হাইড পার্কে একখানি বেঞ্চির উপর বসে আছেন নরম্যান গরটসবি। পিছনে খানিকটা খোলা জায়গা,মাঝে মাঝে সযন্তবর্ধিত লতাগুল্মের ঝোপ, সামনে রেলিঙের ওধারে প্রশস্ত রাজপথ, পথের দুধারে সুরম্য অতটালিকার সারি। মার্চ মাসের সন্ধ্যা, ছটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ। সন্ধ্যার অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে চারধারে, তবে চাঁদের অস্ফুট আলোয় অন্ধকারটা বেশ জমাট বাঁধতে পারছে না। পার্কের ভিতরের ছোট-বড় রাস্তাগুলি ফাঁকা হয়ে গেছে, মাঝে মাঝে দুএকজন লোক আবছা অন্ধকারের মধ্যে এদিক ওদিক ঘোরা ফেরা করছে, কেউ কেউ বা চেয়ারে বা বেঞ্চিতে নিঃশব্দে বসে আছে অন্ধকারের মধ্যে গা ঢেকে।
দৃশ্যটা গরটসবির ভালোই লাগ্ল। তাঁর বর্মান মানসিক অবস্থার সঙ্গে আসন্ন সন্ধ্যার এই বিষাদময় দৃশ্য বেশ খাপ খেয়ে গেল। সন্ধ্যা তাঁর কাছে অরাজিতের উন্মুক্ত অবসর। জীবনযুদ্ধে পরাজিত যারা, অনুসিন্ধুৎসু নরনারীর দৃষ্ট থেকে নিজেদের বেফনা ও গ্লানি যারা গোপন করতেঞ্চায়, তারা এই ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যেই নির্জন গৃহকোণ থেকে বাইরের জগতে বেরিয়ে আসে—কারণ এসময় তাদের অপরিচ্ছন্ন পোষাক আর নৈরাশ্যম্লান মুখ অপরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে না।
অন্ধকারে যারা পায়চারি করছে তারা চায় অপরের কৌতুহলী দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে। তাই তারা বাদুড়ের মতো এই সন্ধ্যাবেলায় এসেছে পার্কে বেড়াতে, যখন আনন্দপিয়াসী নরনারীর দল বিদায় নিয়েছে। রেলিঙের বাইরে আলো আর আনন্দের রাজ্য। ওই যে বড় বাড়িটার সারি সারি জানালা অন্ধকারের মধ্যে আলোয় ঝলমল করছে ওটা তাদেরই আস্তানা যারা জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করেছে—অন্তত পরাজয়ের বেদনা যাদের কনতরকে বিদ্ধ করেনি। নির্জনে বেঞ্চির উপর বসে গরটসবি এম্নিধারা নানান চিন্তায় ডুবে আছেন। তাঁর মনের অবস্থা এখন এমন যে নিজেকে তিনি পরাজিতের দলের মধ্যেই মনে করেন। অর্থের অনটন যে তাঁর দুঃখের কারণ তা নয়। ইচ্ছে করলে তিনি ওই আলো ও আনন্দ-ভরা রাজপথে আর সকলের মতো বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে পারেন। অর্থের সচ্ছলতা তাঁর আছে। মনের নিগূঢ় আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ হয়েছে তাঁর। তাই তাঁর মন এখন বেদনায় বিপর্যস্ত। ওই অন্ধকারের বসগানের মধ্যে যারা পায়চারি করছে তারাও যে তারই মতো পরাজয়ের গ্লানি বহন করছে একথা মনে করে মনে মনে তিনি যেন খুশি হয়ে ওঠেন।
বেঞ্চিতে ঠিক তারই পাশে এক আধাবয়েসী ভদ্রলোক বসেছিলেন। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ না থাকলেও তাঁর মুখ দেখে মনে হয় যেন এককালে তাঁর যথেষ্ট তেজ ও আত্মসম্মানবোধ ছিল।, তবে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে যুঝে এখন যেন তাঁর সে উগ্রতা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। তাঁর পোষাক-পরচ্ছদ অপরিচ্ছন্ন বলা চলে না। অন্ততঃ সেই স্বল্পালোকের মধ্যে তাঁর ত্রুটি-বিচ্যুতি নজরে পরবার মতো নয়, তবে এটা ঠিক যে তাঁর পোষাক দেখে কেউই কল্পনা করতে পারবে না তাঁর পক্ষে আধ ক্রাউন দামের চকোলেটের বাক্স বা ন’পেনি দামের বাটনহোলের ফুল কেনা সম্ভব হতে পারে। তিনি নিঃসন্দেহে তাদেরই একজন যাদের সঙ্গ ও সোর্হাদ্য কেউ আর কামনা করে না, সংসারে যাদের প্রয়োজন একান্তই ফুরিয়ে গিয়েছে।
ভদ্রলোটি যখন উঠে দাঁড়ালেন, তখন গরটসবির মনে হল, হয় তিনি ফিরে চলেছেন তাঁর আত্মীয়পরিজনের কাছে যেখানে তাঁর কোনো সমাদর নেই, আছে শুধু গঞ্জনা, না হয় কোনো নিরানন্দ কোনো হোটেল-ঘর যেখানে তাঁর সাপ্তাহিক বিল পরিষোধ করবার সামর্থ্যটুকু একমাত্র আকর্ষণের বস্তু।
ভদ্রলোকটি ধীরে ধীরে অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন এবং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁত আসনখানি অধিকার করল পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক যুবক। পোষাকে তার পারিপাট্য আছে বটে, কিন্তু মুখখানা পূর্ববর্তী ভদ্রলোকের মতোই বিমর্ষ ও নিরানন্দ। দুনিয়ার উপর সে যে অত্যন্ত অপ্রসন্ন, বোধ করি এই ভাব~টিকে ব্যক্ত করার জন্যই আগন্তুক আসন অধিকার করার সঙ্গে সঙ্গে একটা ক্রুদ্ধ স্বগতোক্তি করল। কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা থাকায় উক্তিটা আত্মগত হলেও গরটসবির কানে এসে পৌঁছল।
‘আপ্নার মেজাজটা ভাল নেই বলে মনে হচ্ছে,’ মৃদুস্বরে বললেন গরটসবি। এ অবস্থায় কিছু না বলা তাঁর কাছে নিতান্ত অশোভন বলে মনে হয়।
যুবকটি সরল দৃষ্টিতে তাঁর দিকে ফিরে তাকাল।, ‘ আমি যে অবস্থার মধ্যে পড়েছি মশাই, আপনার যদি সেই অবস্থা হত, তাহলে আপনার মেজাজটাও ভালো থাকত কিনা সন্দেহ। আমি অত্যন্ত বোকার মতো কাজ করেছি—যা আমি জীবনে কোন্দিন করিনি।‘
‘ও’ গরটসবি জবাব দিলেন নিতান্ত নির্বিকারভাবে।
‘আজ বিকেলে আমি এখানে এসেছি। বার্কশায়ার স্কোয়ারে প্যাটাগোনিয়ান হোটেলে আমার থাকবার কথা, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম, সে-বাড়ি কয়েক সপ্তাহ আগে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে আর সেই জায়গায় তৈরি হয়েছে একটা সিনেমা থিয়েটার। ট্যাক্সি-ড্রাইভার আমাকে কিছু দূরের আর একটি হোটেলের কথা বললে এবং তার পরামর্শ মতো সেখানেই গেলাম। এই কিছুক্ষণ আগে এখানকার ঠিকানা জানিয়ে বাড়িতে চিঠি পাঠালা আর তার পরই বেরিয়ে এসেছি সাবান কিনতে। সাবান সঙ্গে আনতে ভুলে গেছি, আর হোটেলের সাবান ব্যবহার করতে প্রবৃত্তি হয় না আমার। হোটেল থেকে বেরিয়ে খানিকক্ষণ আমি এদিক –ওদিক পায়চারি করেছি, ঘুরে ঘুরে নানান দোকানের জিনিসপত্র দেখছি এবং তারপর যখন হোটেলে ফিরব বলে মনস্থ করেছি তখন আমার খেয়াল হল যে, হোটেলের নামও আমার মনে নেই আর কোন রাস্তায় যে সেই হোটেল তাও ভুলে গেছি। লন্ডনে যার কোনো বন্ধু বা আত্মীয় নেই তার পক্ষে এ অবস্থাযে মারাত্মক তা সবাই বুঝতে পারবে না। অবশ্য আমি আমার আত্মীয়দের কাছে ‘তার’ করতে পারি হোটেলের ঠিকানার জন্য, কিন্তু কালকের আগে তো খবরটা তাঁদের কাছে পৌছুবে না। আমার এদিকে হাতে টাকাকড়ি কিছুই নেই, মাত্র এক শিলিং নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়েছিলাম সাবান কিনতে আর মদ্যপানে তার প্রায় সবই খরচ হয়ে গেছে, পকেটে দু’পেনি সম্বল করে আমি এখন রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি, রাতটা যে কোথায় কাটাবো তার ঠিক নেই।‘
গল্পটি শেষ করার পর যুবকটি থামল, কিন্তু পরক্ষণেই বেশ একটু উষ্মার সঙ্গে বললে, ‘ আপনি হয়তো ভাবছেন, আমি নিশ্চয় একটা মিথ্যা কাহিনী রচনা করে বলছি, কেমন?’
‘না, মিথ্যা হবে কেন?’ গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন গরটসবি, ‘ মনে পড়ে আমিও একবার বিদেশে একটি শহরে ঠিক ওই অবস্থায় পড়েছিলাম এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমারা ছিলাম দু’জন—দু’জনেই হোটেলের নামটা গেছলাম ভুলে। সৌভাগ্যক্রমে হঠাৎ আমাদের মনে পড়ে গেল হোটেলটা একটা খালের ধারের এবং যখন আমরা খালের কাছে পৌঁছুলাম তখন হোটেলটা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হল না।‘
গরটসবির কথায় যুবকটি যেন একটু উৎফুল্ল হয়ে উঠল, ‘ বিদেশে এ ব্যাপারটা হলে মোটেই ভাবতাম না আমি। কনসালের কাছে গিয়ে বললেই কিছু সাহায্য পাওয়া যেত। নিজের দেশে এরকম ব্যাপার ঘটলেই মুশকিল। এমন কোনো সহৃদয় ভদ্রলোককে যদি পাই যিনি অদ্ভুত গল্পটা বিশ্বাস করে আমায় কিছু টাকা ধার দিতে রাজি হন, তবেই মঙ্গল—নয়তো সারা রাত আমায় রাস্তায় কাটাতে হবে নিশ্চয়। যাই হোক, আমি ভারি খুশি হয়েছি এজন্যে যে আপনি আমার গল্পটা একেবারে অসম্ভব মনে করেননি।‘
তার শেষের কথাটির মধ্যে আন্তরিকতার সুর ধ্বনিত হয়ে উঠল, যেন তার আশা গরটসবি ওই সহৃদয়তাটুকু দেখাতে কুণ্ঠিত হবেন না নিশ্চয়ই।
‘তবে সত্যের খাতিরে এটুকু বলতে হবে যে, আপনার গল্প একেবারে ত্রুটিবর্জিত নয়, কারণ আপনি গল্পে যে সাবানের উল্লেখ করছেন সেই সাবান আপনি দেখাতে পারেননি।‘ ধীরভাবে মন্তব্য করলেন গরটসবি।
যুবকটি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে অভারকোটের পকেটগুলো হাতড়াতে লাগ্ তারপর ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘সাবানটা হারিয়ে ফেলেছি মশাই।‘
‘ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে হোটেল ভুলে যাওয়া আর সাবান হারানো ইচ্ছেকৃত ত্রুটি বলেই মনে হয়,’ গম্ভীরভাবে বললেন গরটসবি, কিন্তু তাঁর কথা শেষ হবার আগেই যুবকটি বিরক্তিভাবে সামনের সঙ্কীর্ণ রাস্তাটি ধরে ত্বরিতপদে অগ্রসর হল। সে যে ভীত বা অপ্রস্তুত হয়েছে তা মনে হল না, সগর্বে মাথা উঁচু করে সে পার্কের অপরদিকে চলে গেল।
গরটসবি মনে মনে ভাবলেন, হোটেল থেকে সাবান আনতে বের হওয়াটাই গল্পের মধ্যে একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা, অথচ ওই সামান্য ঘটনাটাই ওর সমস্ত পরিশ্রম পণ্ড করে দিল। লোকটি যদি কিছু বুদ্ধি খরচ করে আগে থেকে একখানি সাবান সংগ্রহ করে রাখতো—স্টেশনারি দোকানের সযন্তে প্যাক-করা সাবান---তাহলে ও নিশ্চয়ই নিজের ব্যবসায়ে একজন প্রতিভাবান কর্মী বলে গণ্য হত।
মনে মনে এই কথা ভাবতে ভাবতে গরটসবি বাড়ি ফিরবেন বলে ুঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়াতেই কি একটা জিনিস লক্ষ্য করে তিনি বিস্ময়সূচক একটা শব্দ করলেন। বেঞ্চির পাশে মাটিতে পড়ে আছে সযত্নে বাঁধা একটা ডিম্বাকাত প্যাকেট। ওটা সাবানের মোড়ক ছাড়া আর কিছুই নয়। নিশ্চয়ই ওটা যুবকটির ওভারকোটের পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল যখন সে বেঞ্চির উপর বসে। কয়েক মুহূর্ত পরেই দেখা গেল গরটসবি যুবকটির সন্ধানে অন্ধকারাচ্ছন্ন পার্কে এদিক-ওদিক ঘুরছেন। খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরির প্রে যখন তিনি হতাশ হয়ে পড়েছেন, সেই সময় দেখতে পেলেন যুবকটি পার্কের ভিতরের একটা রাস্তায় ধারে চিন্তিত্মুখে দাঁড়িয়ে। সে যেন স্থির করতে পারছে না কী সে করবে—পাআরকের মধ্যে আরো কিছুক্ষণ ঘুরবে, না পার্কের বাইরে ওই জনতাবহুল পথেত দিকে পা বাড়াবে। গরটসবির ডাক শুনে সে চমকে মুখ ফেরাল। পাছে আবার কোনো অপমানকর মন্তব্য শুনতে হয় এজন্য তার মুখে কেমন একটা কঠিন রুক্ষতা ফুটে উঠল।
সাবানখানি তার মুখের উপর সামনে তুলে ধরে গরটসবি বললেন, ‘ আপনার গল্পের সত্যতার প্রধান সাক্ষীটি হাজির হয়েছে। আপনি যখন বেঞ্চির উপর বসেনতখন ওটা নিশ্চয়ই আপনার ওভারকোট থেকে পরে গিয়েছিল। আপনি চলে যাবার পর আমি ওটা মাটির উপর দেখতে পাই। ... আমার সন্দেহ আপনি ক্ষমা করবেন নিশ্চয়ই—কারণ আপনার গল্পের মধ্যে বিষ্বাস করবার মতো বিশেষ কিছু ছিল না এ আপনি স্বীকার করবেন। যাই হোক, আমি যখন সাবানের সাক্ষ্য তলব করেছিলাম তখন তার নির্দেশও আমায় মেনে নিতে হবে। এক পাউন্ড ধার পেলে আপনার যদি উপকার হয়, আমি আপনাকে ওই টাকাটা—‘
যুবকটি তাঁর স্নগশয়কে প্রশ্রয় না দিয়ে তাড়াতাড়ি টাকাটা নিয়ে পকেটে পুরল।
‘এই আমার কার্ড—এতে আমার ঠিকানা আছে,’ গরটসবি প্রফুল্লমুখে বললেন, ‘এই সপ্তাহের মধ্যে যে-কোনো দিন ফেরত দিলে চলবে...আর এই আপনার সাবান, দেখবেন আবার যেন এটা হারাবেন না, এ আপনার ভারি উপকার করেছে আজ।‘
‘আপনি যে এটা পেয়েছেন এ আমার পরম সৌভাগ্য,’ যুবকটি বললে। তারপর আবেগ্রুদ্ধ কণ্ঠে সংক্ষেপে ধন্যবাদ জানিয়ে সোজা পার্কের ফটকের দিকে এগিয়ে চলল।
‘বেচারা ভারি মুষড়ে পড়েছিল,’ মনে মনে বললেন গরটসবি, ‘টাকাটা পেয়ে এ যাত্রা বেঁচে গেল। ঘটনার সাহায্যে কোনো কিছু সিদ্ধান্ত করা যে কত অন্যায় তা আমি বুঝতে পারলাম।‘
গরটসবি যখন বাড়ি ফেরার পথে সেই বেঞ্চিটির পাশ দিয়ে চলেছেন সেই সময় তিনি দেখলেন একজন পৌঢ় ভদ্রলোক বেঞ্চিটার নিচে ও আশেপাশে কি যেন খুঁজছেন। তাঁকে চিনতে দেরী হল না গরটসবির, উনি তাঁরই পাশে বসেছিলেন যুবকটির আবির্ভাবের আগে।
‘আপনার কি কিছু হারিয়েছে, মশাই?’ জিজ্ঞাসা করলেন গরটসবি।
‘হ্যাঁ, একখানা সাবান!’
লেখক পরিচিতি
হেক্টর হিউ মুনরো (সাকি)
জন্ম : ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে বার্মার আকিয়াব শহরে জন্ম। বর্মার পুলিশ বিভাগে কিছুদিন চাকরি করেন। পরে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। ছোট গল্প রচনায় ইনি বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন। আখ্যানবস্তুর অভিনবত্বে ও সরস বর্ণনার গুণে এঁর প্রত্যেকটি গল্প উপভোগ্য।
বই--The Westminster Alice, Not So Stories, When William came, The Rise Of the Russiamn Empire.
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সাকি সৈন্যদলে যোগদান করেন এবং ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে শত্রুপক্ষের আক্রমণে নিহত হন।
অনুবাদক : সুধাংশুকুমার গুপ্ত
অন্ধকারে যারা পায়চারি করছে তারা চায় অপরের কৌতুহলী দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে। তাই তারা বাদুড়ের মতো এই সন্ধ্যাবেলায় এসেছে পার্কে বেড়াতে, যখন আনন্দপিয়াসী নরনারীর দল বিদায় নিয়েছে। রেলিঙের বাইরে আলো আর আনন্দের রাজ্য। ওই যে বড় বাড়িটার সারি সারি জানালা অন্ধকারের মধ্যে আলোয় ঝলমল করছে ওটা তাদেরই আস্তানা যারা জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করেছে—অন্তত পরাজয়ের বেদনা যাদের কনতরকে বিদ্ধ করেনি। নির্জনে বেঞ্চির উপর বসে গরটসবি এম্নিধারা নানান চিন্তায় ডুবে আছেন। তাঁর মনের অবস্থা এখন এমন যে নিজেকে তিনি পরাজিতের দলের মধ্যেই মনে করেন। অর্থের অনটন যে তাঁর দুঃখের কারণ তা নয়। ইচ্ছে করলে তিনি ওই আলো ও আনন্দ-ভরা রাজপথে আর সকলের মতো বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে পারেন। অর্থের সচ্ছলতা তাঁর আছে। মনের নিগূঢ় আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ হয়েছে তাঁর। তাই তাঁর মন এখন বেদনায় বিপর্যস্ত। ওই অন্ধকারের বসগানের মধ্যে যারা পায়চারি করছে তারাও যে তারই মতো পরাজয়ের গ্লানি বহন করছে একথা মনে করে মনে মনে তিনি যেন খুশি হয়ে ওঠেন।
বেঞ্চিতে ঠিক তারই পাশে এক আধাবয়েসী ভদ্রলোক বসেছিলেন। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ না থাকলেও তাঁর মুখ দেখে মনে হয় যেন এককালে তাঁর যথেষ্ট তেজ ও আত্মসম্মানবোধ ছিল।, তবে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে যুঝে এখন যেন তাঁর সে উগ্রতা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। তাঁর পোষাক-পরচ্ছদ অপরিচ্ছন্ন বলা চলে না। অন্ততঃ সেই স্বল্পালোকের মধ্যে তাঁর ত্রুটি-বিচ্যুতি নজরে পরবার মতো নয়, তবে এটা ঠিক যে তাঁর পোষাক দেখে কেউই কল্পনা করতে পারবে না তাঁর পক্ষে আধ ক্রাউন দামের চকোলেটের বাক্স বা ন’পেনি দামের বাটনহোলের ফুল কেনা সম্ভব হতে পারে। তিনি নিঃসন্দেহে তাদেরই একজন যাদের সঙ্গ ও সোর্হাদ্য কেউ আর কামনা করে না, সংসারে যাদের প্রয়োজন একান্তই ফুরিয়ে গিয়েছে।
ভদ্রলোটি যখন উঠে দাঁড়ালেন, তখন গরটসবির মনে হল, হয় তিনি ফিরে চলেছেন তাঁর আত্মীয়পরিজনের কাছে যেখানে তাঁর কোনো সমাদর নেই, আছে শুধু গঞ্জনা, না হয় কোনো নিরানন্দ কোনো হোটেল-ঘর যেখানে তাঁর সাপ্তাহিক বিল পরিষোধ করবার সামর্থ্যটুকু একমাত্র আকর্ষণের বস্তু।
ভদ্রলোকটি ধীরে ধীরে অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন এবং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁত আসনখানি অধিকার করল পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক যুবক। পোষাকে তার পারিপাট্য আছে বটে, কিন্তু মুখখানা পূর্ববর্তী ভদ্রলোকের মতোই বিমর্ষ ও নিরানন্দ। দুনিয়ার উপর সে যে অত্যন্ত অপ্রসন্ন, বোধ করি এই ভাব~টিকে ব্যক্ত করার জন্যই আগন্তুক আসন অধিকার করার সঙ্গে সঙ্গে একটা ক্রুদ্ধ স্বগতোক্তি করল। কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা থাকায় উক্তিটা আত্মগত হলেও গরটসবির কানে এসে পৌঁছল।
‘আপ্নার মেজাজটা ভাল নেই বলে মনে হচ্ছে,’ মৃদুস্বরে বললেন গরটসবি। এ অবস্থায় কিছু না বলা তাঁর কাছে নিতান্ত অশোভন বলে মনে হয়।
যুবকটি সরল দৃষ্টিতে তাঁর দিকে ফিরে তাকাল।, ‘ আমি যে অবস্থার মধ্যে পড়েছি মশাই, আপনার যদি সেই অবস্থা হত, তাহলে আপনার মেজাজটাও ভালো থাকত কিনা সন্দেহ। আমি অত্যন্ত বোকার মতো কাজ করেছি—যা আমি জীবনে কোন্দিন করিনি।‘
‘ও’ গরটসবি জবাব দিলেন নিতান্ত নির্বিকারভাবে।
‘আজ বিকেলে আমি এখানে এসেছি। বার্কশায়ার স্কোয়ারে প্যাটাগোনিয়ান হোটেলে আমার থাকবার কথা, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম, সে-বাড়ি কয়েক সপ্তাহ আগে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে আর সেই জায়গায় তৈরি হয়েছে একটা সিনেমা থিয়েটার। ট্যাক্সি-ড্রাইভার আমাকে কিছু দূরের আর একটি হোটেলের কথা বললে এবং তার পরামর্শ মতো সেখানেই গেলাম। এই কিছুক্ষণ আগে এখানকার ঠিকানা জানিয়ে বাড়িতে চিঠি পাঠালা আর তার পরই বেরিয়ে এসেছি সাবান কিনতে। সাবান সঙ্গে আনতে ভুলে গেছি, আর হোটেলের সাবান ব্যবহার করতে প্রবৃত্তি হয় না আমার। হোটেল থেকে বেরিয়ে খানিকক্ষণ আমি এদিক –ওদিক পায়চারি করেছি, ঘুরে ঘুরে নানান দোকানের জিনিসপত্র দেখছি এবং তারপর যখন হোটেলে ফিরব বলে মনস্থ করেছি তখন আমার খেয়াল হল যে, হোটেলের নামও আমার মনে নেই আর কোন রাস্তায় যে সেই হোটেল তাও ভুলে গেছি। লন্ডনে যার কোনো বন্ধু বা আত্মীয় নেই তার পক্ষে এ অবস্থাযে মারাত্মক তা সবাই বুঝতে পারবে না। অবশ্য আমি আমার আত্মীয়দের কাছে ‘তার’ করতে পারি হোটেলের ঠিকানার জন্য, কিন্তু কালকের আগে তো খবরটা তাঁদের কাছে পৌছুবে না। আমার এদিকে হাতে টাকাকড়ি কিছুই নেই, মাত্র এক শিলিং নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়েছিলাম সাবান কিনতে আর মদ্যপানে তার প্রায় সবই খরচ হয়ে গেছে, পকেটে দু’পেনি সম্বল করে আমি এখন রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি, রাতটা যে কোথায় কাটাবো তার ঠিক নেই।‘
গল্পটি শেষ করার পর যুবকটি থামল, কিন্তু পরক্ষণেই বেশ একটু উষ্মার সঙ্গে বললে, ‘ আপনি হয়তো ভাবছেন, আমি নিশ্চয় একটা মিথ্যা কাহিনী রচনা করে বলছি, কেমন?’
‘না, মিথ্যা হবে কেন?’ গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন গরটসবি, ‘ মনে পড়ে আমিও একবার বিদেশে একটি শহরে ঠিক ওই অবস্থায় পড়েছিলাম এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমারা ছিলাম দু’জন—দু’জনেই হোটেলের নামটা গেছলাম ভুলে। সৌভাগ্যক্রমে হঠাৎ আমাদের মনে পড়ে গেল হোটেলটা একটা খালের ধারের এবং যখন আমরা খালের কাছে পৌঁছুলাম তখন হোটেলটা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হল না।‘
গরটসবির কথায় যুবকটি যেন একটু উৎফুল্ল হয়ে উঠল, ‘ বিদেশে এ ব্যাপারটা হলে মোটেই ভাবতাম না আমি। কনসালের কাছে গিয়ে বললেই কিছু সাহায্য পাওয়া যেত। নিজের দেশে এরকম ব্যাপার ঘটলেই মুশকিল। এমন কোনো সহৃদয় ভদ্রলোককে যদি পাই যিনি অদ্ভুত গল্পটা বিশ্বাস করে আমায় কিছু টাকা ধার দিতে রাজি হন, তবেই মঙ্গল—নয়তো সারা রাত আমায় রাস্তায় কাটাতে হবে নিশ্চয়। যাই হোক, আমি ভারি খুশি হয়েছি এজন্যে যে আপনি আমার গল্পটা একেবারে অসম্ভব মনে করেননি।‘
তার শেষের কথাটির মধ্যে আন্তরিকতার সুর ধ্বনিত হয়ে উঠল, যেন তার আশা গরটসবি ওই সহৃদয়তাটুকু দেখাতে কুণ্ঠিত হবেন না নিশ্চয়ই।
‘তবে সত্যের খাতিরে এটুকু বলতে হবে যে, আপনার গল্প একেবারে ত্রুটিবর্জিত নয়, কারণ আপনি গল্পে যে সাবানের উল্লেখ করছেন সেই সাবান আপনি দেখাতে পারেননি।‘ ধীরভাবে মন্তব্য করলেন গরটসবি।
যুবকটি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে অভারকোটের পকেটগুলো হাতড়াতে লাগ্ তারপর ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘সাবানটা হারিয়ে ফেলেছি মশাই।‘
‘ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে হোটেল ভুলে যাওয়া আর সাবান হারানো ইচ্ছেকৃত ত্রুটি বলেই মনে হয়,’ গম্ভীরভাবে বললেন গরটসবি, কিন্তু তাঁর কথা শেষ হবার আগেই যুবকটি বিরক্তিভাবে সামনের সঙ্কীর্ণ রাস্তাটি ধরে ত্বরিতপদে অগ্রসর হল। সে যে ভীত বা অপ্রস্তুত হয়েছে তা মনে হল না, সগর্বে মাথা উঁচু করে সে পার্কের অপরদিকে চলে গেল।
গরটসবি মনে মনে ভাবলেন, হোটেল থেকে সাবান আনতে বের হওয়াটাই গল্পের মধ্যে একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা, অথচ ওই সামান্য ঘটনাটাই ওর সমস্ত পরিশ্রম পণ্ড করে দিল। লোকটি যদি কিছু বুদ্ধি খরচ করে আগে থেকে একখানি সাবান সংগ্রহ করে রাখতো—স্টেশনারি দোকানের সযন্তে প্যাক-করা সাবান---তাহলে ও নিশ্চয়ই নিজের ব্যবসায়ে একজন প্রতিভাবান কর্মী বলে গণ্য হত।
মনে মনে এই কথা ভাবতে ভাবতে গরটসবি বাড়ি ফিরবেন বলে ুঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়াতেই কি একটা জিনিস লক্ষ্য করে তিনি বিস্ময়সূচক একটা শব্দ করলেন। বেঞ্চির পাশে মাটিতে পড়ে আছে সযত্নে বাঁধা একটা ডিম্বাকাত প্যাকেট। ওটা সাবানের মোড়ক ছাড়া আর কিছুই নয়। নিশ্চয়ই ওটা যুবকটির ওভারকোটের পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল যখন সে বেঞ্চির উপর বসে। কয়েক মুহূর্ত পরেই দেখা গেল গরটসবি যুবকটির সন্ধানে অন্ধকারাচ্ছন্ন পার্কে এদিক-ওদিক ঘুরছেন। খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরির প্রে যখন তিনি হতাশ হয়ে পড়েছেন, সেই সময় দেখতে পেলেন যুবকটি পার্কের ভিতরের একটা রাস্তায় ধারে চিন্তিত্মুখে দাঁড়িয়ে। সে যেন স্থির করতে পারছে না কী সে করবে—পাআরকের মধ্যে আরো কিছুক্ষণ ঘুরবে, না পার্কের বাইরে ওই জনতাবহুল পথেত দিকে পা বাড়াবে। গরটসবির ডাক শুনে সে চমকে মুখ ফেরাল। পাছে আবার কোনো অপমানকর মন্তব্য শুনতে হয় এজন্য তার মুখে কেমন একটা কঠিন রুক্ষতা ফুটে উঠল।
সাবানখানি তার মুখের উপর সামনে তুলে ধরে গরটসবি বললেন, ‘ আপনার গল্পের সত্যতার প্রধান সাক্ষীটি হাজির হয়েছে। আপনি যখন বেঞ্চির উপর বসেনতখন ওটা নিশ্চয়ই আপনার ওভারকোট থেকে পরে গিয়েছিল। আপনি চলে যাবার পর আমি ওটা মাটির উপর দেখতে পাই। ... আমার সন্দেহ আপনি ক্ষমা করবেন নিশ্চয়ই—কারণ আপনার গল্পের মধ্যে বিষ্বাস করবার মতো বিশেষ কিছু ছিল না এ আপনি স্বীকার করবেন। যাই হোক, আমি যখন সাবানের সাক্ষ্য তলব করেছিলাম তখন তার নির্দেশও আমায় মেনে নিতে হবে। এক পাউন্ড ধার পেলে আপনার যদি উপকার হয়, আমি আপনাকে ওই টাকাটা—‘
যুবকটি তাঁর স্নগশয়কে প্রশ্রয় না দিয়ে তাড়াতাড়ি টাকাটা নিয়ে পকেটে পুরল।
‘এই আমার কার্ড—এতে আমার ঠিকানা আছে,’ গরটসবি প্রফুল্লমুখে বললেন, ‘এই সপ্তাহের মধ্যে যে-কোনো দিন ফেরত দিলে চলবে...আর এই আপনার সাবান, দেখবেন আবার যেন এটা হারাবেন না, এ আপনার ভারি উপকার করেছে আজ।‘
‘আপনি যে এটা পেয়েছেন এ আমার পরম সৌভাগ্য,’ যুবকটি বললে। তারপর আবেগ্রুদ্ধ কণ্ঠে সংক্ষেপে ধন্যবাদ জানিয়ে সোজা পার্কের ফটকের দিকে এগিয়ে চলল।
‘বেচারা ভারি মুষড়ে পড়েছিল,’ মনে মনে বললেন গরটসবি, ‘টাকাটা পেয়ে এ যাত্রা বেঁচে গেল। ঘটনার সাহায্যে কোনো কিছু সিদ্ধান্ত করা যে কত অন্যায় তা আমি বুঝতে পারলাম।‘
গরটসবি যখন বাড়ি ফেরার পথে সেই বেঞ্চিটির পাশ দিয়ে চলেছেন সেই সময় তিনি দেখলেন একজন পৌঢ় ভদ্রলোক বেঞ্চিটার নিচে ও আশেপাশে কি যেন খুঁজছেন। তাঁকে চিনতে দেরী হল না গরটসবির, উনি তাঁরই পাশে বসেছিলেন যুবকটির আবির্ভাবের আগে।
‘আপনার কি কিছু হারিয়েছে, মশাই?’ জিজ্ঞাসা করলেন গরটসবি।
‘হ্যাঁ, একখানা সাবান!’
লেখক পরিচিতি
হেক্টর হিউ মুনরো (সাকি)
জন্ম : ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে বার্মার আকিয়াব শহরে জন্ম। বর্মার পুলিশ বিভাগে কিছুদিন চাকরি করেন। পরে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। ছোট গল্প রচনায় ইনি বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন। আখ্যানবস্তুর অভিনবত্বে ও সরস বর্ণনার গুণে এঁর প্রত্যেকটি গল্প উপভোগ্য।
বই--The Westminster Alice, Not So Stories, When William came, The Rise Of the Russiamn Empire.
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সাকি সৈন্যদলে যোগদান করেন এবং ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে শত্রুপক্ষের আক্রমণে নিহত হন।
অনুবাদক : সুধাংশুকুমার গুপ্ত
0 মন্তব্যসমূহ