হোসেন মিঞার নাও

অমর মিত্র

সে একটা দ্বীপে থাকে। তার তিন দিকে পূরব সমুদ্র, বে-অফ-বেঙ্গল, এক দিকে মেঘনা নদী। মেঘনা খুব বড় নদী। সাগরে ভেসে গেছে এইদিকে এসে। সে এই দ্বীপের মেয়ে। এই দ্বীপ সেই ময়নাদ্বীপ। কোন ময়নাদ্বীপ, সেই যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে দ্বীপের কথা লিখেছিলেন পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে। হোসেন মিঞা যে দ্বীপ কিনে সেখানে বসত করিয়েছিল পদ্মাপারের জেলেদের, সেই দ্বীপ। সেই সন্দ্বীপ, হাতিয়া দ্বীপের কাছাকাছি, বঙ্গোপসাগরের কোথাও। সে সেই দ্বীপে থাকে। সেই মেয়েটি, টিয়া রঙের সেই মেয়েটি লিখেছে তাই।

শুনতে শুনতে সুমেরুর বন্ধু বলল, তা হয় নাকি, ওই দ্বীপ তো ছিল মানিকের কল্পনা, আর হোসেন মিঞা ছিল আফিমের কারবারি, পদ্মা নদীর মাঝির জেলেদের ধার দিয়ে দিয়ে কিনে নিয়েছিল। তাই বাধ্য হয়ে কুবের কপিলারা যায় দেনা শোধ করতে। পালিয়েও আসে কেউ কেউ ময়নাদ্বীপ থেকে। হোসেন মিঞা তাদের ক্রীতদাস করে রেখেছিল সেই ময়নাদ্বীপে। কী ভয়ানক ছিল তাদের সেই দাসত্ব।

সুমেরুর বন্ধু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই আবার জানান দেয়। তাকে কোনো কিছু বললে আর রক্ষা নেই, সে বকর বকর করতেই থাকবে। সেই সুযশ একজন পেন্টার। কিন্তু যত না ছবি আঁকা, আড্ডা অনেক বেশি। সে আবার নাবিকও ছিল নাকি। বহুদেশে ঘুরেছে বন্দরে বন্দরে। তার কাছে সেই সব দেশের সুন্দরী কন্যাদের ছবি আছে কত। কার সঙ্গে দেখা হয়েছিল এডেন বন্দরে, কোন সুন্দরী তার হাত ধরেছিল তাহিতি দ্বীপে, ফিলিপিনসের কোন বন্দরে কোন ফিলিপিনি সুন্দরী মারিতেস তাকে বলেছিল, আই লাভ ইউ যশ।

সুমেরু উপন্যাস লেখে, ঊনপঞ্চাশ। জীবনের অর্ধ শতাব্দী হয়ে এল। রুপোলি হয়ে যাচ্ছে মাথার চুল। সুমেরু প্রায় ছ’ফুট এক কৃষ্ণ বর্ণের পুরুষ । খুব খ্যাতিমান নয়। কিন্তু লেখক হিসেবে স্বীকৃতি আছে। অনেকে চেনে। আবার অনেকে চেনে না। সে যাই হোক, সুমেরুর এই ঊনপঞ্চাশে তার কাছে ময়নাদ্বীপ থেকে একটি চিঠি এসেছে। ময়নাদ্বীপের মেয়ে চম্পা আকতার লিখেছে তাকে তার প্রকাশকের ঠিকানায়। প্রকাশক তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার উপন্যাস ‘সমুদ্র মঙ্গল’ পড়ে চম্পা লিখেছে চার পাতা, প্রিয় লেখক সুমেরু......।

সুমেরু অবাক। এমন কখনো ঘটেনি আগে। এক বিদেশিনী দূরদ্বীপবাসিনি তার লেখা পড়ে তাকে লিখছে চিঠি। ‘সমুদ্র মঙ্গল’ তাকে এনে দিয়েছিল তার ভাই ঢাকা থেকে। ভাই বোনের খুব পড়ার নেশা। ভারতীয় বইও তারা অনেক পড়েছে। চম্পা আগে সুমেরুর নাম শোনেনি। কেন শোনেনি জানে না। সে কত লেখকের বই পড়েছে। কারোর কোনো লেখা ভাল লেগেছে, কোনো লেখা খারাপ লেগেছে, কোনো লেখা পড়ে কিছুই মনে হয় নি। ‘সমুদ্র মঙ্গল’ পড়ে অভিভূত হয়ে সে তাকে এই চিঠি লিখছে। সে আগে ভারতীয় লেখক দু একজনকে লিখেছিল চিঠি, জবাব পায় নি, তাই ধরে নিয়েছে এই চিঠিরও জবাব পাবে না। আর জবাব সে চায়ও না, তবু লিখছে। লিখছে এই কারণে যে ‘সমুদ্র মঙ্গল’- এর কাহিনি তার জীবনের সঙ্গে খুব মিলে গেছে । এমন কী করে হল প্রিয় লেখক সুমেরু , তুমি কি কখনো আমাদের এই ময়নাদ্বীপে এসেছিলে ?

কী সুন্দর হাতের লেখা। কোনো অক্ষর কোনো বাক্যের কোথাও কোনো অস্পষ্টতা নেই। আবছা হলুদ রঙের সুন্দর কাগজে পরিপাটি মারজিন রেখে সে লিখেছে চিঠিটি। তাদের ডাকঘর হাতিয়া। কিন্তু তার বাসা ময়নাদ্বীপে, হাতিয়া বা সন্দ্বীপ নয়। চট্টগ্রাম তাদের জেলার সদর। চট্টগ্রাম থেকে তাদের দ্বীপে আসা যায় জাহাজে করে। সেইটুকু সমুদ্র যাত্রা অপরূপ। প্রিয় লেখক, তুমি কী করে আমার কথা লিখলে?

সুযশ চিঠি পড়তে পড়তে বলল, এমনি হয়।

হয় মানে ?

সুযশ বলল, আমাকে তাহিতি দ্বীপের একটি উনিশ বছরের মেয়ে এমিলি বলেছিল সে একটি যুবকের স্বপ্ন দ্যাখে প্রায়ই, একেবারে সে আমার মতো।

তোকে ইম্প্রেস করতে বলেছিল।

সুযশ বলল, তোর তাই মনে হচ্ছে, কিন্তু আমার মনে হয়েছিল সত্যি।

কেন সত্যি?

সে তুই বুঝবি না, আচ্ছা তুই তাহলে কী করে লিখিস যদি নাই বুঝবি, এই যে চম্পা নামের মেয়েটি ময়নাদ্বীপ থেকে লিখেছে, এ কি মিথ্যে লিখেছে ?

বইটা ভাল লেগেছে, তা কী করে মিথ্যে হবে?

কেন ওই যে লিখেছে তার জীবনের কাহিনির সঙ্গে তোর উপন্যাসের কাহিনি অনেক মিলে গেছে।

মিলতে পারে, কেউ কেউ মিলিয়ে নেয়। সুমেরু বলে।

তাহিতির মেয়েও তেমনি হয়ত মিলিয়ে নিয়েছিল।

সুমেরু বোঝে চিঠিটার কথা না বললেই হত। সে জানে এখন সুযশের কথা তাকে শুনতে হবে এই কাফেতে বসে। সুযশ তাকে বোঝাবে, নিজের দেখা নিজের ছোঁয়া নারীদের কথা বলতে থাকবে। সুযশ পঞ্চাশ পার হয়েছে বছর তিন আগে। তার স্ত্রী খুব অসুস্থ। সুযশ এখন অপেক্ষা করছে তার একটা কিছু হয়ে যাওয়ার জন্য। কী হবে? সুমেরু জানে সুযশের স্ত্রী অনুরাধা বাঁচবে না। সুযশ বলেছিল একদিন, অনুরাধার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল খুলনা শহরে। খুলনা বন্দরে তাদের জাহাজ দাঁড়িয়েছিল মাল খালাসের জন্য। তার পূরব পুরুষের গ্রাম ছিল ঐ জেলায়। সেখান থেকে সে অনুরাধাকে নিয়ে আসে। সে কতদিন আগের কথা। সুযশের গুনগুনের ভিতর সুমেরু চম্পার কথা শোনায় তাকে। সে লিখেছে, আমি, আমিই তোমার সবুজটিয়া, টিয়া রঙের কন্যা..., সে লিখেছে সে ভালবাসে সবুজ রঙ। তার আছে সবুজ রঙের শাড়ি, সবুজ রঙের শালোয়ার কামিজ। তার বাসার সামনে পিছনে সে বাগান করেছে যে, সেখানে সবুজের সমারোহ। প্রিয় লেখক সুমেরু, তুমি যে দ্বীপের মেয়ের কথা লিখেছ তাকে তুমি কোথায় পেলে গো ? হ্যাঁ আমিই সেই মেয়ে। হ্যাঁ, আমিও খুব বই পড়তে ভালবাসি। কত বই। এপারের বই ওপারের বই। ওই যে মারা গেলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তাঁর কবিতা আমার খুব প্রিয়। তিনি যেন আমাকে নিয়েই লিখেছিলেন নীরার কথা,

এই কবিতার জন্য আর কেউ নেই, শুধু তুমি, নীরা

এ কবিতা মধ্যরাত্রে তোমার নিভৃত মুখ লক্ষ্য করে...।

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে একা বসে আমি আমার কবির কথা ভাবি যে। আমার যে নিজস্ব এক কবি আছেন। স্বামী জানতেও পারেন না আমি আর এক পুরুষের কথা ভাবছি। আচ্ছা আমি আমার দুই প্রিয় লেখকের কথা বলছি, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় আর সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, তাঁরা কেমন আছেন গো? সিরাজ সায়েবের একটি গল্প পড়েছিলাম সূরযমুখী, সে যেন আমার গল্প গো। আমিই ছিলাম ওই মেয়ে। কাপুড়ের সঙ্গে আমিই চলেছিলাম। মনে পড়ে সেই কথা,

ধুলাউড়ির মাঠেরে ভাই

রোদ ঝনঝন করে।

পানের সখার সঙ্গে দেখা

বেলা দুপহরে।।

প্রাণ সখা কাপুড়ের সঙ্গে আমার দেখা আর হলো কৈ? কিন্তু আমি তো তার সঙ্গে পথ হাঁটি। আবার শ্যামলবাবুর এক গল্প পড়েছিলাম, ‘তেওট তালে কনসার্ট’। সেই যে বরিশালের গৌরনদী, আর শেফালি, বকুল, রীনা, রমজানকাঠি, ভরসাকাঠি, বরিশাল, সাতাত্তর বছরের বুড়ো গণেন্দ্রনাথ, তাঁর চিঠি তো আমাকেই লেখা চিঠি গো। আমিই সেই মেয়ে। আমার বাপের বাড়ি যেন সেই বরিশালের গৌরনদী। আমিই চিঠি লিখতাম লাল শাড়ি চেয়ে। আমি তো পত্রমিতালিতে কতজনের বন্ধুতা পেয়েছিলাম। তাঁরা লিখতেন, আমি লিখতাম। তা দিয়ে একটা গল্প হয়ে গেল! উনি কী করে জানলেন গো? আমি কি ওঁর পত্রমিতা ছিলাম, হয়তো। কিন্তু সেই শ্যামলবাবুর রামায়ণ মহাভারতের পথ ধরে আমার চিঠিই যেন যেত তাঁর কাছে।

গণেন আমার নাম / বরিশাল গৌরনদী ধাম

অতি বলশালী সুন্দর সুঠাম দেহ / দু’চার গ্রামের লোক মল্লযুদ্ধে পারিত না কেহ

কী অবাক হয়েছিলাম সেই গল্প পড়ে। আমি তো হাতিয়ার মেয়ে, ময়নাদ্বীপে আমার সংসার। কিন্তু গৌরনদীর মেয়ে হয়ে গেলাম কী করে? আমার স্বামী অধ্যাপক।এই হাতিয়া কলেজে। আমি সারাদিন বাড়ি থাকি আর বই পড়ি আর চিঠি লিখি। আমি পড়ি আমার স্বামী পড়েন না। তিনি এইসব পছন্দ করেন না। সময় নষ্ট। গল্প উপন্যাস মাথা খায়। মেয়েমানুষ নষ্ট হয় তা পড়ে। সত্যি বলছি প্রিয় লেখক সুমেরু। আমার সঙ্গে তো আমাদের দেশের কবি সুমন্ত রাহমানের পত্রমিতালি ছিল। সে কী সুন্দর চিঠি লিখত আমাকে। প্রতি চিঠির সঙ্গে কখনো শামসুর রাহমান, কখনো সুনীল কখনো শক্তির কবিতা। কখনো অখ্যাত কোনো কবির সুন্দর চরণ। নিজের কবিতাও দিত। না দিলে হবে কেন? আমার খুব ইচ্ছে করত তাকে একবার দেখি। সুনীলকে দেখি শক্তিকে দেখি। একসঙ্গে দুজনকে দেখি। হয় নি। আর হবে না। শুনেছি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও অনেকদিন নেই। শ্যামল বা সিরাজ সায়েব কি আছেন ? তাঁদের নিয়ে একবার এই দ্বীপে তুমি এস প্রিয় সুমেরু। আমি তোমাকেও দেখতে পাব। আমার দুঃখ আমাকে নিয়ে লেখে সবাই কিন্তু আমি তাঁদের কাউকে দেখিনি। তাঁরা আমাকে দেখতে পান, কিন্তু আমি তো পাই না। জানি তাঁরা এই দ্বীপে আসবেন না কোনোদিন। এলে কি দেখতে পেতেন না সেই মেয়েটিকে ? সেই যে সেই সূরযমুখী মেয়ে, সেই কাপড়ের ব্যাপারি, পার হয়ে যাচ্ছে কতবড় মাঠ। অমন মাঠ আমাদের কই? আমাদের প্রান্তরের শেষে হয় নদী মেঘনা কিংবা সাগর। মেঘনা এখানে এসে সাগরের সঙ্গে মিশেছে। তোমার কি মনে পড়ে সেই তিতাস একটি নদীর নাম। অদ্বৈতর তিতাস। তিতাস তো মেঘনায় এসে মিশে এখানে এসে। সেই যে মনে পড়ে, ‘‘ তিতাস যেখানে মেঘনাতে মিলিয়াছে, সেইখানে গিয়া দুপুর হইল। কিশোর দাঁড় তুলিয়া খানিক চাহিয়া দেখিল। অনুভব করিল মেঘনার বিশালত্বকে আর তার অতলস্পর্শী কালো জলকে।’’ অদ্বৈতকে খুব দেখিতে ইচ্ছে হয় গো লেখক, আমিই যে তিতাসের সেই দুঃখিনি মেয়ে বাসন্তী। সে তো মালো ঘরের কথা লিখেছে, তার সঙ্গে কী করে আমার কথা মেলে গো ? আমার সুবল মরিয়াছে। আমার কিশোর পাগল হইয়া ভাসিয়া আসিয়াছে। আমার মনের ভিতরটা যে একই আগুনে পোড়ে গো, একই আগুনে পোড়ে। আমার তারে আমি কোনোদিন দেখলাম না। সুমন্ত রাহমান। কী সুন্দর চিঠি তার গো। তখন আমার বিয়ে হয় নি। সে বলল আমাকে তার দেখতে ইচ্ছে হয়, সব সময়। আমি ছবি পাঠালাম টিয়া রঙ শাড়ি পরা আমার ছবি গেল তার কাছে। লেখকরা এমন হয়। সে লেখে ছবি গেছে নষ্ট হয়ে গেছে। কেন গো ? সে নাকি ছবিতে শুধু চুমা দেয়। ছবিতে আদর করে। আমি তো এমন চাই না গো। ভয় করে খুব। স্বামী সব জানতে পারেন যে। মন টের পেয়ে যান। কোনো কাজে ভুল হলেই বা রাতে তাঁর ডাকে ভাল করে সাড়া না দিতে পারলেই চোখ রাঙা, সেই কবি তোমার সব্বোনাশ করেছে...। তার কথা ভাবছ তো। ইসস! তা নয়। আবার তা সত্যও বটে। কিন্তু আমি যে তারে শুধু একবার দেখতে চাই। হায় আল্লা, সে এই সব বলে কেন? আমি লিখেছি আমি আর ছবি দেব না, এইটাই শেষ। বিয়ের ঠিক আগে আগে তাকে তিনখানা চিঠি দি, তাতে আমার আকুল কান্না ছিল। একটার উত্তরও মেলে নি যে। সে বিবাহিত পুরুষ, তবু লিখি আমারে তোমার আশ্রয়ে রাখো কবি। আমি তোমার কবিতা যত্ন করে রেখে দেব। সব গুছিয়ে রেখে দেব। আমি না হয় তোমার বউ-এর বাঁদি হব কবি। তার কাছ থেকে কেড়ে নেব না তোমাকে। আমি মধুকবির হেনরিয়েটা হব না। তোমার রেবেকা তোমার থাকবে। আমার স্বামীকে আমি বললাম আমাকে নিয়ে চল ঢাকায়, আমার এক পত্রমিতা কবি আছে, তারে কোনোদিন দেখি নাই। আলাপ করে আসি, আমি কোনোদিন কবি লেখক দেখি নাই। খোয়াবনামার লেখক ইলিয়াস নাই, শামসুর রাহমান আছেন, তাঁর কাছে দোয়া মেগে আসি। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞেস করলেন। পত্রমিতা কবি থাকে কোথায়। কী করে পত্রমিতা হলাম আমি। সব শুনে তিনি চোখ লাল করে বললেন, দোয়া আল্লার কাছে মাগো, কবি আবার কে ? ম্যারেড পোয়েট, অন্য মেয়েছেলের দিকে চোখ কেন? তুমি খবদ্দার ও নাম মুখে আনবে না, তুমি বই পড়া বন্ধ কর, বই পড়া হারাম। গল্প উপন্যাসে কিসসা থাকে। তিনি আবার বললেন, যা বলেছি তাই করবে, আমি মেয়েছেলের বেয়াদবি সহ্য করি নে, এস, নিকটে এস। আমি কান্না চেপে শয্যায় গেলাম। তারপর একদিন, তখন আমি যমজ সন্তানের মা, স্বামী আমার লাইব্রেরির কার্ড নিয়ে নিলেন, বললেন, আর একদম না। ঐ সব খারাপ বই পড়ে আমার মন চলে যাচ্ছে সংসার থেকে। নবেল ঢুকবে না এই বাড়িতে।

তুমি যে এই কথাই লিখেছ সুমেরু। এই গল্প তুমি জানলে কী করে সুমেরু ? এ তো আমার কথা। আমার সেই সুমন্ত কবিও এত কথা জানে না। সে যে আমার শাদির পর আবার আমাকে চিঠি লিখল। কী চিঠি তা ? কী তার বেহায়াপণা! সুমন্ত যে আমায় অত কামনা করে তা আমি কি জানতাম। আগে যদি জানইতাম, আমি শাদিই করতাম না। বাবাকে বলতাম আমি পড়ব শুধু। সুমন্ত লিখেছিল সারারাত আমায় ভেবে ভেবে কল্পনা করে তার ঘুম আসে না। লিখেছিল,

কত নদী পার হতে হবে তোমার কাছে পৌঁছতে
কত পথ হাঁটতে হবে তৃষিত ঠোঁট তোমায় ছোঁয়াতে।

সে তো হেঁটেই চলেছে। সাত সাগর পার হয়ে চলেছে। সে দূর দ্বীপবাসিনী বন্দিনীর কাছে পৌঁছতেই পারছে না। অথচ দ্বীপটাকে মেঘনা খেয়ে ফেলছে একটু একটু করে। একদিন হোসেন মিঞার এই ময়নাদ্বীপ সাগরে ভেসে যাবে। তুমি এসে আর পাবে না। তুমিও যে এই কথাই লিখেছ সুমেরু লেখক। আমার স্বামীকে লুকিয়ে আমি আমার প্রিয় লেখককে লিখছি এই চিঠি। হ্যাঁ গো, তুমি আমাকে চিনলে কী করে ? কী করে জানলে দ্বীপটা শুধু ছোট হয়ে আসছে। একদিন যখন আমাদের বাসাটুকু বাদ দিয়ে সব চলে যাবে, নাও ভাসিয়ে হোসেন মিঞাও চলে যাবে, আমি একা পড়ে থাকব এই দ্বীপে। সমুদ্র নিতা আসবে আমায়। স্বপ্নে সেই সমুদ্র দেখি আমি। নিঃশব্দে আসে সে আমার দুয়ারে। আমার কবি। কী সুন্দর লিখেছ তুমি সুমেরু। আমি পড়তে পড়তে বিভোর হয়ে তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। বই-এ ছাপা ছবিতে তোমার চোখদুটি দেখি। এ কেমন চোখ যে বিশ্ব ব্রহ্মান্ড আর অন্তরাত্মা দেখতে পায় ?

সুযশ বলল, কিছু মেয়ে থাকে এমনি, সব কিছুর ভিতরে নিজেকে দ্যাখে, অনুরাধা কাল হসপিটালে যাবে, এত ভুগছে, কী যে হবে !

সুমেরু চুপ করে থাকে। অনুরাধা তাকে ফোন করত প্রায়-ই। তার লেখা ভাল লাগলেই মোবাইল কিংবা ল্যান্ড লাইন বেজে উঠত, কী করে জানলে তুমি লেখক আমার বালিকাবেলার কথা ? সে থমথমে হয়ে বসে থাকল। অনুরাধাকে একদিন দেখতেও যায় নি। সুযশ বলল, উঠি, ও শুধু আমার মোবাইল চেক করত, কী অশান্তি ! কারা আমায় কল করল, এখন কী করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে।

সুমেরু নিশ্চুপ। কথাটি বলে সুযশ তার নতুন আসা মেসেজ দেখতে থাকে। ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে বহু প্রাচীন এই কাফে। সুমেরু উঠতে উঠতে বলল, চম্পা আকতার বলেছে, চিঠির জবাব না দিতে, স্বামীর হাতে পড়লে তার সব্বোনাশ হয়ে যাবে। লেখকদের কথা বলা যায় না। তাঁরা সব জানেন। কী লিখতে কী লেখেন। বেহায়া হন তাঁরা। কিন্তু তার বড় সাধ, একবার তাঁদের দ্যাখে। সবাই আছেন সমুদ্র-বাতাসে। অদ্বৈত, ওয়ালিউল্লাহ, শ্যামল, সিরাজ, সুনীল শক্তি, শামসুর, ইলিয়াস......একবার দেখি তোমাদের। সুমন্ত রাহমান, বড় সাধ জাগে, একবার তোমায় দেখি। কবির চিঠিগুলি সব আমার কাছে লুকোন আছে। হোসেন মিঞা জানতে পারলে আমি শেষ হয়ে যাব, তার নাও, এই ময়নাদ্বীপ ভাসিয়ে এমন কোথাও নিয়ে যাবে, যেখানে ডাকঘর নেই। ভাঙন ধরা দ্বীপে তার অনুমতি নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে আমায়। সম্বল শুধু সুমন্তর পুরোন চিঠি। সবই তো লিখে দিয়েছ প্রিয় লেখক, প্রিয় সুমেরু।




লেখক পরিচিতি
অমর মিত্র

জন্ম :৩০ আগস্ট, ১৯৫১
বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কাছে ধুলিহর গ্রামে | বিজ্ঞানের ছাত্র | কর্ম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক দপ্তরে | তিনি ২০০৬ সালে ধ্রুবপুত্র উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন।

প্রকাশিত বই-- পাহাড়ের মত মানুষ, অমর মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প, অর্ধেক রাত্রি, ডানা নেই উড়ে যায়, ধুলোগ্রাম, অশ্বচরিত, আগুনের গাড়ী, ধ্রুবপুত্র, নদীবসত, কৃষ্ণগহ্বর, আসনবনি, নিস্তব্দ নগর, প্রান্তরের অন্ধকার, ভি আই পি রোড, শ্যাম মিস্ত্রী কেমন ছিলেন, গজেন ভূঁইয়ার ফেরা, জনসমুদ্র, সবুজ রঙের শহর, সমাবেশ, সারিঘর, সুবর্ণরেখা, সোনাই ছিলো নদীর নাম, হাঁসপাহাড়ি।
পুরস্কার : সাহিত্য একাডেমী।

গল্পপাঠে অমর মিত্রের সব লেখা পড়তে এইখানে ক্লিক করুন : লিঙ্ক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ