কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : এই এক ঘোরলাগা জটিল ঝগড়া-লাগাইন্যে প্রশ্ন বটে! আমার গল্প গল্প হয় কিনা, এ দায়িত্বই তো নিতে পারব না; আবার সেরা গল্প নির্ণয় করব কী দিয়ে। এর কি কোনো মাপকাঠি আছে বা থাকা দরকার? নিজের সন্তান কি সেরা, কম-সেরা, না-সেরা হয়। তবে এই চান্সে সবগুলি গল্পের ভিতর বিচরণ করতে শুরু করেছি আমি। সেকেন্ডে সেকেন্ডে নিজের মত বদলাচ্ছি। এক-এক গল্প এক-এক দিকের জন্য সেরা বলা যায়,Ñ মানে যদি সেরার সে-রকম শর্ত মানতেই হয়। আমার নিজের মানসিক জগৎটা মনে হয়--মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম, নামের গল্পে বেশি প্রকাশ পেয়েছে। রাজনৈতিক বা নৈতিক ইতিহাসের ম্যালাকিছু তাতে আছে মনে হয়। ‘তাকে আর পাওয়া যায় না, সেই এক কর্নেলের গল্প, কণার মায়ের দিনলিপি, এ তবে ছায়ার গল্প, শহরটির কোনো ম্যাপ ছিল না, পত্রমিতা, ভালোবাসা সনে আলাদা সত্য রচিত হয়--এর কথা মনে পড়ছে। তবে আরেকটা বিষয়, একটা সময় পর্যন্ত আমি আমার গল্পে সরাসরি থাকতে চাইতাম না। মানে, একটা সময় পর্যন্ত এভাবেই ভাবতাম যে গল্প থেকে নিজেকে দূরে রেখে গল্পের জগৎটা নির্মাণ করতে হবে। এটা তো সত্যি যে গল্পও জীবনযাপনের একধরনের স্ট্যাটমেন্টই। নিজেকে দেখার একটা জায়গা, নিজেকে নির্মাণেরও জায়গা।
তবে একটা সময়ে ভাবলাম, নিজের বাড়ি-আত্মীয়-স্মৃতি সহযোগে একটা গল্প তৈরি হতে চাইছে। তাই আমি একপর্যায়ে লিখতে শুরু করলাম,Ñ আসুন বাড়িটা লক্ষ করি নামের গল্প। নিজের, পরের, স্মৃতির, গল্পের আলাদা ভাবনা মিলিয়ে গল্পটি লেখা হলো। হয়ত এখান থেকেই আমার গল্পের জগতে আলাদা একটা মোচড়ও নিলো। হয়ত কিছুই হলো না। তবু এটিকেই আপনাদের শর্তের কাছে বলি দিলাম হাহাহা।
গল্পপাঠ ২. গল্পটির বীজ কিভাবে পেয়েছিলেন?
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : আসলে অনেকভাবেই অনেক ধরনের কথা এখানে জমে আছে। একটা নির্দিষ্ট ইস্যু ধরে কথা বলা মুশকিলই। তবে আমি আমাদের গ্রামের সেই প্রাচীন মানে অরিজিনাল বাড়িটার কথাই মনে করব। আমাদের বাড়ির পশ্চিমভিটায় টিনের একটা চৌচালা ঘর ছিল। খুবই প্রাচীন, এর শিরদাঁড়া একসময় নড়ে যায় মনে হয়। বৃষ্টি হলেই ঘরটির ভিতরে কিছুটা পানিও ঢুকে যায়। টিনে জঙ ধরে গেছে। আমরা এখানে নতুন ঘর করার কথা ভাবি। পুরোটা ভেঙে একেবারে নতুন করে একটা পাকা ঘর তুলতে চাই। কিন্তু মুশকিল হলো আমাদের বাবাকে নিয়ে, তিনি কিছুতেই এ ঘর ভাঙতে দিবেন না। বার বার মেরামতের কথা বলেন। তার কথা হচ্ছে, আমি মরে গেলে তোমরা যা খুশি করো, আমি এ ঘরেই মরতে চাই। বুঝুন অবস্থা! কিন্তু আমরা ক্রমশ অভিজাত হতে থাকি, বাবাকে সেকেলে জ্ঞান করি। বাড়িটাকে ভাঙার বিষয় পাকা হয়। তাই শেষ পর্যন্ত হয়ও। কিন্তু এর স্মৃতি তো আমাদের মনোজগতেও লেগে থাকে। আমরা স্মৃতির কাছে যেন বন্দি হয়ে থাকি। আমরা হয়ত অসহয়ও হই। এইসব মিলিয়ে একটা গল্প নির্মাণ তখন অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
গল্পপাঠ ৩. গল্পের বীজটির বিস্তার কিভাবে ঘটল? শুরুতে কি থিম বা বিষয়বস্তু নিয়ে ভেবেছেন? না, কাহিনীকাঠামো বা প্লট নিয়ে ভেবেছেন?
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : প্রথম একটা ধারণা ছিল, রাজনীতি তখন আমার মাথায় আরও বেশি করেই ছিল। মনে হচ্ছিল, বাড়িটা সামন্ত আবহের প্রতীক, তাই সেজদার ভঙ্গিতেই ক্রমশ নুয়ে পড়ছে। একে সামন্ত অবশেষও ধরতে পারেন। এতে চিনপন্থিদের রণনীতি আর রণকৌশলও আধাখেচড়াভাবে আসতে পারে হাহাহা। সেই যে আধাসামন্ত আধাপুঁজিবাদী সামাজিক স্তর হাহাহা। যাই হোক, গল্পটি পড়লে দেখবেন, একটা গল্পেও কত স্তর থাকতে পারে। বা, আমি দিতে চাই আর-কি। আমি বরাবরই ছোট প্রাণ ছোট ব্যথার কথিত আবহ থেকে বের হতে চেয়েছিলাম। এখনও মনে হয়, গল্পের জগৎটা কেউ ঠিক করে দিতে পারে না; গল্পকার নিজেই তা ঠিক করে নেন। তবে যেহেতু এটি গল্প হবে, এর একটা পরিকল্পনা তো থাকেই। আমায় সীমানা ঠিক করে এর একটা পরিণতি তো করা লাগবে? তাই এখানেও আছে। গ্রাম, গ্রামীণ সংস্কার, লোকজন, নৃতাত্ত্বিক ইতিবৃত্ত, মানুষের বিশ্বাস, চরিত্রের ভাঙচুর, এনজিও’র কর্কশ হাতের থাবা, প্রেম শুরু-শেষের আবহ নানাভাবে এসেছে। এখানে খেয়াল করলেই দেখবেন, গ্রামীণ জীবন, মিথ, কল্পকথা, চরিত্রের আবহেও জাদুর একটা বিষয় রাখতে চেয়েছি। হয়ত এ গল্পটি দিয়েই আমি রিয়েলিস্টিক জগৎ ছেড়ে ক্রমশ জাদুর জগতে ঢুকছি।
গল্পটির চরিত্রগুলো কিভাবে এসেছে? শুরুতে কতটি চরিত্র এসেছিল? তারা কি শেষ পর্যন্ত থেকেছে? আপনি কি বিশেষ কোনো চরিত্রকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন? তাদের মধ্যে কি আপনার নিজের চেনা জানা কোনো চরিত্র এসেছে? অথবা নিজে কি কোনো চরিত্রের মধ্যে চলে এসেছেন?
হ্যাঁ, এখানে নিজের কিছু চেনা চরিত্র এসেছে। এমনকি এর এক চরিত্র হচ্ছে জাফর যার মাধ্যমে আমার ডাকনামের সাথে একধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বা করতে চেয়েছি। আমার এলাকার নাম রাখতে চেয়েছি। বাবা এখানে নাই, কিন্তু বাড়ির স্মৃতিতে প্রচণ্ডভাবে আছে। জলখেলি নদী আছে, আসলে এটি আমাদের বাড়ির একেবারে পাশ দিয়ে বয়ে চলা তেজখালি নামের বড়ো ধরনের একটা খাল। নদী করে দিয়েছি আর-কি। মৌচাক, সংস্কার, গন্ধ ইত্যাদি নিজের সৃষ্টি। নানাদিক থেকে হয়ত নেয়া আর-কি। দেয়া-নেয়ার কায়দা ছাড়া তো গল্প হয় না,Ñ একধরনের চৌর্যবৃত্তি বলতে পারেন হাহাহা।
গল্প’র শুরুতে অনেক চরিত্র থেকেছে, অনেকেই সরে পড়েছেন। সকলেই তো আর কথা রাখে না। যেমন, সোহাগী চরিত্র বলে কেউ নেয়, হয়ত আছে। একধরনের মাযা তো এ চরিত্রের প্রতি আছেই। হয়ত সারাজীবনই থাকবে। কেন থাকবে, তা তো বলতে পারব না। এ চরিত্রটি আমি অনেক গুরুত্ব দিয়ে নির্মাণ করেছি। যদিও তা গল্পে তেমন নেই। অথবা আছে, যা আমি ধরতেই পারছি না। এ চরিত্র হয়ত চেনাজানা এক চরিত্র, এমনই চেনাজানা যা ঠিক করতে চাইলে হয়ত আমার নিশ্বাসকে জিজ্ঞেস করতে হবে, আমার রক্তপ্রবাহকে জিজ্ঞেস করতে হবে। এমনকি আমার জীবনের সামগ্রিক আয়োজনকেই জিজ্ঞেস করে নিতে হবে। হয়ত তার সমাধান আছে, অথবা জাফর কার্যত গল্পের মতোই স্বপ্নহীন মানুষ থেকে যাবে।
গল্পপাঠ ৪. এই গল্পগুলোর দ্বন্দ্ব-সংঘাত কিভাবে নির্মাণ করেছেন?
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়ত আমার জীবনযাপন বা নৈতিকতার ইতিহাস থেকে নেয়া। তা আদৌ আছে কিনা তা আমি হলফ করে বলতে পারব না। তবে তা থাকার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ তখনও রাজনৈতিক বিশ্বাসকেই কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগাতে চেয়েছি। একটা দ্বন্দ্ব না থাকলে সামগ্রিক জীবন হতো কী করে! সমাজ যেখানে শ্রেণীবিভক্ত, রাষ্ট্র যেখানে তার পছন্দের শ্রেণীকে ভালোবাসে; সেখানে কাইজা-ফ্যাসাদ তো অনিবার্য। এখনও তাই মনে করি। তবে এখন তা প্রকাশে অনেক গণতান্ত্রিক হতে মন চায়। মানুষকে ভিতর থেকে শুধরানোর একটা ব্যাপার থাকতে পারে। পলিটিক্যাল ক্যাডারিশিপ এখন আর ভালো লাগে না। শিল্পের আলাদা জগৎ থাকা দরকার।
গল্পপাঠ ৫.গল্পের পরিণতিটা নিয়ে কি আগেই ভেবে রেখেছিলেন?
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : তা একরকম ভাবাই ছিল। কারণ আমি তো নিজেকে পিষে ফেলার একটা কায়দার কাছে সমর্পণ করেই গল্পটি নির্মাণ শুরু করি। এ গল্প আমার সব কথা শুনেছে। কারণ তা শোনানো দরকার বল মনে করেছিলাম। নিজেকে একধরনের নির্মাণের ভিতর রাখতে চেয়েছি। চরিত্রের প্রতি মায়াটা খুব আছে এখানে।
গল্পপাঠ ৬. গল্পটি কদিন ধরে লিখেছেন? এর ভাষা ভঙ্গিতে কি ধরনের শৈলী ব্যবহার করেছেন?
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : এটি লিখতে তো গল্প লেখার আগের পুরোটা জীবনই এর পিছনে খরচ করেছি বলা যায়। একহিসাবে গল্প লেখার আগের জীবন হয়ত পুরোটাই এখানে আছে। তবে আক্ষরিক লেখালেখিটা ধরেন মাসখানেক লেগেছে। অনেক শ্রম আছে এখানে। গল্পে প্রচুর খাত এসেছে। এখন হয়ত এত জিনিস দিয়ে গল্প নির্মাণ করতেই পারব না। সময়ই হয়ত আমায় বদলে দিয়েছে। কাজেই এই সময়ে এ গল্পের সার্বিক আলাপ হয়ত যথাযথও হবে না। কারণ গল্পটি লেখার মনোতাড়না আমার ভিতর তো সেইভাবে নাইই। ভাষাভঙ্গিটা এখানে রিয়েলিস্টিক ইমেজের সাথে স্বপ্নবাস্তবতা মিলেছে। ফলত, একধরনের মোচড় হয়ত এখানে পাঠক পাবেন।
গল্পপাঠ ৭. গল্পটিতে কি কিছু বলতে চেয়েছিলেন?
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : মোদ্দা কথা হচ্ছে, জীবনকে শেষ পর্যন্ত স্বপ্নময় রাখতে হয়। স্বপ্নকে লালন করতে হয়। পরজীবী অর্থনীতি যে স্বপ্নকে একেবারে নাড়িয়ে সরিয়ে কাঁপিয়ে দিচ্ছে, এ নিয়ে সতর্কও থাকা দরকার। এভাবে যদি বলা হয়, তাহলে তা বলাই হয়। তবে গল্পে এত কথা বলে লাভ কি,Ñ এখন আমি এইভাবেও ভাবি।
গল্পপাঠ ৮. গল্পটি লেখার পরে কি আপনি সন্তুষ্ট হয়েছেন? আপনি কি মনে করেন--আপনি যা লিখতে চেয়েছিলেন, তা লিখতে পেরেছেন এই গল্পটিতে?
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : সব গল্পেই আমি সন্তুষ্টই থাকি। তবে যে কোনো গল্প ফাইনালি লেখার পর আর তা পড়তে ইচ্ছা করে না। তখন মনে হতে থাকে, আমি আসলে কিছুই করতে পারলাম না। কিন্তু এতদিন পর, এটি তো ১৯০৩-এর দিকে লেখা, আবার এটিকে পড়ে বেশ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছিলাম। মনে জচ্ছিল, এ ধরনের গল্প হয়ত আর আমি লিখতে পারব না, অবাক হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে, এমন একটা সামগ্রিক আয়োজনের গল্পও আমি লিখে ফেলতে পেরেছিলাম। হায়, কত ধৈর্য আমার ছিল!
গল্পপাঠ ৯. এই গল্পটি পাঠক কেনো পছন্দ করে বলে আপনার মনে হয়?
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : পাঠক গল্পটি তার বৈচিত্রের জন্য মনে হয় পাঠ করেছে,Ñ আমি যে টুকু জেনেছি, তাতে জীবনের এর ভিতরকার ব্যাপকতা যেমন পাঠক পছন্দ করেছে, দাড়িতে মৌচাষ, বাড়ির এমন পরিণতি, সোহাগীর অতি মানবিক অবস্থান পাঠক পছন্দ করেছে।
লেখক পরিচিতি
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
জন্ম ১৯৬৩-এ, মামাবাড়িতে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থানার সরিষাপুর গ্রামে শৈশব-কৈশোর, যৌবনের প্রাথমিক পর্যায়ও কাটান তিনি। স্কুল-কলেজের পড়াশোনা করেছেন গ্রাম ও গ্রামঘেঁষা শহরে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে একাডেমিক পড়াশুনা করেন চট্টগ্রামে। লেখাজোখা তাঁর কাছে অফুরন্ত এক জীবনপ্রবাহের নাম। মানুষের অন্তর্জগতে একধরনের প্রগতিশীল বোধ তৈরিতে তাঁর আকাক্সক্ষা লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন জায়গায় Ñ ছোট বা বড়োকাগজে তিনি লিখে যাচ্ছেন।
কথাসাহিত্যের ছোটকাগজ কথা-র সম্পাদক তিনি। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ--মৃতের
কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম। (জাগৃতি প্রকাশনী),
স্বপ্নবাজি (ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ), কতিপয় নিম্নবর্গীয় গল্প (শুদ্ধস্বর)। উপন্যাস --পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী(মাওলা ব্রাদার্স), যখন তারা যুদ্ধে (জোনাকী)। উপন্যাসের বিনির্মাণ, উপন্যাসের জাদু (জোনাকী), গল্পের গল্প (জোনাকী), কথাশিল্পের জল-হাওয়া (শুদ্ধস্বর)।
প্রকাশিব্য গ্রন্থ >
১. দেশ-বাড়ি
: শাহবাগ (উপন্যাস/ প্রকাশক শুদ্ধস্বর)
২. কথা’র
কথা (সাক্ষাৎকারমূলক গ্রন্থ/ প্রকাশক আগামী প্রকাশনী)
৩. ভালোবাসা সনে আলাদা সত্য রচিত হয় (গল্পগ্রন্থ/ জোনাকি প্রকাশনী)
0 মন্তব্যসমূহ