অনিন্দ্য আসিফ
এ’টা সেই সময়ের গল্প যখন এই মফস্বলের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির লোকেরা নিজেদের ভেতর আভিজাত্য আনার চেষ্টায় থাকত আর তারা তখন প্রমিত ভাষায় কথা বলত এবং লোকেরা তাদের সাথে এক-ই ভাষায় কথা বলত অথবা চেষ্টা করত। যেমন-
আমাদের কলাপাতা রঙের মফস্বলে একটা সবুজ মেয়ে ছিল। সবুজটা মনের। দেহের কালো। আর নামের রঙে শ্রাবণের আকাশ। উপমাটা যৌক্তিকতাকে সিদ্ধ করে। কেননা নাম পরিবর্তন একধরনের ফ্যাশন ছিল তার কাছে। তার একটা অদ্ভুত উচ্চাশা ছিল। যে-কোনও প্রকারে হোক রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করা। তাই কি না প্রায়ই অপ্রাসঙ্গিক নোবেল পুরস্কারের নানা দিক নিয়ে কথা তুলত। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছিলেন। তারও হয়তো এমন একটা গুপ্ত বাসনা ছিল। গভীর পরিকল্পনা ছিল গীতাঞ্জলির মতো কিংবা তার চেয়েও বিকল্প কিছু লিখে তাক লাগিয়ে দেয়ার ।
সদ্যজাত এক বিকেলে নরসুন্দা থেকে পৃথিবীর মতো পাক খেয়ে বাতাস উঠে আসছিল। নদীটির পাড় ঘেঁষে থাকা একটা পাথরের ওপর বসে আমি সম্ভবত একটা পাণ্ডুলিপি ঘাটছিলাম। আমার অদূরেই একটা ঈগল মাঝারি আকৃতির একটা কাঁকড়া নিয়ে আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। আমি নাটক লিখি না একমাত্র সেজন্য নয়, তবে যে কারণেই হোক, আমার ওপর গ্রিক নাট্যকার এস্কাইলসের প্রভাব কখনও ছিল না। আর তখন মৃত্যুও আমার কাছে বিচ্ছিন্ন বিষয় অথবা নিছক শব্দ। তবু চুলভর্তি মাথার ওপর হাত রেখে যখন চোখ উপরে তুলতে যাই, দেখি লাশের মতো পড়ে থাকা রাস্তার এক পাশকে ক্রমাগত অতিক্রম করে ছুটছে একটা মেয়ে। আমি চিৎকার দিয়ে উঠি
ও হে সবুজ কন্যা। পতাকার মতো চুল উড়িয়ে যাচ্ছ কোথায়?
আমার কণ্ঠ শুনে মেয়েটি তার গতিপথ পাল্টায়। তারপর শরীর এবং তার কাঁধে ঝুলে থাকা চটের ব্যাগে বড় ঢেউয়ের মতো কম্পন তুলে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। শ্যামলা রঙের মুখে শিশুর সরল হাসি ছড়িয়ে বলে, পাবলিক লাইব্রেরিতে যাচ্ছি একটু। কেমন আছেন?
তোমার নামের এমন পরিবর্তন দেখেতো ধাঁধায় পড়ে যাই। ভালো থাকি কী করে?
মেয়েটি কপালে ভাঁজ ফেলে বলে, আমার নামে আবার কী সমস্যা দেখলেন?
পত্রিকায় দেখলাম ‘মিজ্ বাঙ্গালী আঁখি’ নামে তোমার কবিতা ছেপেছে। সমস্যা হলো ওই মিজ্’ শব্দটা নিয়ে।
নরসুন্দার ওই পাক খাওয়া বাতাসের মতোই অঙ্গভঙ্গি করে আঁখি উচ্চস্বরে হেসে ওঠেছিল।
ও এই কথা। আসলে ভাবছি বিয়ে-টিয়ে করবো না। লেখালেখি করেই জীবনটা কাটিয়ে দেব। কী বলেন, পারবো না?
জানি না। হয়তো পারবে। অথবা পারবে না। কিন্তু তোমার লেখাটেখার কী খবর?
খুব ভালো। কবিতার সংখ্যা সতেরো হাজার অতিক্রম করেছে।
আমার চোখ দুটো কপালে উঠে পড়েছিল। যদিও সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবু এই বয়সেই সতেরো হাজার?
আজ ওরকম একটা বিকেলে গৌরাঙ্গবাজার ব্রিজে পা ঝুলিয়ে পারভেজের জন্য অপেক্ষা করি। অপেক্ষার ফাঁকে অনেক দিন পর হঠাৎ করেই আঁখির কথা মনে পড়ে। শুনেছি তার ‘মিজ্’ শব্দটা ‘মিসেস’ শব্দের নিচে ঢাকা পড়েছে। কৃষ্ণের শিশুবেলার ছবির মতো নাদুস-নুদুস একটা ছেলেও হয়েছে নাকি। সে কি আজও লিখে আগের মতো? লিখলে তার সংখ্যা কতো হয়েছে? নোবেল পুরস্কারের কথা কী ভাবে আজও? নাকি ছেলের দিকে তাকিয়ে সমস্ত ভুলে যায়? নোবেলের কথা না হয় ভুলে যায়। কিন্তু লেখা? যে একবার লেখা ধরেছে সে কি না লিখে থাকতে পারে? হয়তো পারে। এই যেমন গত এক বছর যাবত আমি কিছুই লিখছি না। শুধু ভাবছি। ভাবনার অলংকারগুলো নোটও করছি না। দ্বিতীয়বার যখন ভাবছি তখন প্রথমবারের বিষয় ভুলে যাচ্ছি। এভাবে এক বছর যাবত ভেবে যাচ্ছি। লেখার মতো করে একটা বাক্যও লিখছি না। লিখতে পারছি না। তাই বলে কি আমি বেঁচে আছি না? হয়তো বুকটা টনটন করে। বিরক্তিতে কখনও নীরবতা হটিয়ে একা একা বলে উঠছি, লিখতেই যদি না পারি তবে বেঁচে আছি কেন?
তবু বেঁচে আছি। অহর্নিশ ঘুমিয়ে থেকে, জেগে থেকে, সিগেরেট খেয়ে আর কখনও কখনও সিনেমা দেখে বেঁচে আছি।
এইসব ভাবছি আর যেন ঘূর্ণায়মান অতীতগুলোকে ধোঁয়ার সাথে কু-লি পাকিয়ে বাতাসে ছেড়ে দিচ্ছি। নিমগ্ন হয়ে দেখছি কিছু সোনালি ডানার স্মৃতি উড়ে যায় বাতাসের সঙ্গে। আমি হাত বাড়াই আর স্মৃতি আটকাতে মুঠো চেপে ধরি। মুঠো খুলে দেখি কুয়াশার মতো কিছু ধোঁয়া উড়ে যায়। নিজের অদ্ভুত কা- দেখে হো হো করে হেসে উঠি।
একা একাই ঢেলেছো নাকি?
পাশ ফিরে দেখি বাবুই বাসার মতো পা ঝুলিয়ে পারভেজ তার অদ্ভুত স্টাইলে সিগেরেট টানছে। আমার ডান উরুতে চাপড় দিয়ে পুনরায় বলে, পাগলের মতো হাসছো কেন?
সুখী হওয়ার প্র্যাকটিস্ করছি।
পাগলেরা সুখী। কিন্তু ওরা অতীত মনে রাখে না। তুমি অতীত ভেবে হাসছো।
আমি থমকে যাই। পারভেজ আমার মনের কথাটা জানলো কীভাবে?
সিগেরেটে শেষটান দিয়ে মুখভর্তি ধোঁয়া ছাড়ি বৃত্তাকারে। নরসুন্দা থেকে বাতাস এসে ধোঁয়ার শেষ চিহ্নটুকু ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। ধোঁয়ার সাথে অতীতও কি মুছে যায়? এবার হয়তো পাগল হওয়া যায়। প্রাণ খুলে হেসে সুখী হওয়া যায়।
ব্রিজের ওপর থেকে পারভেজ ধপাস করে নিচে নামে। তার চেহারায় গতিশীলতার ছাপ স্পষ্ট। যেন রেসের জন্যে তৈরি থাকা ঘোড়া। যার কাজই কেবল ছুটে চলা।
আমি বলি, নামলে যে?
সন্ধ্যার পরে আসলামের স্টুডিওতে দেখা হবে।
বলেই সে পুরান থানার দিকে হনহনিয়ে ছুট দেয়। আমি প্রথমে অবাক হই। তারপর অপমানবোধ করি। আমাকে অবহেলা? তারপর ভাবি, ব্যাপার না।
আমিও ঠিক একইভাবে ধপাস করে নামি। চোখ বন্ধ করে ঝটপট ভাবতে চেষ্টা করি, কোথায় যাওয়া যায়? একবার মনে হয় মান্নার কাছে যাই। কিন্তু ওর কাছে গেলে বরফ বাষ্প হয়ে যায়। বিরক্তিকর কাজ। প্রায় পুরো পত্রিকার কাজ ওর ওপর চাপানো থাকে। কথা বলার সুযোগ নেই। মেজাজ বিগড়ে যায়।
তারপর মনে হয় দ্বীপের বাসায় যাই। অনেকদিন খোঁজ-খবর নেই। অথচ ইচ্ছে করলেই নেয়া যায়। বুকের ওপর হাত রেখে অনিবার্যভাবে বলা যায়, এখানে বিশ্বস্ত প্রেম আছে। কিন্তু ইচ্ছে করে না। আমি চাচ্ছি ঈশাখাঁ রোড অথবা স্টেশন রোড কিংবা অন্য কোনও গলিতে হঠাৎ দূরত্ব অতিক্রম করে আমরা মুখোমুখি হই। দ্বীপের মনে হোক এটা মনের আবেদন। কিন্তু আমি জানবো মনের অবাধ স্বাধীনতা প্রযোজ্য। তার আবেদন এককভাবে কোথাও সিদ্ধ হবে না। তারপর সব অতীত ভুলে পারফেক্ট পাগলের মতো হো হো করে হাসব।
দু’কদম এগোতেই একটা রিকশা বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং সঙ্গে দ্বীপও। পরিচিত চুল, হাসি আর শরীর নিয়ে।
কী ব্যাপার, একা একা যে?
পারভেজ ছিল। ফাঁকি দিয়েছে।
ফাঁকি? পারভেজ? আপনাকে? বিশ্বাস হয় না।
আমি কখনও কখনও বিশ্বাসকে চোখ ও মনের বাইরে রাখি। রাখতে হয়। কেননা গভীরের বিশ্বাসগুলো মোহাম্মদ আলী বেগ হয়। ব্রুটাস হয়। সবসময় হয়তো না। কিন্তু অনেক সময়।
তারপর বলি, ভেবেছিলাম বিকেলটা বুঝি স্রেফ নিঃসঙ্গ কাটবে। তার ওপর যেহেতু মনে হয় আমি আমাকে নিয়েই থাকতে হবে।
দ্বীপ বলে, তাই কি দূরে দূরে থাকেন? শুনেছি তিন দিন হলো এসেছেন। আমি খুঁজে খুঁজে অস্থির। অথচ আমাকে একবারও মনে করলেন না।
কে বলল?
আমি বলছি। মনে করলে ঠিক টের পেতাম।
আমি বোকার মতো অবাক হই। বুঝি না আমি মনে করলে সে টের পাবে কী করে? মন কি সত্যিই বার্তাবাহক?
বুঝতে পারি দ্বীপের মনে সায় দেয় না। আমার মনকে গুরুত্ব দিতেই সে আমার পাশাপাশি হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে পুরান থানা পেরিয়ে রেললাইনে এসে দাঁড়াই। ভালো লাগে খুব। অনেক দিন পর বেঁচে থাকার তাড়না প্রবলভাবে নড়ে ওঠে। দ্বীপের দিকে তাকিয়ে দেখি গাছপালার ফাঁক দিয়ে কয়েক টুকরো সূর্যের আলো তার বাম গালের ওপর পড়ে। ঠিক যেমন ভোর হয় তাকে তেমন নতুন আর সজীব লাগে। আমি তার বাম বাহু ঘেঁষে দাঁড়াই।
দ্বীপ হেলে যাওয়া বৃক্ষের মতো ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, এত কাছে আসেন কেন?
তোমার হাতটা দাও।
কেন?
তোমার হাত ধরে হাঁটবো।
পাগল নাকি? চারদিকে গিজগিজ করছে পরিচিত সব চোখ। কী ভাববে তারা?
যার যা ইচ্ছে ভাবতে দাও। আজইতো। তারপর যদি মরে যাই, এই রেললাইনে কভু না আসি, তবে এইভাবে আর হাঁটা হবে না। তোমার হাত ধরাটা আর হবে না।
দ্বীপ কাতর খরগোশ ছানার মতো তুলতুলে চোখে তাকায় আমার দিকে। আমি তার বাম হাতের পাঁচ আঙুলের ফাঁকে আমার ডান হাতের পাঁচ আঙুল ডুবিয়ে দিই। এভাবে দু’কদম এগোতেই টের পাই কেবল আমার আঙুল না, পুরো আমি ডুবে গেছি তার হাতের বৃত্তাকার মুঠোয়।
দ্বীপ বলে, আচ্ছা, আপনি প্রায়ই মৃত্যুর কথা বলেন কেন?
যেন তার কথা শুনতে পাইনি, তার ভেতর এমনভাবে ডুবে হাঁটতে থাকি। ভাবি, বেঁচে থাকার অর্থ কী? মানুষ কেন বেঁচে থাকে? নিয়ম আমাকে জন্ম দিয়েছে, তাই কি আমি বেঁচে থাকি? নাকি বাবা-মা, ভাই-বোনের সংসারে পিছুটান আর দায়িত্ববোধের তাড়না আমাকে বাঁচিয়ে রাখে?
কখনও কখনও মনে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে ইহুদি হয়ে থাকলে বেঁচে থাকার অর্থটা টের পাওয়া যেত। আবার কখনও মনে হয় মানুষ ছাড়া যদি অন্য কিছু হতাম? যেমন দক্ষিণ গোলার্ধের এক টুকরো বরফ। সূর্যের তাপে একটু একটু করে বাষ্প হতাম। অথবা এই রেললাইনে পড়ে থাকা দু’টুকরো পাথর। বুকের ওপর তপ্ত শ্বাস ফেলে দানবের মতো চিৎকার করে যেত ধাতব ট্রেন।
আমি বলি, দ্বীপ?
দ্বীপ নেশাক্তভাবে তাকায় আমার দিকে। আমি তার চোখ অতিক্রম করে আমার দৃষ্টি রাখি তার মেরুন রঙের ঠোঁটের ওপর। সে তার নিচের এক ফালি ঠোঁটে উপরের পাটির দাঁত চেপে হাসে। হঠাৎ আমার মাথায় সুনামির ঝড় ওঠে।
দ্বীপ বলে, প্লিজ, অন্যদিন।
হঠাৎ রেললাইনে কম্পন অনুভব করি। বিশ্রী হুইসেল শুনে পেছন ফিরে দেখি দীর্ঘতা নিয়ে সাপের মতো বাঁকা দেহে ধেয়ে আসছে ট্রেন। আমরা সরে যেতেই মুহূর্তে ট্রেনটি আমাদের অতিক্রম করে।
একদিন শাহবাগের এক রেস্তোরাঁয় কফি খাওয়ার সময় হঠাৎ খবর পাই শেকড় ট্রেনের নিচে কাটা পড়েছে। তার বড় দাদা শরীরের কাটা টুকরোগুলো একটা একটা করে চটের ব্যাগে তুলে বাড়িতে নিয়ে আসার সংবাদ শুনে সারাটা দিন করুণ শূন্যতা পেয়ে বসেছিল আমাকে। সেদিন রাতে স্বপ্নে দেখি আমাদের চৌরাস্তার মোড়ে দীর্ঘ কালো চুলওয়ালা একটি ছেলে রিকশা থেকে নামছে। আমি চিৎকার দিয়ে বলেছিলাম, আরে শেকড় তুই?
শেকড় প্রথমে পুরোহিতদের মতো মিষ্টি করে হাসল। তারপর তার করুণ চোখ দুটো থেকে পানি ঝরে পড়ছিল। সেই থেকে ট্রেন দেখলে আমার বুকের ভেতর হু হু হাওয়া বয়। তবু বারবার ট্রেনের কাছে আসি। গ্রাম, শহর ছাড়িয়ে রেললাইনের দূরত্ব অতিক্রমণে তিন কালের যোগাযোগ খুঁজি।
আমি বলি, দ্বীপ, আমার মনে হচ্ছে এতদিন মরেছিলাম। আজ বেঁচে উঠেছি। তোমাকে খুব ভালো লাগছে। তাই স্বার্থপরের মতো বলছি শুধু বিকেলটাতে তোমার ওপর থেকে তোমার দাবি তুলে নাও। অন্যদিনের ওপর আমার বিশ্বাস নেই। আমার মনে হয় কোনো একদিন আমি কোথাও থাকব না।
প্লিজ, অমন করে বলবেন না। আপনাকে বাঁচতে হবে। সবার জন্য বাঁচতে হবে। আপনাকে লিখতে হবে। শূন্য দশকের প্রতিভাবান লেখক আপনি। দশক পেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ শুনছি আপনি নাকি হাত গুটিয়ে বসে আছেন। লিখছেন না?
ঠিকই শোনেছ। আমি লিখছি না। আমি লিখতে পারছি না। গত এক বছরে মাথার ভেতর কেবল অগোছালো তিনটা লাইন জমা পড়েছে। শুনবে?
বলুন।
আমি প্রথম শব্দ বলে আর পারি না। গলা জড়িয়ে আসে। কাতর চোখে দ্বীপের দিকে তাকিয়ে বলি, আচ্ছা এভাবে বাঁচা যায়?
দ্বীপ নিরুত্তর থাকে। যেন সমস্ত বিকেল মুঠোর মধ্যে এনে শিশুর মতো আমার হাতে নরম করে চাপ দেয়। আমি চোখ বন্ধ করে ভাবতে চেষ্টা করি, যৌবন জীবনের সৃষ্টিকর্তা। জীবনকে যা অক্ষুণ্ন রাখে সেই ব্যগ্রতা অনুভবেরও প্রয়াস পাই তখন।
সন্ধ্যার পরেও শেষ বিকেলটা আমাকে মদের মতো আচ্ছন্ন করে রাখে। মানুষ কেন বেঁচে থাকে, অমূলক সেই প্রেক্ষাপট ন। আসলে আমি কী চাই অথবা আমার জীবনদর্শন কী? অসমাপ্ত পুরনো এই সমাধানের হিসেব কষতে কষতে আসলামের স্টুডিওতে ঢোকার সময় রায়হান ভাইয়ের সাথে দেখা। বেশ পরিপাটি সাজে হাতে দুটো বই নিয়ে স্টুডিও থেকে বেরুচ্ছেন। আমাকে দেখে চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ বের করে বিস্মিত কণ্ঠে বলেন, আরে তুমি?
হ্যাঁ, ঠিক আমিইতো। আছেন কেমন?
রায়হান ভাই ঠোঁটের বিচিত্র ভঙ্গিতে সম্ভবত বুঝানোর চেষ্টা করেন, ভালো নেই।
আমি টের পেয়ে বলি, ভালো না থাকলে চলবে কেন? এই মফস্বল মাতিয়ে রাখবেন তো আপনারাই। আপনার লিট্লম্যাগের কী খবর?
গল্প সংখ্যা বের করছি। পনের ফর্মা। তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালোই হলো। তোমার গল্পের খুব দরকার। তোমাকে তো খুঁজে খুঁজে হয়রান। মুঠোফোনে ডায়াল করতে করতে হাঁপিয়ে উঠছি। সিম পাল্টিয়েছ নাকি?
বন্ধ রাখছি আজকাল। ইদানীং সেলফোনের টোন বিরক্তিকর লাগছে।
রায়হান ভাই হো হো করে হেসে ওঠেন। হঠাৎ এমন হাসির শব্দে চারপাশের কিছু অলস চোখ এসে পড়ে আমাদের ওপর।
রায়হান ভাই আমার কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন, ইয়ংম্যান, সময়কে সবদিকে কাজে লাগাও। আমাকে দেখ, মোবাইল ফোনের টোন এত হাই দিয়ে রেখেছি যে লোকে ভাববে আমি বুঝি কালা হয়ে গেছি। হা-হা-হা-হা...তা এখন কী লিখছ?
কিছুই না। নির্বাসনে আছি। সবকিছু থেকে।
তাই না কি? ব্যাপার না। ঠিক হয়ে যাবে। এখন চল।
কোথায়?
রায়হান ভাই কণ্ঠনালীতে মৈথুনের মতো করে তার একটা হাত বোলান। তারপর খুব রহস্যজনক উপায়ে চোখ টিপেন। আমি ঠিক অর্থটা বুঝে যাই। মাতালের মতো নরম করে মাথা নুয়ে বলি, আপনি যান। আমি ভেতরটায় একটা চক্কর দিয়ে আসি।
তারপর অগত্যাই আমি নরসুন্দার মৃদু ঢেউয়ের মতো ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসি। কিন্তু রায়হান ভাই হাসেন জলোচ্ছ্বাসের মতো শব্দ করে। হা-হা-হা...
ওকে ওকে। আসবে কিন্তু।
আমি স্টুডিও’র ফ্লোর অতিক্রম করে পেছনের ক্ষুদ্র ও পরিপাটি বাগানে ঢুকি এবং কোনো দিকে না-তাকিয়ে ছোট ছোট পাতায় বৃত্তাকারে ঘেরা আমার সমান উচ্চতার একটি বৃক্ষের পাশে এসে দাঁড়াই। কিন্তু রায়হান ভাইকে দেখে যে-ঈর্ষা আমাকে পেয়ে বসেছিল তা থেকে আমি বেরোতে পারি না। লোকটা সবার দৃষ্টি এবং সময়কে ক্রমাগত অতিক্রম করে কী চমৎকার বয়ে যাচ্ছে। যেন জীবন একটা তরল রমণী। যাকে যেভাবে ইচ্ছা রাঙানো যায়।
হায় কীটস্।
আমি আঁতকে উঠি। ডানে তাকিয়ে দেখি দেয়ালের ধারঘেঁষে আসলাম, পারভেজ আর খোকা ভাই পা ছড়িয়ে বসে আছে। খোকা ভাইকে দেখে ভীষণ অবাক হই। কিন্তু ঘটে যাওয়া খুব সাধারণ ঘটনার মতো অভিব্যক্তিহীনভাবে পা টেনে তাদের কাছে আসি।
আমি বলি, কখন এলেন?
বিকেলে।
একটা খবর দিবেন না?
ট্রাই করেছি বেশ ক’বার। ভাবলাম নাম্বারটা ডেড হয়ে আছে। ব্যাপার কী?
রায়হান ভাইকে বলা কথাগুলো পুনরাবৃত্তির ইচ্ছা হয় না। মৃদুহাসির মতো করে ঠোঁট বাঁকিয়ে পারভেজের পাশে ফাঁকা সিঁড়িটায় বসতে বসতে বলি, হ্যাঁ, ডেড হয়ে আছে। ধরুন, নাম্বারটা আমার প্রতিচ্ছবি।
সম্ভবত আমার শেষ কথাটায় কেউ মনোযোগ দেয় না। আসলাম তার সদ্যকিশোরীর মতো দীর্ঘ চুলের ফাঁকে বাম হাতের পাঁচ আঙুল ডুবিয়ে বলে, রায়হান ভাইয়ের সাথে এত কী কথা হলো?
বিশেষ কিছু না। অনেক দিন পরে দেখা। তাই কুশলাদি বিনিময়। ব্যস।
আসলাম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, শালা বদ।
আমি শুনতে না পাওয়া উৎসুক কণ্ঠে বলি, কিছু বললে?
আর বলো না যেন শেক্সপিয়রের ভাব নিয়ে আছে। অথচ বিজ্ঞাপন হিসেবে ক্রমাগত প্রকাশিত কিছু বই ছাড়া মৌলিক কিছু নেই। বলতে পারো, উত্তর প্রজন্ম তাদের কাছ থেকে কী পাওয়ার আশা রাখে?
আসলাম তার দু’হাতের কনুই দু’হাঁটুতে রেখে কিছুক্ষণ ন্যুব্জ হয়ে থাকে। সোজা হওয়ার সময় তার পুরো মুখে ছড়িয়ে থাকা চুল দু’হাতে দু’দিকে আলগা করে বলে, নারীই যেন তার কাছে সৃষ্টির প্রধান উৎস। ঠিক আমাদের নাগালের ভেতর থেকেও বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে নিয়ে যায়।
আমি বলি, আর পুরো মফস্বল বুঝি নরসুন্দার বুকে জায়নামাজ পেতে মরুপাঠ করে?
আসলাম তার রঙধনুর মতো ঝুঁকে থাকা পিঠ সোজা করে উত্তেজিত ঢঙে বলে, বাজপাখি অথবা শিকারি যেহেতু বর্তমান সুতরাং কেউ শঙ্কামুক্ত নয়। এমনকি তুমি আর খোকা ভাই দু’জনই।
একবার ঢোক গিলে আসলাম খুব শঙ্কিত কণ্ঠে বলে, জেনে রেখো এই মফস্বলে প্রগতিশীল ধারায় উত্তর প্রজন্মের যারাই রায়হান ভাইয়ের প্রভাবমুক্ত তারাই প্রতিভাবান এবং মৌলিক।
আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে পারভেজ আর খোকা ভাইয়ের দিকে তাকাই। তারা মাথা নাড়িয়ে আসলামের বক্তব্যের সত্যতা বুঝিয়ে দেয়।
রাত দশটায় স্টুডিও-র কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে আমরা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দু’তলায় উঠি। তারপর একটা টি-টেবিলকে কেন্দ্র করে চেয়ার টেনে বৃত্তাকারে বসি।
টেবিলের ওপর রাখা একটা কাঁচের ক্রিস্টল তিন আঙুলের ম্যাজিকে লাটিমের মতো বার কয়েক ঘুরিয়ে আমি বলি, মান্নার ওপর দিয়ে খুব চাপ যাচ্ছে মনে হয়।
বলতে বলতে মান্না আসে--চেহারা এবং কণ্ঠে চিরচেনা ঝড় এবং প্রফুল্লতা নিয়ে। চড়–ই পাখির বাসার মতো ড্রেসিংরুমটা তার পদশব্দে মৃদু ভূ-কম্পনের মতো কেঁপে ওঠে। তারপর রাজনীতিবিদদের বক্তৃতার স্টাইলে হাত নেড়ে কথা শুরু করার সময় খোকা ভাইকে দেখে থমকে যায়। আমি যতটা অবাক হয়েছিলাম তার চেহারা দেখে অনুভূত হয় সে আমার চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু বিস্ময় ভঙ্গিকে নানা ঢঙে উচ্ছ্বসিত করতে তার সময়ক্ষেপণ হয় না। খোকা ভাইয়ের দিকে তার ডান হাতটা বাড়িয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে, আরে আপনি? কখন এলেন? একটা খবর দিবেন না?
খোকা ভাই তান্ত্রিকের মুখস্থ তন্ত্রপাঠের মতো আমাকে বলা শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি করে। বলে, ট্রাই করেছি বেশ ক’বার। ভাবলাম তোমার নাম্বারটা ডেড হয়ে আছে। ব্যাপার কী?
মান্না পকেট থেকে মোবাইল সেট বের করে হতভম্বের মতো একবার মোবাইল আর একবার খোকা ভাইয়ের দিকে তাকায়। পারভেজ কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে তার মেয়েদের মতো লাজুক আর স্মিতহাস্যময় ঠোঁট বাঁকিয়ে বিশেষজ্ঞের মতো বলে, যা কিছু ব্যাখ্যাহীন অর্থ্যাৎ ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে তা-ই সুন্দর। তোমরা যাই বলো সৃষ্টি, প্রেম আর নারী ত্রিমাত্রিক রহস্য। যথোপযুক্ত কোনো সংজ্ঞা নেই। আর প্রেম বহুগামী একটা শব্দ। বিশ্বাস আর প্রেম ছিঁড়ে না বলেই খোকা ভাই, পার্টনার আবার মফস্বলের আড্ডায়।
মান্নার হন্তদন্ত ভাব, আসলামের আয়োজন, খোকা ভাই আর পারভেজের শ্রীযুক্ত আলাপ সব মিলিয়ে মিষ্টি একটা উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে ঘরটা জুড়ে। কেবল আমি কোলাহলের ভেতর নিজের নির্জনে ভাবি, পারভেজ কি সত্যি বলল? ভালোবাসা ছিঁড়ে না? মানুষগুলো ফিরে আসে?
বিকালে যখন দ্বীপের তুলার মতো নরম মুঠোর ভেতর আপাদমস্তক ডুবিয়ে রেললাইনের অজস্র পাথর অতিক্রম করছিলাম, তখন মনে পড়েনি। যখন সমস্ত বিকেল সঙ্গী করে তার মেরুন রঙের ঠোঁটের ওপর ঝুঁকে পড়েছিলাম, মনে পড়েনি। এখন পড়ছে। প্রসঙ্গ ছাড়াই ইন্দুর কথা মনে পড়ছে।
ইন্দু। আমার ভালোবাসা শিক্ষার প্রথম গুরু। নারীর ঠোঁট, চিবুক, স্তনের ওপর অন্ধকারে জানালা গলে চাঁদের আলোর মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ার প্রথম অভিজ্ঞতা।
ইন্দু। আহ্ ইন্দু! আমার প্রথম প্রেম। প্রথম চুম্বন। প্রথম নারী। আর দ্বিধাদ্বন্দ্বে প্রথম পাপ, প্রথম পুণ্য।
সেদিন রাত ছিল প্রায় অমাবশ্যা। চাঁদের চিহ্নমাত্র ছিল না। তার ওপর বিশাল মেঘের জায়নামাজ। আমি এমন কবরের অন্ধকার অতিক্রম করে ইন্দুর তপ্ত নিঃশ্বাসমাখা ভেঁজা ঠোঁটে আমার শুকনো ঠোঁট ঘষেছিলাম। তারপর ইন্দু এই উষ্ণ শিহরণে দু’পাশে দীর্ঘ চুল ছড়িয়ে পড়ার টেবিলে সারারাত ঝুঁকে বসেছিল। আমি জেনেছিলাম পরদিন সকালে যখন সূর্য কেবল জেগে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ইন্দু আমার চোখে কামুক দৃষ্টিপাতে বলেছিল, তুমি আমাকে পাগল করে দিয়েছ। পাগল। হা-হা-হা...
আমার এমন অপ্রাসঙ্গিক হাসির শব্দ শুনে সকলেই স্তম্ভিত ঢঙে আমার দিকে তাকায়।
পারভেজ বলে, আবার বুঝি পুরনো স্মৃতির সুতো ধরে টানা। ‘সুখে আছি’-র মৌখিক রিহার্সেল? কবি, সামনের দিকে তাকাও। সময় তোমার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে।
আসলাম আমাদের বৃত্তাকার বাসস্থানের কেন্দ্র টেবিলের ওপর একটা লম্বা, কালো রঙের বোতল রাখে। তার পাশে সিগেরেটের প্যাক, কয়েকটা কাচের গ্লাস আর এক বাটি বরফের টুকরা।
খোকা ভাই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, আরে বাহ্। দারুণতো!
তারপর বোতলটা হাতে নিয়ে আপাদমস্তক লালচ-জড়ানো দৃষ্টি বুলিয়ে বলে, হ্যাঁ, বলতে দ্বিধা নেই যে এটা চমৎকার আয়োজন। স্পন্সর করল কে? আসলাম?
আসলাম বলে, পারভেজ শেয়ার করেছে।
আমি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলি, পারভেজ প্রমাণ করেছে যে শৈল্পিকতা কেবল তার চেহারাতেই সীমাবদ্ধ নয়।
পারভেজ নিঃশব্দে, নিখুঁতভাবে তার ফেবারিট হাসিটা হাসে। তারপর বেশ কায়দা করে নিজের হাতে বোতলের ক্যাপটা খুলে।
মান্না দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, আমি বরং উঠি।
খোকা ভাই বিস্মিত হয়ে বলে, উঠি মানে? আরে বস। সবাই একসাথে বেরোই।
মান্না ট্রাজিক গল্প পাঠের স্টাইলে বলে, আমাদের নির্বাহী সম্পাদকের চেয়ারে বসে থাকে এক লোক। জানেন না তো, শালা কী রকম বদ। দম বন্ধ করে কাজ করে যাই তবু তার সাথে দূরত্ব কমে না।
তা হলে একটু ঢেলে যাও।
মান্না ভড়কে যাওয়ার মতো করে শুকনো ঢোক গিলে। আসলাম আড়চোখে একবার তাকিয়ে হঠাৎ হেসে ওঠে। একেবারে মেয়েদের মতো হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে।
আমি বলি, হাসছো যে?
আসলাম হাসি থামিয়ে বলে, শোনো, এক রাতে আমার সাথে মাত্র হাফ গ্লাস ঢেলেছিল। পরদিন পত্রিকা বেরিয়েছে। আট পৃষ্ঠা পত্রিকায় একুশটা বানান ভুল। হায়রে সম্পাদকের ঝারি।
বলে আবার লুটিয়ে পড়ে ও। এবার ওর হাসির সাথে আমরাও যোগ দিই। সংঘবদ্ধ এই হাসির প্রকোপে মান্না অনেকটা বিরক্তিভাব নিয়েই বেরিয়ে যায়।
পারভেজ সবগুলো গ্লাসে তরল ঢালে। এই ফাঁকে আসলাম একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল এনে কর্ক খুলে রাখে বরফের বাটির পাশে। অল্প করে পানি ঢেলে দেয় প্রতিটি গ্লাসে।
আমি বলি, আমার লাগবে না।
সিগেরেটের প্যাক ভেঙে একটা দু’ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দিই। পারভেজ ফচ করে আগুন জ্বালিয়ে আমার সিগেরেটের মাথায় ধরে। তারপর হঠাৎ করেই যেন আমার ওপর চে গুয়েভারা’র অবিকল ছায়া পড়ে। তাই অভিজ্ঞ শিল্পীর সামনে সিটিং দেয়ার মতো সিগেরেট হাতে চে’র ফটোগ্রাফ হয়ে মুহূর্ত কয়েক বসে থাকি। এবং দ্রুত প্রথম টানের ধোঁয়া ভেতরে রেখেই পারভেজের জ্বালানো দেশলাইয়ের আগুনের মতো ফচ করে বলে ফেলি
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়
আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে...
আজকাল আমার অনেক কিছুই হঠাৎ হয়ে যাচ্ছে। এখন চে’র মৃত্যুতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যে-অপরাধবোধ, তৎক্ষণাৎ ভেবেছিলাম তার ছায়া আমার ওপরও পড়বে। কিন্তু আমার চিন্তা খুব দ্রুত এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসে। অন্যদের দিকে আমার আড়চোখের দৃষ্টিপাতে আমি বুঝতে পারি আমার দিকে ওদের প্রশ্নবোধক দৃষ্টি সুনীল বাবুর ওই চরণকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু তারা কিছু বলার আগেই আমার দু’কনুই টি-টেবিলে রেখে অনেকটা ন্যুব্জ হয়ে বলি, শাহ্ আজিজ কাকার কী খবর?
আসলাম বলে, ব্যস্ত খুব। বারের সেক্রেটারি পদের জন্য নির্বাচন করছে।
ওদের লেবেলের আড্ডাটা আজ বসেনি?
না।
পারভেজ উঁকি দিয়ে বলে, সম্ভবত আজ ব্ল্যাক লেবেলটা ছিল না। তাই জমেনি।
সঙ্গে সঙ্গে বখাটে ছেলেদের মতো আড্ডায় হাসির একটা প্রলেপ পড়ে। আমি এড়িয়ে যাই। বাম হাতের আঙুলের ফাঁকে সিগেরেট রেখে একি হাতে আমার গ্লাসটা গভীর মমতায় চোখের নিচে এনে রাখি। সুনীল বাবুর মতো কোনও অপরাধবোধে নয়, অনুভব করি মাতাল হওয়ার তৃষ্ণায় আমার ঠোঁট দুটো শুকনো হয়ে আসে। দ্রুত একটা বরফের টুকরো ছেড়ে দিই গ্লাসের ভেতর। টুকরোটা প্রথমবার ডুবে যায়। তারপর গ্লাসের তল স্পর্শ করে আবার ভেসে ওঠে। এবং বাল্বের আলোয় টুকরোটি চাঁদের মতো জ্বলে উঠার সাথে সাথে ইন্দুর কথা মনে পড়ে।
আবার ইন্দু? আমার প্রথম বিশ্বাস। প্রথম শয্যাসঙ্গী।
একদিন দিনভর সকালের মতো নরম রোদ ছিল। সেদিন আমি আর ইন্দু সকাল এগারোটা থেকে বিকেল চারটা অবধি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের পাশে ছোট সিঁড়িতে জড়াজড়ি করে বসেছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ইন্দু একত্রিশবার বলেছিল, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তার ‘ভালোবাসি’ শব্দের মোহ থেকে বেরিয়ে সাহস করে বলেছিলাম, আমি কিন্তু আজ রাতে আসব।
ইন্দু ভীতু কণ্ঠে বলেছিল, প্লিজ তুমি এভাবে এসো না।
যদিও পৌর্ণমাসীর চাঁদের মতো আকণ্ঠ যৌবনা ইন্দুর ছিল মেধাবী চোখ ও মনন আর এই চাপ অথবা টানাপড়েনে সে কখনও কখনও বলত যে এটা পাপ। কিন্তু অবলীলায় তার অঙ্গ সঞ্চালন, শীৎকারের ব্যঞ্জনা, চোখে দীপ্তিময়তা ইত্যাদি দেখে কখনও মনে হতো না যে তার ভেতর কোনো পাপবোধ কাজ করছে। এবং শেষমেশ তার অনুশোচনাহীনতায় মনে হয়েছে যে পাপ সংক্রান্ত একটা চমৎকার উপলব্ধি তার মাঝে বিরাজ করে। আর তা হলো, যা কিছু অবলীলায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তা-ই পবিত্র। পাপ এখানে নৈর্ব্যক্তিক।
তাই হয়তো অন্ধকারে তার তপ্ত নিঃশ্বাস বিশ্বাসী স্পর্শে বলতো, তুমি যেয়ো না। তুমি থাক। আকণ্ঠ ডুব দিয়ে থাক আমার মধ্যে। আমি তোমাকে সব দেব। স্বর্গ এবং স্বর্গের সুখ দেব তোমাকে। তুমি যেয়ো না।
ইন্দু মুখ ফুটে ওসব বলত না কিন্তু তার দৃষ্টি সেই ইঙ্গিতই বহন করত। কেননা দীর্ঘদিন পাশাপাশি অবস্থানের ফলে আমার সম্পর্কে ইন্দুর এই ধারণা স্পষ্ট ছিল যে, ধর্মীয় অনুষঙ্গাদি তথা স্বর্গ-নরক ইত্যাদিকে আমি এক প্রকার ‘ইজম’ হিসেবেই জানি।
তারপর সেদিন রাতে ইন্দু আমার ডান কানে আলতো করে কামড় দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, আমি তোমাকে অ-নে-ক ভালোবাসি।
আমার মনে হয়েছিল কান পেতে আমি আমার মনের কথাটাই শুনছি। ভালোবাসা কেবল কামোদ্দীপক কোনো ধর্ম নয়। বিশ্বাসের নিটোল ভিত্তিও। আমি সেই প্রথম ইন্দুকে ভালোবেসেছিলাম, বিশ্বাস করেছিলাম। আর সেই বিশ্বাস ছিল আমাদের প্রথম সম্ভাবনা। সম্ভাবনার নুড়ি পাথরগুলো আমি বুক পকেটে ভরে রাখতাম দারুণ যত্ন করে। একটু আগে পারভেজের একটা বক্তব্যের সারমর্ম ছিল এই, ‘ভালোবাসা দীর্ঘ হয়’। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস ছিঁড়ে গেল। ভালোবাসাগুলো বালির মতো গুঁড়া হয়ে গেল এবং বিভক্ত হয়ে মোড় নিল অন্যদিকে।
আমি এইসব কবেকার কথা ভাবছি? সত্যিই কি এইসব আমার জীবনের কোনো নির্বাচিত অংশ? ইন্দু যখন সংসারের খুঁটিনাটি সমস্যায় একাকিত্ববোধ করে তখন জানালার পাশে এসে লোহার গ্রিল ধরে আমার কথা ভেবে মন খারাপ করে? অথবা এই যে আমি এখন মাতাল হওয়ার আগে গ্লাসের ভেতর রঙিন তরলে সেইসব দিন ও রাতের গল্প লিখছি ও পড়ছি, ইন্দু কি তা আঁচ করছে? দ্বীপ যদি করে তবে সে কেন করবে না?
খোকা ভাই সিগেরেটে কখনই পারদর্শী ছিল না। গ্লাসটা চোখের নিচে এনে প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো ঝুঁকে একেবারে নিউ স্মোকারদের মতো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে,
আমি প্রত্যহ জলের কাছে যাই, জল তখন ঘুমিয়ে
ঘুম না আসার কষ্ট বুঝি, ঘুম ভাঙাইনি জলের...
আসলাম সম্ভবত গভীরভাবে খেয়াল করে না। সে নিজের গ্লাসে আরেকটা বরফের টুকরো ছেড়ে বলে, আগামীকাল রঙমহল সিনেমা হলের সামনে আমাদের সংগঠনের উদ্যোগে মানববন্ধন। কেউ মিস করো না যেন।
খোকা ভাই তেমনি তন্ময়াচ্ছন্ন ভঙ্গিতে বলে, আমি থাকব না। আমাকে ঢাকায় ফিরতে হবে।
পারভেজ বলে, কী বলেন?
ঠিকই বলছি। কীট্স জানে। কর্মময় জীবনে কি রকম ঊর্ধ্বশ্বাসে বেঁচে আছি।
আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলি, মনে আছে, সেবার মুনতাসীর মামুন আর কবির চৌধুরীর ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে আমরা মানববন্ধন করেছিলাম। মোশাহিদসহ কয়েকটা ছেলে মানববন্ধন প্রত্যাহার করেছিল?
পারভেজ এক ঢোকে পুরো গ্লাস শেষ করে জড়ানো কণ্ঠে বলে, হ্যাঁ আছে। শালারা কাপুরুষ। আর মনে আছে, কী নিঃসঙ্কোচে তুমি দ্বীপের হাত তোমার মুঠোয় চেপে ধরে দাঁড়িয়েছিলে। সেদিনই বুঝেছিলাম, দ্বীপের সাথে তোমার হয়ে যাবে। তোমার অনেক সাহস।
আমি কিছু বলি না। কেবল আমি না, প্রত্যেকে নিঃশব্দে এক ঢোক তরলের সাথে গড়ে তিন ঢোক ধোঁয়া গিলে। আমার চোখ দুটো নিভে আসে। মনে হয় মস্তিষ্কের কোষগুলো জ্যাম হয়ে যাচ্ছে। স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারি না কিছুই। কেবল বুঝতে পারি নৈঃশব্দ্যের অণুকণাগুলো সমষ্টিগতভাবে পিন পড়ার মতো শব্দ করে। আর আমার ধারণা হয়, আমার মতো বাকি দু’জনও পান করার শেষদিকে নিয়মানুযায়ী আসলামের অদ্ভুত ছেলেমানুষি প্রত্যক্ষ করার জন্য নিবিষ্ট হয়ে অপেক্ষা করে। কিন্তু সে আমাদেরকে জটিল অন্ধকারের মতো থমকে দেয়। প্রবীণ দার্শনিকের মতো কুঁজো হয়ে কাঁপা কণ্ঠে অনেকটা সময় নিয়ে বলে, জীবন আর পারফেক্ট জল সহজেই সমার্থক, সমকামী অথবা সহবাসী হতে পারে। কেননা পাত্রভেদে জীবনও মুহূর্তক্ষেপণ না করে নানামাত্রিক বিশেষণ।
মূলত আসলাম তার বিপরীত চরিত্র সম্পাদন করে। কিন্তু যদিও তার এই অকস্মাৎ বক্তব্য অপ্রাসঙ্গিক এবং স্ব-চরিত্রে ক্ষণস্থায়ী তবু তাকে আজ অন্তত এই মুহূর্তে পুরোপুরি নতুন মানুষ মনে হয়। সে তার নিয়মকে অবজ্ঞা করে খুব সংক্ষেপে কথা শেষ করে ঝিম ধরে থাকে। আমি প্রায় জোর করে খোকা ভাইয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাই। তাকে কখনও সিগেরেটের ধোঁয়া গলাধঃকরণ করতে দেখিনি। আজ সে তা-ই করে আমার দিকে তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ তুলে বলে, কীট্স, যাচ্ছ কবে?
আমি তখনও তার দিকে অনিচ্ছুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। তারপর আমার গ্লাসের ভেতর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নীরবে খুব নিবিষ্ট মনে খালি গ্লাসে এক টুকরা বরফ ছাড়ি। শব্দও কি মাতাল হয়ে গেল? যেন গভীর কুয়োর তলদেশে পাথর ছুঁড়েছি। তাই এমন ধ্যানী নীরবতার মাঝেও কানে শব্দ বাজতে ঢের দেরি হয়।
মনে হয় খোকা ভাই এবার বিরক্ত হয়ে প্রশ্নবোধক উচ্চারণ করে, কীট্স?
আমি আমার গ্লাসটা দু’হাতের মুঠোয় চেপে আরও সংকুচিত হয়ে বসি। তারপর দ্যোদুল্যমান বিশ্বাস-অবিশ্বাস জড়ানো চোখ তুলে কম্পমান তরলকণ্ঠে বলি, A things of beauty is a joy forever…
রাত বারোটায় যখন শহরের সিংহভাগ নির্জীব হয়ে পড়ে তখন আমরা স্টুডিও থেকে বের হই। তখনও দু’একটা রিকশা জোছনা রাতে ক্ষেতের আইল বেয়ে নিশাচর শিয়ালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরঘুর করে। আসলাম একটাকে ডেকে এনে সামান্য কথাকে কেন্দ্র করে রিকশাওয়ালার সঙ্গে লেগে যায়। তবু নিজের লম্বা চুলে ম্যাজিক স্টাইলে হাত বুলিয়ে ওই রিকশাতেই চেপে বসে এবং খোকা ভাই আরেকটাতে। কিন্তু সে উঠার আগে যতবার সম্ভব তার বাসায় যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করে। নেশার পর কেউ হয় উত্তেজিত আর কেউ হয় কোমল। আমি নীরব চোখের ইশারায় মানা করি। কোমলকণ্ঠে জানিয়ে দিই, বাড়িতে এলে বাইরে কোথাও আমার রাত্রিযাপন শুদ্ধ হয় না। শরীরের কোষে কোষে অস্বস্তি ভিড় করে।
একদা বহমান নরসুন্দা আমাদের এই শহরকে দ্বিখন্ড করে রেখেছে। তাকে ঘিরে রেখেছে শহরের প্রধান দু’টি সড়ক। আমি আর পারভেজ নিশাচর পতিতার মতো রাত্রিকে সঙ্গী করে এপার ওপার চোখ মেরে তাদের একটি (স্টেশন রোড) বেয়ে শান্ত পায়ে হাঁটি। চারপাশ নীরব হয়ে আসে ইতোমধ্যে। এবং ইতোমধ্যে আমার ঘোর কেটে গেছে স্বাভাবিকভাবেই। নইলে এই ভৌতিক পর্যায়কে তিলোত্তমা মনে হতে পারত।
আমি আর পারভেজ নিজেদের পায়ের আওয়াজ অতিক্রম করে ল্যাম্পপোস্টের ধবল আলো আর ঘুমন্ত শহরের অব্যক্ত গান শুনে হাঁটি। এই গান আড়াল করে আমি ব্যক্তিগতভাবে গোপনে আমার হৃৎপিন্ডের ওপর কান পাতি। নীরবে কিসের আওয়াজে আমি কেঁপে উঠি? মৃত্যুর?
দ্বীপ বলেছিল মৃত্যুর কথা আর না ভাবতে। কিন্তু আর কিছু না, কেবল মৃত্যুই নিকটজনের মতো আমার পাশাপাশি ঘুরঘুর করে। তবে কি মৃত্যুই জীবনের পরম বন্ধু? যাকে জয় করার তীব্র আকাক্সক্ষায় অন্ধকারের মুখোমুখি হওয়া? সমস্ত ভালোবাসার যোগফলকে অতিক্রম করেই মৃত্যুর ওপর দাঁড়াতে হয়। কিন্তু আমি ভালোবাসার জন্যে দুয়ারে দুয়ারে হাত পাতি। দীর্ঘসময় লিখতে না পারার ব্যথায় থেকে থেকে কুঁকড়ে উঠি। তবে মৃত্যুকে জয় করা আমার পক্ষে কীভাবে তরলের মতো সহজ?
পারভেজকে বলি, ক’টা বাজে?
পারভেজ তার মোবাইল সেট বাটনের সাহায্যে আলোকিত করে বলে, ঠিক একটা।
এই মফস্বলেও যেন একটা বেজে যাওয়াটা বলিষ্ঠ কোনও রাত না, এমন একটা ভাব নিয়ে গুরুদয়াল কলেজের বিশাল মাঠের উত্তরে নদীকে ঠিক সামনে রেখে বেশ আরামের ঢঙে বসি। সঙ্গে সঙ্গে নদী থেকে একদল বাতাস এসে প্রেমিকার মতো নরম শরীরে আমাদের জড়িয়ে ধরে। এবং নদীর জল কাচের টুকরোর মতো জ্বলজ্বল করে ওঠে। আমার আনত মুখটা আকাশের দিকে তুলে দেখি, অবোধ শিশুর অর্ধেকটা মুখের মতো চাঁদ ওঠেছে।
পারভেজ বলে, বসলে যে, বাসায় ফিরবে না?
ফিরব। বস, নরসুন্দার সাথে দুঃখ শেয়ার করি। অথবা তার মুক্তোজলে দুঃখ ধুয়ে শুদ্ধ করে নিয়ে যাই।
পারভেজ নীরবে, শান্ত হাতে আমার কাঁধে ভর করে বসে। বাতাস এবং চন্দ্রালোক তেমনিভাবে জড়িয়ে রাখে আমাদের। চমৎকার এমন ঘুমন্ত পরিবেশে ভেতরটা কেমন হু হু করে ওঠে।
পারভেজ জড়ানো কণ্ঠে বলে, দ্বীপের জন্যে খারাপ লাগছে?
আমি বাতাসের বিপরীতে ধীরে ধীরে তার দিকে তাকিয়ে বলি, নাহ্। নাতো। আসলে কোনো নির্দিষ্ট মেয়ের প্রতি আমি আর আগ্রহী নই। কোনো নির্দিষ্ট মেয়ের ঠোঁট, বুক, উরুসন্ধি... জান, আমাকে আর টানে না।
আমি আমার মাথাটাকে নামাজরতদের মতো করে আনত করি। তারপর পুনরায় বাতাসের বিপরীতে পারভেজের দিকে মুখ তুলে বলি, জানো, মানুষের চিরদিনের ধর্ম হল দুঃখদাতাগোষ্ঠীকে এড়িয়ে চলা। কিন্তু আমার ব্যাপারটা ঠিক তার উল্টো। ইন্দুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর থেকে সাধারণভাবে আমার উচিত ছিল ওসব থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখা। কিন্তু তখন থেকে আমি চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছি। নারীজাতিকে নানা প্রকারে ভালো লাগছে। হাত ধরে হাঁটতে, চুমু খেতে কিংবা বিছানায় যেতে অসম্ভব পুলকিত হচ্ছি। কিন্তু তারপরই সেই শূন্যতা। অস্তিত্বে মৃত্যু আর অচল কণ্ঠের গোঙানি। কিন্তু এভাবে কতকাল? মৃত্যুর কাছে পরাজয়ের আশক্সকায় আর কতোদিন এমন মুষড়ে থাকা?
পারভেজ আমার বাম কাঁধে মৃদু চাপ দিয়ে বলে, পার্টনার, আমার মনে হয় কেবলই যৌনতাকে অবজ্ঞা করে তুমি নারীর কাছে যেতে পার, তবেই সৃষ্টির উৎস পাবে। পারবে? আছে কেউ?
আমি কিছুক্ষণ পুরোহিতের মতো যেন ধ্যানে বসি। নিজের ভেতর পারভেজের উচ্চারিত শব্দের প্রতিধ্বনি হয়, আছে কেউ? তারপর হঠাৎ বিশ্বাসী কণ্ঠে বলে উঠি, পারব। জানো, দীর্ঘদিন থেকে, হ্যাঁ, অনেকদিন থেকে সমস্ত নারীর আড়ালে আমি একজনের প্রেমে পড়ে আছি। ঠিক তুমি যেমন বললে, কেবল যৌনতা নয়। তার ক্ষেত্রে আমার শরীর থেকে সমস্ত আদিমতা নিঃশেষিত আছে। পারভেজ, মনে পড়ছে, ঝোঁপের ভেতর ঝিঁ ঝিঁ ডাকা আর আকাশ ভর্তি এক তারকারাতে তার কথা ভাবতে গিয়ে আমি হঠাৎ আর্তনাদের মতো ডেকে উঠেছিলাম, নিশিকানন, নিশিকানন...।
জানি, রাজু ভাস্কর্যের নিচে এক বিকেলে বলেছিলে। তবে চমৎকার নাম দিয়েছ তার।
তারপর পারভেজ হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে, আচ্ছা, চন্দ্রিমার কোনো খবর জানো? খোকা ভাইয়ের সাথে তার যোগাযোগটা কেমন আছে?
জানি না। তবে মনে হয় তাদের বেশ চলছে। জানো, এক রাতে বেনামে মোবাইলফোনে দীর্ঘক্ষণ চন্দ্রিমার সাথে কথা বলেছিলাম। তারপর আর এক রাতে। তারপর আর এক রাতে...
কী কথা বললে এত?
সংস্কৃতি বিষয়ক। চন্দ্রিমা তো ঘোর নারীবাদী। তাই ঘুরেফিরে তসলিমা, অ্যানিলেকদের কথাই বারবার প্রসঙ্গপাত করেছে।
খোকা ভাই জানে?
জানে।
তখন তার অনুভূতি কেমন ছিল?
তখন তার চেহারা দেখিনি। তবে স্পষ্ট মনে আছে, খোকা ভাই শীতল কণ্ঠে বলেছিল, শেষমেশ পরকীয়া শুরু করেছ?
পারভেজ তার শব্দের সীমাবদ্ধতা ভেঙে হেসে ওঠে। অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ শব্দের দ্যোতনায় গা ছমছম করা পরিবেশটা যেন প্রাণ ফিরে পায়। তার হাসিটা বন্ধ হলে নদীর ওপার থেকে যেন ব্যঙ্গ করে অনুরূপ একটা হাসি ফিরে আসে। এই হাসির ওপর ভর করে আসে কয়েকটা কুকুরের সমষ্টিগত আওয়াজ।
আমি বলি, তোমার ললিতার কী খবর? ওর ক্রিয়েটিভিটি ভালো। চাইলে লিখতে পারত। আমার বিশ্বাস।
আমি একদিন বলেছিলাম। হেসেই উড়িয়ে দিল। বলল, ক’দিন পরে দেখবে লেখকরাই কেবল নিজেদের লেখা পড়ছে। সাধারণ পাঠক পাবে না। সুতরাং পড়ার ঐতিহ্য যেন জাদুঘরে না যায়, সে জন্য আমাকে পাঠক হিসেবেই থাকতে দাও।
খানিকক্ষণ থেমে আবার সেই বাতাসটা বয়। আমি আড়ষ্ট হয়ে প্রার্থনারত ধর্মভীরুদের মতো বসে থাকি। পারভেজ একটা সিগেরেট ধরায়। এই বাতাসেও বেশ কায়দা করে প্রথমবারেই সে কাজটা সম্পাদন করে। আমি বিমুখ হয়ে বসে থাকি। যেন ধূমপান ক্ষমার অযোগ্য। আর এমন হীনকর্ম থেকে আমি মুক্ত।
পারভেজ পুনরায় আমার বাম কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলে, কীটস্?
আমি নরসুন্দার জলের মতো কেঁপে ওঠি। করুণ চোখে তাকাই তার দিকে। পারভেজ একগাল ধোঁয়া ছেড়ে মৃদু হেসে বলে, খোকা ভাই বলে।
কেন জানি আমি কুঁকড়ে যাই। হাত পা গুটিয়ে আরও সংযত হয়ে সাধু-সন্ন্যাসীদের মতো ধ্যানী হয়ে বসি। চোখ বন্ধ করে বলি, কীট্স, হায় কীটস্। তোমার মৃত্যুর একশ’ পঁচাশি বছর পর অদ্ভুত গভীর রাতে এক ঐতিহ্যবাহী নদীর তীরে বসে তোমাকে স্মরণ করছি। স্মরণ করছি তোমার ধমনি থেকে উঠে আসা রক্তকে যা তোমার মৃত্যুর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্মরণ করছি ফ্যানি ব্রনকে, যাকে প্রচুর ভালোবেসেও মৃত্যুর সময় কাছে পাওনি। আর মূলত স্মরণ করছি তোমার অসাধারণ সৃষ্টিকে, যা তোমার মৃত্যু এবং মৃত্যুযন্ত্রণা অতিক্রম করে বিকশিত করেছে বিশ্বের সৌন্দর্যকে। কীট্স, তুমি কি তোমার বন্ধু শেলির মতো ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ছিলে? তবে কীট্স, তুমি মৃত্যুকে জয় করেছ। তুমি গর্বিত। তোমার মৃত্যুর একশ’ পঁচাশি বছর পর এক অখ্যাত কবি না লিখতে পারার যন্ত্রণা নিয়ে তোমাকে স্মরণ করছে। কীটস্, তোমার বয়সী আমি যদি আজ এই মাতাল রাতে নির্জীব হয়ে যাই, যদি তোমাকে স্মরণ করাই আমার শেষ কবিতা হয়, তবে আগামী একশ’ পঁচাশি দিন পর আমার বিবর্ণ ফটোগ্রাফের সামনে দাঁড়িয়ে আমার মা ছাড়া আমাকে কে স্মরণ করবে?
কীটস্, তুমি গর্বিত। সীমাহীন আর্থিক দৈন্য নিয়েও তুমি মৃত্যুকে জয় করেছ।
আমার শরীর পাথরের মতো শক্ত হয়ে আসে। আমার আনত মাথাকে দু’হাঁটুর ফাঁকে রেখে ফুঁপাতে থাকি। পারভেজ আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকি দেয়।
পার্টনার?
আমি শিশুর মতো নরম করে মাথা তুলি।
তুমি কাঁদছ?
আমি বাম হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মোছি। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কিছু অন্ধকার হয়ে আসে।
সকাল দশটায় ঘুম থেকে জেগে অনুভব করি চোখ দুটো পাথরের মতো শক্ত আর ভারী লাগে। তারপর অনেকদিন পর গায়ে জড়ানো গত রাতের বাসি কাপড় নিয়ে পুকুরে সাঁতার কেটে গোসল করি। গোসল শেষে নিজেকে বেশ হালকা লাগে। মনে হয় একটু জোরে বাতাস এলেই শিমুল তুলোর মতো উড়ে যাব।
শহরে ঢোকার প্রথম গলির মাথায় একটা চা’র দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে কড়া এক কাপ চা খাওয়ার সময় কেন যেন মনে হয় খোকা ভাই আজ যাচ্ছে না। তারপর ঠিক করি আজ পায়ে হেঁটে খোকা ভাইয়ের বাসায় যাব। সে কি বাসায় আছে?
প্রথম গলি পেরুতেই মনে হয় আমি নতুন কোনও শহরে (পথ ভুলেই কিনা) ঢুকে পড়েছি। পরিচিত পথ এবং হঠাৎ হঠাৎ পরিচিত মুখগুলো অপরিচিত কিন্তু শ্যাম্পুমাখা চুলের মতো ঝরঝরে লাগে। তাদের দেখে মনেই হয় না জীবন এক জটিল আবর্তে ঘূর্ণায়মান। জীবন যে চলমান পরিবেশের ওপর এমন চমৎকারভাবে বিরাজ করতে পারে তা দেখে ঈর্ষায় আমার চোখ লাল হয়ে ওঠে। জীবনের অজ্ঞাত নস্টালজিক শব্দগুলো বিক্ষিপ্ত আকারে মগজে ও মনে ঘুরপাক খায়। মনে হয় আমার জন্য উপযুক্ত হল নির্জনতা। আমি নড়ে উঠি। হ্যাঁ, নির্জনতা। ঠিক এই শব্দটাই থেকে থেকে খুঁজছি ক’দিন যাবৎ। মানুষের মাঝেই নির্জনতাকে উপলব্ধি করার মাতাল ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়াস পাই থেকে থেকে।
আমি বামে জুট ইনস্টিটিউট, আদালত ভবন আর ডানে হর্টিকালচার রেখে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন কিন্তু একাগ্র হয়ে হাঁটি। মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে ওঠে। তালুতে হাত রেখে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা অনুভব করি। কতক্ষণ তাপমাত্রার যোগফল এটা? পায়ের তলার বিটুমিন থেকে উঠে আসা তাপমাত্রাটাও টের পাই খুব সহজে। এই একটা সময়কে বড় বিশ্রী লাগে। মনে হয় সবকিছুতে দারুণ দুর্ভিক্ষ। কী বৃক্ষে, কী পথে, কী অন্তরীক্ষে কিংবা শ্রমিকের ঘামে। বিশেষত মনে হয় শ্রমিকের ঘামে আমার সব সময়ের ঘোর বেদনা। কিন্তু তাদের সাথে আমার দূরত্ব কমে না। দূরত্ব কমে না, না কমাতে চাই না?
মনে পড়ে থেকে থেকে গুমরে উঠা এক মেঘাচ্ছন্ন রাতে আমাকে আর তন্ময়কে বাধ্যগত শিষ্যের মতো তন্ময়াচ্ছন্ন বসিয়ে রেখে গুরু আশুতোষ ভৌমিক তার বিশ্বস্ত হাতে লিখেছিলেন, ক্ষেতের আইলে ভাঙনের শব্দে বাজে সাম্যের গান...
তন্ময়তো বরাবর তোষামোদী। কিন্তু তার মতো তখন আমিও গুণকীর্তনকারী প্রজাদের মতো সমস্বরে বলে উঠেছিলাম, বাহ্, বা-বা-বা, সোবহান আল্লাহ...
আমি নীরবে কেঁপে উঠি। তবে কি আমি স্ববিরোধী? শ্রমিকের ঘামের মাঝে কি আমি হিমোগ্লোবিনের করুণ ছাপ দেখি না?
খোকা ভাইয়ের বাসায় ঢোকার মুহূর্তে চোখে পড়ে খোকা ভাই আর চন্দ্রিমা পরস্পর হাত ধরাধরি করে বেরুচ্ছে। আমি অগত্যাই অবাক হই। অথচ এটা পূবদিক থেকে সূর্য উঠার মতোই স্বাভাবিক আর সঙ্গত। ওরা পরস্পর হাত ধরে হাঁটবে, গোপনে চুমু খাবে, চুলের গন্ধ নেবে, রাত জেগে কবিতায় অলংকরণ হিসেবে পরস্পরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সাজিয়ে রাখবে এটাই সাধারণ নিয়ম। অথচ আমি নিয়মকে অবজ্ঞা করে অবাক হই।
আমাকে দেখে ওরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। খোকা ভাইয়ের নিষ্পাপ মুখে অপরাধবোধের ছায়া পড়ে। যেন কোনও মেয়ের হাত ধরা চুরি করার মতো অন্যায়। চন্দ্রিমা ওরকম বিষয়ে লজ্জা পাওয়ার মতো মেয়ে না। কিন্তু আমাকে সত্যিকারের অবাক করে দিয়ে সে-ও সঙ্কুচিত হয়। তার পাতলা ঠোঁটের বিচিত্র ভঙ্গি দেখে আমি টের পাই।
আমি বলি, বেরোচ্ছেন নাকি?
হ্যাঁ। কিন্তু এসময় তুমি এখানে?
হ্যাঁ। শুনলাম চন্দ্রিমা এসেছে। অনেকদিন দেখা নেই। ভাবলাম সময় মানুষের ওপর কতোটা প্রভাব বিস্তার করে একবার দেখে যাই।
চন্দ্রিমা আমার অভিনয়টা ঠিক ধরে ফেলে। বলে, ফাও কথা বলবেন না। জোর দিয়ে বলতে পারবেন, কখনও স্মরণ করেন?
খোকা ভাই বলে, আজকের মানববন্ধন কর্মসূচিতে তোমার কোনো দায়িত্ব ছিল না?
আমি হতভম্ব হয়ে যাই। একটু আগে খোকা ভাইয়ের মতো লজ্জা আর অপরাধবোধও জেগে ওঠে। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুলেছিলাম কীভাবে?
রংমহলের সামনে এসে দেখি প্রস্তুতির পর্ব শেষ। সবার বুকে নানা প্রকার শ্লোগান লেখা প্লেকার্ড লাগানো। আমাদের দেখে আসলাম আর মান্না খুবই মুডি ভঙ্গিতে ক’টা প্লেকার্ড নিয়ে এগিয়ে আসে। আমি তাদেরসহ অন্যদের সাথে চোখে চোখে কুশল বিনিময় করি। মান্না আমাকে বলে, তোমার দায়িত্বজ্ঞান দেখে অবাক হয়ে যাই। আজ এমন একটা দিন অথচ তোমার কোনো পাত্তা নেই।
তারপর চন্দ্রিমার দিকে এক পলক চোখ মেরে খোকা ভাইকে বলে, আর আপনি, খোকা ভাই, বাসায় থেকেও এত দেরি করলেন?
মান্না এতক্ষণে ঠিক জেনে গেছে খোকা ভাই কেন আজ ঢাকা যায়নি আর বাসায় থেকে কেন তার এত দেরি হল? পাশে চন্দ্রিমা না থাকলে ঠিক টের পাইয়ে দিতো। চন্দ্রিমা মান্নার কেবল দূরাত্মীয় নয় মানসিকতায় দূরবর্তীজনও।
মান্নার মনের উত্তেজনাটা যত দ্রুত জ্বলে উঠে নিভেও তত সহজে।। আমি আর খোকা ভাই মিষ্টি হেসে নিভিয়ে দিই। তারপর আমি পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বোলাই।
আসলাম বলে, কাকে খোঁজো?
আমি নিচু স্বরে বলি, দ্বীপ আসেনি?
এসেছেতো। তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল দু’বার।
আমি জিরাফের মতো গলা লম্বা করে বলি, কই, চোখে পড়ে না তো।
এরই মধ্যে শাহ আজিজ কাকা হাঁক ছেড়ে তার প্রতি মনোনিবেশ করার আহ্বান জানান সবাইকে। আমরা সবাই বাধ্যগত ছাত্রের মতো শোরগোল বন্ধ করে তার দিকে শ্রদ্ধাবনত দৃষ্টি তাক করি। তিনি রাজনৈতিক বক্তৃতার ঢঙে ডান হাতের তর্জনী নাড়িয়ে আজকের কর্মসূচির প্রেক্ষাপট পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন। তারপর বুকে জমাকৃত প্লেকার্ড লাগানো ছেলেমেয়েদের জটলাটা ভেঙে যায়। আমিও তাদের মতো বুকে ‘‘জঙ্গি উত্থানে সহযোগিতা করছে কারা?’’ লেখা প্লেকার্ড সেটে লম্বা লাইনের একেবারে শেষ মাথায় পারভেজের হাত ধরে দাঁড়াই। কেমন যেন একটা উৎসবের আমেজ আর উত্তেজনায় সারা শরীর টগবগ করে।
পারভেজ বলে, পার্টনার, জানো আজও দু’টা ছেলে শেষ মুহূর্তে কেটে পড়েছে।
আমি অবাক কণ্ঠে বলি, তাই?
হ্যাঁ।
আচ্ছা ওরা কেমন মানসিকতা নিয়ে এই লাইনে আছে বলত?
জানি না। বলে লাভ নেই। আসলে মনের ভেতর গেঁথে থাকা সংস্কারটা যায় না। কে জানে, একেবারে মূলে গেলে হয়তো দেখা যাবে আমাদের ভেতরেও এমন কিছু রয়ে গেল কি না।
পারভেজের এই কথাটা আমি বুঝি না। আমাদের ভেতরেও এমন কিছু রয়ে গেল মানে কী? এটা যদি আইয়ুব খান কিংবা এরশাদের শাসনকাল হত তবে কি আমরা এভাবে হাতে হাত মিলিয়ে প্রতিবাদ করতাম না? বুলেটের ভয়ে দরজায় সিটকিনি এঁটে বসে থাকতাম? আমাদের রক্তাক্ত শার্টকে হয়তো শামসুর রাহমান প্রাণের পতাকা বলতেন না। তাতে কী আসে যায়? গভীর প্রত্যয়ে সঠিক কাজে নিজেকে সমর্পণ করাই কি আসল নয়? আমার পরিচিত একজন শিল্পী ও ভাস্কর আছেন। নাম সাঈদ আলমগীর। শিল্পের প্রতি তার গভীর মমত্ববোধ। একবার এক মেলায় ছোট ছোট কয়েকটা ভাস্কর্য নিয়ে সারাদিন বসেছিলেন। দিনের একেবারে শেষ লগ্নে কী মনে করে এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক একটা মূর্তির দাম করেছিলেন পনের টাকা। তাতে কি তার শিল্পবোধের গুরুত্ব কমে গেল?
ব্যাখ্যা চাওয়ার জন্য পারভেজের দিকে আমার মুখ তুলে রাখি। কিন্তু মুখ ফুটে বলার আগেই অনুভব করি ভেজা এবং নরম একটা হাত আমার ঝুলে থাকা হাতের মুঠোয় আলতো করে চাপ দিয়ে আছে। আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখি দ্বীপ তপ্ত রাস্তার ওপর স্থিরদৃষ্টি ফেলে দাঁড়িয়ে আছে।
দ্বীপ আমার দিকে না তাকিয়ে নিচুকণ্ঠে বলে, মানুষের মনে কতো সহজে আঘাত দিতে পারেন আপনি।
আমি বিস্মিতকণ্ঠে বলি, বুঝলাম না।
এত দেরি করলেন যে?
আসলে ঘুম থেকে জাগতে অনেক দেরি হয়ে গেল।
দ্বীপের কপালে অনেকগুলো ঘামের ফোঁটা জড়াজড়ি করে জমে আছে। নাকের ডগার কণাগুলো জ্বলে ওঠে হিরার মতো। একবার ইচ্ছে করে মুছে দিই সবার আড়ালে, আলতো করে। কিন্তু এভাবে দ্বীপকে দারুণ লাগে।
আমি বলি, তোমার বর তোমাকে খুব ভালোবাসবে।
কেন?
তোমার নাক ঘামছে।
ধ্যেৎ, বাজে কথা।
তারপর দ্বীপের নিচু কণ্ঠটা শীতল হয়ে আসে। বলে, গতকাল বলেছিলেন আপনি এতদিন মরেছিলেন, আমার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বেঁচে উঠেছেন। অনেক রাত পর্যন্ত আপনার কথাটা ভাবতে ভাবতে মনে হল আমার বেলাতেও ঠিক তাই ঘটেছে। আর প্রবল ইচ্ছা হল আবার একদিন অনেকগুলো পরিচিত মানুষের সামনে আপনার হাত ধরে হাঁটব অথবা ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকব। তখন হঠাৎ আজকের প্রোগ্রামের কথা মনে হল। কী যে উত্তেজনা অনুভব করেছিলাম, মনে হয়েছিল এবার সত্যিকারের বেঁচে উঠছি। কিন্তু আজ যখন আসছিলেন না, জানেন, যেন ঠিক মরে যাচ্ছিলাম।
আমি বলি, আমাদের প্রথম স্পর্শ মনে আছে?
আছে। ঠিক এখানে। এভাবে।
আমি বলতে চাই সেই আমার প্রথম স্পর্শ। কিন্তু বলি না। কারণ দ্বীপ আমার প্রথম স্পর্শ নয়, নয় প্রথম অনুভূতিও। নারীস্পর্শ যদি পাপ হয় তবে আমি দীর্ঘদিনের বহু নারীস্পর্শের পাপী, তবে আমাকে দিয়ে হয়তো আরও অনেক পাপ হবে। শুধু প্রেম হবে না। ত্রিদিব দস্তিদারের মতো বলা হবে না, ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেব। কারণ ইন্দু...। আহ্, আবার ইন্দু! প্রথম স্পর্শ, কেবলই সঙ্গম আর ক্রমাগত ক্ষয়ে যাওয়া, সৃষ্টির উৎস ফুরিয়ে যাওয়া?
আমার পাশেই, দ্বীপের প্রায় শরীরঘেঁষে একটি রিকশা দাঁড়ায়। রিকশা থেকে নীল রঙের শার্ট পরে নেমে আসেন রায়হান ভাই। সঙ্গে আকাশি রঙের শাড়ি জড়ানো শ্যামলা রঙের একটা মেয়ে। রায়হান ভাই দীর্ঘলাইনের প্রতিটি মুখের দিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চোখ মারেন। আমি লক্ষ করি আমার আর দ্বীপের হাতদ্বয়ের সন্ধিস্থলে দৃষ্টি রেখে কেমন বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তারপর রিকশায় চেপে বসেন। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিও।
আমি কণ্ঠে বিস্ময়ভাব জমা করে বলি, কী ব্যাপার, দাঁড়াবেন না?
রায়হান ভাই যেন শুনতে পাননি এমন ভঙ্গিতে খটখটে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকান। তারপর আর কিছু বলার আগেই রিকশাসহ এই যুগল অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি রহস্যপূর্ণভাবে নিঃশব্দে ঠোঁটের কারুকার্যে হাসি। দ্বীপের দিকে তাকিয়ে দেখি এক প্রকার অপরাধীর মতো লজ্জা এবং ভয়ের মিথষ্ক্রিয়ায় ও সঙ্কুচিত হতে থাকে। প্রথম প্রেম, প্রথম দংশন কিংবা জোচ্চুরি আঘাতপূর্ণ হয়ে থাকে। দ্বীপ কিছুতেই আমার প্রথম নয়। তাই হয়তো রায়হান ভাইকে দেখে দ্বীপের এমন ন্যুব্জতা আমাকে কোনোরকম নিঃস্ব করে না।
রাত আটটার দিকে দমকা হাওয়া বইতে শুরু করে। পারভেজের জন্য অপেক্ষমাণ আমি আখড়াবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে আকাশের বিদ্যুৎ খেলা দেখি। বিজলির সাথে সাথে বজ্রপাতের শব্দে অনেকেই ছুটাছুটি করে। কেউ কেউ মাথায় টুপি জড়িয়ে ঢুকে মোড়ের পাশেই দণ্ডায়মান গর্বিত মসজিদে। কী মনে করে আমিও তাই করি। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে যতœ সহকারে ওজু করি। তারপর বিশ্বাস করি আর না করি ইমাম সাহেবের পেছনে শ্রদ্ধা আর ভয়ে জড়িয়ে থাকা মুসল্লিদের লাইনে দাঁড়াই। কখনও রুকু আর কখনও সেজদায় লুটিয়ে পড়ি অভিব্যক্তিহীন। নামাজ শেষে দু’হাত থালার মতো গোল করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি দু’হাতের সন্ধিস্থলে। আমার চতুষ্পার্শের লোকজন নানান ভঙ্গিতে মুখ বিকৃত করে বিলাপের সুরে এটা ওটা প্রার্থনা করে। কেমন যেন ওসব বিষয় সংক্রমণের মতো প্রভাব ফেলে আমার ওপর। নিজেকে নিঃস্ব আর ভিখিরির মতো মনে হয়। নিজের শূন্যতাকে পুঁজি করে কিছু চাইতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কী চাইব। কার কাছে চাইব?
মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেখি এ যেন মফস্বল নয়, কোনো ব্যস্ততম নগরী। পরিষ্কার আকাশের নিচে সবকিছুর মাঝে এক প্রকার চাঞ্চল্যবোধ লক্ষ করি। আমার কিছুক্ষণের সহবাসী মুসল্লিগণকে দেখি আমাকে অতিক্রম করে যেন চেহারায় কথিত স্বর্গের তৃপ্তি নিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। আমার ভেতর পুরনো একটা ধাঁধা অথবা প্রশ্ন সাপের মতো মোচড় দিয়ে ওঠে জটিল বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু; কে এই ঈশ্বর? অবিনশ্বর শব্দের নশ্বরতা অথবা অলৌকিক শব্দের লৌকিকতা কী?
আমি যদি ঈশ্বরে পুরোপুরি বিশ্বাসী হতাম তবে নিশ্চয়ই মিথ্যে আশ্বাসে হলেও মুসল্লিদের মতো অগাধ শান্তি বয়ে বেড়ানো যেত। অন্ধবিশ্বাসে জীবনকে চারদিক থেকে সঙ্কুচিত করে বলা যেত, এই আমার বেহেশত।
রাস্তা পার হতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে পারভেজ বলেছিল, মনের ভেতর গেঁথে থাকা সংস্কারটা যায় না।
বৃষ্টিতে ভেজা সোঁদা গন্ধের রাস্তা অতিক্রম করে ‘দৈনিক আজকের দেশ’-এর সামনে এসে দাঁড়াই। একতলা টিন শেডের পত্রিকা অফিসটা ঠিক আগের মতোই আছে। এখানে এই ‘আগের মতোই’ শব্দ দুটো আমার কাছে বেশ অর্থবহ। কেননা এখানেই আমার আনকোরা খন্ড সময়ের প্রথম বিচরণ। ছাপার অক্ষরে আমার লেখার হাতেখড়ি। নিষ্পাপ বালিকার মতো চন্দ্রিমার সাথে প্রথম অক্ষর বিনিময়। খোকা ভাই এবং খোকা ভাইয়ের সাথে চন্দ্রিমার প্রথম দেখা এখানেই। তারপর দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত আমাদের রাত আর দিনের হিসেবটা বাচ্চাদের যোগ অঙ্কের মতো কতো সহজ ছিল। এই মফস্বলের সকল আঙ্গিনায় আমাদের প্রজন্ম ছড়িয়েছিল শুদ্ধ কুয়াশার মতো। তারপর থেকে জীবনের প্রয়োজনে সময়ের কাছে সমর্পিত হয়ে একে একে শিমুল তুলার মতো পরস্পর অথবা নিজস্ব গতির আবেদনে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রজন্ম কি প্রশ্নবিদ্ধ? সময় এত স্থূল হয় কেন?
শিল্পকলার সামনে এসে শুনি ভেতরে হট্টগোল। গেটের দিকে তাকিয়ে প্রথমে ধাঁধায় পড়ে যাই। ভুল করছি না তো?
অনেকদিন পর অলস পায়ে গেট মাড়িয়ে ভেতরে ঢুকি। ঢুকে খুব অবাক হয়ে যাই। শিল্পকলার সেই পরিচিত ভাঙাচোরা শরীর এমন উঁচু বিল্ডিংময় হয়ে উঠেছে দেখে সঙ্কুচিত হয়ে যাই। মনের কোনো এককোণে বিঁধে থাকা মফস্বলের সাথে আমার দূরত্বটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেন অগাধ সম্ভাবনা নিয়ে আমি কোনো এক নগরীতে জন্মেছিলাম। যেন ‘আড্ডা’ শব্দের সাথে পরিচিত হওয়ার পর থেকেই আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ মোড়, নিশিতে পিজি-র আঙিনা অথবা টিএসসি-র মোড়ে নিজেকে উত্তাল করে তুলেছি। অথচ কত গতি, প্রেম আর স্পর্শ দিয়ে এই মফস্বল আমাকে, আমাদেরকে সংঘ করে রেখেছিল।
আমার নাম ধরে কেউ একজন হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠে। আমি অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চোখ মারি। ফর্সা চেহারায় মেয়েলি হাসির প্রলেপ মেখে সজল এসে দাঁড়ায় আমার ঠিক মুখোমুখি।
সজল কিছুটা বিস্মিত কণ্ঠে বলে, কীরে তুই এখানে?
কেন, মানা আছে?
আরে নাহ্। অনেকদিন এই চত্বরে তোর পদচিহ্ন দেখি না, তাই। ঢাকা থেকে কখন আসিস আর যাস টেরই পাই না।
আসলে খুব কম সময় নিয়ে আসি।
নাকি দূরত্ব সৃষ্টির সূক্ষ্ম চাল?
আরে নাহ্। তা ছাড়া এই লাইনের লোকেরা অঞ্চল দ্বারা বিভক্ত হয় না এবং তাই পথের দূরত্ব সীমানা নির্ধারণের মধ্যে পড়ে না।
সজল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সাথে সাথেই আমাদের কাছ থেকে কিছুটা দূরে, তুলনামূলক অস্পষ্ট আলোয় গুটি ক’জনের জটলা থেকে প্রথমে ক্ষীণ, পরে ঝড়ের মতো হাসির ছটা বেরিয়ে আসে এবং সম্ভবত উচ্ছ্বাসের চাপে একটা মেয়ে জটলা থেকে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
সজল বলে, চিনতে পারিস?
নাহ্। কখনও দেখেছি বলে মনে হয় না। কে?
সজল তার মেয়েলি হাসির পুনরাবৃত্তি করে বলে, যুথি। এবার চিনেছিস? মনে করে দ্যাখ, ঠিক মনে পড়বে।
আমি পাথরের মতো নীরব হয়ে মনে করার চেষ্টা করি। তারপর বলি, হ্যাঁ, পড়েছে। যুথি, যাকে আমি দেখব বলে দু’জনে পাবলিক লাইব্রেরিতে পুরো একটা বিকেল ওভারকাম করেছিলাম।
সজল যেন আমার কথাটা শুনতে পায়নি এমন ভঙ্গিতে হাত উঁচিয়ে মেয়েটিকে ডেকে ওঠে। মেয়েটি প্রথমে নাচের ঢঙে কোমরে ছোট একটা ঢেউ তোলে। তারপর প্রচলিত মডেলদের স্টাইলে সজলের পাশে প্রায় শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়। আমি খুব সংক্ষিপ্তভাবে যুথিকে এক পলক দেখে নিই। দেখে ছোট একটা ধাক্কা খাই। মেয়েটির চেহারায় এক প্রকার মাধুর্য আছে যা প্রথম দর্শনেই ঠিক ভেতরে করাঘাত করে। তবে সজল মেয়েটির সৌন্দর্যের যে নিপুণ ব্যাখ্যা দিয়েছিল ততটা কোনোমতেই না।
সজল বিনয়মিশ্রিত ভাষায় আমার সাথে তার পরিচয়পর্ব শেষ করে।
যুথি বলে, আমি আপনার লেখা পড়েছি। বেশ ভালো লেখেন। আপনার উচিত পেছনে না তাকিয়ে ক্রমাগত লিখে যাওয়া।
সদ্য পরিচিত কোনো মেয়ের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকা কোনো সভ্য লোকের কাজ না। কিন্তু আমি দ্বিধাহীন সেই কাজটাই করি। যখন বুঝতে পারি যুথির প্রশংসাসূচক শব্দগুলোতে কৃত্রিমতা নেই তখন চোখ নামিয়ে আনি। তারপর ডান হাতটা বুকের এক পাশে রেখে সেই কষ্টটা অনুভব করি। যুথির ‘ক্রমাগত লিখে যাওয়া’ বাক্যাংশটুকু বুকের ভেতর ক্রমাগত উঠানামা করে। আমি দ্রুত নিজেকে সামলে নিই।
যুথি বলে, আপনারা কথা বলুন। আমি ওদিকটায় আছি। আর নাটক দেখে যাবেন কিন্তু।
যুথি নৃত্যের ঢঙে চলে যাওয়ার আগে অকারণেই উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। আমার মস্তিষ্কে ঝিনঝিন শুরু হয়। কার যেন দুরন্ত হাসির মুখচ্ছবি ফিরে আসে। আমি কিছুক্ষণ তন্ময় হয়ে সেই ছবিটা খুঁজে আনার চেষ্টা করি। কিন্তু ছবিটা কার? কার?
আমি আপনা থেকেই ঐ প্রসঙ্গ আড়াল করে যুথির ‘নাটক’ শব্দটা নিজের মধ্যে টেনে আনি। নাটক।
হায় কবি, কেমন দেখলেন?
চমৎকার, দুরন্ত কিন্তু বয়স কম বলে মনে হল। সম্ভবত টিনএজ তাই পটিয়েছিস ভালোই। চালিয়ে যা।
ঝারি দিবি না। তোর নারীপ্রীতি সবার জানা। বিকেলে বাবলীর সাথে দেখা হয়েছিল। ঢাকা থেকে আসার পর নাকি একবারও দেখা করিসনি।
আমার শীতল শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। বাবলী? যুথিকে দেখে যে নামটা বারবার আমার মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছিল কিন্তু মনে পড়ছিল না। হ্যাঁ, বাবলী।
সেদিন সকালে আমাকে দারুণ বিস্ময় পেয়ে বসেছিল। বাবলীকে কখনও কাজিন ছাড়া অন্য কিছু ভাবিনি, সম্ভবত সে কারণেই ভেতরে ভেতরে বেড়ে ওঠা তার লোভনীয় নারীত্ব আমার সূক্ষ্মদৃষ্টিকে এড়িয়ে গেছে। আমার জন্য অর্থবহ অথবা তাৎপর্যপূর্ণ ‘সেদিন সকালে’ প্রচলিত পবিত্র মনে ওর ঘরে (যদিও সচরাচর বাবলীল ঘরে অনুপ্রবেশ করতাম না।) ঢুকেছিলাম। আমি আজও প্রায় সকালে সেদিনের সকালকে স্মরণ করি। কেননা সকালটা ছিল সত্যিকার অর্থেই কমনীয়। পরে যাকে বেশ ক’বার বাবলীর তরলের মতো নমনীয় শরীরের সাথে তুলনা করেছি।
বাবলী সম্ভবত তখন পনেরোতে। সে বিছানায় উপুড় হয়ে যতখানি লিখছিল তার চেয়ে বেশি বিরক্ত হয়ে কলম কামড়াচ্ছিল। আমাকে দেখেই সে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে লাফিয়ে উঠল এবং অনুনয়ের স্বরে বলতে লাগল, প্লিজ, অঙ্কটা মিলিয়ে দাও না। নইলে ক্লাসে সবগুলো মেয়ের সামনে স্যার আমাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবে। জাননা তো, আমাদের অঙ্কের স্যারটা কতো পাজি।
আমি মজা করে বলেছিলাম, তাতে আমার লাভ?
বাবলী এক মিনিট চোখ বন্ধ রেখে ঠোঁট কামড়ে বলল, তোমাকে দারুণ দুটো জিনিস দেখাব।
দারুণ কিছু দেখার লোভে নয়, স্বেচ্ছায় সেই সকালে বাবলীর তিনটি অঙ্ক মিলিয়ে দিয়েছিলাম আমি।
বাবলী বলল, তোমার চোখ দুটো বন্ধ কর তো।
এক মিনিট পরে চোখ খুলে আমি কেঁপে উঠেছিলাম। কোনো মেয়ের স্তন যে বাংলাদেশের মতো এমন সজীব আর নিটোল হয় সেই প্রথম এবং তার আঠারোর পূর্ব পর্যন্ত যতদিন তার স্তনযুগল সেই মহিমায় ছিল আমি স্পর্শে ও কামে দেখেছিলাম এবং আঠারোর আগেই আমাকে অবাক করে দিয়ে পড়ার বিপরীতে এমন একটা চঞ্চল ও ঝগড়াটে মেয়ে বাসন্তী শরীরের কামক্রিয়ায় দারুণ মেধাবী হয়ে ওঠেছিল।
রাত একটার দিকে নাটক শেষ হলে বাইরে এসে দাঁড়াই। দু’পায়ে নূপুরের আওয়াজ তুলে যুথি এসে কুর্নিশের ভঙ্গিতে বলে, আলামপনা, এবার বাসায় যাওয়ার হুকুম করুন।
বলেই সে তার নূপুরের শব্দকে ম্লান করে উচ্চশব্দে হেসে ওঠে।
সজল বলে, চল, কালীবাড়িতে যাই।
কেন?
কীর্তন হচ্ছে।
যুথির দিকে তাকিয়ে বলি, যাবে নাকি?
খুব বিনয়ের সুরে যুথি বলে, দুঃখিত।
শিল্পকলা থেকে বেরুলে মনে হয় এ এক ধ্বংসপ্রাপ্ত কোনও প্রাচীন নগরী। পাথর আর ছবির মতো পড়ে আছে সব। কে বলবে এই শহরে একটা সময় ছোটকাগজ প্রকাশের জন্য বিজ্ঞাপন, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে চাঁদা উত্তোলন, এপারে ওপারে চা’র দোকানে, আসলামের স্টুডিওতে আমাদের জীবনগুলো সজীব হয়ে উঠত, মৃত্যুগুলো জীবন ফিরে পেত?
সজল, চল গৌরাঙ্গবাজার দিয়ে ঘুরে যাই।
কেন?
এম্নি, আবারতো এদিকেই ফিরে আসা। মনে হোক বৃত্তাকার চাঁদের ধার ধরে ঘুরছি।
কালীবাড়িতে ঢুকতেই এতক্ষণের প্রাচীনতা মুহূর্তে উধাও হয়ে যায়। খঞ্জর, ঢোল, করতাল আর কোরাসের সুরে রাতের গভীরতা একদম অনুভূত হয় না।
আমরা ওসবকে একপাশে রেখে কালীমূর্তির মুখোমুখি এসে দাঁড়াই। সজল তার দু’পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে ভর করে তার উচ্চতার চেয়ে দীর্ঘ হয়ে ঘণ্টায় আঘাত করে। অনুগত শিষ্যের মতো আমিও তাকে অনুসরণ করি। তারপর সজল ষাষ্টাঙ্গে কালীকে প্রণাম করে। আমিও হাঁটুভেঙে বসি। কিন্তু মধ্যম পদ্ধতিতে কালিকে প্রণাম করার আগে কী মনে করে দাঁড়িয়ে পড়ি। প্রণাম রেখে অগত্যাই বিভোর হয়ে ভাবি, নামাজ আর পূজার মধ্যকার মৌলিক পার্থক্যটা কতোটা গভীর?
কীর্তনের পাশে কিছুক্ষণ বসে থেকে বাজনার সাথে কণ্ঠের তাল না পেয়ে বিরক্ত হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ি। রাস্তায় নামতেই সেই প্রাচীনতা আমাকে ঘিরে ধরে। সেই পাথর, সেই ছবি আমাকে স্তব্ধ করে রাখে। আখড়া বাজারের ব্রিজে উঠতে উঠতে সজল আমার কাঁধে হাত রেখে বলে, কবি?
হুঁ।
কিছু পেয়েছিস মনে হয়?
সজলের ‘পেয়েছিস’ শব্দের অর্থ আমি বুঝি না। কিন্তু প্রশ্নও করি না। নিকোটিনে ঢলে পড়ার মতো কণ্ঠে বলি, একটা বিড়ি ধরা।
সজল পকেট হাতড়ে প্যাক বের করে বলে, ট্রিপল ফাইভ। তোর ভাষায় লেডিস হার্ট। চলবে?
‘চলবে’-র উত্তর এড়িয়ে সজলকে পাল্টা প্রশ্ন করি, আচ্ছা, তোদের থিয়েটার থেকে পারফর্ম করলি অথচ জুয়েল ভাইকে চোখে পড়ল না। ব্যাপার কী রে?
আসেনি।
কেন?
উত্তর না দিয়ে সজল নির্জন দ্বীপের মতো স্তব্ধ হওয়ার ভান করে। কিন্তু আমি সহজেই বুঝে যাই নগরীর মতো মফস্বলেও মানুষের কমার্শিয়াল আত্মার দৌরাত্ম্য কতটা বেড়েছে। তবু আরেকটু অভিজ্ঞ হওয়ার জন্য বলি, যে থিয়েটার পারফর্ম করছে তার নির্দেশকের কোনো পাত্তাই নেই!
সজল আমার জানা কথাটাই নতুন করে বলে, আসলে সবাই কমার্শিয়াল হয়ে যাচ্ছে। তোদের সেই আড্ডা অথবা আড্ডার সেই জোশও এখন আর নেই।
তাইতো মনে হচ্ছে। ঢাকা থেকে আসার পর থেকে তো শহরেই ঘুরছি। অথচ তরুণ ভাইকে একবারও চোখে পড়ল না। কোথায় আছে জানিস কিছু?
আমরা নাটকের লোক। তবু যতদূর জানি, তরুণ ভাই এখন বৃন্দাবন অথবা বৃত্তের বাইরে।
বুঝলাম না।
চন্দ্রিমাকে নিয়ে দুই ভাইয়ের মাঝে ঘাপলা হচ্ছে। কিন্তু রায়হান ভাইয়ের সাথে তরুণ ভাই পেরে উঠছে না।
আমি হঠাৎ বজ্রপাতের মতো উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠি। নিজের হাসির শব্দটা নিজের কানেই উচ্চতর শব্দ হয়ে বাজে। তারপর ২০ বছর পর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে নীতি রায়কে গ্রহণ করার পরও রেসে রায়হান ভাই ভালোভাবে টিকে আছে ভেবে চমৎকৃত হই। তুলনায় একটা পিচ্চি মেয়েকে নিয়ে মধ্যবয়েসী দু’ভাইয়ের মানসিক টানাপড়েনের কথা ভাবতে গিয়ে আবার হাসি। হাসতে হাসতে দু’চোখ জলের পুকুর হয়ে যায়। কে জানে কতদিন পর পাগলকেও হার মানিয়ে এভাবে হাসি। যখন হাসি থামে খুব কাছেই দুটো কুকুর চারপাশে প্রতিধ্বনি তুলে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। সজল ধমক দিলে ক্লাসরুমে হট্টগোলরত ছাত্রদের মতো থমকে যায় তারা।
কলেজ গেটে এসে সজল একটা ট্রিপল ফাইভ ধরায়। আর একটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, চল বাসায় যাই। কোয়ার্টার প্যাক আছে একটা। দু’জন মিলে জল মিশিয়ে মেরে দিই।
আমি কোনো উচ্চবাচ্য করি না। পৃথিবীর খণ্ডিত অংশকে ঘুম পাড়ানো সদা জাগ্রত আকাশের দিকে চোখ মারি। তারপর ফালি করা তরমুজের মতো চাঁদ থেকে চোখ নামানোর সময় অগত্যাই একবাক্য শব্দ আমার মগজে আলপিনের মতো খোঁচা দিয়ে ওঠে, মনের মাঝে গেঁথে থাকা সংস্কারটা যায় না।
পরদিন ঘুম থেকে জাগি অনেক বেলা করে। ব্রাশ হাতে করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি মুখের দু’পাশে চারাগাছের মতো দাড়ি গজিয়েছে। কিন্তু দাড়ি পরিষ্কার করার কোনো ব্যাকুলতা আমার মধ্যে কাজ করে না। বরং হাত বুলাতে বুলাতে একবার মনে হয়, ত্রিদিব দস্তিদারের মতো রেখে দেবো নাকি একগাল? তারপর মাথায় ক্যাপ, গলায় মোটা মালা, হাতে বালা আর গায়ে তালি দেয়া প্যান্ট, জামা?
কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে রাস্তায় নেমে ভাবি কোথায় যাব? প্রথমে নক করি মান্নার বাসায়। মান্নার ছোট বোন এসে জানান দেয় সে বাসায় নেই। পত্রিকা অফিসে কী নিয়ে যেন ঘাপলা হয়েছে।
তবু মান্নার রুমে গিয়ে ঢুকি এবং বরাবরই মান্নার রুমে ঢুকলে যে ব্যাপারটি আমার ঘটে (নীরবে নীরবে নিজেকে তুচ্ছ ভাবা) এবারও তাই হয়। অভিজ্ঞ ও শিক্ষিত গৃহিণীর মতো একটা কলমকেও চমৎকার সাজিয়ে রাখে সে। যা অন্তত আমার সময় এবং জীবনের বিপ্রতীপ কোণে।
বেরিয়ে আসার আগে টেবিলের কোণে সারিবদ্ধ বইয়ের ওপরে একটা লিটলম্যাগ দেখে আমি থমকে দাঁড়াই। সেটা হাতে নিয়ে দু’পলক চোখ মারি। কাগজটির সম্পাদনায় চন্দ্রিমা ও দ্বীপের নাম বেশ গর্বিত অবস্থায় কালির কাপড়ে শুয়ে আছে। ক’পাতা উল্টাতেই নিজের লেখা কবিতা দেখে পুনরায় থমকে যাই। চন্দ্রিমার পত্রিকায় আমার লেখা? ‘গোত্র’ কবিতার ইতিহাস ঘাটতে শুরু করি আমি। মনে পড়ে এক যুবতী বিকেলে ঘুরতে ঘুরতে চন্দ্রিমাদের বাসায় ঢুকে পড়েছিলাম। চন্দ্রিমা তার চিকন হাত বাড়িয়ে অভিভাবকের মতো কঠিন স্বরে বলেছিল, আপনার কোনো নতুন লেখা থাকলে দেন তো।
আমার উজ্জীবিত হাত পকেটে ঢুকিয়ে যখন বের করি তখন শাদা কাগজে লেখা একটা নতুন কবিতা বেরিয়ে এসেছিল। নাম ‘গোত্র’।
আমি আমার বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে যেন সেই সময়ের ভেতর ডুবে যাই। কিন্তু পকেট থেকে হাত বের হওয়ার পর মনে হয় পাঁচ আঙুলে রক্তমাংস কিছুই নেই। যেন তিন কোটি বছর আগের প্রাচীনতম পাখির পা’র মতো পাঁচটি কঙ্কাল। আমি শিউরে উঠি। আমার সম্ভাবনা কি নরসুন্দার মতো শুকিয়ে যাচ্ছে? এভাবে আর কতকাল?
কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে পুনরায় নেমে পড়ি রাস্তায়। রাস্তার পাশের একটা চা’র দোকান থেকে এক কাপ চা গিলে পারভেজের বাসায় নক করি। খবর আসে পারভেজ নেই। ঢাকা ফিরে গেছে। দোজখের আগুন মাথায় নিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে খোকা ভাইয়ের বাসায় নক করি। খবর আসে খোকা ভাই নেই। ঢাকা ফিরে গেছে।
হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় শুকনো রোদ যতখানি তার চেয়ে ‘প্রজন্ম প্রশ্নবিদ্ধ’ এই অমীমাংসিত বাক্যটুকু আমাকে বেশি তাড়া করে। নইলে তাদের সাথে আমার মানসিক দূরত্বটা ক্রমাগত এভাবে বেড়ে চলবে কেন? তবু ‘ঢাকা ফিরে গেছে’ শব্দত্রয় আমার ওপর হঠাৎই একাকিত্বের প্রভাব ফেলে। আর মনে হয় বিকেলের ম্যাজিক লণ্ঠন, সন্ধ্যার আজিজ সুপার মার্কেট আর রাতের পিজি’র আঙিনা আড়ালে আমাকে ডেকে ওঠে।
আমি পুনরায় পথে নেমে পড়ি। যেন পথই আমার মৌলিক পরিচয়। দীর্ঘকাল থেকে এপথ ওপথ করে যাচ্ছি। যেন কাউকে অথবা কিছু একটা পথেই থাকার কথা ছিল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না। কী যেন পাওয়ার আশায় আমি এপার ওপার অনুসন্ধিৎসু চোখ মারি। কিন্তু দৃষ্টি প্রতিধ্বনির মতো নিজের কাছেই ফিরে আসে। আমি নিজের দিকে চোখ মেরে নিজেকেই দেখি। বাইরের আমি আর ভেতরের আমি’র পার্থক্য খুঁজি। কিন্তু শূন্যতার আঘাতে দৃষ্টি শুষ্ক মরু হয়ে ওঠে।
একটা রিকশা এসে হঠাৎ আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। কিন্তু আমি কোন ধ্যানে হাঁটতেই থাকি! পেছন থেকে একটা কণ্ঠের ধাক্কায় আমি নড়ে উঠি।
কী ব্যাপার, অ্যাকসিডেন্ট হলেও তো টের পাবে না দেখছি।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি রিকশার ওপর রায়হান ভাই। উজ্জ্বল মুখে চশমার ফাঁক দিয়ে পিটপিট চোখে তাকিয়ে আছে। তার পাশে জড়সড় হয়ে বসে আছে একটি মেয়ে। রায়হান ভাইয়ের পাশে এক রিকশায় বসে আছে সে জন্য নয়, প্রথম দৃষ্টিতে দ্বীপকে আমার অচেনা মনে হয় এজন্য আমি অবাক হয়ে যাই। দ্বীপের শরীরে আকাশি রঙের শাড়ি। তার চোখ, ঠোঁট আর পেটের ভাঁজে ভয়, লজ্জা ও অনুশোচনাবোধ দেখে মনে হয়, ওটা কিছু নয়, অর্থহীন। আমি কাউকেই পুরোপুরি পেতে চাইনি। শুধু দ্বীপ কেন, ইন্দু অথবা বাবলী কিংবা শয্যা আর রেললাইনের স্মৃতি খুঁড়ে আনা কোনো মেয়েই আমাকে দীর্ঘক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখতে পারেনি। কেবল কবিতা আর কথাশিল্প আমাকে সারাক্ষণ প্রসব বেদনায় অস্থির করে রাখে।
রায়হান ভাই বলে, কী হে। মফস্বলেইতো আছ দেখছি। অথচ চোখে পড়ে না। আড্ডাফাড্ডা কি ছেড়ে দিলে নাকি?
আমি মন ও চোখ দিয়ে দ্বীপকেই দেখছি। তার শেষ বয়সী মহিলার মতো ন্যুব্জ হয়ে থাকা শরীর আর পরাজিত রানির মতো অসহায় আনত চোখ দেখে উল্টা নিজেই লজ্জা পাই। আমি দেখতে পাই তার কাজ করা ঠোঁটে দু’পাটি ঠোঁটই কেবল সাধারণ হয়ে শুয়ে আছে। প্রাঞ্জল বিকেল আর দীর্ঘ রেললাইনের সাথে তার কোনো যোগাযোগ চোখে পড়ে না।
আমি কী মনে করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাক্য ছুঁড়ে রায়হান ভাইকে আনমনে নিজের কথাই বলি, ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে। এখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।
রায়হান ভাই সলো ছবির গাব্বার সিং এর মতো হেসে ওঠেন।
রাগ করো না হে। আজ সন্ধ্যায় এসো। গল্পটা যেন সাথে থাকে। দেখব তুমি কেমন এক্সপার্ট হয়েছ। আজ তোমাকে ভাসিয়ে দেব।
বলেই রায়হান ভাই আবার হাসেন। তিনি যত উন্মুক্ত হন, দ্বীপ ততই সঙ্কুচিত হতে থাকে। আমি আর কিছুই বলি না। দীর্ঘ রাস্তার ওপর লাশের মতো ঝিম ধরে পড়ে থাকা কড়া রোদ মাড়িয়ে হাঁটতে থাকি। রিকশাটা দ্রুতবেগে আমার পাশঘেঁষে যেন বাতাসে উড়ে চলে। সেই সাথে আমি মাথা তুলে অনুভব করি, রায়হান ভাইয়ের উচ্চহাসি আর দ্বীপের খোলা চুলও উড়ে বাতাসে ভর করে। চোখ বন্ধ করে স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে আমার মনে হয়, রফিক আজাদের মতো বুকের ভেতর জেঁকে থাকা কোনো ভারী পাথর দীর্ঘদিন পর নিঃশব্দে নেমে গেল। কিন্তু যখন নিজেকে উড়ন্ত শিমুল তুলার মতো নিশ্চিন্ত ভাবতে শুরু করি তখন আরব্য রজনীর কোনও এক চরিত্রের মতো হঠাৎ তন্ময় এসে দাঁড়ায় আমার ঠিক মুখোমুখি। এমন উচ্ছ্বলতায় বিভোর সময়ে আমি থমকে যেতাম না। কিন্তু তাকে বেশ আপসেট মনে হয়। তার কপালের এক পাশে টিউমারের মতো ফোলা জায়গা যাকে আমরা ঠাট্টাচ্ছলে কখনও কখনও রাজটিকা বলে থাকি, সেটাকে আরও বড় মনে হয়। তবে কি সে কোনো কিছুতে খুব ক্ষেপে আছে?
কীরে, কোত্থেকে এলি? ঠিক আছিস তো?
তন্ময় উত্তর দেয় না। কপালের ওপর তার ডান হাতটা ছাতার মতো ধরে উঁকি দিয়ে দূরে কী যেন দেখে।
কাউকে খুঁজছিস?
তন্ময় কোমরে হাত রেখে ঘাড় কাঁত করে বলে, রায়হান ভাই ছিল না এখানে?
হ্যাঁ। কেন?
সাথে কে ছিল?
দ্বীপ।
তন্ময় ঘাড় ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলে।
কিছু বলছিস?
তন্ময় সম্ভবত মূল কথাটা এড়িয়ে তার ক্ষোভ অন্য খাতে ঠেলে দেয়।
আর বলিস না। কাম, প্রেম না-কি উৎসের জন্য মরিয়া ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। নইলে মেয়ের বয়েসীদের সাথেও অমন সুরসুরি চলাফেরার সঠিক অর্থ কী? অথচ মৌলিক কাজগুলো করছে নির্লজ্জের মতো। ভাবতে পারিস, এরকম একটা সংখ্যায় টাকা খেয়ে বাজে সব লেখা দিচ্ছে।
রায়হান ভাইয়ের এসব সংকীর্ণতার ব্যাপারে আমি জ্ঞাত। চাইলে এ-বিষয়ে ওর সাথে আমি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে পারি। কিন্তু তাকে থমকে দেয়ার জন্য তার পিঠ চাপড়ে বলি, ব্যাপার না। ওরা টিকবে না।
তন্ময় নিজের নামের মতোই নীরব হয়ে পুনরায় কপালের ওপর ছাতার মতো তার ডান হাতটা গোল করে ধরে। তারপর সময়ের মতো সবকিছু উপেক্ষা করে দ্রুত আমার দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করে।
মধ্যবয়েসী বিকালে নিজেকে অবাক করে দিয়ে পুরনো ছোট একটা পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়াই। সম্ভবত আমি ঘোরের মধ্যে কাজটা করে ফেলি। কেননা এই সময়ে এত সহজে ইন্দুদের বাড়িকে ঠিক পেছনে রেখে দাঁড়ানোর যে সঙ্কোচ অথবা দ্বিধা তাকে অবহেলা করার সাধ্য আমার নেই। আমি চোখ বন্ধ করে ব্যাপারটাকে যতই সহজ ভাবার চেষ্টা করি নিজেকে তার চেয়ে বেশি অচেনা এবং ভিন্ন গ্রহের কোনো মস্তকবিহীন প্রাণী মনে হয়। কিন্তু নিজেকে অবাক করে দিয়ে আমি খুব দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠি। আর মনে হতে থাকে এই উঠান, জঙ্গলের মতো জড়াজড়ি করে থাকা বৃক্ষ, ঘর ইত্যাদি আমাদের প্রথম থেকে শেষ স্পর্শ, চুম্বন, সঙ্গমের (যদি পাপ হয়) প্রথম ও শেষ সাক্ষী। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ইন্দুদের উঠানে অন্ধকার রাত খুঁজি। স্মৃতির মতো মিলিয়ে থাকা পদচিহ্ন খুঁজি। আর ইন্দুকে...
না না, এখানে, আমার এই ক্ষয়িষ্ণু সময়ে ইন্দুকে পাওয়া যাবে না। আমি জানি। আচ্ছা, সময়য়ের ক্ষয়িষ্ণুতা সম্পর্কে ইন্দুর কি কোনো ধারণা আছে? বহমান নদীর মতো সাবলীল সময়ে ঢাকা নগরীর একপাশে স্বামী-সন্তান নিয়ে বেশ সংসারী হয়ে আছে যে মেয়েটা সে কি এখনও চরম বাস্তবমুখী?
আচ্ছা, রমনার বটমূলে বোমা ফাটালে তোমার সমস্যাটা কোথায়? এই নিয়ে তোমাকে কালো ব্যাজ পরে রাস্তায় নামতে হবে কেন?
আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। ইন্দুর ওপর রাগ করার সাধ্য আমার কখনও ছিল না। কিন্তু সেদিনই প্রথম আমি তাকে খুব ঘৃণা করেছিলাম এবং সে যখন বলেছিল, তোমাদের এইসব গল্প আর কবিতা সময়ের অভিশাপ, বাণিজ্যিক হও দেখবে সময় তোমার দাসত্ব করবে-- তখন এই যে দীর্ঘ সময় ধরে ইন্দু তার মন ও শরীর দ্বিধাহীন আমাকে সমর্পণ করার মতো উদারতা দেখিয়েছে আমি তা অকৃতজ্ঞের মতো সহজেই অস্বীকার করেছিলাম। আমি যদিও প্রচলিত ঈশ্বরাত্মার মতো মহান ও ক্ষমাশীল নই তবুও আমি ইন্দুকে ক্ষমা করে দিতে পারতাম, কেননা ‘বাণিজ্যিক’ শব্দের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে তার ধারণা নেই অথবা তখন ছিল না। কিন্তু খুব সত্য ও সহজ অর্থেই আমি তা করিনি। বরং আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। নইলে (যদিও রমণীর শরীর আমার প্রিয়) নতুন সঙ্গম, নতুন স্পর্শ যুবতী চাঁদের মতো আমাকে শুষে নিতে পারত না। বাবলীর উঠতি যৌবনের ভাঁজে ভাঁজে আত্মসমর্পণ করতাম না।
অপরিচিতের মতো এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
একটা অপরিচিত কণ্ঠের টানে আমি পেছনে তাকাই। এতকিছুর পরেও ইন্দুর কণ্ঠ চিনতে পারিনি সেজন্য যৌক্তিকভাবেই আমি অবাক হতে পারতাম। কিন্তু মূলত তার কণ্ঠটাই সে পর্যায়ে নেই, তাই আমি অবাক হই।
আস, আমার ঘরে আস।
কোনো উচ্চবাচ্য না করে তন্ময়াচ্ছন্ন হয়ে তার পিছু যেতে যেতে হঠাৎ কেন জানি মনে হয় আমি একজন পতিতার রুমে গিয়ে ঢুকছি। কেননা যদিও দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত মনে হতো শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার দ্রবণেই আমরা এক বিছানায় দ্রবীভূত হতাম, কিন্তু পরে মনে হয়েছিল আমি একজন মাত্র পুরুষ তার শয্যাসঙ্গী ছিলাম না। কেননা ইন্দু আপাদমস্তক বাণিজ্যিক। সাম্যবাদ তার কাছে অর্থবহ কোনো বিষয় বা শব্দ নয়। অথবা কেননা আমি শুনতাম লোকে বলত যে নরসুন্দার ওপারের টাক মাথার একটা ছেলে তার শূন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দু’জনকেই বিধ্বস্ত মনে হত।
ইন্দুর রুমে ঢুকতেই পাঁচ সেকেন্ডে যেন আমার পাঁচ বছর বয়স কমে যায়। এক চিলতে রুমের ভেতর একটি খাটের সাথে জড়িয়ে থাকা পড়ার টেবিল আর জানালায় আমাদের শীৎকার শুনতে পাই। আমাদের সন্ধি আর বিচ্ছেদের গল্প প্রামাণ্যচিত্রের মতো চোখে ভেসে ওঠে।
আসলে বেঁচে থাকার জন্যে খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। প্রচন্ড শীতের রাতে তিন চারটে বাচ্চা নিয়ে ফুটপাতে ঘুমায় মানুষ। তার তুলনায় একটা স্বাধীন দেশে এরকম একটা ক্ষুদ্র রুমে নিদ্রা অথবা বেঁচে থাকার মূল্যায়ন খাটো হওয়ার কথা নয়। কী বল?
রমণকালে মেয়েরা খুব বাধ্যগত হয়। সম্ভবত সে কারণেই ইন্দু ‘হুঁ’ উচ্চারণ করতে ইতস্তত করেনি। কেননা পরদিনই সে খোশগল্পে খুব সহজেই বলেছিল, আমাদের কিন্তু বড় বড় তিনটে রুম থাকবে। একটা আমাদের দু’জনের। একটা আমাদের বাচ্চাদের। বাকিটা গেস্টদের।
সাধারণত আমার ধারণা সত্যি হয় না। কিন্তু সেদিন মনে হয়েছিল ইন্দুর সাথে আমার হবে না। তারপর হয়নি। ইন্দু সুশৃঙ্খল থেকে গেল আর আমি বিচ্ছিন্ন।
এতদিন পর আজ ইন্দুর রুমে ঢুকে মনে হয় সবকিছু আগের মতোই আছে। শুধু ইন্দু চট করে চিনে ফেলার মতো অবস্থায় নেই।
আমি বলি, কেমন আছ তুমি?
ইন্দুর চোখে মুখে যেন ভোরের সূর্য ফুটে ওঠে। একটা ঘুমন্ত বাচ্চা ছেলের পাশে শুয়ে তার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলে, ভালো, খুব ভালো। গোছানো সংসারে আমি, আমার স্বামী আর আমাদের মেয়েকে নিয়ে তোমাদের ভাষায় অনাবিল সুখেই আছি।
এটা তোমার মেয়ে?
ইন্দু ‘কেন’ প্রশ্ন করে টের পেয়ে যায়। তারপর বাচ্চাটিকে কাঁপিয়ে দিয়ে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে দীর্ঘসময় কামোত্তেজিত থাকা ক্লান্ত রমণীর মতো হাত পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। যেন তৈরি হয়েই আছে।
সব ওর বাবার পাগলামি। মেয়েদের পোশাক পরতেই দেয় না। আচ্ছা বল, লাভ আছে কোনো?
ইন্দু হাসতেই থাকে। আমি বলি, আচ্ছা কে বেশি পারে? তুমি, না তোমার বর?
ইন্দুর হাসিটা থেমে যায়। বৃদ্ধার মতো ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসে। তারপর বৃদ্ধ বিকেলের করুণ সূর্যের মতো তাকায় আমার দিকে।
আমাদের দু’জনের মধ্যে নগ্নতাপে কে বেশি উষ্ণ হত? আমি না তুমি?
ইন্দুর এই অবস্থা দেখে আমার বিহ্বল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যেন আমি ভেতরে ভেতরে বেশ গর্বের সাথেই বলি, মনে হয় আমি।
ইন্দু অভিজ্ঞ সংসারী মা’র মতো একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। আমি তার সুখে থাকার অভিনয়টা ধরে ফেলি।
তুমি অনেক মোটা হয়ে গেছ কিন্তু। কণ্ঠটাও বদলেছে অনেক। স্বাস্থ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে স্থূল হয়েছে তোমার কণ্ঠ।
বাদ দাও ওসব। তোমার কথা বল। কেমন আছ তুমি?
জানি না। তবে বেঁচে আছি।
না। তুমি বেঁচে নেই। আমি জানি। তুমি মৃত।
আমি শিউরে উঠি। আমার কোন অবস্থাকে কেন্দ্র করে ইন্দু ‘মৃত’ শব্দ উচ্চারণ করে আমি বুঝি না। আমি মৃত মানুষের মতো নিশ্চল চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
হ্যাঁ, আমি জানি, না লিখে তুমি বাঁচতে পার না। আমি শুনেছি তুমি নাকি লিখছ না। কথাটা সত্যি?
আমি জানি, যুক্তরাষ্ট্র আগ্রাসী হওয়াতে অন্যদের পৃথিবীটা ক্ষুদ্র হচ্ছে কি না সে বিষয়ে ইন্দুর কোনো মাথাব্যথা নেই। তার ঘরটা প্রশস্ত থাকল কিনা সেটাই আসল কথা। আমার লিখা না লিখা নিয়েও তার উচ্চবাচ্য ছিল না কখনও। তবু নিম্নস্বরে অনেকটা নতজানু হয়ে বলি, আমি পারছি না।
পারছি না বললে তো হবে না। তোমাকে লিখতে হবে। শূন্য দশকের প্রতিভাবান লেখক তুমি। দশক পেরিয়ে যাচ্ছে।
সেদিন বিকেলে দ্বীপের বলা শব্দগুলোই যেন ইন্দু পুনরাবৃত্তি করে। কিন্তু প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি মাত্রা ভোরের সূর্যের মতো নতুন মনে হয়। আমি কি ঘোরের মধ্যে আছি? অথবা আমি যদি ইন্দুর জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকতাম তবে কি সে এমন কথা বলার সাহস দেখাতে পারত? তবু আমার সম্মুখ অংশ আমার চোখে ঝাপসা লাগে। ইন্দুর সেই শিহরিত ঠোঁট এখন আর নেই। সময়, সংসার অথবা সুখের চাপে স্থূল হয়েছে অনেক। কিন্তু এই প্রথম তার ঠোঁটে একসাথে আমার কামনা আর বিদ্রোহ জেগে ওঠে। কিন্তু আমি নিবৃত্ত হই। নিভৃতে থাকি।
আমি বলি, তুমি ঠিক বলেছ। আমি মৃত। জীবন যেখানে চমৎকারভাবে বিরাজ করে তার আর আমার মাঝে দীর্ঘপথ অন্ধকার।
একটু থেমে বলি, জান, ব্যাবিলন ধ্বংস হয়ে গেল, আমি কিছুই লিখতে পারিনি। আজাদ স্যারকে খুন করা হল, আমি কিছুই লিখতে পারিনি। তুমি উপযুক্ত শব্দটি নির্বাচন করেছ মৃত।
ইন্দু খ্যাপার মতো হেসে ওঠে। সে কখনও আমাকে তার ধাঁধাঁয় ফেলতে পারেনি। তবু দু’চোখ গোল করে বলে, আরে ধ্যাৎ, আমি তো এমনি বললাম।
ইন্দু তার হাসিটা ধরে রাখে। আমি দীর্ঘ নদীতে নৌকার পালের মতো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। এ যেন পৃথিবীটা একটা বৃত্ত প্রমাণ করে পূর্বের পরিধিবিন্দুতে ফিরে আসা। কত নারীর পর পুনরায় ইন্দুর বিছানায় এসে বসা। কিন্তু ক’বছরের সংসারে ইন্দুর বয়স একটু বেশিই বেড়েছে মনে হয়।
ইন্দু শীতল হয়ে অনেকটা আমার দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, শুনেছি তুমি নাকি বিয়ে করছ?
আমি ভেতরে একটা ধাক্কা খাই। কিছু বলি না। টেলিফোন রিসিভারের মতো মাথা নিচু করে বসে থাকি।
ইন্দু জড়ানো কণ্ঠে বলে, আমি চাই তুমি লিখ। কিন্তু যে রকম শূন্যতায় তুমি ভুগছ তাতে বিয়ে করলে কেবল বউকে ভালোবাসতে চাইবে, লিখবে না। অথচ এটাই তোমার শ্রেষ্ঠ সময়। এই মফস্বল, এই দেশের সবগুলো মানুষ, মানুষের আড্ডায় তোমাকে স্মরণ করা হবে। আমি তোমাকে নিরেট ভালোবাসা দেব। বিছানায় সুখ দেব। কিন্তু তুমি লিখবে।
আমি ভারাক্রান্ত হয়ে তার দিকে আর্দ্র চোখ তুলি। ইন্দু অনুসন্ধিৎসুর মতো আমার চোখের ওপর দৃষ্টি পাতে। একবার ইচ্ছে করে স্ফীতকণ্ঠে নির্মলেন্দু গুণ-এর মতো বলি,
ওখানে কি খোঁজ তুমি? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ;
রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,
কিন্তু আমার কণ্ঠ, ঠোঁট দক্ষিণ গোলার্ধের মতো জমে যায়।
এবার দেখি ইন্দুর চোখও বর্ষার পুকুরের মতো জলে ভরে আছে। ঝুলে থাকা আলোহীন বৈদ্যুতিক বাল্বের মতো নিচের পাটির ঠোঁটে জমা পড়ে তার ক’ফোঁটা। আমি ঠিক থাকতে পারি না। বিহ্বল হয়ে পড়ি। আমার আমিত্বকে ফিরে পাওয়ার প্রাণান্ত ব্যাকুলতা ইন্দু উপলব্ধি করছে দেখে এই প্রথম আর কিছু নয়, কেবল শ্রদ্ধায় লতার মতো জড়িয়ে ধরি তাকে।
রাত বারোটা অবধি একটা ঘোর যা চেতনাকে সজীব রাখে, আমি তার মাঝে আচ্ছন্ন থাকি। তারপর নিজেকে কর্পূরের মতো হালকা লাগে। বেঁচে থাকার প্রেরণা উর্বর হয়ে ওঠে। উৎফুল্ল মনে অনেক ঘেঁটেঘুঁটে দেড় বছর আগে শুরু করা একটা অসমাপ্ত গল্প, যেখানে স্বজনহারা, মঙ্গাপীড়িত এবং রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা এক সদ্য-যুবতী কী রকম চাপে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করতে সম্মতি দিয়েছিল তার বর্ণনা আছে, সেই গল্পটা বের করি।
কিন্তু একঘণ্টা বসে থেকেও এক লাইন লিখতে পারি না। সৃষ্টিহীনতার চাপে তখন আমার হাত কাঁপতে শুরু করে। অস্থিরতায় লরেল বৃক্ষের মতো ঘামতে শুরু করি। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। যদিও জন কীটস্ গল্প লেখায় পারদর্শী ছিলেন না তবু মৃত্যুপথযাত্রীর তওবা পাঠ করার মতো বিলাপের সুরে তার কাছেই প্রসঙ্গপাত করি হায় কীটস্, আত্মার স্বরূপ কী? প্রচলিত বিশ্বাসের আত্মা অমর? তোমার আত্মা বেঁচে আছে? আমার অবস্থানে থাকলে তুমি কী করতে?
যেন ঘোরের মধ্যে অনেকটা জেদ করে একটানা লেখা শুরু করি। কিন্তু লেখা শেষে অবাক হয়ে যাই। গুণে দেখি দেড় পৃষ্ঠা লেখায় বিয়াল্লিশবার নিশিকাননের নাম। আমি থ মেরে যাই। এতদিন কি তবে নিশিকাননকেই চেয়েছি? কলম খাতা ফেলে আমি হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। আমার দু’চোখের কোণ থেকে কলা পাতা বেয়ে বৃষ্টি পড়ার মতো জল ঝরতে থাকে।
তারপর আমার চোখের পাতা আর নামে না। তিনটার দিকে আমাদের টিনচালে প্রথমে সে রাতে কালীবাড়ির অগোছালো বাদ্যবাজনা এবং পরে ছান্দসিক শব্দ তুলে স্থূলাকার বৃষ্টি নামে। এরকম বৃষ্টির পরে পৃথিবী হয় রমণীয়। আমি ফজরের প্রথম আজানের সাথে সাথে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে কাউকে না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। ঠিক ভোর নয়, রমণীমোহন শেষ রাতে নিশিকাননের বাড়িকে সামনে রেখে বিশ্বস্ত পুরুষের মতো দাঁড়াই। কিন্তু প্রচন্ড আবেদন না থাকলে এমন সময় কোনও নারী ঘর থেকে বের হয়? আমি তবু দাঁড়িয়েই থাকি। ঢাকা যাওয়ার নিরেট আবেদনটা ক্রমশ শীতল হতে শুরু করে। কিন্তু কেন? এই মফস্বল, যার আড্ডা একদা আমাকে পুনর্বার সৃষ্টি করেছিল এখন তার কী এমন মাদকতা আছে যা আমাকে অভিজ্ঞ মাতাল করে রাখে?
আমাদের বাড়ির ঠিক মুখোমুখি যেখানে নরসুন্দা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পানি পুষে রাখে তার পাশে ব্যাগটা রেখে আলতো ঢঙে বসি। আমার প্রায় পাঁচ ফুট দূরে যেখানে চাঁদ তার অবিকল ছায়া ফেলে রেখেছে অভিজ্ঞ শিকারির মতো তার ঠিক মাঝখানে ঢিল মেরে মনে হয় কতো প্রজন্ম আগে আমার সৃষ্টি এবং তখন থেকেই আমি বিচ্ছিন্ন। তবু কার টানে আমি বৃত্তের বাইরে থেকেও কেন্দ্রে ফিরে আসতে ব্যাকুল হয়ে উঠি? নিশিকানন আমার কে হয়? কেন ব্যাকুল মনে হয় নিশিকানন আমার প্রিয় জন্মভূমি? আমার প্রিয় মফস্বল, হারানো প্রিয় আড্ডা?
আজ ১০ ডিসেম্বর। এই যে ১০ ডিসেম্বরের ক্ষণ তথা নিশিকাননের জন্মতিথি সৃষ্টির উৎসের জন্যে আমি আমার মন ও মননকে সুন্দরের দিকে ধাবিত করি। মনে হচ্ছে সৌন্দর্যই¬¬¬¬¬¬¬¬¬ প্রেমের ভিত্তি। আর ‘সমৃদ্ধ ভালোবাসা’ যদি সুন্দরের ন্যূনতম সমার্থক হয় তবে তা প্রিয় মদের মতো পান করতে চাই। জটিল জীবনের সাক্ষী মহান কবি কীটস্’র মতো বলতে চাই, A things of beauty is a joy forever…
আর তাই ইতিমধ্যে স্থির হওয়া জলের ওপর চাঁদের প্রতিচ্ছবির দিকে নিবদ্ধ দৃষ্টি রেখে সেই প্রথম ‘ঝোঁপের ভেতর ঝিঁ ঝিঁ ডাকা আর আকাশভর্তি তারকা রাত’-এর মতো আর্তনাদের সুরে ডেকে উঠি-- নিশিকানন, নিশিকানন...
২০০৬ ইং
লেখক পরিচিতি
অনিন্দ্য আসিফ
কবি ও গল্পকার
কাতিয়ার চর, কিশোরগঞ্
ঢাকা, বাংলাদেশ।
এ’টা সেই সময়ের গল্প যখন এই মফস্বলের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির লোকেরা নিজেদের ভেতর আভিজাত্য আনার চেষ্টায় থাকত আর তারা তখন প্রমিত ভাষায় কথা বলত এবং লোকেরা তাদের সাথে এক-ই ভাষায় কথা বলত অথবা চেষ্টা করত। যেমন-
আমাদের কলাপাতা রঙের মফস্বলে একটা সবুজ মেয়ে ছিল। সবুজটা মনের। দেহের কালো। আর নামের রঙে শ্রাবণের আকাশ। উপমাটা যৌক্তিকতাকে সিদ্ধ করে। কেননা নাম পরিবর্তন একধরনের ফ্যাশন ছিল তার কাছে। তার একটা অদ্ভুত উচ্চাশা ছিল। যে-কোনও প্রকারে হোক রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করা। তাই কি না প্রায়ই অপ্রাসঙ্গিক নোবেল পুরস্কারের নানা দিক নিয়ে কথা তুলত। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছিলেন। তারও হয়তো এমন একটা গুপ্ত বাসনা ছিল। গভীর পরিকল্পনা ছিল গীতাঞ্জলির মতো কিংবা তার চেয়েও বিকল্প কিছু লিখে তাক লাগিয়ে দেয়ার ।
সদ্যজাত এক বিকেলে নরসুন্দা থেকে পৃথিবীর মতো পাক খেয়ে বাতাস উঠে আসছিল। নদীটির পাড় ঘেঁষে থাকা একটা পাথরের ওপর বসে আমি সম্ভবত একটা পাণ্ডুলিপি ঘাটছিলাম। আমার অদূরেই একটা ঈগল মাঝারি আকৃতির একটা কাঁকড়া নিয়ে আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। আমি নাটক লিখি না একমাত্র সেজন্য নয়, তবে যে কারণেই হোক, আমার ওপর গ্রিক নাট্যকার এস্কাইলসের প্রভাব কখনও ছিল না। আর তখন মৃত্যুও আমার কাছে বিচ্ছিন্ন বিষয় অথবা নিছক শব্দ। তবু চুলভর্তি মাথার ওপর হাত রেখে যখন চোখ উপরে তুলতে যাই, দেখি লাশের মতো পড়ে থাকা রাস্তার এক পাশকে ক্রমাগত অতিক্রম করে ছুটছে একটা মেয়ে। আমি চিৎকার দিয়ে উঠি
ও হে সবুজ কন্যা। পতাকার মতো চুল উড়িয়ে যাচ্ছ কোথায়?
আমার কণ্ঠ শুনে মেয়েটি তার গতিপথ পাল্টায়। তারপর শরীর এবং তার কাঁধে ঝুলে থাকা চটের ব্যাগে বড় ঢেউয়ের মতো কম্পন তুলে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। শ্যামলা রঙের মুখে শিশুর সরল হাসি ছড়িয়ে বলে, পাবলিক লাইব্রেরিতে যাচ্ছি একটু। কেমন আছেন?
তোমার নামের এমন পরিবর্তন দেখেতো ধাঁধায় পড়ে যাই। ভালো থাকি কী করে?
মেয়েটি কপালে ভাঁজ ফেলে বলে, আমার নামে আবার কী সমস্যা দেখলেন?
পত্রিকায় দেখলাম ‘মিজ্ বাঙ্গালী আঁখি’ নামে তোমার কবিতা ছেপেছে। সমস্যা হলো ওই মিজ্’ শব্দটা নিয়ে।
নরসুন্দার ওই পাক খাওয়া বাতাসের মতোই অঙ্গভঙ্গি করে আঁখি উচ্চস্বরে হেসে ওঠেছিল।
ও এই কথা। আসলে ভাবছি বিয়ে-টিয়ে করবো না। লেখালেখি করেই জীবনটা কাটিয়ে দেব। কী বলেন, পারবো না?
জানি না। হয়তো পারবে। অথবা পারবে না। কিন্তু তোমার লেখাটেখার কী খবর?
খুব ভালো। কবিতার সংখ্যা সতেরো হাজার অতিক্রম করেছে।
আমার চোখ দুটো কপালে উঠে পড়েছিল। যদিও সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবু এই বয়সেই সতেরো হাজার?
আজ ওরকম একটা বিকেলে গৌরাঙ্গবাজার ব্রিজে পা ঝুলিয়ে পারভেজের জন্য অপেক্ষা করি। অপেক্ষার ফাঁকে অনেক দিন পর হঠাৎ করেই আঁখির কথা মনে পড়ে। শুনেছি তার ‘মিজ্’ শব্দটা ‘মিসেস’ শব্দের নিচে ঢাকা পড়েছে। কৃষ্ণের শিশুবেলার ছবির মতো নাদুস-নুদুস একটা ছেলেও হয়েছে নাকি। সে কি আজও লিখে আগের মতো? লিখলে তার সংখ্যা কতো হয়েছে? নোবেল পুরস্কারের কথা কী ভাবে আজও? নাকি ছেলের দিকে তাকিয়ে সমস্ত ভুলে যায়? নোবেলের কথা না হয় ভুলে যায়। কিন্তু লেখা? যে একবার লেখা ধরেছে সে কি না লিখে থাকতে পারে? হয়তো পারে। এই যেমন গত এক বছর যাবত আমি কিছুই লিখছি না। শুধু ভাবছি। ভাবনার অলংকারগুলো নোটও করছি না। দ্বিতীয়বার যখন ভাবছি তখন প্রথমবারের বিষয় ভুলে যাচ্ছি। এভাবে এক বছর যাবত ভেবে যাচ্ছি। লেখার মতো করে একটা বাক্যও লিখছি না। লিখতে পারছি না। তাই বলে কি আমি বেঁচে আছি না? হয়তো বুকটা টনটন করে। বিরক্তিতে কখনও নীরবতা হটিয়ে একা একা বলে উঠছি, লিখতেই যদি না পারি তবে বেঁচে আছি কেন?
তবু বেঁচে আছি। অহর্নিশ ঘুমিয়ে থেকে, জেগে থেকে, সিগেরেট খেয়ে আর কখনও কখনও সিনেমা দেখে বেঁচে আছি।
এইসব ভাবছি আর যেন ঘূর্ণায়মান অতীতগুলোকে ধোঁয়ার সাথে কু-লি পাকিয়ে বাতাসে ছেড়ে দিচ্ছি। নিমগ্ন হয়ে দেখছি কিছু সোনালি ডানার স্মৃতি উড়ে যায় বাতাসের সঙ্গে। আমি হাত বাড়াই আর স্মৃতি আটকাতে মুঠো চেপে ধরি। মুঠো খুলে দেখি কুয়াশার মতো কিছু ধোঁয়া উড়ে যায়। নিজের অদ্ভুত কা- দেখে হো হো করে হেসে উঠি।
একা একাই ঢেলেছো নাকি?
পাশ ফিরে দেখি বাবুই বাসার মতো পা ঝুলিয়ে পারভেজ তার অদ্ভুত স্টাইলে সিগেরেট টানছে। আমার ডান উরুতে চাপড় দিয়ে পুনরায় বলে, পাগলের মতো হাসছো কেন?
সুখী হওয়ার প্র্যাকটিস্ করছি।
পাগলেরা সুখী। কিন্তু ওরা অতীত মনে রাখে না। তুমি অতীত ভেবে হাসছো।
আমি থমকে যাই। পারভেজ আমার মনের কথাটা জানলো কীভাবে?
সিগেরেটে শেষটান দিয়ে মুখভর্তি ধোঁয়া ছাড়ি বৃত্তাকারে। নরসুন্দা থেকে বাতাস এসে ধোঁয়ার শেষ চিহ্নটুকু ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। ধোঁয়ার সাথে অতীতও কি মুছে যায়? এবার হয়তো পাগল হওয়া যায়। প্রাণ খুলে হেসে সুখী হওয়া যায়।
ব্রিজের ওপর থেকে পারভেজ ধপাস করে নিচে নামে। তার চেহারায় গতিশীলতার ছাপ স্পষ্ট। যেন রেসের জন্যে তৈরি থাকা ঘোড়া। যার কাজই কেবল ছুটে চলা।
আমি বলি, নামলে যে?
সন্ধ্যার পরে আসলামের স্টুডিওতে দেখা হবে।
বলেই সে পুরান থানার দিকে হনহনিয়ে ছুট দেয়। আমি প্রথমে অবাক হই। তারপর অপমানবোধ করি। আমাকে অবহেলা? তারপর ভাবি, ব্যাপার না।
আমিও ঠিক একইভাবে ধপাস করে নামি। চোখ বন্ধ করে ঝটপট ভাবতে চেষ্টা করি, কোথায় যাওয়া যায়? একবার মনে হয় মান্নার কাছে যাই। কিন্তু ওর কাছে গেলে বরফ বাষ্প হয়ে যায়। বিরক্তিকর কাজ। প্রায় পুরো পত্রিকার কাজ ওর ওপর চাপানো থাকে। কথা বলার সুযোগ নেই। মেজাজ বিগড়ে যায়।
তারপর মনে হয় দ্বীপের বাসায় যাই। অনেকদিন খোঁজ-খবর নেই। অথচ ইচ্ছে করলেই নেয়া যায়। বুকের ওপর হাত রেখে অনিবার্যভাবে বলা যায়, এখানে বিশ্বস্ত প্রেম আছে। কিন্তু ইচ্ছে করে না। আমি চাচ্ছি ঈশাখাঁ রোড অথবা স্টেশন রোড কিংবা অন্য কোনও গলিতে হঠাৎ দূরত্ব অতিক্রম করে আমরা মুখোমুখি হই। দ্বীপের মনে হোক এটা মনের আবেদন। কিন্তু আমি জানবো মনের অবাধ স্বাধীনতা প্রযোজ্য। তার আবেদন এককভাবে কোথাও সিদ্ধ হবে না। তারপর সব অতীত ভুলে পারফেক্ট পাগলের মতো হো হো করে হাসব।
দু’কদম এগোতেই একটা রিকশা বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং সঙ্গে দ্বীপও। পরিচিত চুল, হাসি আর শরীর নিয়ে।
কী ব্যাপার, একা একা যে?
পারভেজ ছিল। ফাঁকি দিয়েছে।
ফাঁকি? পারভেজ? আপনাকে? বিশ্বাস হয় না।
আমি কখনও কখনও বিশ্বাসকে চোখ ও মনের বাইরে রাখি। রাখতে হয়। কেননা গভীরের বিশ্বাসগুলো মোহাম্মদ আলী বেগ হয়। ব্রুটাস হয়। সবসময় হয়তো না। কিন্তু অনেক সময়।
তারপর বলি, ভেবেছিলাম বিকেলটা বুঝি স্রেফ নিঃসঙ্গ কাটবে। তার ওপর যেহেতু মনে হয় আমি আমাকে নিয়েই থাকতে হবে।
দ্বীপ বলে, তাই কি দূরে দূরে থাকেন? শুনেছি তিন দিন হলো এসেছেন। আমি খুঁজে খুঁজে অস্থির। অথচ আমাকে একবারও মনে করলেন না।
কে বলল?
আমি বলছি। মনে করলে ঠিক টের পেতাম।
আমি বোকার মতো অবাক হই। বুঝি না আমি মনে করলে সে টের পাবে কী করে? মন কি সত্যিই বার্তাবাহক?
বুঝতে পারি দ্বীপের মনে সায় দেয় না। আমার মনকে গুরুত্ব দিতেই সে আমার পাশাপাশি হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে পুরান থানা পেরিয়ে রেললাইনে এসে দাঁড়াই। ভালো লাগে খুব। অনেক দিন পর বেঁচে থাকার তাড়না প্রবলভাবে নড়ে ওঠে। দ্বীপের দিকে তাকিয়ে দেখি গাছপালার ফাঁক দিয়ে কয়েক টুকরো সূর্যের আলো তার বাম গালের ওপর পড়ে। ঠিক যেমন ভোর হয় তাকে তেমন নতুন আর সজীব লাগে। আমি তার বাম বাহু ঘেঁষে দাঁড়াই।
দ্বীপ হেলে যাওয়া বৃক্ষের মতো ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, এত কাছে আসেন কেন?
তোমার হাতটা দাও।
কেন?
তোমার হাত ধরে হাঁটবো।
পাগল নাকি? চারদিকে গিজগিজ করছে পরিচিত সব চোখ। কী ভাববে তারা?
যার যা ইচ্ছে ভাবতে দাও। আজইতো। তারপর যদি মরে যাই, এই রেললাইনে কভু না আসি, তবে এইভাবে আর হাঁটা হবে না। তোমার হাত ধরাটা আর হবে না।
দ্বীপ কাতর খরগোশ ছানার মতো তুলতুলে চোখে তাকায় আমার দিকে। আমি তার বাম হাতের পাঁচ আঙুলের ফাঁকে আমার ডান হাতের পাঁচ আঙুল ডুবিয়ে দিই। এভাবে দু’কদম এগোতেই টের পাই কেবল আমার আঙুল না, পুরো আমি ডুবে গেছি তার হাতের বৃত্তাকার মুঠোয়।
দ্বীপ বলে, আচ্ছা, আপনি প্রায়ই মৃত্যুর কথা বলেন কেন?
যেন তার কথা শুনতে পাইনি, তার ভেতর এমনভাবে ডুবে হাঁটতে থাকি। ভাবি, বেঁচে থাকার অর্থ কী? মানুষ কেন বেঁচে থাকে? নিয়ম আমাকে জন্ম দিয়েছে, তাই কি আমি বেঁচে থাকি? নাকি বাবা-মা, ভাই-বোনের সংসারে পিছুটান আর দায়িত্ববোধের তাড়না আমাকে বাঁচিয়ে রাখে?
কখনও কখনও মনে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে ইহুদি হয়ে থাকলে বেঁচে থাকার অর্থটা টের পাওয়া যেত। আবার কখনও মনে হয় মানুষ ছাড়া যদি অন্য কিছু হতাম? যেমন দক্ষিণ গোলার্ধের এক টুকরো বরফ। সূর্যের তাপে একটু একটু করে বাষ্প হতাম। অথবা এই রেললাইনে পড়ে থাকা দু’টুকরো পাথর। বুকের ওপর তপ্ত শ্বাস ফেলে দানবের মতো চিৎকার করে যেত ধাতব ট্রেন।
আমি বলি, দ্বীপ?
দ্বীপ নেশাক্তভাবে তাকায় আমার দিকে। আমি তার চোখ অতিক্রম করে আমার দৃষ্টি রাখি তার মেরুন রঙের ঠোঁটের ওপর। সে তার নিচের এক ফালি ঠোঁটে উপরের পাটির দাঁত চেপে হাসে। হঠাৎ আমার মাথায় সুনামির ঝড় ওঠে।
দ্বীপ বলে, প্লিজ, অন্যদিন।
হঠাৎ রেললাইনে কম্পন অনুভব করি। বিশ্রী হুইসেল শুনে পেছন ফিরে দেখি দীর্ঘতা নিয়ে সাপের মতো বাঁকা দেহে ধেয়ে আসছে ট্রেন। আমরা সরে যেতেই মুহূর্তে ট্রেনটি আমাদের অতিক্রম করে।
একদিন শাহবাগের এক রেস্তোরাঁয় কফি খাওয়ার সময় হঠাৎ খবর পাই শেকড় ট্রেনের নিচে কাটা পড়েছে। তার বড় দাদা শরীরের কাটা টুকরোগুলো একটা একটা করে চটের ব্যাগে তুলে বাড়িতে নিয়ে আসার সংবাদ শুনে সারাটা দিন করুণ শূন্যতা পেয়ে বসেছিল আমাকে। সেদিন রাতে স্বপ্নে দেখি আমাদের চৌরাস্তার মোড়ে দীর্ঘ কালো চুলওয়ালা একটি ছেলে রিকশা থেকে নামছে। আমি চিৎকার দিয়ে বলেছিলাম, আরে শেকড় তুই?
শেকড় প্রথমে পুরোহিতদের মতো মিষ্টি করে হাসল। তারপর তার করুণ চোখ দুটো থেকে পানি ঝরে পড়ছিল। সেই থেকে ট্রেন দেখলে আমার বুকের ভেতর হু হু হাওয়া বয়। তবু বারবার ট্রেনের কাছে আসি। গ্রাম, শহর ছাড়িয়ে রেললাইনের দূরত্ব অতিক্রমণে তিন কালের যোগাযোগ খুঁজি।
আমি বলি, দ্বীপ, আমার মনে হচ্ছে এতদিন মরেছিলাম। আজ বেঁচে উঠেছি। তোমাকে খুব ভালো লাগছে। তাই স্বার্থপরের মতো বলছি শুধু বিকেলটাতে তোমার ওপর থেকে তোমার দাবি তুলে নাও। অন্যদিনের ওপর আমার বিশ্বাস নেই। আমার মনে হয় কোনো একদিন আমি কোথাও থাকব না।
প্লিজ, অমন করে বলবেন না। আপনাকে বাঁচতে হবে। সবার জন্য বাঁচতে হবে। আপনাকে লিখতে হবে। শূন্য দশকের প্রতিভাবান লেখক আপনি। দশক পেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ শুনছি আপনি নাকি হাত গুটিয়ে বসে আছেন। লিখছেন না?
ঠিকই শোনেছ। আমি লিখছি না। আমি লিখতে পারছি না। গত এক বছরে মাথার ভেতর কেবল অগোছালো তিনটা লাইন জমা পড়েছে। শুনবে?
বলুন।
আমি প্রথম শব্দ বলে আর পারি না। গলা জড়িয়ে আসে। কাতর চোখে দ্বীপের দিকে তাকিয়ে বলি, আচ্ছা এভাবে বাঁচা যায়?
দ্বীপ নিরুত্তর থাকে। যেন সমস্ত বিকেল মুঠোর মধ্যে এনে শিশুর মতো আমার হাতে নরম করে চাপ দেয়। আমি চোখ বন্ধ করে ভাবতে চেষ্টা করি, যৌবন জীবনের সৃষ্টিকর্তা। জীবনকে যা অক্ষুণ্ন রাখে সেই ব্যগ্রতা অনুভবেরও প্রয়াস পাই তখন।
সন্ধ্যার পরেও শেষ বিকেলটা আমাকে মদের মতো আচ্ছন্ন করে রাখে। মানুষ কেন বেঁচে থাকে, অমূলক সেই প্রেক্ষাপট ন। আসলে আমি কী চাই অথবা আমার জীবনদর্শন কী? অসমাপ্ত পুরনো এই সমাধানের হিসেব কষতে কষতে আসলামের স্টুডিওতে ঢোকার সময় রায়হান ভাইয়ের সাথে দেখা। বেশ পরিপাটি সাজে হাতে দুটো বই নিয়ে স্টুডিও থেকে বেরুচ্ছেন। আমাকে দেখে চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ বের করে বিস্মিত কণ্ঠে বলেন, আরে তুমি?
হ্যাঁ, ঠিক আমিইতো। আছেন কেমন?
রায়হান ভাই ঠোঁটের বিচিত্র ভঙ্গিতে সম্ভবত বুঝানোর চেষ্টা করেন, ভালো নেই।
আমি টের পেয়ে বলি, ভালো না থাকলে চলবে কেন? এই মফস্বল মাতিয়ে রাখবেন তো আপনারাই। আপনার লিট্লম্যাগের কী খবর?
গল্প সংখ্যা বের করছি। পনের ফর্মা। তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালোই হলো। তোমার গল্পের খুব দরকার। তোমাকে তো খুঁজে খুঁজে হয়রান। মুঠোফোনে ডায়াল করতে করতে হাঁপিয়ে উঠছি। সিম পাল্টিয়েছ নাকি?
বন্ধ রাখছি আজকাল। ইদানীং সেলফোনের টোন বিরক্তিকর লাগছে।
রায়হান ভাই হো হো করে হেসে ওঠেন। হঠাৎ এমন হাসির শব্দে চারপাশের কিছু অলস চোখ এসে পড়ে আমাদের ওপর।
রায়হান ভাই আমার কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন, ইয়ংম্যান, সময়কে সবদিকে কাজে লাগাও। আমাকে দেখ, মোবাইল ফোনের টোন এত হাই দিয়ে রেখেছি যে লোকে ভাববে আমি বুঝি কালা হয়ে গেছি। হা-হা-হা-হা...তা এখন কী লিখছ?
কিছুই না। নির্বাসনে আছি। সবকিছু থেকে।
তাই না কি? ব্যাপার না। ঠিক হয়ে যাবে। এখন চল।
কোথায়?
রায়হান ভাই কণ্ঠনালীতে মৈথুনের মতো করে তার একটা হাত বোলান। তারপর খুব রহস্যজনক উপায়ে চোখ টিপেন। আমি ঠিক অর্থটা বুঝে যাই। মাতালের মতো নরম করে মাথা নুয়ে বলি, আপনি যান। আমি ভেতরটায় একটা চক্কর দিয়ে আসি।
তারপর অগত্যাই আমি নরসুন্দার মৃদু ঢেউয়ের মতো ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসি। কিন্তু রায়হান ভাই হাসেন জলোচ্ছ্বাসের মতো শব্দ করে। হা-হা-হা...
ওকে ওকে। আসবে কিন্তু।
আমি স্টুডিও’র ফ্লোর অতিক্রম করে পেছনের ক্ষুদ্র ও পরিপাটি বাগানে ঢুকি এবং কোনো দিকে না-তাকিয়ে ছোট ছোট পাতায় বৃত্তাকারে ঘেরা আমার সমান উচ্চতার একটি বৃক্ষের পাশে এসে দাঁড়াই। কিন্তু রায়হান ভাইকে দেখে যে-ঈর্ষা আমাকে পেয়ে বসেছিল তা থেকে আমি বেরোতে পারি না। লোকটা সবার দৃষ্টি এবং সময়কে ক্রমাগত অতিক্রম করে কী চমৎকার বয়ে যাচ্ছে। যেন জীবন একটা তরল রমণী। যাকে যেভাবে ইচ্ছা রাঙানো যায়।
হায় কীটস্।
আমি আঁতকে উঠি। ডানে তাকিয়ে দেখি দেয়ালের ধারঘেঁষে আসলাম, পারভেজ আর খোকা ভাই পা ছড়িয়ে বসে আছে। খোকা ভাইকে দেখে ভীষণ অবাক হই। কিন্তু ঘটে যাওয়া খুব সাধারণ ঘটনার মতো অভিব্যক্তিহীনভাবে পা টেনে তাদের কাছে আসি।
আমি বলি, কখন এলেন?
বিকেলে।
একটা খবর দিবেন না?
ট্রাই করেছি বেশ ক’বার। ভাবলাম নাম্বারটা ডেড হয়ে আছে। ব্যাপার কী?
রায়হান ভাইকে বলা কথাগুলো পুনরাবৃত্তির ইচ্ছা হয় না। মৃদুহাসির মতো করে ঠোঁট বাঁকিয়ে পারভেজের পাশে ফাঁকা সিঁড়িটায় বসতে বসতে বলি, হ্যাঁ, ডেড হয়ে আছে। ধরুন, নাম্বারটা আমার প্রতিচ্ছবি।
সম্ভবত আমার শেষ কথাটায় কেউ মনোযোগ দেয় না। আসলাম তার সদ্যকিশোরীর মতো দীর্ঘ চুলের ফাঁকে বাম হাতের পাঁচ আঙুল ডুবিয়ে বলে, রায়হান ভাইয়ের সাথে এত কী কথা হলো?
বিশেষ কিছু না। অনেক দিন পরে দেখা। তাই কুশলাদি বিনিময়। ব্যস।
আসলাম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, শালা বদ।
আমি শুনতে না পাওয়া উৎসুক কণ্ঠে বলি, কিছু বললে?
আর বলো না যেন শেক্সপিয়রের ভাব নিয়ে আছে। অথচ বিজ্ঞাপন হিসেবে ক্রমাগত প্রকাশিত কিছু বই ছাড়া মৌলিক কিছু নেই। বলতে পারো, উত্তর প্রজন্ম তাদের কাছ থেকে কী পাওয়ার আশা রাখে?
আসলাম তার দু’হাতের কনুই দু’হাঁটুতে রেখে কিছুক্ষণ ন্যুব্জ হয়ে থাকে। সোজা হওয়ার সময় তার পুরো মুখে ছড়িয়ে থাকা চুল দু’হাতে দু’দিকে আলগা করে বলে, নারীই যেন তার কাছে সৃষ্টির প্রধান উৎস। ঠিক আমাদের নাগালের ভেতর থেকেও বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে নিয়ে যায়।
আমি বলি, আর পুরো মফস্বল বুঝি নরসুন্দার বুকে জায়নামাজ পেতে মরুপাঠ করে?
আসলাম তার রঙধনুর মতো ঝুঁকে থাকা পিঠ সোজা করে উত্তেজিত ঢঙে বলে, বাজপাখি অথবা শিকারি যেহেতু বর্তমান সুতরাং কেউ শঙ্কামুক্ত নয়। এমনকি তুমি আর খোকা ভাই দু’জনই।
একবার ঢোক গিলে আসলাম খুব শঙ্কিত কণ্ঠে বলে, জেনে রেখো এই মফস্বলে প্রগতিশীল ধারায় উত্তর প্রজন্মের যারাই রায়হান ভাইয়ের প্রভাবমুক্ত তারাই প্রতিভাবান এবং মৌলিক।
আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে পারভেজ আর খোকা ভাইয়ের দিকে তাকাই। তারা মাথা নাড়িয়ে আসলামের বক্তব্যের সত্যতা বুঝিয়ে দেয়।
রাত দশটায় স্টুডিও-র কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে আমরা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দু’তলায় উঠি। তারপর একটা টি-টেবিলকে কেন্দ্র করে চেয়ার টেনে বৃত্তাকারে বসি।
টেবিলের ওপর রাখা একটা কাঁচের ক্রিস্টল তিন আঙুলের ম্যাজিকে লাটিমের মতো বার কয়েক ঘুরিয়ে আমি বলি, মান্নার ওপর দিয়ে খুব চাপ যাচ্ছে মনে হয়।
বলতে বলতে মান্না আসে--চেহারা এবং কণ্ঠে চিরচেনা ঝড় এবং প্রফুল্লতা নিয়ে। চড়–ই পাখির বাসার মতো ড্রেসিংরুমটা তার পদশব্দে মৃদু ভূ-কম্পনের মতো কেঁপে ওঠে। তারপর রাজনীতিবিদদের বক্তৃতার স্টাইলে হাত নেড়ে কথা শুরু করার সময় খোকা ভাইকে দেখে থমকে যায়। আমি যতটা অবাক হয়েছিলাম তার চেহারা দেখে অনুভূত হয় সে আমার চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু বিস্ময় ভঙ্গিকে নানা ঢঙে উচ্ছ্বসিত করতে তার সময়ক্ষেপণ হয় না। খোকা ভাইয়ের দিকে তার ডান হাতটা বাড়িয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে, আরে আপনি? কখন এলেন? একটা খবর দিবেন না?
খোকা ভাই তান্ত্রিকের মুখস্থ তন্ত্রপাঠের মতো আমাকে বলা শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি করে। বলে, ট্রাই করেছি বেশ ক’বার। ভাবলাম তোমার নাম্বারটা ডেড হয়ে আছে। ব্যাপার কী?
মান্না পকেট থেকে মোবাইল সেট বের করে হতভম্বের মতো একবার মোবাইল আর একবার খোকা ভাইয়ের দিকে তাকায়। পারভেজ কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে তার মেয়েদের মতো লাজুক আর স্মিতহাস্যময় ঠোঁট বাঁকিয়ে বিশেষজ্ঞের মতো বলে, যা কিছু ব্যাখ্যাহীন অর্থ্যাৎ ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে তা-ই সুন্দর। তোমরা যাই বলো সৃষ্টি, প্রেম আর নারী ত্রিমাত্রিক রহস্য। যথোপযুক্ত কোনো সংজ্ঞা নেই। আর প্রেম বহুগামী একটা শব্দ। বিশ্বাস আর প্রেম ছিঁড়ে না বলেই খোকা ভাই, পার্টনার আবার মফস্বলের আড্ডায়।
মান্নার হন্তদন্ত ভাব, আসলামের আয়োজন, খোকা ভাই আর পারভেজের শ্রীযুক্ত আলাপ সব মিলিয়ে মিষ্টি একটা উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে ঘরটা জুড়ে। কেবল আমি কোলাহলের ভেতর নিজের নির্জনে ভাবি, পারভেজ কি সত্যি বলল? ভালোবাসা ছিঁড়ে না? মানুষগুলো ফিরে আসে?
বিকালে যখন দ্বীপের তুলার মতো নরম মুঠোর ভেতর আপাদমস্তক ডুবিয়ে রেললাইনের অজস্র পাথর অতিক্রম করছিলাম, তখন মনে পড়েনি। যখন সমস্ত বিকেল সঙ্গী করে তার মেরুন রঙের ঠোঁটের ওপর ঝুঁকে পড়েছিলাম, মনে পড়েনি। এখন পড়ছে। প্রসঙ্গ ছাড়াই ইন্দুর কথা মনে পড়ছে।
ইন্দু। আমার ভালোবাসা শিক্ষার প্রথম গুরু। নারীর ঠোঁট, চিবুক, স্তনের ওপর অন্ধকারে জানালা গলে চাঁদের আলোর মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ার প্রথম অভিজ্ঞতা।
ইন্দু। আহ্ ইন্দু! আমার প্রথম প্রেম। প্রথম চুম্বন। প্রথম নারী। আর দ্বিধাদ্বন্দ্বে প্রথম পাপ, প্রথম পুণ্য।
সেদিন রাত ছিল প্রায় অমাবশ্যা। চাঁদের চিহ্নমাত্র ছিল না। তার ওপর বিশাল মেঘের জায়নামাজ। আমি এমন কবরের অন্ধকার অতিক্রম করে ইন্দুর তপ্ত নিঃশ্বাসমাখা ভেঁজা ঠোঁটে আমার শুকনো ঠোঁট ঘষেছিলাম। তারপর ইন্দু এই উষ্ণ শিহরণে দু’পাশে দীর্ঘ চুল ছড়িয়ে পড়ার টেবিলে সারারাত ঝুঁকে বসেছিল। আমি জেনেছিলাম পরদিন সকালে যখন সূর্য কেবল জেগে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ইন্দু আমার চোখে কামুক দৃষ্টিপাতে বলেছিল, তুমি আমাকে পাগল করে দিয়েছ। পাগল। হা-হা-হা...
আমার এমন অপ্রাসঙ্গিক হাসির শব্দ শুনে সকলেই স্তম্ভিত ঢঙে আমার দিকে তাকায়।
পারভেজ বলে, আবার বুঝি পুরনো স্মৃতির সুতো ধরে টানা। ‘সুখে আছি’-র মৌখিক রিহার্সেল? কবি, সামনের দিকে তাকাও। সময় তোমার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে।
আসলাম আমাদের বৃত্তাকার বাসস্থানের কেন্দ্র টেবিলের ওপর একটা লম্বা, কালো রঙের বোতল রাখে। তার পাশে সিগেরেটের প্যাক, কয়েকটা কাচের গ্লাস আর এক বাটি বরফের টুকরা।
খোকা ভাই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, আরে বাহ্। দারুণতো!
তারপর বোতলটা হাতে নিয়ে আপাদমস্তক লালচ-জড়ানো দৃষ্টি বুলিয়ে বলে, হ্যাঁ, বলতে দ্বিধা নেই যে এটা চমৎকার আয়োজন। স্পন্সর করল কে? আসলাম?
আসলাম বলে, পারভেজ শেয়ার করেছে।
আমি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলি, পারভেজ প্রমাণ করেছে যে শৈল্পিকতা কেবল তার চেহারাতেই সীমাবদ্ধ নয়।
পারভেজ নিঃশব্দে, নিখুঁতভাবে তার ফেবারিট হাসিটা হাসে। তারপর বেশ কায়দা করে নিজের হাতে বোতলের ক্যাপটা খুলে।
মান্না দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, আমি বরং উঠি।
খোকা ভাই বিস্মিত হয়ে বলে, উঠি মানে? আরে বস। সবাই একসাথে বেরোই।
মান্না ট্রাজিক গল্প পাঠের স্টাইলে বলে, আমাদের নির্বাহী সম্পাদকের চেয়ারে বসে থাকে এক লোক। জানেন না তো, শালা কী রকম বদ। দম বন্ধ করে কাজ করে যাই তবু তার সাথে দূরত্ব কমে না।
তা হলে একটু ঢেলে যাও।
মান্না ভড়কে যাওয়ার মতো করে শুকনো ঢোক গিলে। আসলাম আড়চোখে একবার তাকিয়ে হঠাৎ হেসে ওঠে। একেবারে মেয়েদের মতো হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে।
আমি বলি, হাসছো যে?
আসলাম হাসি থামিয়ে বলে, শোনো, এক রাতে আমার সাথে মাত্র হাফ গ্লাস ঢেলেছিল। পরদিন পত্রিকা বেরিয়েছে। আট পৃষ্ঠা পত্রিকায় একুশটা বানান ভুল। হায়রে সম্পাদকের ঝারি।
বলে আবার লুটিয়ে পড়ে ও। এবার ওর হাসির সাথে আমরাও যোগ দিই। সংঘবদ্ধ এই হাসির প্রকোপে মান্না অনেকটা বিরক্তিভাব নিয়েই বেরিয়ে যায়।
পারভেজ সবগুলো গ্লাসে তরল ঢালে। এই ফাঁকে আসলাম একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল এনে কর্ক খুলে রাখে বরফের বাটির পাশে। অল্প করে পানি ঢেলে দেয় প্রতিটি গ্লাসে।
আমি বলি, আমার লাগবে না।
সিগেরেটের প্যাক ভেঙে একটা দু’ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দিই। পারভেজ ফচ করে আগুন জ্বালিয়ে আমার সিগেরেটের মাথায় ধরে। তারপর হঠাৎ করেই যেন আমার ওপর চে গুয়েভারা’র অবিকল ছায়া পড়ে। তাই অভিজ্ঞ শিল্পীর সামনে সিটিং দেয়ার মতো সিগেরেট হাতে চে’র ফটোগ্রাফ হয়ে মুহূর্ত কয়েক বসে থাকি। এবং দ্রুত প্রথম টানের ধোঁয়া ভেতরে রেখেই পারভেজের জ্বালানো দেশলাইয়ের আগুনের মতো ফচ করে বলে ফেলি
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়
আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে...
আজকাল আমার অনেক কিছুই হঠাৎ হয়ে যাচ্ছে। এখন চে’র মৃত্যুতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যে-অপরাধবোধ, তৎক্ষণাৎ ভেবেছিলাম তার ছায়া আমার ওপরও পড়বে। কিন্তু আমার চিন্তা খুব দ্রুত এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসে। অন্যদের দিকে আমার আড়চোখের দৃষ্টিপাতে আমি বুঝতে পারি আমার দিকে ওদের প্রশ্নবোধক দৃষ্টি সুনীল বাবুর ওই চরণকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু তারা কিছু বলার আগেই আমার দু’কনুই টি-টেবিলে রেখে অনেকটা ন্যুব্জ হয়ে বলি, শাহ্ আজিজ কাকার কী খবর?
আসলাম বলে, ব্যস্ত খুব। বারের সেক্রেটারি পদের জন্য নির্বাচন করছে।
ওদের লেবেলের আড্ডাটা আজ বসেনি?
না।
পারভেজ উঁকি দিয়ে বলে, সম্ভবত আজ ব্ল্যাক লেবেলটা ছিল না। তাই জমেনি।
সঙ্গে সঙ্গে বখাটে ছেলেদের মতো আড্ডায় হাসির একটা প্রলেপ পড়ে। আমি এড়িয়ে যাই। বাম হাতের আঙুলের ফাঁকে সিগেরেট রেখে একি হাতে আমার গ্লাসটা গভীর মমতায় চোখের নিচে এনে রাখি। সুনীল বাবুর মতো কোনও অপরাধবোধে নয়, অনুভব করি মাতাল হওয়ার তৃষ্ণায় আমার ঠোঁট দুটো শুকনো হয়ে আসে। দ্রুত একটা বরফের টুকরো ছেড়ে দিই গ্লাসের ভেতর। টুকরোটা প্রথমবার ডুবে যায়। তারপর গ্লাসের তল স্পর্শ করে আবার ভেসে ওঠে। এবং বাল্বের আলোয় টুকরোটি চাঁদের মতো জ্বলে উঠার সাথে সাথে ইন্দুর কথা মনে পড়ে।
আবার ইন্দু? আমার প্রথম বিশ্বাস। প্রথম শয্যাসঙ্গী।
একদিন দিনভর সকালের মতো নরম রোদ ছিল। সেদিন আমি আর ইন্দু সকাল এগারোটা থেকে বিকেল চারটা অবধি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের পাশে ছোট সিঁড়িতে জড়াজড়ি করে বসেছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ইন্দু একত্রিশবার বলেছিল, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তার ‘ভালোবাসি’ শব্দের মোহ থেকে বেরিয়ে সাহস করে বলেছিলাম, আমি কিন্তু আজ রাতে আসব।
ইন্দু ভীতু কণ্ঠে বলেছিল, প্লিজ তুমি এভাবে এসো না।
যদিও পৌর্ণমাসীর চাঁদের মতো আকণ্ঠ যৌবনা ইন্দুর ছিল মেধাবী চোখ ও মনন আর এই চাপ অথবা টানাপড়েনে সে কখনও কখনও বলত যে এটা পাপ। কিন্তু অবলীলায় তার অঙ্গ সঞ্চালন, শীৎকারের ব্যঞ্জনা, চোখে দীপ্তিময়তা ইত্যাদি দেখে কখনও মনে হতো না যে তার ভেতর কোনো পাপবোধ কাজ করছে। এবং শেষমেশ তার অনুশোচনাহীনতায় মনে হয়েছে যে পাপ সংক্রান্ত একটা চমৎকার উপলব্ধি তার মাঝে বিরাজ করে। আর তা হলো, যা কিছু অবলীলায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তা-ই পবিত্র। পাপ এখানে নৈর্ব্যক্তিক।
তাই হয়তো অন্ধকারে তার তপ্ত নিঃশ্বাস বিশ্বাসী স্পর্শে বলতো, তুমি যেয়ো না। তুমি থাক। আকণ্ঠ ডুব দিয়ে থাক আমার মধ্যে। আমি তোমাকে সব দেব। স্বর্গ এবং স্বর্গের সুখ দেব তোমাকে। তুমি যেয়ো না।
ইন্দু মুখ ফুটে ওসব বলত না কিন্তু তার দৃষ্টি সেই ইঙ্গিতই বহন করত। কেননা দীর্ঘদিন পাশাপাশি অবস্থানের ফলে আমার সম্পর্কে ইন্দুর এই ধারণা স্পষ্ট ছিল যে, ধর্মীয় অনুষঙ্গাদি তথা স্বর্গ-নরক ইত্যাদিকে আমি এক প্রকার ‘ইজম’ হিসেবেই জানি।
তারপর সেদিন রাতে ইন্দু আমার ডান কানে আলতো করে কামড় দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, আমি তোমাকে অ-নে-ক ভালোবাসি।
আমার মনে হয়েছিল কান পেতে আমি আমার মনের কথাটাই শুনছি। ভালোবাসা কেবল কামোদ্দীপক কোনো ধর্ম নয়। বিশ্বাসের নিটোল ভিত্তিও। আমি সেই প্রথম ইন্দুকে ভালোবেসেছিলাম, বিশ্বাস করেছিলাম। আর সেই বিশ্বাস ছিল আমাদের প্রথম সম্ভাবনা। সম্ভাবনার নুড়ি পাথরগুলো আমি বুক পকেটে ভরে রাখতাম দারুণ যত্ন করে। একটু আগে পারভেজের একটা বক্তব্যের সারমর্ম ছিল এই, ‘ভালোবাসা দীর্ঘ হয়’। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস ছিঁড়ে গেল। ভালোবাসাগুলো বালির মতো গুঁড়া হয়ে গেল এবং বিভক্ত হয়ে মোড় নিল অন্যদিকে।
আমি এইসব কবেকার কথা ভাবছি? সত্যিই কি এইসব আমার জীবনের কোনো নির্বাচিত অংশ? ইন্দু যখন সংসারের খুঁটিনাটি সমস্যায় একাকিত্ববোধ করে তখন জানালার পাশে এসে লোহার গ্রিল ধরে আমার কথা ভেবে মন খারাপ করে? অথবা এই যে আমি এখন মাতাল হওয়ার আগে গ্লাসের ভেতর রঙিন তরলে সেইসব দিন ও রাতের গল্প লিখছি ও পড়ছি, ইন্দু কি তা আঁচ করছে? দ্বীপ যদি করে তবে সে কেন করবে না?
খোকা ভাই সিগেরেটে কখনই পারদর্শী ছিল না। গ্লাসটা চোখের নিচে এনে প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো ঝুঁকে একেবারে নিউ স্মোকারদের মতো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে,
আমি প্রত্যহ জলের কাছে যাই, জল তখন ঘুমিয়ে
ঘুম না আসার কষ্ট বুঝি, ঘুম ভাঙাইনি জলের...
আসলাম সম্ভবত গভীরভাবে খেয়াল করে না। সে নিজের গ্লাসে আরেকটা বরফের টুকরো ছেড়ে বলে, আগামীকাল রঙমহল সিনেমা হলের সামনে আমাদের সংগঠনের উদ্যোগে মানববন্ধন। কেউ মিস করো না যেন।
খোকা ভাই তেমনি তন্ময়াচ্ছন্ন ভঙ্গিতে বলে, আমি থাকব না। আমাকে ঢাকায় ফিরতে হবে।
পারভেজ বলে, কী বলেন?
ঠিকই বলছি। কীট্স জানে। কর্মময় জীবনে কি রকম ঊর্ধ্বশ্বাসে বেঁচে আছি।
আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলি, মনে আছে, সেবার মুনতাসীর মামুন আর কবির চৌধুরীর ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে আমরা মানববন্ধন করেছিলাম। মোশাহিদসহ কয়েকটা ছেলে মানববন্ধন প্রত্যাহার করেছিল?
পারভেজ এক ঢোকে পুরো গ্লাস শেষ করে জড়ানো কণ্ঠে বলে, হ্যাঁ আছে। শালারা কাপুরুষ। আর মনে আছে, কী নিঃসঙ্কোচে তুমি দ্বীপের হাত তোমার মুঠোয় চেপে ধরে দাঁড়িয়েছিলে। সেদিনই বুঝেছিলাম, দ্বীপের সাথে তোমার হয়ে যাবে। তোমার অনেক সাহস।
আমি কিছু বলি না। কেবল আমি না, প্রত্যেকে নিঃশব্দে এক ঢোক তরলের সাথে গড়ে তিন ঢোক ধোঁয়া গিলে। আমার চোখ দুটো নিভে আসে। মনে হয় মস্তিষ্কের কোষগুলো জ্যাম হয়ে যাচ্ছে। স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারি না কিছুই। কেবল বুঝতে পারি নৈঃশব্দ্যের অণুকণাগুলো সমষ্টিগতভাবে পিন পড়ার মতো শব্দ করে। আর আমার ধারণা হয়, আমার মতো বাকি দু’জনও পান করার শেষদিকে নিয়মানুযায়ী আসলামের অদ্ভুত ছেলেমানুষি প্রত্যক্ষ করার জন্য নিবিষ্ট হয়ে অপেক্ষা করে। কিন্তু সে আমাদেরকে জটিল অন্ধকারের মতো থমকে দেয়। প্রবীণ দার্শনিকের মতো কুঁজো হয়ে কাঁপা কণ্ঠে অনেকটা সময় নিয়ে বলে, জীবন আর পারফেক্ট জল সহজেই সমার্থক, সমকামী অথবা সহবাসী হতে পারে। কেননা পাত্রভেদে জীবনও মুহূর্তক্ষেপণ না করে নানামাত্রিক বিশেষণ।
মূলত আসলাম তার বিপরীত চরিত্র সম্পাদন করে। কিন্তু যদিও তার এই অকস্মাৎ বক্তব্য অপ্রাসঙ্গিক এবং স্ব-চরিত্রে ক্ষণস্থায়ী তবু তাকে আজ অন্তত এই মুহূর্তে পুরোপুরি নতুন মানুষ মনে হয়। সে তার নিয়মকে অবজ্ঞা করে খুব সংক্ষেপে কথা শেষ করে ঝিম ধরে থাকে। আমি প্রায় জোর করে খোকা ভাইয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাই। তাকে কখনও সিগেরেটের ধোঁয়া গলাধঃকরণ করতে দেখিনি। আজ সে তা-ই করে আমার দিকে তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ তুলে বলে, কীট্স, যাচ্ছ কবে?
আমি তখনও তার দিকে অনিচ্ছুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। তারপর আমার গ্লাসের ভেতর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নীরবে খুব নিবিষ্ট মনে খালি গ্লাসে এক টুকরা বরফ ছাড়ি। শব্দও কি মাতাল হয়ে গেল? যেন গভীর কুয়োর তলদেশে পাথর ছুঁড়েছি। তাই এমন ধ্যানী নীরবতার মাঝেও কানে শব্দ বাজতে ঢের দেরি হয়।
মনে হয় খোকা ভাই এবার বিরক্ত হয়ে প্রশ্নবোধক উচ্চারণ করে, কীট্স?
আমি আমার গ্লাসটা দু’হাতের মুঠোয় চেপে আরও সংকুচিত হয়ে বসি। তারপর দ্যোদুল্যমান বিশ্বাস-অবিশ্বাস জড়ানো চোখ তুলে কম্পমান তরলকণ্ঠে বলি, A things of beauty is a joy forever…
রাত বারোটায় যখন শহরের সিংহভাগ নির্জীব হয়ে পড়ে তখন আমরা স্টুডিও থেকে বের হই। তখনও দু’একটা রিকশা জোছনা রাতে ক্ষেতের আইল বেয়ে নিশাচর শিয়ালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরঘুর করে। আসলাম একটাকে ডেকে এনে সামান্য কথাকে কেন্দ্র করে রিকশাওয়ালার সঙ্গে লেগে যায়। তবু নিজের লম্বা চুলে ম্যাজিক স্টাইলে হাত বুলিয়ে ওই রিকশাতেই চেপে বসে এবং খোকা ভাই আরেকটাতে। কিন্তু সে উঠার আগে যতবার সম্ভব তার বাসায় যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করে। নেশার পর কেউ হয় উত্তেজিত আর কেউ হয় কোমল। আমি নীরব চোখের ইশারায় মানা করি। কোমলকণ্ঠে জানিয়ে দিই, বাড়িতে এলে বাইরে কোথাও আমার রাত্রিযাপন শুদ্ধ হয় না। শরীরের কোষে কোষে অস্বস্তি ভিড় করে।
একদা বহমান নরসুন্দা আমাদের এই শহরকে দ্বিখন্ড করে রেখেছে। তাকে ঘিরে রেখেছে শহরের প্রধান দু’টি সড়ক। আমি আর পারভেজ নিশাচর পতিতার মতো রাত্রিকে সঙ্গী করে এপার ওপার চোখ মেরে তাদের একটি (স্টেশন রোড) বেয়ে শান্ত পায়ে হাঁটি। চারপাশ নীরব হয়ে আসে ইতোমধ্যে। এবং ইতোমধ্যে আমার ঘোর কেটে গেছে স্বাভাবিকভাবেই। নইলে এই ভৌতিক পর্যায়কে তিলোত্তমা মনে হতে পারত।
আমি আর পারভেজ নিজেদের পায়ের আওয়াজ অতিক্রম করে ল্যাম্পপোস্টের ধবল আলো আর ঘুমন্ত শহরের অব্যক্ত গান শুনে হাঁটি। এই গান আড়াল করে আমি ব্যক্তিগতভাবে গোপনে আমার হৃৎপিন্ডের ওপর কান পাতি। নীরবে কিসের আওয়াজে আমি কেঁপে উঠি? মৃত্যুর?
দ্বীপ বলেছিল মৃত্যুর কথা আর না ভাবতে। কিন্তু আর কিছু না, কেবল মৃত্যুই নিকটজনের মতো আমার পাশাপাশি ঘুরঘুর করে। তবে কি মৃত্যুই জীবনের পরম বন্ধু? যাকে জয় করার তীব্র আকাক্সক্ষায় অন্ধকারের মুখোমুখি হওয়া? সমস্ত ভালোবাসার যোগফলকে অতিক্রম করেই মৃত্যুর ওপর দাঁড়াতে হয়। কিন্তু আমি ভালোবাসার জন্যে দুয়ারে দুয়ারে হাত পাতি। দীর্ঘসময় লিখতে না পারার ব্যথায় থেকে থেকে কুঁকড়ে উঠি। তবে মৃত্যুকে জয় করা আমার পক্ষে কীভাবে তরলের মতো সহজ?
পারভেজকে বলি, ক’টা বাজে?
পারভেজ তার মোবাইল সেট বাটনের সাহায্যে আলোকিত করে বলে, ঠিক একটা।
এই মফস্বলেও যেন একটা বেজে যাওয়াটা বলিষ্ঠ কোনও রাত না, এমন একটা ভাব নিয়ে গুরুদয়াল কলেজের বিশাল মাঠের উত্তরে নদীকে ঠিক সামনে রেখে বেশ আরামের ঢঙে বসি। সঙ্গে সঙ্গে নদী থেকে একদল বাতাস এসে প্রেমিকার মতো নরম শরীরে আমাদের জড়িয়ে ধরে। এবং নদীর জল কাচের টুকরোর মতো জ্বলজ্বল করে ওঠে। আমার আনত মুখটা আকাশের দিকে তুলে দেখি, অবোধ শিশুর অর্ধেকটা মুখের মতো চাঁদ ওঠেছে।
পারভেজ বলে, বসলে যে, বাসায় ফিরবে না?
ফিরব। বস, নরসুন্দার সাথে দুঃখ শেয়ার করি। অথবা তার মুক্তোজলে দুঃখ ধুয়ে শুদ্ধ করে নিয়ে যাই।
পারভেজ নীরবে, শান্ত হাতে আমার কাঁধে ভর করে বসে। বাতাস এবং চন্দ্রালোক তেমনিভাবে জড়িয়ে রাখে আমাদের। চমৎকার এমন ঘুমন্ত পরিবেশে ভেতরটা কেমন হু হু করে ওঠে।
পারভেজ জড়ানো কণ্ঠে বলে, দ্বীপের জন্যে খারাপ লাগছে?
আমি বাতাসের বিপরীতে ধীরে ধীরে তার দিকে তাকিয়ে বলি, নাহ্। নাতো। আসলে কোনো নির্দিষ্ট মেয়ের প্রতি আমি আর আগ্রহী নই। কোনো নির্দিষ্ট মেয়ের ঠোঁট, বুক, উরুসন্ধি... জান, আমাকে আর টানে না।
আমি আমার মাথাটাকে নামাজরতদের মতো করে আনত করি। তারপর পুনরায় বাতাসের বিপরীতে পারভেজের দিকে মুখ তুলে বলি, জানো, মানুষের চিরদিনের ধর্ম হল দুঃখদাতাগোষ্ঠীকে এড়িয়ে চলা। কিন্তু আমার ব্যাপারটা ঠিক তার উল্টো। ইন্দুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর থেকে সাধারণভাবে আমার উচিত ছিল ওসব থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখা। কিন্তু তখন থেকে আমি চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছি। নারীজাতিকে নানা প্রকারে ভালো লাগছে। হাত ধরে হাঁটতে, চুমু খেতে কিংবা বিছানায় যেতে অসম্ভব পুলকিত হচ্ছি। কিন্তু তারপরই সেই শূন্যতা। অস্তিত্বে মৃত্যু আর অচল কণ্ঠের গোঙানি। কিন্তু এভাবে কতকাল? মৃত্যুর কাছে পরাজয়ের আশক্সকায় আর কতোদিন এমন মুষড়ে থাকা?
পারভেজ আমার বাম কাঁধে মৃদু চাপ দিয়ে বলে, পার্টনার, আমার মনে হয় কেবলই যৌনতাকে অবজ্ঞা করে তুমি নারীর কাছে যেতে পার, তবেই সৃষ্টির উৎস পাবে। পারবে? আছে কেউ?
আমি কিছুক্ষণ পুরোহিতের মতো যেন ধ্যানে বসি। নিজের ভেতর পারভেজের উচ্চারিত শব্দের প্রতিধ্বনি হয়, আছে কেউ? তারপর হঠাৎ বিশ্বাসী কণ্ঠে বলে উঠি, পারব। জানো, দীর্ঘদিন থেকে, হ্যাঁ, অনেকদিন থেকে সমস্ত নারীর আড়ালে আমি একজনের প্রেমে পড়ে আছি। ঠিক তুমি যেমন বললে, কেবল যৌনতা নয়। তার ক্ষেত্রে আমার শরীর থেকে সমস্ত আদিমতা নিঃশেষিত আছে। পারভেজ, মনে পড়ছে, ঝোঁপের ভেতর ঝিঁ ঝিঁ ডাকা আর আকাশ ভর্তি এক তারকারাতে তার কথা ভাবতে গিয়ে আমি হঠাৎ আর্তনাদের মতো ডেকে উঠেছিলাম, নিশিকানন, নিশিকানন...।
জানি, রাজু ভাস্কর্যের নিচে এক বিকেলে বলেছিলে। তবে চমৎকার নাম দিয়েছ তার।
তারপর পারভেজ হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে, আচ্ছা, চন্দ্রিমার কোনো খবর জানো? খোকা ভাইয়ের সাথে তার যোগাযোগটা কেমন আছে?
জানি না। তবে মনে হয় তাদের বেশ চলছে। জানো, এক রাতে বেনামে মোবাইলফোনে দীর্ঘক্ষণ চন্দ্রিমার সাথে কথা বলেছিলাম। তারপর আর এক রাতে। তারপর আর এক রাতে...
কী কথা বললে এত?
সংস্কৃতি বিষয়ক। চন্দ্রিমা তো ঘোর নারীবাদী। তাই ঘুরেফিরে তসলিমা, অ্যানিলেকদের কথাই বারবার প্রসঙ্গপাত করেছে।
খোকা ভাই জানে?
জানে।
তখন তার অনুভূতি কেমন ছিল?
তখন তার চেহারা দেখিনি। তবে স্পষ্ট মনে আছে, খোকা ভাই শীতল কণ্ঠে বলেছিল, শেষমেশ পরকীয়া শুরু করেছ?
পারভেজ তার শব্দের সীমাবদ্ধতা ভেঙে হেসে ওঠে। অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ শব্দের দ্যোতনায় গা ছমছম করা পরিবেশটা যেন প্রাণ ফিরে পায়। তার হাসিটা বন্ধ হলে নদীর ওপার থেকে যেন ব্যঙ্গ করে অনুরূপ একটা হাসি ফিরে আসে। এই হাসির ওপর ভর করে আসে কয়েকটা কুকুরের সমষ্টিগত আওয়াজ।
আমি বলি, তোমার ললিতার কী খবর? ওর ক্রিয়েটিভিটি ভালো। চাইলে লিখতে পারত। আমার বিশ্বাস।
আমি একদিন বলেছিলাম। হেসেই উড়িয়ে দিল। বলল, ক’দিন পরে দেখবে লেখকরাই কেবল নিজেদের লেখা পড়ছে। সাধারণ পাঠক পাবে না। সুতরাং পড়ার ঐতিহ্য যেন জাদুঘরে না যায়, সে জন্য আমাকে পাঠক হিসেবেই থাকতে দাও।
খানিকক্ষণ থেমে আবার সেই বাতাসটা বয়। আমি আড়ষ্ট হয়ে প্রার্থনারত ধর্মভীরুদের মতো বসে থাকি। পারভেজ একটা সিগেরেট ধরায়। এই বাতাসেও বেশ কায়দা করে প্রথমবারেই সে কাজটা সম্পাদন করে। আমি বিমুখ হয়ে বসে থাকি। যেন ধূমপান ক্ষমার অযোগ্য। আর এমন হীনকর্ম থেকে আমি মুক্ত।
পারভেজ পুনরায় আমার বাম কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলে, কীটস্?
আমি নরসুন্দার জলের মতো কেঁপে ওঠি। করুণ চোখে তাকাই তার দিকে। পারভেজ একগাল ধোঁয়া ছেড়ে মৃদু হেসে বলে, খোকা ভাই বলে।
কেন জানি আমি কুঁকড়ে যাই। হাত পা গুটিয়ে আরও সংযত হয়ে সাধু-সন্ন্যাসীদের মতো ধ্যানী হয়ে বসি। চোখ বন্ধ করে বলি, কীট্স, হায় কীটস্। তোমার মৃত্যুর একশ’ পঁচাশি বছর পর অদ্ভুত গভীর রাতে এক ঐতিহ্যবাহী নদীর তীরে বসে তোমাকে স্মরণ করছি। স্মরণ করছি তোমার ধমনি থেকে উঠে আসা রক্তকে যা তোমার মৃত্যুর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্মরণ করছি ফ্যানি ব্রনকে, যাকে প্রচুর ভালোবেসেও মৃত্যুর সময় কাছে পাওনি। আর মূলত স্মরণ করছি তোমার অসাধারণ সৃষ্টিকে, যা তোমার মৃত্যু এবং মৃত্যুযন্ত্রণা অতিক্রম করে বিকশিত করেছে বিশ্বের সৌন্দর্যকে। কীট্স, তুমি কি তোমার বন্ধু শেলির মতো ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ছিলে? তবে কীট্স, তুমি মৃত্যুকে জয় করেছ। তুমি গর্বিত। তোমার মৃত্যুর একশ’ পঁচাশি বছর পর এক অখ্যাত কবি না লিখতে পারার যন্ত্রণা নিয়ে তোমাকে স্মরণ করছে। কীটস্, তোমার বয়সী আমি যদি আজ এই মাতাল রাতে নির্জীব হয়ে যাই, যদি তোমাকে স্মরণ করাই আমার শেষ কবিতা হয়, তবে আগামী একশ’ পঁচাশি দিন পর আমার বিবর্ণ ফটোগ্রাফের সামনে দাঁড়িয়ে আমার মা ছাড়া আমাকে কে স্মরণ করবে?
কীটস্, তুমি গর্বিত। সীমাহীন আর্থিক দৈন্য নিয়েও তুমি মৃত্যুকে জয় করেছ।
আমার শরীর পাথরের মতো শক্ত হয়ে আসে। আমার আনত মাথাকে দু’হাঁটুর ফাঁকে রেখে ফুঁপাতে থাকি। পারভেজ আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকি দেয়।
পার্টনার?
আমি শিশুর মতো নরম করে মাথা তুলি।
তুমি কাঁদছ?
আমি বাম হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মোছি। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কিছু অন্ধকার হয়ে আসে।
সকাল দশটায় ঘুম থেকে জেগে অনুভব করি চোখ দুটো পাথরের মতো শক্ত আর ভারী লাগে। তারপর অনেকদিন পর গায়ে জড়ানো গত রাতের বাসি কাপড় নিয়ে পুকুরে সাঁতার কেটে গোসল করি। গোসল শেষে নিজেকে বেশ হালকা লাগে। মনে হয় একটু জোরে বাতাস এলেই শিমুল তুলোর মতো উড়ে যাব।
শহরে ঢোকার প্রথম গলির মাথায় একটা চা’র দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে কড়া এক কাপ চা খাওয়ার সময় কেন যেন মনে হয় খোকা ভাই আজ যাচ্ছে না। তারপর ঠিক করি আজ পায়ে হেঁটে খোকা ভাইয়ের বাসায় যাব। সে কি বাসায় আছে?
প্রথম গলি পেরুতেই মনে হয় আমি নতুন কোনও শহরে (পথ ভুলেই কিনা) ঢুকে পড়েছি। পরিচিত পথ এবং হঠাৎ হঠাৎ পরিচিত মুখগুলো অপরিচিত কিন্তু শ্যাম্পুমাখা চুলের মতো ঝরঝরে লাগে। তাদের দেখে মনেই হয় না জীবন এক জটিল আবর্তে ঘূর্ণায়মান। জীবন যে চলমান পরিবেশের ওপর এমন চমৎকারভাবে বিরাজ করতে পারে তা দেখে ঈর্ষায় আমার চোখ লাল হয়ে ওঠে। জীবনের অজ্ঞাত নস্টালজিক শব্দগুলো বিক্ষিপ্ত আকারে মগজে ও মনে ঘুরপাক খায়। মনে হয় আমার জন্য উপযুক্ত হল নির্জনতা। আমি নড়ে উঠি। হ্যাঁ, নির্জনতা। ঠিক এই শব্দটাই থেকে থেকে খুঁজছি ক’দিন যাবৎ। মানুষের মাঝেই নির্জনতাকে উপলব্ধি করার মাতাল ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়াস পাই থেকে থেকে।
আমি বামে জুট ইনস্টিটিউট, আদালত ভবন আর ডানে হর্টিকালচার রেখে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন কিন্তু একাগ্র হয়ে হাঁটি। মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে ওঠে। তালুতে হাত রেখে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা অনুভব করি। কতক্ষণ তাপমাত্রার যোগফল এটা? পায়ের তলার বিটুমিন থেকে উঠে আসা তাপমাত্রাটাও টের পাই খুব সহজে। এই একটা সময়কে বড় বিশ্রী লাগে। মনে হয় সবকিছুতে দারুণ দুর্ভিক্ষ। কী বৃক্ষে, কী পথে, কী অন্তরীক্ষে কিংবা শ্রমিকের ঘামে। বিশেষত মনে হয় শ্রমিকের ঘামে আমার সব সময়ের ঘোর বেদনা। কিন্তু তাদের সাথে আমার দূরত্ব কমে না। দূরত্ব কমে না, না কমাতে চাই না?
মনে পড়ে থেকে থেকে গুমরে উঠা এক মেঘাচ্ছন্ন রাতে আমাকে আর তন্ময়কে বাধ্যগত শিষ্যের মতো তন্ময়াচ্ছন্ন বসিয়ে রেখে গুরু আশুতোষ ভৌমিক তার বিশ্বস্ত হাতে লিখেছিলেন, ক্ষেতের আইলে ভাঙনের শব্দে বাজে সাম্যের গান...
তন্ময়তো বরাবর তোষামোদী। কিন্তু তার মতো তখন আমিও গুণকীর্তনকারী প্রজাদের মতো সমস্বরে বলে উঠেছিলাম, বাহ্, বা-বা-বা, সোবহান আল্লাহ...
আমি নীরবে কেঁপে উঠি। তবে কি আমি স্ববিরোধী? শ্রমিকের ঘামের মাঝে কি আমি হিমোগ্লোবিনের করুণ ছাপ দেখি না?
খোকা ভাইয়ের বাসায় ঢোকার মুহূর্তে চোখে পড়ে খোকা ভাই আর চন্দ্রিমা পরস্পর হাত ধরাধরি করে বেরুচ্ছে। আমি অগত্যাই অবাক হই। অথচ এটা পূবদিক থেকে সূর্য উঠার মতোই স্বাভাবিক আর সঙ্গত। ওরা পরস্পর হাত ধরে হাঁটবে, গোপনে চুমু খাবে, চুলের গন্ধ নেবে, রাত জেগে কবিতায় অলংকরণ হিসেবে পরস্পরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সাজিয়ে রাখবে এটাই সাধারণ নিয়ম। অথচ আমি নিয়মকে অবজ্ঞা করে অবাক হই।
আমাকে দেখে ওরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। খোকা ভাইয়ের নিষ্পাপ মুখে অপরাধবোধের ছায়া পড়ে। যেন কোনও মেয়ের হাত ধরা চুরি করার মতো অন্যায়। চন্দ্রিমা ওরকম বিষয়ে লজ্জা পাওয়ার মতো মেয়ে না। কিন্তু আমাকে সত্যিকারের অবাক করে দিয়ে সে-ও সঙ্কুচিত হয়। তার পাতলা ঠোঁটের বিচিত্র ভঙ্গি দেখে আমি টের পাই।
আমি বলি, বেরোচ্ছেন নাকি?
হ্যাঁ। কিন্তু এসময় তুমি এখানে?
হ্যাঁ। শুনলাম চন্দ্রিমা এসেছে। অনেকদিন দেখা নেই। ভাবলাম সময় মানুষের ওপর কতোটা প্রভাব বিস্তার করে একবার দেখে যাই।
চন্দ্রিমা আমার অভিনয়টা ঠিক ধরে ফেলে। বলে, ফাও কথা বলবেন না। জোর দিয়ে বলতে পারবেন, কখনও স্মরণ করেন?
খোকা ভাই বলে, আজকের মানববন্ধন কর্মসূচিতে তোমার কোনো দায়িত্ব ছিল না?
আমি হতভম্ব হয়ে যাই। একটু আগে খোকা ভাইয়ের মতো লজ্জা আর অপরাধবোধও জেগে ওঠে। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুলেছিলাম কীভাবে?
রংমহলের সামনে এসে দেখি প্রস্তুতির পর্ব শেষ। সবার বুকে নানা প্রকার শ্লোগান লেখা প্লেকার্ড লাগানো। আমাদের দেখে আসলাম আর মান্না খুবই মুডি ভঙ্গিতে ক’টা প্লেকার্ড নিয়ে এগিয়ে আসে। আমি তাদেরসহ অন্যদের সাথে চোখে চোখে কুশল বিনিময় করি। মান্না আমাকে বলে, তোমার দায়িত্বজ্ঞান দেখে অবাক হয়ে যাই। আজ এমন একটা দিন অথচ তোমার কোনো পাত্তা নেই।
তারপর চন্দ্রিমার দিকে এক পলক চোখ মেরে খোকা ভাইকে বলে, আর আপনি, খোকা ভাই, বাসায় থেকেও এত দেরি করলেন?
মান্না এতক্ষণে ঠিক জেনে গেছে খোকা ভাই কেন আজ ঢাকা যায়নি আর বাসায় থেকে কেন তার এত দেরি হল? পাশে চন্দ্রিমা না থাকলে ঠিক টের পাইয়ে দিতো। চন্দ্রিমা মান্নার কেবল দূরাত্মীয় নয় মানসিকতায় দূরবর্তীজনও।
মান্নার মনের উত্তেজনাটা যত দ্রুত জ্বলে উঠে নিভেও তত সহজে।। আমি আর খোকা ভাই মিষ্টি হেসে নিভিয়ে দিই। তারপর আমি পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বোলাই।
আসলাম বলে, কাকে খোঁজো?
আমি নিচু স্বরে বলি, দ্বীপ আসেনি?
এসেছেতো। তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল দু’বার।
আমি জিরাফের মতো গলা লম্বা করে বলি, কই, চোখে পড়ে না তো।
এরই মধ্যে শাহ আজিজ কাকা হাঁক ছেড়ে তার প্রতি মনোনিবেশ করার আহ্বান জানান সবাইকে। আমরা সবাই বাধ্যগত ছাত্রের মতো শোরগোল বন্ধ করে তার দিকে শ্রদ্ধাবনত দৃষ্টি তাক করি। তিনি রাজনৈতিক বক্তৃতার ঢঙে ডান হাতের তর্জনী নাড়িয়ে আজকের কর্মসূচির প্রেক্ষাপট পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন। তারপর বুকে জমাকৃত প্লেকার্ড লাগানো ছেলেমেয়েদের জটলাটা ভেঙে যায়। আমিও তাদের মতো বুকে ‘‘জঙ্গি উত্থানে সহযোগিতা করছে কারা?’’ লেখা প্লেকার্ড সেটে লম্বা লাইনের একেবারে শেষ মাথায় পারভেজের হাত ধরে দাঁড়াই। কেমন যেন একটা উৎসবের আমেজ আর উত্তেজনায় সারা শরীর টগবগ করে।
পারভেজ বলে, পার্টনার, জানো আজও দু’টা ছেলে শেষ মুহূর্তে কেটে পড়েছে।
আমি অবাক কণ্ঠে বলি, তাই?
হ্যাঁ।
আচ্ছা ওরা কেমন মানসিকতা নিয়ে এই লাইনে আছে বলত?
জানি না। বলে লাভ নেই। আসলে মনের ভেতর গেঁথে থাকা সংস্কারটা যায় না। কে জানে, একেবারে মূলে গেলে হয়তো দেখা যাবে আমাদের ভেতরেও এমন কিছু রয়ে গেল কি না।
পারভেজের এই কথাটা আমি বুঝি না। আমাদের ভেতরেও এমন কিছু রয়ে গেল মানে কী? এটা যদি আইয়ুব খান কিংবা এরশাদের শাসনকাল হত তবে কি আমরা এভাবে হাতে হাত মিলিয়ে প্রতিবাদ করতাম না? বুলেটের ভয়ে দরজায় সিটকিনি এঁটে বসে থাকতাম? আমাদের রক্তাক্ত শার্টকে হয়তো শামসুর রাহমান প্রাণের পতাকা বলতেন না। তাতে কী আসে যায়? গভীর প্রত্যয়ে সঠিক কাজে নিজেকে সমর্পণ করাই কি আসল নয়? আমার পরিচিত একজন শিল্পী ও ভাস্কর আছেন। নাম সাঈদ আলমগীর। শিল্পের প্রতি তার গভীর মমত্ববোধ। একবার এক মেলায় ছোট ছোট কয়েকটা ভাস্কর্য নিয়ে সারাদিন বসেছিলেন। দিনের একেবারে শেষ লগ্নে কী মনে করে এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক একটা মূর্তির দাম করেছিলেন পনের টাকা। তাতে কি তার শিল্পবোধের গুরুত্ব কমে গেল?
ব্যাখ্যা চাওয়ার জন্য পারভেজের দিকে আমার মুখ তুলে রাখি। কিন্তু মুখ ফুটে বলার আগেই অনুভব করি ভেজা এবং নরম একটা হাত আমার ঝুলে থাকা হাতের মুঠোয় আলতো করে চাপ দিয়ে আছে। আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখি দ্বীপ তপ্ত রাস্তার ওপর স্থিরদৃষ্টি ফেলে দাঁড়িয়ে আছে।
দ্বীপ আমার দিকে না তাকিয়ে নিচুকণ্ঠে বলে, মানুষের মনে কতো সহজে আঘাত দিতে পারেন আপনি।
আমি বিস্মিতকণ্ঠে বলি, বুঝলাম না।
এত দেরি করলেন যে?
আসলে ঘুম থেকে জাগতে অনেক দেরি হয়ে গেল।
দ্বীপের কপালে অনেকগুলো ঘামের ফোঁটা জড়াজড়ি করে জমে আছে। নাকের ডগার কণাগুলো জ্বলে ওঠে হিরার মতো। একবার ইচ্ছে করে মুছে দিই সবার আড়ালে, আলতো করে। কিন্তু এভাবে দ্বীপকে দারুণ লাগে।
আমি বলি, তোমার বর তোমাকে খুব ভালোবাসবে।
কেন?
তোমার নাক ঘামছে।
ধ্যেৎ, বাজে কথা।
তারপর দ্বীপের নিচু কণ্ঠটা শীতল হয়ে আসে। বলে, গতকাল বলেছিলেন আপনি এতদিন মরেছিলেন, আমার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বেঁচে উঠেছেন। অনেক রাত পর্যন্ত আপনার কথাটা ভাবতে ভাবতে মনে হল আমার বেলাতেও ঠিক তাই ঘটেছে। আর প্রবল ইচ্ছা হল আবার একদিন অনেকগুলো পরিচিত মানুষের সামনে আপনার হাত ধরে হাঁটব অথবা ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকব। তখন হঠাৎ আজকের প্রোগ্রামের কথা মনে হল। কী যে উত্তেজনা অনুভব করেছিলাম, মনে হয়েছিল এবার সত্যিকারের বেঁচে উঠছি। কিন্তু আজ যখন আসছিলেন না, জানেন, যেন ঠিক মরে যাচ্ছিলাম।
আমি বলি, আমাদের প্রথম স্পর্শ মনে আছে?
আছে। ঠিক এখানে। এভাবে।
আমি বলতে চাই সেই আমার প্রথম স্পর্শ। কিন্তু বলি না। কারণ দ্বীপ আমার প্রথম স্পর্শ নয়, নয় প্রথম অনুভূতিও। নারীস্পর্শ যদি পাপ হয় তবে আমি দীর্ঘদিনের বহু নারীস্পর্শের পাপী, তবে আমাকে দিয়ে হয়তো আরও অনেক পাপ হবে। শুধু প্রেম হবে না। ত্রিদিব দস্তিদারের মতো বলা হবে না, ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেব। কারণ ইন্দু...। আহ্, আবার ইন্দু! প্রথম স্পর্শ, কেবলই সঙ্গম আর ক্রমাগত ক্ষয়ে যাওয়া, সৃষ্টির উৎস ফুরিয়ে যাওয়া?
আমার পাশেই, দ্বীপের প্রায় শরীরঘেঁষে একটি রিকশা দাঁড়ায়। রিকশা থেকে নীল রঙের শার্ট পরে নেমে আসেন রায়হান ভাই। সঙ্গে আকাশি রঙের শাড়ি জড়ানো শ্যামলা রঙের একটা মেয়ে। রায়হান ভাই দীর্ঘলাইনের প্রতিটি মুখের দিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চোখ মারেন। আমি লক্ষ করি আমার আর দ্বীপের হাতদ্বয়ের সন্ধিস্থলে দৃষ্টি রেখে কেমন বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তারপর রিকশায় চেপে বসেন। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিও।
আমি কণ্ঠে বিস্ময়ভাব জমা করে বলি, কী ব্যাপার, দাঁড়াবেন না?
রায়হান ভাই যেন শুনতে পাননি এমন ভঙ্গিতে খটখটে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকান। তারপর আর কিছু বলার আগেই রিকশাসহ এই যুগল অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি রহস্যপূর্ণভাবে নিঃশব্দে ঠোঁটের কারুকার্যে হাসি। দ্বীপের দিকে তাকিয়ে দেখি এক প্রকার অপরাধীর মতো লজ্জা এবং ভয়ের মিথষ্ক্রিয়ায় ও সঙ্কুচিত হতে থাকে। প্রথম প্রেম, প্রথম দংশন কিংবা জোচ্চুরি আঘাতপূর্ণ হয়ে থাকে। দ্বীপ কিছুতেই আমার প্রথম নয়। তাই হয়তো রায়হান ভাইকে দেখে দ্বীপের এমন ন্যুব্জতা আমাকে কোনোরকম নিঃস্ব করে না।
রাত আটটার দিকে দমকা হাওয়া বইতে শুরু করে। পারভেজের জন্য অপেক্ষমাণ আমি আখড়াবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে আকাশের বিদ্যুৎ খেলা দেখি। বিজলির সাথে সাথে বজ্রপাতের শব্দে অনেকেই ছুটাছুটি করে। কেউ কেউ মাথায় টুপি জড়িয়ে ঢুকে মোড়ের পাশেই দণ্ডায়মান গর্বিত মসজিদে। কী মনে করে আমিও তাই করি। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে যতœ সহকারে ওজু করি। তারপর বিশ্বাস করি আর না করি ইমাম সাহেবের পেছনে শ্রদ্ধা আর ভয়ে জড়িয়ে থাকা মুসল্লিদের লাইনে দাঁড়াই। কখনও রুকু আর কখনও সেজদায় লুটিয়ে পড়ি অভিব্যক্তিহীন। নামাজ শেষে দু’হাত থালার মতো গোল করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি দু’হাতের সন্ধিস্থলে। আমার চতুষ্পার্শের লোকজন নানান ভঙ্গিতে মুখ বিকৃত করে বিলাপের সুরে এটা ওটা প্রার্থনা করে। কেমন যেন ওসব বিষয় সংক্রমণের মতো প্রভাব ফেলে আমার ওপর। নিজেকে নিঃস্ব আর ভিখিরির মতো মনে হয়। নিজের শূন্যতাকে পুঁজি করে কিছু চাইতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কী চাইব। কার কাছে চাইব?
মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেখি এ যেন মফস্বল নয়, কোনো ব্যস্ততম নগরী। পরিষ্কার আকাশের নিচে সবকিছুর মাঝে এক প্রকার চাঞ্চল্যবোধ লক্ষ করি। আমার কিছুক্ষণের সহবাসী মুসল্লিগণকে দেখি আমাকে অতিক্রম করে যেন চেহারায় কথিত স্বর্গের তৃপ্তি নিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। আমার ভেতর পুরনো একটা ধাঁধা অথবা প্রশ্ন সাপের মতো মোচড় দিয়ে ওঠে জটিল বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু; কে এই ঈশ্বর? অবিনশ্বর শব্দের নশ্বরতা অথবা অলৌকিক শব্দের লৌকিকতা কী?
আমি যদি ঈশ্বরে পুরোপুরি বিশ্বাসী হতাম তবে নিশ্চয়ই মিথ্যে আশ্বাসে হলেও মুসল্লিদের মতো অগাধ শান্তি বয়ে বেড়ানো যেত। অন্ধবিশ্বাসে জীবনকে চারদিক থেকে সঙ্কুচিত করে বলা যেত, এই আমার বেহেশত।
রাস্তা পার হতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে পারভেজ বলেছিল, মনের ভেতর গেঁথে থাকা সংস্কারটা যায় না।
বৃষ্টিতে ভেজা সোঁদা গন্ধের রাস্তা অতিক্রম করে ‘দৈনিক আজকের দেশ’-এর সামনে এসে দাঁড়াই। একতলা টিন শেডের পত্রিকা অফিসটা ঠিক আগের মতোই আছে। এখানে এই ‘আগের মতোই’ শব্দ দুটো আমার কাছে বেশ অর্থবহ। কেননা এখানেই আমার আনকোরা খন্ড সময়ের প্রথম বিচরণ। ছাপার অক্ষরে আমার লেখার হাতেখড়ি। নিষ্পাপ বালিকার মতো চন্দ্রিমার সাথে প্রথম অক্ষর বিনিময়। খোকা ভাই এবং খোকা ভাইয়ের সাথে চন্দ্রিমার প্রথম দেখা এখানেই। তারপর দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত আমাদের রাত আর দিনের হিসেবটা বাচ্চাদের যোগ অঙ্কের মতো কতো সহজ ছিল। এই মফস্বলের সকল আঙ্গিনায় আমাদের প্রজন্ম ছড়িয়েছিল শুদ্ধ কুয়াশার মতো। তারপর থেকে জীবনের প্রয়োজনে সময়ের কাছে সমর্পিত হয়ে একে একে শিমুল তুলার মতো পরস্পর অথবা নিজস্ব গতির আবেদনে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রজন্ম কি প্রশ্নবিদ্ধ? সময় এত স্থূল হয় কেন?
শিল্পকলার সামনে এসে শুনি ভেতরে হট্টগোল। গেটের দিকে তাকিয়ে প্রথমে ধাঁধায় পড়ে যাই। ভুল করছি না তো?
অনেকদিন পর অলস পায়ে গেট মাড়িয়ে ভেতরে ঢুকি। ঢুকে খুব অবাক হয়ে যাই। শিল্পকলার সেই পরিচিত ভাঙাচোরা শরীর এমন উঁচু বিল্ডিংময় হয়ে উঠেছে দেখে সঙ্কুচিত হয়ে যাই। মনের কোনো এককোণে বিঁধে থাকা মফস্বলের সাথে আমার দূরত্বটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেন অগাধ সম্ভাবনা নিয়ে আমি কোনো এক নগরীতে জন্মেছিলাম। যেন ‘আড্ডা’ শব্দের সাথে পরিচিত হওয়ার পর থেকেই আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ মোড়, নিশিতে পিজি-র আঙিনা অথবা টিএসসি-র মোড়ে নিজেকে উত্তাল করে তুলেছি। অথচ কত গতি, প্রেম আর স্পর্শ দিয়ে এই মফস্বল আমাকে, আমাদেরকে সংঘ করে রেখেছিল।
আমার নাম ধরে কেউ একজন হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠে। আমি অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চোখ মারি। ফর্সা চেহারায় মেয়েলি হাসির প্রলেপ মেখে সজল এসে দাঁড়ায় আমার ঠিক মুখোমুখি।
সজল কিছুটা বিস্মিত কণ্ঠে বলে, কীরে তুই এখানে?
কেন, মানা আছে?
আরে নাহ্। অনেকদিন এই চত্বরে তোর পদচিহ্ন দেখি না, তাই। ঢাকা থেকে কখন আসিস আর যাস টেরই পাই না।
আসলে খুব কম সময় নিয়ে আসি।
নাকি দূরত্ব সৃষ্টির সূক্ষ্ম চাল?
আরে নাহ্। তা ছাড়া এই লাইনের লোকেরা অঞ্চল দ্বারা বিভক্ত হয় না এবং তাই পথের দূরত্ব সীমানা নির্ধারণের মধ্যে পড়ে না।
সজল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সাথে সাথেই আমাদের কাছ থেকে কিছুটা দূরে, তুলনামূলক অস্পষ্ট আলোয় গুটি ক’জনের জটলা থেকে প্রথমে ক্ষীণ, পরে ঝড়ের মতো হাসির ছটা বেরিয়ে আসে এবং সম্ভবত উচ্ছ্বাসের চাপে একটা মেয়ে জটলা থেকে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
সজল বলে, চিনতে পারিস?
নাহ্। কখনও দেখেছি বলে মনে হয় না। কে?
সজল তার মেয়েলি হাসির পুনরাবৃত্তি করে বলে, যুথি। এবার চিনেছিস? মনে করে দ্যাখ, ঠিক মনে পড়বে।
আমি পাথরের মতো নীরব হয়ে মনে করার চেষ্টা করি। তারপর বলি, হ্যাঁ, পড়েছে। যুথি, যাকে আমি দেখব বলে দু’জনে পাবলিক লাইব্রেরিতে পুরো একটা বিকেল ওভারকাম করেছিলাম।
সজল যেন আমার কথাটা শুনতে পায়নি এমন ভঙ্গিতে হাত উঁচিয়ে মেয়েটিকে ডেকে ওঠে। মেয়েটি প্রথমে নাচের ঢঙে কোমরে ছোট একটা ঢেউ তোলে। তারপর প্রচলিত মডেলদের স্টাইলে সজলের পাশে প্রায় শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়। আমি খুব সংক্ষিপ্তভাবে যুথিকে এক পলক দেখে নিই। দেখে ছোট একটা ধাক্কা খাই। মেয়েটির চেহারায় এক প্রকার মাধুর্য আছে যা প্রথম দর্শনেই ঠিক ভেতরে করাঘাত করে। তবে সজল মেয়েটির সৌন্দর্যের যে নিপুণ ব্যাখ্যা দিয়েছিল ততটা কোনোমতেই না।
সজল বিনয়মিশ্রিত ভাষায় আমার সাথে তার পরিচয়পর্ব শেষ করে।
যুথি বলে, আমি আপনার লেখা পড়েছি। বেশ ভালো লেখেন। আপনার উচিত পেছনে না তাকিয়ে ক্রমাগত লিখে যাওয়া।
সদ্য পরিচিত কোনো মেয়ের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকা কোনো সভ্য লোকের কাজ না। কিন্তু আমি দ্বিধাহীন সেই কাজটাই করি। যখন বুঝতে পারি যুথির প্রশংসাসূচক শব্দগুলোতে কৃত্রিমতা নেই তখন চোখ নামিয়ে আনি। তারপর ডান হাতটা বুকের এক পাশে রেখে সেই কষ্টটা অনুভব করি। যুথির ‘ক্রমাগত লিখে যাওয়া’ বাক্যাংশটুকু বুকের ভেতর ক্রমাগত উঠানামা করে। আমি দ্রুত নিজেকে সামলে নিই।
যুথি বলে, আপনারা কথা বলুন। আমি ওদিকটায় আছি। আর নাটক দেখে যাবেন কিন্তু।
যুথি নৃত্যের ঢঙে চলে যাওয়ার আগে অকারণেই উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। আমার মস্তিষ্কে ঝিনঝিন শুরু হয়। কার যেন দুরন্ত হাসির মুখচ্ছবি ফিরে আসে। আমি কিছুক্ষণ তন্ময় হয়ে সেই ছবিটা খুঁজে আনার চেষ্টা করি। কিন্তু ছবিটা কার? কার?
আমি আপনা থেকেই ঐ প্রসঙ্গ আড়াল করে যুথির ‘নাটক’ শব্দটা নিজের মধ্যে টেনে আনি। নাটক।
হায় কবি, কেমন দেখলেন?
চমৎকার, দুরন্ত কিন্তু বয়স কম বলে মনে হল। সম্ভবত টিনএজ তাই পটিয়েছিস ভালোই। চালিয়ে যা।
ঝারি দিবি না। তোর নারীপ্রীতি সবার জানা। বিকেলে বাবলীর সাথে দেখা হয়েছিল। ঢাকা থেকে আসার পর নাকি একবারও দেখা করিসনি।
আমার শীতল শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। বাবলী? যুথিকে দেখে যে নামটা বারবার আমার মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছিল কিন্তু মনে পড়ছিল না। হ্যাঁ, বাবলী।
সেদিন সকালে আমাকে দারুণ বিস্ময় পেয়ে বসেছিল। বাবলীকে কখনও কাজিন ছাড়া অন্য কিছু ভাবিনি, সম্ভবত সে কারণেই ভেতরে ভেতরে বেড়ে ওঠা তার লোভনীয় নারীত্ব আমার সূক্ষ্মদৃষ্টিকে এড়িয়ে গেছে। আমার জন্য অর্থবহ অথবা তাৎপর্যপূর্ণ ‘সেদিন সকালে’ প্রচলিত পবিত্র মনে ওর ঘরে (যদিও সচরাচর বাবলীল ঘরে অনুপ্রবেশ করতাম না।) ঢুকেছিলাম। আমি আজও প্রায় সকালে সেদিনের সকালকে স্মরণ করি। কেননা সকালটা ছিল সত্যিকার অর্থেই কমনীয়। পরে যাকে বেশ ক’বার বাবলীর তরলের মতো নমনীয় শরীরের সাথে তুলনা করেছি।
বাবলী সম্ভবত তখন পনেরোতে। সে বিছানায় উপুড় হয়ে যতখানি লিখছিল তার চেয়ে বেশি বিরক্ত হয়ে কলম কামড়াচ্ছিল। আমাকে দেখেই সে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে লাফিয়ে উঠল এবং অনুনয়ের স্বরে বলতে লাগল, প্লিজ, অঙ্কটা মিলিয়ে দাও না। নইলে ক্লাসে সবগুলো মেয়ের সামনে স্যার আমাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবে। জাননা তো, আমাদের অঙ্কের স্যারটা কতো পাজি।
আমি মজা করে বলেছিলাম, তাতে আমার লাভ?
বাবলী এক মিনিট চোখ বন্ধ রেখে ঠোঁট কামড়ে বলল, তোমাকে দারুণ দুটো জিনিস দেখাব।
দারুণ কিছু দেখার লোভে নয়, স্বেচ্ছায় সেই সকালে বাবলীর তিনটি অঙ্ক মিলিয়ে দিয়েছিলাম আমি।
বাবলী বলল, তোমার চোখ দুটো বন্ধ কর তো।
এক মিনিট পরে চোখ খুলে আমি কেঁপে উঠেছিলাম। কোনো মেয়ের স্তন যে বাংলাদেশের মতো এমন সজীব আর নিটোল হয় সেই প্রথম এবং তার আঠারোর পূর্ব পর্যন্ত যতদিন তার স্তনযুগল সেই মহিমায় ছিল আমি স্পর্শে ও কামে দেখেছিলাম এবং আঠারোর আগেই আমাকে অবাক করে দিয়ে পড়ার বিপরীতে এমন একটা চঞ্চল ও ঝগড়াটে মেয়ে বাসন্তী শরীরের কামক্রিয়ায় দারুণ মেধাবী হয়ে ওঠেছিল।
রাত একটার দিকে নাটক শেষ হলে বাইরে এসে দাঁড়াই। দু’পায়ে নূপুরের আওয়াজ তুলে যুথি এসে কুর্নিশের ভঙ্গিতে বলে, আলামপনা, এবার বাসায় যাওয়ার হুকুম করুন।
বলেই সে তার নূপুরের শব্দকে ম্লান করে উচ্চশব্দে হেসে ওঠে।
সজল বলে, চল, কালীবাড়িতে যাই।
কেন?
কীর্তন হচ্ছে।
যুথির দিকে তাকিয়ে বলি, যাবে নাকি?
খুব বিনয়ের সুরে যুথি বলে, দুঃখিত।
শিল্পকলা থেকে বেরুলে মনে হয় এ এক ধ্বংসপ্রাপ্ত কোনও প্রাচীন নগরী। পাথর আর ছবির মতো পড়ে আছে সব। কে বলবে এই শহরে একটা সময় ছোটকাগজ প্রকাশের জন্য বিজ্ঞাপন, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে চাঁদা উত্তোলন, এপারে ওপারে চা’র দোকানে, আসলামের স্টুডিওতে আমাদের জীবনগুলো সজীব হয়ে উঠত, মৃত্যুগুলো জীবন ফিরে পেত?
সজল, চল গৌরাঙ্গবাজার দিয়ে ঘুরে যাই।
কেন?
এম্নি, আবারতো এদিকেই ফিরে আসা। মনে হোক বৃত্তাকার চাঁদের ধার ধরে ঘুরছি।
কালীবাড়িতে ঢুকতেই এতক্ষণের প্রাচীনতা মুহূর্তে উধাও হয়ে যায়। খঞ্জর, ঢোল, করতাল আর কোরাসের সুরে রাতের গভীরতা একদম অনুভূত হয় না।
আমরা ওসবকে একপাশে রেখে কালীমূর্তির মুখোমুখি এসে দাঁড়াই। সজল তার দু’পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে ভর করে তার উচ্চতার চেয়ে দীর্ঘ হয়ে ঘণ্টায় আঘাত করে। অনুগত শিষ্যের মতো আমিও তাকে অনুসরণ করি। তারপর সজল ষাষ্টাঙ্গে কালীকে প্রণাম করে। আমিও হাঁটুভেঙে বসি। কিন্তু মধ্যম পদ্ধতিতে কালিকে প্রণাম করার আগে কী মনে করে দাঁড়িয়ে পড়ি। প্রণাম রেখে অগত্যাই বিভোর হয়ে ভাবি, নামাজ আর পূজার মধ্যকার মৌলিক পার্থক্যটা কতোটা গভীর?
কীর্তনের পাশে কিছুক্ষণ বসে থেকে বাজনার সাথে কণ্ঠের তাল না পেয়ে বিরক্ত হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ি। রাস্তায় নামতেই সেই প্রাচীনতা আমাকে ঘিরে ধরে। সেই পাথর, সেই ছবি আমাকে স্তব্ধ করে রাখে। আখড়া বাজারের ব্রিজে উঠতে উঠতে সজল আমার কাঁধে হাত রেখে বলে, কবি?
হুঁ।
কিছু পেয়েছিস মনে হয়?
সজলের ‘পেয়েছিস’ শব্দের অর্থ আমি বুঝি না। কিন্তু প্রশ্নও করি না। নিকোটিনে ঢলে পড়ার মতো কণ্ঠে বলি, একটা বিড়ি ধরা।
সজল পকেট হাতড়ে প্যাক বের করে বলে, ট্রিপল ফাইভ। তোর ভাষায় লেডিস হার্ট। চলবে?
‘চলবে’-র উত্তর এড়িয়ে সজলকে পাল্টা প্রশ্ন করি, আচ্ছা, তোদের থিয়েটার থেকে পারফর্ম করলি অথচ জুয়েল ভাইকে চোখে পড়ল না। ব্যাপার কী রে?
আসেনি।
কেন?
উত্তর না দিয়ে সজল নির্জন দ্বীপের মতো স্তব্ধ হওয়ার ভান করে। কিন্তু আমি সহজেই বুঝে যাই নগরীর মতো মফস্বলেও মানুষের কমার্শিয়াল আত্মার দৌরাত্ম্য কতটা বেড়েছে। তবু আরেকটু অভিজ্ঞ হওয়ার জন্য বলি, যে থিয়েটার পারফর্ম করছে তার নির্দেশকের কোনো পাত্তাই নেই!
সজল আমার জানা কথাটাই নতুন করে বলে, আসলে সবাই কমার্শিয়াল হয়ে যাচ্ছে। তোদের সেই আড্ডা অথবা আড্ডার সেই জোশও এখন আর নেই।
তাইতো মনে হচ্ছে। ঢাকা থেকে আসার পর থেকে তো শহরেই ঘুরছি। অথচ তরুণ ভাইকে একবারও চোখে পড়ল না। কোথায় আছে জানিস কিছু?
আমরা নাটকের লোক। তবু যতদূর জানি, তরুণ ভাই এখন বৃন্দাবন অথবা বৃত্তের বাইরে।
বুঝলাম না।
চন্দ্রিমাকে নিয়ে দুই ভাইয়ের মাঝে ঘাপলা হচ্ছে। কিন্তু রায়হান ভাইয়ের সাথে তরুণ ভাই পেরে উঠছে না।
আমি হঠাৎ বজ্রপাতের মতো উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠি। নিজের হাসির শব্দটা নিজের কানেই উচ্চতর শব্দ হয়ে বাজে। তারপর ২০ বছর পর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে নীতি রায়কে গ্রহণ করার পরও রেসে রায়হান ভাই ভালোভাবে টিকে আছে ভেবে চমৎকৃত হই। তুলনায় একটা পিচ্চি মেয়েকে নিয়ে মধ্যবয়েসী দু’ভাইয়ের মানসিক টানাপড়েনের কথা ভাবতে গিয়ে আবার হাসি। হাসতে হাসতে দু’চোখ জলের পুকুর হয়ে যায়। কে জানে কতদিন পর পাগলকেও হার মানিয়ে এভাবে হাসি। যখন হাসি থামে খুব কাছেই দুটো কুকুর চারপাশে প্রতিধ্বনি তুলে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। সজল ধমক দিলে ক্লাসরুমে হট্টগোলরত ছাত্রদের মতো থমকে যায় তারা।
কলেজ গেটে এসে সজল একটা ট্রিপল ফাইভ ধরায়। আর একটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, চল বাসায় যাই। কোয়ার্টার প্যাক আছে একটা। দু’জন মিলে জল মিশিয়ে মেরে দিই।
আমি কোনো উচ্চবাচ্য করি না। পৃথিবীর খণ্ডিত অংশকে ঘুম পাড়ানো সদা জাগ্রত আকাশের দিকে চোখ মারি। তারপর ফালি করা তরমুজের মতো চাঁদ থেকে চোখ নামানোর সময় অগত্যাই একবাক্য শব্দ আমার মগজে আলপিনের মতো খোঁচা দিয়ে ওঠে, মনের মাঝে গেঁথে থাকা সংস্কারটা যায় না।
পরদিন ঘুম থেকে জাগি অনেক বেলা করে। ব্রাশ হাতে করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি মুখের দু’পাশে চারাগাছের মতো দাড়ি গজিয়েছে। কিন্তু দাড়ি পরিষ্কার করার কোনো ব্যাকুলতা আমার মধ্যে কাজ করে না। বরং হাত বুলাতে বুলাতে একবার মনে হয়, ত্রিদিব দস্তিদারের মতো রেখে দেবো নাকি একগাল? তারপর মাথায় ক্যাপ, গলায় মোটা মালা, হাতে বালা আর গায়ে তালি দেয়া প্যান্ট, জামা?
কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে রাস্তায় নেমে ভাবি কোথায় যাব? প্রথমে নক করি মান্নার বাসায়। মান্নার ছোট বোন এসে জানান দেয় সে বাসায় নেই। পত্রিকা অফিসে কী নিয়ে যেন ঘাপলা হয়েছে।
তবু মান্নার রুমে গিয়ে ঢুকি এবং বরাবরই মান্নার রুমে ঢুকলে যে ব্যাপারটি আমার ঘটে (নীরবে নীরবে নিজেকে তুচ্ছ ভাবা) এবারও তাই হয়। অভিজ্ঞ ও শিক্ষিত গৃহিণীর মতো একটা কলমকেও চমৎকার সাজিয়ে রাখে সে। যা অন্তত আমার সময় এবং জীবনের বিপ্রতীপ কোণে।
বেরিয়ে আসার আগে টেবিলের কোণে সারিবদ্ধ বইয়ের ওপরে একটা লিটলম্যাগ দেখে আমি থমকে দাঁড়াই। সেটা হাতে নিয়ে দু’পলক চোখ মারি। কাগজটির সম্পাদনায় চন্দ্রিমা ও দ্বীপের নাম বেশ গর্বিত অবস্থায় কালির কাপড়ে শুয়ে আছে। ক’পাতা উল্টাতেই নিজের লেখা কবিতা দেখে পুনরায় থমকে যাই। চন্দ্রিমার পত্রিকায় আমার লেখা? ‘গোত্র’ কবিতার ইতিহাস ঘাটতে শুরু করি আমি। মনে পড়ে এক যুবতী বিকেলে ঘুরতে ঘুরতে চন্দ্রিমাদের বাসায় ঢুকে পড়েছিলাম। চন্দ্রিমা তার চিকন হাত বাড়িয়ে অভিভাবকের মতো কঠিন স্বরে বলেছিল, আপনার কোনো নতুন লেখা থাকলে দেন তো।
আমার উজ্জীবিত হাত পকেটে ঢুকিয়ে যখন বের করি তখন শাদা কাগজে লেখা একটা নতুন কবিতা বেরিয়ে এসেছিল। নাম ‘গোত্র’।
আমি আমার বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে যেন সেই সময়ের ভেতর ডুবে যাই। কিন্তু পকেট থেকে হাত বের হওয়ার পর মনে হয় পাঁচ আঙুলে রক্তমাংস কিছুই নেই। যেন তিন কোটি বছর আগের প্রাচীনতম পাখির পা’র মতো পাঁচটি কঙ্কাল। আমি শিউরে উঠি। আমার সম্ভাবনা কি নরসুন্দার মতো শুকিয়ে যাচ্ছে? এভাবে আর কতকাল?
কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে পুনরায় নেমে পড়ি রাস্তায়। রাস্তার পাশের একটা চা’র দোকান থেকে এক কাপ চা গিলে পারভেজের বাসায় নক করি। খবর আসে পারভেজ নেই। ঢাকা ফিরে গেছে। দোজখের আগুন মাথায় নিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে খোকা ভাইয়ের বাসায় নক করি। খবর আসে খোকা ভাই নেই। ঢাকা ফিরে গেছে।
হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় শুকনো রোদ যতখানি তার চেয়ে ‘প্রজন্ম প্রশ্নবিদ্ধ’ এই অমীমাংসিত বাক্যটুকু আমাকে বেশি তাড়া করে। নইলে তাদের সাথে আমার মানসিক দূরত্বটা ক্রমাগত এভাবে বেড়ে চলবে কেন? তবু ‘ঢাকা ফিরে গেছে’ শব্দত্রয় আমার ওপর হঠাৎই একাকিত্বের প্রভাব ফেলে। আর মনে হয় বিকেলের ম্যাজিক লণ্ঠন, সন্ধ্যার আজিজ সুপার মার্কেট আর রাতের পিজি’র আঙিনা আড়ালে আমাকে ডেকে ওঠে।
আমি পুনরায় পথে নেমে পড়ি। যেন পথই আমার মৌলিক পরিচয়। দীর্ঘকাল থেকে এপথ ওপথ করে যাচ্ছি। যেন কাউকে অথবা কিছু একটা পথেই থাকার কথা ছিল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না। কী যেন পাওয়ার আশায় আমি এপার ওপার অনুসন্ধিৎসু চোখ মারি। কিন্তু দৃষ্টি প্রতিধ্বনির মতো নিজের কাছেই ফিরে আসে। আমি নিজের দিকে চোখ মেরে নিজেকেই দেখি। বাইরের আমি আর ভেতরের আমি’র পার্থক্য খুঁজি। কিন্তু শূন্যতার আঘাতে দৃষ্টি শুষ্ক মরু হয়ে ওঠে।
একটা রিকশা এসে হঠাৎ আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। কিন্তু আমি কোন ধ্যানে হাঁটতেই থাকি! পেছন থেকে একটা কণ্ঠের ধাক্কায় আমি নড়ে উঠি।
কী ব্যাপার, অ্যাকসিডেন্ট হলেও তো টের পাবে না দেখছি।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি রিকশার ওপর রায়হান ভাই। উজ্জ্বল মুখে চশমার ফাঁক দিয়ে পিটপিট চোখে তাকিয়ে আছে। তার পাশে জড়সড় হয়ে বসে আছে একটি মেয়ে। রায়হান ভাইয়ের পাশে এক রিকশায় বসে আছে সে জন্য নয়, প্রথম দৃষ্টিতে দ্বীপকে আমার অচেনা মনে হয় এজন্য আমি অবাক হয়ে যাই। দ্বীপের শরীরে আকাশি রঙের শাড়ি। তার চোখ, ঠোঁট আর পেটের ভাঁজে ভয়, লজ্জা ও অনুশোচনাবোধ দেখে মনে হয়, ওটা কিছু নয়, অর্থহীন। আমি কাউকেই পুরোপুরি পেতে চাইনি। শুধু দ্বীপ কেন, ইন্দু অথবা বাবলী কিংবা শয্যা আর রেললাইনের স্মৃতি খুঁড়ে আনা কোনো মেয়েই আমাকে দীর্ঘক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখতে পারেনি। কেবল কবিতা আর কথাশিল্প আমাকে সারাক্ষণ প্রসব বেদনায় অস্থির করে রাখে।
রায়হান ভাই বলে, কী হে। মফস্বলেইতো আছ দেখছি। অথচ চোখে পড়ে না। আড্ডাফাড্ডা কি ছেড়ে দিলে নাকি?
আমি মন ও চোখ দিয়ে দ্বীপকেই দেখছি। তার শেষ বয়সী মহিলার মতো ন্যুব্জ হয়ে থাকা শরীর আর পরাজিত রানির মতো অসহায় আনত চোখ দেখে উল্টা নিজেই লজ্জা পাই। আমি দেখতে পাই তার কাজ করা ঠোঁটে দু’পাটি ঠোঁটই কেবল সাধারণ হয়ে শুয়ে আছে। প্রাঞ্জল বিকেল আর দীর্ঘ রেললাইনের সাথে তার কোনো যোগাযোগ চোখে পড়ে না।
আমি কী মনে করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাক্য ছুঁড়ে রায়হান ভাইকে আনমনে নিজের কথাই বলি, ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে। এখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।
রায়হান ভাই সলো ছবির গাব্বার সিং এর মতো হেসে ওঠেন।
রাগ করো না হে। আজ সন্ধ্যায় এসো। গল্পটা যেন সাথে থাকে। দেখব তুমি কেমন এক্সপার্ট হয়েছ। আজ তোমাকে ভাসিয়ে দেব।
বলেই রায়হান ভাই আবার হাসেন। তিনি যত উন্মুক্ত হন, দ্বীপ ততই সঙ্কুচিত হতে থাকে। আমি আর কিছুই বলি না। দীর্ঘ রাস্তার ওপর লাশের মতো ঝিম ধরে পড়ে থাকা কড়া রোদ মাড়িয়ে হাঁটতে থাকি। রিকশাটা দ্রুতবেগে আমার পাশঘেঁষে যেন বাতাসে উড়ে চলে। সেই সাথে আমি মাথা তুলে অনুভব করি, রায়হান ভাইয়ের উচ্চহাসি আর দ্বীপের খোলা চুলও উড়ে বাতাসে ভর করে। চোখ বন্ধ করে স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে আমার মনে হয়, রফিক আজাদের মতো বুকের ভেতর জেঁকে থাকা কোনো ভারী পাথর দীর্ঘদিন পর নিঃশব্দে নেমে গেল। কিন্তু যখন নিজেকে উড়ন্ত শিমুল তুলার মতো নিশ্চিন্ত ভাবতে শুরু করি তখন আরব্য রজনীর কোনও এক চরিত্রের মতো হঠাৎ তন্ময় এসে দাঁড়ায় আমার ঠিক মুখোমুখি। এমন উচ্ছ্বলতায় বিভোর সময়ে আমি থমকে যেতাম না। কিন্তু তাকে বেশ আপসেট মনে হয়। তার কপালের এক পাশে টিউমারের মতো ফোলা জায়গা যাকে আমরা ঠাট্টাচ্ছলে কখনও কখনও রাজটিকা বলে থাকি, সেটাকে আরও বড় মনে হয়। তবে কি সে কোনো কিছুতে খুব ক্ষেপে আছে?
কীরে, কোত্থেকে এলি? ঠিক আছিস তো?
তন্ময় উত্তর দেয় না। কপালের ওপর তার ডান হাতটা ছাতার মতো ধরে উঁকি দিয়ে দূরে কী যেন দেখে।
কাউকে খুঁজছিস?
তন্ময় কোমরে হাত রেখে ঘাড় কাঁত করে বলে, রায়হান ভাই ছিল না এখানে?
হ্যাঁ। কেন?
সাথে কে ছিল?
দ্বীপ।
তন্ময় ঘাড় ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলে।
কিছু বলছিস?
তন্ময় সম্ভবত মূল কথাটা এড়িয়ে তার ক্ষোভ অন্য খাতে ঠেলে দেয়।
আর বলিস না। কাম, প্রেম না-কি উৎসের জন্য মরিয়া ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। নইলে মেয়ের বয়েসীদের সাথেও অমন সুরসুরি চলাফেরার সঠিক অর্থ কী? অথচ মৌলিক কাজগুলো করছে নির্লজ্জের মতো। ভাবতে পারিস, এরকম একটা সংখ্যায় টাকা খেয়ে বাজে সব লেখা দিচ্ছে।
রায়হান ভাইয়ের এসব সংকীর্ণতার ব্যাপারে আমি জ্ঞাত। চাইলে এ-বিষয়ে ওর সাথে আমি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে পারি। কিন্তু তাকে থমকে দেয়ার জন্য তার পিঠ চাপড়ে বলি, ব্যাপার না। ওরা টিকবে না।
তন্ময় নিজের নামের মতোই নীরব হয়ে পুনরায় কপালের ওপর ছাতার মতো তার ডান হাতটা গোল করে ধরে। তারপর সময়ের মতো সবকিছু উপেক্ষা করে দ্রুত আমার দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করে।
মধ্যবয়েসী বিকালে নিজেকে অবাক করে দিয়ে পুরনো ছোট একটা পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়াই। সম্ভবত আমি ঘোরের মধ্যে কাজটা করে ফেলি। কেননা এই সময়ে এত সহজে ইন্দুদের বাড়িকে ঠিক পেছনে রেখে দাঁড়ানোর যে সঙ্কোচ অথবা দ্বিধা তাকে অবহেলা করার সাধ্য আমার নেই। আমি চোখ বন্ধ করে ব্যাপারটাকে যতই সহজ ভাবার চেষ্টা করি নিজেকে তার চেয়ে বেশি অচেনা এবং ভিন্ন গ্রহের কোনো মস্তকবিহীন প্রাণী মনে হয়। কিন্তু নিজেকে অবাক করে দিয়ে আমি খুব দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠি। আর মনে হতে থাকে এই উঠান, জঙ্গলের মতো জড়াজড়ি করে থাকা বৃক্ষ, ঘর ইত্যাদি আমাদের প্রথম থেকে শেষ স্পর্শ, চুম্বন, সঙ্গমের (যদি পাপ হয়) প্রথম ও শেষ সাক্ষী। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ইন্দুদের উঠানে অন্ধকার রাত খুঁজি। স্মৃতির মতো মিলিয়ে থাকা পদচিহ্ন খুঁজি। আর ইন্দুকে...
না না, এখানে, আমার এই ক্ষয়িষ্ণু সময়ে ইন্দুকে পাওয়া যাবে না। আমি জানি। আচ্ছা, সময়য়ের ক্ষয়িষ্ণুতা সম্পর্কে ইন্দুর কি কোনো ধারণা আছে? বহমান নদীর মতো সাবলীল সময়ে ঢাকা নগরীর একপাশে স্বামী-সন্তান নিয়ে বেশ সংসারী হয়ে আছে যে মেয়েটা সে কি এখনও চরম বাস্তবমুখী?
আচ্ছা, রমনার বটমূলে বোমা ফাটালে তোমার সমস্যাটা কোথায়? এই নিয়ে তোমাকে কালো ব্যাজ পরে রাস্তায় নামতে হবে কেন?
আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। ইন্দুর ওপর রাগ করার সাধ্য আমার কখনও ছিল না। কিন্তু সেদিনই প্রথম আমি তাকে খুব ঘৃণা করেছিলাম এবং সে যখন বলেছিল, তোমাদের এইসব গল্প আর কবিতা সময়ের অভিশাপ, বাণিজ্যিক হও দেখবে সময় তোমার দাসত্ব করবে-- তখন এই যে দীর্ঘ সময় ধরে ইন্দু তার মন ও শরীর দ্বিধাহীন আমাকে সমর্পণ করার মতো উদারতা দেখিয়েছে আমি তা অকৃতজ্ঞের মতো সহজেই অস্বীকার করেছিলাম। আমি যদিও প্রচলিত ঈশ্বরাত্মার মতো মহান ও ক্ষমাশীল নই তবুও আমি ইন্দুকে ক্ষমা করে দিতে পারতাম, কেননা ‘বাণিজ্যিক’ শব্দের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে তার ধারণা নেই অথবা তখন ছিল না। কিন্তু খুব সত্য ও সহজ অর্থেই আমি তা করিনি। বরং আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। নইলে (যদিও রমণীর শরীর আমার প্রিয়) নতুন সঙ্গম, নতুন স্পর্শ যুবতী চাঁদের মতো আমাকে শুষে নিতে পারত না। বাবলীর উঠতি যৌবনের ভাঁজে ভাঁজে আত্মসমর্পণ করতাম না।
অপরিচিতের মতো এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
একটা অপরিচিত কণ্ঠের টানে আমি পেছনে তাকাই। এতকিছুর পরেও ইন্দুর কণ্ঠ চিনতে পারিনি সেজন্য যৌক্তিকভাবেই আমি অবাক হতে পারতাম। কিন্তু মূলত তার কণ্ঠটাই সে পর্যায়ে নেই, তাই আমি অবাক হই।
আস, আমার ঘরে আস।
কোনো উচ্চবাচ্য না করে তন্ময়াচ্ছন্ন হয়ে তার পিছু যেতে যেতে হঠাৎ কেন জানি মনে হয় আমি একজন পতিতার রুমে গিয়ে ঢুকছি। কেননা যদিও দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত মনে হতো শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার দ্রবণেই আমরা এক বিছানায় দ্রবীভূত হতাম, কিন্তু পরে মনে হয়েছিল আমি একজন মাত্র পুরুষ তার শয্যাসঙ্গী ছিলাম না। কেননা ইন্দু আপাদমস্তক বাণিজ্যিক। সাম্যবাদ তার কাছে অর্থবহ কোনো বিষয় বা শব্দ নয়। অথবা কেননা আমি শুনতাম লোকে বলত যে নরসুন্দার ওপারের টাক মাথার একটা ছেলে তার শূন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দু’জনকেই বিধ্বস্ত মনে হত।
ইন্দুর রুমে ঢুকতেই পাঁচ সেকেন্ডে যেন আমার পাঁচ বছর বয়স কমে যায়। এক চিলতে রুমের ভেতর একটি খাটের সাথে জড়িয়ে থাকা পড়ার টেবিল আর জানালায় আমাদের শীৎকার শুনতে পাই। আমাদের সন্ধি আর বিচ্ছেদের গল্প প্রামাণ্যচিত্রের মতো চোখে ভেসে ওঠে।
আসলে বেঁচে থাকার জন্যে খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। প্রচন্ড শীতের রাতে তিন চারটে বাচ্চা নিয়ে ফুটপাতে ঘুমায় মানুষ। তার তুলনায় একটা স্বাধীন দেশে এরকম একটা ক্ষুদ্র রুমে নিদ্রা অথবা বেঁচে থাকার মূল্যায়ন খাটো হওয়ার কথা নয়। কী বল?
রমণকালে মেয়েরা খুব বাধ্যগত হয়। সম্ভবত সে কারণেই ইন্দু ‘হুঁ’ উচ্চারণ করতে ইতস্তত করেনি। কেননা পরদিনই সে খোশগল্পে খুব সহজেই বলেছিল, আমাদের কিন্তু বড় বড় তিনটে রুম থাকবে। একটা আমাদের দু’জনের। একটা আমাদের বাচ্চাদের। বাকিটা গেস্টদের।
সাধারণত আমার ধারণা সত্যি হয় না। কিন্তু সেদিন মনে হয়েছিল ইন্দুর সাথে আমার হবে না। তারপর হয়নি। ইন্দু সুশৃঙ্খল থেকে গেল আর আমি বিচ্ছিন্ন।
এতদিন পর আজ ইন্দুর রুমে ঢুকে মনে হয় সবকিছু আগের মতোই আছে। শুধু ইন্দু চট করে চিনে ফেলার মতো অবস্থায় নেই।
আমি বলি, কেমন আছ তুমি?
ইন্দুর চোখে মুখে যেন ভোরের সূর্য ফুটে ওঠে। একটা ঘুমন্ত বাচ্চা ছেলের পাশে শুয়ে তার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলে, ভালো, খুব ভালো। গোছানো সংসারে আমি, আমার স্বামী আর আমাদের মেয়েকে নিয়ে তোমাদের ভাষায় অনাবিল সুখেই আছি।
এটা তোমার মেয়ে?
ইন্দু ‘কেন’ প্রশ্ন করে টের পেয়ে যায়। তারপর বাচ্চাটিকে কাঁপিয়ে দিয়ে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে দীর্ঘসময় কামোত্তেজিত থাকা ক্লান্ত রমণীর মতো হাত পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। যেন তৈরি হয়েই আছে।
সব ওর বাবার পাগলামি। মেয়েদের পোশাক পরতেই দেয় না। আচ্ছা বল, লাভ আছে কোনো?
ইন্দু হাসতেই থাকে। আমি বলি, আচ্ছা কে বেশি পারে? তুমি, না তোমার বর?
ইন্দুর হাসিটা থেমে যায়। বৃদ্ধার মতো ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসে। তারপর বৃদ্ধ বিকেলের করুণ সূর্যের মতো তাকায় আমার দিকে।
আমাদের দু’জনের মধ্যে নগ্নতাপে কে বেশি উষ্ণ হত? আমি না তুমি?
ইন্দুর এই অবস্থা দেখে আমার বিহ্বল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যেন আমি ভেতরে ভেতরে বেশ গর্বের সাথেই বলি, মনে হয় আমি।
ইন্দু অভিজ্ঞ সংসারী মা’র মতো একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। আমি তার সুখে থাকার অভিনয়টা ধরে ফেলি।
তুমি অনেক মোটা হয়ে গেছ কিন্তু। কণ্ঠটাও বদলেছে অনেক। স্বাস্থ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে স্থূল হয়েছে তোমার কণ্ঠ।
বাদ দাও ওসব। তোমার কথা বল। কেমন আছ তুমি?
জানি না। তবে বেঁচে আছি।
না। তুমি বেঁচে নেই। আমি জানি। তুমি মৃত।
আমি শিউরে উঠি। আমার কোন অবস্থাকে কেন্দ্র করে ইন্দু ‘মৃত’ শব্দ উচ্চারণ করে আমি বুঝি না। আমি মৃত মানুষের মতো নিশ্চল চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
হ্যাঁ, আমি জানি, না লিখে তুমি বাঁচতে পার না। আমি শুনেছি তুমি নাকি লিখছ না। কথাটা সত্যি?
আমি জানি, যুক্তরাষ্ট্র আগ্রাসী হওয়াতে অন্যদের পৃথিবীটা ক্ষুদ্র হচ্ছে কি না সে বিষয়ে ইন্দুর কোনো মাথাব্যথা নেই। তার ঘরটা প্রশস্ত থাকল কিনা সেটাই আসল কথা। আমার লিখা না লিখা নিয়েও তার উচ্চবাচ্য ছিল না কখনও। তবু নিম্নস্বরে অনেকটা নতজানু হয়ে বলি, আমি পারছি না।
পারছি না বললে তো হবে না। তোমাকে লিখতে হবে। শূন্য দশকের প্রতিভাবান লেখক তুমি। দশক পেরিয়ে যাচ্ছে।
সেদিন বিকেলে দ্বীপের বলা শব্দগুলোই যেন ইন্দু পুনরাবৃত্তি করে। কিন্তু প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি মাত্রা ভোরের সূর্যের মতো নতুন মনে হয়। আমি কি ঘোরের মধ্যে আছি? অথবা আমি যদি ইন্দুর জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকতাম তবে কি সে এমন কথা বলার সাহস দেখাতে পারত? তবু আমার সম্মুখ অংশ আমার চোখে ঝাপসা লাগে। ইন্দুর সেই শিহরিত ঠোঁট এখন আর নেই। সময়, সংসার অথবা সুখের চাপে স্থূল হয়েছে অনেক। কিন্তু এই প্রথম তার ঠোঁটে একসাথে আমার কামনা আর বিদ্রোহ জেগে ওঠে। কিন্তু আমি নিবৃত্ত হই। নিভৃতে থাকি।
আমি বলি, তুমি ঠিক বলেছ। আমি মৃত। জীবন যেখানে চমৎকারভাবে বিরাজ করে তার আর আমার মাঝে দীর্ঘপথ অন্ধকার।
একটু থেমে বলি, জান, ব্যাবিলন ধ্বংস হয়ে গেল, আমি কিছুই লিখতে পারিনি। আজাদ স্যারকে খুন করা হল, আমি কিছুই লিখতে পারিনি। তুমি উপযুক্ত শব্দটি নির্বাচন করেছ মৃত।
ইন্দু খ্যাপার মতো হেসে ওঠে। সে কখনও আমাকে তার ধাঁধাঁয় ফেলতে পারেনি। তবু দু’চোখ গোল করে বলে, আরে ধ্যাৎ, আমি তো এমনি বললাম।
ইন্দু তার হাসিটা ধরে রাখে। আমি দীর্ঘ নদীতে নৌকার পালের মতো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। এ যেন পৃথিবীটা একটা বৃত্ত প্রমাণ করে পূর্বের পরিধিবিন্দুতে ফিরে আসা। কত নারীর পর পুনরায় ইন্দুর বিছানায় এসে বসা। কিন্তু ক’বছরের সংসারে ইন্দুর বয়স একটু বেশিই বেড়েছে মনে হয়।
ইন্দু শীতল হয়ে অনেকটা আমার দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, শুনেছি তুমি নাকি বিয়ে করছ?
আমি ভেতরে একটা ধাক্কা খাই। কিছু বলি না। টেলিফোন রিসিভারের মতো মাথা নিচু করে বসে থাকি।
ইন্দু জড়ানো কণ্ঠে বলে, আমি চাই তুমি লিখ। কিন্তু যে রকম শূন্যতায় তুমি ভুগছ তাতে বিয়ে করলে কেবল বউকে ভালোবাসতে চাইবে, লিখবে না। অথচ এটাই তোমার শ্রেষ্ঠ সময়। এই মফস্বল, এই দেশের সবগুলো মানুষ, মানুষের আড্ডায় তোমাকে স্মরণ করা হবে। আমি তোমাকে নিরেট ভালোবাসা দেব। বিছানায় সুখ দেব। কিন্তু তুমি লিখবে।
আমি ভারাক্রান্ত হয়ে তার দিকে আর্দ্র চোখ তুলি। ইন্দু অনুসন্ধিৎসুর মতো আমার চোখের ওপর দৃষ্টি পাতে। একবার ইচ্ছে করে স্ফীতকণ্ঠে নির্মলেন্দু গুণ-এর মতো বলি,
ওখানে কি খোঁজ তুমি? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ;
রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,
কিন্তু আমার কণ্ঠ, ঠোঁট দক্ষিণ গোলার্ধের মতো জমে যায়।
এবার দেখি ইন্দুর চোখও বর্ষার পুকুরের মতো জলে ভরে আছে। ঝুলে থাকা আলোহীন বৈদ্যুতিক বাল্বের মতো নিচের পাটির ঠোঁটে জমা পড়ে তার ক’ফোঁটা। আমি ঠিক থাকতে পারি না। বিহ্বল হয়ে পড়ি। আমার আমিত্বকে ফিরে পাওয়ার প্রাণান্ত ব্যাকুলতা ইন্দু উপলব্ধি করছে দেখে এই প্রথম আর কিছু নয়, কেবল শ্রদ্ধায় লতার মতো জড়িয়ে ধরি তাকে।
রাত বারোটা অবধি একটা ঘোর যা চেতনাকে সজীব রাখে, আমি তার মাঝে আচ্ছন্ন থাকি। তারপর নিজেকে কর্পূরের মতো হালকা লাগে। বেঁচে থাকার প্রেরণা উর্বর হয়ে ওঠে। উৎফুল্ল মনে অনেক ঘেঁটেঘুঁটে দেড় বছর আগে শুরু করা একটা অসমাপ্ত গল্প, যেখানে স্বজনহারা, মঙ্গাপীড়িত এবং রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা এক সদ্য-যুবতী কী রকম চাপে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করতে সম্মতি দিয়েছিল তার বর্ণনা আছে, সেই গল্পটা বের করি।
কিন্তু একঘণ্টা বসে থেকেও এক লাইন লিখতে পারি না। সৃষ্টিহীনতার চাপে তখন আমার হাত কাঁপতে শুরু করে। অস্থিরতায় লরেল বৃক্ষের মতো ঘামতে শুরু করি। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। যদিও জন কীটস্ গল্প লেখায় পারদর্শী ছিলেন না তবু মৃত্যুপথযাত্রীর তওবা পাঠ করার মতো বিলাপের সুরে তার কাছেই প্রসঙ্গপাত করি হায় কীটস্, আত্মার স্বরূপ কী? প্রচলিত বিশ্বাসের আত্মা অমর? তোমার আত্মা বেঁচে আছে? আমার অবস্থানে থাকলে তুমি কী করতে?
যেন ঘোরের মধ্যে অনেকটা জেদ করে একটানা লেখা শুরু করি। কিন্তু লেখা শেষে অবাক হয়ে যাই। গুণে দেখি দেড় পৃষ্ঠা লেখায় বিয়াল্লিশবার নিশিকাননের নাম। আমি থ মেরে যাই। এতদিন কি তবে নিশিকাননকেই চেয়েছি? কলম খাতা ফেলে আমি হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। আমার দু’চোখের কোণ থেকে কলা পাতা বেয়ে বৃষ্টি পড়ার মতো জল ঝরতে থাকে।
তারপর আমার চোখের পাতা আর নামে না। তিনটার দিকে আমাদের টিনচালে প্রথমে সে রাতে কালীবাড়ির অগোছালো বাদ্যবাজনা এবং পরে ছান্দসিক শব্দ তুলে স্থূলাকার বৃষ্টি নামে। এরকম বৃষ্টির পরে পৃথিবী হয় রমণীয়। আমি ফজরের প্রথম আজানের সাথে সাথে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে কাউকে না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। ঠিক ভোর নয়, রমণীমোহন শেষ রাতে নিশিকাননের বাড়িকে সামনে রেখে বিশ্বস্ত পুরুষের মতো দাঁড়াই। কিন্তু প্রচন্ড আবেদন না থাকলে এমন সময় কোনও নারী ঘর থেকে বের হয়? আমি তবু দাঁড়িয়েই থাকি। ঢাকা যাওয়ার নিরেট আবেদনটা ক্রমশ শীতল হতে শুরু করে। কিন্তু কেন? এই মফস্বল, যার আড্ডা একদা আমাকে পুনর্বার সৃষ্টি করেছিল এখন তার কী এমন মাদকতা আছে যা আমাকে অভিজ্ঞ মাতাল করে রাখে?
আমাদের বাড়ির ঠিক মুখোমুখি যেখানে নরসুন্দা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পানি পুষে রাখে তার পাশে ব্যাগটা রেখে আলতো ঢঙে বসি। আমার প্রায় পাঁচ ফুট দূরে যেখানে চাঁদ তার অবিকল ছায়া ফেলে রেখেছে অভিজ্ঞ শিকারির মতো তার ঠিক মাঝখানে ঢিল মেরে মনে হয় কতো প্রজন্ম আগে আমার সৃষ্টি এবং তখন থেকেই আমি বিচ্ছিন্ন। তবু কার টানে আমি বৃত্তের বাইরে থেকেও কেন্দ্রে ফিরে আসতে ব্যাকুল হয়ে উঠি? নিশিকানন আমার কে হয়? কেন ব্যাকুল মনে হয় নিশিকানন আমার প্রিয় জন্মভূমি? আমার প্রিয় মফস্বল, হারানো প্রিয় আড্ডা?
আজ ১০ ডিসেম্বর। এই যে ১০ ডিসেম্বরের ক্ষণ তথা নিশিকাননের জন্মতিথি সৃষ্টির উৎসের জন্যে আমি আমার মন ও মননকে সুন্দরের দিকে ধাবিত করি। মনে হচ্ছে সৌন্দর্যই¬¬¬¬¬¬¬¬¬ প্রেমের ভিত্তি। আর ‘সমৃদ্ধ ভালোবাসা’ যদি সুন্দরের ন্যূনতম সমার্থক হয় তবে তা প্রিয় মদের মতো পান করতে চাই। জটিল জীবনের সাক্ষী মহান কবি কীটস্’র মতো বলতে চাই, A things of beauty is a joy forever…
আর তাই ইতিমধ্যে স্থির হওয়া জলের ওপর চাঁদের প্রতিচ্ছবির দিকে নিবদ্ধ দৃষ্টি রেখে সেই প্রথম ‘ঝোঁপের ভেতর ঝিঁ ঝিঁ ডাকা আর আকাশভর্তি তারকা রাত’-এর মতো আর্তনাদের সুরে ডেকে উঠি-- নিশিকানন, নিশিকানন...
২০০৬ ইং
লেখক পরিচিতি
অনিন্দ্য আসিফ
কবি ও গল্পকার
কাতিয়ার চর, কিশোরগঞ্
ঢাকা, বাংলাদেশ।
2 মন্তব্যসমূহ
valo...
উত্তরমুছুনI like to say along with Nirad C. Chaudhuri ’Kishoregonj is my Birthplace’You have write well and captured a glorious floating time of kishoregonj which we have passed & I feel nostalgia .Dear friend Asif please keep it up …………I Wish your progress & success
উত্তরমুছুন