বৃষ্টি হচ্ছে—হাত বাড়িয়ে দিই বাইরে, ভীষণ ছুঁতে ইচ্ছে করছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো হুড়মুড় করে হাতে এসে পড়ছে; তারপর পাল্লা দিয়ে গলে পড়ছে হাতের ফাঁক-ফোকর দিয়ে। ইট বিছানো মাটিতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে প্রতিটির দেহ; শেষবারের মতন ককিয়ে উঠছে তীব্র বেদনায়। মাটি গভীর মমতায় শুষে নিচ্ছে বৃষ্টির বেদনাগুলো, নাকি গোগ্রাসে গিলছে তার আর্তনাদ, মেটাচ্ছে জন্মের পিপাসা? মানুষ হওয়ার এই এক অসুবিধে: কারণে-অকারণে অনেক ভাবনাই মাথায় আসে। সাপের মতো সরু দেহের দানবাকৃতির এই যন্ত্রটা নিশ্চয় এমন করে ভাবছে না!
ট্রেন ভেড়ামারায় এসে দাঁড়াল, একজোড়া নারী-পুরুষ আমার সামনের আসনে এসে তড়িঘড়ি করে বসল। ট্রেন আবার চলতে শুরু করলো। প্রথমে একপা দুপা তারপর বলাই বাহুল্য! বাম পাশের সিটে বসা যে মানুষটি এতক্ষণ বকর বকর করে মাছের হাট বানিয়ে রেখেছিল বগিটি, সে তড়িৎ গতিতে ট্রেন থেকে নেমে গেল। লোকটি গল্পে এতটাই মশগুল ছিল যে আর অল্পক্ষণ গত হলেই এখানে আর নামতে হত না তাকে। হঠাৎই আমার মনে হল, মাছের বাজার থেকে চলে এসেছি সোজা কাঁচামালের বাজারে যেখানে লোক সমাগমের ঘাটতি নেই বটে তবে জিনিসপত্রের দাম শুনে যেন জনতা বাক হারিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চাইছে ইতি-উতি! পাশে বসা ছেলেটি আমার মাথার উপর দিয়ে বৃষ্টিতে নেয়ে ওঠা প্রকৃতি দেখায় মহাব্যস্ত, যেন গোগ্রাসে গিলছে বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির আঁটসাঁট যৌবন। পৃথিবীতে লম্বা হওয়ার যতগুলো সুবিধা আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অনায়াসে অনেক কিছু দেখতে পাওয়া। ও যে আমার থেকে অনেক লম্বা এই বিষয়টি আমাকে বোঝানোর জন্যে থেকে থেকে আমার মাথায় ওপর দিয়ে হাত চালিয়ে দিচ্ছে জানালার দিকে।
ট্রেন চলছে ঝিকঝিক ঝিকঝিক—আমি অনুবাদ করলাম—সন্ধে হয়ে এলো, এখন বাড়ি যাব; সন্ধে হয়ে এলো, এখন বাড়ি যাব। একটা কবিতার কথা মনে পড়ে গেল। ছোটবেলায় পড়েছিলাম, একটা অংশ এখনও মনে আছে—
Tickerty-too/ Hurry up do!/ Trains cannot wait/ Must not be late…কবিতাটা আমাদের দেশের ট্রেনের ক্ষেত্রে খাটে না। সেটা অবশ্য বড় হয়ে জেনেছি। আমাদের ট্রেন মানেই ‘এত তাড়া কিসের, এই তো চলছি বেশ’! কবিতাটি যেই লিখুক, বাঙালি হলে এমনটি লিখতেন না, লিখলে ডাহা মিথ্যা লেখা হতো।
আমি দৃষ্টি বিছিয়ে দিলাম বাইরে। বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতি এখন নিশ্চুপ-নিষ্পাপ যেন জগতের হালচাল সে কিছুই বোঝে না। প্রকৃতির এই নিষ্পাপ চেহারা আজই প্রথম প্রত্যক্ষ করছি তা কিন্তু নয়; ইতোপূর্বে বহুবার করেছি, তবে আজকের এই অনুভূতিটা খাঁদবর্জিত-নিরেট অনুভূতি। ট্রেনের শব্দটা এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে ঘুমপাড়ানি গান; প্রকৃতিকে ঘুম পাড়াতে ভীষণ ব্যস্ত সে এখন। এই মুহূর্তে মা’র কথা মনে পড়ছে খুব করে। মা গান জানতেন না। সংসারের সাতকাহন সামলাতে গিয়ে গান গাওয়া কিংবা শোনার ফুসরৎ মেলেনি তার। সাতবোকার একটি গল্প জানতেন এবং এই একটি গল্প দিয়েই তার ন’টি সন্তানকে ঘুম পাড়িয়েছেন। তারপর একদিন ক্লান্ত হয়ে তিনি নিজেই ঘুমিয়ে পড়লেন। সাথে গল্পটিও। আমার বোনেরা মা’র কানের কাছে সুর করে কালিমা তাইয়েবা পাঠ করছিলেন। ঘুম পাড়ানোর এই তাজ্জব তরিকার সাথে সেদিনই আমার প্রথম পরিচয় ঘটলো। তবে আমি জানি, ঐ সময় পৃথিবীর কোনো শব্দই মা’র কানে প্রবেশ করেনি। ধ্যান করার প্রথম ও প্রধান কারণ হল নিজের চারপাশে ভ্যাকুয়াম বলয় সৃষ্টি করা। নিজের সত্তাকে transcend করানো মানেই হচ্ছে তাকে শব্দের জগত থেকে বের করে আনা। এবং সোল যখন এ্যাবসুলুট্লি transcend করে তখনই তো আমরা শরীর ধরে কান্নাকাটি করি! আমরা যাকে মৃত্যু বলি সে শুধু দেহেরই ঘটে। আমাদের ভালোবাসা কেবলই বস্তুকে ঘিরে। মানুষের যদি বাদুড়ের মতো দৃষ্টি না থাকতো তাহলে দৃশ্য বা বস্তুর আবেদন অনেকখানি কমে যেত; এক্ষেত্রে সৃষ্টির সেরা জীব হত বানর গোছের কিছু একটা।
খ
সামনের আসনে বসা নারী-পুরুষ দুজন দুজনার হাত ধরে একটি করে কথা বলছে আর অট্টহাসিতে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়ছে। দুজনেরই বয়স ২৮ থেকে ৩৫-এর মধ্যে হবে; আচরণে মনে হচ্ছে সদ্যবিবাহিত। সদ্য বলছি এ জন্যে যে, বেশি দিন সংসার করা নারী-পুরুষেরা বাইরে এসেও সংসারের গাণিতিক হিসেব মেলাতে ব্যস্ত থাকেন; ভালোবাসা তাদের কাছে মধ্যরাতের বিছানাতেই ঠাঁই পায়। তবে এরা প্রেমিক-প্রেমিকাও হতে পারে। চার্লস ল্যাম্ব আজীবন ব্যাচেলর ছিলেন। তাঁর একটি রচনায় লিখেছিলেন যে, তিনি কোনো বিবাহিত বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গেলে তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে তাঁর সামনে এমন ভান করে যেন তারা তীব্রভাবে একে অপরকে ভালোবাসে এবং তারা ল্যাম্বকে বলতে চায়, দেখ ব্যাটা তুই কত অসুখী! এরা দুজন কি এখন আমাকে সেরকমই কিছু ইঙ্গিত করছে? না হলে বউকে নিয়ে তো ঘরের মধ্যে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে লটর-পটর করতে পারে! আমি বলার কে? এভাবে ট্রেনের তালে তালে একে অন্যের গায়ে হেলে পড়ার মানে কী! আমার বামদিকের কোণায় মাঝবয়সী এক হুজুর বসে আছেন। হুজুরটি সুবিধা মতো এঙ্গেলে আমার সামনের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছেন; তাকানোর ভঙ্গিমাটা এমন যেন ডায়বেটিকসে রোগী রাস্তায় দাঁড়িয়ে হোটেলের কাচ দিয়ে ঘেরা মিষ্টি দেখছে, পারলে টপাটপ গিলে ফেলে! মেয়েরা যদি খাদ্য হয় তবে আমরা যাকে চরিত্রহীন বলি তাকে ভোজনরসিক বললেই মানাবে বেশ। শুনতে খারাপ লাগলেও অনেকে একমত হবে, মেয়েরা পুরুষদের কাছে খাবারই বটে। পার্থক্য হচ্ছে, এদেরকে ডাইনিং টেবিলে পরিবেশন না করে বিছানাতে করা হয়, মশলার বদলে মেকআপ দেওয়া হয়। আমাদের দেশে হুজুরদের বিনোদনের মাধ্যম বলতে শুধুমাত্র স্ত্রী মানে নারী আর কী, ফলে হুজুরদের বৌদের বেশ ধকল সহ্য করতে হয়। আমার দূর সম্পর্কের এক ভাবীকে, যার স্বামী বেশ নামকরা হুজুর ছিলেন, বলতে শুনেছিলাম যে তার স্বামীর ভালোবাসা এখন তার কাছে অত্যাচারের মতন বিঁধে। দিন নেই রাত নেই যখন তখন...! বেচারা বৌ!
একটু ঝিমুনি এসেছে মাত্র এমন সময় একটা হাতের আলতো পরশে হকচকিয়ে উঠলাম। ঘুম মৃত্যুর কাছাকাছি একটি স্তর। একটা থেকে ফেরত আসা যায়, আরেকটা থেকে যায় না। মেজর পার্থক্য এই যা। ঘুমালে অবচেতন মন জেগে ওঠে। ফ্রয়েডের মতে মনের অবদমিত আকাঙ্ক্ষাগুলো অবচেতনে জমা হয় তারপর ঘুমের মধ্যে জেগে উঠে তাদের উপস্থিতির কথা জানান দেয়। মারা গেলে কি অবচেতন কাজ করে? কি জানি—ফ্রয়েড ফেরত আসলে জানা যেতো! দেখি একজন অর্ধউলঙ্গ ভিখারি, সমস্ত হাত জুড়ে খ্যাত খ্যাতে ঘা, বৃষ্টির পানিতে ভিজে হাতটির দশা বর্ষায় আমার পাড়ার গলির মতো: গরুর গোবর, চুনার সাথে টয়লেটের ট্যাংক উপচে পড়া নোংরা আর ড্রেনের পানির এক অদ্ভুত মিশ্রণ! লোকটির চারিদিকে মাছি ভনভন করছে। আমার তো প্রায় বমি হবার উপক্রম। ঝট করে চোখ সরিয়ে নিলাম। লোকটি হাত প্রসারিত করে বলতেই থাকল, ‘ভাই-আফারা, শরীরে আমার কঠিন ব্যামো, আল্লার বান্দা, দু-এক টাকা দিয়ে সাহায্য করেন, আল্লাহ আপনাগো মঙ্গল করবে।’ মনে হচ্ছে এই ব্যামোটাই ওর ব্যবসায়ের মূলধন। ভিক্ষাবৃত্তিকে যদি এক ধরনের ব্যবসা বলা হয় তবে আমাদের দেশে এই ব্যবসাতে শুধু আল্লাহর নাম এবং আল-কুরআনের দু-একটি লাইন জানা থাকলেই চলে। আমি এখন পর্যন্ত কোনো হিন্দু ভিখারি দেখি নি যারা রাম রাম করে ভিক্ষা করছে। তার মানে কি হিন্দু ভিখারি নেই? আছে, কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক যে একটা ভ্যালু আছে সেটা তারাও বোঝে। আমি একজন পঙ্গু হিন্দু ভিখারিকে চিনি যে সারাদিন কুরআনের আয়াত পড়ে ভিক্ষা করে রাতে রাম রাম করতে করতে বাড়ি ফেরে। তার অন্ধ মেয়েটা চমৎকার ভজন গাইতে পারে আবার আস্ত আস্ত সুরাও মুখস্থ। আমার মন বলছে আরেকবার লোকটির হাতের দিকে তাকাতে, কিন্তু আমি জানি তাকালে এই মনই ভেতর থেকে বমি খিঁচিয়ে বের করে আনবে। মনের একই সাথে এই দ্বিমুখী আচরণে আশ্চর্য না হয়ে পারি না। এই বিশ্রী জিনিসটার প্রতি তার এত টান কিসের!
ফকিরটা যেতে না যেতেই এক হকার এসে শুরু করলো তার তোষামুদে বক্তৃতা। ‘মসুলমান ভাইদের সালাম, হিন্দু ভাইদের নমস্কার আর যারা আছেন তাদের আদাব। ভাইয়েরা আমার, পকেটমার হইতে সাবধান, মানিব্যাগ-মোবাইল ঠিক মতো আছে কিনা দেখে নিন। অপরিচিত কেউ কিছু দিলে খাবেন না দয়া করে। আমি একটা মকছেদ নিয়ে আপনাদের কাছে এসেছি। কোম্পানি আমার উপর একটা গুরু দায়িত্ব দিয়েছে। আমার হাতে ছোট্ট যে জিনিসটা দেখছেন এইটা হলো কি যে বাতের মলম। আম বাত, বাম বাত, ডান বাত পৃথিবীর সে যত কঠিন বাত হোক না কেনো আমার এই ছোট্ট মলমটার কাছে কুপোকাত। লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে ফল, ফল না পেলে ডবল টাকা ফেরত। ভয় নেই, ফল পেলে ডবল টাকা চাইব না। আপনারা ভাবছেন, কত বিরাট বিরাট ডাক্তার কমনে গেল, আমার এই ছোট্ট মলম কি করবে? আর করতে পারলে না জানি এর কত দাম! আপনারা জানেন, ছোট্ট সাপের বিষ বেশি। দাম শুনলে আমার সব মলম কিনে নিতে মন চাইবে। কিন্তু দুঃখিত, আমি একটার বেশি দিতে পারবো না। কোম্পানি সাম্পুল হিসেবে খুব সীমিত কিছু আমার হাতে তুলে দিয়েছে। দাম মাত্র ৫০ টাকা নিতে চাইলে আরও কম মাত্র ১০ টাকা। একেবারে পানির দামে বারডামের চিকিৎসা। বাইরে কিনতে চাইলে আপনাদের পুরা ৫০ টাকা দিয়েই নিতে হবে। যাদের বাত আছে কিংবা মাথা ধরেছে এখনই লাগিয়ে দেখুন এই ছোট্ট সাপের তেলেসমাতি কারবার। ফ্রি লাগান। এক পয়সাও লাগবে না। আমার কোম্পানি লাভে বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে গুণে। লাগবে নাকি ভাই? আমি পরের স্টেশনেই নেমে যাব। কাছে বেশি মাল নেই। পরে কিন্তু হাজার পস্তেও কাজ হবে না। লাগবে নাকি একখান?...’ কথা বলা যে লোক ঠেকানোর এবং ঠকানোর জন্যে খুবই কার্যকরী এক শিল্প তা এই হকার এবং রাজনীতিবিদদের বক্তব্য শুনলে বোঝা যায়। একজন চকলেট বিক্রেতাও আমাদের কামরায় প্রবেশ করল। ‘ভাই-বোনেরা আমার, আমি অন্ধ মানুষ, চকলেট বিক্রি করি পেট চালাই, সবাই একটি করে চকলেট কিনি সাহায্য করেন’, বলেই বিক্রেতা এদিক-ওদিক হাত বাড়িয়ে দিল। লোকটিকে আমার বেশ ভালো লাগল।
এমনিতেই মানুষ অলস জাতের প্রাণী; বসার অবকাশ পেলেই ঘুমানোর চিন্তা করে। কিন্তু এই মানুষটার কণ্ঠে কী যেন একটা পেলাম! সৃষ্টিকর্তা লোকটির দেখার শক্তি কেড়ে নিলেও মনের শক্তি নেননি। সৃষ্টিকর্তার এই পরাজয়ে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও খুশি হবেন নিশ্চয়।
গ
ট্রেন সমান মমতায় সকলকে তার বুকে আশ্রয় দিয়েছে। ট্রেনের কাছে জাত-ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ নেই। হয়ত নিজের কোনো জাত-ধর্ম নেই বলেই! আর আমরা মানুষেরা দশজন এক জায়গায় হলেই শ্রেণি গড়ে তুলি। তাই তো কৌশলে ট্রেনের ভেতরটাকে বিভক্ত করা হয়েছে—প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণি, তৃতীয় শ্রেণিতে। দারিদ্র্যকে এত ভয় কিসের! সমাজের সকলে যদি সত্যি-সত্যিই চাই তাহলে পরবর্তী প্রজন্মকে দারিদ্র্যকে দেখতে হলে জাদুঘরে যেতে হবে কোনো সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু দারিদ্র্য আর ধর্ম এই দুটো জিনিস না থাকলে যে ‘ওদের’ বড় ধরনের সর্বনাশ হয়ে যাবে! মানুষ হয়ে মানুষকে ঠকানোর এর থেকে মস্ত হাতিয়ার যে এখানো আবিষ্কার হয়নি।
পিছনের কামরায় একজন তিলের খাজা বিক্রেতা একটা বাচ্চা মেয়ের পাশে অনেকক্ষণ থেকে ঘুরঘুর করছে। মেয়েটির বোধ হয় তিলের খাজা পছন্দের না। বিক্রেতা সুবিধা করতে না পেরে আমাদের কামরায় চলে আসল। ‘নেবেন ভাই, কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা’—লোকটি গড়গড় করে বেশ কয়েকবার বলল। আমি লোকটাকে চিনি, বাড়ি ফরিদপুরে। খাজাও ওখানকার। আমার চোখে চোখ পড়তেই দ্রুত অন্য বগিতে চলে গেল। সৃষ্টি-সেরা একমাত্র মানুষই এতো সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারে। একবার এক ব্যক্তিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘পৃথিবীর কোন জিনিসটা দেখতে আপনার সব থেকে ভালো লাগে?’ ‘অপরাধ ধরা পড়ার পর একজন অপরাধীর চেহারা’—উত্তরে ভদ্রলোকটি বলেছিলেন।
ট্রেনটি এইমাত্র পাকশি ব্রিজের উপর পা রাখলো। ট্রেনের ক্ষেত্রে পা না বলে চাকা বলাই যৌক্তিক। তবে আজ এ Personification বেশ গুরুত্ব বহন করে, অন্তত আমার কাছে। এখন বর্ষাকাল। নদীর ভরা যৌবন উথলে পড়ছে। প্রকৃতিকে যারা ভোগ করতে জানেন তাদের কাছে এ এক মোক্ষম সময়। ওয়ার্ডসওয়ার্থ কিংবা জীবনানন্দ যদি আজ এই ট্রেনে থাকতেন আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি এখনই জন্ম হয়ে যেত বেশ কিছু কবিতার। ভ্রুণ অবস্থায় থেকে যেত আরও কিছু। এক্ষেত্রে আবার কবি ভেদে ট্রেনের ইমেজ হতো ভিন্ন। টেড হিউজ থাকলে ট্রেনকে সম্ভবত কুমিরের সাথে তুলনা করতেন। এইমাত্র বেশ কিছু প্রাণ আস্ত গিলে সদর্পে এগিয়ে চলেছে আরও কিছু ভক্ষণের জন্যে। ট্রেন তখন ‘এ ডেসট্রাকটিভ ফর্স অব ন্যাচার’। আর রবার্ট লুই স্টিভেনসন তো লিখেছেনই— Faster than fairies, faster than witches/ Bridges and houses, hedges and ditches;/ And charging along like troops in a battle…’ আজ থাকলে হয়ত তিনি অন্য কথা লিখতেন কিংবা পুরনো কবিতাটি এডিট করতে বসে যেতেন। আমি কবি নই, কাজেই মাথায় যত চিন্তা আসছে সবই আন-রোমান্টিক ধাঁচের। লিখলে খুব বাজে দেখাবে। কবি সমাজ টুঁটি চেপে ধরার সমূহ সম্ভাবনা আছে। আমার এই মুহূর্তেই ইচ্ছে করছে নদীর বুকে লাফিয়ে পড়ি। প্রকৃতির কাছে এর থেকে সুখের আত্মসমর্পণ আর হতে পারে না! উঁচুতে উঠলেই মানুষের মনে এক ধরনের লাফ দেয়ার প্রবণতা কাজ করে। দর্শনের ভাষায় একে বলা হয়, Antipathitic-Sympathy, Sympathetic-Antipathy । শেষপর্যন্ত লাফ আর দেয়া হল না। ট্রেন এখন স্থলদেশে। এখানে লাফ দেওয়ার মাঝে কোনো রোমান্টিকতা নেই। মাঝখান থেকে শুধু শুধু দেহের হাড়গোড়গুলোর বারটা বাজানো। ট্রেন এখন ঈশ্বরদীর খুব কাছাকাছি। ওখানে গিয়ে কিছুটা সময় জিরিয়ে নেবে। বদলে নেবে মাথাটাও। যন্ত্র হওয়ার এই এক সুবিধা—ইচ্ছা মতো সব কিছু বদলানো যায়! এখানে আমি চা গেলার কাজটি সেরে নেবো। চা খেলে বুদ্ধি খোলেআমার এক মামা হিমুগীরী ফলাতে বলেছিলেন একদিন! শোনার পর থেকে চা পান করার পর নিজেকে খানিকটা হলেও বুদ্ধিমান মনে হয়।
গতকাল একটি ফরাসি সিনেমা দেখলাম। সেখানে বলা হচ্ছে—‘if you don’t choose, everything remains possible’। সিনেমার প্রটাগনিস্ট তিনটা মেয়েকে পছন্দ করে। সে কাউকেই চুজ করলো না, ফলে দেখা গেল সে তিনটা মেয়ের সঙ্গে একই সাথে সংসার করছে। মানে আমি স্টেশনে এসে রাজশাহীগামী ট্রেনটি চুজ না করলে যে কোনো জায়গায় যেতে পারতাম। একটা আমি যেতো ঢাকায়, একটা আমি খুলনায়, একটা রাজশাহী। তিনটা আমির অস্তিত্ব টের পেতো তার আশপাশের মানুষেরা। একমাত্র স্টেশনের আমিই they don’t exist. They are just a possibility. ছবির শেষে বলা হচ্ছে— ‘We don’t exist. We are just an imagination of a nine-year-boy. (who didn’t choose anything)’ এখন আমার কেবলই মনে হচ্ছে—do I exist? আমি কয়েকটি সম্ভাবনার একটি নই তো! যদি সম্ভাবনা হই তাহলে আমার কোনো জন্ম-মৃত্যু নেই। শুধু সমাপ্তি আছে। মানে আমার কোনো ঈশ্বর-পরকাল নেই। আর যদি আমি সম্ভাবনা না হই তাহলে I have to choose. সেক্ষেত্রে বড় ঝামেলা হলো, আমাকে এখন ঠিক করতে হবে— Whether I will choose or not and what to choose and what not. ট্রেনের ঘণ্টা পড়ে গেল। হাতে বেশি সময় নেই। ট্রেনের ভেতর আমার যাবতীয় মালামাল। আপাতত সিনেমাটি মাথা থেকে নামিয়ে ট্রেনের দিকে হাঁটা দিলাম। পেছনে ঘুরে দেখে নিলাম, আমি সত্যিই এলাম কিনা!
ঘ
আমার সামনে বসা জুটিটা এখন বাদাম খাচ্ছে। আমার ঐ হিমু মামা বাদামকে বলতেন প্রেমফল; দুজনার খাওয়ার ভঙ্গিমা দেখে আজ তার কথার সত্যতা মিললো। মহিলাটি আমার দিকে বাদামের ঠোঙাটি এগিয়ে ধরে বললেন, ‘নেন ভাই, বাদাম খান।’ আমি বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করতে গেলে পাশের জনটি বলল, ‘আপনার আপা এত করে যখন বলছে, নেন না!’ গোটা কতক বাদাম ঠোঙা থেকে উঠিয়ে নিলাম। না, এরা বোধ হয় বিবাহিত না। বিবাহিত হলে লোকটি ‘আপনার আপা’ না বলে বলত ‘আপনার ভাবি’; এক্ষেত্রে সচরাচর এমনটিই ঘটে। এখন মনে হচ্ছে আমার দ্বিতীয় ধারণাটাই ঠিক।
একটা অল্প বয়স্কা মেয়েকে কয়েকজন ধরে আমাদের বগিতে উঠালো। মেয়েটি চিৎকার দিয়ে বুক চাপড়িয়ে কাঁদছে। কান্নার ভাষা বোঝার চেষ্টা করলাম। বিশেষ কিছু বোঝা যাচ্ছে না তবে প্রতিটি বাক্যের আগে অথবা পিছনে মা শব্দটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মেয়েটির মা মারা গেছে বিষয়টি বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। বেশ দুঃখের কথা, কিন্তু আমি কেমন যেন একটা স্বস্তি অনুভব করলাম। অনুভবে যে মারা গেছে সে অন্য কেউ, আমি না কিংবা আমার কেউ না। ‘ডেথ অব ইভান ঈলিচ’-এ ইভান ঈলিচের মৃত্যুর সংবাদ পড়ে তার বন্ধুদের এমনটি মনে হয়েছিল। মেয়েটি কাঁদছে বিরতিহীন।
আশপাশের সকলে মেয়েটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে পাশের মা গোছের মহিলাটি মেয়েটির খসে পড়া বুকের কাপড় ঠিক করে দিলেন। আমার মা যখন মারা গিয়েছিল আমিও তখন এমন করে কেঁদেছিলাম, আমার নানি মারা গেলে মা কেঁদেছিলেন;—এ কান্না বংশ পরম্পরায় হয়ে আসছে, খুবই স্বাভাবিক, খুবই চিরন্তন এই কান্না। একেক কান্নার আপিল আবার একেক রকমের হয়। শিক্ষকদের পিটুনি খেয়ে যে কান্না তাতে থাকে অপমান, বাবার বকুনি খেয়ে যে কান্না তাতে থাকে জেদ, মা-র বকা খেয়ে যে কান্না তাতে থাকে অভিমান, স্বামীর বকুনি খেয়ে যে কান্না তাতে থাকে জ্বালা, আর আপনজন হারানোর যে কান্না তাতে থাকে বিস্ময়কর আবেদন, যে আবেদনে সাড়া দিতে গিয়ে এখন ট্রেনের এই বগিতে বেশ মেঘলা আবহাওয়া বিরাজ করছে। সন্ধ্যার সমস্ত নীরবতাকে ভেদ করে মানব জীবনের সবচেয়ে অসহায়ত্বটি ট্রেনের কামরায় কামরায় উত্তর খুঁজে ফিরছে। বিশ্বাসীরা অস্থির হয়ে উঠেছে, সংশয়বাদীরা নড়েচড়ে বসছে, অবিশ্বাসীরা চুপচাপ বসে আছে। ট্রেনটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সামনে এসে থামলো; এখানে থামার কথা না, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটা ছাত্র চেইন টেনেছে। আমার পাশের লম্বুটি প্রথমবারের মতো রাজশাহী আসছে, ও ভেবেছে এটাই রাজশাহী স্টেশন! আমি ওর ভুলটা ভাঙ্গালাম।
ট্রেন স্টেশনে প্রবেশ করছে; অল্পক্ষণের মধ্যে আমরা নেমে পড়বো। আমার জায়গায় অন্য কেউ আসবে, অন্যভাবে ভাববে সবকিছু, বাস্তবের চরিত্রগুলো কিছুক্ষণের জন্যে হয়ে উঠবে ভাবনা জগতের বাসিন্দা।
মাস কতক পরে কুষ্টিয়ার সোনালী বাজারে আমার সামনে বসা লোকটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপা কেমন আছে? ‘ও তো এখন শ্বশুরবাড়িতে, ভালোই আছে!’লোকটি হাসতে হাসতে বলেছিল। তাদের সম্পর্কটা শেষপর্যন্ত রহস্যই থেকে গেল।

লেখক পরিচিতি
মোজাফফর হোসেনজন্ম, ১৮৮৬। মেহেরপুর, বাংলাদেশ। পড়াশুনায়, ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। লেখালেখি, মূলত ছোটগল্প; সেই সঙ্গে অনুবাদ ও সাহিত্য সমালোচনা। প্রকাশিত বই: দ্বিধা (গল্পগ্রন্থ,অন্বেষা প্রকাশনী, ২০১১); আদিম বুদবুদ অথবা কাচামাটির বিগ্রহ (গল্পগ্রন্থ, রাত্রি প্রকাশনী, ২০১৩), সাহিত্য সমালোচনা ও অন্যান্য প্রবন্ধ (প্রকাশিতব্য)। পুরষ্কার: অরণি ছোটগল্প পুরস্কার-২০১৩, শ্রেষ্ঠ গল্প পুরস্কার, বৈশাখী টেলিভিশন, ২০১৩।
0 মন্তব্যসমূহ