অমিতাভ দেব চৌধুরী গল্প : সূর্যাস্তের পানশালা - অমিতাভ দেব চৌধুরী

সচরাচর আমি এখানেই বসি । দেবদূত সিনেমাহলের পাশ দিয়ে ডানদিকে যে রাস্তাটা শিলচর সার্কিট হাউসের দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তা ধরে একটু এগোলেই বারটা । ছোট্ট বার । আটটা টেবিল । প্রতি টেবিলে চারটে করে চেয়ার ।আমি এসে বসি সূর্যাস্তের প্রহরে ।বার এসময় সাধারণত ফাঁকা থাকে ।অন্তত চ্যাংড়া বয়সীরা থাকে না ।তাই হইচইও থাকে না ।বারে চ্যাঁচামেচি আমার একদম পছন্দ নয় ।

পশ্চিমদিকটা দেয়ালঢাকা । ওইদিকেই বারে ঢোকার কাচের দরজা । সেই দরজায় প্রতিফলিত সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে মদে চুমুক দিই আর ভাবি : আহা, মদ খাচ্ছি না জীবন খাচ্ছি ?

নিজেকে নিয়েই তন্ময় ছিলাম । তাই ‘বসতে পারি?’প্রশ্নের কর্তাটিকে না দেখেই ভদ্রলোকসুলভ স্বাভাবিক সৌজন্যে হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়লাম ।তারপরই চারদিকে চোখ বুলিয়ে একটু অবাক হয়ে গেলাম । বাকি সাত-সাতটা টেবিলই তো পুরো খালি ! আমার টেবিলেই এসে বসতে হল ?তাকিয়ে দেখলাম । লম্বা, ফর্সা,পাকা দাড়ি আর কাঁচাপাকা চুলের, চশমাপরা সুদর্শন মানুষটি । যেতে যেতেও যৌবন যেন এর রূপের কোথাও একটা থমকে গেছে । আমার চেয়ে বড় হবেন বছর বিশ-বাইশ ।কিন্তু ভদ্রলোক এত দ্রুত মদ খান ? আমার তো প্রথম পেগের আদ্ধেকটাই এখনও শেষ হয় নি। এর মধ্যেই একটা খেয়ে দ্বিতীয়টি নিয়ে তারও অর্ধেক মেরে দিলেন ?

‘আপনার নিজের গতজন্মের কথা মনে পড়ে ?’ প্রশ্নটা শুনে আঁতকে উঠলেও, বুঝতে পারলাম, এতদিন ধরে আমার যে ধারণা ছিল পাগলদের কখনও মদ খাবার দরকার হয় না---তা সর্বৈব ভুল । ভ্যাবাচ্যাকা ভাবকে বিদ্রূপে রূপান্তরিত করতে পাঁচ সেকেন্ডমতো সময় লাগল ।তারপর বললাম, ‘এজন্মেই ঠিকঠাক মানুষ হয়ে জন্মাতে পারলাম না । আবার গতজন্ম ? কেন, আপনার বুঝি মনে পড়ে ?’

‘হ্যাঁ’,স্পষ্ট জবাব এল ।‘ আজ যেখানে এই বার, তখন এখানে কিচ্ছু ছিল না ।আজ যেখানটায় দেবদূত সিনেমাহল, সেখানে তখন ছিল টেনিসের হা্র্ড কোর্ট ।সাহেবরা খেলত । তারপর খানিকটা এগিয়ে ছিল টেনিসের গ্রাস কোর্ট । কাছাড় ক্লাবের একতলায় ছিল বার আর লাইব্রেরি । দোতলায় ছিল বলডান্সের ফ্লোর । এদিকে প্রচুর গাছ ছিল তখন। আর কত কত পাখি ছিল জানেন ? অনেক, অজস্র। শালিখ, দোয়েল, টিয়া, ময়না, মুনিয়া, বুলবুলি, খঞ্জনা... সাহেব-মেমরা বিকেলে-সন্ধ্যেয় পাখি দেখত ।খালি চোখে বা বায়নোকুলার দিয়ে ।

‘আপনি তখন কী মানে কী ছিলেন?’

‘আমি ? আমি বিপ্লবী ছিলাম । স্বাধীনতাসংগ্রামী । তুলাপট্টিতে বাবার মস্ত বড় ব্যবসা ছিল ।পেতল আর কাঁসার বাসনের । কিন্তু আমি মহাপ্রভু আখড়ার আর সারস্বত সমাজের বিপ্লবীদের খপ্পরে পড়েছিলাম ।’

পাগল ? কিন্তু পাগলে কি এত গুছিয়ে গল্প বলে? বললাম, ‘তারপর ?’ ‘ওদের দেখতাম ।ওই সাহেব-মেমদের । যাদের মারতে চাই, তাড়াতে চাই আমাদের দেশ থেকে তাদের প্রতি স্বাভাবিক একটা আকর্ষণ থাকবে তো ! এক্সমাসের সময় মস্ত বড় তাঁবু পড়ত ওদের । এই পুরো চত্বর জুড়ে । চারপাশের সব চাবাগান-টাগান থেকে সাহেব-মেমেরা ঝাঁক বেঁধে আসত ।নিশ্ছিদ্র তাঁবু পড়ত ।আমাদের নেটিভদের ঢুকতে তো দিতই না, দেখলেই খেদিয়ে দিত ওদের ভাষায় ।ভাষাটা ভালোই জানতাম, কিন্তু ওদের উচ্চারণে বুঝতে কষ্ট হত । তবে গ্রাসকোর্টে সাহেব-মেমরা যখন পাখি দেখত,আমরা দূর থেকে লুকিয়ে ওদের দেখতাম ।একদিন একটা বাচ্চা মেম , এই আমার চেয়ে বছর তিনেকের ছোট হবে্‌ ,দারুণ সুন্দরী, আমাকে পাখি-দেখার মতো করে দেখল---যেন আমি এক পুরুষ ধনেশ । দেখে সুন্দর করে হাসল ।এক্কেবারে আমার চোখে চোখ রেখে ।’

‘তারপর ?’

‘তারপর আর কী ? সারাবছর কি আর বড়দিন থাকে ? বড়দিনরা চলে যায়্‌ , ফুরিয়ে যায় । সাহেবরাও তাঁবু গুটিয়ে চলে গেল । আর দেখতেই পেলাম না তাকে ।’ ‘এরপর কী হল বলুন ।’

‘আর কী কিছু হয় রে ভাই ! কিছুদিনের মধ্যে আমার বিয়ে হল । সুন্দরী, ছিপছিপে বউ, বারো বছরের তরুণী । তার সঙ্গে ভারী ভাব হয়ে গেল আমার । কিন্তু রাতে তাকে শাড়ি-পরা দেখতে মোটেও ভালো লাগত না । একদিন এক বদখেয়ালে কিনেই ফেললাম ।পয়সার কোনও অভাব তো আর ছিল না ! দামি কাপড় কিনে মুসলিম এক দর্জিকে দিয়ে চোখের আন্দাজে মাপ দিয়ে একটা মেমের পোশাক বানিয়েই ফেললাম ।সে আমলের চৌকশ দর্জি তো ! সাহেবি পোশাক বানাতে অভ্যস্তই ছিল । পোশাকটা হাতে পেয়ে রাতে, সাহেবরা যেমন সারপ্রাইজ দেয়, তেমনিভাবে বউকে প্রেজেন্ট করলাম । ভেবেছিলাম, বউ আহ্লাদে লাফিয়ে উঠবে ।কিন্তু তেমনটা ঘটল না । উল্টে চোখ গোল গোল করে আমাকে দেখতে লাগল । যেন পাগল দেখছে ।তারপর দরজা খুলে সেই পোশাক হাতে একছুট্টে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।’

আমি জমে গেছি । মদের নয়,গল্পের মৌতাতে । খেয়েছি তো এখন অব্দি মাত্র দেড় পেগ । বাকি হাফ পেগ আমার গ্লাসে।ওদিকে কথকবাবুটি তাঁর চারনম্বর পেগে চুমুক দিচ্ছেন । সূর্য অস্তে গেছে । বারের ভেতরটায় আবছা একটা অন্ধকার । যেন সারা ঘরটাকে জলরঙে এঁকে কালোর ওয়াশ দিয়ে আঁকা ছেড়ে উঠে গেছে কেউ । আলো জ্বলে নি এখনও ।


‘গেল তো গেল, একেবারে আমার মায়ের আশ্রয়ে । মা সে রাতে তার বউকে আমার কাছে পাঠালেনই না । পরের রাতেও না । তার পরের রাতেও না । এর পরের দিন বাবার ঘরে আমার ডাক পড়ল। গিয়ে দেখি, বাবার মুখোমুখি বসে আছেন আমাদের কুলপুরোহিত, হাতে লালশালুমোড়া পুথি । বাবা সরাসরি বললেন, তুমি তো মনে মনে মেম-সংসর্গ করেই ফেলেছ হে। তোমার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে ।’

‘তারপর ? তারপর ?’

‘সেই প্রায়শ্চিত্ত ছিল দিনে । প্রায়শ্চিত্ত করতে করতে নিজেরই উপর কেমন ঘেন্না ধরে গেল । সন্ধেয় বন্ধুদের জোটালাম। মদ কিনলাম । জীবনে সেই প্রথম । তিন বন্ধু মিলে হু হু করে মদ গিললাম ।’

‘তারপর ?’

‘তার আর কোনও পর হয় নাকি ? সেই যে মদ খেতে শুরু করেছিলাম, প্রায় আশি বছর আগে---সেই মদ তো এখনও খেয়ে যাচ্ছি...’ বলতে বলতে , এখনও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়, লোকটা চোখের ওপর বেমালুম মিলিয়ে গেল । পড়ে রইল ফাঁকা গ্লাস । আর তার ব্যবহার করা দলানো ন্যাপকিনগুলি ।


খানিকক্ষণ থম মেরে বসে রইলাম ।তারপর উঠে দাঁড়ালাম । লোকটি যেখানে এতক্ষণ বসেছিল সেই সিটের গদিতে আলতো হাত ছোঁয়ালাম । কিন্তু এই গরমের দিনে সিটের ওপরটা এত ঠাণ্ডা হয় কী করে ? যেন এখানে এতক্ষণ কোনও মানুষ নয়, বরফের মূর্তিকেই বসিয়ে রেখেছিল কেউ !

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ