কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
তিনি, সৈয়দ শামসুল হক, হয়ত গল্পনিমগ্ন মানুষই। আমরা এইটুকু বুঝতে পারি, তার ব্যক্তিক পক্ষপাত হয়ত কাব্যসাধনার দিকেই বেশি। কিন্তু তিনি তো গল্পসাধনারও মানুষ। এমনকি গল্পে আছে প্রচুর দেখার বোঝার জানার বিষয়, আছে ভাংচুর। এই সময় গল্প মরাবাচার নিয়ে কথা হয়; তখনকার সময়টা ছিল গল্পেরই। শীতবিকেল লিখলেন ১৯৫৯ সালে; তার সাথে আমরা যদি তার ইদানীংকার গল্প উদ্বেগ বা যদি গাবতলিতে দেখা হতো পাঠ করি, তাতে বার মেজাজ বা বলার ভঙ্গির পরিবর্তনটা আমরা দেখে যাই, কিন্তু মানুষকে যাচাই করার বা তাকে মানবিক জায়গা থেকে দেখার বিষয়টার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। তিনি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গল্প লিখেছেন সেসবকে আমরা হয়ত কালোত্তীর্ণ বলতে পছন্দই করব। এমনই কিছু গল্প হচ্ছে, নেপেন দারোগার দায়ভার, রক্ত গোলাপ, প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান, আনন্দের মৃত্যু, সম্রাট, জমিরুদ্দিনের মৃত্যুবিবরণ ইত্যাদি। আমরা তাকে গল্পকার হিসাবে নানাভাবে পরখও করতে চাই।
আমরা যখন তার গল্প নিয়ে কথা বলি, গল্পের সাথে তার সখিতা দেখি, তখনই ব্যক্তি সৈয়দ শামসুল হক একেবারে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান। আমরা তাকে দাঁড়াতে দিই,-- কারণ তার ব্যক্তিত্বই গল্পময়। সেখানে যেন তিনি গল্পের হুলস্থূলে মত্ত হন। তিনি গল্পকে হয়ত কামনা করেন অথবা করেন না। কিন্তু আমরা তাকে গল্পের অপরিহার্য ব্যক্তিত্বই মনে করি। কারণ তার সৃজিত হিস্টরির ভিতর দিয়ে আমরা গল্পের জগৎটাকেও দেখে নিতে পারি।
আমরা স্মরণ করি সেই ৫০ দশকের কথা বা তারও পরের ৬০ দশকের কথা। আমরা তা স্মরণ করতে বাধ্য হই। কারণ আমরা গল্পের ভিতর-বাহির চিহ্নিত করতে চাই। গল্পের এই ধারাবাহিক হিস্টরি থেকে আলাদা হয়ে আমাদের তা করতে পারি না। যদিও এটা ঠিক যে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শওকত ওসমান, শাহেদ আলী, আবু রুশদ, এমনকি শওকত আলীর গল্পপাঠে আমরা পূর্ববাংলার বাঙাল, জল-কাদা, নদী, পাহাড়, সংস্কৃতি এমনকি ধর্মীয় প্রবণতাকে চিনে নিতে পারি। তখনকার সমযটাই ছিল গল্পের সময়। এর প্রত্যেকেই গল্পকে আরাধ্য করেছেন। এর ভিতর দিয়ে জীবনকে চিনিয়ে দিতে চেয়েছেন। এটা ছিল সময়ের মৌলিকতা। অথবা বলা যেতে পারে, পূর্ববঙ্গের জল-হাওয়া যেন গল্পের জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। আমরা প্রসঙ্গতই এখানে রবিঠাকুরকেও স্মরণ করতে চাই। তিনি প্রচুর গল্প লিখেছেন,-- এবং তার অনেক গল্পই পূর্ববঙ্গের মায়া-কায়া দ্বারা নির্মিত। এখানে আরও একটা ব্যাপার বলতে চাই, তিনি এই বঙ্গের জীবন নিয়ে, বা তাতে নিমগ্ন হয়ে কোনো উপন্যাস লিখেছেন বলে মনে পড়ে না। অথচ তিনি কত গল্প যে আমাদের এই বাঙাল-জীবনের মায়া নিয়ে লিখেছেন! তার মানে আমরা হয়ত ধরতে পারি যে আমাদের এই লোকময় জীবন গল্পকে নেমন্তন্ন করে, উচ্ছ্বাস ছড়ায়, জীবনের প্রতিটা ক্ষণ রাঙিয়ে দেয়। অনেকেই মনে করেন, এমনকি সৈয়দ হকও এমন মতামত জানান যে, এখানকার সময়ে অনেকেই বড়ো গল্পকে টেনে উপন্যাস করছেন; উপন্যাসিকার মতো নতুন ভড়ংও যুক্ত হয়েছে। কিন্তু গল্প কেউ লিখতে চান না। গল্পের গ্রন্থ প্রকাশ করা যায় না। সাময়িকী আর ছোটকাগজওয়ালার গল্পের এক জগতের ভিতর আছেন। এরাই বরং গল্পবে নবতর উদ্যোমে প্রাণ দিচ্ছেন। এমনই কতিপয় মতামত আমাদের জানাচ্ছেন সৈয়দ হক। এ নিয়ে তিনি ছোটগল্প : কথা কতিপয় নামের নিবন্ধও লিখেছেন। আমরা তার সৃজিত কথা সামান্যই গ্রন্থটির কথা স্মরণ করতে পারি। তাতেও শব্দের শরীর ধরে ধরে যেন প্রতিবেদনধর্মী এক-এক গল্পই লেখা হয়েছে!
তিনি তার মুক্তচৈতন্যের নেশায় কিছূ কলাম লিখেছেন, এসবে গল্প আছে। জীবনের চমৎকার সব অনুসঙ্গ আছে। হৃদকলমের টানে এমনই এক আয়োজন। তাতে সমাজ আছে, আছে মানুষ সম্পর্কে, তার প্রতিবেশ সম্পর্কে অতি দরকারি অনুসঙ্গ আছে। এ তার অনুভবের গল্প,-- একেবারে ছড়িয়ে ছিটিযে থাকা জীবনগল্প। বাঙলার মুখও এমনই কিছু বিষয়ে এক-একটা প্রতিবেদনধর্মী গল্পই। এখানে তার পর্যবেক্ষণ আর তার ছবি যেন একসাথে প্রকাশ পেয়েছি। অনেক বড়ো জায়গায় প্রণীত জীবন নামের জীবনমুখর এক সত্যকথন সাজিয়েছেন। গল্পের ভিতরকার গল্প আছে এখানে।
তবে আমরা তার কতিপয় কথার ভিতর থাকতে পারি না। আমরা থাকতে পারি না মানে তিনিই আমাদের সেইভাবে থাকতে দেন না। গল্প তিনি লিখছেন, গল্পময় জীবন পার করছেন, তার ব্যক্তিত্বে গল্পের চরম ধাঁধা যুক্ত হয়ে আছে। আমরা তার সেই ধাঁধার পিছনে, রংদার জীবনের আনাচে কানাচে গল্প খুঁজি। গল্পের ভিতর দিয়ে আমরা একটা জগৎই বানিয়ে ফেলি। আমরা এই ক্ষেত্রে তার গল্পের জগৎকেই কেবল মনে করব না, মার্জিনে মন্তব্য/ গল্পের কলকব্জা নামের চমৎকার একটা গ্রন্থের কথা বলব। তিনি কথায কথায় যে গল্পের নানান অনুসঙ্গ জানান, তারই সারাৎসার হিসাবে এ গ্রন্থটি লিখে ফেলেন। আমরা কবিতা, ছন্দ, নাটক, এমনকি উপন্যাসের উপরও অনেক গ্রন্থ পাই, অনেক ধরনের জ্ঞানের কথা শুনি। সেই জ্ঞানের ভারে জ্ঞান বিতরণে হয়ত প্রবৃত্ত হই। কিন্তু গল্পের উপর তেমন গ্রন্থ নেই। তেমন কোনো গ্রন্থ যে রচিত হতে পারে, তাই আমরা হয়ত স্মরণ করতে চাই না। ছোটগল্পের উপরও যে লেখাজোখা বা বই একদম নেই, তা আমরা বলতে চাই না, কিন্তু গল্পের প্রাণভোমরায় ঢুকে, একেবারে ভিতরের খবর দিয়ে গল্প করার বিষয়টা নেই। প্রাতিষ্ঠানিক কিছু কাজ আছে, কিন্তু গল্পের ভিতর গল্পের আলাপ নেই। তাই এ গ্রন্থের সাথে আমাদের প্রেম করি, আমরা তার সাথে আলাপ করি, কথা বলি। সেই কথা দশজনকে জানানোর বাসনা করি।
তিনি আসলে গল্পসাধনাই করেননি, জীবনের একটা জার্নি এই খাতে রেখেছেন; নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। গল্পের গল্প বলতে গেলে আমরা তার প্রবন্ধগ্রন্থ মাজিনে মন্তব্য/ গল্পের কলকব্জা পাঠ করতে পারি। তিনি কেন এবং কিভাবে তা লেখা শুরু করলেন, আড্ডাকে, সাহিত্য-তাগিদকে, সর্বোপরি যোগাযোগের রূপকে প্রাণবন্ত করতে চাইলেন, তার একটা বর্ণনা তিনি গ্রন্থটির শুরুতেই দিয়েছেন। গ্রন্থটি মূলত মার্জিনে মন্তব্য আর গল্পের কলকব্জা নামের উপশিরোানামে বিভক্ত। গল্প নিয়ে তার যত কথাবার্তা আছে, একে সাক্ষীসমেত পেশ করার জন্যই যেন কয়েকটি গল্পও তাতে জুড়ে দিয়েছেন। এসব হচ্ছে রবিঠাকুরের নিশিথে, পোস্টমাস্টার, প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনোপোতা আবিস্কার, জগদীশ গুপ্তের দিবসের শেষে, মানিকের ভয়ঙ্কর।
প্রবন্ধের শুরুতেই শিল্পী ও মিস্তিরি নামে নিবন্ধে তিনি শিল্পীকে মিস্তিরির সাথে তুলনীয় মনে করছেন। তিনি কিন্তু মিস্ত্রি না বলে মিস্তিরির মতো বৈঠকি শব্দকেই প্রেপার করছেন। তার এই মনোবাসনার বিষয়টা তার কথাশিল্পে আমরা বরাবরই লক্ষ করি। তিনি এ কাজে তুখোড় শিল্পমুখরতার কাছে না গিয়ে আমাদের আশপাশের অতি পরিচিতি একজন মিস্তিরির সাথে তুলনা করলেন। শিল্প আসলে মেধার কাজ, প্রতিভার কাজ, গ্রহণের কাজ-- সেই কাজটি একজন সংসারি মানুষও করেন। কাজের সাথে, শিল্পের নিপুণতার একটা সম্পর্ক থাকে, ঘষামাজার বিষয় থাকে। কারণ সৃষ্টিশীলতা কোনো ওহী নাজেলের মধ্য দিয়ে হয় না। যিনি শিল্পী তিনি তা ঠিক করেন তার শিল্পযজ্ঞটি কার্যত কেমন হবে; বা তিনি তা কেমন করার ক্ষমতা আর বাসনা রাখেন, তাই প্রকাশ করেন। সেই লেখা যে তরতর করে হতে পারে বা একেবারে ঘষে ঘষে কঠিনভাবে হতে পারে, তাই তিনি জানাচ্ছেন। তাই কারও লেখা আপসেআপ হতে পারে, হতে পারে একটু একটু করে, তা তখন যেন একেবারে খোঁড়াখুড়ির মতো ব্যাপার হয়। আমরা ক্রমে ক্রমে জানতে পারি, সৈয়দ হক তার লেখাটির একেবারে দাড়ি-কম-সেমিকোলন ঠিকঠাক করে লেখতে থাকেন। সেই কাজটি নানাভাবে হয়, লেখকদের নিয়ে নানাধরনের গুজবও আছে। তিনি এ গ্রন্থে তাও বলেওছেন। তাহলে সেই লেখাটি শেখার দরকার আছে?
তিনি, সৈয়দ শামসুল হক, হয়ত গল্পনিমগ্ন মানুষই। আমরা এইটুকু বুঝতে পারি, তার ব্যক্তিক পক্ষপাত হয়ত কাব্যসাধনার দিকেই বেশি। কিন্তু তিনি তো গল্পসাধনারও মানুষ। এমনকি গল্পে আছে প্রচুর দেখার বোঝার জানার বিষয়, আছে ভাংচুর। এই সময় গল্প মরাবাচার নিয়ে কথা হয়; তখনকার সময়টা ছিল গল্পেরই। শীতবিকেল লিখলেন ১৯৫৯ সালে; তার সাথে আমরা যদি তার ইদানীংকার গল্প উদ্বেগ বা যদি গাবতলিতে দেখা হতো পাঠ করি, তাতে বার মেজাজ বা বলার ভঙ্গির পরিবর্তনটা আমরা দেখে যাই, কিন্তু মানুষকে যাচাই করার বা তাকে মানবিক জায়গা থেকে দেখার বিষয়টার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। তিনি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গল্প লিখেছেন সেসবকে আমরা হয়ত কালোত্তীর্ণ বলতে পছন্দই করব। এমনই কিছু গল্প হচ্ছে, নেপেন দারোগার দায়ভার, রক্ত গোলাপ, প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান, আনন্দের মৃত্যু, সম্রাট, জমিরুদ্দিনের মৃত্যুবিবরণ ইত্যাদি। আমরা তাকে গল্পকার হিসাবে নানাভাবে পরখও করতে চাই।
আমরা যখন তার গল্প নিয়ে কথা বলি, গল্পের সাথে তার সখিতা দেখি, তখনই ব্যক্তি সৈয়দ শামসুল হক একেবারে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান। আমরা তাকে দাঁড়াতে দিই,-- কারণ তার ব্যক্তিত্বই গল্পময়। সেখানে যেন তিনি গল্পের হুলস্থূলে মত্ত হন। তিনি গল্পকে হয়ত কামনা করেন অথবা করেন না। কিন্তু আমরা তাকে গল্পের অপরিহার্য ব্যক্তিত্বই মনে করি। কারণ তার সৃজিত হিস্টরির ভিতর দিয়ে আমরা গল্পের জগৎটাকেও দেখে নিতে পারি।
আমরা স্মরণ করি সেই ৫০ দশকের কথা বা তারও পরের ৬০ দশকের কথা। আমরা তা স্মরণ করতে বাধ্য হই। কারণ আমরা গল্পের ভিতর-বাহির চিহ্নিত করতে চাই। গল্পের এই ধারাবাহিক হিস্টরি থেকে আলাদা হয়ে আমাদের তা করতে পারি না। যদিও এটা ঠিক যে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শওকত ওসমান, শাহেদ আলী, আবু রুশদ, এমনকি শওকত আলীর গল্পপাঠে আমরা পূর্ববাংলার বাঙাল, জল-কাদা, নদী, পাহাড়, সংস্কৃতি এমনকি ধর্মীয় প্রবণতাকে চিনে নিতে পারি। তখনকার সমযটাই ছিল গল্পের সময়। এর প্রত্যেকেই গল্পকে আরাধ্য করেছেন। এর ভিতর দিয়ে জীবনকে চিনিয়ে দিতে চেয়েছেন। এটা ছিল সময়ের মৌলিকতা। অথবা বলা যেতে পারে, পূর্ববঙ্গের জল-হাওয়া যেন গল্পের জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। আমরা প্রসঙ্গতই এখানে রবিঠাকুরকেও স্মরণ করতে চাই। তিনি প্রচুর গল্প লিখেছেন,-- এবং তার অনেক গল্পই পূর্ববঙ্গের মায়া-কায়া দ্বারা নির্মিত। এখানে আরও একটা ব্যাপার বলতে চাই, তিনি এই বঙ্গের জীবন নিয়ে, বা তাতে নিমগ্ন হয়ে কোনো উপন্যাস লিখেছেন বলে মনে পড়ে না। অথচ তিনি কত গল্প যে আমাদের এই বাঙাল-জীবনের মায়া নিয়ে লিখেছেন! তার মানে আমরা হয়ত ধরতে পারি যে আমাদের এই লোকময় জীবন গল্পকে নেমন্তন্ন করে, উচ্ছ্বাস ছড়ায়, জীবনের প্রতিটা ক্ষণ রাঙিয়ে দেয়। অনেকেই মনে করেন, এমনকি সৈয়দ হকও এমন মতামত জানান যে, এখানকার সময়ে অনেকেই বড়ো গল্পকে টেনে উপন্যাস করছেন; উপন্যাসিকার মতো নতুন ভড়ংও যুক্ত হয়েছে। কিন্তু গল্প কেউ লিখতে চান না। গল্পের গ্রন্থ প্রকাশ করা যায় না। সাময়িকী আর ছোটকাগজওয়ালার গল্পের এক জগতের ভিতর আছেন। এরাই বরং গল্পবে নবতর উদ্যোমে প্রাণ দিচ্ছেন। এমনই কতিপয় মতামত আমাদের জানাচ্ছেন সৈয়দ হক। এ নিয়ে তিনি ছোটগল্প : কথা কতিপয় নামের নিবন্ধও লিখেছেন। আমরা তার সৃজিত কথা সামান্যই গ্রন্থটির কথা স্মরণ করতে পারি। তাতেও শব্দের শরীর ধরে ধরে যেন প্রতিবেদনধর্মী এক-এক গল্পই লেখা হয়েছে!
তিনি তার মুক্তচৈতন্যের নেশায় কিছূ কলাম লিখেছেন, এসবে গল্প আছে। জীবনের চমৎকার সব অনুসঙ্গ আছে। হৃদকলমের টানে এমনই এক আয়োজন। তাতে সমাজ আছে, আছে মানুষ সম্পর্কে, তার প্রতিবেশ সম্পর্কে অতি দরকারি অনুসঙ্গ আছে। এ তার অনুভবের গল্প,-- একেবারে ছড়িয়ে ছিটিযে থাকা জীবনগল্প। বাঙলার মুখও এমনই কিছু বিষয়ে এক-একটা প্রতিবেদনধর্মী গল্পই। এখানে তার পর্যবেক্ষণ আর তার ছবি যেন একসাথে প্রকাশ পেয়েছি। অনেক বড়ো জায়গায় প্রণীত জীবন নামের জীবনমুখর এক সত্যকথন সাজিয়েছেন। গল্পের ভিতরকার গল্প আছে এখানে।
তবে আমরা তার কতিপয় কথার ভিতর থাকতে পারি না। আমরা থাকতে পারি না মানে তিনিই আমাদের সেইভাবে থাকতে দেন না। গল্প তিনি লিখছেন, গল্পময় জীবন পার করছেন, তার ব্যক্তিত্বে গল্পের চরম ধাঁধা যুক্ত হয়ে আছে। আমরা তার সেই ধাঁধার পিছনে, রংদার জীবনের আনাচে কানাচে গল্প খুঁজি। গল্পের ভিতর দিয়ে আমরা একটা জগৎই বানিয়ে ফেলি। আমরা এই ক্ষেত্রে তার গল্পের জগৎকেই কেবল মনে করব না, মার্জিনে মন্তব্য/ গল্পের কলকব্জা নামের চমৎকার একটা গ্রন্থের কথা বলব। তিনি কথায কথায় যে গল্পের নানান অনুসঙ্গ জানান, তারই সারাৎসার হিসাবে এ গ্রন্থটি লিখে ফেলেন। আমরা কবিতা, ছন্দ, নাটক, এমনকি উপন্যাসের উপরও অনেক গ্রন্থ পাই, অনেক ধরনের জ্ঞানের কথা শুনি। সেই জ্ঞানের ভারে জ্ঞান বিতরণে হয়ত প্রবৃত্ত হই। কিন্তু গল্পের উপর তেমন গ্রন্থ নেই। তেমন কোনো গ্রন্থ যে রচিত হতে পারে, তাই আমরা হয়ত স্মরণ করতে চাই না। ছোটগল্পের উপরও যে লেখাজোখা বা বই একদম নেই, তা আমরা বলতে চাই না, কিন্তু গল্পের প্রাণভোমরায় ঢুকে, একেবারে ভিতরের খবর দিয়ে গল্প করার বিষয়টা নেই। প্রাতিষ্ঠানিক কিছু কাজ আছে, কিন্তু গল্পের ভিতর গল্পের আলাপ নেই। তাই এ গ্রন্থের সাথে আমাদের প্রেম করি, আমরা তার সাথে আলাপ করি, কথা বলি। সেই কথা দশজনকে জানানোর বাসনা করি।
তিনি আসলে গল্পসাধনাই করেননি, জীবনের একটা জার্নি এই খাতে রেখেছেন; নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। গল্পের গল্প বলতে গেলে আমরা তার প্রবন্ধগ্রন্থ মাজিনে মন্তব্য/ গল্পের কলকব্জা পাঠ করতে পারি। তিনি কেন এবং কিভাবে তা লেখা শুরু করলেন, আড্ডাকে, সাহিত্য-তাগিদকে, সর্বোপরি যোগাযোগের রূপকে প্রাণবন্ত করতে চাইলেন, তার একটা বর্ণনা তিনি গ্রন্থটির শুরুতেই দিয়েছেন। গ্রন্থটি মূলত মার্জিনে মন্তব্য আর গল্পের কলকব্জা নামের উপশিরোানামে বিভক্ত। গল্প নিয়ে তার যত কথাবার্তা আছে, একে সাক্ষীসমেত পেশ করার জন্যই যেন কয়েকটি গল্পও তাতে জুড়ে দিয়েছেন। এসব হচ্ছে রবিঠাকুরের নিশিথে, পোস্টমাস্টার, প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনোপোতা আবিস্কার, জগদীশ গুপ্তের দিবসের শেষে, মানিকের ভয়ঙ্কর।
প্রবন্ধের শুরুতেই শিল্পী ও মিস্তিরি নামে নিবন্ধে তিনি শিল্পীকে মিস্তিরির সাথে তুলনীয় মনে করছেন। তিনি কিন্তু মিস্ত্রি না বলে মিস্তিরির মতো বৈঠকি শব্দকেই প্রেপার করছেন। তার এই মনোবাসনার বিষয়টা তার কথাশিল্পে আমরা বরাবরই লক্ষ করি। তিনি এ কাজে তুখোড় শিল্পমুখরতার কাছে না গিয়ে আমাদের আশপাশের অতি পরিচিতি একজন মিস্তিরির সাথে তুলনা করলেন। শিল্প আসলে মেধার কাজ, প্রতিভার কাজ, গ্রহণের কাজ-- সেই কাজটি একজন সংসারি মানুষও করেন। কাজের সাথে, শিল্পের নিপুণতার একটা সম্পর্ক থাকে, ঘষামাজার বিষয় থাকে। কারণ সৃষ্টিশীলতা কোনো ওহী নাজেলের মধ্য দিয়ে হয় না। যিনি শিল্পী তিনি তা ঠিক করেন তার শিল্পযজ্ঞটি কার্যত কেমন হবে; বা তিনি তা কেমন করার ক্ষমতা আর বাসনা রাখেন, তাই প্রকাশ করেন। সেই লেখা যে তরতর করে হতে পারে বা একেবারে ঘষে ঘষে কঠিনভাবে হতে পারে, তাই তিনি জানাচ্ছেন। তাই কারও লেখা আপসেআপ হতে পারে, হতে পারে একটু একটু করে, তা তখন যেন একেবারে খোঁড়াখুড়ির মতো ব্যাপার হয়। আমরা ক্রমে ক্রমে জানতে পারি, সৈয়দ হক তার লেখাটির একেবারে দাড়ি-কম-সেমিকোলন ঠিকঠাক করে লেখতে থাকেন। সেই কাজটি নানাভাবে হয়, লেখকদের নিয়ে নানাধরনের গুজবও আছে। তিনি এ গ্রন্থে তাও বলেওছেন। তাহলে সেই লেখাটি শেখার দরকার আছে?
অনেকেই মনে করেন গল্প / উপন্যাস চাইলেই লেখা যায়। একে অনেকেই কাহিনীর মতো কিছু জ্ঞান করেন। কারণ তাতে তো ছন্দ, তাল, লয় ঠিক করে লিখতে হয় না। তবে তাদের এটা মাথায় থাকে না যে গদ্যেরও ছন্দ থাকে। সেই ছন্দ লেখকের নিজস্ব কৌশলের ব্যাপার। কাজেই কেউ চাইলেই তরতর করে যা ইচ্ছা লিখলেই তা কথাশিল্প হয়ে যায় না। সেই জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। সৈয়দ হক তাই প্রতিদিনের ভাষা আর প্রতিদিনকার ভাষার ভিতর বড়োসড়ো একটা ভেদরেখা টেনেছেন। ভাষাকে শান দেয়ার মতো করেই তার বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। অনুভবের উপর জোর দিচ্ছেন তিনি; অভিব্যক্তি প্রকাশের কথাও বলেছেন। শুধু নিরাকার ভাব থাকলেই তো লেখা হবে না, তা প্রকাশের যথাযথ ভাষাও থাকতে হয়। ভাব আর ভাষার ভিতর খাতির-প্রণয় ঠিকমতো ঘটাতে না পারলে সৃষ্টিশীলতা হয় না। লেখাও তো একধরনের ঈশ্বরত্বই। তাকে ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে সৃজন করতে হয়।
আমরা যে সাহিত্যিক গদ্য নির্মাণ করি, তা প্রথমত আমরা শুনি, কানে বাজিয়ে নিই, হৃদয়ের ভিতর দিয়ে তা কান পর্যন্ত যায়; তা অনুরণিত হয়, তার বাদে লেখা হয়। তাতে একটা ভঙ্গিমা দাঁড়ায়, প্রকাশের একটা ধরন প্রকাশ পায়। আমরা তাতে মগ্ন-নিমগ্ন হই। তাই তিনি তার মতো করে প্রকাশ করেছেন। গল্পের বিষয়কে অপরিহার্য বিষয় করে তোলার তাড়না বোধ করেছেন। তার পাঠককে সেইদিকে নিয়ে যাচ্ছেন। লেখক থেকে লেখার একটা দূরত্ব বা ঘষাঘষি হয়। তার লেখা কিভাবে এগুবে, তাই সেই ব্যক্তি ঠিক করেন। ক্রিয়াপদের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমরা তার কথা শুনবো। তিনি যথাথই বলেছেন, আমরা কথনশিল্পে সাধারণত নিত্যবৃত্ত অতীতের ব্যবহার দেখি। কিন্তু তিনি উদাহরণসহ দেখাচ্ছেন, একজন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ কত সার্থকভাবে সাধারণ বর্তমান ব্যবহার করেছেন। সেই কাজটি এ লেখকও তার কথাশিল্পে করে দেখিয়েছেন। এতে কথাশিল্পের যথার্থ শক্তিমত্তারও প্রকাশ পায়। কেউ কেউ হয়ত একই লেখায় বর্তমান আার অতীত কাল ব্যবহার করেছেন। তা আমরা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনায় দেখেছি। তবে বিষয় আর কথনশৈলীর ভিতর একটা প্রণয় থাকা দরকার। গদ্য আর পদ্যের পার্থক্য তো আছেই, তবে এখন তা হয়ত ধীরে ধীরে মুছে যেতে পারে। কারণ শিল্পের একটা সমন্বিত চেহারা ধীরে ধীরে বিকশিত হতে পারে। ভাষার ভিতর থেকে সেই ধরনের আলাদা এক জ্যোতি হয়ত প্রকাশ পাবে।
আমরা বরং গ্রন্থটির শেষ কয়টা লাইনই পাঠ করি, ভাষায় কখননোই আমরা সম্পূর্ণ করে কিছু বলতে পারি না। বড়োজোর বক্তব্যের দিকে পাঠক বা শ্রোতাকে টেনে আনতে পারি এবং হয়ত তাকেও এক অর্থে রচয়িতা করে তুলতে পারি; যিনি তা সাবলীলভাবে পারেন তিনি লেখক; যিতি তা জীবনের অনুকূলে পারেন তিনি মহৎ লেখক; আর যিনি পুরুষের পর পুরষ এই কীর্তিটি সাধনা করতে পারেন তিনি অমর লেখক॥ তবে আমরা আপাতত শেষ কথা হিসাবে বলতে পারি, ভাষা আর মনই সব, আনন্দই আসল কারিগর। ভাষার সাথে, চিন্তার সাথে, সর্বময় আনন্দের সাথে গল্পেরও একটা নিজস্ব আদল দাঁড়াতে পারে। আমরা হয়ত সৈয়দ হককে এই কাজের এক সহযাত্রী হিসাবেও পাবো।
এইভাবে, নানান স্তরের ভিতর দিয়ে তাকে আমরা পাঠ করতে পারি। অত ব্যাপক কাজ তিনি করেছেন। গল্পের এমন মনমরা দিনে তাকে তো আমাদের স্মরণ করতে হয়। তার জন্মদিনের উজ্জ্বল-উচ্ছ্বামুখর দিনে তার সৃজিত সাহিত্যের অন্যসব বিষয়ে সাথে গল্পের নানান দিক নিয়েও অনবরত মত প্রকাশ করাই যায়।
২৮.১২.১৩
এইভাবে, নানান স্তরের ভিতর দিয়ে তাকে আমরা পাঠ করতে পারি। অত ব্যাপক কাজ তিনি করেছেন। গল্পের এমন মনমরা দিনে তাকে তো আমাদের স্মরণ করতে হয়। তার জন্মদিনের উজ্জ্বল-উচ্ছ্বামুখর দিনে তার সৃজিত সাহিত্যের অন্যসব বিষয়ে সাথে গল্পের নানান দিক নিয়েও অনবরত মত প্রকাশ করাই যায়।
২৮.১২.১৩
0 মন্তব্যসমূহ