই করব ওই করব, থিয়েটার করব, নাটক লিখব করতে করতে গল্প।
আসলে আমাকে ১৯৭৪-এ চাকরি নিয়ে কলকাতার বাইরে দূর গ্রামে চলে যেতে হয়। সেই আরম্ভের দিনেও হয়তো এইটি একটি কারণ ছিল। একা থেকেছি অন্তঃগ্রামে, বন্ধু স্বজন বর্জিত সেই জীবন ছিল খুব মন খারাপের। আর বিস্ময়েরও। নিঃসঙ্গতা কাটাতে লেখা ছাড়া অন্য কোনো অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। অতি প্রত্যুষে ওঠার অভ্যাস সে গ্রাম বাস থেকে। কত সময় ছিল হাতে। সময় ব্যয় করতে কাগজ কলম নিয়ে বসা। সেই অভ্যাস চলছে। বিস্মিত হওয়ার নানা অনুষঙ্গ এখনো আছে। তাই লেখা থামেনি।
জীবনের নানা বিস্ময় আমাকে লিখিয়ে নেয়। তাই লিখি। লিখতে ভাল লাগে তাই লিখি। লিখলে জীবনকে সতেজ মনে হয় তাই লিখি। লিখতে বসে ভবিষ্যত নিয়ে নানা রকম ভাবতে পারি, তাই লিখি। আবার লিখতে বসলে বয়স কমে যায় তাই লিখি। লিখতে বসলে শৈশব ফিরে আসে, মা বাবা ভাই বোন, ঠাকুমা ঠাকুদ্দা নিয়ে গোটা একটা সংসার, তাই লিখি। ফিরে আসে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার (তখন শুধুই মেদিনীপুর) ডেবরা থানার লোয়াদা বলে একটি জনপদ। সেখানে কংসাবতী নদী পার হয়ে ঘন্টা দেড় হেঁটে করন্ডা নামের এক গ্রামে পৌঁছন। চাষাদের গ্রাম। খুব গরিব মানুষজন। আমি ভালবাসা পেয়েছি তাদের অনেকের। ভালবাসতে চেয়েছিও গাঁয়ের মানুষকে। আবার এই কারণে অপছন্দের মানুষও হয়েছিলাম চাশাভুসোর সঙ্গে বেশি মেলামেশার জন্য। সেই ভালবাসা থেকে তাদের কথা লিখতে চাওয়া।
১৯৭৪ সাল। একমাসে, এপ্রিলে দুটি গল্প লিখেছিলাম, মেলার দিকে ঘর ও পার্বতীর বোশেখ মাস। মনে হয়েছিল লিখতে পেরে যে আনন্দ তা আর কিছুতে নেই। তাই লেখা। এখন সব মনে পড়ে। জানি না কেন প্রথম দিন লিখতে শুরু করেছিলাম। না লিখে কেন তাসুড়েদের তাসের আড্ডায় গিয়ে বসিনি। সন্ধে থেকে জোর তাস খেলা সেই করন্ডা গ্রামে। আমি কেরোসিন ল্যাম্প নিয়ে ঘরের ভিতর। কাগজ কলম নিয়ে বসেছি। কেন তা জানি না, জানি না। হ্যাঁ, সেখানে বই আর লেখা ব্যতীত কিছুই উপায় ছিল না অতটা সকাল আর সন্ধে থেকে রাত দশটা পর্যন্ত অতটা সময়। তাই লিখতে বসলাম। আমি যে লিখতে পারলেও পারতে পারি, ওই দুটি গল্পের পর মনে হয়। আসলে জীবনের বিস্ময় তো লেখায়। আর লেখা হয়ে গেলেও নিজে কম বিস্মিত হই না। আমি তো এইভাবে ভাবি নি।
২.শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?
শুরুর কথাই তো বললাম। মেলার দিকে ঘর ছিল অভাবী পিতা আর তার বালিকা কন্যার এক দীর্ঘ যাত্রার। কন্যাকে বলা হয়েছে তাকে মেলা দেখাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সে কোনোদিন গ্রামের বাইরে যায় নি। সমস্ত গল্প ছিল তার বিস্ময়ের গল্প। এই যাত্রা ছিল আমার। নদীঘাট থেকে ৬ কিমি দূরে সেই গ্রামে অফিস। হাঁটতে হত। বালিকাটির ভিতরে আমিই ছিলাম। বালিকাটিকে দালালের হাতে তুলে দেবে বাবা। কংসাবতী নদীর বালুচরের ভিতর মেয়ের আতঙ্কের ডাকে গল্প তার অন্তিমে পৌঁছয়।
৩. গল্প লেখার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছেন? নিলে সেগুলো কেমন?
আমি পড়েছি অনেক। গল্পগুচ্ছ থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র, তিন বন্দ্যোপাধ্যায়, আর রুশ সাহিত্য। চেখভ আমার প্রিয় গল্পকার। চেখভ , প্রেমেন্দ্র মিত্র রবীন্দ্রনাথ আমার শিক্ষক। আরো অনেক লেখক আছেন। বাংলা গল্পের ভান্ডার খুব সমৃদ্ধ। গল্প লিখতে হলে গল্প পড়তে হয়। আমি যেমন হাংরির বাসুদেব দাশগুপ্তর অনুরাগী, শ্যামল মহাশ্বেতা, সন্দীপনেরও অনুরাগী। লেখা পড়তে পড়তেই আমি লিখতে শিখেছি।
৪. আপনার গল্পলেখার কৌশল বা ক্রাফট কি?
আমি তো ছক বেঁধে লিখি না। একটি ঝলক একটি বিন্দু থেকে গল্প শুরু করি, সে যেন এক অজানার দিকে যাত্রা শুরু হয়। তারপর গল্প হয় আবার হয় আবার হয়ও না। কিন্তু এইটিই আমার লেখার কৌশল। গল্পের ফর্ম পেলেই গল্প হয়। আর সেই ফরমের সঙ্গে আমার যাপিত জীবনের এক গভীর সম্পর্ক। যখন আমাকে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হত, সেইটাই ছিল গল্পের আঙ্গিক। মেলার দিকে ঘর, পার্বতীর বোশেখমাস, গাঁওবুড়ো, রাজকাহিনী, এইসব গল্প সেই পথ হাঁটার গল্প। পথের দুপাশ দেখার গল্প। আবার নির্মমতার গল্পও। আমি দানপত্র নামের দুটি গল্প লিখেছিলাম, সাফ কবলা, জমি হস্তান্তরের দলিল যেভাবে লেখা হয়, সেই ভাবে। আস্ত একট দলিল তা। লিখেছিলাম কেননা তখন দলিল নিয়ে কাজ করতাম। মনে হয়েছিল এইটিও একটি ফর্ম। মহাশ্বেতাদি এখনো ওই দুই দানপত্রের কথা বলেন।
৫. আপনার নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজের বিবেচনা কি কি?
নিজের গল্প নিয়ে কী বলব। লিখতে ভাল লাগে। লিখে এখনো আনন্দ পাই। স্তব্ধ হই আপাত না জানা অচেনাপ্রায় উপলব্ধিতে পৌঁছে।
৬. আপনার আদর্শ গল্পকার কে কে? কেনো তাঁদেরকে আদর্শ মনে করেন?
চেখভ প্রেমেন্দ্র মিত্র আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্প লেখক। কত পড়েছি, এখনো পড়ি। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, শ্যামল, সিরাজ, মহাশ্বেতা, হাসান আজিজুল হক, শহিদুল জহির আমায় স্তব্ধ করেন। হ্যঁ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তও খুব ভাল। আমার সময়ের স্বপ্নময়। আদর্শ আবার কী ? এঁরা আমাকে চুপ করিয়ে দেন। শহিদুল জহিরের ডলু নদীর হাওয়া অসম্ভব একটি বই। কী গল্প ! নমস্কার জানাই তাঁকে। তাঁর নাম এই বাংলায় তেমন পরিচিত নয়।
৭. গল্প থেকে কখন উপন্যাসে গেলেন?
১৯৭৮-এ আমি প্রথম উপন্যাস লিখি অমৃত পত্রিকায়। নদীর মানুষ। পরে পড়ে দেখেছি আমি অসম্পূর্ণ। কতগুলি চরিত্রের কথা আলাদা করে বলে শেষে একজায়গায় মেলাতে চেয়েছি। এরপর পাহাড়ের মতো মানুষ নামে একটি বড় উপন্যাস লিখি অমৃততে। সেই উপন্যাস বের হয় ১৯৭৯-র মধ্যভাগ থেকে। কোনোরকম প্রস্তুতি ব্যতীত সেই উপন্যাস লিখি। ওই উপন্যাসের আরম্ভেই ছিল সরকারী অফিসার তদন্তে নতুন জায়গায়। তাকে ডুলং নদী পার করে দেয় গাঁয়ের মানুষ কাঁধে চাপিয়ে। সে পৌঁছয় একটি রাজবাড়িতে। রাজত্ব বা জমিদারি নেই। তাদের বাড়িতেই জমির অফিস। লুকোন জমি উদ্ধারে এসেছে সেই অফিসার। অনেক বড় করে লিখতে চেয়েছিলাম। পরে বুঝেছি লেখার অনভিজ্ঞতায় আমি হয়তো পৌঁছতে পারি নি নিজের জায়গায়।
এরপর দুটি উপন্যাস লিখি। ভয় নামে একটি ছোট উপন্যাস, পরে তা আলোকবর্ষ নামে বই হয়। ঐ উপন্যাসটিতে আমি কিছুটা নিজের কথা নিজের অনুভূতিকে প্রকাশ করতে পেরেছিলাম। এরপর লিখি ভি,আই,পি রোড নামে একটি উপন্যাস। সেই লেখাটি থেকে উপন্যাসের দিকে প্রকৃত যাত্রা শুরু হয় যেন। আমার তাই মনে হয়। গল্পকে উপন্যাস বানিয়েছি কয়েকবার। কিন্তু তা উপন্যাসের চরিত্র থেকে আলাদা। এরপর আমাকে ১৯৯০-এ দেবেশ রায় প্রতিক্ষণে উপন্যাস লিখতে বলেন। লিখি ছোট একটি উপন্যাস হাঁসপাহাড়ি। সেই উপন্যাস থেকে ধীরে ধীরে আমি উপন্যাসের আলাদা লিখন যে গল্প থেকে তা বুঝতে পারি। এই সময়ে প্রতিক্ষণের আড্ডাটি আমার উপন্যাস রচনায় অনেক সাহায্য করেছিল।
হ্যাঁ, হাঁসপাহাড়ি লেখার আগে একটি উপন্যাস আমি লিখেছিলাম। সমাবেশ। ওই উপন্যাসেও আমি উপন্যাসকে গল্প থেকে আলাদা করতে পেরেছিলাম মনে হয়। সে এক খরাপীড়িত এলাকায় নদীর উৎসে মেলা বসানর কাহিনি। বাঁকুড়া জেলায় বসবাসের ৪টি বছর জলহীনতা আমি দেখেছিলাম। সেই নির্জলা পৃথিবীই আমার ভিতরে ধীরে ধীরে বড় কিছু করার কথা ভাবায়।
হাঁসপাহাড়িও সেই খরার কাহিনি। নির্দয় বৈশাখ। এই দুই উপন্যাস ছিল ধ্রুবপুত্র রচনার ভূমিকা। কয়েকবার উজ্জয়িনী গিয়েছি এমনিই, আত্মীয় গৃহে। মেঘদূত আমার অত্যন্ত প্রিয়। সেই মেঘদূতমের বিপরীত কিছু লেখার কথা মনে হয়েছিল খরা পীড়িত উজ্জয়িনীকে দেখে।এর জন্য সংস্কৃত সাহিত্য পড়েছি। প্রাচীন ভারতকে জেনেছি। কাহিনি আমার নিজের। এটি কোনো ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস নয়।
৮. এর জন্য কি আলাদা কোনো প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল?
আলাদা করে কোনো প্রস্তুতি নিইনি উপন্যাস লিখতে গিয়ে। সাহিত্যের সঙ্গে আর সাধারণ মানুষের সঙ্গে যাপিত জীবনই উপন্যাস লিখতে শিখিয়েছিল।
৯. গল্প এবং উপন্যাসকে কি করে আলাদা করেন?
গল্প জীবনের এক ক্ষুদ্র মুহূর্ত। এক আঁজলা জল। আর উপন্যাস সমুদ্র। তবে গল্পও অনেক সময় সমুদ্রের গভীরতা পায় না তাও তো নয়। উপন্যাস সমস্ত জীবন যেন। গল্প জীবনের কোনো কোনো অনুভূতি। গল্প ছক বেঁধে লিখতে পারি না। উপন্যাসও না সত্য, কিন্তু লিখতে লিখতে একটা পথ যেন দিয়ে দেয় উপন্যাস। হ্যাঁ আমি কিন্তু উপন্যাসও একটি চরিত্র বা এক পটভূমি, এক সামাজিক দুর্ঘটনা থেকে শুরু করি। তারপর সে নিজের মতো চলতে থাকে। আমি টের পাই আমার জীবনাভিজ্ঞতা তার ভিতরে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি উপন্যাসের শেষ নেই।
১০. বিচিত্র বিষয় নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। ধনপতির চর যখন লেখেন--তখন মনে হয় এ ধরনের জীবন অভিজ্ঞতার বাইরে হয় না। সে অভিজ্ঞতাটি আসলে কি?
বিচিত্র অভিজ্ঞতা কী তা জানি না। আমি একটা চিহ্ন ধরে উপন্যাসের দিকে এগোতে থাকি। কখনো তা পারি, কখনো পারি না। ধনপতির চরের জীবন কতটা দেখেছি কতটা দেখিনি তা কি বলতে পারি ? এতটা জীবন অনেক মানুষ দেখেছি, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গিয়েছি, থেকেছি। সেই সবের ফসল ওই উপন্যাস। আমি কল্পনায় বিশ্বাস করি। ধ্রুবপুত্র তাই, ধনপতির চরও সেই কল্পনা থেকে জন্মেছে। আমি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার উপকূল অঞ্চলে গিয়েছি কয়েকবার। প্রথম অভিজ্ঞতা সেই ৩৫-৩৬ বছর আগের।
এই উপকূলাঞ্চলের সমুদ্রে ছোট ছোট দ্বীপ, চর জাগে নদীতে। তা আমার অভিজ্ঞতায় ছিল। জম্বু দ্বীপ থেকে উৎখাত করা হয়েছিল মৎস্যজীবীদের। পরিবেশ ধংস করছে তারা, এই অভিযোগে। এই সব অঞ্চলে পর্তুগীজ, দিনেমার জলদস্যুরা এক সময় দাপিয়েছে। তাদের রক্ত এই অঞ্চলে রয়ে গেছে। প্রচুর খ্রিস্টান চাষা আছে এদিকে। খ্রিস্টান মৎস্যজীবী। ধনপতির চর আমার কল্পিত। ধনপতি পেদ্রু আমার কল্পিত। এর একটু সামান্য সূত্র সাঁওতাল জাতির সৃষ্টিতত্ব থেকে আহরণ করা। কাছিমের পিঠে চর জেগে আছে। এইটুকু। সাঁওতালি উপকথা বলে, পৃথিবীর ভার নিয়ে সমুদ্র মধ্যে ভেসে আছে একটি কাছিম। বাকি সবটাই আমার কল্পনা।
লেখার সময় আমি যাইনি ওই অঞ্চলে। আমি একটি পৃথিবী নির্মাণ করছি, আমি আমার মনের ভিতরে তা এঁকেছি। কেউ কেউ উপন্যাস রচনার জন্য ওই সব অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তথ্য জোগাড় করেছেন, লিখেছেন তারপর। আমি এই সবে বিশ্বাসী নই। সমস্তজীবন তাহলে কী দেখলাম? এই উপন্যাসের বীজ কীভাবে এল তা জানি না। তবে তখন এবং তার আগে জমি অধিগ্রহণ আমি দেখেছিলাম। মনে হয়েছিল তা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। রাষ্ট্র যদি চায়, কে তাকে রুখবে।
কাঁথাকানি নিয়ে এক বৃদ্ধা আমার কাছে এসে কেঁদে পড়েছিল, মনে আছে। তার ভিটে থেকে সবুজ ফসলে ভরা জমি নিয়ে গ্রামটির দখল নেওয়া হচ্ছিল। সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল, গ্রামটিকে নিয়ে যদি ওরা পালাতে পারত তবে রেহাই পেত। ধনপতির চর উপন্যাসে চর অধিগ্রহণ রুখতে ঘুমন্ত কাছিমকে জাগিয়ে তুলে ভেসে যায় চরের বাসিন্দারা কল্পিত লিঁসবোঁয়ার দিকে। আমি আমার এক স্বপ্ন নির্মাণ করেছি এই উপন্যাসে। স্বপ্নে পেয়েছিলাম হয়তো। উপন্যাস বই হয়ে বেরবার মাস ছয় বাদে আমি গিয়েছিলাম ওই অঞ্চলে লেখক বন্ধুদের সঙ্গে অবকাশ কাটাতে। যত যাই শিহরিত হই, যেমন আমি লিখেছি, এযে প্রায় সেই রকম। মনে হচ্ছিল ধনপতি পেদরুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে হয়তো।
১০. এক ধরনের ভাষাভঙ্গী ব্যবহার করেছেন উপন্যাসটিতে। পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে যায় স্রোতের মত। আবার ধ্রুব পুত্রে আপনার ভাষাটি গম্ভীর। একটু ধীর লয়ে এগোতে হয়। একটা এই সময়ের, আরেকটা পুরনো কালের। শব্দ আলাদা। ভঙ্গী আলাদা। বাক্য আলাদা। এই যে ভাষার ব্যবহারে নানাবিধ উপায় নিলেন--এটা কি জন্য নিলেন? কিভাবে নিলেন? এ জন্য আপনার কি ধরনের প্রস্তুতি নিতে হয়েছে?
পরিবেশ, পটভূমি বিষয় আর চরিত্র অনুযায়ী ভাষা বদলে যায়। তাইই গেছে। এর জন্য আলাদা করে কোনো প্রস্তুতি নিতে হয় নি। লিখন প্রক্রিয়ায় ভাষার জায়গাটি বড়। তা না মনোমত হলে লেখা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। ধ্রুবপুত্র ওই গদ্যভাষা না হলে লেখা হত না। ধনপতির চরও তাই।
১১. ধনপতির চরে লোক কবিতা ব্যবহার করেছেন। এগুলি সংগ্রহ করার বিষয়টি একটু বলেন।
ধনপতির চরে ব্যবহৃত লোক কবিতা আমার লেখা প্রায় সবকটি। ৫-৬টি প্রচলিত ছড়াও ব্যবহার করেছি।
১২. পদ্মানদীর মাঝির হোসেন মিয়ার ময়না দ্বীপের কথা কি কোনোভাবে ধনপতির চর লেখার সময়ে এসেছিল? ময়না দ্বীপের বিস্তারটি মানিক সেভাবে ঘটানটি। কিন্তু আপনার চরটির বিস্তারই উপন্যাসের সিংহভাগ। হোসেন মিয়া এবং পেদ্রু দুজনে দুদ্বীপের ঈশ্বর। কিন্তু দুরকম। এই পেদ্রু চরিত্রটি বাংলা উপন্যাসে নতুন। কিভাবে এই চরিত্রটি নির্মাণ করলেন?
না মনে আসেনি হোসেন মিঞার কথা। হোসেন মিঞা আর পেদরু আলাদা। হোসেন মিঞা উপনিবেশ গড়ছিল। অত্যাচারী ভূস্বামীর মতো হয়ে উঠেছিল। পেদরু তো তা নয়। পেদরুর পরিণতি ভাবুন। ১৯৯৫-৯৬-এ সাগরদ্বীপে টুরিস্ট সেন্টার গড়ে তোলার একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। ভাসমান মোটেল, নানা জনমনোরঞ্জনের ব্যবস্থার কথা ভাবা হয়েছিল। টুরিস্ট সেন্টার মানে গাঁয়ের মেয়েদের বেশ্যাবৃত্তির আয়োজন। দক্ষিণ ২৪পরগণা জেলা থেকে প্রতি বছর বহু কিশোরী, যুবতী মেয়ে ভারতদেশটির অন্ধকারে হারিয়ে যায়। সেই সব মাথায় ছিল এই উপন্যাস রচনার সময়। পেদ্রুকে আমি কোথাও দেখিনি যেমন, দেখেছিও সমস্ত জীবন ধরে গাঁয়ে-গঞ্জে, হাটে-মাঠে, নদীঘাটে, পুরুলিয়া বাঁকুড়া দক্ষিণ ২৪পরগণা—হেথাহোথা।
১৩. আপনার লেখায় নানা রকম বৃষ্টির দেখা মেলে। জলের হাহাকার বাজে। কেনো দাদা?
আমি জলের দেশের সন্তান। সাতক্ষীরে ছিল আমার পিতৃপুরুষের দেশ। আমি কলকাতায় কোনোদিন জলের কষ্ট দেখিনি, টালার জলাধারের পাশে আমার বাসস্থান। পশ্চিম মেদিনীপুর আর পরে বাঁকুড়ায় বসবাসের সময় দেখেছি জলের জন্য হাহাকার। খরা আর অনাবৃষ্টি। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা। গনগনে রোদে মানুষের মাথার গোলমাল হয়ে যেতেও দেখেছি যেন। বৃষ্টির জন্য আমিও তাদের হাহাকারে নিজেকে মিলিয়েছি। হাঁসপাহাড়ি, সমাবেশ আর সবশেষে ধ্রুবপুত্র সেই অভিজ্ঞতার ফসল। আর বৃষ্টির নানা চেহারা তো দেখেইছি।
১৪. ধনপতির চর পুরোটাই আপনার নির্মাণ। এখানে কিংবদন্তীর সঙ্গে ভূমি দখলের রাষ্ট্রীয় আখ্যানের নবায়ন করেছেন। আবার ধ্রুব পুত্র উপন্যাসে পুরোটাই আপনি পুরানকালের এক ধরনের অভিযাত্রার বয়ান করেছেন। সেখানে প্রাচীন ভারতের একটা প্রেক্ষাপটে বর্তমানের প্রতিবেশের সঙ্কট উপস্থাপিত হয়েছে। দুটো উপন্যাসের পটভুমি--১. একটি দ্বীপ। ২. একটি প্রাচীন নগর। কিন্তু অশ্বচরিত উপন্যাসে আপনি ভূগোলকে অতিক্রম করে গেছেন। পরিসরটা হয়েছে ভারত থেকে জাপানে। সেখানে সময়কে আপনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন নিপূন হাতে। একাল থেকে সেকালে। চরিত্র হয়েছে একালের এক পর্যটকের সঙ্গে সেকালের বুদ্ধের। এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার যাকে সোজা অর্থে যাদু-বাস্তব বলা যায়।
১৭. কার জন্য গল্প লেখেন? আপনি কি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখেন? লিখলে কেনো লেখেন? আর যদি পাঠকের কথা মনে না রেখে লেখেন তাহলে কেনো পাঠককে মনে রাখেন না লেখার সময়ে?
আমি প্রথমে আমার জন্য গল্প লিখি। শেষেও তাই। নিজেই টের পাই গল্প হয়েছে কি হয় নি। পাঠক পড়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানালে আমি ভাল মন্দ দুইই শুনি। নানা পাঠকের নানা রুচি। আমি কয়জনকে সন্তুষ্ট করব?
১৮.এখন কি লিখছেন?
কিছুই লিখছি না, পড়ছি। গল্প লিখতে আমার সময় লাগে ২-৩দিন। যদি ভিতর থেকে টান আসে, লিখব হয়তো।
১৯. আগামীতে কি লিখবেন?
কী লিখব আগামীতে তা ঈশ্বরও জানেন না। আমিও না। কোনদিন বিদ্যুচ্চমকের মতো গল্প আসতে চাইবে একটি বিন্দুর শরীর নিয়ে। তাকে সিন্ধু করে তুলতে হবে আমাকে।
----------------------------------------
৯ সেপ্টেম্বর এবং ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
জন্ম :৩০ আগস্ট, ১৯৫১।
বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কাছে ধুলিহর গ্রামে | বিজ্ঞানের ছাত্র | কর্ম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক দপ্তরে | তিনি ২০০৬ সালে ধ্রুবপুত্রউপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন।]
প্রকাশিত বই
পাহাড়ের মত মানুষ, অমর মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প, অর্ধেক রাত্রি, ডানা নেই উড়ে যায়, ধুলোগ্রাম, অশ্বচরিত, আগুনের গাড়ী, ধ্রুবপুত্র, নদীবসত, কৃষ্ণগহ্বর, আসনবনি, নিস্তব্দ নগর, প্রান্তরের অন্ধকার, ভি আই পি রোড, শ্যাম মিস্ত্রী কেমন ছিলেন, গজেন ভূঁইয়ার ফেরা, জনসমুদ্র, সবুজ রঙের শহর, সমাবেশ, সারিঘর, সুবর্ণরেখা, সোনাই ছিলো নদীর নাম, হাঁসপাহাড়ি।
পুরস্কার : সাহিত্য একাডেমী।
জীবনের নানা বিস্ময় আমাকে লিখিয়ে নেয়। তাই লিখি। লিখতে ভাল লাগে তাই লিখি। লিখলে জীবনকে সতেজ মনে হয় তাই লিখি। লিখতে বসে ভবিষ্যত নিয়ে নানা রকম ভাবতে পারি, তাই লিখি। আবার লিখতে বসলে বয়স কমে যায় তাই লিখি। লিখতে বসলে শৈশব ফিরে আসে, মা বাবা ভাই বোন, ঠাকুমা ঠাকুদ্দা নিয়ে গোটা একটা সংসার, তাই লিখি। ফিরে আসে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার (তখন শুধুই মেদিনীপুর) ডেবরা থানার লোয়াদা বলে একটি জনপদ। সেখানে কংসাবতী নদী পার হয়ে ঘন্টা দেড় হেঁটে করন্ডা নামের এক গ্রামে পৌঁছন। চাষাদের গ্রাম। খুব গরিব মানুষজন। আমি ভালবাসা পেয়েছি তাদের অনেকের। ভালবাসতে চেয়েছিও গাঁয়ের মানুষকে। আবার এই কারণে অপছন্দের মানুষও হয়েছিলাম চাশাভুসোর সঙ্গে বেশি মেলামেশার জন্য। সেই ভালবাসা থেকে তাদের কথা লিখতে চাওয়া।
১৯৭৪ সাল। একমাসে, এপ্রিলে দুটি গল্প লিখেছিলাম, মেলার দিকে ঘর ও পার্বতীর বোশেখ মাস। মনে হয়েছিল লিখতে পেরে যে আনন্দ তা আর কিছুতে নেই। তাই লেখা। এখন সব মনে পড়ে। জানি না কেন প্রথম দিন লিখতে শুরু করেছিলাম। না লিখে কেন তাসুড়েদের তাসের আড্ডায় গিয়ে বসিনি। সন্ধে থেকে জোর তাস খেলা সেই করন্ডা গ্রামে। আমি কেরোসিন ল্যাম্প নিয়ে ঘরের ভিতর। কাগজ কলম নিয়ে বসেছি। কেন তা জানি না, জানি না। হ্যাঁ, সেখানে বই আর লেখা ব্যতীত কিছুই উপায় ছিল না অতটা সকাল আর সন্ধে থেকে রাত দশটা পর্যন্ত অতটা সময়। তাই লিখতে বসলাম। আমি যে লিখতে পারলেও পারতে পারি, ওই দুটি গল্পের পর মনে হয়। আসলে জীবনের বিস্ময় তো লেখায়। আর লেখা হয়ে গেলেও নিজে কম বিস্মিত হই না। আমি তো এইভাবে ভাবি নি।
২.শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?
শুরুর কথাই তো বললাম। মেলার দিকে ঘর ছিল অভাবী পিতা আর তার বালিকা কন্যার এক দীর্ঘ যাত্রার। কন্যাকে বলা হয়েছে তাকে মেলা দেখাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সে কোনোদিন গ্রামের বাইরে যায় নি। সমস্ত গল্প ছিল তার বিস্ময়ের গল্প। এই যাত্রা ছিল আমার। নদীঘাট থেকে ৬ কিমি দূরে সেই গ্রামে অফিস। হাঁটতে হত। বালিকাটির ভিতরে আমিই ছিলাম। বালিকাটিকে দালালের হাতে তুলে দেবে বাবা। কংসাবতী নদীর বালুচরের ভিতর মেয়ের আতঙ্কের ডাকে গল্প তার অন্তিমে পৌঁছয়।
৩. গল্প লেখার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছেন? নিলে সেগুলো কেমন?
আমি পড়েছি অনেক। গল্পগুচ্ছ থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র, তিন বন্দ্যোপাধ্যায়, আর রুশ সাহিত্য। চেখভ আমার প্রিয় গল্পকার। চেখভ , প্রেমেন্দ্র মিত্র রবীন্দ্রনাথ আমার শিক্ষক। আরো অনেক লেখক আছেন। বাংলা গল্পের ভান্ডার খুব সমৃদ্ধ। গল্প লিখতে হলে গল্প পড়তে হয়। আমি যেমন হাংরির বাসুদেব দাশগুপ্তর অনুরাগী, শ্যামল মহাশ্বেতা, সন্দীপনেরও অনুরাগী। লেখা পড়তে পড়তেই আমি লিখতে শিখেছি।
৪. আপনার গল্পলেখার কৌশল বা ক্রাফট কি?
আমি তো ছক বেঁধে লিখি না। একটি ঝলক একটি বিন্দু থেকে গল্প শুরু করি, সে যেন এক অজানার দিকে যাত্রা শুরু হয়। তারপর গল্প হয় আবার হয় আবার হয়ও না। কিন্তু এইটিই আমার লেখার কৌশল। গল্পের ফর্ম পেলেই গল্প হয়। আর সেই ফরমের সঙ্গে আমার যাপিত জীবনের এক গভীর সম্পর্ক। যখন আমাকে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হত, সেইটাই ছিল গল্পের আঙ্গিক। মেলার দিকে ঘর, পার্বতীর বোশেখমাস, গাঁওবুড়ো, রাজকাহিনী, এইসব গল্প সেই পথ হাঁটার গল্প। পথের দুপাশ দেখার গল্প। আবার নির্মমতার গল্পও। আমি দানপত্র নামের দুটি গল্প লিখেছিলাম, সাফ কবলা, জমি হস্তান্তরের দলিল যেভাবে লেখা হয়, সেই ভাবে। আস্ত একট দলিল তা। লিখেছিলাম কেননা তখন দলিল নিয়ে কাজ করতাম। মনে হয়েছিল এইটিও একটি ফর্ম। মহাশ্বেতাদি এখনো ওই দুই দানপত্রের কথা বলেন।
৫. আপনার নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজের বিবেচনা কি কি?
নিজের গল্প নিয়ে কী বলব। লিখতে ভাল লাগে। লিখে এখনো আনন্দ পাই। স্তব্ধ হই আপাত না জানা অচেনাপ্রায় উপলব্ধিতে পৌঁছে।
৬. আপনার আদর্শ গল্পকার কে কে? কেনো তাঁদেরকে আদর্শ মনে করেন?
চেখভ প্রেমেন্দ্র মিত্র আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্প লেখক। কত পড়েছি, এখনো পড়ি। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, শ্যামল, সিরাজ, মহাশ্বেতা, হাসান আজিজুল হক, শহিদুল জহির আমায় স্তব্ধ করেন। হ্যঁ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তও খুব ভাল। আমার সময়ের স্বপ্নময়। আদর্শ আবার কী ? এঁরা আমাকে চুপ করিয়ে দেন। শহিদুল জহিরের ডলু নদীর হাওয়া অসম্ভব একটি বই। কী গল্প ! নমস্কার জানাই তাঁকে। তাঁর নাম এই বাংলায় তেমন পরিচিত নয়।
৭. গল্প থেকে কখন উপন্যাসে গেলেন?
১৯৭৮-এ আমি প্রথম উপন্যাস লিখি অমৃত পত্রিকায়। নদীর মানুষ। পরে পড়ে দেখেছি আমি অসম্পূর্ণ। কতগুলি চরিত্রের কথা আলাদা করে বলে শেষে একজায়গায় মেলাতে চেয়েছি। এরপর পাহাড়ের মতো মানুষ নামে একটি বড় উপন্যাস লিখি অমৃততে। সেই উপন্যাস বের হয় ১৯৭৯-র মধ্যভাগ থেকে। কোনোরকম প্রস্তুতি ব্যতীত সেই উপন্যাস লিখি। ওই উপন্যাসের আরম্ভেই ছিল সরকারী অফিসার তদন্তে নতুন জায়গায়। তাকে ডুলং নদী পার করে দেয় গাঁয়ের মানুষ কাঁধে চাপিয়ে। সে পৌঁছয় একটি রাজবাড়িতে। রাজত্ব বা জমিদারি নেই। তাদের বাড়িতেই জমির অফিস। লুকোন জমি উদ্ধারে এসেছে সেই অফিসার। অনেক বড় করে লিখতে চেয়েছিলাম। পরে বুঝেছি লেখার অনভিজ্ঞতায় আমি হয়তো পৌঁছতে পারি নি নিজের জায়গায়।
এরপর দুটি উপন্যাস লিখি। ভয় নামে একটি ছোট উপন্যাস, পরে তা আলোকবর্ষ নামে বই হয়। ঐ উপন্যাসটিতে আমি কিছুটা নিজের কথা নিজের অনুভূতিকে প্রকাশ করতে পেরেছিলাম। এরপর লিখি ভি,আই,পি রোড নামে একটি উপন্যাস। সেই লেখাটি থেকে উপন্যাসের দিকে প্রকৃত যাত্রা শুরু হয় যেন। আমার তাই মনে হয়। গল্পকে উপন্যাস বানিয়েছি কয়েকবার। কিন্তু তা উপন্যাসের চরিত্র থেকে আলাদা। এরপর আমাকে ১৯৯০-এ দেবেশ রায় প্রতিক্ষণে উপন্যাস লিখতে বলেন। লিখি ছোট একটি উপন্যাস হাঁসপাহাড়ি। সেই উপন্যাস থেকে ধীরে ধীরে আমি উপন্যাসের আলাদা লিখন যে গল্প থেকে তা বুঝতে পারি। এই সময়ে প্রতিক্ষণের আড্ডাটি আমার উপন্যাস রচনায় অনেক সাহায্য করেছিল।
হ্যাঁ, হাঁসপাহাড়ি লেখার আগে একটি উপন্যাস আমি লিখেছিলাম। সমাবেশ। ওই উপন্যাসেও আমি উপন্যাসকে গল্প থেকে আলাদা করতে পেরেছিলাম মনে হয়। সে এক খরাপীড়িত এলাকায় নদীর উৎসে মেলা বসানর কাহিনি। বাঁকুড়া জেলায় বসবাসের ৪টি বছর জলহীনতা আমি দেখেছিলাম। সেই নির্জলা পৃথিবীই আমার ভিতরে ধীরে ধীরে বড় কিছু করার কথা ভাবায়।
হাঁসপাহাড়িও সেই খরার কাহিনি। নির্দয় বৈশাখ। এই দুই উপন্যাস ছিল ধ্রুবপুত্র রচনার ভূমিকা। কয়েকবার উজ্জয়িনী গিয়েছি এমনিই, আত্মীয় গৃহে। মেঘদূত আমার অত্যন্ত প্রিয়। সেই মেঘদূতমের বিপরীত কিছু লেখার কথা মনে হয়েছিল খরা পীড়িত উজ্জয়িনীকে দেখে।এর জন্য সংস্কৃত সাহিত্য পড়েছি। প্রাচীন ভারতকে জেনেছি। কাহিনি আমার নিজের। এটি কোনো ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস নয়।
৮. এর জন্য কি আলাদা কোনো প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল?
আলাদা করে কোনো প্রস্তুতি নিইনি উপন্যাস লিখতে গিয়ে। সাহিত্যের সঙ্গে আর সাধারণ মানুষের সঙ্গে যাপিত জীবনই উপন্যাস লিখতে শিখিয়েছিল।
৯. গল্প এবং উপন্যাসকে কি করে আলাদা করেন?
গল্প জীবনের এক ক্ষুদ্র মুহূর্ত। এক আঁজলা জল। আর উপন্যাস সমুদ্র। তবে গল্পও অনেক সময় সমুদ্রের গভীরতা পায় না তাও তো নয়। উপন্যাস সমস্ত জীবন যেন। গল্প জীবনের কোনো কোনো অনুভূতি। গল্প ছক বেঁধে লিখতে পারি না। উপন্যাসও না সত্য, কিন্তু লিখতে লিখতে একটা পথ যেন দিয়ে দেয় উপন্যাস। হ্যাঁ আমি কিন্তু উপন্যাসও একটি চরিত্র বা এক পটভূমি, এক সামাজিক দুর্ঘটনা থেকে শুরু করি। তারপর সে নিজের মতো চলতে থাকে। আমি টের পাই আমার জীবনাভিজ্ঞতা তার ভিতরে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি উপন্যাসের শেষ নেই।
১০. বিচিত্র বিষয় নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। ধনপতির চর যখন লেখেন--তখন মনে হয় এ ধরনের জীবন অভিজ্ঞতার বাইরে হয় না। সে অভিজ্ঞতাটি আসলে কি?
বিচিত্র অভিজ্ঞতা কী তা জানি না। আমি একটা চিহ্ন ধরে উপন্যাসের দিকে এগোতে থাকি। কখনো তা পারি, কখনো পারি না। ধনপতির চরের জীবন কতটা দেখেছি কতটা দেখিনি তা কি বলতে পারি ? এতটা জীবন অনেক মানুষ দেখেছি, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গিয়েছি, থেকেছি। সেই সবের ফসল ওই উপন্যাস। আমি কল্পনায় বিশ্বাস করি। ধ্রুবপুত্র তাই, ধনপতির চরও সেই কল্পনা থেকে জন্মেছে। আমি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার উপকূল অঞ্চলে গিয়েছি কয়েকবার। প্রথম অভিজ্ঞতা সেই ৩৫-৩৬ বছর আগের।
এই উপকূলাঞ্চলের সমুদ্রে ছোট ছোট দ্বীপ, চর জাগে নদীতে। তা আমার অভিজ্ঞতায় ছিল। জম্বু দ্বীপ থেকে উৎখাত করা হয়েছিল মৎস্যজীবীদের। পরিবেশ ধংস করছে তারা, এই অভিযোগে। এই সব অঞ্চলে পর্তুগীজ, দিনেমার জলদস্যুরা এক সময় দাপিয়েছে। তাদের রক্ত এই অঞ্চলে রয়ে গেছে। প্রচুর খ্রিস্টান চাষা আছে এদিকে। খ্রিস্টান মৎস্যজীবী। ধনপতির চর আমার কল্পিত। ধনপতি পেদ্রু আমার কল্পিত। এর একটু সামান্য সূত্র সাঁওতাল জাতির সৃষ্টিতত্ব থেকে আহরণ করা। কাছিমের পিঠে চর জেগে আছে। এইটুকু। সাঁওতালি উপকথা বলে, পৃথিবীর ভার নিয়ে সমুদ্র মধ্যে ভেসে আছে একটি কাছিম। বাকি সবটাই আমার কল্পনা।
লেখার সময় আমি যাইনি ওই অঞ্চলে। আমি একটি পৃথিবী নির্মাণ করছি, আমি আমার মনের ভিতরে তা এঁকেছি। কেউ কেউ উপন্যাস রচনার জন্য ওই সব অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তথ্য জোগাড় করেছেন, লিখেছেন তারপর। আমি এই সবে বিশ্বাসী নই। সমস্তজীবন তাহলে কী দেখলাম? এই উপন্যাসের বীজ কীভাবে এল তা জানি না। তবে তখন এবং তার আগে জমি অধিগ্রহণ আমি দেখেছিলাম। মনে হয়েছিল তা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। রাষ্ট্র যদি চায়, কে তাকে রুখবে।
কাঁথাকানি নিয়ে এক বৃদ্ধা আমার কাছে এসে কেঁদে পড়েছিল, মনে আছে। তার ভিটে থেকে সবুজ ফসলে ভরা জমি নিয়ে গ্রামটির দখল নেওয়া হচ্ছিল। সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল, গ্রামটিকে নিয়ে যদি ওরা পালাতে পারত তবে রেহাই পেত। ধনপতির চর উপন্যাসে চর অধিগ্রহণ রুখতে ঘুমন্ত কাছিমকে জাগিয়ে তুলে ভেসে যায় চরের বাসিন্দারা কল্পিত লিঁসবোঁয়ার দিকে। আমি আমার এক স্বপ্ন নির্মাণ করেছি এই উপন্যাসে। স্বপ্নে পেয়েছিলাম হয়তো। উপন্যাস বই হয়ে বেরবার মাস ছয় বাদে আমি গিয়েছিলাম ওই অঞ্চলে লেখক বন্ধুদের সঙ্গে অবকাশ কাটাতে। যত যাই শিহরিত হই, যেমন আমি লিখেছি, এযে প্রায় সেই রকম। মনে হচ্ছিল ধনপতি পেদরুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে হয়তো।
১০. এক ধরনের ভাষাভঙ্গী ব্যবহার করেছেন উপন্যাসটিতে। পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে যায় স্রোতের মত। আবার ধ্রুব পুত্রে আপনার ভাষাটি গম্ভীর। একটু ধীর লয়ে এগোতে হয়। একটা এই সময়ের, আরেকটা পুরনো কালের। শব্দ আলাদা। ভঙ্গী আলাদা। বাক্য আলাদা। এই যে ভাষার ব্যবহারে নানাবিধ উপায় নিলেন--এটা কি জন্য নিলেন? কিভাবে নিলেন? এ জন্য আপনার কি ধরনের প্রস্তুতি নিতে হয়েছে?
পরিবেশ, পটভূমি বিষয় আর চরিত্র অনুযায়ী ভাষা বদলে যায়। তাইই গেছে। এর জন্য আলাদা করে কোনো প্রস্তুতি নিতে হয় নি। লিখন প্রক্রিয়ায় ভাষার জায়গাটি বড়। তা না মনোমত হলে লেখা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। ধ্রুবপুত্র ওই গদ্যভাষা না হলে লেখা হত না। ধনপতির চরও তাই।
১১. ধনপতির চরে লোক কবিতা ব্যবহার করেছেন। এগুলি সংগ্রহ করার বিষয়টি একটু বলেন।
ধনপতির চরে ব্যবহৃত লোক কবিতা আমার লেখা প্রায় সবকটি। ৫-৬টি প্রচলিত ছড়াও ব্যবহার করেছি।
১২. পদ্মানদীর মাঝির হোসেন মিয়ার ময়না দ্বীপের কথা কি কোনোভাবে ধনপতির চর লেখার সময়ে এসেছিল? ময়না দ্বীপের বিস্তারটি মানিক সেভাবে ঘটানটি। কিন্তু আপনার চরটির বিস্তারই উপন্যাসের সিংহভাগ। হোসেন মিয়া এবং পেদ্রু দুজনে দুদ্বীপের ঈশ্বর। কিন্তু দুরকম। এই পেদ্রু চরিত্রটি বাংলা উপন্যাসে নতুন। কিভাবে এই চরিত্রটি নির্মাণ করলেন?
না মনে আসেনি হোসেন মিঞার কথা। হোসেন মিঞা আর পেদরু আলাদা। হোসেন মিঞা উপনিবেশ গড়ছিল। অত্যাচারী ভূস্বামীর মতো হয়ে উঠেছিল। পেদরু তো তা নয়। পেদরুর পরিণতি ভাবুন। ১৯৯৫-৯৬-এ সাগরদ্বীপে টুরিস্ট সেন্টার গড়ে তোলার একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। ভাসমান মোটেল, নানা জনমনোরঞ্জনের ব্যবস্থার কথা ভাবা হয়েছিল। টুরিস্ট সেন্টার মানে গাঁয়ের মেয়েদের বেশ্যাবৃত্তির আয়োজন। দক্ষিণ ২৪পরগণা জেলা থেকে প্রতি বছর বহু কিশোরী, যুবতী মেয়ে ভারতদেশটির অন্ধকারে হারিয়ে যায়। সেই সব মাথায় ছিল এই উপন্যাস রচনার সময়। পেদ্রুকে আমি কোথাও দেখিনি যেমন, দেখেছিও সমস্ত জীবন ধরে গাঁয়ে-গঞ্জে, হাটে-মাঠে, নদীঘাটে, পুরুলিয়া বাঁকুড়া দক্ষিণ ২৪পরগণা—হেথাহোথা।
১৩. আপনার লেখায় নানা রকম বৃষ্টির দেখা মেলে। জলের হাহাকার বাজে। কেনো দাদা?
আমি জলের দেশের সন্তান। সাতক্ষীরে ছিল আমার পিতৃপুরুষের দেশ। আমি কলকাতায় কোনোদিন জলের কষ্ট দেখিনি, টালার জলাধারের পাশে আমার বাসস্থান। পশ্চিম মেদিনীপুর আর পরে বাঁকুড়ায় বসবাসের সময় দেখেছি জলের জন্য হাহাকার। খরা আর অনাবৃষ্টি। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা। গনগনে রোদে মানুষের মাথার গোলমাল হয়ে যেতেও দেখেছি যেন। বৃষ্টির জন্য আমিও তাদের হাহাকারে নিজেকে মিলিয়েছি। হাঁসপাহাড়ি, সমাবেশ আর সবশেষে ধ্রুবপুত্র সেই অভিজ্ঞতার ফসল। আর বৃষ্টির নানা চেহারা তো দেখেইছি।
১৪. ধনপতির চর পুরোটাই আপনার নির্মাণ। এখানে কিংবদন্তীর সঙ্গে ভূমি দখলের রাষ্ট্রীয় আখ্যানের নবায়ন করেছেন। আবার ধ্রুব পুত্র উপন্যাসে পুরোটাই আপনি পুরানকালের এক ধরনের অভিযাত্রার বয়ান করেছেন। সেখানে প্রাচীন ভারতের একটা প্রেক্ষাপটে বর্তমানের প্রতিবেশের সঙ্কট উপস্থাপিত হয়েছে। দুটো উপন্যাসের পটভুমি--১. একটি দ্বীপ। ২. একটি প্রাচীন নগর। কিন্তু অশ্বচরিত উপন্যাসে আপনি ভূগোলকে অতিক্রম করে গেছেন। পরিসরটা হয়েছে ভারত থেকে জাপানে। সেখানে সময়কে আপনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন নিপূন হাতে। একাল থেকে সেকালে। চরিত্র হয়েছে একালের এক পর্যটকের সঙ্গে সেকালের বুদ্ধের। এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার যাকে সোজা অর্থে যাদু-বাস্তব বলা যায়।
এই অশ্বচরিত লেখার বৃত্তান্তটা একটু বলুন।
ধনপতির চর বা ধ্রুবপুত্রের সঙ্গে অশ্বচরিতের একটা সাযুজ্য আছে। তিনটি উপন্যাসই নিরুদ্দিষ্টের
কাহিনি। এদের পরেও আমি এক নিরুদ্দিষ্টের কাহিনি লিখেছি, নিরুদ্দিষ্টের
উপাখ্যান। ধনপতির চরে তো দ্বীপটিই নিরুদ্দেশে যায়। ধ্রুবপুত্রে কবি। আর অশ্বচরিতে
বুদ্ধের অশ্ব কন্থক। নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান উপন্যাসটিতে পুলিশ নিরুদ্দেশে পাঠায়
কারখানার শ্রমিককে। সবকটি উপন্যাসেই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসই মূল উপজীব্য। আসলে বোধ হয়
আমরা সারাজীবন ধরে একটিই উপন্যাস লিখি।
অশ্বচরিতের মূল বয়ান আমি লিখি ১৯৮১র মাঝামাঝি। তখন আমি বিভ্রমের এই কাহিনি লিখেছিলাম সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত শিলাদিত্য পত্রিকায়। সেখানে নিরুদ্দিষ্ট ঘোড়াটির কাহিনি লিখেছিলাম। সে এক বিভ্রমে পড়ে মৃত্যুর দিকে ছুটে যায়। তারপর আমার লেখাটি পড়েই ছিল। বই করিনি। নিজেই বুঝতে পারছিলাম আমার ভিতরে আরো লেখা আছে। আমি তা বের করে আনতে পারছি না।
১৯৯৮-এ রাজস্থানের মরুভূমিতে পরমানু বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় আমাদের সরকার। আর তার খবর দিল্লিতে আসে ‘‘বুদ্ধ হেসেছেন’’ এই বাক্যে। তখন আমি ধ্রুবপুত্র লিখছি। পড়ছি সংস্কৃত সাহিত্য। রাজস্থানে বিস্ফোরণের পরদিন আমি তাড়িত হয়ে সেই পলাতক ঘোড়ার কাহিনি আবার লিখতে আরম্ভ করি। আর এই বিষয় নিয়ে দেবেশ রায়ের সঙ্গে একদিন আলাপে তিনি বুদ্ধ চরিত পড়ার কথা বলেছিলেন। আমি বুদ্ধ চরিত খুলতেই কন্থক আর ছন্দককে পেয়ে যাই সেই রুগ্ন টাট্টু ঘোড়া আর তার পরিচর্যাকারী ভানুর ভিতরে। ভানু আর সেই ঘোড়া আর হোটেলওয়ালাকে আমি চিনতাম। তাদের সঙ্গে একটি বছর যাপন করেছিলাম আমার দিন। আমি ওই সমুদ্রতীরে ছিলাম একবছর।
আমি যাদু বাস্তবতা জানি না। আমার উপন্যাসে যে তা আছে তাও বুঝিনি। তার বিভ্রমের কাহিনিটি তো ১৯৮১-র মাঝামাঝি লেখা, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২-র ফেব্রুয়ারিতে। এই উপন্যাসে যাদু বাস্তবতার কথা প্রথম বলেছিলেন শ্রদ্ধেয় পবিত্র সরকার উপন্যাস নিয়ে এক কথোপকথনে। আমি তো অবাক। আমি ফ্যান্টাসির ভিতরে পরিভ্রমণ করতে ভালবাসি। কল্পনার জগত খুলতে চাই। একেই কি যাদু বাস্তবতা বলে, আমি জানি না। আসলে প্রকৃতিই সবচেয়ে বড় যাদুকর। আমি প্রকৃতির ভিতরে ছিলাম তখন। প্রকৃতিই লিখিয়ে নিয়েছে এই উপন্যাস। ভানুর কথা আর ঘোড়াটির কথা খুব মনে পড়ে এখন। ওরাই আমাকে যাদু করেছিল। ভানুর সঙ্গে ওই পলাতক অশ্বকে খুঁজতে গিয়েছি আমি কতদিন।
অশ্বচরিতের মূল বয়ান আমি লিখি ১৯৮১র মাঝামাঝি। তখন আমি বিভ্রমের এই কাহিনি লিখেছিলাম সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত শিলাদিত্য পত্রিকায়। সেখানে নিরুদ্দিষ্ট ঘোড়াটির কাহিনি লিখেছিলাম। সে এক বিভ্রমে পড়ে মৃত্যুর দিকে ছুটে যায়। তারপর আমার লেখাটি পড়েই ছিল। বই করিনি। নিজেই বুঝতে পারছিলাম আমার ভিতরে আরো লেখা আছে। আমি তা বের করে আনতে পারছি না।
১৯৯৮-এ রাজস্থানের মরুভূমিতে পরমানু বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় আমাদের সরকার। আর তার খবর দিল্লিতে আসে ‘‘বুদ্ধ হেসেছেন’’ এই বাক্যে। তখন আমি ধ্রুবপুত্র লিখছি। পড়ছি সংস্কৃত সাহিত্য। রাজস্থানে বিস্ফোরণের পরদিন আমি তাড়িত হয়ে সেই পলাতক ঘোড়ার কাহিনি আবার লিখতে আরম্ভ করি। আর এই বিষয় নিয়ে দেবেশ রায়ের সঙ্গে একদিন আলাপে তিনি বুদ্ধ চরিত পড়ার কথা বলেছিলেন। আমি বুদ্ধ চরিত খুলতেই কন্থক আর ছন্দককে পেয়ে যাই সেই রুগ্ন টাট্টু ঘোড়া আর তার পরিচর্যাকারী ভানুর ভিতরে। ভানু আর সেই ঘোড়া আর হোটেলওয়ালাকে আমি চিনতাম। তাদের সঙ্গে একটি বছর যাপন করেছিলাম আমার দিন। আমি ওই সমুদ্রতীরে ছিলাম একবছর।
আমি যাদু বাস্তবতা জানি না। আমার উপন্যাসে যে তা আছে তাও বুঝিনি। তার বিভ্রমের কাহিনিটি তো ১৯৮১-র মাঝামাঝি লেখা, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২-র ফেব্রুয়ারিতে। এই উপন্যাসে যাদু বাস্তবতার কথা প্রথম বলেছিলেন শ্রদ্ধেয় পবিত্র সরকার উপন্যাস নিয়ে এক কথোপকথনে। আমি তো অবাক। আমি ফ্যান্টাসির ভিতরে পরিভ্রমণ করতে ভালবাসি। কল্পনার জগত খুলতে চাই। একেই কি যাদু বাস্তবতা বলে, আমি জানি না। আসলে প্রকৃতিই সবচেয়ে বড় যাদুকর। আমি প্রকৃতির ভিতরে ছিলাম তখন। প্রকৃতিই লিখিয়ে নিয়েছে এই উপন্যাস। ভানুর কথা আর ঘোড়াটির কথা খুব মনে পড়ে এখন। ওরাই আমাকে যাদু করেছিল। ভানুর সঙ্গে ওই পলাতক অশ্বকে খুঁজতে গিয়েছি আমি কতদিন।
১৫. অশ্বচরিত কিভাবে লিখলেন?
মূল বয়ান ১৯৮১-তে লেখা যে হয় তা তো বললাম। এরপর ১৯৮৮ নাগাদ একবার পুনর্লিখন করেছিলাম। সেই পান্ডুলিপি হারিয়ে যায় এক প্রকাশকের ঘর থেকে। ভাগ্যিস হারিয়েছিল। ১৯৯৮-এ পরমাণু বিস্ফোরণের পর আমি ঘোরের ভিতরে থেকে মাস তিনেকে উপন্যাসটি লিখি। তার আগে মনে হত ওই ঘোড়ার কাহিনিটি আমার থেকে হারিয়ে গেছে চিরতরে। আসলে কিছুই হারায় না। কোথাও না কোথাও তা থেকে যায়। তাইই ছিল।
১৬. এ ধরনের যাদু-বাস্তব উপন্যাস লেখার পরে লেখক-পাঠকদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
এই উপন্যাসটি আমার পাঠক নিয়েছিল মনে হয়। কল্যাণী নাট্যচর্চা পাঠক নিয়েছিল মনে হয়। অনেকে ব্যাক্তিগত ভাবে আমাকে জানিয়েছিল। অনেক মূল্যায়ন প্রকাশিত হয়েছিল। রিভিউ। অশ্বচরিতকে মঞ্চে এনেছিল কল্যানী নাট্ট্যচর্চা কেন্দ্র।
মূল বয়ান ১৯৮১-তে লেখা যে হয় তা তো বললাম। এরপর ১৯৮৮ নাগাদ একবার পুনর্লিখন করেছিলাম। সেই পান্ডুলিপি হারিয়ে যায় এক প্রকাশকের ঘর থেকে। ভাগ্যিস হারিয়েছিল। ১৯৯৮-এ পরমাণু বিস্ফোরণের পর আমি ঘোরের ভিতরে থেকে মাস তিনেকে উপন্যাসটি লিখি। তার আগে মনে হত ওই ঘোড়ার কাহিনিটি আমার থেকে হারিয়ে গেছে চিরতরে। আসলে কিছুই হারায় না। কোথাও না কোথাও তা থেকে যায়। তাইই ছিল।
১৬. এ ধরনের যাদু-বাস্তব উপন্যাস লেখার পরে লেখক-পাঠকদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
এই উপন্যাসটি আমার পাঠক নিয়েছিল মনে হয়। কল্যাণী নাট্যচর্চা পাঠক নিয়েছিল মনে হয়। অনেকে ব্যাক্তিগত ভাবে আমাকে জানিয়েছিল। অনেক মূল্যায়ন প্রকাশিত হয়েছিল। রিভিউ। অশ্বচরিতকে মঞ্চে এনেছিল কল্যানী নাট্ট্যচর্চা কেন্দ্র।
১৭. কার জন্য গল্প লেখেন? আপনি কি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখেন? লিখলে কেনো লেখেন? আর যদি পাঠকের কথা মনে না রেখে লেখেন তাহলে কেনো পাঠককে মনে রাখেন না লেখার সময়ে?
আমি প্রথমে আমার জন্য গল্প লিখি। শেষেও তাই। নিজেই টের পাই গল্প হয়েছে কি হয় নি। পাঠক পড়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানালে আমি ভাল মন্দ দুইই শুনি। নানা পাঠকের নানা রুচি। আমি কয়জনকে সন্তুষ্ট করব?
১৮.এখন কি লিখছেন?
কিছুই লিখছি না, পড়ছি। গল্প লিখতে আমার সময় লাগে ২-৩দিন। যদি ভিতর থেকে টান আসে, লিখব হয়তো।
১৯. আগামীতে কি লিখবেন?
কী লিখব আগামীতে তা ঈশ্বরও জানেন না। আমিও না। কোনদিন বিদ্যুচ্চমকের মতো গল্প আসতে চাইবে একটি বিন্দুর শরীর নিয়ে। তাকে সিন্ধু করে তুলতে হবে আমাকে।
----------------------------------------
৯ সেপ্টেম্বর এবং ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কাছে ধুলিহর গ্রামে | বিজ্ঞানের ছাত্র | কর্ম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক দপ্তরে | তিনি ২০০৬ সালে ধ্রুবপুত্রউপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন।]
প্রকাশিত বই
পাহাড়ের মত মানুষ, অমর মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প, অর্ধেক রাত্রি, ডানা নেই উড়ে যায়, ধুলোগ্রাম, অশ্বচরিত, আগুনের গাড়ী, ধ্রুবপুত্র, নদীবসত, কৃষ্ণগহ্বর, আসনবনি, নিস্তব্দ নগর, প্রান্তরের অন্ধকার, ভি আই পি রোড, শ্যাম মিস্ত্রী কেমন ছিলেন, গজেন ভূঁইয়ার ফেরা, জনসমুদ্র, সবুজ রঙের শহর, সমাবেশ, সারিঘর, সুবর্ণরেখা, সোনাই ছিলো নদীর নাম, হাঁসপাহাড়ি।
0 মন্তব্যসমূহ