রেজা ঘটক
তাকে দোষী সাবাস্থ করার আগে আমরা যদি তার একটা কাল্পনিক বায়োগ্রাফি প্রস্তুত করতে পারি, তাহলে ব্যাপারটা বুঝতে হয়তো আমাদের সুবিধা হবে। আরেকটা জিনিস আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে কিনা যে, পরবর্তী প্রজন্মের কোনো অনুসন্ধানী গবেষক আমাদেরকে যদি পাল্টা প্রশ্ন করে এটা প্রমান করতে সক্ষম হয় যে তাকে হত্যার জন্য বিচারের দায়ভার তোমরা কেমন করে পেলে, সেইসব প্রশ্নের কোনো প্রত্যুত্তর আমাদের জানা আছে কিনা, অথবা আমরা সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা রেখে যাবো কিনা? নতুবা তখন যদি আমাদের আত্মার উপরে তাকে হত্যার জন্য পাল্টা বিচারকার্য অনুষ্ঠিত হয় এবং আমরা যদি তখন দোষী সাব্যস্ত হই, তখন কি উত্তর প্রজন্ম আমাদের কবরের এপিটাপে খোদাই করে রাখবে যে নির্দোষ ব্যক্তিকে হত্যার জন্য এরাই দায়ী ছিল অথবা সংক্ষেপে স্রেফ একটি শব্দ- পাপী। তখনকার প্রজন্মের চিন্তাবিদদের-ইবা ঠিক কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে, যা কি আমরা মোটেও কল্পনা করতে পারি?
আমাদের ভাগ্য খুব ভালো যে, লোকটা মোটেও অসৎ নয় আর সে জীবনে কখনো বানিয়েও মিথ্যা বলতে রাজী ছিল না। বরং তার ওই অহংকার আর নেহাত ধর্মকে অস্বীকার করার জন্য তার ফাঁসির হুকুম হল আর তৃষ্ণার্ত যূপকাঠে দাঁড়ানোর আগে পৃথিবীর উদ্দেশ্যে সে কি এমন রহস্যময় বাণী ছুঁড়ল অথবা স্রেফ নির্বাক থাকল যে, তার পরিনতি আমরা এখনো ভোগ করছি। তার সেই রহস্যময় বাণী অথবা নির্বাক চোখের ভাষা আমরা কেউ কি আজ পর্যন্ত অনুবাদ করতে পেরেছি? যা হয়তো যারা বুঝতে পারছে তারাই শুধু তা অনুসরন করছে আর সমগ্র জাতিকে একটা কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আমরা এখনো জানি না বা অনুমান করতে পারি না পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ সেইসব রহস্যময় অনুচ্চারিত শব্দগুলো কিভাবে বর্ননা করবে। তবু একুশ বছর পর আবারো যখন তার কথা উঠলো আমরা দায়ভার এড়ানোর প্রচেষ্টা হিসাবে কিছু ব্যাখ্যা এখানে হয়তো রেখে যাবো। আর আমাদের এখনো একথা স্বীকার করতে হবে যে, লোকটা ছিল সহজ সরল গোবেচারা টাইপের এক খাঁটি আদমি। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখেও কেমন একঘুয়ে গোঁয়ার্তুমিটা সে দিগ্বিজয়ীর মত আগলে রেখেছিল। তার পরিনতি নিয়ে আমরা শুধু একথা বলতে পারি যে, মানুষ হয়তো একদিন তাকে নিয়ে খুব আফসোস করবে অথবা চলমান বাস্তবতায় অন্য অনেকের মতো সেও হারিয়ে যাবে এবং পৃথিবীবাসী কখনোই তার নাম আর উচ্চারন করবে না। আবার উল্টো যদি তার ওই ব্যতিক্রমী বলিদানকে কেউ কেউ মহাবীরের পর্যায়ে তুলনা করে এবং দেশের সবচেয়ে উত্তাল নদীকে তার নামে নামকরন করা হয় তাহলেও হয়তো আমরা অবাক হবো না। আবার হয়তো কেউ যদি তার ওই নির্মোহ বলিদানকে স্রেফ দুঃস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেয় তখনও আমাদের হয়তো কিছুই বলার থাকবে না।
নদীর পাশে জন্ম হওয়ায় তার বেড়ে ওঠার ইতিহাস আমরা জানি। প্রকৃতির স্বাভাবিক রীতির একটু উলোট-পালোট হলেই সে বড়ো বিচলিত হতো। যদিও তার দুর্দান্ত দুঃসাহসের কথা এখনো যারা তার বিরুদ্বাচারন করে তারাও উচ্চকণ্ঠে স্বীকার করে। হাঁটতে শেখার আগে সাঁতার শেখা লোকটি কোনোদিন হয়তো ভাবতেও পারেনি নদী থেকে অনেক দূরে কোনো জনাকীর্ন নগরে তার একদিন এভাবে এক ভরা চাঁদনী রাতে ফাঁসি হবে। আর তার ফাঁসির দিনে সারা শহরে উজানের মতো মানুষ ছুটবে আর স্ফুর্তিতে তারা প্রলয় নৃত্য করবে। শুধুমাত্র ধর্মকে অস্বীকার করার দুঃসাহসের জন্য তাকে যে অমোন পরিনতি বরণ করতে হতে পারে, তা হয়তো লোকটি আগেভাগেই জানতো। তবু তার কথা যখন বলছি তখন আমাদের খুব দুঃখ হয় এই ভেবে যে স্রেফ হাড্ডিসার গড়নের দৃঢ়চেতা লোকটা কেমন বেকুবের মতো অসহায় প্রাণ বিসর্জন দিল জন সমুদ্রে ঘেরা উত্তাল কোলাহলের মধ্যে। রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন আগেভাগেই ঠিক করে রেখেছিল যে একেবারে মধ্যরাতের কাঁটায় কাঁটায় বারোটা এক মিনিট বাজার সাথে সাথে লোকটাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। আর সেই দৃশ্য যাতে উৎসুক শহরবাসী সরাসরি প্রত্যক্ষ করতে পারে সেজন্য স্বাধীনতা চত্বরের উন্মুক্ত মঞ্চেই তাকে ফাঁসি দেওয়া হলো। যদিও মধ্যরাত্রি বারোটা বাজার অনেক আগেই সারা শহর থেকে দলে দলে নানান বাদ্যযন্ত্র নিয়ে উৎসুক জনতার ভিড় বেড়েছিল স্বাধীনতা চত্বরে। আর অমোন উন্মুক্ত ফাঁসির দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার জন্য সেদিন নগরপিতাও নগরে বিশেষ ছুটি ঘোষণা করেছিলেন, যাতে সাধারণ জনতাও বিষয়টি বেশ আনন্দের সাথে উদযাপন করতে পারে। পৃথিবীর অন্তত কয়েকশো দেশের গণমাধ্যমের লোকজন অমোন দুর্লভ ফাঁসির দৃশ্য সরাসরি ধারণ করার জন্য আগাম বিমানের টিকিট নিলেন। আর একথা আমরা এখন নিশ্চিত করেই জানি যে লোকটার সেই ফাঁসি থেকে সে বছরই সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা আয় হয়েছিল রাষ্ট্রের সারা বছর লোকসানে থাকা সিভিল এভিয়েশন বিভাগের। আর বিদেশি গণমাধ্যমের যারা অন্তত এক ঢিলে দুই পাখি মারায় ওস্তাদ, তাদের কেউ কেউ স্বাধীনতা চত্বরে বিশেষভাবে নির্মিত ফাঁসির মঞ্চের খুব কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে গোটা দৃশ্য ধারণ করার পাশাপাশি উপস্থিত জনতারও প্রতিক্রিয়া নিচ্ছিল। কিন্তু একটা ব্যাপারে তারা রহস্য উন্মোচনের প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছিল যে, স্বাধীনতা গানের নতুন সুরকার হিসেবে ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা পাওয়া লোকটার বিরুদ্ধে কেন গোটা রাষ্ট্র অমোন তড়িঘড়ি একটা বিচারকার্য শেষ করেছিল। আর আত্মপক্ষ সমর্থনের চিরাচরিত সুযোগ থাকলেও লোকটা কেন সেই সুযোগকেও প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাদের কাছে একটা জিনিস একেবারেই রহস্যময় থাকলো যে রাষ্ট্রীয় আইনে ধর্মকে যেভাবে বিবেচনায় নেয়া হয় সেই তুলনায় লোকটার গোঁয়ার্তুমির মাত্রা-ইবা কতোটুকু ছিল? তবু ফাঁসিতে লোকটাকে টানা একুশ মিনিট ছুলিয়ে রাখা হয়েছিল। আর প্রচলিত ফাঁসিতে যেখানে দণ্ডপ্রাপ্তের দেহ ফাঁসিমঞ্চের নিচে চলে যায়, সেখানে লোকটার বেলায় তার দেহ মঞ্চ থেকে আড়াই ফুট উঁচুতে ঝুলে ছিল।
এ বিষয়ে কোনো কোনো পণ্ডিতের কিছু কিছু লেখা পরবর্তী সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশ পেলেও একটা পর্যায়ে তারাও যখন লোকটার পক্ষ ত্যাগ করল। আর তাদের নির্লজ্ব রাষ্ট্রপক্ষে ঝুঁকে যাবার পিছনে কিসের রহস্য ছিল তা অবশ্য কেউ আর মুখ ফুটে উচ্চারণ করল না। তবু আগাগোড়া নাস্তিক লোকটা যে গোটা গোটা বিশ্বেই নেহাত অল্প সময়ের জন্য হলেও একটা আলোচনার ঝড় তুলেছিল, তা ওই সপ্তাহের কাগজগুলো আর টেলিভিশন ফুটেজ দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়। এমন কি একেবারে কট্টর ধর্মীয় রাষ্ট্রগুলোর গণমাধ্যমেও লোকটার প্রতি দু’একবার করুণার আহবান থাকলেও, সে বিষয়ে ভীষণ একরোখা লোকটা একবারও প্রতিক্রিয়া দেখায় নি।
সবচেয়ে বেশি ঝামেলা হয়েছিল ফাঁসির পরে লোকটার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিয়ে খোদ রাষ্ট্র যখন বিপাকে পড়ল তখন। বিচারকদের কাছে শেষ অভিপ্রায় হিসেবে লোকটা নাকি আবদার করেছিল, তার মৃতদেহ যেনো চিকিৎসা সেবায় উৎসর্গ করা হয়। অথচ লোকটার মৃতদেহকে যখন কবরস্থ করার প্রক্রিয়া চলছিল তখন বিদেশি গণমাধ্যমের রিপোর্টারদের প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রপক্ষ তা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। আর শেষ পর্যন্ত লোকটার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যে ওভাবে বিলম্বিত হবে, আর তা নিয়ে তিন সপ্তাহ পর রাষ্টপক্ষকে গণভোটের আয়োজন করতে হবে, তা হয়তো আগেভাগে কেউই অনুমান করতে পারেনি। আর পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো মৃতব্যক্তির লাশ নিয়ে কোনো রাষ্ট্রের গণভোট আয়োজনের ব্যাপারটা সেবারই প্রথম ঘটায়, পরবর্তীতে কেউ কেউ যখন এমোন অভিমত রাখতে শুরু করল যে, শয়তান লোকটা মারা গেলেও আমাদেরকে কেমন উৎকণ্ঠার মধ্যে রেখে গেল। হয়তো তার পাপিষ্ঠ আত্মা আমাদের এইসব পাগলামি দেখে দূরে কোথাও বসে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
এসবের মধ্যে আবার শহরের যেসব রাস্তা দিয়ে লোকটা নিয়মিত যাতায়াত করতো, সিটি করপোরেশানের বিশেষ উদ্যোগে সেই সকল রাস্তা বিশেষ ব্যবস্থায় ধোয়া মোছা করা হল। যদিও ওটা ছিল হয়তো কট্টরপন্থী কিছু ধার্মীক লোকদের পাগলামি বা খামখেয়ালিপনা। যা মানুষ কেবল বেশ উৎসাহ নিয়েই দেখল। কিন্তু অমোন উৎসাহের মধ্যে ঠিক একুশ দিন পরে যখন সত্যি সত্যি লোকটাকে সমাধিস্থ করা হল, তখন তার প্রতিবাদে স্বাধীনতা চত্বরের ঠিক যেখানে লোকটার ফাঁসির মঞ্চ করা হয়েছিল, তার পাশে গিয়ে একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা আত্মাহুতি দিল। তখন নতুন করে সারা শহরে লোকটা সম্পর্কে আবারো রহস্য আর আতংক শুরু হল সবার মনে। আর ঠিক পরবর্তী একুশ দিনের মাথায় নগরবাসী আবারো আরো দুই জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার আত্মাহুতি প্রত্যক্ষ করল ঠিক স্বাধীনতা চত্বরের আশেপাশে। তখন সারা শহরে সবার মধ্যে একটা গুজব ছড়ালো যে, হয়তো বদমায়েশ লোকটা গোপনে তার কিছু অনুসারী রেখে গেছে। আর তারা সবাই কেবল ওইভাবে আত্মহুতি দেবে। পরবর্তী একুশ দিনের মাথায় অর্থাৎ লোকটার ফাঁসি কার্যকর হবার ঠিক তেষট্টিতম দিনে যখন আবারো চার জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা স্বাধীনতা চত্বরে একইভাবে আত্মাহুতি দিল, তখন রাষ্ট্রপক্ষের খেয়াল হলো যে, ঘটনার সঙ্গে 'একুশ' সংখ্যাটির একটা রহস্যময় মিল রয়েছে।
শেষ পর্যন্ত দেশের আইনসভায় একটা অদ্ভুত আইন পাশের জন্য যখন জনপ্রতিনিধিরা পরস্পর তুমুল বিতর্কে লিপ্ত, ঠিক তখন সেখানে খবর পৌঁছালো যে বিশেষ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বেষ্টনির তোয়াক্কা না করেই শহরের বাইরে অন্তত আটজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা আত্মাহুতি দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আইনসভায় যে আইনটি পাশ করা হলো সেটি ছিল, লোকটার করা স্বাধীনতা গানের নতুন সুরটি পরিবর্তন করা হবে। আর স্বাধীনতা চত্বরে কোনো প্রেমিক-প্রেমিকা জুটির প্রবেশাধিকার থাকবে না।
আইনসভায় পাশ করা নতুন এই আইন নিয়ে পরবর্তী সময়ে সারা শহর তখন প্রতিবাদ মিছিলে উত্তাল। তাদের দাবী, লোকটার করা স্বাধীনতা গানের নতুন সুরটি কিছুতেই পরিবর্তন করা যাবে না। আর স্বাধীনতা চত্বর সবার জন্যই উন্মুক্ত রাখতে হবে। রাষ্ট্রপক্ষ দাবী না মানলে প্রতিবাদকারীরা সবাই একযোগে আত্মাহুতি দেবে বলেও হুঁসিয়ারি দিল। সেই থেকেই লোকটার নাম নতুন করে সবাই আবার জানার চেষ্টা করছে।
এখন আমরা স্বাধীনতা চত্বরে যে শিখা অনির্বাণ দেখি, কারো করো অভিমত লোকটার আত্মাকে যথেষ্ঠ সাজা দেবার জন্য ওটা নাকি গনতন্ত্রপন্থীদের একটা নেহাত কারসাজি...
কাঁঠালবাগান, ঢাকা ৩১ শে ডিসেম্বর ২০০৯
তাকে দোষী সাবাস্থ করার আগে আমরা যদি তার একটা কাল্পনিক বায়োগ্রাফি প্রস্তুত করতে পারি, তাহলে ব্যাপারটা বুঝতে হয়তো আমাদের সুবিধা হবে। আরেকটা জিনিস আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে কিনা যে, পরবর্তী প্রজন্মের কোনো অনুসন্ধানী গবেষক আমাদেরকে যদি পাল্টা প্রশ্ন করে এটা প্রমান করতে সক্ষম হয় যে তাকে হত্যার জন্য বিচারের দায়ভার তোমরা কেমন করে পেলে, সেইসব প্রশ্নের কোনো প্রত্যুত্তর আমাদের জানা আছে কিনা, অথবা আমরা সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা রেখে যাবো কিনা? নতুবা তখন যদি আমাদের আত্মার উপরে তাকে হত্যার জন্য পাল্টা বিচারকার্য অনুষ্ঠিত হয় এবং আমরা যদি তখন দোষী সাব্যস্ত হই, তখন কি উত্তর প্রজন্ম আমাদের কবরের এপিটাপে খোদাই করে রাখবে যে নির্দোষ ব্যক্তিকে হত্যার জন্য এরাই দায়ী ছিল অথবা সংক্ষেপে স্রেফ একটি শব্দ- পাপী। তখনকার প্রজন্মের চিন্তাবিদদের-ইবা ঠিক কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে, যা কি আমরা মোটেও কল্পনা করতে পারি?
আমাদের ভাগ্য খুব ভালো যে, লোকটা মোটেও অসৎ নয় আর সে জীবনে কখনো বানিয়েও মিথ্যা বলতে রাজী ছিল না। বরং তার ওই অহংকার আর নেহাত ধর্মকে অস্বীকার করার জন্য তার ফাঁসির হুকুম হল আর তৃষ্ণার্ত যূপকাঠে দাঁড়ানোর আগে পৃথিবীর উদ্দেশ্যে সে কি এমন রহস্যময় বাণী ছুঁড়ল অথবা স্রেফ নির্বাক থাকল যে, তার পরিনতি আমরা এখনো ভোগ করছি। তার সেই রহস্যময় বাণী অথবা নির্বাক চোখের ভাষা আমরা কেউ কি আজ পর্যন্ত অনুবাদ করতে পেরেছি? যা হয়তো যারা বুঝতে পারছে তারাই শুধু তা অনুসরন করছে আর সমগ্র জাতিকে একটা কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আমরা এখনো জানি না বা অনুমান করতে পারি না পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ সেইসব রহস্যময় অনুচ্চারিত শব্দগুলো কিভাবে বর্ননা করবে। তবু একুশ বছর পর আবারো যখন তার কথা উঠলো আমরা দায়ভার এড়ানোর প্রচেষ্টা হিসাবে কিছু ব্যাখ্যা এখানে হয়তো রেখে যাবো। আর আমাদের এখনো একথা স্বীকার করতে হবে যে, লোকটা ছিল সহজ সরল গোবেচারা টাইপের এক খাঁটি আদমি। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখেও কেমন একঘুয়ে গোঁয়ার্তুমিটা সে দিগ্বিজয়ীর মত আগলে রেখেছিল। তার পরিনতি নিয়ে আমরা শুধু একথা বলতে পারি যে, মানুষ হয়তো একদিন তাকে নিয়ে খুব আফসোস করবে অথবা চলমান বাস্তবতায় অন্য অনেকের মতো সেও হারিয়ে যাবে এবং পৃথিবীবাসী কখনোই তার নাম আর উচ্চারন করবে না। আবার উল্টো যদি তার ওই ব্যতিক্রমী বলিদানকে কেউ কেউ মহাবীরের পর্যায়ে তুলনা করে এবং দেশের সবচেয়ে উত্তাল নদীকে তার নামে নামকরন করা হয় তাহলেও হয়তো আমরা অবাক হবো না। আবার হয়তো কেউ যদি তার ওই নির্মোহ বলিদানকে স্রেফ দুঃস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেয় তখনও আমাদের হয়তো কিছুই বলার থাকবে না।
নদীর পাশে জন্ম হওয়ায় তার বেড়ে ওঠার ইতিহাস আমরা জানি। প্রকৃতির স্বাভাবিক রীতির একটু উলোট-পালোট হলেই সে বড়ো বিচলিত হতো। যদিও তার দুর্দান্ত দুঃসাহসের কথা এখনো যারা তার বিরুদ্বাচারন করে তারাও উচ্চকণ্ঠে স্বীকার করে। হাঁটতে শেখার আগে সাঁতার শেখা লোকটি কোনোদিন হয়তো ভাবতেও পারেনি নদী থেকে অনেক দূরে কোনো জনাকীর্ন নগরে তার একদিন এভাবে এক ভরা চাঁদনী রাতে ফাঁসি হবে। আর তার ফাঁসির দিনে সারা শহরে উজানের মতো মানুষ ছুটবে আর স্ফুর্তিতে তারা প্রলয় নৃত্য করবে। শুধুমাত্র ধর্মকে অস্বীকার করার দুঃসাহসের জন্য তাকে যে অমোন পরিনতি বরণ করতে হতে পারে, তা হয়তো লোকটি আগেভাগেই জানতো। তবু তার কথা যখন বলছি তখন আমাদের খুব দুঃখ হয় এই ভেবে যে স্রেফ হাড্ডিসার গড়নের দৃঢ়চেতা লোকটা কেমন বেকুবের মতো অসহায় প্রাণ বিসর্জন দিল জন সমুদ্রে ঘেরা উত্তাল কোলাহলের মধ্যে। রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন আগেভাগেই ঠিক করে রেখেছিল যে একেবারে মধ্যরাতের কাঁটায় কাঁটায় বারোটা এক মিনিট বাজার সাথে সাথে লোকটাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। আর সেই দৃশ্য যাতে উৎসুক শহরবাসী সরাসরি প্রত্যক্ষ করতে পারে সেজন্য স্বাধীনতা চত্বরের উন্মুক্ত মঞ্চেই তাকে ফাঁসি দেওয়া হলো। যদিও মধ্যরাত্রি বারোটা বাজার অনেক আগেই সারা শহর থেকে দলে দলে নানান বাদ্যযন্ত্র নিয়ে উৎসুক জনতার ভিড় বেড়েছিল স্বাধীনতা চত্বরে। আর অমোন উন্মুক্ত ফাঁসির দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার জন্য সেদিন নগরপিতাও নগরে বিশেষ ছুটি ঘোষণা করেছিলেন, যাতে সাধারণ জনতাও বিষয়টি বেশ আনন্দের সাথে উদযাপন করতে পারে। পৃথিবীর অন্তত কয়েকশো দেশের গণমাধ্যমের লোকজন অমোন দুর্লভ ফাঁসির দৃশ্য সরাসরি ধারণ করার জন্য আগাম বিমানের টিকিট নিলেন। আর একথা আমরা এখন নিশ্চিত করেই জানি যে লোকটার সেই ফাঁসি থেকে সে বছরই সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা আয় হয়েছিল রাষ্ট্রের সারা বছর লোকসানে থাকা সিভিল এভিয়েশন বিভাগের। আর বিদেশি গণমাধ্যমের যারা অন্তত এক ঢিলে দুই পাখি মারায় ওস্তাদ, তাদের কেউ কেউ স্বাধীনতা চত্বরে বিশেষভাবে নির্মিত ফাঁসির মঞ্চের খুব কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে গোটা দৃশ্য ধারণ করার পাশাপাশি উপস্থিত জনতারও প্রতিক্রিয়া নিচ্ছিল। কিন্তু একটা ব্যাপারে তারা রহস্য উন্মোচনের প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছিল যে, স্বাধীনতা গানের নতুন সুরকার হিসেবে ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা পাওয়া লোকটার বিরুদ্ধে কেন গোটা রাষ্ট্র অমোন তড়িঘড়ি একটা বিচারকার্য শেষ করেছিল। আর আত্মপক্ষ সমর্থনের চিরাচরিত সুযোগ থাকলেও লোকটা কেন সেই সুযোগকেও প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাদের কাছে একটা জিনিস একেবারেই রহস্যময় থাকলো যে রাষ্ট্রীয় আইনে ধর্মকে যেভাবে বিবেচনায় নেয়া হয় সেই তুলনায় লোকটার গোঁয়ার্তুমির মাত্রা-ইবা কতোটুকু ছিল? তবু ফাঁসিতে লোকটাকে টানা একুশ মিনিট ছুলিয়ে রাখা হয়েছিল। আর প্রচলিত ফাঁসিতে যেখানে দণ্ডপ্রাপ্তের দেহ ফাঁসিমঞ্চের নিচে চলে যায়, সেখানে লোকটার বেলায় তার দেহ মঞ্চ থেকে আড়াই ফুট উঁচুতে ঝুলে ছিল।
এ বিষয়ে কোনো কোনো পণ্ডিতের কিছু কিছু লেখা পরবর্তী সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশ পেলেও একটা পর্যায়ে তারাও যখন লোকটার পক্ষ ত্যাগ করল। আর তাদের নির্লজ্ব রাষ্ট্রপক্ষে ঝুঁকে যাবার পিছনে কিসের রহস্য ছিল তা অবশ্য কেউ আর মুখ ফুটে উচ্চারণ করল না। তবু আগাগোড়া নাস্তিক লোকটা যে গোটা গোটা বিশ্বেই নেহাত অল্প সময়ের জন্য হলেও একটা আলোচনার ঝড় তুলেছিল, তা ওই সপ্তাহের কাগজগুলো আর টেলিভিশন ফুটেজ দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়। এমন কি একেবারে কট্টর ধর্মীয় রাষ্ট্রগুলোর গণমাধ্যমেও লোকটার প্রতি দু’একবার করুণার আহবান থাকলেও, সে বিষয়ে ভীষণ একরোখা লোকটা একবারও প্রতিক্রিয়া দেখায় নি।
সবচেয়ে বেশি ঝামেলা হয়েছিল ফাঁসির পরে লোকটার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিয়ে খোদ রাষ্ট্র যখন বিপাকে পড়ল তখন। বিচারকদের কাছে শেষ অভিপ্রায় হিসেবে লোকটা নাকি আবদার করেছিল, তার মৃতদেহ যেনো চিকিৎসা সেবায় উৎসর্গ করা হয়। অথচ লোকটার মৃতদেহকে যখন কবরস্থ করার প্রক্রিয়া চলছিল তখন বিদেশি গণমাধ্যমের রিপোর্টারদের প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রপক্ষ তা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। আর শেষ পর্যন্ত লোকটার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যে ওভাবে বিলম্বিত হবে, আর তা নিয়ে তিন সপ্তাহ পর রাষ্টপক্ষকে গণভোটের আয়োজন করতে হবে, তা হয়তো আগেভাগে কেউই অনুমান করতে পারেনি। আর পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো মৃতব্যক্তির লাশ নিয়ে কোনো রাষ্ট্রের গণভোট আয়োজনের ব্যাপারটা সেবারই প্রথম ঘটায়, পরবর্তীতে কেউ কেউ যখন এমোন অভিমত রাখতে শুরু করল যে, শয়তান লোকটা মারা গেলেও আমাদেরকে কেমন উৎকণ্ঠার মধ্যে রেখে গেল। হয়তো তার পাপিষ্ঠ আত্মা আমাদের এইসব পাগলামি দেখে দূরে কোথাও বসে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
এসবের মধ্যে আবার শহরের যেসব রাস্তা দিয়ে লোকটা নিয়মিত যাতায়াত করতো, সিটি করপোরেশানের বিশেষ উদ্যোগে সেই সকল রাস্তা বিশেষ ব্যবস্থায় ধোয়া মোছা করা হল। যদিও ওটা ছিল হয়তো কট্টরপন্থী কিছু ধার্মীক লোকদের পাগলামি বা খামখেয়ালিপনা। যা মানুষ কেবল বেশ উৎসাহ নিয়েই দেখল। কিন্তু অমোন উৎসাহের মধ্যে ঠিক একুশ দিন পরে যখন সত্যি সত্যি লোকটাকে সমাধিস্থ করা হল, তখন তার প্রতিবাদে স্বাধীনতা চত্বরের ঠিক যেখানে লোকটার ফাঁসির মঞ্চ করা হয়েছিল, তার পাশে গিয়ে একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা আত্মাহুতি দিল। তখন নতুন করে সারা শহরে লোকটা সম্পর্কে আবারো রহস্য আর আতংক শুরু হল সবার মনে। আর ঠিক পরবর্তী একুশ দিনের মাথায় নগরবাসী আবারো আরো দুই জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার আত্মাহুতি প্রত্যক্ষ করল ঠিক স্বাধীনতা চত্বরের আশেপাশে। তখন সারা শহরে সবার মধ্যে একটা গুজব ছড়ালো যে, হয়তো বদমায়েশ লোকটা গোপনে তার কিছু অনুসারী রেখে গেছে। আর তারা সবাই কেবল ওইভাবে আত্মহুতি দেবে। পরবর্তী একুশ দিনের মাথায় অর্থাৎ লোকটার ফাঁসি কার্যকর হবার ঠিক তেষট্টিতম দিনে যখন আবারো চার জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা স্বাধীনতা চত্বরে একইভাবে আত্মাহুতি দিল, তখন রাষ্ট্রপক্ষের খেয়াল হলো যে, ঘটনার সঙ্গে 'একুশ' সংখ্যাটির একটা রহস্যময় মিল রয়েছে।
শেষ পর্যন্ত দেশের আইনসভায় একটা অদ্ভুত আইন পাশের জন্য যখন জনপ্রতিনিধিরা পরস্পর তুমুল বিতর্কে লিপ্ত, ঠিক তখন সেখানে খবর পৌঁছালো যে বিশেষ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বেষ্টনির তোয়াক্কা না করেই শহরের বাইরে অন্তত আটজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা আত্মাহুতি দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আইনসভায় যে আইনটি পাশ করা হলো সেটি ছিল, লোকটার করা স্বাধীনতা গানের নতুন সুরটি পরিবর্তন করা হবে। আর স্বাধীনতা চত্বরে কোনো প্রেমিক-প্রেমিকা জুটির প্রবেশাধিকার থাকবে না।
আইনসভায় পাশ করা নতুন এই আইন নিয়ে পরবর্তী সময়ে সারা শহর তখন প্রতিবাদ মিছিলে উত্তাল। তাদের দাবী, লোকটার করা স্বাধীনতা গানের নতুন সুরটি কিছুতেই পরিবর্তন করা যাবে না। আর স্বাধীনতা চত্বর সবার জন্যই উন্মুক্ত রাখতে হবে। রাষ্ট্রপক্ষ দাবী না মানলে প্রতিবাদকারীরা সবাই একযোগে আত্মাহুতি দেবে বলেও হুঁসিয়ারি দিল। সেই থেকেই লোকটার নাম নতুন করে সবাই আবার জানার চেষ্টা করছে।
এখন আমরা স্বাধীনতা চত্বরে যে শিখা অনির্বাণ দেখি, কারো করো অভিমত লোকটার আত্মাকে যথেষ্ঠ সাজা দেবার জন্য ওটা নাকি গনতন্ত্রপন্থীদের একটা নেহাত কারসাজি...
কাঁঠালবাগান, ঢাকা ৩১ শে ডিসেম্বর ২০০৯
0 মন্তব্যসমূহ