শোয়াইব জিবরান কবি। এক সময় নিজে গল্প লিখতেন। লিখতেন বলে লেখা ছেড়ে দেননি। আবারও লিখবেন। তাঁর গবেষণার বিষয় লেখক কমলকুমার মজুমদার। এ বিষয়ে তিনি অভিসন্দর্ভ লিখেছেন।
গল্পপাঠে শোয়াইব জিবরান তার গল্পভাবনা নিয়ে আলাপচারিতা করেছেন। এখানেও স্বল্প পরিসরে হলেও তাঁর কমল-ভাব প্রকাশিত হয়েছে। তাঁকে এ বিষয়ে লিখতে বললে নিচের লেখাটি পাঠান। সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন এক টুকরো চিরকূট--
প্রশ্নগুলোর উত্তর জলদি পাঠালাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে গল্প লিখেছিলাম কতকগুলান। তারপর কবিতার ভেতর দিয়াই অবিরাম গল্প লিখে চলেছি। আপনের প্রথম জিকাইলেন, বাছা গল্প লিখো কেনে? ঐ যে গোল্ডেন বাও কিতাবে লেখা আছে- মানুষ গল্পের ভেতর বাস করে। বাস করছি গল্পেরই ভেতর। বাস্তবতাবোধও মাঝে মাঝে নাই। তারা দুচারটে কথা এইখানে বলা হইল।
ধুলোমাটির এই দেশ হইতে আপনেরে সালাম জানাই।
ধুলোমাটির এই দেশ হইতে আপনেরে সালাম জানাই।

শোয়াইব জিরবান
-------------------------------------------------------------------------------------------
গল্পপাঠ: আপনি শুরুতে কি পড়তেন?
শোয়াইব জিবরান: মা আমার সিলেটি নাগরি ভাষা জানতেন। তাঁর কাছে অনেকগুলি নাগরিপুঁথি ছিল। তিনি
সকালে সেগুলো পড়তেন। তখন
শীত নামতো। আমি লেপের ভেতরে শোয়া। তিনি পড়ে শুনাতেন। ইউসুফ- জুলেখার কাহিনী। প্রেম প্রত্যাখান করায় ইউসুফকে আটকে রাখা হয়েছে।চুরির মিথ্যে অভিযোগ তুলে তাঁকে অন্ধকার
কূপের পানিতে ফেলে দেয়া হবে। আমি উত্তেজনায় উঠে বসতাম।সিলেটি ভাষায় লিখিত গল্পগুলো শুনেই আমার গল্প
পড়ার নেশা তৈরি হয়। হাতের কাছে সে রকম গল্পের বই ছিল না। বাবা
কোন উপলক্ষে মাকে মকছোদুল মো’মেনিন বা স্বামীর প্রতি
স্ত্রীর কর্তব্য নামে একটা বই উপহার দিয়েছিলেন। ঔটাতে
স্বামীর প্রতি বিভিন্ন মহামতি নারীদের ঘটনার ছোট ছোট গল্প ছিল। সে গুলো
পড়তে শুরু করি। তবে সবচেয়ে উত্তেজনাকর অংশ ছিল- মিলনের বিভিন্ন
সহি নিয়ম নিয়ে বর্ণনামূলক অংশ। লুকিয়ে কী যে অজানা উত্তেজনা নিয়ে শিশু বয়েসে সে
গুলো পড়েছি। এভাবেই ন্যারেটিভ পড়া শুরু।
গল্পপাঠ: এর মধ্যে গল্প কখন পড়া শুরু করলেন?
শোয়াইব জিবরান: তখনকার স্কুল পাঠ্যবইগুলোতে
খুব সুন্দর সুন্দর গল্প থাকতো। জুলেখা বাদশার মেয়ে। ফরহাদের
ময়না। মিথ্যেবাদি রাখাল। এগুলো
দিয়েই আমার গল্প পড়া শুরু। তারপর বাড়িতে বড়চাচার সংগ্রহে বিদ্যাসাগরের আখ্যানমঞ্জুরী
ছিল। কঠিন কিন্তু অত্যন্ত মিষ্টিভাষা। প্রায়
কিছুই বুঝতাম না। তবু পড়তাম। একটা ঘোর লেগে যেতো।
গল্পপাঠ: গল্প কেনো পড়েন?
শোয়াইব জিরবার: উপন্যাসে বৃহৎ স্কেলে জীবনকে ধরা হয়। গল্পে
সে পরিসর থাকে বেশ ছোট। জীবনকে, মানুষকে বুঝার জন্য গল্প পড়ি।
গল্পপাঠ: জীবনে প্রথম কোন গল্পটি আপনাকে বেশী স্পর্শ
করেছিল? কেনো করেছিল?
শোয়াইব জিবরান: বিভূতিভূষণের
‘পথের পাঁচালী’র আম আাঁটির ভেপু নামে
একটা অংশ আমাদের নবম শ্রেণির দ্রুতপঠনে ছিল। এ লেখাটি
আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। সম্ভবত অপুর মধ্যে নিজেরে দেখতে পেয়েছিলাম।
গল্পপাঠ: গল্প পড়তেন কিভাবে? কোন কোন সময়ে? কোন কোন পরিবেশে? পরিবারের কেউ বা বন্ধু বা শিক্ষক কি কেউ গল্প পড়তে
উৎসাহিত করেছেন? একটি গল্প কিভাবে
পড়তে হয়--সেটা কি কেউ কখনো আপনাকে দেখিয়ে দিয়েছেন?

আমার পড়ালেখা জন্য শৈশবেই আলাদা একটি ঘর ছিল। সিলেটে
এ ঘরগুলোরে বলে কুঠাঘর। মূলঘরের একপ্রান্তে থাকে। নিরিবিলি। ছোট। সে ঘরেই
সাধাররণত আমার বেশিরভাই সময় কাটত। সেখানে শুয়ে বসেই অধিকাংশ গল্প পড়তাম। কোন
সময় নির্দিষ্ট করা ছিল না।
শৈশবে আবু কায়সার খান নামে কমিউনিস্ট
পার্টির এক নেতা ও কবির সাথে পরিচিত হই। তিনিই
বেশি পড়তে উৎসাহিত করতেন। তাঁর সংগ্রহে ছিল রাশি রাশি রাশিযান বই। সেগুলো
পড়তে দিতেন। চেখব, গোগল, অস্ত্রভস্কি,
টলস্টয়, গোর্কির লেখা বই তিনি আমারে নিয়মিত দিতেন। পড়তে
উৎসাহিত করতেন। পড়া শেষ হলে একটু খানি জেনে নিয়ে গল্পটি ব্যাখ্যা করতেন। যেমন
মা পড়ার পর বলেছিলেন, ওখানে পাভেলের বিপ্লবের স্বপ্নের সাথে মায়ের একাত্ব হয়ে ওঠাটি বড় বিষয়। তোমার
দেখার বিষয় লেখক সেটারে কীভাবে রূপদান করেছেন।
গল্পপাঠ: পড়ে কোনো গল্প ভালো লাগলে কি রকম অনুভূতি
হয়? আপনার কি কখনো মনে
হয়েছে গল্পের কোনো চরিত্র আপনার নিজের মত। বা চরিত্রটি আপনার
মধ্যে চলে এসেছে। কিছুদিন
তার মত করে চলাফেরা করতে শুরু করেছেন?
শোয়াইব জিবরান: একটা ঘোরের মধ্যে থাকি। শৈশবে ‘পথের পাঁচালী’
পড়ার পর অপু চরিত্রকে নিজের মতো মনে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনে কমলকুমারের কয়েদখানা পড়ার পর মনে হয়েছে দুচোখ অন্ধ করে এমনি চরিত্রটির মতো ভিক্ষে
করতে বেরিয়ে যাই। ভাগ্যিস তখন প্রেম করতাম। মেয়েটি ধরে রেখেছিল।
গল্পপাঠ: একটি গল্পের কি কি বিষয় আপনাকে টানে? অর্থাৎ একটি ভালো গল্প হয়ে উঠতে হলে গল্পের মধ্যে
কি কি বিষয় থাকা দরকার বলে মনে করেন?
শোয়াইব জিবরান: ডিটেল আর ট্রিটমেন্টের কাজ। দেখি
লেখক ঘটনার সামনে খাড়াইয়া এটারে কীভাবে হ্যান্ডেল করলেন। গল্প
অনেক প্রকার হতে পারে। তো আমি
দেখি গল্পকার আমাকে শেষ পর্যন্ত তার গল্প থেকে
বের হওয়ার রাস্তা দিলেন কিনা। একটু
উন্মুক্ত জানালা খুলে দিলেন কিনা। যে দিক থেকে আমার কাছে
প্রান্তরের হা হা বাতাস আসে। আমারে
তাড়িয়ে নিযে চলে। যেমন- গোলাপ সুন্দরী পড়ার পর পুত্রের ভেতর দিয়া পিতার ফিরে আমার বাসনা তথা ভারতীয় জন্মান্তরের বাসনাটা
আমারে তাড়া করে। এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আকেরটা উদাহরণ দিই। চ্যাপলিনের
ছবিতে বাপে ছুতোর মিস্ত্রি।পুত্র ঢিল মেরে মানুষের জানালার কাচ ভাঙ্গে। যেন
পিতা সারাইয়ের কাজটি পায়। তারা চুরি করে। কনকনে শীতে জামা নাই, আলু সেদ্ধ খায়। হঠাৎ
শীতের বাতাসে তাদের পাখা গজায় তারা এই বাস্তবতা থেকে বের হয়ে যায়। এই দেখে আমার চোখে জল আসে। বউ ঘরে ফিরে তো অবাক। জিকায়, দীনস্বামী তুমি কান্দ কেনে?
গল্পপাঠ: সে রকম গল্প কোন কোন গল্পকারের মধ্যে পেয়েছেন? কিছু গল্পের নাম বলুন।
শোয়াইব জিবরান: কমলকুমার
মজুমদার। কয়েদখানা, মতিলাল পাদ্রি, গোলাপ সুন্দরী, অনিলা স্মরণে, সুহাসিনীর পমেটম, পিঞ্জরে বসিয়া শুক-এগুলি একটু দীর্ঘ আর ডিটেলের গল্প। মুক্তির পাখা মেলা পথ বহুদূর
পার হয়ে তবে পাওয়া যায়।
৯. কি কি কারণে কোনো গল্প মন্দ হয়ে ওঠে? এ রকম কি ঘটনা ঘটেছে যে এক সময় মনে হয়েছিল গল্পটি
ভালো--পরে তা মন্দ লেগেছে?
শোয়াইব জিবরান: বাস্তবতার কচকচানি। হাসান আজিজুল হকের ‘পাতালে হাসপাতালে’।
গল্পপাঠ: এ সময়ের কোন কোন গল্পকারের গল্প আপনি পড়েছেন বা পড়েন? সেগুলো কেমন লাগে? ভালো লাগলে কেনো ভালো লাগে? মন্দ লাগলে কেনো মন্দ লাগে? কারণগুলো বিস্তারিত লিখুন।
শোয়াইব জিরবান:
কাজল শাহনেওয়াজ,
সেলিম মোরশেদ, সৈয়দ রিজাজুর রশীদ, শাহনাজ মুন্নী,
শাহাদুজ্জামান, মাহবুব মোর্শেদ, সাদ কামালী, তানিম কবিরসহ অনেকরেই। এঁদের
লেখা ভাল লাগে বলেই পড়ি। তবে
যে লেখাগুলোর মধ্যে বাস্তবতার কচকচানি যা প্রকৃতপক্ষে ডিটেলের কাজ নয়
যা আমারে কল্পনার রাজ্যে পালানোর পাখাটি গজাতে দেয় না, কল্পনার
স্পেসটি তৈরি করতে দেয় না সেগুলোরে মন্দ লাগে।
0 মন্তব্যসমূহ