সম্প্রতি পড়েছি জাকির তালুকদারের ‘দাসপরম্পরা'। ছোটগল্প। বটকৃষ্ণ দাস গল্পের নায়ক! সত্যিই কি তাই? পুরো গল্প পড়ার পর আমার কাছে মনে হয়েছে আসলে এই গল্পের নায়ক কোনো ব্যক্তি না, বরং মঙ্গা নামক ‘পেটের বিষ!' যে বিষ বটকৃষ্ণ ওরফে বটকুর পূর্বপুরুষকে রায়বাড়িতে বহুকাল আগে আত্মবিক্রি করতে বাধ্য করে। একেবারে খাতা-কলমে দলিল করে রায়বাড়ির বাবুরা তাকে কিনে নেয়। এবং সেই দলিলের ফাঁদে পড়ে বটকুকেও পূর্বপুরুষের ঘানি টানতে হয়। তার সমস্ত চাওয়া-পাওয়া স্বপ্ন-সাধ নিয়ন্ত্রণ করে রায়বাড়ির বেণীরায়। কিন্তু সে ক্লান্তিবোধ করে। চারপাশে স্বাধীন মুক্ত মানুষ দেখে তার ইচ্ছে জাগে অভিশপ্ত দলিলটা পুড়িয়ে বহুদূরে কোথাও পালিয়ে যায়, কিন্তু অশিক্ষিত বটকুকে মিথ্যে কথা বলে শাসায় বেণী রায়।
একদিন গাঁয়ের চেয়ারম্যানের সহায়তায় তার মুক্তি ঘটে। তিনবিঘা জমিও পায়। ইউনিয়ন পরিষদে আনুষ্ঠানিক ভাবে যুবক বটকুকে নুনু কাটিয়ে আব্দুল বারেকে পরিণত করা হয়। কিন্তু আসলেই কি তার মুক্তি ঘটে? রায়বাড়িতে থাকার সময় তার খাওয়া পড়ার চিন্তা ছিল না। চিন্তা ছিল— মুক্তি, নতুন জীবন গড়ার, সামনে এগিয়ে চলার। সে ছিল তখন আস্তিত্বিক বন্দী কিন্তু স্বাধীন জীবন পাবার পর মঙ্গা জমি কেড়ে নিল, বউ বাচ্চা নিয়ে জীবনকে ফেলে দিল চ্যালেঞ্জের মুখে। শেষমেশ হিন্দুর গোলামী থেকে মুক্তি পেয়ে যখন মুসলমান হল তখন পেটের দায়ে তার পুত্রকে সৌদি আরবে উঠের জকি হতে দালালের কাছে বিক্রি করতে হয়! যে দারিদ্র্য তার পূর্বপুরুষকে হিন্দু জমিদারের ক্রীতদাস হতে বাধ্য করে, বাধ্য করে বটকুকে তার ঘানি টানতে সে দারিদ্র্যই বটকু ওরফে আব্দুল বারেককে বাধ্য করে নিজের নাবালক পুত্রকে মোসলমানদের ক্রীতদাসত্ব বরণ করতে।
এখন প্রশ্ন ওঠতে পারে যে, বটকুদের এই যে ক্রম ক্রীতদাসত্ব, এটা কি সিসিফাসের মত নিয়তি নির্ধারিত নাকি কোনো এক বিশেষ গোষ্ঠীর গভীর কোনো চক্রান্তের ফলাফল? পুঁজিপতিরা সবসময় চেয়েছে, যাদের পেটের ওপর দাঁড়িয়ে ওদের পুঁজির পাহাড় জমে, তাদের সেই দারিদ্র্যকে তাদের মাঝে জিইয়ে রাখতে। তাই হয়ত হিন্দুর ক্রীতদাস বটকু মুক্ত হয়ে যখন মুসলমান আব্দুল বারেক বনে যায়, তখনও তার দারিদ্র্য পিছু ছাড়ে না।
সমাজ যে স্ট্রাকচারে গঠিত, আরো ভাল করে বললে, সমাজের স্ট্রাকচার যারা তৈরি করেন, সেইসব পুঁজিপতিরাই বটকুদের নিয়তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন; তাই আমরা দেখতে পাই, বটকু ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েও দারিদ্র্য বা অভাব অথবা পেটের বিষের তাড়নায় তার পরবর্তী প্রজন্মকে ক্রীতদাসত্ব বরণ করাতে বাধ্য করে, যেমন তাকে বাধ্য করিয়েছিল তার পূর্বপুরুষ তার অজান্তেই! হ্যাঁ, নিজেদের অজান্তেই যেন অমোঘ ক্রীতদাসত্ব বরণ হতে বাধ্য হয়।
বটকু যেমন নিজের চারপাশকে ভাল করে বোঝার আগেই নিজেকে বেণী রায়ের ক্রীতদাস হিসেবে আবিষ্কার করে, তেমনি অদূর ভবিষ্যতেও যে বটকুর নাবালক ছেলে নিজেকে মরুভূমির বুকে কোনো এক মুসলমানের ক্রীতদাস হিসেবে আবিষ্কার করবে— এই ইঙ্গিত লেখক চমৎকারভাবে দিয়েছেন।
এ গল্পে স্পষ্ট দুটি ভাগ আছে— হিন্দু বটকুর হিন্দু জমিদারের কাছে ক্রীতদাসত্ব। জীবনের এই পিরিয়ডে বটকু কান-মাথা-চোখ বেণী বাবুর তর্জনীর তলে বন্ধক রাখে। তবুও স্বপ্ন দেখে মুক্তির। যখন মুক্তি ঘটে, হিন্দু বটকু যখন মুসলমান আব্দুল বারেক, জীবনের এই দ্বিতীয় পিরিয়ডে আমরা দেখতে পাই— বটকু নতুন সমাজের যাঁতাকলে পিষে যাচ্ছে, সামাজিক বাস্তবতায় নির্মমতায় নিজেকে বড্ডো অসহায় প্রাণী হিসেবে আবিষ্কার করছে; গাঁয়ে কর্ম নেই, আসলে সমাজ তার জন্য এমন কোনো কোঠা রাখেনি যার সাহায্যে বটকু নিজেকে গড়ে নিতে পারে; তাই আবাদি জমি বেচতে হয় পেট বাঁচাতে, তারপর ছুটে যায় শহরে। কিন্তু সেখানেও কাজ মেলে না। তার মত হাজার হাজার বারেক গিজগিজ করছে শহরজুড়ে।
তার শ্রেণির যুবতীরা অভাবের তাড়নায় নির্দ্বিধায় পরপুরুষের লালসার শিকার হতে বাধ্য হয়। নিঃস্ব বারেক নিঃস্ব পরিবারে বৌ-বাচ্চার কাছে ফিরে আসে। তাড়া নোট আর আগামী স্বপ্নের কাছে বিক্রি করে পুত্রকে। যে জীবন এক কালে তার নিজেকে যাপন করতে হয়েছে, সে জীবনের হাতে পিতা তার আদরের পুত্রকে সঁপে দিতে বাধ্য হয়। আড়ালে পুঁজিবাদিরা অট্টহাসি দেয়।
এখন শৈলীটা খেয়াল করা যাক, কেননা সেখানেই, গল্পে যে চিন্তাটা বপন করা হয়েছে, তার শেকড় লুকিয়ে আছে। গল্পের কাহিনী নির্দিষ্ট কোনো গ্রামে সংঘটিত হয়নি। তখন আমরা বুঝতে পারি, এটা আসলে নির্দিষ্ট কোনো গ্রামের ঘটনা হয় বরং পুরো বাংলাদেশের তৃণমূল জনগোষ্ঠীর গভীর গোপন অসুখ। কিন্ত সময়? গল্পটা কোন সময়ের তাও উল্লেখ করা হয়নি। আর তখনই মনে ঝিলিক মেরে ওঠে গল্পের নাম— ‘দাসপরম্পরা'! সেই সুদূর অতীত থেকে এখন পর্যন্ত ক্রীতদাস প্রথার ধারা রূপান্তরের পথ ধরে বয়েই চলেছে। শুধু রীতিটার বদল ঘটেছে, অভাব-অনটন এ বাংলার মানুষের কাছে অতি প্রাচীন কাল থেকে অতি পরিচিত মুখ যে!
একদিন গাঁয়ের চেয়ারম্যানের সহায়তায় তার মুক্তি ঘটে। তিনবিঘা জমিও পায়। ইউনিয়ন পরিষদে আনুষ্ঠানিক ভাবে যুবক বটকুকে নুনু কাটিয়ে আব্দুল বারেকে পরিণত করা হয়। কিন্তু আসলেই কি তার মুক্তি ঘটে? রায়বাড়িতে থাকার সময় তার খাওয়া পড়ার চিন্তা ছিল না। চিন্তা ছিল— মুক্তি, নতুন জীবন গড়ার, সামনে এগিয়ে চলার। সে ছিল তখন আস্তিত্বিক বন্দী কিন্তু স্বাধীন জীবন পাবার পর মঙ্গা জমি কেড়ে নিল, বউ বাচ্চা নিয়ে জীবনকে ফেলে দিল চ্যালেঞ্জের মুখে। শেষমেশ হিন্দুর গোলামী থেকে মুক্তি পেয়ে যখন মুসলমান হল তখন পেটের দায়ে তার পুত্রকে সৌদি আরবে উঠের জকি হতে দালালের কাছে বিক্রি করতে হয়! যে দারিদ্র্য তার পূর্বপুরুষকে হিন্দু জমিদারের ক্রীতদাস হতে বাধ্য করে, বাধ্য করে বটকুকে তার ঘানি টানতে সে দারিদ্র্যই বটকু ওরফে আব্দুল বারেককে বাধ্য করে নিজের নাবালক পুত্রকে মোসলমানদের ক্রীতদাসত্ব বরণ করতে।
এখন প্রশ্ন ওঠতে পারে যে, বটকুদের এই যে ক্রম ক্রীতদাসত্ব, এটা কি সিসিফাসের মত নিয়তি নির্ধারিত নাকি কোনো এক বিশেষ গোষ্ঠীর গভীর কোনো চক্রান্তের ফলাফল? পুঁজিপতিরা সবসময় চেয়েছে, যাদের পেটের ওপর দাঁড়িয়ে ওদের পুঁজির পাহাড় জমে, তাদের সেই দারিদ্র্যকে তাদের মাঝে জিইয়ে রাখতে। তাই হয়ত হিন্দুর ক্রীতদাস বটকু মুক্ত হয়ে যখন মুসলমান আব্দুল বারেক বনে যায়, তখনও তার দারিদ্র্য পিছু ছাড়ে না।
সমাজ যে স্ট্রাকচারে গঠিত, আরো ভাল করে বললে, সমাজের স্ট্রাকচার যারা তৈরি করেন, সেইসব পুঁজিপতিরাই বটকুদের নিয়তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন; তাই আমরা দেখতে পাই, বটকু ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েও দারিদ্র্য বা অভাব অথবা পেটের বিষের তাড়নায় তার পরবর্তী প্রজন্মকে ক্রীতদাসত্ব বরণ করাতে বাধ্য করে, যেমন তাকে বাধ্য করিয়েছিল তার পূর্বপুরুষ তার অজান্তেই! হ্যাঁ, নিজেদের অজান্তেই যেন অমোঘ ক্রীতদাসত্ব বরণ হতে বাধ্য হয়।
বটকু যেমন নিজের চারপাশকে ভাল করে বোঝার আগেই নিজেকে বেণী রায়ের ক্রীতদাস হিসেবে আবিষ্কার করে, তেমনি অদূর ভবিষ্যতেও যে বটকুর নাবালক ছেলে নিজেকে মরুভূমির বুকে কোনো এক মুসলমানের ক্রীতদাস হিসেবে আবিষ্কার করবে— এই ইঙ্গিত লেখক চমৎকারভাবে দিয়েছেন।
এ গল্পে স্পষ্ট দুটি ভাগ আছে— হিন্দু বটকুর হিন্দু জমিদারের কাছে ক্রীতদাসত্ব। জীবনের এই পিরিয়ডে বটকু কান-মাথা-চোখ বেণী বাবুর তর্জনীর তলে বন্ধক রাখে। তবুও স্বপ্ন দেখে মুক্তির। যখন মুক্তি ঘটে, হিন্দু বটকু যখন মুসলমান আব্দুল বারেক, জীবনের এই দ্বিতীয় পিরিয়ডে আমরা দেখতে পাই— বটকু নতুন সমাজের যাঁতাকলে পিষে যাচ্ছে, সামাজিক বাস্তবতায় নির্মমতায় নিজেকে বড্ডো অসহায় প্রাণী হিসেবে আবিষ্কার করছে; গাঁয়ে কর্ম নেই, আসলে সমাজ তার জন্য এমন কোনো কোঠা রাখেনি যার সাহায্যে বটকু নিজেকে গড়ে নিতে পারে; তাই আবাদি জমি বেচতে হয় পেট বাঁচাতে, তারপর ছুটে যায় শহরে। কিন্তু সেখানেও কাজ মেলে না। তার মত হাজার হাজার বারেক গিজগিজ করছে শহরজুড়ে।
তার শ্রেণির যুবতীরা অভাবের তাড়নায় নির্দ্বিধায় পরপুরুষের লালসার শিকার হতে বাধ্য হয়। নিঃস্ব বারেক নিঃস্ব পরিবারে বৌ-বাচ্চার কাছে ফিরে আসে। তাড়া নোট আর আগামী স্বপ্নের কাছে বিক্রি করে পুত্রকে। যে জীবন এক কালে তার নিজেকে যাপন করতে হয়েছে, সে জীবনের হাতে পিতা তার আদরের পুত্রকে সঁপে দিতে বাধ্য হয়। আড়ালে পুঁজিবাদিরা অট্টহাসি দেয়।
এখন শৈলীটা খেয়াল করা যাক, কেননা সেখানেই, গল্পে যে চিন্তাটা বপন করা হয়েছে, তার শেকড় লুকিয়ে আছে। গল্পের কাহিনী নির্দিষ্ট কোনো গ্রামে সংঘটিত হয়নি। তখন আমরা বুঝতে পারি, এটা আসলে নির্দিষ্ট কোনো গ্রামের ঘটনা হয় বরং পুরো বাংলাদেশের তৃণমূল জনগোষ্ঠীর গভীর গোপন অসুখ। কিন্ত সময়? গল্পটা কোন সময়ের তাও উল্লেখ করা হয়নি। আর তখনই মনে ঝিলিক মেরে ওঠে গল্পের নাম— ‘দাসপরম্পরা'! সেই সুদূর অতীত থেকে এখন পর্যন্ত ক্রীতদাস প্রথার ধারা রূপান্তরের পথ ধরে বয়েই চলেছে। শুধু রীতিটার বদল ঘটেছে, অভাব-অনটন এ বাংলার মানুষের কাছে অতি প্রাচীন কাল থেকে অতি পরিচিত মুখ যে!
0 মন্তব্যসমূহ