গল্পপাঠ : আপনার লেখা কোন গল্পটি সেরা বলে মনে হয়?
অঞ্জন আচার্য : খুব কমই গল্প লিখেছি আমি। প্রকৃত পক্ষে কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ইত্যাদিই লেখা হয় বেশি। তবে যে কয়টা গল্প লেখা হয়েছে তার মধ্যে আমার পছন্দগত দুর্বলতা আছে “অতঃপর আত্মহত্যা ও তৎপরবর্তী সংবাদ বিরতি” গল্পটির প্রতি। পাঠক মহলে প্রশংসা পেয়েছি বলে নয়, এখন পর্যন্ত এইটাই আমার কাছে ভালো কাজ বলে মনে হয়। সেরা কাজ তো বলতে পারবো না। সেরার হিসেব নিকেষ তো কষা হয় অন্তিম লগ্নে। আমার তো কেবল সকাল।
গল্পপাঠ : গল্পটির বীজ কীভাবে পেয়েছেন?
অঞ্জন আচার্য : আমি ঠিক বলতে পারবো না এ গল্পটি আমার মাথায় কখন কীভাবে খেলে গেছে। গল্পটি পড়ার পর অনেকে এটিকে শহীদুল জহিরের গল্প বলার ধরনের সাথে তুলনা করেছেন। শহীদুল জহির আমি পড়েছি ঠিকই, তবে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমন গল্প লিখেছি, তা বলাটা নিজের ওপর অবিচার করা হবে। গল্পের বীজ আসলে লুকিয়ে থাকে আমাদের জীবনের গল্পের মধ্যেই। হুটহাট করে সেগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
গল্পপাঠ : গল্পের বীজটির বিস্তার কীভাবে ঘটলো?
অঞ্জন আচার্য : সাধারণত যা হয়, একটি গল্পের প্লট আসার পর আমি মাথায় করে কয়েক দিন ঘুরাফেরা করি। গল্পটি নিয়ে ভাবি, চরিত্রগুলো নিয়ে খেলা করি। তবে এক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। একদিন অযথা বসে বসে ভাবছিলামÑ কী লেখা যায় তা নিয়ে। একটা লাইন মাথায় খেলে গেল। তারপর এই লাইটাকে কেন জানি কবিতায় না বলে গল্পের ভেতর দিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো। এক বসাতেই লেখা শেষ। তারপর ভাবতে থাকি। কী লিখলাম। মুহূর্তের লেখায় উত্তাপ থাকে। আবেগও কাজ করে। তাই লেখাটিকে দুই দিন জিইয়ে রাখলাম। তারপর জীবনানন্দের টাঙ্ক থেকে গল্পটি আবার বের করলাম। দেখলাম সামান্য মুদ্রণ প্রমাদ ও দু’একটা বাক্য পরিবর্তন ছাড়া খুব একটা কিছু করতে হয়নি। তাছাড়া গল্পটির আয়তনও খুব বেশি নয়। বলা যায় অনুগল্প থেকে একটু বড়ো গল্প, তবে বড় গল্প নয়।
গল্পপাঠ : শুরুতে কি থিম বা বিষয়বস্তু নিয়ে ভেবেছেন? না, কাহিনি কাঠামো বা প্লট নিয়ে ভেবেছেন?
অঞ্জন আচার্য : সত্যিকার অর্থে এতশত ভেবে আমি গল্পটি লিখিনি। থিম কী হবে তা আমার ভাবনার মধ্যে কোনো কাজ করেনি। আমি আসলে গল্পটিতে একটি ঘটনার কথা বলতে চেয়েছি। একটি মানুষের কথা বলতে চেয়েছি। কাহিনিটাও আমার হঠাৎ পাওয়া বলা যায়। লিখতে গিয়ে কাহিনি এগিয়ে গেছে। তবে বলার ভঙ্গির মধ্যে আমি টাইম অ্যান্ড স্পেস রাখিনি। এটা সচেতনভাবেই করেছি। কোনো একটি সময়ের মধ্যে আমি কাহিনিটিকে বন্দি করতে চাইনি।
গল্পপাঠ : গল্পটির চরিত্রগুলো কীভাবে এসেছে? শুরুতে কতগুলো চরিত্র এসেছিল? তারা কি শেষ পর্যন্ত থেকেছে? আপনি কি বিশেষ কোনো চরিত্রকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন? তাদের মধ্যে কি আপনার নিজের চেনাজানা কোনো চরিত্র এসেছে? অথবা কি কোনো চরিত্রের মধ্যে চলে এসেছেন?
অঞ্জন আচার্য : গল্পটির একটি মাত্র চরিত্রই কেবল মাথার মধ্যে খেলা করেছে। তার পাশাপাশি অন্যান্য চরিত্রগুলোও চলে আসে। গল্পটির শুরু যে জায়গা থেকে, শেষও সেখানে এসে। একটা দিনের একটা মুহূর্তের গল্প মাত্র। গল্পটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় একই চরিত্র ঘুরে ফিরে আসে। আমি মূলত একটি মেয়ের কথা লিখেছি এ গল্পে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে থাকা একটি মেয়ে। চেহারায় যার লাবণ্যতা নেই। কোনো ছেলে তার দিকে কখনো কোনোদিন দুইবার ফিরেও তাকায়নি। তার অন্য সব সুন্দরী বান্ধবীদের প্রত্যেকেরই প্রেমিক পুরুষ আছে। কেবল সেই মেয়েটির ছাড়া। শুরুতে দেখা যায় মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। এবং নিয়ে নানাজনে নানা কল্পনা-জল্পনা করছে। তার আত্মহত্যার পেছনে কোনো কারণ খুঁজে পায় না কেউ। তবে পুলিশ এসে যখন গলায় ফাঁস দেয়া মরদেহটি নামায় তখন মেয়েটির হাতে পিঠে একটি পুরুষের নাম চোখে পড়ে সবার। অবশেষে সকলে জানতে পারে। আগের রাতে টেলিভিশনে মুম্বাইয়ের ফিল্মস্টার অভিষেক বচ্চন ও ঐশরিয়া রাইয়ের বিয়ের খবর ফলাওভাবে প্রচার করা হয়েছিল। আর মেয়েটির হাতে লেখা ছিল অভিষেক বচ্চন, যা এতদিন তার কাছের বান্ধবীরা টের পায়নি। মূলত অভিষেকের ওপর অভিমান করেই মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে উল্লেখ থাকে সুইসাইড নোটে।
আমার চেনাজানা কেউ এমনটা করেছে বলে জানি না। তবে বিখ্যাত ফিল্মস্টারদের বিয়ের পর অনেক ছেলে-মেয়েকে, বিশেষ করে কিশোর বা তরুণ বয়সীরা অতি উৎসাহী হয়েই হোক, মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়েই হোকÑ আত্মবলি দেয়। এমন খবর অনেক পড়েছি খবরের কাগজে।
গল্পপাঠ : এ গল্পের দ্বন্দ্ব-সংঘাত কীভাবে নির্মাণ করেছেন?
অঞ্জন আচার্য : এটি অতি সাধারণ একটি গল্প মাত্র। তবে এর বয়নভঙ্গিতে আমি নানা আঙ্গিক ব্যবহার করেছি। পাঠককে ভাবার অবশন দিয়েছি। গল্পের মধ্যে অনেকগুলো স্পেস রেখেছি। যেকোনো পাঠক যেকোনো জায়গা থেকে দাঁড়িয়েই গল্পটি ভাবতে পারেন। দ্বান্দ্বিকতা কিংবা সাংঘষিকতা আমার বাক্য নির্মাণের মধ্য দিয়েই প্রকাশ করেছি।
গল্পপাঠ : গল্পের পরিণতিটা কি আগে থেকেই ভাবা ছিল?
অঞ্জন আচার্য : গল্পের শুরুতেই পরিণতিটা নিয়ে একরকম চিন্তাভাবনা তো ছিলই। তবে সেটা কীভাবে উপস্থাপন করবো তা নিয়েও চিন্তা করেছি অনেক। বলা যায়, অনেকটা রোলার কোস্টারে চড়ে বসে লেখা এটি। এত হিসেব করার সুযোগ দেয়নি। লেখা তার আপন গতিতে পরিণতিতে এসে ঠেকে যায়। আমি কেবল নীরব দর্শক হয়ে সেটা দেখে যাই।
গল্পপাঠ : গল্পটি কদিন ধরে লিখেছেন? এর ভাষাভঙ্গিতে কী ধরনের শৈলী ব্যবহার করেছেন?
অঞ্জন আচার্য : ওই যে বললাম, গল্পটি এক বসায় লেখা। বড় জোর ঘণ্টাখানিক সময় নিয়েছি। ফুস করে লেখা হয়ে গেল। ভাষার ক্ষেত্রে আমি ম্যাজিক রিয়েলিজম ব্যবহার করেছি। তবে আবার বলছি, সেটা মার্কেজ কিংবা শহিদুল জহিরের কাছ থেকে ধার করে নয়। তাদের লেখার স্টাইলের সাথে এ গল্পটির মিল অবশ্য আছে। তবে গল্প লেখার ক্ষেত্রে মার্কেজ বা জহির কোনোটাই মাথার মধ্যে কাজ করেনি। আমি কেবল অন্যভাবে গল্পটি বলতে চেয়েছিলাম। এক্ষেত্রে ম্যাজিক রিয়েলিজমকেই আমি বেছে নিয়েছি। কিংবা এভাবে বলতেই আমি পছন্দ করেছি। বলে রাখা ভালো, আমার অন্যসব গল্প কিন্তু এ ধাতের নয়। একটি একেক আঙ্গিকে লেখা। নিয়ত টেস্ট করে যাচ্ছি বিভিন্ন স্বাদের আইটেম। ভাঙতে ভাঙতে গড়ছি।
গল্পপাঠ : গল্পটিতে কি কিছু বলতে চেয়েছিলেন?
অঞ্জন আচার্য : নারীবাদীরা গল্পটিকে চরম নারী অবমাননাকর গল্প বলে যেমন খারিজ করে দিতে পারেন, গাল দিতে পারেন; তেমনি পুরুষবাদীরা এটা নিয়ে হাসি-তামাশাও করতে পারেন। আবার মানুষের অন্তর্নিহিত অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়েও ভাবতে পারেন কেউ কেউ। আমি সে বিতর্কে যাচ্ছি না। তবে কারো ভাবনাকেই আমি খাটো করেও দেখছি না। একটা নারীর কাছে তার স্বপ্নের পুরুষ যে কেউ হতেই পারে। তা সে ফিল্মস্টারই হোক, কিংবা ফুটপাতের দোকানদারই হোকÑ আমার সে নিয়ে আপত্তি নেই। আমি কেবল অতিবাস্তবতায় বাস করা একজন মানুষের কথা বলতে চেয়েছি, যাকে যে স্বচক্ষে কখনো দেখেনি। কেবল টিভি বা সিনেমার পর্দায় দেখা একজন মানুষকে নিজের সঙ্গী ভেবে বসবাস করা এক মানুষের কথা বলতে চেয়েছি। যে সঙ্গী অন্য কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে দেখে আত্মহত্যা করেছে।
গল্পপাঠ : গল্পটি লেখার পরে কি আপনি সন্তুষ্ট হয়েছেন? আপনি কি মনে করেন আপনি যা লিখতে চেয়েছিলেন, তা লিখতে পেরেছেন এই গল্পটিতে?
অঞ্জন আচার্য : গল্পটি লেখার পর মুহূর্তের ভালো লাগা তো কাজ করেছিলই, কিন্তু সেই ভালো লাগাকে আমি প্রশ্রয় দিইনি। লেখার ঘোরের ভেতরে থাকলে মস্তিষ্ক খুব অনুভূতিপ্রবণ, স্পর্শকাতর, আবেগ সর্বস্ব হয়ে ওঠে অনেক সময়। সেসময় অনেক কিছুকেই অনেক বড় কিছু মনে হতে পারে। অনেকটা গরম তরকারির সাথে তুলনা করা চলে। চুলা থেকে নামিয়েই লবণ টেস্ট করাটা যথাযথ হয় না। তবে শীতল হতে দিলে প্রকৃত স্বাদটা পাওয়া যায়।
আমি যেমনটা ভেবে রেখে এগিয়েছি তেমনটাই হয়েছে। আমার তো মনে হয় ভাবনার তুলনায় ভালোই হয়েছে।
গল্পপাঠ : এই গল্পটি পাঠক কেন পছন্দ করে বলে আপনার মনে হয়?
অঞ্জন আচার্য : একেকজনের পছন্দের কারণ, ধরন বা মাত্রা একেক রকম। তবে এ পর্যন্ত যাদের কাছ থেকে গল্পটির প্রশংসা পেয়েছি তারা এর বাচনভঙ্গির জন্যই পছন্দ করেছেন। কেউ কেউ প্রশংসা করেছেন গল্পটির মূল বিষয়বস্তুটিকে। একটি ঠুনকো, অহেতুক বিষয় নিয়ে মানুষ কি করে অফেরৎযোগ্য জীবনটাকে নিঃশেষ করে দিতে পারে-- তার জন্যও অনেকের কাছ থেকে নানা রিয়েকশান পেয়েছি। তবে কেউ কেউ মেয়েটির প্রতি করুণার্তও হয়েছেন। কখন কোন পরিস্থিতিতে একজন মানুষ তার জীবনটাকে উৎসর্গ করতে পারে তা বিশ্লেষণ করেছেন কেউ কেউ।
লেখক পরিচিত
অঞ্জন আচার্য
জন্ম : ময়মনসিংহ জেলার প্রাণকেন্দ্রে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষে নিয়োজিত আছেন সাংবাদিকতা পেশায়। বর্তমানে জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল পরিবর্তন-এ জ্যেষ্ঠ সহকারী বার্তা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন। পেশাগত জীবন শুরু হয় দৈনিক ভোরের কাগজ, প্রথম আলো, ইত্তেফাক পত্রিকায় কাজ করার মধ্য দিয়ে। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের গবেষণা সহকারী হিসেবে ‘জেন্ডার ও উন্নয়ন’ বিষয়ে কর্মরত ছিলেন দীর্ঘদিন। বাংলা ভাষার বিবর্তনের ওপর গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন বাংলা একাডেমিতে। লিখেন- কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ফিচার, সাহিত্য- সমালোচনা। প্রকাশিত বই- জলের উপর জলছাপ (কবিতা, শুদ্ধস্বর), আবছায়া আলো-অন্ধকারময় নীল (কবিতা, বিজয় প্রকাশ), রবীন্দ্রনাথ : জীবনে মৃত্যুর ছায়া (গবেষণা-প্রবন্ধ, মূর্ধন্য), জীবনানন্দ দাশের নির্বাচিত গল্প (সম্পাদনা, বিজয় প্রকাশ), পাবলো নেরুদার কবিতা সংগ্রহ (সম্পাদনা, বিজয় প্রকাশ), ধর্ম-নিধর্ম-সংশয় (যৌথ-সম্পাদনা, রোদেলা প্রকাশনী)।
অঞ্জন আচার্য : খুব কমই গল্প লিখেছি আমি। প্রকৃত পক্ষে কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ইত্যাদিই লেখা হয় বেশি। তবে যে কয়টা গল্প লেখা হয়েছে তার মধ্যে আমার পছন্দগত দুর্বলতা আছে “অতঃপর আত্মহত্যা ও তৎপরবর্তী সংবাদ বিরতি” গল্পটির প্রতি। পাঠক মহলে প্রশংসা পেয়েছি বলে নয়, এখন পর্যন্ত এইটাই আমার কাছে ভালো কাজ বলে মনে হয়। সেরা কাজ তো বলতে পারবো না। সেরার হিসেব নিকেষ তো কষা হয় অন্তিম লগ্নে। আমার তো কেবল সকাল।
গল্পপাঠ : গল্পটির বীজ কীভাবে পেয়েছেন?
অঞ্জন আচার্য : আমি ঠিক বলতে পারবো না এ গল্পটি আমার মাথায় কখন কীভাবে খেলে গেছে। গল্পটি পড়ার পর অনেকে এটিকে শহীদুল জহিরের গল্প বলার ধরনের সাথে তুলনা করেছেন। শহীদুল জহির আমি পড়েছি ঠিকই, তবে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমন গল্প লিখেছি, তা বলাটা নিজের ওপর অবিচার করা হবে। গল্পের বীজ আসলে লুকিয়ে থাকে আমাদের জীবনের গল্পের মধ্যেই। হুটহাট করে সেগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
গল্পপাঠ : গল্পের বীজটির বিস্তার কীভাবে ঘটলো?
অঞ্জন আচার্য : সাধারণত যা হয়, একটি গল্পের প্লট আসার পর আমি মাথায় করে কয়েক দিন ঘুরাফেরা করি। গল্পটি নিয়ে ভাবি, চরিত্রগুলো নিয়ে খেলা করি। তবে এক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। একদিন অযথা বসে বসে ভাবছিলামÑ কী লেখা যায় তা নিয়ে। একটা লাইন মাথায় খেলে গেল। তারপর এই লাইটাকে কেন জানি কবিতায় না বলে গল্পের ভেতর দিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো। এক বসাতেই লেখা শেষ। তারপর ভাবতে থাকি। কী লিখলাম। মুহূর্তের লেখায় উত্তাপ থাকে। আবেগও কাজ করে। তাই লেখাটিকে দুই দিন জিইয়ে রাখলাম। তারপর জীবনানন্দের টাঙ্ক থেকে গল্পটি আবার বের করলাম। দেখলাম সামান্য মুদ্রণ প্রমাদ ও দু’একটা বাক্য পরিবর্তন ছাড়া খুব একটা কিছু করতে হয়নি। তাছাড়া গল্পটির আয়তনও খুব বেশি নয়। বলা যায় অনুগল্প থেকে একটু বড়ো গল্প, তবে বড় গল্প নয়।
গল্পপাঠ : শুরুতে কি থিম বা বিষয়বস্তু নিয়ে ভেবেছেন? না, কাহিনি কাঠামো বা প্লট নিয়ে ভেবেছেন?
অঞ্জন আচার্য : সত্যিকার অর্থে এতশত ভেবে আমি গল্পটি লিখিনি। থিম কী হবে তা আমার ভাবনার মধ্যে কোনো কাজ করেনি। আমি আসলে গল্পটিতে একটি ঘটনার কথা বলতে চেয়েছি। একটি মানুষের কথা বলতে চেয়েছি। কাহিনিটাও আমার হঠাৎ পাওয়া বলা যায়। লিখতে গিয়ে কাহিনি এগিয়ে গেছে। তবে বলার ভঙ্গির মধ্যে আমি টাইম অ্যান্ড স্পেস রাখিনি। এটা সচেতনভাবেই করেছি। কোনো একটি সময়ের মধ্যে আমি কাহিনিটিকে বন্দি করতে চাইনি।
গল্পপাঠ : গল্পটির চরিত্রগুলো কীভাবে এসেছে? শুরুতে কতগুলো চরিত্র এসেছিল? তারা কি শেষ পর্যন্ত থেকেছে? আপনি কি বিশেষ কোনো চরিত্রকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন? তাদের মধ্যে কি আপনার নিজের চেনাজানা কোনো চরিত্র এসেছে? অথবা কি কোনো চরিত্রের মধ্যে চলে এসেছেন?
অঞ্জন আচার্য : গল্পটির একটি মাত্র চরিত্রই কেবল মাথার মধ্যে খেলা করেছে। তার পাশাপাশি অন্যান্য চরিত্রগুলোও চলে আসে। গল্পটির শুরু যে জায়গা থেকে, শেষও সেখানে এসে। একটা দিনের একটা মুহূর্তের গল্প মাত্র। গল্পটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় একই চরিত্র ঘুরে ফিরে আসে। আমি মূলত একটি মেয়ের কথা লিখেছি এ গল্পে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে থাকা একটি মেয়ে। চেহারায় যার লাবণ্যতা নেই। কোনো ছেলে তার দিকে কখনো কোনোদিন দুইবার ফিরেও তাকায়নি। তার অন্য সব সুন্দরী বান্ধবীদের প্রত্যেকেরই প্রেমিক পুরুষ আছে। কেবল সেই মেয়েটির ছাড়া। শুরুতে দেখা যায় মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। এবং নিয়ে নানাজনে নানা কল্পনা-জল্পনা করছে। তার আত্মহত্যার পেছনে কোনো কারণ খুঁজে পায় না কেউ। তবে পুলিশ এসে যখন গলায় ফাঁস দেয়া মরদেহটি নামায় তখন মেয়েটির হাতে পিঠে একটি পুরুষের নাম চোখে পড়ে সবার। অবশেষে সকলে জানতে পারে। আগের রাতে টেলিভিশনে মুম্বাইয়ের ফিল্মস্টার অভিষেক বচ্চন ও ঐশরিয়া রাইয়ের বিয়ের খবর ফলাওভাবে প্রচার করা হয়েছিল। আর মেয়েটির হাতে লেখা ছিল অভিষেক বচ্চন, যা এতদিন তার কাছের বান্ধবীরা টের পায়নি। মূলত অভিষেকের ওপর অভিমান করেই মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে উল্লেখ থাকে সুইসাইড নোটে।
আমার চেনাজানা কেউ এমনটা করেছে বলে জানি না। তবে বিখ্যাত ফিল্মস্টারদের বিয়ের পর অনেক ছেলে-মেয়েকে, বিশেষ করে কিশোর বা তরুণ বয়সীরা অতি উৎসাহী হয়েই হোক, মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়েই হোকÑ আত্মবলি দেয়। এমন খবর অনেক পড়েছি খবরের কাগজে।
গল্পপাঠ : এ গল্পের দ্বন্দ্ব-সংঘাত কীভাবে নির্মাণ করেছেন?
অঞ্জন আচার্য : এটি অতি সাধারণ একটি গল্প মাত্র। তবে এর বয়নভঙ্গিতে আমি নানা আঙ্গিক ব্যবহার করেছি। পাঠককে ভাবার অবশন দিয়েছি। গল্পের মধ্যে অনেকগুলো স্পেস রেখেছি। যেকোনো পাঠক যেকোনো জায়গা থেকে দাঁড়িয়েই গল্পটি ভাবতে পারেন। দ্বান্দ্বিকতা কিংবা সাংঘষিকতা আমার বাক্য নির্মাণের মধ্য দিয়েই প্রকাশ করেছি।
গল্পপাঠ : গল্পের পরিণতিটা কি আগে থেকেই ভাবা ছিল?
অঞ্জন আচার্য : গল্পের শুরুতেই পরিণতিটা নিয়ে একরকম চিন্তাভাবনা তো ছিলই। তবে সেটা কীভাবে উপস্থাপন করবো তা নিয়েও চিন্তা করেছি অনেক। বলা যায়, অনেকটা রোলার কোস্টারে চড়ে বসে লেখা এটি। এত হিসেব করার সুযোগ দেয়নি। লেখা তার আপন গতিতে পরিণতিতে এসে ঠেকে যায়। আমি কেবল নীরব দর্শক হয়ে সেটা দেখে যাই।
গল্পপাঠ : গল্পটি কদিন ধরে লিখেছেন? এর ভাষাভঙ্গিতে কী ধরনের শৈলী ব্যবহার করেছেন?
অঞ্জন আচার্য : ওই যে বললাম, গল্পটি এক বসায় লেখা। বড় জোর ঘণ্টাখানিক সময় নিয়েছি। ফুস করে লেখা হয়ে গেল। ভাষার ক্ষেত্রে আমি ম্যাজিক রিয়েলিজম ব্যবহার করেছি। তবে আবার বলছি, সেটা মার্কেজ কিংবা শহিদুল জহিরের কাছ থেকে ধার করে নয়। তাদের লেখার স্টাইলের সাথে এ গল্পটির মিল অবশ্য আছে। তবে গল্প লেখার ক্ষেত্রে মার্কেজ বা জহির কোনোটাই মাথার মধ্যে কাজ করেনি। আমি কেবল অন্যভাবে গল্পটি বলতে চেয়েছিলাম। এক্ষেত্রে ম্যাজিক রিয়েলিজমকেই আমি বেছে নিয়েছি। কিংবা এভাবে বলতেই আমি পছন্দ করেছি। বলে রাখা ভালো, আমার অন্যসব গল্প কিন্তু এ ধাতের নয়। একটি একেক আঙ্গিকে লেখা। নিয়ত টেস্ট করে যাচ্ছি বিভিন্ন স্বাদের আইটেম। ভাঙতে ভাঙতে গড়ছি।
গল্পপাঠ : গল্পটিতে কি কিছু বলতে চেয়েছিলেন?
অঞ্জন আচার্য : নারীবাদীরা গল্পটিকে চরম নারী অবমাননাকর গল্প বলে যেমন খারিজ করে দিতে পারেন, গাল দিতে পারেন; তেমনি পুরুষবাদীরা এটা নিয়ে হাসি-তামাশাও করতে পারেন। আবার মানুষের অন্তর্নিহিত অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়েও ভাবতে পারেন কেউ কেউ। আমি সে বিতর্কে যাচ্ছি না। তবে কারো ভাবনাকেই আমি খাটো করেও দেখছি না। একটা নারীর কাছে তার স্বপ্নের পুরুষ যে কেউ হতেই পারে। তা সে ফিল্মস্টারই হোক, কিংবা ফুটপাতের দোকানদারই হোকÑ আমার সে নিয়ে আপত্তি নেই। আমি কেবল অতিবাস্তবতায় বাস করা একজন মানুষের কথা বলতে চেয়েছি, যাকে যে স্বচক্ষে কখনো দেখেনি। কেবল টিভি বা সিনেমার পর্দায় দেখা একজন মানুষকে নিজের সঙ্গী ভেবে বসবাস করা এক মানুষের কথা বলতে চেয়েছি। যে সঙ্গী অন্য কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে দেখে আত্মহত্যা করেছে।
গল্পপাঠ : গল্পটি লেখার পরে কি আপনি সন্তুষ্ট হয়েছেন? আপনি কি মনে করেন আপনি যা লিখতে চেয়েছিলেন, তা লিখতে পেরেছেন এই গল্পটিতে?
অঞ্জন আচার্য : গল্পটি লেখার পর মুহূর্তের ভালো লাগা তো কাজ করেছিলই, কিন্তু সেই ভালো লাগাকে আমি প্রশ্রয় দিইনি। লেখার ঘোরের ভেতরে থাকলে মস্তিষ্ক খুব অনুভূতিপ্রবণ, স্পর্শকাতর, আবেগ সর্বস্ব হয়ে ওঠে অনেক সময়। সেসময় অনেক কিছুকেই অনেক বড় কিছু মনে হতে পারে। অনেকটা গরম তরকারির সাথে তুলনা করা চলে। চুলা থেকে নামিয়েই লবণ টেস্ট করাটা যথাযথ হয় না। তবে শীতল হতে দিলে প্রকৃত স্বাদটা পাওয়া যায়।
আমি যেমনটা ভেবে রেখে এগিয়েছি তেমনটাই হয়েছে। আমার তো মনে হয় ভাবনার তুলনায় ভালোই হয়েছে।
গল্পপাঠ : এই গল্পটি পাঠক কেন পছন্দ করে বলে আপনার মনে হয়?
অঞ্জন আচার্য : একেকজনের পছন্দের কারণ, ধরন বা মাত্রা একেক রকম। তবে এ পর্যন্ত যাদের কাছ থেকে গল্পটির প্রশংসা পেয়েছি তারা এর বাচনভঙ্গির জন্যই পছন্দ করেছেন। কেউ কেউ প্রশংসা করেছেন গল্পটির মূল বিষয়বস্তুটিকে। একটি ঠুনকো, অহেতুক বিষয় নিয়ে মানুষ কি করে অফেরৎযোগ্য জীবনটাকে নিঃশেষ করে দিতে পারে-- তার জন্যও অনেকের কাছ থেকে নানা রিয়েকশান পেয়েছি। তবে কেউ কেউ মেয়েটির প্রতি করুণার্তও হয়েছেন। কখন কোন পরিস্থিতিতে একজন মানুষ তার জীবনটাকে উৎসর্গ করতে পারে তা বিশ্লেষণ করেছেন কেউ কেউ।
লেখক পরিচিত
অঞ্জন আচার্য
জন্ম : ময়মনসিংহ জেলার প্রাণকেন্দ্রে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষে নিয়োজিত আছেন সাংবাদিকতা পেশায়। বর্তমানে জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল পরিবর্তন-এ জ্যেষ্ঠ সহকারী বার্তা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন। পেশাগত জীবন শুরু হয় দৈনিক ভোরের কাগজ, প্রথম আলো, ইত্তেফাক পত্রিকায় কাজ করার মধ্য দিয়ে। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের গবেষণা সহকারী হিসেবে ‘জেন্ডার ও উন্নয়ন’ বিষয়ে কর্মরত ছিলেন দীর্ঘদিন। বাংলা ভাষার বিবর্তনের ওপর গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন বাংলা একাডেমিতে। লিখেন- কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ফিচার, সাহিত্য- সমালোচনা। প্রকাশিত বই- জলের উপর জলছাপ (কবিতা, শুদ্ধস্বর), আবছায়া আলো-অন্ধকারময় নীল (কবিতা, বিজয় প্রকাশ), রবীন্দ্রনাথ : জীবনে মৃত্যুর ছায়া (গবেষণা-প্রবন্ধ, মূর্ধন্য), জীবনানন্দ দাশের নির্বাচিত গল্প (সম্পাদনা, বিজয় প্রকাশ), পাবলো নেরুদার কবিতা সংগ্রহ (সম্পাদনা, বিজয় প্রকাশ), ধর্ম-নিধর্ম-সংশয় (যৌথ-সম্পাদনা, রোদেলা প্রকাশনী)।
0 মন্তব্যসমূহ