গল্পকারের সেরা গল্প নিয়ে আলাপ : শামসুজ্জামান হীরা

গল্পপাঠ : ০১. আপনার লেখা কোন গল্পটি সেরা বলে মনে হয়?

শামসুজ্জামান হীরা  ঃ একটি মৃত্যু : অতঃপর

গল্পপাঠ : ০২. গল্পটির বীজ কিভাবে পেয়েছিলেন?

শামসুজ্জামান হীরা  ঃ সে অনেক কথা। আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমার এক অনুজপ্রতিমের(গল্পে বন্ধু, হান্নান) বড় ভাই (হানিফ) হেপাটাইটিস-বি রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা সিয়েমেইচে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থেকে মৃত্যুবরণ করেন। আমি প্রায় প্রতিদিনই যেতাম হাসপাতালে। আসত রোগীর নিকটজনেরাও। রোগীর শ্যালিকার স্বামী ছিল আর্মির লেফটেন্যান্ট কর্নেল। শ্যালক একজন ব্যবসায়ী। লক্ষ করতাম এসব লোকের আচরণ¾একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা। রোগী মারা যাওয়ার পর যে-ঘটনাগুলো ঘটে তা আমাকে খুবই নাড়া দেয়। মৃতদেহের সঙ্গে আমিও যাই দাউদকান্দির এক অজপাড়াগাঁয়ে। ফিরে আসি শেষকৃত্য সাধনের পর। এই মৃত্যুকে ঘিরে সংঘঠিত ঘটনাগুলো বহুবছর পর, কুমিল্লার সেই সাহিত্যচর্চা থেকে সুদীর্ঘ একযুগ বিরতির পর আমাকে আবার গল্প লেখার জন্যে খোঁচাতে থাকে।


গল্পপাঠ : ০৩. গল্পের বীজটির বিস্তার কীভাবে ঘটল? শুরুতে কি থিম বা বিষয়বস্তু নিয়ে ভেবেছেন? না, কাহিনিকাঠামো বা প্লট নিয়ে ভেবেছেন?

শামসুজ্জামান হীরা  ঃ ব্যাপারটা এরকম যে, জীবিত মানুষকে নিয়ে লোকে যেভাবে চর্চা করে মৃত্যুর পর সেগুলো যেন ঘনীভূত হয়। যদিও স্থায়ীত্ব দীর্ঘ নয়। বিরাগ থাকলেও দৃশ্যত তা অনুরাগে রূপ নেয়। আর যেহেতু মৃতব্যক্তিটির কারো অনুরাগ-বিরাগে কিছু করবার থাকে না, যে যার মত করে চালিয়ে যায় অভিনয়¾। এ-গল্পে বিষয়বস্তুটাই প্রধান; কাহিনিকাঠামো এসেছে লেখার সময়¾খুব যে পূর্বপরিকল্পিত ছিল তা নয়। অনেক চরিত্রই এসেছে কলমের ডগা থেকে যতটা, মাথা থেকে ততটা নয়। যেমন পথের পাশে মরে পড়ে থাকা কাক। মৃত কাকটাকে কি চরিত্র বলা যায়?
জীবনের অর্থ খোঁজার চেষ্টা, শোক, বিষাদের মধ্যে দীর্ঘদিন অবস্থানের পর তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়া, এমন কি তা থেকে বেরিয়ে আসতে সুক্ষ্ম এক বেদনাবোধ¾এসব এসেছে গল্পটিতে।

গল্পপাঠ : ০৪. গল্পটির চরিত্রগুলো কিভাবে এসেছে? শুরুতে কতটি চরিত্র এসেছিল? তারা কি শেষ পর্যন্ত থেকেছে? আপনি কি বিশেষ কোনো চরিত্রকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন? তাদের মধ্যে কি আপনার নিজের চেনা জানা কোনো চরিত্র এসেছে? অথবা নিজে কি কোনো চরিত্রের মধ্যে চলে এসেছেন?

শামসুজ্জামান হীরা  ঃ  শুরুতে মৃতব্যক্তির চরিত্র, তাঁকে ঘিরে তাঁর ছোট ভাই (হান্নান), শ্যালক(মোস্তফা), এক সন্তান(গল্পে দুটো), মৃতের স্ত্রী(রোকেয়া), শ্যালিকা(ফারজানা), তার কর্নেল স্বামী(বদরে আলম) ও পিতা। ও হ্যাঁ সেই ডাক্তার, যিনি রোগী কখন মারা যাবেন এই তথ্য সরবরাহ করে অবলীলায় পকেটস্থ করেছিলেন সেই আমলে ৬০০টাকা(গল্পে অবশ্য টাকার অঙ্ক উল্লেখ নেই এবং এও উল্লেখ নেই যে, ডাক্তার সাহেবকে মিলিটারি হাসপাতালের অনুমতি নিয়ে বাইরে থেকে আনা হয়েছিল; তিনি তখন দেশের সবচেয়ে নামজাদা গ্যাস্ট্রোলিভার বিশেষজ্ঞ), ভালোই ঝাঁকুনি দিয়েছিল আমাকে।

হাসপাতালে অন্য রোগী ইমতিয়াজ আর তাঁর শ্যালিকা ঝিমলিকে আঁকবার চেষ্টা হয়েছে অন্য মাত্রায়। এরা সম্পূর্ণ কাল্পনিক চরিত্র। কনট্রাক্টর মতলব মণ্ডলও আধা কাল্পনিক। ওর জায়গায় বাস্তবে ছিলেন এক ইঞ্জিনিয়ার, মৃত হানিফের বড় ভাই।
চরিত্রগুলোর মধ্যে যাদের কথা বললাম তারা তো চেনাজানাই। এদের বাইরেও গ্রামের মৌলবি, গণ্যমান্য কিছু লোককে দেখেছি শেষকৃত্যানুষ্ঠানের প্রাক্কালে।

শুরুতে যে চরিত্রগুলো ছিল কাহিনির শেষে তাদের অনেকেই থাকেনি।

হ্যাঁ, যুবায়ের চরিত্রটাকে একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যুবায়ের চরিত্রটা তো গল্পকার নিজেই। এবং বোধগম্য কারণেই প্রধানতম চরিত্র। পাঠক সহজেই বুঝবেন।

গল্পপাঠ : ০৫. এই গল্পগুলোর দ্বন্দ্ব-সংঘাত কিভাবে নির্মাণ করেছেন?

শামসুজ্জামান হীরা  ঃ কিছু বাস্তব পর্যবেক্ষণ থেকে কিছু নেহাত কল্পনা। এখানে মৃতের শ্যালকের সঙ্গে ছোটভাইয়ের দ্বন্দ্বটা বাস্তব থেকেই উপলব্ধ, শ্বশুরের সঙ্গে সদ্যপ্রয়াত পুত্রবধূরও। বাস্তবে যে দ্বন্দ্বগুলো আবছাভাবে দৃশ্যমান হয়েছে তাকেই মূর্তরূপ দেবার চেষ্টা করেছি।

গল্পপাঠ : ০৬. গল্পের পরিণতিটা নিয়ে কি আগেই ভেবে রেখেছিলেন?

শামসুজ্জামান হীরা  ঃ না।

গল্পপাঠ : ০৭. গল্পটি কদিন ধরে লিখেছেন? এক এর ভাষা ভঙ্গিতে কি ধরনের শৈলী ব্যবহার করেছেন?

শামসুজ্জামান হীরা  ঃ খসড়া করেছিলাম ১৯৮০র দিকে। লিখব লিখব করে লেখা হয়ে ওঠেনি। তখন লেখালেখির চেয়ে অন্যকাজে মগ্ন থাকতাম বেশি। সন্ধ্যা হতেই ছুটতাম আড্ডায়। এক ঊর্ধ্বতন সরকারি আমলার বাসায় চলত আড্ডা ও সোনালি তরল পান। চলত অনেক রাত অব্দি।

১৯৯৬তে দীনেশ দাস-এর (‘চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি সংসদ’-এর সাধারণ সম্পাদক, প্রয়াত) অনুরোধে বন্ধু মোনাজাতউদ্দিনের ওপর একটা স্মৃতিচারণমূলক লেখা লিখে ফেলি। ছাপা হয় ওর প্রথম মৃত্যুবার্ষির্কীতে। আর কী আশ্চর্য্ পরিচিত বন্ধুদের, তাদের অনেকেই আবার প্রতিষ্ঠিত কথাশিল্পী, কাছ থেকে অনুরোধ আসতে থাকে লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ার। উৎসাহ পাই বৈকি। কিন্তু যে গল্পটার খসড়া করে রেখেছিলাম তা খুঁজে পাই না। নেই নেই তো নেই। আমারও জেদ, ওটা না পেলে আর কখনও গল্প জাতীয় কিছু লিখব না। কত ঘাঁটাঘাঁটি। ২০০৩য়ের দিকে হঠাৎই আবিষ্কৃত হয় পুরোন কাগজের স্তূপের মধ্যে লুকিয়ে থাকা হলদেটে খসড়া পাণ্ডুলিপিটি। সে কী আনন্দ!

খসড়া থেকে একরাতেই দাঁড় করানো গল্পের প্রাথমিক অবস্থা। তারপর ফেলে রাখা। অনেক সংস্কারের পর ২০০৫-এ জনকণ্ঠে পাঠানো হয় গল্পটা। তারপর অপেক্ষা। বেশ কিছুদিন পর জুনের ৩ তরিখে ছাপা হয়। তারপর আসতে থাকে প্রশংসাবার্তা¾বিব্রত হওয়া আর কাকে বলে। কোনো লেখকের ৪০০০শব্দের গল্প দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যের পাতায় মুদ্রিত হওয়া, তাও আবার কোনো বিশেষ সংখ্যায় নয়, বিস্মিত হওয়ার মতই।

ভাষা? যেখানে যেভাবে যেটা মানায় সেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে চাকরি করে মোস্তফা তার কনভারসেশনে ইংরেজির বহুল ব্যবহার; মৌলবির জবানে আরবি-ফার্সি, গ্রাম্য মাতব্বরের মুখে গ্রামের টিপিক্যাল ভাষা। ইমামের নসিহতে একধরনেরে আঞ্চলিক বাংলা-আরবি-ফার্সি মেশানো ভাষা।

গল্পপাঠ : ০৮.গল্পটিতে কি কিছু বলতে চেয়েছিলেন?

শামসুজ্জামান হীরা  ঃ গল্পে তো কিছু বলা হয়ই। স্যাটায়ার কিছুটা, আপাত সিরিয়াস বিষয় নিয়ে। প্রথাকে নিয়ে। তবে এ-গল্পে কোনো বিশেষ একটা ম্যাসেজ আছে বলে আমার মনে হয়নি। আমার মনে হওয়া না-হওয়া দিয়ে যদিও কিছু এসে যায় না।

গল্পে মূলত মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিকটাকেই ফুটিয়ে তুলবার চেষ্টা করা হয়েছে। বয়স্কদের জটিলতা এবং শিশুর সরলতাকে পাশাপাশি স্থাপন করবার প্রচ্ছন্ন প্রয়াসও আছে। ধর্মের নামে আর্থিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা। সামাজিক কুসংস্কার; শোকের মধ্যেও প্রেম, প্রদর্শনবাদ, সন্দেহ-বাতিকতা। সবশেষে একটি শিশুর নিষ্কলুষ নিঃস্বার্থ পিতৃপ্রেম দিয়ে সমাপ্তি। কাক, আমার সবচেয়ে প্রিয় পাখি¾এ গল্পের প্রধানতম মেটাফোর। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নরম ঘাসের ওপর মরে পড়ে থাকা এবং গল্পের শেষে মুক্ত আকাশ পানে উড়াল দেওয়া …

গল্পপাঠ : ০৯. গল্পটি লেখার পরে কি আপনি সন্তুষ্ট হয়েছেন? আপনি কি মনে করেন--আপনি যা লিখতে চেয়েছিলেন, তা লিখতে পেরেছেন এই গল্পটিতে?

শামসুজ্জামান হীরা  ঃ ভালো লেগেছে। যা লিখতে চেয়েছিলাম তা না হয়ে তার চেয়ে ভালো কিছু হয়ে গেছে বলে মনে হয়।

মনে হয় আমাকে দিয়ে কেউ লিখিয়েছে এই গল্পটা।

গল্পপাঠ : ১০. এই গল্পটি পাঠক কেনো পছন্দ করে বলে আপনার মনে হয়?

শামসুজ্জামান হীরা  ঃ সাধারণ পাঠকেরা এ-গল্পটিকে পছন্দ করেন কি না জানি না। ধারণা করি, পছন্দ করেন না। কারণ, এতে কোনও সুসংবদ্ধ কাহিনি নেই। আমার পরিচিত যাঁরা সিরিয়াস পাঠক, ক্রিটিকও বটেন, তাঁরা এর মধ্যে ভিন্ন কিছু পেয়েছেন বলেই মনে হয় পছন্দ করেছেন। কিছু কঠিন বিষয়কে, সামাজিক প্রথাকে স্যাটায়ার করা হয়েছে, যা মুক্তচিন্তকদের ভালো লাগার কারণ হতে পারে। সব থেকে শ্লাঘা বোধ করেছি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার প্রাক্তন অধ্যাপক(বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর) গোপা দত্তভৌমিক, আমার বন্ধুর ভাগ্নি, যাকে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থটি উপহার দিয়েছিলাম, ফোন করে ‘একটি মৃত্যু:অতঃপর’ সম্পর্কে আমাকে জানিয়েছিল: খুব কমই নাকি এত ভালো গল্প ও পড়েছে। জানি না, বাড়িয়ে বলেছিল কি না। কত ভালো সেটা বড় কথা নয়, একজন বোদ্ধা পাঠকের ভালো লাগার মত কিছু তো একটা হয়েছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ওর প্রশংসা আমার খুব ভালোই লেগেছিল।




সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
শামসুজ্জামান হীরা
শেক্সপিয়রের কমপ্লিট ওয়ার্ক্সয়ের শুরুর ফাঁকা পাতায় আমার বাবা এভাবে লিখেছিলেন: A son………….born in ইত্যাদি। ফিল ইন দ্য ব্ল্যাংক,………….. জায়গাটায় লাল কালিতে ডাকনাম ঠিক করবার পর লিখেছিলেন, Hira; তারপর সন-তারিখ। বাবা রিটায়ার করার পর ১৯৬৮তে আমাদের পরিবার এসে ঠাঁই নিল পাবনা শহরে সদ্য নির্মিত ছোট্ট বাসাটাতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পরপরই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শিকার হল আমাদের সেমিপাকা বাসাটা¾পুড়ে ছাই। আমার সংগ্রহের আলমারি বোঝাই বই সেই সঙ্গে বাপের Complete Works of Shakespeare। আমার ডাকনামটা তো ক্রিমেটেড হলই সেইসঙ্গে জন্মের সনতারিখও।

বাবা সরকারি চাকুরে হওয়াতে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। একেবারে শৈশব¾যখন সবে স্মৃতির উদ্ভব¾কেটেছে ছাতক। তারপর বানিয়াচং, জকিগঞ্জ, কমলগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও রংপুর। স্কুলে ভর্তি হই জকিগঞ্জে, তারপর ক্লাশ ফাইভ-সিক্স কমলগঞ্জে, সেভেনের কিছু অংশ ফেনীতে। সেভেনের শেষ থেকে বিএসসি পর্যন্ত কুমিল্লায়। বলা চলে আমার জীবনের সোনালি সময়টা কাটে কুমিল্লায়। সাতজন সাহিত্যপ্রেমী বন্ধু মিলে গড়ে তুলি সপ্তর্ষি গোষ্ঠী। আমাদের উপদেষ্টা ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের তরুণ অধ্যাপক কবি আসাদ চৌধুরী। ভালো কিছু কাজ করা হয় গোষ্ঠী থেকে। আমাদের জ্যেষ্ঠ সদস্য মনোরঞ্জন বিশ্বাসের সম্পাদনায় বেরোয় বাংলাদেশের সেরা কবিদের কবিতা নিয়ে কবিতাসংকলন,‘সন্দীপন’। সিকান্দার আবু জাফর, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, হাসান হাফিজুর রহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন, আবদুল গনি হাজারী, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, ফরহাদ মজহার, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, আলতাফ হোসেনসহ আরও বহু কবির কবিতা স্থান পায় তাতে। এ-কবিতাপত্রটি ভারতের সাহিত্যাঙ্গনেও উচ্চপ্রশংসিত হয়। এছাড়াও মাসিক গোমতী, ময়নামতির সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ি ওতপ্রোতভাবে। ফলে লেখাপড়ায় লবডঙ্কা। বারবার পরীক্ষা ড্রপ¾বাধ্য হয়ে বাপ এসে গ্রেপ্তার করেন আমাকে এবং সোজা রংপুরে ‘চালান’। বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার, রিটায়ারমেন্টের আগে ছিলেন রংপুর।

৬৮র আগপর্য‌্ন্ত ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক ছিল না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর শুরু হয় নতুন এ-অধ্যায়। আগেই বলেছি, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে আমাদের পরিবার শহর ছেড়ে এদিক ওদিক কিছুদিন কাটিয়ে শেষে গিয়ে মাথা গোঁজে গ্রামের বাড়িতে।

আমি তখনও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র (ক্লাশের হাজিরা-খাতা তাই সাক্ষ্য দিত)। পড়াশোনার চেয়ে বেশি ব্যস্ততা ছাত্ররাজনীতি নিয়ে। ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি।

১৯৭১এর ৩রা মার্চ ইয়াহিয়া খানের গণপরিষদের অধিবেশন বাতিল করার ঘোষণার পরপরই শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ সংগ্রাম। বাড়ি ফেরার প্রশ্নই আসে না। ছাত্র ইউনিয়ন-ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির তরুণদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব বর্তায় আমার ওপর। প্রতিরোধ টেকে না বেশিদিন। ২৯ তারিখে শহর ছেড়ে বোয়ালখালী থানার গোমদন্ডী। ওখান থেকে দক্ষিণে পশ্চাদপসরণ, বাঁশখালী, ছনুয়া, ইলিশিয়া। তারপর ভারত যাওয়ার ব্যবস্থা হওয়ার পর কাজিরহাট দিয়ে বর্ডার পার হয়ে আগরতলা। ওখান থেকে আসামের তেজপুর। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা ব্যান্ডের সদস্য হিসেবে তেজপুরে ট্রেনিং শেষ করে আবার ফিরে আসি চাটগাঁয়। যুদ্ধএলাকা স্থির হয় পটিয়া-বোয়ালখালী-আনোয়ারা। পটিয়ার গৈড়লায় আমরা যে অ্যামবুশ করি তা ছিল চট্টগ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বড় অপারেশন। বছর তিনেক আগে ওখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।

যুদ্ধশেষে আবার বিশ্ববিদ্যালয়। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাকে পাশ করিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত ছিল ভার্সিটি কর্তৃপক্ষের(যেহেতু ফাইনাল পরীক্ষার এক পেপার বাদে সবগুলোই শেষ হয়ে গিয়েছিল যুদ্ধ শুরুর আগে)। আমি পালিয়ে বেড়াতে থাকি ডিপার্টমেন্টাল হেডের চোখ এড়িয়ে! মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বার ইচ্ছা একদম ছিল না। আরো কাটানো যাক কবছর ছাত্র হিসেবে। বায়াত্তরে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন। সারা বাংলাদেশেই তখন ছাত্র ইউনিয়নের জয়জয়কার। সাতাশজনের মধ্যে পঁচিশজন নিয়ে আমি নির্বাচিত হলাম চাকসু’র ভিপি। দুজন পেল অবিভক্ত ছাত্রলীগ। ৭২এ অন্যান্য স্থানে দুভাগ হলেও কৌশলগত কারণে চট্টগ্রামে তখনও ভাঙেনি ছাত্রলীগ।

ছাত্রত্ব শেষ হবার পর বেকার। চরম আর্থিক সংকট। আত্মীয়-বাড়িতে কাটাই হতাশাক্রান্ত আমি। সাতাত্তরে একবন্ধুর সঙ্গে শুরু করি ব্যবসা। ব্যবসায়েও মার খাই। আবার অনিশ্চিত এক জীবন। ইচ্ছা ছিল সার্বক্ষণিকভাবে রাজনীতি করবার; পারিবারিক সমস্যার কারণে তা হয়ে ওঠে না।

তারপর কখনও ছোটখাটো এনজিওর প্রধান, কখনও এটাওটা। ইনকন্সিস্টেন্সি আমার সবচেয়ে বড় দোষ বা গুণ! লেখালেখিতেও কখনও খুব ঝোঁক, কখনও শিথিলতা¾চলছে এভাবেই। চলুক।

একটা ব্যাপারে আমাকে অনেকে খুবই অপছন্দ করেন, আমি না কি অতি মাত্রায় খুঁতখুঁতে, অতিমাত্রায় স্বাধীনতার চেতনা না কী যেন বলে তা নিয়ে বুঁদ, অতিমাত্রায় শোষণহীন সমাজ নির্মাণে বিশ্বাসী! এবং একটি দর্শনে ৪৫বছর যাবত অতিমাত্রায় অবিচল, তাহল মেহনতি মানুষের রাজ কায়েমের দর্শন।

এপর্যন্ত আমার গল্পগ্রন্থ বেরিয়েছে দুটি। ‘দিঘির জলে পুরনো চাঁদের শব’ ও ‘কানাগলিতে কানামাছি’। সম্পাদিত বই অরুণ সোম কর্তৃক অনূদিত নিকোলাই গোগলের ‘ওভারকোট’। বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিনে গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলো পুস্তক প্রকাশের আগেই মুদ্রিত হয়েছিল। বক্ষ্যমাণ গল্পটি প্রথম গল্পগ্রন্থ থেকে নেওয়া।

লেখালেখি চলছে ঢিমে তালে। বাড়াবাড়ি রকমের মিটিকিউলাস ও আলস্যের কারণে বহুপ্রজ হতে পারিনি। এ-বছর অমর একুশে বইমেলায় আমার সম্পাদিত ননী ভৌমিক অনূদিত দস্তোয়েভস্কির ‘জুয়াড়ি’ উপন্যাসটি বেরোচ্ছে। মৌলিক কিছু একটা বার করবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্যে হয়ে ওঠেনি।

বর্তমানে আমি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির একজন পূর্ণ সদস্য, বাংলাদেশ কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।

আমার স্ত্রী ঢাকার একটি কলেজে শিক্ষকতা করেন; খেয়েপরে বেঁচে আছি তাঁর কল্যাণে! দু-সন্তান আমাদের; দু-ছেলেই স্কলারশিপ নিয়ে অ্যামেরিকায় পিএইচডি করছে। এরা তিনজনই আমাকে ভালোবাসে, কী কারণে তারাই জানে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ