পাঁচ ফুট পাঁচের মতো হাইট, ফর্সা রং, বোঝাই যাবে না উনিই বড় সায়েব। অমিয় চন্দ বলল।
দেখেছিস সায়েবকে?
না, শুনলাম খুবই সাধারণ, চেনা যাবে না পাঁচ জনের ভিড়ে। অমিয় বলল।
কে দেখেছে?
এ-ব্লকের শ্যামাদাস।
ও দ্যাখেনি, পাঁচ পাঁচ নয়, পাঁচ সাত হবে, ফর্সা নয়, আধময়লা রং।
অমিয় জিজ্ঞেস করল, আপনি দেখেছেন?
না, শুনেছি তাই, যে কোনও দিন অফিসে চলে আসতে পারেন।
অমিয় চন্দ বলল, একেবারে দশটা বাজতে পাঁচে ঢুকে পড়ছেন, কেউ ধরতেই পারছে না বড় সায়েব ঢুকেছেন।
হুঁ! চিন্তিত মুখে হেড ক্লার্ক সদানন্দ রায় বলল, সাড়ে পাঁচটাতেও ঢুকছেন, আগে যেখানে ছিলেন সেখানে নাকি ছ’জনের চাকরি নষ্ট হয়েছে, চার জন সাসপেনশনে আছে।
অমিয় চন্দ চুপ করে থাকল কিছু সময়, তার পর বলল, তবে ভাল কাজ করলে উনি তাদের দ্যাখেন, অ্যাডমিনিষ্ট্রেটর হিসেবে খুবই কড়া।
সদানন্দ রায় হাসে, সিগারেট ধরিয়ে বলে, তিরিশ বছরে এমন কত দেখেছি।
অমিয় কুণ্ঠিত স্বরে বলল, আমি আবার পিটিশন দিচ্ছি, টাকাটা যদি বাড়ে।
কোনও লাভ হবে কি? তবে হতেও পারে, চেষ্টা করো।
অমিয় একটু দমে যায়। মাসে আড়াই হাজারের মতো পায়। কম্পিউটর অপারেটর। কাজ করলে টাকা, ছুটি বলতে কিচ্ছু নেই। আবার সোম থেকে শুক্রর ভিতরে যদি ছুটি পড়ে, তার লোকসান। টাকা নেই। সদানন্দরা পাকা চাকুরে। কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে এই আড়াই তিন পেত। অমিয় ছ’মাস ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে তার চুক্তিটা বদল হোক। থোক টাকা হাজার ছয়ের মতো দিক কর্তৃপক্ষ। আর তা মঞ্জুর করতে পারেন সর্বোচ্চ পদের উপরওয়ালা। এখন তিনি পাঁচ ফুট পাঁচ, সাধারণ চেহারা। অতি সাধারণ অমিয়র কথা কি তিনি ভাববেন না? অমিয়র দরখাস্ত এই অফিস রেকমেণ্ড করে পাঠালে, সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে তিন প্রস্ত উপরওয়ালা হয়ে নতুন বড় সায়েবের কাছে পৌঁছলে, তাঁর কলমের খোঁচায় কপাল খুলে যেতে পারে। এর আগে বার দুই অবশ্য উপর পর্যন্ত দরখাস্ত পৌঁছে আবার নীচে নেমে এসেছিল আশ্বাসবাণী সহ। বিবেচনা করে দেখা হবে। কাজের কাজ কিচ্ছু হয়নি।
অমিয় খুব মন দিয়ে কাজ করে। দক্ষ। কম্পিউটরের নানা গোলমাল সে-ই সামাল দেয়। ডাটা এন্ট্রি করতে করতে অফিসের কাজও শিখে গেছে সে। সদানন্দ রায় বা অন্য কারও কারও কাজের ভুলও কম্পিউটরে এন্ট্রির সময় অমিয় সংশোধন করে দেয়। নানা চিঠির বয়ানও সে নিজে তৈরি করে। তা হলে তার প্রার্থনা মঞ্জুর হবে না কেন? সায়েব তার মতো অনেকটা। সায়েব দরদি হবেনই।
আট তলা এই অফিস বিল্ডিং তিনটি ব্লকে ভাগ করা। তিন ব্লকের সর্বমোট চব্বিশটি ফ্লোরে তিরিশটির মতো অফিস আছে। প্রত্যেকটা অফিসই পরস্পরের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। এতগুলি অফিসের যিনি সর্বময় কর্তা, তিনি সদ্য বদলি হয়ে এখানে এসেছেন। তাঁর বসার কথা বি-ব্লকের এইট্থ ফ্লোরে। কিন্তু সেখানে থাকছেন না। ঘুরছেন বিভিন্ন ফ্লোরে। আদেশ পাঠিয়েছেন সমস্ত ফ্লোরে তাঁর বসার একটি ঘর করতে হবে। যে কোনও দিন যে কোনও অফিসে ঢুকে পড়ে সেই ঘরে বসে চুপচাপ সেই অফিসের কাজকর্ম লক্ষ করবেন। অমিয়দের এই অফিসেও তাঁর জন্য একটি ঘর তৈরি হয়েছে। তার দেওয়ালে কালো কাচ। বাইরে থেকে ভিতরটা দেখা যাবে না। ভিতর থেকে সব স্পষ্ট বোঝা যাবে। অফিসের কর্মচারীরা ধরতে পারবে না বড় সায়েব ভিতরে আছেন কি না। এখন সেই চেম্বারে এ সি মেসিন লাগানো বাকি। তা হয়ে গেলেই আর উপায় থাকবে না। অমিয় চন্দ ভয়ার্ত চোখে কালো কাচের দিকে তাকায়।
সদানন্দ রায় বলল, সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
অমিয় হাসল বিষণ্ণ মুখে, বলল, আমার তো চাকরিই পাকা নয়।
অমিয়র কথায় সদানন্দ রায় খুশি হল না। এখন কি পাকা চাকরি পাওয়া যায়? যা পেয়েছে তাই যথেষ্ট। এরা অল্পতে সন্তুষ্ট হয় না। অমিয় চন্দ কী তাকে ইঙ্গিত করল? তার তিরিশ বছরের পুরনো চাকরি, ভয় তার বেশি। সপ্তাহে দিন তিনেক বেলা চারটের পর তাকে বেরোতে হয় সত্যি। না বেরোলে তো হবে না। দেড়টা নাগাদ একটু ঘুমের ঢুল আসে। আধ ঘন্টা, চল্লিশ মিনিট যায়। বহু দিনের এই অভ্যাস কি বন্ধ করতে হবে? এই অফিসের কর্তা মাইতি স্যরও মেনে নিয়েছেন সদানন্দর এই অভ্যাস। আর, শুধু সদানন্দই বা কেন, চন্দন পাল তো অফিসে ঢোকে বারোটা নাগাদ। তার আগে পারে না। আশিস ব্যানার্জি দশটায় ঢুকে হাজিরা খাতায় আঁচড় মেরে সেই যে বেরোয়, ফেরে আড়াইটা নাগাদ। অমিয় চন্দ এ সব নিয়েই কি তার পাকা চাকরি নয় বলে হাহুতাশ করল? চাকরি পাকা হলে সে-ও অমন পারবে। কিন্তু এমন কেউ কেউ তো আছে, যারা দশটায় ঢুকে সাড়ে পাঁচটা অবধি কাজই করে যায়। সব কিছু নিয়েই তো অফিস। হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয়?
আর পারছি না সদানন্দদা, চলছে না। অমিয় বলল।
সদানন্দ চুপ করে থাকে। অমিয় আর কথা না বলে কম্পিউটর রুমে ঢুকল। সদানন্দ রায় গেল এই অফিসের কর্তা গগন মাইতির চেম্বারে। গগন মাইতি বললেন, বসুন সদানন্দবাবু, আমাদের সকলের একসঙ্গে বসা দরকার, নতুন বড় সায়েব খুব ঘুরছেন, এমনিতে ভালমানুষ কিন্তু কাজ ছাড়া কিছু বোঝেন না। দশটা-সাড়ে পাঁচটা করতেই হবে। তিনি কোন দিন ঢুকে পড়বেন তার ঠিক নেই।
সদানন্দ বলল, হ্যাঁ স্যার, এ-ব্লকের সেকেণ্ড ফ্লোরে পৌনে দশটায় ঢুকে পড়েছিলেন, দশটা পনেরো অবধি দেখে রিপোর্ট নিয়ে চলে গেছেন শুনেছি।
ক’জন এসেছিল?
নাইট গার্ড ছাড়া কেউ ছিল না।
গগন মাইতি বললেন, আগে ছিলেন শিলিগুড়িতে, একটা অফিসের সকলকে সাসপেণ্ড করে দিয়েছিলেন সাড়ে দশটার ভিতর কেউ না আসায়।
শুনেছি স্যার।
গগন মাইতি বললেন, আমি জানি এক অফিসের স্যালারি বন্ধ করে দিয়েছিলেন কাজে গাফিলতির কারণে।
পুরো অফিসের নয়, কয়েক জনের।
হতে পারে, দু’জনের প্রমোশন বন্ধ করে দিয়েছিলেন, জানেন এটা?
শুনছি স্যার।
কোচবিহার থেকে সুন্দরবনে বদলি করে দিয়েছিলেন এক জনকে, কেউ আটকাতে পারেনি।
শুনেছি উনি বহু কর্মচারীর ক্ষতি করে দিয়েছেন। সদানন্দ বলল।
উল্টোও আছে সদানন্দবাবু, একটা অফিসে গিয়ে ঠিক দশটায় এক জনকে পেয়েছিলেন, তার নাম কার্তিক সিংহ, তার প্রমোশনের ব্যবস্থা করেছিলেন। বাকিদের বদলি করে দিয়েছিলেন, সিংহবাবুর কাছেই শোনা, বালুরঘাটের স্টাফ।
সদানন্দবাবু বললেন, আমি জানি স্যার, তবে যাকে উনি পেয়েছিলেন সকাল দশটায়, সে ওই সময় এসে সাড়ে দশটায় বেরিয়ে যেত, আর একটা কাজ করত শুনেছি। তার এমনই লাক, সায়েব সাড়ে দশটার পর এলে তাকে অফিসে পেত না।
হাসলেন গগন মাইতি, আমি জানি এটা, কিন্তু ঘটনা হল ওই এক দিনের জন্য তার উপর এমন ইম্প্রেশন হয়েছিল ডিরেক্টর সায়েবের যে, পরে সে কাজ না করলেও তিনি কিছু বলতেন না, সে আর একটা কাজ করে, তা জেনেও তিনি কিছু বলতেন না। যাক গে, এ সব কথা আলোচনা না করাই ভাল।
সদানন্দ বলল, আমাকে কিন্তু চারটেয় বেরোতে হবে স্যার।
পাঁচটা পঁচিশে ফেরত আসবেন, ওই সময়ে তাঁর আসার একটা চান্স আছে।
জানি স্যার, আমি বরং তিনটেয় বেরিয়ে পৌনে পাঁচটা থেকে পাঁচটায় ফিরে আসব, সব দিক রক্ষা হবে তা হলে। সদানন্দ উঠল।
বড়কর্তা, ডিরেক্টর সায়েবের গতিবিধি নিয়ে এর পর নানা কথা শোনা যেতে থাকল। তিন ব্লকের নানা ফ্লোর থেকে নানা কথা নানা ফ্লোরে উড়ে যেতে লাগল। ভাল কথা আসতে লাগল। মন্দ কথাও উড়তে লাগল। অমিয় চন্দ শুনতে পেল হাওড়াতে যখন ছিলেন সায়েব, এক ব্যক্তি তাঁর কাছে দরখাস্ত নিয়ে গিয়েছিল। তার মাধ্যমিক পাশ যুবতী কন্যার পিছনে কয়েকটি যুবক ঘুরছিল। এ নিয়ে সে কিছু বলতে গেলে যুবকেরা শাসিয়েছিল, মেয়েকে তুলে নিয়ে বাংলাদেশে চলে যাবে। সেখান থেকে আরব দেশে বেচে দেবে। তিনি অভিযোগ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে এস পি-কে ফোন করেন। থানা কেন অভিযোগ নেয়নি তার কৈফিয়তও তলব করেন। এর ফলে থানার ও সি রাতারাতি বদলি হয়ে যান। পুলিশ যুবক তিনটিকে তুলে খুনের মামলায় জড়িয়ে জেল হাজতে ঢুকিয়ে দেয়। জামিনই হয়নি। সায়েব যদি অ্যাকশন না নিতেন লোকটি তার মেয়েকে বাঁচাতে পারত না।
অমিয় চন্দর মুখে এই কাহিনি শুনে অনেকে মাথা দোলাতে লাগল। বড়কর্তা তো এমনই হওয়া উচিত। অমিয়র প্রার্থনা মঞ্জুর হবে ঠিক। বড়কর্তা অভিভাবকের মতো। এক জন বলল, পুরনো উত্তম-সুচিত্রার সিনেমায় কমল মিত্র যেমন অভিভাবক সাজতেন, ইনি তেমনই প্রায়। ওই রকমই কণ্ঠস্বর। ওই রকম দার্ঢ্য। যদিও উচ্চতা কম।
শুনে এক জন জিজ্ঞেস করল, তুমি ওঁকে দেখেছ?
না, শুনে এই রকম মনে হচ্ছে। উত্তম-সুচিত্রার সিনেমাগুলোর কথা ভুলে গেছ?
এই সব কথা শুনতে শুনতে অন্য এক জন বলল, তোমরা তো বালুরঘাটের কার্তিক সিংহর কথা শুনেছ, সায়েবের গুড বুকে থাকা আর এক জনের কথা আমি বলতে পারি, কৃষ্ণনগরের অতনু সোম। বড়কর্তার সুনজরে থাকার জন্য সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারত। এই তো ক’বছর আগের কথা, অফিসে সদ্য জয়েন করা একটি বছর বাইশের মেয়েকে সে ভয় দেখাত, বড়কর্তাকে বলে তার চাকরি খেয়ে নেবে। মেয়েটির চাকরি তখন টেম্পোরারি। অতনু সোম তাকে ভয়ও দেখায়, লোভও দেখায় বড়কর্তাকে বলে সে তার চাকরি পামার্নেন্ট করে দিতে পারে ছ’মাসের ভিতরেই, প্রমোশনের ব্যবস্থাও করে দেবে। তার কথামতো চললেই ও-সব হতে পারে। এই সব শুনতে শুনতে প্রলোভিত হয়ে সে প্রায় নিজেকে সমর্পণ করে ফেলে অতনু সোমের কাছে। অতনু সোম সুযোগ নেয়। মেয়েটি শেষ পর্যন্ত তার অপমানের কথা না প্রকাশ করে পারেনি। লিখিত অভিযোগ জানিয়েছিল কী ভাবে অতনু সোম তাকে ভয় দেখিয়ে নষ্ট করেছে। তদন্ত কমিটি বসে। কিন্তু তদন্তে কিছুই হয় না। তদন্ত চলতে থাকে। তদন্ত কমিটি চেষ্টা করে কী ভাবে অতনু সোমকে বাঁচানো যায়। শেষ অবধি মেয়েটি বদলি নিয়ে লজ্জার হাত থেকে বাঁচে। বড়কর্তা এই সময় মেয়েটির পক্ষে কোনও কিছুই করেননি। তাঁরই প্রশ্রয়ে অতনু সোম রেহাই পেয়ে যায়।
এই কাহিনি বড়কর্তার বিপক্ষেই যায়, যদিও কেউ কেউ বলে বড়কর্তা অবধি অভিযোগ যায়নি। বড়কর্তার স্নেহধন্য বলেই অতনু সোমকে বাঁচানোর জন্য সকলেই উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। তারা জানত, অতনু সোমকে বাঁচাতে পারলে অতনু সোমই তাদের নানা ভাবে বাঁচাবে। সকলেই তো বিভিন্ন কারণে অসুবিধেয় ছিল। সকলেই সুযোগ খুঁজছিল, কী ভাবে অতনু সোমের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা যায়, যদিও তারা অতনুর থেকে উঁচু পদের চাকুরে ছিল।
সমস্তটা শুনে গগন মাইতি সায়েব বলেন, বড়কর্তা জানলেই বা হবে কেন? কেউ একটা অভিযোগ করলেই তা মেনে নিতে হবে? প্রশাসন ও ভাবে চলে না। প্রশাসককে বহু মানুষ নিয়ে কাজ করতে হয়। অনেক কিছু গ্রহণ বর্জন করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তখন কম্পিউটর অপারেটর অমিয় তিরিশটা পাতার রিপোর্ট এনে মাইতি সায়েবের টেবিলে রেখে হাত কচলে বলল, আমি আবার একটা দরখাস্ত করব স্যার।
হেডক্লার্ক সদানন্দবাবু বলল, তুমি নিজে গিয়ে আর্জি জানাও, কাজ হবে।
কী করে যাব?
যে দিন উনি এখানে আসবেন, বলবে।
কবে আসবেন?
তা বলব কী করে, ওঁর চেম্বারে এসে বসলে তুমি ঢুকে যাবে।
তখন অমিয় বলে, আজ ওই চেম্বারে ঢুকে পড়েছিলাম।
কেন? গগন মাইতি সায়েব অবাক। না বলে ঢুকলে?
ভিতরে তো কেউ ছিলেন না।
যদি থাকতেন?
আমি আমার কথা বলতাম স্যার।
গগন মাইতি বিরক্তিতে মাথা নাড়তে লাগলেন, এটা ঠিক করনি, উনি কখন আসবেন কখন আসবেন না, এসে চলে গেছেন কি না উনিই জানবেন। ওঁর ওই চেম্বারে কেউ কখনও ঢুকবে না, শুনছ? উনি থাকলে তোমার চাকরি চলে যেত।
স্যার, আর হবে না। নুয়ে গেল অমিয় চন্দ।
দ্যাখো, গত পরশু উনি সেকেণ্ড ফ্লোরে নেমেছিলেন পাঁচটা বত্রিশে, তখন নাইট গার্ড আলো নেভাতে শুরু করেছে। সায়েব তার কাছে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছেন কে কখন আসে, কে কখন যায়।
সদানন্দ রায় বলল, ওঁর চেম্বার থেকেই উনি বেরিয়ে এসেছিলেন শুনি। অবাক ব্যাপার, কখন ওই চেম্বারে উনি এসে বসেছিলেন তা কেউ জানে না, অ্যাভারেজ চেহারা বলে উনি এই রকম করতে পারছেন।
গগন মাইতি বললেন, সবাইকে যাওয়া-আসার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। পাঁচটায় সকলের যাওয়া চলবে না, আরও আধঘণ্টা দেখে যাওয়া উচিত।
সদানন্দ রায় চুপ করে থাকে। গগন মাইতি সায়েব ফাইলে মন দিলেন। সদানন্দ ও অমিয় চন্দ বাইরে এল। বড়কর্তার চেম্বারটির বন্ধ দরজার দিকে তাকায়। ঘরটিতে সব সময় আলো জ্বলে, কিন্তু তা বাইরে থেকে ধরা যায় না। দেওয়ালের কালো কাচের আড়াল থেকে ভিতরের আলো বাইরে আসতে পারে না। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় অন্ধকার ঘর। অন্ধকারে কেউ বসে আছে ভিতরে।
সদানন্দ জিজ্ঞেস করল, ভিতরে কী দেখলি?
খালি চেয়ার।
আর, আর কিছু না?
অমিয় বলল, মনে হল চেয়ারটায় কেউ বসে ছিল একটু আগে।
তা কী করে হবে, এলে আমরা দেখতে পেতাম।
অমিয় বলল, ভিতরে যেন সিগারেটের গন্ধ।
সত্যি?
মনে হল তাই, আমি আর একটু আগে গেলেই স্যারের দেখা পেয়ে যেতাম। ঢুকব ঢুকব করেও ঢুকিনি, যখন ঢুকেছি উনি নেই।
কিন্তু...। সদানন্দ রায়ের কথা গলায় আটকে থাকল। তার মনে হল, কথাটা সত্যি হতেই পারে। এমন হতে পারে, তারা অফিসে ঢোকার আগে বড় সায়েব ঢুকে পড়েছিলেন তাঁর চেম্বারে। তার পর কোনও এক সময় বেরিয়ে গেছেন। সদানন্দ রায় তখন বলল, দরখাস্তটা ওর টেবিলে রেখে আসতে পারতিস।
হ্যাঁ, পরে মনে হল তাই, কিন্তু না রেখেও ভাল হয়েছে। আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করব, মুখে সব বলব।
মাইতি স্যার যে বারণ করলেন ঢুকতে।
আমার কোনও উপায় নেই সদানন্দদা, এ চাকরি কোনও দিন পাকা হবে না, তা আমি জানি, কিন্তু এই আয়ে তো চলছে না। আমাকে ইন্দ্রাণী বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, এই আয়ে বিয়ে করা যায়!
তুই প্রেয়ারটা মাইতি সায়েবের কাছে দে।
সে তো কয়েক বার দিয়েছি।
আবার দে, উনি যেন উপরে পাঠান রেকমেণ্ড করে।
অমিয় চন্দ কথা না বলে কালো কাচের ঘরটির দিকে তাকিয়ে থাকে। গগন মাইতি তখন বেরিয়ে এলেন তাঁর চেম্বার থেকে। বললেন, একটা কথা বলা হয়নি সদানন্দবাবু, বড় সায়েব এর ভিতরে এক দিন আমাদের অফিস দেখে গেছেন, ফোনে সেভেন্থ ফ্লোরের অরিন্দম মণ্ডল তাই বলল।
আমরা সে দিন সবাই অফিসে ছিলাম? জিজ্ঞেস করে সদানন্দ।
বলতে পারছি না। জেনে যাব অবশ্য দু’এক দিনেই, তবে সিট ছেড়ে এখানে-ওখানে না যাওয়াই ভাল, এতে ইম্প্রেশন খারাপ হয়।
সদানন্দ রায় বলল, আমি এর ভিতরে এক দিন বেরিয়েছিলাম ডাক্তার দেখাতে।
কী হবে বলতে পারছি না। অস্ফুট গলায় বললেন গগন মাইতি।
তখন অমিয় চন্দ বলল, স্যার, আমি কি আপনার কাছেই প্রেয়ার দেব?
দিতে পারো, তবে এর দু’রকম অ্যাকশন হতে পারে। উনি প্রেয়ার কনসিডার করতে পারেন, আবার নাও পারেন। বলবেন, এই টাকাতেই করতে হবে, না পারলে ছেড়ে দাও, লোকের তো অভাব নেই। গগন মাইতি ধীরে ধীরে বললেন।
অমিয় চন্দ বুঝতে পারে না, কথাটা মাইতি স্যারের কি না। অভিমতটা মাইতি স্যারেরই কি না। তবু সে বলল, আমি এত বছর ধরে করছি, আমাকে ছেড়ে দেবেন?
ছাড়া হবে কী হবে না, সে বড় সায়েবের ইচ্ছে, কিন্তু তুমি তো পার্মানেন্ট নও। সায়েব যদি বোঝেন তোমাকে না রেখে অন্য কাউকে দিয়ে কাজটা আরও কম টাকায় করিয়ে নিতে পারবেন, সেটাই করবেন।
আপনি ভাল করে লিখে দেবেন প্রেয়ারের উপর।
মাইতি সায়েব বললেন, লিখতে পারি, যদি জানি সায়েব কী চান। সায়েব যদি না চান, রেকমেণ্ড করে আমি তাঁর গুড বুকের বাইরে চলে যাব। আসলে সায়েব মানে বড়কর্তা যেমন চান, তেমন কাজই করতে হবে আমাকে, সকলেরই তাই-ই করা উচিত।
অমিয় চন্দ বলল, তা হলে আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করি।
পরিস্থিতি তেমন হলে দেখা করতে পারো, অর্থাৎ সায়েব যদি মনে করেন তাঁর কাছে তোমার যাওয়া দরকার, তুমি গেলেই তোমার প্রার্থনা পূরণ করবেন, তবেই তুমি যাবে, না হলে তুমি তাঁর কাছে গেলে তাঁর সময় নষ্ট হবে, তোমার উপর ডিসপ্লিজড হয়ে তোমার স্যালারি কমিয়েও দিতে পারেন। এই রকম একটা ঘটনা ঘটেছিল শুনেছি।
মাইতি সায়েব বলতে বলতে গম্ভীর হয়ে গেলেন। সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়া উড়িয়ে একটু ভেবে বললেন, ডেইলি ওয়েজ বাড়াতে তোমার মতো এক জন দেখা করেছিল বড় সায়েবের সঙ্গে। বড়কর্তা তাকে জেরা করে, কাজের হিসেব নিয়ে ডেইলি ওয়েজ ওয়ান-ফোর্থ কমিয়ে দিয়েছিলেন।
তা হলে আমার হবে না? বিষণ্ণ হয়ে গেছে অমিয় চন্দ।
হতে পারে, সায়েবের নজরে পড়ে গেলে হবে।
নজরে কী ভাবে পড়ব?
মাইতি সায়েব বললেন, দশটার আগে অফিসে ঢুকে কাজ আরম্ভ করবে, শেষ করবে ছ’টার পর। সায়েব ওই সময়েই নাকি ঢুকে পড়ছেন।
অমিয় বলল, তখন তো অফিসে কেউ থাকবে না।
কাজ থাকবে, তুমি থাকবে, বড় সায়েব ঠিক খবর পেয়ে যাবেন। হয়তো ইন্সপেকশনে ঢুকে পড়ে তোমাকেই পেয়ে যাবেন, তখন তুমি তাঁর গুড বুকে চলে যাবে সিংহবাবুর মতো। চাকরি তো পাকা হবেই, ওঁর কাছে তুমি সব সময় যেতে পারবে।
সদানন্দ রায় বলল, ঠিক কথা, আমাদের স্যার জানেন বড় সায়েব কী চান। জানেন বলেই তোমাকে ঠিক পরামর্শ দিলেন উনি। এখন মন দিয়ে কাজ করে যাও।
অমিয় ন’টা চল্লিশে অফিসে ঢুকে কাজ আরম্ভ করে দেয়। তার কত পরে আর সবাই অফিসে ঢোকে! অমিয় বেরোয় রাত পৌনে সাতটা নাগাদ। পাঁচটার পরেই তো অফিস খাঁ খাঁ করে। অমিয়র কাজও অনেক। মাইতি সায়েব দিনের কাজ দিনে শেষ করতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন। বড় সায়েবের আদেশও তাই। অমিয় কাজ করতে করতে টেরও পায় না কখন সন্ধে হল, কখন বৃষ্টি নামল। মেঘের ডাক শুনলে অমিয়র মন খারাপ হয়। ইন্দ্রাণী নামের একটি মেয়ের কথা মনে পড়ে। অমিয়র হাতের আঙুলগুলি ব্যথায় থেমে আসতে থাকে। কালো কাচে ঘেরা ঘরটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে এগোয়। আচমকা সেই ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়ে। অতি সাধারণ চেহারার অসাধারণ বড় সায়েব আছেন ভিতরে। অমিয় কড়া সিগারেটের গন্ধ পায়। দামি সুগন্ধির সৌরভ নাকে আসে। সে হাত জোড় করে ধরা গলায় বলে, নমস্কার স্যার, আমি অমিয় চন্দ, একটা আর্জি নিয়ে এসেছি, সাত বছরে টাকা বাড়েনি, এক্সকিউজ মি স্যার, বাবার খুব অসুখ, ইন্দ্রাণীকে কত দিন দেখিনি, আমার চাকরিটা যদি পাকা হয়, দেখবেন স্যার, আর পারি না, মার্জনা করবেন স্যার...।
শূন্য চেয়ারখানি দুলে ওঠে। পায়ের উপর দিয়ে বুড়ো ইঁদুর চলে যায়। অমিয় ভক্তিভরে শূন্য চেয়ারের দিকে চেয়ে থাকে।
জন্ম :৩০ আগস্ট, ১৯৫১।
বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কাছে ধুলিহর গ্রামে | বিজ্ঞানের ছাত্র | কর্ম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক দপ্তরে | তিনি ২০০৬ সালে ধ্রুবপুত্র উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন।
প্রকাশিত বই
পাহাড়ের মত মানুষ, অমর মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প, অর্ধেক রাত্রি, ডানা নেই উড়ে যায়, ধুলোগ্রাম, অশ্বচরিত, আগুনের গাড়ী, ধ্রুবপুত্র, নদীবসত, কৃষ্ণগহ্বর, আসনবনি, নিস্তব্দ নগর, প্রান্তরের অন্ধকার, ভি আই পি রোড, শ্যাম মিস্ত্রী কেমন ছিলেন, গজেন ভূঁইয়ার ফেরা, জনসমুদ্র, সবুজ রঙের শহর, সমাবেশ, সারিঘর, সুবর্ণরেখা, সোনাই ছিলো নদীর নাম, হাঁসপাহাড়ি।
পুরস্কার :
সাহিত্য একাডেমী।
বঙ্কিম পুরস্কার--২০০১ ও গল্পের জন্য সর্ব ভারতীয় কথা পুরস্কার ১৯৯৮।
দেখেছিস সায়েবকে?
না, শুনলাম খুবই সাধারণ, চেনা যাবে না পাঁচ জনের ভিড়ে। অমিয় বলল।
কে দেখেছে?
এ-ব্লকের শ্যামাদাস।
ও দ্যাখেনি, পাঁচ পাঁচ নয়, পাঁচ সাত হবে, ফর্সা নয়, আধময়লা রং।
অমিয় জিজ্ঞেস করল, আপনি দেখেছেন?
না, শুনেছি তাই, যে কোনও দিন অফিসে চলে আসতে পারেন।
অমিয় চন্দ বলল, একেবারে দশটা বাজতে পাঁচে ঢুকে পড়ছেন, কেউ ধরতেই পারছে না বড় সায়েব ঢুকেছেন।
হুঁ! চিন্তিত মুখে হেড ক্লার্ক সদানন্দ রায় বলল, সাড়ে পাঁচটাতেও ঢুকছেন, আগে যেখানে ছিলেন সেখানে নাকি ছ’জনের চাকরি নষ্ট হয়েছে, চার জন সাসপেনশনে আছে।
অমিয় চন্দ চুপ করে থাকল কিছু সময়, তার পর বলল, তবে ভাল কাজ করলে উনি তাদের দ্যাখেন, অ্যাডমিনিষ্ট্রেটর হিসেবে খুবই কড়া।
সদানন্দ রায় হাসে, সিগারেট ধরিয়ে বলে, তিরিশ বছরে এমন কত দেখেছি।
অমিয় কুণ্ঠিত স্বরে বলল, আমি আবার পিটিশন দিচ্ছি, টাকাটা যদি বাড়ে।
কোনও লাভ হবে কি? তবে হতেও পারে, চেষ্টা করো।
অমিয় একটু দমে যায়। মাসে আড়াই হাজারের মতো পায়। কম্পিউটর অপারেটর। কাজ করলে টাকা, ছুটি বলতে কিচ্ছু নেই। আবার সোম থেকে শুক্রর ভিতরে যদি ছুটি পড়ে, তার লোকসান। টাকা নেই। সদানন্দরা পাকা চাকুরে। কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে এই আড়াই তিন পেত। অমিয় ছ’মাস ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে তার চুক্তিটা বদল হোক। থোক টাকা হাজার ছয়ের মতো দিক কর্তৃপক্ষ। আর তা মঞ্জুর করতে পারেন সর্বোচ্চ পদের উপরওয়ালা। এখন তিনি পাঁচ ফুট পাঁচ, সাধারণ চেহারা। অতি সাধারণ অমিয়র কথা কি তিনি ভাববেন না? অমিয়র দরখাস্ত এই অফিস রেকমেণ্ড করে পাঠালে, সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে তিন প্রস্ত উপরওয়ালা হয়ে নতুন বড় সায়েবের কাছে পৌঁছলে, তাঁর কলমের খোঁচায় কপাল খুলে যেতে পারে। এর আগে বার দুই অবশ্য উপর পর্যন্ত দরখাস্ত পৌঁছে আবার নীচে নেমে এসেছিল আশ্বাসবাণী সহ। বিবেচনা করে দেখা হবে। কাজের কাজ কিচ্ছু হয়নি।
অমিয় খুব মন দিয়ে কাজ করে। দক্ষ। কম্পিউটরের নানা গোলমাল সে-ই সামাল দেয়। ডাটা এন্ট্রি করতে করতে অফিসের কাজও শিখে গেছে সে। সদানন্দ রায় বা অন্য কারও কারও কাজের ভুলও কম্পিউটরে এন্ট্রির সময় অমিয় সংশোধন করে দেয়। নানা চিঠির বয়ানও সে নিজে তৈরি করে। তা হলে তার প্রার্থনা মঞ্জুর হবে না কেন? সায়েব তার মতো অনেকটা। সায়েব দরদি হবেনই।
আট তলা এই অফিস বিল্ডিং তিনটি ব্লকে ভাগ করা। তিন ব্লকের সর্বমোট চব্বিশটি ফ্লোরে তিরিশটির মতো অফিস আছে। প্রত্যেকটা অফিসই পরস্পরের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। এতগুলি অফিসের যিনি সর্বময় কর্তা, তিনি সদ্য বদলি হয়ে এখানে এসেছেন। তাঁর বসার কথা বি-ব্লকের এইট্থ ফ্লোরে। কিন্তু সেখানে থাকছেন না। ঘুরছেন বিভিন্ন ফ্লোরে। আদেশ পাঠিয়েছেন সমস্ত ফ্লোরে তাঁর বসার একটি ঘর করতে হবে। যে কোনও দিন যে কোনও অফিসে ঢুকে পড়ে সেই ঘরে বসে চুপচাপ সেই অফিসের কাজকর্ম লক্ষ করবেন। অমিয়দের এই অফিসেও তাঁর জন্য একটি ঘর তৈরি হয়েছে। তার দেওয়ালে কালো কাচ। বাইরে থেকে ভিতরটা দেখা যাবে না। ভিতর থেকে সব স্পষ্ট বোঝা যাবে। অফিসের কর্মচারীরা ধরতে পারবে না বড় সায়েব ভিতরে আছেন কি না। এখন সেই চেম্বারে এ সি মেসিন লাগানো বাকি। তা হয়ে গেলেই আর উপায় থাকবে না। অমিয় চন্দ ভয়ার্ত চোখে কালো কাচের দিকে তাকায়।
সদানন্দ রায় বলল, সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
অমিয় হাসল বিষণ্ণ মুখে, বলল, আমার তো চাকরিই পাকা নয়।
অমিয়র কথায় সদানন্দ রায় খুশি হল না। এখন কি পাকা চাকরি পাওয়া যায়? যা পেয়েছে তাই যথেষ্ট। এরা অল্পতে সন্তুষ্ট হয় না। অমিয় চন্দ কী তাকে ইঙ্গিত করল? তার তিরিশ বছরের পুরনো চাকরি, ভয় তার বেশি। সপ্তাহে দিন তিনেক বেলা চারটের পর তাকে বেরোতে হয় সত্যি। না বেরোলে তো হবে না। দেড়টা নাগাদ একটু ঘুমের ঢুল আসে। আধ ঘন্টা, চল্লিশ মিনিট যায়। বহু দিনের এই অভ্যাস কি বন্ধ করতে হবে? এই অফিসের কর্তা মাইতি স্যরও মেনে নিয়েছেন সদানন্দর এই অভ্যাস। আর, শুধু সদানন্দই বা কেন, চন্দন পাল তো অফিসে ঢোকে বারোটা নাগাদ। তার আগে পারে না। আশিস ব্যানার্জি দশটায় ঢুকে হাজিরা খাতায় আঁচড় মেরে সেই যে বেরোয়, ফেরে আড়াইটা নাগাদ। অমিয় চন্দ এ সব নিয়েই কি তার পাকা চাকরি নয় বলে হাহুতাশ করল? চাকরি পাকা হলে সে-ও অমন পারবে। কিন্তু এমন কেউ কেউ তো আছে, যারা দশটায় ঢুকে সাড়ে পাঁচটা অবধি কাজই করে যায়। সব কিছু নিয়েই তো অফিস। হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয়?
আর পারছি না সদানন্দদা, চলছে না। অমিয় বলল।
সদানন্দ চুপ করে থাকে। অমিয় আর কথা না বলে কম্পিউটর রুমে ঢুকল। সদানন্দ রায় গেল এই অফিসের কর্তা গগন মাইতির চেম্বারে। গগন মাইতি বললেন, বসুন সদানন্দবাবু, আমাদের সকলের একসঙ্গে বসা দরকার, নতুন বড় সায়েব খুব ঘুরছেন, এমনিতে ভালমানুষ কিন্তু কাজ ছাড়া কিছু বোঝেন না। দশটা-সাড়ে পাঁচটা করতেই হবে। তিনি কোন দিন ঢুকে পড়বেন তার ঠিক নেই।
সদানন্দ বলল, হ্যাঁ স্যার, এ-ব্লকের সেকেণ্ড ফ্লোরে পৌনে দশটায় ঢুকে পড়েছিলেন, দশটা পনেরো অবধি দেখে রিপোর্ট নিয়ে চলে গেছেন শুনেছি।
ক’জন এসেছিল?
নাইট গার্ড ছাড়া কেউ ছিল না।
গগন মাইতি বললেন, আগে ছিলেন শিলিগুড়িতে, একটা অফিসের সকলকে সাসপেণ্ড করে দিয়েছিলেন সাড়ে দশটার ভিতর কেউ না আসায়।
শুনেছি স্যার।
গগন মাইতি বললেন, আমি জানি এক অফিসের স্যালারি বন্ধ করে দিয়েছিলেন কাজে গাফিলতির কারণে।
পুরো অফিসের নয়, কয়েক জনের।
হতে পারে, দু’জনের প্রমোশন বন্ধ করে দিয়েছিলেন, জানেন এটা?
শুনছি স্যার।
কোচবিহার থেকে সুন্দরবনে বদলি করে দিয়েছিলেন এক জনকে, কেউ আটকাতে পারেনি।
শুনেছি উনি বহু কর্মচারীর ক্ষতি করে দিয়েছেন। সদানন্দ বলল।
উল্টোও আছে সদানন্দবাবু, একটা অফিসে গিয়ে ঠিক দশটায় এক জনকে পেয়েছিলেন, তার নাম কার্তিক সিংহ, তার প্রমোশনের ব্যবস্থা করেছিলেন। বাকিদের বদলি করে দিয়েছিলেন, সিংহবাবুর কাছেই শোনা, বালুরঘাটের স্টাফ।
সদানন্দবাবু বললেন, আমি জানি স্যার, তবে যাকে উনি পেয়েছিলেন সকাল দশটায়, সে ওই সময় এসে সাড়ে দশটায় বেরিয়ে যেত, আর একটা কাজ করত শুনেছি। তার এমনই লাক, সায়েব সাড়ে দশটার পর এলে তাকে অফিসে পেত না।
হাসলেন গগন মাইতি, আমি জানি এটা, কিন্তু ঘটনা হল ওই এক দিনের জন্য তার উপর এমন ইম্প্রেশন হয়েছিল ডিরেক্টর সায়েবের যে, পরে সে কাজ না করলেও তিনি কিছু বলতেন না, সে আর একটা কাজ করে, তা জেনেও তিনি কিছু বলতেন না। যাক গে, এ সব কথা আলোচনা না করাই ভাল।
সদানন্দ বলল, আমাকে কিন্তু চারটেয় বেরোতে হবে স্যার।
পাঁচটা পঁচিশে ফেরত আসবেন, ওই সময়ে তাঁর আসার একটা চান্স আছে।
জানি স্যার, আমি বরং তিনটেয় বেরিয়ে পৌনে পাঁচটা থেকে পাঁচটায় ফিরে আসব, সব দিক রক্ষা হবে তা হলে। সদানন্দ উঠল।
বড়কর্তা, ডিরেক্টর সায়েবের গতিবিধি নিয়ে এর পর নানা কথা শোনা যেতে থাকল। তিন ব্লকের নানা ফ্লোর থেকে নানা কথা নানা ফ্লোরে উড়ে যেতে লাগল। ভাল কথা আসতে লাগল। মন্দ কথাও উড়তে লাগল। অমিয় চন্দ শুনতে পেল হাওড়াতে যখন ছিলেন সায়েব, এক ব্যক্তি তাঁর কাছে দরখাস্ত নিয়ে গিয়েছিল। তার মাধ্যমিক পাশ যুবতী কন্যার পিছনে কয়েকটি যুবক ঘুরছিল। এ নিয়ে সে কিছু বলতে গেলে যুবকেরা শাসিয়েছিল, মেয়েকে তুলে নিয়ে বাংলাদেশে চলে যাবে। সেখান থেকে আরব দেশে বেচে দেবে। তিনি অভিযোগ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে এস পি-কে ফোন করেন। থানা কেন অভিযোগ নেয়নি তার কৈফিয়তও তলব করেন। এর ফলে থানার ও সি রাতারাতি বদলি হয়ে যান। পুলিশ যুবক তিনটিকে তুলে খুনের মামলায় জড়িয়ে জেল হাজতে ঢুকিয়ে দেয়। জামিনই হয়নি। সায়েব যদি অ্যাকশন না নিতেন লোকটি তার মেয়েকে বাঁচাতে পারত না।
অমিয় চন্দর মুখে এই কাহিনি শুনে অনেকে মাথা দোলাতে লাগল। বড়কর্তা তো এমনই হওয়া উচিত। অমিয়র প্রার্থনা মঞ্জুর হবে ঠিক। বড়কর্তা অভিভাবকের মতো। এক জন বলল, পুরনো উত্তম-সুচিত্রার সিনেমায় কমল মিত্র যেমন অভিভাবক সাজতেন, ইনি তেমনই প্রায়। ওই রকমই কণ্ঠস্বর। ওই রকম দার্ঢ্য। যদিও উচ্চতা কম।
শুনে এক জন জিজ্ঞেস করল, তুমি ওঁকে দেখেছ?
না, শুনে এই রকম মনে হচ্ছে। উত্তম-সুচিত্রার সিনেমাগুলোর কথা ভুলে গেছ?
এই সব কথা শুনতে শুনতে অন্য এক জন বলল, তোমরা তো বালুরঘাটের কার্তিক সিংহর কথা শুনেছ, সায়েবের গুড বুকে থাকা আর এক জনের কথা আমি বলতে পারি, কৃষ্ণনগরের অতনু সোম। বড়কর্তার সুনজরে থাকার জন্য সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারত। এই তো ক’বছর আগের কথা, অফিসে সদ্য জয়েন করা একটি বছর বাইশের মেয়েকে সে ভয় দেখাত, বড়কর্তাকে বলে তার চাকরি খেয়ে নেবে। মেয়েটির চাকরি তখন টেম্পোরারি। অতনু সোম তাকে ভয়ও দেখায়, লোভও দেখায় বড়কর্তাকে বলে সে তার চাকরি পামার্নেন্ট করে দিতে পারে ছ’মাসের ভিতরেই, প্রমোশনের ব্যবস্থাও করে দেবে। তার কথামতো চললেই ও-সব হতে পারে। এই সব শুনতে শুনতে প্রলোভিত হয়ে সে প্রায় নিজেকে সমর্পণ করে ফেলে অতনু সোমের কাছে। অতনু সোম সুযোগ নেয়। মেয়েটি শেষ পর্যন্ত তার অপমানের কথা না প্রকাশ করে পারেনি। লিখিত অভিযোগ জানিয়েছিল কী ভাবে অতনু সোম তাকে ভয় দেখিয়ে নষ্ট করেছে। তদন্ত কমিটি বসে। কিন্তু তদন্তে কিছুই হয় না। তদন্ত চলতে থাকে। তদন্ত কমিটি চেষ্টা করে কী ভাবে অতনু সোমকে বাঁচানো যায়। শেষ অবধি মেয়েটি বদলি নিয়ে লজ্জার হাত থেকে বাঁচে। বড়কর্তা এই সময় মেয়েটির পক্ষে কোনও কিছুই করেননি। তাঁরই প্রশ্রয়ে অতনু সোম রেহাই পেয়ে যায়।
এই কাহিনি বড়কর্তার বিপক্ষেই যায়, যদিও কেউ কেউ বলে বড়কর্তা অবধি অভিযোগ যায়নি। বড়কর্তার স্নেহধন্য বলেই অতনু সোমকে বাঁচানোর জন্য সকলেই উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। তারা জানত, অতনু সোমকে বাঁচাতে পারলে অতনু সোমই তাদের নানা ভাবে বাঁচাবে। সকলেই তো বিভিন্ন কারণে অসুবিধেয় ছিল। সকলেই সুযোগ খুঁজছিল, কী ভাবে অতনু সোমের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা যায়, যদিও তারা অতনুর থেকে উঁচু পদের চাকুরে ছিল।
সমস্তটা শুনে গগন মাইতি সায়েব বলেন, বড়কর্তা জানলেই বা হবে কেন? কেউ একটা অভিযোগ করলেই তা মেনে নিতে হবে? প্রশাসন ও ভাবে চলে না। প্রশাসককে বহু মানুষ নিয়ে কাজ করতে হয়। অনেক কিছু গ্রহণ বর্জন করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তখন কম্পিউটর অপারেটর অমিয় তিরিশটা পাতার রিপোর্ট এনে মাইতি সায়েবের টেবিলে রেখে হাত কচলে বলল, আমি আবার একটা দরখাস্ত করব স্যার।
হেডক্লার্ক সদানন্দবাবু বলল, তুমি নিজে গিয়ে আর্জি জানাও, কাজ হবে।
কী করে যাব?
যে দিন উনি এখানে আসবেন, বলবে।
কবে আসবেন?
তা বলব কী করে, ওঁর চেম্বারে এসে বসলে তুমি ঢুকে যাবে।
তখন অমিয় বলে, আজ ওই চেম্বারে ঢুকে পড়েছিলাম।
কেন? গগন মাইতি সায়েব অবাক। না বলে ঢুকলে?
ভিতরে তো কেউ ছিলেন না।
যদি থাকতেন?
আমি আমার কথা বলতাম স্যার।
গগন মাইতি বিরক্তিতে মাথা নাড়তে লাগলেন, এটা ঠিক করনি, উনি কখন আসবেন কখন আসবেন না, এসে চলে গেছেন কি না উনিই জানবেন। ওঁর ওই চেম্বারে কেউ কখনও ঢুকবে না, শুনছ? উনি থাকলে তোমার চাকরি চলে যেত।
স্যার, আর হবে না। নুয়ে গেল অমিয় চন্দ।
দ্যাখো, গত পরশু উনি সেকেণ্ড ফ্লোরে নেমেছিলেন পাঁচটা বত্রিশে, তখন নাইট গার্ড আলো নেভাতে শুরু করেছে। সায়েব তার কাছে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছেন কে কখন আসে, কে কখন যায়।
সদানন্দ রায় বলল, ওঁর চেম্বার থেকেই উনি বেরিয়ে এসেছিলেন শুনি। অবাক ব্যাপার, কখন ওই চেম্বারে উনি এসে বসেছিলেন তা কেউ জানে না, অ্যাভারেজ চেহারা বলে উনি এই রকম করতে পারছেন।
গগন মাইতি বললেন, সবাইকে যাওয়া-আসার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। পাঁচটায় সকলের যাওয়া চলবে না, আরও আধঘণ্টা দেখে যাওয়া উচিত।
সদানন্দ রায় চুপ করে থাকে। গগন মাইতি সায়েব ফাইলে মন দিলেন। সদানন্দ ও অমিয় চন্দ বাইরে এল। বড়কর্তার চেম্বারটির বন্ধ দরজার দিকে তাকায়। ঘরটিতে সব সময় আলো জ্বলে, কিন্তু তা বাইরে থেকে ধরা যায় না। দেওয়ালের কালো কাচের আড়াল থেকে ভিতরের আলো বাইরে আসতে পারে না। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় অন্ধকার ঘর। অন্ধকারে কেউ বসে আছে ভিতরে।
সদানন্দ জিজ্ঞেস করল, ভিতরে কী দেখলি?
খালি চেয়ার।
আর, আর কিছু না?
অমিয় বলল, মনে হল চেয়ারটায় কেউ বসে ছিল একটু আগে।
তা কী করে হবে, এলে আমরা দেখতে পেতাম।
অমিয় বলল, ভিতরে যেন সিগারেটের গন্ধ।
সত্যি?
মনে হল তাই, আমি আর একটু আগে গেলেই স্যারের দেখা পেয়ে যেতাম। ঢুকব ঢুকব করেও ঢুকিনি, যখন ঢুকেছি উনি নেই।
কিন্তু...। সদানন্দ রায়ের কথা গলায় আটকে থাকল। তার মনে হল, কথাটা সত্যি হতেই পারে। এমন হতে পারে, তারা অফিসে ঢোকার আগে বড় সায়েব ঢুকে পড়েছিলেন তাঁর চেম্বারে। তার পর কোনও এক সময় বেরিয়ে গেছেন। সদানন্দ রায় তখন বলল, দরখাস্তটা ওর টেবিলে রেখে আসতে পারতিস।
হ্যাঁ, পরে মনে হল তাই, কিন্তু না রেখেও ভাল হয়েছে। আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করব, মুখে সব বলব।
মাইতি স্যার যে বারণ করলেন ঢুকতে।
আমার কোনও উপায় নেই সদানন্দদা, এ চাকরি কোনও দিন পাকা হবে না, তা আমি জানি, কিন্তু এই আয়ে তো চলছে না। আমাকে ইন্দ্রাণী বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, এই আয়ে বিয়ে করা যায়!
তুই প্রেয়ারটা মাইতি সায়েবের কাছে দে।
সে তো কয়েক বার দিয়েছি।
আবার দে, উনি যেন উপরে পাঠান রেকমেণ্ড করে।
অমিয় চন্দ কথা না বলে কালো কাচের ঘরটির দিকে তাকিয়ে থাকে। গগন মাইতি তখন বেরিয়ে এলেন তাঁর চেম্বার থেকে। বললেন, একটা কথা বলা হয়নি সদানন্দবাবু, বড় সায়েব এর ভিতরে এক দিন আমাদের অফিস দেখে গেছেন, ফোনে সেভেন্থ ফ্লোরের অরিন্দম মণ্ডল তাই বলল।
আমরা সে দিন সবাই অফিসে ছিলাম? জিজ্ঞেস করে সদানন্দ।
বলতে পারছি না। জেনে যাব অবশ্য দু’এক দিনেই, তবে সিট ছেড়ে এখানে-ওখানে না যাওয়াই ভাল, এতে ইম্প্রেশন খারাপ হয়।
সদানন্দ রায় বলল, আমি এর ভিতরে এক দিন বেরিয়েছিলাম ডাক্তার দেখাতে।
কী হবে বলতে পারছি না। অস্ফুট গলায় বললেন গগন মাইতি।
তখন অমিয় চন্দ বলল, স্যার, আমি কি আপনার কাছেই প্রেয়ার দেব?
দিতে পারো, তবে এর দু’রকম অ্যাকশন হতে পারে। উনি প্রেয়ার কনসিডার করতে পারেন, আবার নাও পারেন। বলবেন, এই টাকাতেই করতে হবে, না পারলে ছেড়ে দাও, লোকের তো অভাব নেই। গগন মাইতি ধীরে ধীরে বললেন।
অমিয় চন্দ বুঝতে পারে না, কথাটা মাইতি স্যারের কি না। অভিমতটা মাইতি স্যারেরই কি না। তবু সে বলল, আমি এত বছর ধরে করছি, আমাকে ছেড়ে দেবেন?
ছাড়া হবে কী হবে না, সে বড় সায়েবের ইচ্ছে, কিন্তু তুমি তো পার্মানেন্ট নও। সায়েব যদি বোঝেন তোমাকে না রেখে অন্য কাউকে দিয়ে কাজটা আরও কম টাকায় করিয়ে নিতে পারবেন, সেটাই করবেন।
আপনি ভাল করে লিখে দেবেন প্রেয়ারের উপর।
মাইতি সায়েব বললেন, লিখতে পারি, যদি জানি সায়েব কী চান। সায়েব যদি না চান, রেকমেণ্ড করে আমি তাঁর গুড বুকের বাইরে চলে যাব। আসলে সায়েব মানে বড়কর্তা যেমন চান, তেমন কাজই করতে হবে আমাকে, সকলেরই তাই-ই করা উচিত।
অমিয় চন্দ বলল, তা হলে আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করি।
পরিস্থিতি তেমন হলে দেখা করতে পারো, অর্থাৎ সায়েব যদি মনে করেন তাঁর কাছে তোমার যাওয়া দরকার, তুমি গেলেই তোমার প্রার্থনা পূরণ করবেন, তবেই তুমি যাবে, না হলে তুমি তাঁর কাছে গেলে তাঁর সময় নষ্ট হবে, তোমার উপর ডিসপ্লিজড হয়ে তোমার স্যালারি কমিয়েও দিতে পারেন। এই রকম একটা ঘটনা ঘটেছিল শুনেছি।
মাইতি সায়েব বলতে বলতে গম্ভীর হয়ে গেলেন। সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়া উড়িয়ে একটু ভেবে বললেন, ডেইলি ওয়েজ বাড়াতে তোমার মতো এক জন দেখা করেছিল বড় সায়েবের সঙ্গে। বড়কর্তা তাকে জেরা করে, কাজের হিসেব নিয়ে ডেইলি ওয়েজ ওয়ান-ফোর্থ কমিয়ে দিয়েছিলেন।
তা হলে আমার হবে না? বিষণ্ণ হয়ে গেছে অমিয় চন্দ।
হতে পারে, সায়েবের নজরে পড়ে গেলে হবে।
নজরে কী ভাবে পড়ব?
মাইতি সায়েব বললেন, দশটার আগে অফিসে ঢুকে কাজ আরম্ভ করবে, শেষ করবে ছ’টার পর। সায়েব ওই সময়েই নাকি ঢুকে পড়ছেন।
অমিয় বলল, তখন তো অফিসে কেউ থাকবে না।
কাজ থাকবে, তুমি থাকবে, বড় সায়েব ঠিক খবর পেয়ে যাবেন। হয়তো ইন্সপেকশনে ঢুকে পড়ে তোমাকেই পেয়ে যাবেন, তখন তুমি তাঁর গুড বুকে চলে যাবে সিংহবাবুর মতো। চাকরি তো পাকা হবেই, ওঁর কাছে তুমি সব সময় যেতে পারবে।
সদানন্দ রায় বলল, ঠিক কথা, আমাদের স্যার জানেন বড় সায়েব কী চান। জানেন বলেই তোমাকে ঠিক পরামর্শ দিলেন উনি। এখন মন দিয়ে কাজ করে যাও।
অমিয় ন’টা চল্লিশে অফিসে ঢুকে কাজ আরম্ভ করে দেয়। তার কত পরে আর সবাই অফিসে ঢোকে! অমিয় বেরোয় রাত পৌনে সাতটা নাগাদ। পাঁচটার পরেই তো অফিস খাঁ খাঁ করে। অমিয়র কাজও অনেক। মাইতি সায়েব দিনের কাজ দিনে শেষ করতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন। বড় সায়েবের আদেশও তাই। অমিয় কাজ করতে করতে টেরও পায় না কখন সন্ধে হল, কখন বৃষ্টি নামল। মেঘের ডাক শুনলে অমিয়র মন খারাপ হয়। ইন্দ্রাণী নামের একটি মেয়ের কথা মনে পড়ে। অমিয়র হাতের আঙুলগুলি ব্যথায় থেমে আসতে থাকে। কালো কাচে ঘেরা ঘরটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে এগোয়। আচমকা সেই ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়ে। অতি সাধারণ চেহারার অসাধারণ বড় সায়েব আছেন ভিতরে। অমিয় কড়া সিগারেটের গন্ধ পায়। দামি সুগন্ধির সৌরভ নাকে আসে। সে হাত জোড় করে ধরা গলায় বলে, নমস্কার স্যার, আমি অমিয় চন্দ, একটা আর্জি নিয়ে এসেছি, সাত বছরে টাকা বাড়েনি, এক্সকিউজ মি স্যার, বাবার খুব অসুখ, ইন্দ্রাণীকে কত দিন দেখিনি, আমার চাকরিটা যদি পাকা হয়, দেখবেন স্যার, আর পারি না, মার্জনা করবেন স্যার...।
শূন্য চেয়ারখানি দুলে ওঠে। পায়ের উপর দিয়ে বুড়ো ইঁদুর চলে যায়। অমিয় ভক্তিভরে শূন্য চেয়ারের দিকে চেয়ে থাকে।
লেখক পরিচিতি
অমর মিত্র
বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কাছে ধুলিহর গ্রামে | বিজ্ঞানের ছাত্র | কর্ম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক দপ্তরে | তিনি ২০০৬ সালে ধ্রুবপুত্র উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন।
প্রকাশিত বই
পাহাড়ের মত মানুষ, অমর মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প, অর্ধেক রাত্রি, ডানা নেই উড়ে যায়, ধুলোগ্রাম, অশ্বচরিত, আগুনের গাড়ী, ধ্রুবপুত্র, নদীবসত, কৃষ্ণগহ্বর, আসনবনি, নিস্তব্দ নগর, প্রান্তরের অন্ধকার, ভি আই পি রোড, শ্যাম মিস্ত্রী কেমন ছিলেন, গজেন ভূঁইয়ার ফেরা, জনসমুদ্র, সবুজ রঙের শহর, সমাবেশ, সারিঘর, সুবর্ণরেখা, সোনাই ছিলো নদীর নাম, হাঁসপাহাড়ি।
পুরস্কার :
সাহিত্য একাডেমী।
বঙ্কিম পুরস্কার--২০০১ ও গল্পের জন্য সর্ব ভারতীয় কথা পুরস্কার ১৯৯৮।
0 মন্তব্যসমূহ