১
'আমার নাম রুহুল। রহুল কুদ্দুস।'
'ও আচ্ছা। ভাল কথা।'
'আমরা একই ক্লাসে পড়ি।'
'ওহ তাহলে তুমি আমার ক্লাসমেট। আমার নাম রাদিয়া।'
'জানি। তোমার নাম রাদিয়া। তুমি মগ বাজার থাকো। তোমার ফোন নাম্বার ৮৩৪৯২৩।'
'কী ব্যাপার, আমার সম্পর্কে এতো কিছু জানলে কি করে?'
'ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেরা আড্ডায় বসলে ঘুরেফিরে ক্লাসের মেয়েদের কথা উঠবে। এবং এইসব তথ্য এতোবার শুনতে হয়েছে যে না চাইতেই মুখস্থ হয়ে গেছে। অন্যকিছু না। নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবার দরকার নেই।'
'আমি নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবছি?'
'তুমি একা না, তোমার বয়সী সব মেয়েই এমনটা ভেবে থাকে। বিশেষ করে কোন ছেলে যখন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসে তখন এই ভাবনাটা আরও বেড়ে যায়।'
'এ কথাগুলো বলার জন্য কি তুমি আমার সাথে পরিচিত হলে?'
'না, এসব কথার কথা। আসলে কিছুক্ষণ পর পরই দুজনের মধ্যে এতো চোখাচোখী হচ্ছিল যে মনে হলো আমাদের পরিচিত হওয়া দরকার।'
'তুমি বলতে চাচ্ছ, আমি বার বার তোমার দিকে তাকাচ্ছিলাম? মোটেই না।'
'ও হো সরি। আমি জানতাম না যে তুমি কিছুটা লক্ষীট্যারা।'
রাদিয়ার বিস্ফোরিত দৃষ্টিসীমার মধ্যে থেকে রুহুল দ্রুত সরে যায়। তাদের দুজনের পরিচয়ের শুরুটা ছিল একদম এইরকম।
২
এই ঢাকা শহরে কোন একসময় রুহুল আর রাদিয়া বাস করতো। তারা একই সাথে এই শহরের কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো,
একই বিভাগে। সেই সূত্রে তারা ছিল সহপাঠী। শুধুই সহপাঠী;
বন্ধু নয়। আবার শত্রুও নয়। এমন কেউ ছিল না যে দুজনেরই বন্ধু। তাই ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে কিংবা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তারা কখনও একসাথে আড্ডা দেয়নি, ক্যাফেটেরিয়ায় চা পান করেনি, শর্ট-ফিল্ম দেখতে পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে যায়নি বা একত্রে
ঘুরতেও বের হয়নি।
তারপরও উল্টোদিক থেকে আসবার মুখে,
পথে কিংবা করিডোরে হঠাৎ হঠাৎ তাদের দেখা হয়ে যেত। মাঝের বিরতিটুকু হতো কখনও একমাসের, কখনওবা তিনমাসের। আর দেখা হলেই তারা মেতে উঠতো কথোপকথনে।
৩
“তোমার সাথে রুহুল কুদ্দুস নামটা একদমই খাপ খায় না।”
“নামটা আমার মতো হ্যান্ডসাম না বলে?”
“হয়তোবা।”
“জান রুহুল কুদ্দুস আসলে কে?”
“ঘাটের মরা?”
“ওহ নো!
রুহুল কুদ্দুস হচ্ছেন একজন বিখ্যাত প্রহরী।”
“কোথাকার? মোগলদের হারেমের?”
“ওহ নো!
বেহেস্তের। চিন্তা করে দেখ নামের বরকত যদি ফলে যায় তাহলে আমার অবস্থান কোথায় থাকবে।”
“বেহেস্তের মধ্যে না থেকে বাইরে থাকবে। এটাতে এতো উচ্ছ্বসিত হওয়ার কি আছে?”
“দেখ কলির মধ্যেই সব রহস্য সঞ্চিত থাকে। হতে পারে সেটা কৌতূহল, রোমান্স, উত্তেজনা, আশা, স্বপ্ন কিংবা স্বপ্নভগ্ন। ফুল মানেই তো সব রহস্যের অবসান। ঠিক তেমনি প্রহরী হয়ে দ্বার খুলে একটু উঁকি-ঝুঁকি মারার মধ্যেই আসলে আনন্দ বেশি।”
“তুমি তো দেখি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার ভাব বদলে দিচ্ছ। ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটিতে গেটের ভেতর ঢুকতে দেয়নি বলে একটা বাচ্চা ছেলে খুব দুঃখ পেয়েছিল। মনে নেই?”
“সেসময় নির্ঘাত সুনীলের দৃষ্টি খুব গরিবি ছিল। আমি কি আর কাঠি-লজেন্সের আশায় আছি? যতবারই বেহেস্তের দ্বার খুলবো ততবারই অপরূপ হুরীদের দেখা পাব। আর প্রতিবারই নতুন করে প্রেমে পড়বো।”
“ব্যাস, প্রেমে পড়া পর্যন্তই? প্রেম করার ইচ্ছে নেই?”
“হুরদের সাথে প্রেম করতে যাব কোন দুঃখে? একে তো হাজার বছরের বুড়ী তার উপর আবার মানুষ না, অন্যজাত। সিস্টেম কেমন কে জানে?”
রাদিয়া উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। সে হাসি একসময় ঢেউ ভাঙা ফেনার বেলাভূমিতে মিশে যাওয়ার মতো মিলিয়ে যায়। তারপর সেই কণ্ঠস্বর জেগে উঠে বললো,
“সিস্টেম নিয়ে তোমার অতো ভয় পাওয়ার কি আছে? জান না প্রহরীরা খোজা হয়।”
“তুমি জানতে চাও কতোটা পুরুষ আমি?”
এবার সেই কণ্ঠস্বর কিছুক্ষণের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়ে। স্তব্ধ হয়ে যায়। ভেতরে কি একটা জানি জেগে উঠে। বুঝতে পারে ইচ্ছে করছে খুব নারী হতে।
৪
বিশ্ববিদ্যালয় ভবনটার সামনের পথটা ছিল পীচ-ঢালা মসৃণ। তার দুপাশে সটান দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধ দেবদারু গাছ। দেবদারু গাছে নিশাচর বাদুরেরা বাসা বাঁধে। রাত হলে তারা মশা খেতে বের হয়। দিনের বেলা পাতার আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রেখে ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে ঘুমুতে থাকে। সে পথ দিয়ে চলতে চলতে রুহুল আর রাদিয়ার হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যেত। সে পথ, দেবদারু গাছ আর আধা ঘুমন্ত বাদুরদের কেউ কেউ তার সাক্ষী হয়ে থাকবে। প্রথম প্রথম তারা খুব কৌতূহলী হয়ে উঠতো। এখন এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ফী বছর এইরকম রুহুল আর রাদিয়ারা চলতে চলতে থমকে দাঁড়ায়। আর খুব অনায়াস কথোপকথনে মেতে ওঠে।
৫
“শুভ বসন্ত। আজ তোমাকে দেখে বুঝলাম এবার বুঝি সত্যি সত্যিই ফাগুন এসেছে।”
“আমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে বলে?”
“হয়তোবা। শাড়িটা খুব সুন্দর। গাঁদা বা ডালিয়ার মতো ঠিক পরিচিত কোন ফুল নয় – অন্য একটি নাম না জানা ফুলের কথা মনে করিয়ে দেয়।”
“সব প্রশংসা তাহলে শাড়ির। আমার জন্য কিছু বরাদ্দ নেই?”
“আছে। তবে তা পেতে হলে ট্যাক্স দিতে হবে।”
“কি ট্যাক্স চাও?”
“একসাথে বিগ বাইটে যাব। বার্গার খাব। আর খাওয়ার শেষে বিলটা তোমাকে দিতে হবে।”
“ওহ বিগ বাইট! নতুন এই রেস্টুরেন্টটায় মুন্নি একবার নিয়ে গিয়েছিল ওর জন্মদিনে। কিন্তু খাবারের যা দাম! সাজতে গিয়ে সব পয়সা শেষ হয়ে গেছে।”
“ঋণ খেলাপি তাহলে শুধু বড়লোকেরাই নয়, সুন্দরীরাও।”
“আমাকে দেখে মুগ্ধ হলে তো তুমি। আমার তো ট্যাক্স ব্রেক পাবার কথা। তাও ঠিক না। উলটো আমাকে তোমার ট্যাক্স দেবার কথা।”
“গুড পয়েন্ট। চল তাহলে।”
“আজকেই যাব? অন্য আরেকদিন গেলে হয়না? এই যেমন ধরো যেদিন পাখী-টাখী গাইবে, ফুল-টুল ফুটবে, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে। এমন কোনদিনে না হয় যাই?”
“আচ্ছা তোমরা নারী জাতিরা এতো ড্যামি কেন বলতো?”
“রুহুল, এটা কিন্তু তোমার খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। পুরো নারীজাতিকে অসম্মান। আমরা কোথায় ড্যামি হলাম?”
“মুখস্থ করে করে পরীক্ষা দাও ভাল কথা। রোমান্টিক ডায়লগও মুখস্থ বলতে হবে? এইমাত্র শীর্ষেন্দুর ‘যাও পাখী’ কপচালে। তাই না? আমার বসন্তটাই মাটি।”
“বসন্ত তোমার না, আমার মাটি। আমরা খালি মুখস্থ করি – এই ধারণা তোমার নারীজাতি সম্পর্কে। যাও তোমার সাথে আমি আর কথা বলবো না।”
হাই-হিলের গট-গট শব্দে পথ উত্তপ্ত হয়ে উঠে। শব্দ-সংবেদনশীল দু-একটা বাদুরের ঘুম ভেঙে যায়। দেবদারু গাছ থেকে টুপটুপ করে কয়েকটা পাতা ঝরে। পথ চলতে চলতে রাদিয়া ওর হাঁটার গতি শ্লথ করে। আশা করে শেষ মুহূর্তে পেছন থেকে কেউ ওর নাম ধরে ডাকবে। তা আর হয় না। দুজনে দুদিকে চলে যায়। কয়েকটা দেবদারু গাছ, আধা-ঘুমন্ত বাদুর আর পীচ-ঢালা মসৃণ পথ শুধু তা চেয়ে চেয়ে দেখে।
৬
রুহুল আর রাদিয়ার কখনই একসাথে ঘোরা হয়ে উঠেনি। বছরে তাদের পাঁচ-ছয়বারের বেশি দেখাও হয়তো হয়না। তা না হলেও তারা জানে যে আরেকজন আছে। খুব কাছেই আছে। চাইলেই দেখতে পাওয়া যাবে। শুধু এই চাওয়াটুকুতেই আনন্দ। আর দেখা হলেই তারা কথোপকথনে মেতে উঠে। তারা ফ্লার্ট করে, ঝগড়া করে, হাসিঠাট্টা করে আর নিজেদের মধ্যে কিছু একটা গোপন করে। তাদের কথোপকথন খুব স্বচ্ছন্দ। কাকচক্ষু দিঘির পানির মতো স্বচ্ছ এবং গভীর। তবে বড়ই আলগা-পলকা। পানিতে দাগ কাটার মতো সেখানে কিছু দানা বাঁধে না। দুর্বল নক্ষত্র কোন গ্রহের জন্ম দিতে পারে না। মাঝে মধ্যে কিছু উল্কা ছিটকে বেড়িয়ে পড়ে। তাই এই কথোপকথন ঘিরে জন্ম নেওয়া আকর্ষণ, অভিমান, ভালোলাগা এবং প্রেমবোধের মতো কিছু কিছু অনুভূতিরা ক্রমশ উল্কার মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এভাবেই গড়ায় সময় । মাস গড়িয়ে বছর। বছর গড়িয়ে ছাত্রজীবনের সমাপ্তি।
রুহুল আর রাদিয়ার আর এক পথ দিয়ে হাঁটা হয়না। আগেকার সেই দৃষ্টিসীমা-দূরত্ব এখন অসীম, অজানা। তারা কখনও বন্ধু ছিল না, শত্রুও না। আবার একে অন্যের কেউ নয় সেটাও বলা যায় না। হয়তো এই সম্পর্কের নাম কথোপকথন। কিছু শব্দ। আর তাকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া কিছু বুদবুদ অনুভূতি।
তারপরও রাদিয়ার অতিথি তালিকায় রুহুলের নাম লেখা হয়। এর ওর কাছ থেকে ফোন নাম্বারে জোগাড় করে রাদিয়া একদিন রুহুলের বাসায় ফোনও করে।
৭
“আহা দিলি তো মনটা ভেঙ্গে। এতদিন তোর আশায় আশায় ছিলাম।”
“সময় যখন ছিল তখন বললি না কেন?”
“সব মেয়েই একই কথা বলে।”
“সব মেয়ে মানে? এই কথা তুই আর কতজনকে বলেছিস?”
“বেশি না মাত্র একজন। আমার স্কুলের বান্ধবী। গত সপ্তাহে ওর বিয়ে ছিল। প্রথমে যাব না ভেবেছিলাম। কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে? তারপরও গেলাম। বিয়েবাড়ির জর্দার স্বাদই আলাদা।”
“তোর মতো টাংকিবাজের কপালে কখনও বৌ জুটবে না। আগামী মাসে আমার হলুদ আর বিয়েতে এসে ইচ্ছে মতোন জর্দা খেয়ে যাস।”
রাদিয়া আবিষ্কার করে দূরত্ব তাদের কাছে এনে দিয়েছে। সম্পর্কটাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তারা একে অন্যকে তুই-তোকারি করতো।
কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
৮
“কিরে এতো রাতে ফোন! খবর সব ভালো তো?”
“খুব তো বলেছিলি আজকে সন্ধ্যায় আমার হলুদের অনুষ্ঠানে আসবি। তোকে না দেখে ভাবলাম একটু খোঁজ নিয়ে দেখি সব ঠিক আছে কিনা।”
“যাক বাবা বাঁচালি। আমি তো ভেবেছিলাম তোর বিয়ে ভেঙে গেছে। এখন এই রাত-বিরেতে উদ্ধার করার জন্য কাকুতি-মিনতি করবি।”
“শকুনের দোয়ায় গরু মরে না।”
“শকুনের দোয়ায় মরে না তবে মৌলবির দোয়ায় মরে। ঠিক মরে না;
কোরবানি হয়। তোর জন্য খুব দুঃখ হচ্ছেরে। আর চব্বিশ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে একদম কোরবানি হয়ে যাবি। তার থেকে শকুনের দোয়ায় মরাও ভাল ছিল।”
“দুষ্টামী রাখ। আজ আসিসনি কেন?”
“দেবদাসগিরিতে মজে আছি। তাই আসতে পারিনি।”
“এ কেমন দেবদাস যে পার্বতীর মৃত্যু কামনা করে?”
“শরৎবাবু ছাড়া খুব কম বাঙ্গালির মাথা এটা বোঝার মতো ক্ষমতা রাখে। হয় এ মরবে, নয়তো ও মরবে। ব্যাপারটা হচ্ছে টিলো-এক্সপ্রেস খেলার মতো।”
“তুই সত্যি সত্যিই দেবদাস হয়ে গেলে খুব খারাপ লাগবে রে। শরৎবাবুর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী আবার ছাইপাঁশ গিলতে বসিস না। বরং কাল এসে আমার বিয়ের জর্দা খেয়ে যাস।”
“দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে বলছিস? তাই’ই তো এখন করে যাচ্ছি। ডিভিডির বোতাম টিপে চন্দ্রমুখীর নাচ দেখছি।”
“ফুলের থেকে কলিই না তোর বেশি পছন্দের ছিল? হঠাৎ সব বদলে গেল যে?”
“তখন কি আর ভেবেছিলাম, যে সময় এতো দ্রুত ফুরিয়ে আসবে?
আর মাত্র একটা রাত। তারপরই সব শেষ।”
“কি শেষ?”
“তোকে পাবার আশা শেষ।”
“জীবনটা ড্রেস রিহার্সাল না। লেইট লতিফদের জন্য স্টেশনে ট্রেন আজীবন থেমে থাকে না।”
“একটা আবদার করতে ইচ্ছে করছে। ধরে নে তোর কাছে এটাই আমার প্রথম এবং শেষ চাওয়া। রাখবি আমার আবদারটা?”
“যদি কাল আসিস তাহলে রাখবো?”
“আমাকে এতো আসতে বলছিস কেন?”
“জানিনা। কেন জানি তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। তোর শেষ ইচ্ছেটা কি?”
“তোকে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। ছোট্ট একটা চুমু। আলতো করে। এখনই এসে খেয়ে চলে যাব। তোর বর কিচ্ছু বুঝতে পারবে না।”
“আয়। তবে চুমু না একটা থাপ্পড় খাবি।”
৯
“যাক বাবা, অনেক কষ্টে তোর পাশে বসার জায়গা পেলাম। বিয়ের আসরে বৌরা তো দেখি দেশের প্রধানমন্ত্রীর থেকেও ভিআইপি প্রটোকল পায়। তবে জর্দার বদলে আইসক্রিম দেখে বড়ই দুঃখ পেলাম।”
“এই তোর দেবদাসগিরি? পার্বতীর থেকে জর্দার দুঃখ বড় হয়ে গেল?”
“নারে সত্যিই বড় দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে এসেছিলাম। কিন্তু তোর বরকে দেখে মনটা ভাল হয়ে গেল।”
“কেন?”
“বেশ মোটা। আমি তার থেকে অনেক হ্যান্ডসাম।”
“মোটেই মোটা না। মাথার পাগড়িটা টিপু সুলতান মার্কা হয়ে গেছে বলে মোটা দেখাচ্ছে। এই ভিডিও ক্যামেরাম্যান আসছে। আমাকে এখন বৌ বৌ ভাব করতে হবে। পাশ থেকে তুই কোন কথা বলিস না।”
১০
সময় বয়ে যায়। সেলফোন ক্রমশ তার আভিজাত্য হারিয়ে মোর্শেদ খান থেকে রিকশাচালকের হাতেও উঠে আসে। প্রধান প্রধান ব্যস্ত সড়কের দুপাশ বিপনীবিতানে ভরে উঠে। একতলা-দোতলা বাড়িগুলো ভেঙ্গেচুরে আটতলা-বারতলা বিল্ডিং হয়ে যায়। শহরের রাস্তাগুলোতে সকাল-সন্ধ্যা সার বেঁধে রঙ-বেরঙের প্রাইভেট গাড়িরা চলতে থাকে। ধীরে ধীরে সবকিছু বদলে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের সামনের পরিচিত পথটা আর আগের মতো মসৃণ নেই। দেবদারু গাছগুলো অনেক বড় হয়ে গেছে। এখনো সেখানে অনেক বাদুর ঝোলে। তবে এখন তাদের অখণ্ড অবসর। অন্তর্জালের পোয়াবারো। হঠাৎ হঠাৎ কথোপকথন এখন সব চ্যাট বাক্সে চলে গেছে।
পরিচিত শহরটা দিন দিন অপরিচিত হয়ে যাচ্ছে। ভারী হয়ে পড়ছে। তারপরও এ শহরটা ছেড়ে বেশিদিন কোথাও থাকতে পারে না রাদিয়া। ঘুরেফিরে পরিচিত জায়গাগুলো খুঁজে বেড়ায়। পিংক সিটি, বসুন্ধরা কমপ্লেক্সে মন ভরে না। প্রায়ই ছুটে যায় গাউছিয়াতে। সেখানে ফ্লেমিঙ্গোর চটপটির স্বাদ এখনও আগের মতোই আছে। স্বামী, সন্তান, সংসার, স্কুলের চাকরি – সব মিলিয়ে এ শহরের মতোই ব্যস্ত জীবন তার। আর অবসরতো ভরে থাকে দোকানে ঘোরা, কেনাকাটা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, পারসোনা আর ফিগারিনায় ছোটা, নিত্য-নতুন রান্না শেখা, ঘুরে বেড়ানো, টেলিভিশন কতো কিছুতে। সব মিলিয়ে ভালই আছে রাদিয়া। যতটুকু ভাল থাকলে মানুষকে একঘেয়েমিতে পেয়ে বসে ঠিক ততটুকু ভাল আছে সে। এই একঘেয়েমিটা যখন মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায় তখন সে নতুন কোন রান্নার ক্লাসে ভর্তি হয়। এবার সে সাউথ ইন্ডিয়ান রান্না শিখছে। দোসা, সাম্বার আর নারকেলের চাটনি খাওয়ার জন্য একদিন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরনো বন্ধু-বান্ধবীদের দাওয়াত দিল।
১১
কিন্তু দাওয়াতের একমাস আগেই হঠাৎ একদিন তার মেইল বক্সে একটি ইমেইল আবিষ্কার করে সে। কম্পিউটারের
সাথে রাদিয়ার কখনও সখ্য ছিল না। সেই দশ
বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কম্পিউটার ল্যাবে একটি ইমেইল খুলেছিল,
এখনও সেটাই আছে। মাঝে মাঝে সেখানে সহপাঠীদের খোঁজ পাওয়া যায়। ইন-বক্সে একটি ইমেইলে প্রেরকের নাম রুহুল। প্রায় চার মাস আগে পাঠানো
ইমেইল। এতদিন পর সেই রুহুল। সেই কথোপকথনের সম্পর্ক। রাদিয়ার বিয়ের পর আর কোনদিন রুহুলের সাথে দেখা হয়নি। কোনরকম যোগাযোগও নেই। শুনেছে সে দুবাই চলে গেছে। সেখানেই একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল দিয়েছে।
কাঁপা হাতে রাদিয়া ইমেইলটা খোলে।
“প্রতিবছর
বসন্ত আসলে,
প্রথমেই তোমার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে,
এক বসন্তে আমি তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। সেই থেকে বসন্ত, প্রেম আর তুমি মিলে মিশে একাকার। আজ এতো বছর পরে কেন জানি তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কোথায় আছো জানিও। আসছে বসন্তে আমাদের দেখা হবে।”
১২
উত্তেজনার চোটে রুহুলের ইমেইলের উত্তর দিতে রাদিয়ার কয়েকদিন সময় লেগে যায়। কি লিখবে সে? ‘এসো, দেখে যাও কেমন আছি,’ নাকি লিখবে-
‘গাঁদা কিংবা ডালিয়া নয় – অন্যরকম একটি ফুল দিয়ে তোমায় সম্ভাষণ দেবার অপেক্ষায় রইলাম,’।
অর্ন্তজাল এক বিরাট ভুল-ভুলাইয়া। পত্র পাঠিয়ে নিস্তব্ধ সময় পার করতে হয়। উত্তর আর আসে না। দিন যায়। সপ্তাহ যায়। উত্তর আসে না। রাদিয়া আবার ইমেইল পাঠায়। কিছুদিন পর আবারও।
১৩
পুরনো বন্ধুরা একসাথে হওয়া মানেই তুমুল আড্ডা। কতো কথা। কতো স্মৃতি। কতো হাসি-ঠাট্টা। অনেকের অজানা তথ্য জানা হতে থাকে। এক সময় রুহুলের কথা উঠে। অনেকদিন ধরেই তার সাথে কারো যোগাযোগ নেই। দুবাই থেকে নাকি জার্মানি চলে গিয়েছিল। সেখানে এক জার্মান মহিলাকে বিয়েও করেছিল। সে সংসারও বেশিদিন টেকেনি। এরপর সে দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে যায়। সেখানে নাকি এক কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। হঠাৎকরেই রাদিয়ার মনটা ভারী হয়ে উঠে। ঠিক ঢাকা শহরের মতো।
অস্ফুট স্বরে সে শুধু জিজ্ঞেস করে, “কবে?”
“একবছর আগে শুনেছিলাম।”
রাদিয়া মনে মনে হিসেব কষে দেখে রুহুলের ইমেইলটা এসেছিল ছয়মাস আগে। রাদিয়া চুপচাপ ইমেইলের কথা গোপন রাখে।
১৪
সবকিছুই আগের মতো আছে। ঢাকা শহর। গাউছিয়া মার্কেট। ফ্ল্যামিঙ্গোতে চটপটির স্বাদ। ভোরের আযান। শুধু রাদিয়া বদলে গেছে। দু লাইনের ছোট্ট একটা ইমেইল ব্লটিং পেপারের মতো রাদিয়ার সবটুকু একঘেয়েমি শুষে নিয়েছে। রুহুল-রহস্য-প্রতীক্ষা সবকিছু মিলেমিশে ছায়ার মতো অস্ফুষ্ট একটা অশরীরী অবয়ব মাঝে মাঝে খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
লেখক পরিচিতি
ওয়াহিদা নূর আফজা
লেখক পরিচিতি
ওয়াহিদা নূর আফজা
জন্ম সালঃ ৩০শে জানুয়ারি
জন্মস্থানঃ ঢাকা, বাংলাদেশ
বর্তমান আবাসস্থলঃ ফ্রীমন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া.
পেশাঃ তড়িৎ প্রকৌশলী
প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস লেখেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ : কিন্নরকণ্ঠী নদী, বিতংস, ঘরট্ট
প্রাপ্ত পুরস্কার: কথাসাহিত্যে কালি ও কলম পুরষ্কার'২০১৩
http://www.cadetcollegeblog.com/author/noorafzaইমেইল-ঠিকানা দেবেনঃ wahidaafza@gmail.com
জন্মস্থানঃ ঢাকা, বাংলাদেশ
বর্তমান আবাসস্থলঃ ফ্রীমন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া.
পেশাঃ তড়িৎ প্রকৌশলী
প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস লেখেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ : কিন্নরকণ্ঠী নদী, বিতংস, ঘরট্ট
প্রাপ্ত পুরস্কার: কথাসাহিত্যে কালি ও কলম পুরষ্কার'২০১৩
http://www.cadetcollegeblog.com/author/noorafzaইমেইল-ঠিকানা দেবেনঃ wahidaafza@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ