লুতফুন নাহার লতার জার্নাল : মায়ের বাড়ি

বেশ আগের কথা বলছি !তখন খুলনা শহর ছিল আমাদের ওই অঞ্চলের প্রান কেন্দ্র । বাগেরহাট , মোল্লার হাট , রামপাল , গোপালগঞ্জ , তেরখাদা , এদিকে যশোর , সাতক্ষীরা এসব জায়গা থেকে চাকুরী উপলক্ষে খুলনায় লোক সমাগম ছিল অনেক । আমার বাবা মা ,তাদের মিলিত জীবনের শুরুতে ভাড়া থাকতেন খুলনার প্রখ্যাত ও জাঁদরেল উকিল সায়েম কাজীর বাড়ীতে । খুলনা থেকে মাত্র দশ মাইল দূরে আমার নানা বাড়ী ও দাদা বাড়ীর দুটি গ্রামই তৎকালীন সময়ের হিন্দু অধ্যুষিত উন্নত সুন্দর গ্রাম ছিল ! স্কুল, কলেজ, থানা , সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্র সবই ছিল সে গ্রামে তবু বাবা কর্মোপলক্ষ্যে খুলনায় চলে এলেন ।


একদিন সায়েম কাজী সাহেবের মধ্যাহ্ন ভোজের পরে ভাত ঘুমের ব্যাঘাত ঘটল নির্জন পুকুরে আমার মায়ের সাঁতরানোর শব্দে । রাগে তিনি বন্দুক নিয়ে ছুটে এলেন , এই অসময়ে পুকুরে নেমেছে কে ! আমার মা তখন মাত্র ১৮ /১৯ বছরের ! ছিপছিপে গড়নের, পরমা সুন্দরী এক মেয়ে সারা গায়ে তার কাঁচা সোনার আভা ! মাকে দেখে সায়েম কাজীর বন্দুক তো থামল কিন্তু মেজাজ গেলো আরো চড়ে, 'কী আমার ভাড়াটিয়া বউয়ের এতো সাহস আমার পুকুরে সাঁতার কাটে ! ঘর ভাড়া দিয়েছি মেয়ে পুকুর ভাড়া দেই নি কো !' মা তো ভয়ে ভয়ে বাড়ীর অন্য মা চাচীদের সহায়তায় উঠে এলেন কিন্তু সেই দিন থেকে আমার বাবার কাছে সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন ভাড়া বাড়িতে আর তিনি থাকবেন না !

আমার বাবা চিরকালের জ্ঞান পিপাসু মানুষ । বৈষয়িক না বলে আজীবন অভাবের সাথে লড়েছেন । তিনি মনে মনে পরমাদ গুনলেন ! দু'এক দিন পরে মা আড়ঙের মেলায় গিয়ে কিনে আনলেন মাটির ব্যাংক । সেই ব্যাংকে প্রতিদিন কিছু খুচরা পয়সা আমার মায়ের অনেক বড় স্বপ্ন হয়ে টুপ টাপ পড়তে থাকল । আরো কিছুদিন পরে মা উকিল সাহেবকে গিয়ে বললেন ' বাবা আমার কাছে কিছু টাকা জমেছে, আপনি আমাকে একটু জমি কিনে দেন ! কড়া উকিল সাহেব আমার মাকে দিলেন এক ধমক ' মেয়ে তোমার আক্কেল আছে ? বাড়ী কিনতে কি লাগে জানো ! পাগল আর কাকে বলে !' মা তবু তাঁকে ছাড়ে না , অবশেষে তার এক বন্ধু নাজির হোসেনকে ডেকে বললেন টুটপাড়ায় খোলা জায়গা টায়গা থাকলে এই জেদী মেয়েটাকে দেখাও । উকিল নানার কথায় , আমাদের নাজির নানা মা কে জায়গা দেখাতে শুরু করলেন ! টুটপাড়া কবরখানার সামনে জায়গা দেখান হল , মা বেঁকে বসলেন, কবরখানার সামনে বাড়ী ! নাহ কিছুতেই না ! সকাল বিকেল এই জীবন মৃত্যুর পালা দেখতে রাজী হলেন না মা । অবশেষে সরকার পাড়া রোডে এসে বাড়ীর সামনে খোলা মাঠ দেখে মা'র বেশ পছন্দ হল । একসাথে অনেক জমি কিন্তু টাকা ! মার মাটির ব্যাংকে মাত্র ৩০০ টাকা । টাকা পয়সা ধার টার করে জমি কেনা হল, প্রথমে অল্প !

মা বাড়ীতে উঠলেন , মায়ের পেটে আমার বয়স চার মাস ! নতুন ঘর তোলা হল, উঠোন লেপা হল চারিদিকে গাছ লাগিয়ে বাড়ীর দেয়ালের কাজ হল, নতুন বাড়ীতে আরো কয়েক মাস পরে আমার জন্ম হল, তখন খুলনা শহরের একমাত্র মহিলা ডাক্তার শামসুন নাহার আর নার্স কুঞ্জবালার হাতে !

বাড়ীতে তখন বাবার বন্ধু সাতক্ষীরার সোরমান কাকা, যিনি ভালোবেসে হিন্দু মেয়ে বিয়ে করে বাড়ী থেকে বিতাড়িত হয়ে এসে আমাদের বাড়ীতে ছিলেন, তার স্ত্রী, আমার মায়া কাকীমা আমায় কোলে নিয়ে নাম দিলেন অঞ্জলি । আমার নানী , আমার খালা , আমার নানীর বোন আমার সেজবু , আর তার স্বামী ফকির আব্দুর রহমান , আমার ফকির নানা , আমার মায়ের মামাতো খালাতো ভাই বোনেরা , আমার সালেহা খালা , আর হাজেরা খালা ওদের সবার আদরে ওই বাড়ীর ধুলো মাটি কিছু খেয়ে কিছু গায়ে মাথায় মেখে আমি বড় হলাম !

আমার নাম কিন্তু সেই অঞ্জলি আর রইল না । পাড়ার লোকের কথায় হিন্দুয়ানী নাম হয়ে যাবে সেই ভয়ে বদলে গেল আমার নাম । কিন্তু আমার মায়া কাকীমা তা কিছুতেই মানলেন না ! বড় হয়ে শুনেছি তাঁর দেয়া নাম রাখা হল না বলে তিনি অনেক কেঁদেছিলেন , তবে তিনিও হেরে যাবার পাত্রী নন আর তাই আমি ছিলাম চিরদিন আমার মায়া কাকীমার অতি আদরের অঞ্জলি । আমার নাম বদলে গিয়ে মা খালার নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে নাম হল । সেই নামের সাথে আদর সোহাগ মাখামাখি হয়ে তা লুতু হয়ে উঠল । লুতু মানেই পাড়ার মায়াবতী , আহ্লাদী , ঢংগী, চঞ্চলা, কবিতা ,গানে ভরপুর কাঁদুনি আর পড়াশোনায় একটু একটু ভালো মেয়েটির কথা ভাবে সবাই , কিন্তু আসলে সে একটু আধটু পাগোলও ছিল। একবার পাড়ায় চোর ধরা পড়েছে , পাড়ার ছেলেরা টাকে বেদম পিটুনি দিচ্ছে , তাই দেখে এমন কান্না জুড়ে দিলাম , রাস্তায় গড়াগড়ি কান্না , চিৎকার শুনে বাবার দুপুরের ঘুম ভেঙ্গে গেল , পাড়ার ছেলেরা ভাবল চোর পেটানোর চেয়ে আরো ভয়ংকর কিছু ঘটেছে ! বাবাকে বলে চোর কে ছাড়ান গেলো কিন্তু চোরের গায়ে জামা নেই পেটে খাবার নেই তার ব্যাবস্থা করতে মার সাহায্য প্রয়োজন হল , আবার একদফা কান্না জুড়ে দিলাম , যাহোক মা সে যাত্রা চোরকে ভাত খাইয়ে আর আমার দাদার গায়ের পুরনো জামা দিয়ে বিদায় করেছিলেন ।

তা ঐ লুতু আমার চিরকালের বাড়ীর নাম হয়ে গেল । আমি কাউকে নাম বলতে লজ্জা পেতাম খুব আর মা বলতেন এমন মধুর নাম নাকি আর হয় না ! মা যখন ডাকতেন , তখন নামের সাথে একটি অ যুক্ত হয়ে তাঁর কন্ঠের সোহাগ ঝরে পড়ত।

আমার জেদী মা কিন্তু ঠিকই একটু একটু করে পুরো জমিটাই কিনেছিলেন, তবে তা আস্তে আস্তে আরো পরে । আমার নানী ওই বাড়ীর একধারে বেশ বড় সড় শব্জীর বাগান করেছিলেন , আর এক ধারে আম, জাম , করমচা, কামরাঙা আর বেত গাছ লাগিয়ে ছিলেন । বাবার চাকরী উপলক্ষে আমরা তখন থাকতাম সাতক্ষীরা কালিগঞ্জে , একবার বাড়ীতে এসে দেখি আমাদের বাগান ভর্তি কাওনের ধান লাগান হয়েছে । সেই প্রথম দেখলাম কাওন নামে এক রকম চাল হয় , কিন্তু সে গাছের ঝাড় অনেক লম্বা ।

যত দিন বেঁচে ছিলেন , মা ঐ বাড়ী ছেড়ে কোথাও যেতে চাইতেন না । উৎসবে, পালা পার্বনে আমরাই যেতাম খুলনায় । ডাক্তার দেখাতে হলেও ঢাকায় তাঁকে আনার জন্যে আমার ভাই মানিককে নানা রকম ফন্দি ফিকির করতে হত । যেমন ' মা তোমারে দেখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু অফিস থেকে ছুটি দেবে না, অথবা তোমার হাতের রান্না খাই না কতদিন ।' মা আসতেন , কিন্তু এসেই বলতেন যাই !

২০১০ এ মা চলে গেলেন কিন্তু তাঁর মধুর স্মৃতি মাখা আমাদের ওই বাড়ী তার নীরব আগমনের আকাঙ্ক্ষায় প্রহর জাগে ! বাড়ীর বুকের তলায় কান পেতে কি সেই দীর্ঘশ্বাস শোনা যায় না ! আমি হাজার হাজার মাইল দূর থেকেও ঘোরের মধ্যে দেখি মা'র নরম সুন্দর পা দুখানি আমাদের সারা বাড়ীর মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে । মা কে দেখি আমি আমার অন্তরলোকে ।।


লেখক পরিচিতি
লুতফুন নাহার লতা

গল্পকার। কবি।
আবৃত্তিকার। অভিনেত্রী। একটিভিস্ট।
সদ্য প্রকাশিত কবিতার বই : চাঁদের উঠোন।
গল্পের বই : জীবন ও যুদ্ধের কোলাজ
নিউ ইয়র্কে থাকেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

5 মন্তব্যসমূহ