রেজা ঘটক : নিজের লেখা কোন গল্পটি সেরা সেটা
নিজের পক্ষে বলা খুব কঠিন। আমার সব গল্পই আমার সন্তানের মত। সেই গল্পগুলো'র মধ্যে কারো হয়তো
চেহারা সুরত ভালো। কারো হয়তো গায়ের রঙ কালো। কারো হয়তো ক্যানভাস সুদৃঢ়। কারো হয়তো
বুনট ভারী যুতসই। কারো হয়তো কাঠামো ভারী টেকসই। কারো হয়তো স্থান-কাল-পাত্র আবেগঘন।
কারো হয়তো ভাষার ঢং আঞ্চলিক। কারো হয়তো খেয়ানৌকায় ওঠার তাড়া। কারো হয়তো পকেটে নেই
ভাড়া। এমন অসংখ্য মিশেলে আমার গল্পগুলো সৃষ্টি হয়েছে। সেখান থেকে নিজের সেরা
গল্পটি বেছে নেওয়া আমার জন্য বেশ দুরুহ। তবে আমার গল্পগুলো যখন আমি পাঠ করি, কিছু কিছু গল্পের
মধ্যে আমার এখনো হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিছু কিছু গল্পের মধ্যে এখনো আমি নিজেই
ডুবে যাই। কিছু কিছু গল্পের মধ্যে এখনো আমি অতল গাঙের ঠাই খুঁজে পাই। সেভাবে বললে
বলতে পারি, আমার নিজের লেখা বেশকিছু গল্পই আমার বেশ পছন্দের। সেই তালিকাও বেশ
লম্বা। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এবং সময়ের বিচারে আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে 'শিখা অনির্বাণ' গল্পটির কথা। 'শিখা অনির্বাণ' গল্পটি আমার
দ্বিতীয় গল্প সংকলন 'সোনার কংকাল'
বইয়ে আছে।
গল্পপাঠ ২. গল্পটির বীজ কিভাবে পেয়েছিলেন?
রেজা ঘটক : ২০০০ সালে আমার সার্টিফিকেট অনুযায়ী
সরকারি চাকরির বয়স সীমা শেষ হয়। সপ্তদশ, অষ্টাদশ ও বিশতম বিসিএস পরীক্ষায় পর
পর তিনবার আমি ভাইভা দেবার পরেও বিসিএস হল না। তখন মন মেজাজ ভারী খারাপ। সরকারি
চাকরিতে আর কোনো আবেদন করারও সুযোগ নেই। ওই সময় পরিবারের সঙ্গেও সম্পর্কে ভারী
টানাপোড়ন। একটা প্রেম করতাম,
সেই যুবতীও চলে গেল। চাকরি নাই। কাজকর্ম নাই। ফুলটাইম বেকার। কোথাও
চাকরির আবেদন করতেও মন থেকে সারা পাই না। নানান টাইপের নেশা করি। হরেক রকম নেশা।
নেশার মধ্যেই ডুবে থাকি সেই সময়। তো একরাতে আমার সকল
সার্টিফিকেট-মার্কসিটগুলো নিয়ে সন্ধ্যা থেকে নানান গবেষণা করলাম। আমি তখন থাকি
কাঁঠালবাগানের এক চিলেকোঠায়। আমরা থাকি চারজন। ঈদের ছুটির সময় ওটা। অন্যরা যার যার
বাড়িতে গেছে। আমি একা একা ঘোরলাগা নেশা করছি। তো ঠিক রাত বারোটা এক মিনিটে আমার
সকল সার্টিফিকেট-মার্কসিট গুলো আগুন দিয়ে পোড়ালাম। সেই আগুন যতোক্ষণ ছিল, ততোক্ষণ সেই আগুন
দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে টেনেছি। তারপর আমার এক গল্পকার বন্ধু রাজীব
নূরকে ফোন করলাম। বললাম, আমি এখন সুইসাইড করব। কিন্তু সুইসাইডাল নোটে কি লিখতে হয় বুঝতে
পারছি না। কি লেখা উচিত? ওপাশ থেকে রাজীব নূর বললো, রেজা আপনি কোথায়?
বললাম, বাসায়। - আপনি কি একা?
- হ্যা
- আমার ফকিরাপুল থেকে আসতে একটু লেট হবে। আপনি অন্তত সকাল পর্যন্ত
অপেক্ষা করেন। আমি আসি। আপনার সুইসাইড করার কারণ শুনি। তারপর আমার সামনে যা করার
কইরেন।
তারপর ফোনে অনেকক্ষণ চিৎকার করে
কাঁদলাম। রাজীব নূর যেভাবে পারলো শান্তনা দেবার চেষ্টা করলো। তারপর কাগজ কলম নিয়ে লিখতে শুরু করলাম। কিন্তু কি লিখব বুঝতে পারছি
না। আমি সুইসাইড করব এটা তখনো শতভাগ নিশ্চিত।
হঠাৎ মনে হল, জাপানি লেখক ওসামু
দোজাই'র 'দ্য সেটিং সান'
উপন্যাসে সেই লোকটি কিভাবে সুইসাইড করেছিল, সেটি একটু চেক
করি। তো ওটা চেক করতে করতে রাজীব নূর এসে হাজির।
তারপর কি হল? আমার সুইসাইড করা
হল না। তখন একটি গল্পের বীজ আমার মাথার মধ্যে দানা বেঁধেছিল। কিন্তু
গল্পটি আর লেখা হয় না। কারণ গল্পের চরিত্র কারা, গল্পটি কি নিয়ে, গল্পের স্থান কাল
কেমন, গল্পের বিষয়-আশয় কি এসব আর মাথায় ঠিক কাজ করে না। কিন্তু 'ঠিক রাত বারোটা এক মিনিটে ফাঁসি হবে' এই লাইনটা ঘুরে ফিরে মাথায় ঘুরতে
থাকলো। গল্পটি আর আমার কাছে ধরা দেয় না। আমি আর গল্পটি লিখতেও পারি না। গল্পটি দূর
আকাশে উড়ে বেড়ায়, ডানা মেলে নিজের মত ঘুরে বেড়ায়। আমি যখনই তাকে নিয়ে ভাবতে বসি, সে আরো সুদূরতম
দূরে অবস্থান করে। ধরা দেয় না। কথা কয় না। সে ভারী তাল বাহানা করতে লাগলো। আমিও
সময় সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। ফাঁদ পাতার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনো কাজ হল না। গল্পটি
কেবলই সাঁই সাঁই করে আমার মাথায় ঘা মেরে দূরে মিলিয়ে যেতে থাকলো। হয়তো সেই রাতের
ওই ঘটনা থেকেই আমার 'শিখা অনির্বাণ'
গল্পটির বীজ রোপিত হয়েছিল। আমি ঠিক জানি না। তবে এটা আমার একটা
আন্দাজও হতে পারে।
গল্পপাঠ ৩. গল্পের বীজটির বিস্তার কিভাবে ঘটল? শুরুতে কি থিম বা
বিষয়বস্তু নিয়ে ভেবেছেন? না, কাহিনীকাঠামো বা প্লট নিয়ে ভেবেছেন?
রেজা ঘটক : 'শিখা অনির্বাণ' গল্পটির কথাই যদি
বলি, এই গল্পের বীজ ঠিক কিভাবে বিস্তার ঘটলো আমি নিজেও বুঝতে পারি না।
প্রথমে মনে হচ্ছিল, লোকটার যে ফাঁসি হবে, কি কারণে হবে, কি তার অপরাধ? তো সেই অপরাধ গুলো
বিশ্লেষন করতে করতে পেলাম যে,
লোকটার ফাঁসি হবার মত তেমন কোনো অপরাধ নেই। তবে লোকটা খুব গোঁয়ার
টাইপের। লোকটা নাস্তিক। তখণই আবিস্তার করলাম, হ্যা, নাস্তিকতার দায়ে লোকটাকে ফাঁসি দেওয়া
হতে পারে। তারপর আবার লোকটার কারা প্রতিপক্ষ সেই ভাবনায় পেয়ে বসলো। সেই
ভাবনার কোনো কিনার পাই না। পরে ঠিক করলাম, হয়তো রাষ্ট্রপক্ষই লোকটাকে ফাঁসি
দিতে চাইছে। তারপর আসলো, লোকটার আর কি কি পরিচয় থাকতে পারে সেই ভাবনা? সেই ভাবনা থেকে
অটোমেটিক পাওয়া গেল যে, লোকটা স্বাধীনতা গানের নতুন সুরকার। এছাড়া আর কি কি পরিচয় আছে
লোকটার? সেই ভাবনায় আর দিশা পাই না। এক সময় আকাশ বাণী'র মত সেই খবর আমার
মাথায় উড়ে এলো যে, লোকটা হাঁটা শেখার আগেই সাঁতার শিখেছিল।
লোকটা খুব পাতলা গড়নের ছিল। আর লোকটা
ভারী একঘুয়েমি টাইপের। এক সময় সেই লোকটার একটা অবয়ব আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
কিন্তু গল্পটি কিভাবে হবে সেই ভাবনায় আর কোনো কাঠামো তখনো পাই না। এভাবে কেটে গেল
নয়টি বছর। না শুরুতে কেবল লোকটার কথাই ভেবেছি।
গল্পের থিম বা বিষয়বস্তু নিয়ে একদম
ভাবিনি। লোকটাকে চেনার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি শুরু থেকে। লোকটা যখন ধীরে ধীরে আমার
কাছে পরিচিত হতে শুরু করলো, তখন থিমটা নিয়ে একটু ভাবা শুরু করলাম। কিন্তু সেই ভাবনাও ছিল
এলোমেলো অগোছালো। তো এর মাঝেই একবার আমি গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি। ঢাকা থেকে নাইট
কোচে। টুঙ্গিপাড়া পৌঁছালাম রাত দুইটা আড়াইটার দিকে। পাটগাতী খেয়া পার হয়ে ওপারে
গিয়ে আবার আমাকে হাঁটতে হবে নতুবা রিক্সা ভ্যানের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। মধুমতী
পার হয়ে ওপারে গেলাম। একটা রিক্সভ্রানও পেলাম। কিন্তু ভ্যানওয়ালা শৈলদহ বাজার
পর্যন্ত যেতে রাজী। এখানেই তার বাড়ি। আমার সঙ্গে আরো দুইজন যাত্রী। সেই ভ্যানে
উঠলাম। একটা পলিথিনে মুড়ি কিনে নিয়ে ভ্যানের সামনের দিকে পা ছড়িয়ে বসলাম। আমরা মোট
চারজন। একজন বয়স্ক হুজুর। একটা দশ বারো বছরের বাচ্চা ছেলে আর ভ্যানওয়ালা। তিনজনের
গন্তব্য শৈলদহ পর্যন্ত। তারপর আমি একা। শৈলদহ যাবার পর আমি হেঁটে রওনা দিলাম।
পশ্চিম আকাশে চাঁদ তখন ডুবতে বসেছে। ঘোরলাগা সময়। একটু সামনে একটা জায়গা আছে
যেখানে দুই জেলার মিলনস্থান। বাগেরহাট ও পিরোজপুর জেলার সঙ্গম স্থান। আরো স্পষ্ট
করে বললে বলতে হয়, দুই থানার সঙ্গম স্থান। চিতলমারী ও নাজিরপুর থানার মিলনস্থল। তো ওখানে বড় রাস্তায় একটা দোকান আছে। সেই দোকানের বাইরে লাইটপোস্টে
একটা বিশাল লাইট। গোটা গ্রাম ঘুমিয়ে। কেবল একলা আমি ওই ত্রিমোহনায় বসে আছি।
লাইটপোস্টের নিচে বসে থাকতেই মাথায় 'শিখা অনির্বাণ' গল্পটির থিমটি
বিদ্যুৎ গতিতে চলে আসলো। ঝোলা থেকে ডায়েরি বের করে আমি গল্পের থিমটি তখনই লিখে
রাখি। পরবর্তী সময়ে ওই রাতের ঘটনা নিয়ে আরেকটি গল্প লিখেছিলাম। 'দ্রাঘিমা'। ওই গল্পটিও আমার
প্রিয় গল্পের একটি।
গল্পপাঠ ৪. গল্পটির চরিত্রগুলো কিভাবে এসেছে? শুরুতে কতটি চরিত্র এসেছিল? তারা কি শেষ
পর্যন্ত থেকেছে? আপনি কি বিশেষ কোনো চরিত্রকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন? তাদের মধ্যে কি
আপনার নিজের চেনা জানা কোনো চরিত্র এসেছে? অথবা নিজে কি কোনো চরিত্রের মধ্যে
চলে এসেছেন?
রেজা ঘটক : এই গল্পে ফাঁসি হওয়া লোকটির চরিত্রই প্রথম এসেছে। লোকটার কোনো নাম
দেওয়া হয়নি। গল্পে কোনো সুনির্দিষ্ট জায়গার নামও বলা হয়নি। কোনো সুনির্দিষ্টি নগর
বা গ্রামের কথা বলা হয় নি। হতে পারে ওটা পৃথিবীর আদি বা শেষ কোনো নগর। হতে পারে
ওটা পৃথিবীর শেষ কোনো গ্রাম। যেখানে সেই দেশের স্বাধীনতা চত্বর অবস্থিত। আবার এরকম
কোনো নগর বা গ্রাম পৃথিবীতে ঠিক নাও থাকতে পারে। এটা আমার কল্পনাপ্রসূত। শুরুতে একটি চরিত্রই এসেছে। দীর্ঘদিন সেই একটি চরিত্রই আমার সঙ্গে
দূর থেকে ভাব বিনিময় করেছে। আমার সঙ্গে বোঝাপড়া করেছে। আমাকে সুইসাইড করতে
উদ্ভূদ্ধ করেছে। কিন্তু আমি গল্পটি না লিখে তো আর সুইসাইড করতে পারি না! পরবর্তী সময়ে আরো অনেক চরিত্র গল্পে এসেছে। কারো চরিত্রই সুস্পষ্ট
নয়। তবে অনুমান করা যায়, সেই চরিত্রগুলো কি কি করেছে, কিভাবে কিভাবে করেছে, কখন কখন করেছে, কেন করেছে ইত্যাদি
ইত্যাদি। সেই চরিত্রগুলো দল বেঁধে এসেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে এসেছে। গুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে
এসেছে। নানান দাবী নিয়ে এসেছে। নানান যুক্তি নিয়ে এসেছে। সেই চরিত্রগুলোও এই গল্পে
নামহীন। আসলে গোটা গল্পেই সব চরিত্রগুলো নামহীন, কালহীন। কিন্তু গল্পের খাতিরে খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই
তারা গল্পে এসেছে বলেই আমার মনে হয়। এই চরিত্রগুলো হয়তো আমার চেনা। হয়তো
আমার খুব পরিচিত তারা সবাই। কিন্তু কারো সাথেই আমার সখ্যতা নেই। বন্ধুত্ব নেই।
কিন্তু তাদের জন্য আমার মায়া আছে। তাদের জন্য আমার উৎকণ্ঠা আছে। তাদের জন্য আমার
নির্ঘুম রাত আছে। তাদের জন্য আমার মনের মধ্যে সপ্তনদীর উজানের মত টান আছে। হয়তো
তাদের সঙ্গে আমার জীবনের ভাগাভাগি। হয়তো তাদের সঙ্গে আমার কল্পনার উঠোনবাড়িতে
ঘোরাঘুরি। হয়তো তাদের সঙ্গে আমার হাজার বছরের বন্ধুত্ব ছিল, আগামী হাজার বছর
পরেও সেই সখ্যতা রয়ে যাবে। ব্যাপারটা ঠিক কথায় বোঝানো যাবে না। হয়তো দূর আকাশের
উড়ে যাওয়া মেঘের গায়ে সেই সখ্যতার বার্তা কেউ লিখে রাখছে। হয়তো ভূবনডাঙ্গার কোনো
ভাঙা সেতুর ওপারে দাঁড়িয়ে কেউ তাদের জন্য আমার মত অপেক্ষা করছে। অথবা তারা সবাই
আমার চারপাশে ভারী লুটোপুটি খাচ্ছে। খিস্তিখেউর করছে। হয়তো তাদের সবাইকে আমি খুব
চিনি। অথবা কাউকে একদম চিনিই না। গল্পে আমি কখনো কোনো চরিত্রের মধ্যে
চলে আসি কিনা সেটা বলা খুব মুশকিল। হয়তো যে লোকাটার ফাঁসি হয়েছে, সে আমাকে কিছু
বলতে চেয়েছিল। সেই কথাটি শোনার জন্য হয়তো আমি সেই মধ্যরাতের গগণবিদারী জাগরণের
মধ্যে লোকটার ফাঁসির সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। হয়তো লোকটাকে ফাঁসি দেবার জন্য
আমিই লাল রুমাল ছুড়ে ছিলাম। হয়তো আমিই সেই ফাঁসি'র জল্লাদ ছিলাম। হয়তো আমি সেখানে
স্রেফ একজন মাতাল দর্শক হিসেবেই উপস্থিত ছিলাম। নতুবা এতো বড় ঘটনা যে আমার চোখের
সামনে ঘটলো, সেটা তো আমি দিব্যি দেখেছিলাম। নতুবা আমার কল্পনায় সেরকম একটি
অনুরণন ঘটেছিল। অথবা ঠিক ওরকম একটি ফাঁসির মঞ্চের আশেপাশে আমি হয়তো বেড়ে উঠেছি।
কোনটা যে ঠিক বলা আসলে মুশকিল!
গল্পপাঠ ৫. এই গল্পগুলোর দ্বন্দ্ব-সংঘাত কিভাবে নির্মাণ করেছেন?
রেজা ঘটক : যে গল্পটির কথা
বলছি, মানে 'শিখা অনির্বাণ'
গল্পের দ্বন্দ্ব-সংঘাত কিভাবে নির্মিত হল, কিভাবে তা চিত্রিত
হল, কিংম্বা আদৌ সেখানে কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত আছে কিনা, কিংম্বা আদৌ এটা
কোনো গল্পের ক্যানভাস হয়েছে কিনা,
আমি আজও জানি না। তবে আমার গল্পটি যেভাবে আমি নির্মাণ করেছি, এটাই আমি করতে
চেয়েছিলাম। সেখানে দ্বন্দ্ব-সংঘাত যতোটুকু অনিবার্য প্রয়োজনবোধ করেছি, হয়তো ততোটাই আমি
বর্ণনা করেছি। যতোটা অপ্রয়োজনীয় মনে করেছি, ততোটা হয়তো ইচ্ছে করেই দেইনি।
গল্পপাঠ ৬. গল্পের পরিণতিটা নিয়ে কি আগেই ভেবে রেখেছিলেন?
রেজা ঘটক : না, আমি গল্পের পরিনতি
লেখা শেষ হবার আগেও জানতাম না। নয় বছর গল্পটি আমার মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে। অনেকবার
এটা লিখতে গিয়েও মাঝপথে থেমে গেছি। ২০০৯ সালের ২৭ শে জানুয়ারি আমার মা মারা গেল।
আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। কাউকে বোঝাতে পারছিলাম না। ৩০শে জানুয়ারি আমি ঢাকা ফেরত
আসলাম। মনের মধ্যে উচাটন ঢেউ। কেউ বাহির থেকে সেই ঢেউয়ের নাগাল পায় না। কেউ সেই
কষ্টের ক্ষরণ টের পায় না। আমি সেই ক্ষরণ দূর করতেই কাগজ কলম টেনে নিয়ে বসি। সেই
বসাতেই 'শিখা অনির্বাণ'
গল্পটি লিখে ফেলি। গল্পটি যখন আমার 'সোনার কংকাল' বইয়ের জন্য
সিলেক্ট করি, তখন আবার একটু রিরাইট করেছিলাম। এমনিতে আমি অনেক রিরাইট করি। অনেক
কিছু কাটছাট করি। অনেক কিছু নতুন করে যুক্ত করি। ঠিক তখন এই গল্পের পরিনতিটা
লিখেছিলাম। আর তখনই মনে হয়েছিল,
এটাই এই গল্পের পরিনতি।
গল্পপাঠ ৭. গল্পটি কদিন ধরে লিখেছেন? এক এর ভাষা ভঙ্গিতে কি ধরনের শৈলী
ব্যবহার করেছেন?
রেজা ঘটক : আগেই বলেছি, গল্পটি প্রায় নয় বছর আমার মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে। এক রাতে নির্ঘুম
গ্রামের রাস্তার লাইটপোস্টের নিচে এই গল্পের থিম লিখেছিলাম। আর আমার মায়ের মৃত্যুর
পর আরেক রাতে এটি একটানা লিখেছিলাম। আর পরিনতি'র শেষ কয়েক লাইন কয়েক দিন পরে
লিখেছিলাম। সেই হিসেবে এটি তিন বসায় লেখা। কিন্তু এই গল্পের বাস্তবরূপে আসতে সময়
লেগেছে প্রায় নয় বছর।
৮. গল্পটিতে কি কিছু বলতে চেয়েছিলেন? সুস্পষ্ট করে বললে বলতে হয় না কিছুই
বলতে চাই নি। আর ঝাপসা করে বললে বলতে চাই যে, আমার সুইসাইডাল নোট লেখার
প্রক্ষাপটেই এই গল্পটির আগমন। কিন্তু যেহেতু আমি এখনো সুইসাইড করিনি। তাই সত্যি
করে কিছু বলতে চেয়েছি কিনা এখনো আমার কাছেও বিষয়টি অস্পষ্ট। নতুবা লোকটি হয়তো
নিজেই স্বেচ্ছায় ফাঁসি নিয়ে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল। হা হা হা...
গল্পপাঠ ৯. গল্পটি লেখার পরে কি আপনি সন্তুষ্ট হয়েছেন? আপনি কি মনে
করেন--আপনি যা লিখতে চেয়েছিলেন,
তা লিখতে পেরেছেন এই গল্পটিতে?
রেজা ঘটক : হ্যা, এই গল্পটি লেখার পর আমার শরীর থেকে
প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও ঘাম ঝরেছিল। শরীর খুব হালকাবোধ করেছিলাম। গল্পটি লেখা শেষ
করে আমি ঠাণ্ডা জলে স্নান করেছিলাম। মাস্টারবেশন করেছিলাম। স্নান শেষে শীতের জামা
পড়ে সিগারেট ধরিয়ে গল্পটি যখন আবার পড়ছিলাম, তখন সত্যিই আমি খুব স্বস্থি
পেয়েছিলাম। আমি যা লিখতে চেয়েছিলাম, এই গল্পে হয়তো ওই লোকটি আমাকে দিয়ে
তাই লেখিয়ে নিয়েছে। নতুবা ওই লোকটি'র এভাবে ফাঁসি হল, আর কেউ সেই খবর
নিয়ে কেন উতলা হল না, সেটি রটিয়ে দেবার জন্য হয়তো লোকটি আমাকে তার মুখপাত্র বানিয়েছিল।
নতুবা আমি কেন লিখতে গেলাম? অথবা এমনও হতে পারে যে, বদমায়েশ লোকটা আমাকে স্রেফ পাগল
ঠাওরে এভাবে বিনা পয়সায় কিছু সময় ঘুরিয়েছে। আর আমি তার পরিনতি'র খুটিনাটি কেবল
নোট আকারে লিখে গেছি। অথবা এটা স্রেফ একটা নস্টালজিয়া, সেই ঘোরের মধ্যে
আমি কি লিখেছি, বা কতোটা লিখতে পেরেছি, তা নিজেও জানি না।
গল্পপাঠ ১০. এই গল্পটি পাঠক কেনো পছন্দ করে বলে আপনার মনে হয়?
রেজা ঘটক : এটা তো আমি জানি
না। 'শিখা অনির্বাণ'
গল্পটি আদৌ কোনো পাঠকের পছন্দ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। এটি আদৌ
গল্প হয়েছে কিনা তাও আমি জানি না। আর এই গল্প কোনো পাঠক কেন পছন্দ করবে, সেই যুক্তিও আমার
জানা নেই। যদি কোনো পাঠক এটি পছন্দ করেন, তাহলে সেই মহান পাঠকই সেই
সুনির্দিষ্ট যুক্তিগুলো বলতে পারবেন। আমার পক্ষে এটা বলা মুশকিল। সত্যি এই
প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। ধন্যবাদ।
লেখক পরিচিতি
রেজা ঘটক
কবি। গল্পকার।
ঔপন্যাসিক। প্রবন্ধকার।
লেখক পরিচিতি
রেজা ঘটক
কবি। গল্পকার।
ঔপন্যাসিক। প্রবন্ধকার।
0 মন্তব্যসমূহ