জয়শ্রী সরকারের জার্নাল : গোল হয়ে আসুন সকলে, ঘন হয়ে আসুন সকলে

এ শহর ইট পাথরের শহর। ভূ-স্তরের কতটুকু গেলে এখানে জল পাওয়া যাবে আমি জানিনা। যে জানে সেও সঠিক জানে কিনা আমি জানি না। পুরো দশ বার মাইলে এখানে পলাশ ফোটেনা, ফোটেনা নীলকন্ঠ বা বরুণফুল। চোখ জ্বালা করলে এখানে বাতাস মেলেনা, মন জ্বালা করলে দেখা যায় না ঘাস। এই কংক্রিটের শহরে পাখীরাও বড় প্রফেশনাল। কই যায়, কি করে, কই থাকে বলে না। শুধু ওড়ে, আর ওড়ে।


এখানে ঘুড়ি ওড়ানো, নাটাই-সুতা হলো উদযাপনের ছবি। এখানে মানুষ এক পলক হেসে কথা কয়, আদর করে ডাকে আবার মূহূর্তেই অপরিচিত হয়ে যায়। সবাই যেনো এক একটি ট্রেন। অনেক বগি নিয়ে বীরদর্পে ছুটে বেড়াচ্ছে। এক বগির সাথে অন্য বগির মিল নেই। তাই এক দুটি বগি খসে গেলে তার কোন প্রকার ক্ষরণ হয় না।

এখানকার নদীর জল কালো দুর্গন্ধময় । এখানে বৃষ্টি মানে ফাঁকি। এই যে দেখো দিন ডাকছে। প্রবল শব্দে ডাকছে। কিন্ত বৃষ্টি হবে কি হবে না স্বয়ং আকাশেরও বলবার জো নেই। এখানে ইচ্ছে করলেই হাপুস হুপস করে ভিজে ঘুরে বেড়ানো যায় না।

রাক্ষুসে ইমারতের দুইরুম, কিচেন১, বাথরুম১ ডাইনিং১, নামের ঝুপড়িতে সংসার বানায় মানুষ। পরিবার বলতে এই শহরের নব্বই ভাগ মানুষ জানে এবং মানে- বাবা মা ভাই বোন এই হলো পরিবার। পড়শীর সাথে যে পড়শীর সমন্ধ হয়। গ্রামে গঞ্জে যে মানুষ সই পাতায়, বাবা-মা-ভাইবোন পাতায়। পাতানো সইকে দেখতে না পাবার জন্যে সই যে কাঁদে, পাতানো মা-বাবা মারা গেলে অশৌচ খায়, পাতানো ভাইয়ের মঙ্গলের জন্যেও ভাইফোঁটা দেয়--এসবের কিচ্ছু কংক্রিট শহরের মানুষ জানে না।

ছোটবেলায় পাশের পড়শী মাসীর এক ভাই আসতো। সে এসে দিদি দিদি বলে ডাকতো। মাসী ভালো মন্দ রান্না করতো। পূজায় উনি আসতেন বোনের জন্যে নতুন কাপড় নিয়ে। ঈদে আবার বোন যেতো ভাইয়ের জন্যে কাপড় নিয়ে। মাকে অনেকদিন বলতাম একটা ভাই বানাও না। আমরাও মামার বাড়ি যাই। এই পাতানো সম্পর্ক, পড়শীর জন্যে চোখের জল ফেলা, ভালো মন্দ খাবার হলে তরকারী পাঠানো এই শহুরে জীবনে ফালতু, কখনো গেয়োপনাও বটে।

প্রবীণদের মনে যদিও সে সব সম্পর্কের জন্যে, সেই সব সময়ের জন্যে শূণ্যতা রয়েছে। রয়েছে হাহাকার। কিন্ত এই প্রজন্মের একভাগও সেই আবেগের ছিটেফোঁটা মূল্য দেয় কিনা সন্দেহ আছে! অবশ্য দেবেই বা কি করে যে শহরের শিশুরা দেখছে ঘরে দাদা-দাদী কে নিয়ে ভাগাভাগি হয়। মা, বাবা ঝগড়া করে তাদের থাকা না থাকা নিয়ে। চাচা বিয়ে করা মানেই অন্য সংসার। এক হাড়িতে তিনচারজনের বেশি চাল ফোটে না। কিছু হলেই কেবল তালাতালি। তালাতালি শব্দটা বোঝা গেলো তো মানে লাগালাগি, রেষারেষি। সে শিশু বড় হয়ে এর বাইরে ভাববে কেন? কেনই বা সে সম্পর্কের মায়াময় জালে বাঁধা থাকবে। পূর্ববর্তী প্রজন্ম যদি বাবা মা কে গ্রামে পাঠিয়ে থাকে, তবে এ প্রজন্ম তার বাবা মা কে আরো একধাপ দূরে ঠেলে দেবে সেই তো স্বাভাবিক। সে জন্যেই তো বৃদ্ধালয় শব্দটি বাংলাদেশের বেশ প্রচলিত।

এমন একটি পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা প্রজন্ম যৌথ পরিবার, পাতানো সম্পর্ক, পড়শীর দুঃখ, অগ্রজদের মন কেমন করার মূল্য দেবেনা এমনটাই ঘটবে, ঘটছে। আত্মকেন্দ্রিকতা ঠেলে দিচ্ছে পরিবারকে, সমাজকে, দেশকে ভয়াবহ অন্ধকারের দিকে। শুধু বলে মূল্যবোধ নেই। আরে মূল্যবোধ কি আকাশ থেকে পড়বে? একক-পরিবার-কেন্দ্রিকতা মূল্যবোধের কতটুকুই শেখাবে! কংক্রিটের শহুরে জীবন কেবলই আত্মকেন্দ্রিক। তাই এই শহরে মায়া কুঁড়ানো যায় না। কষ্ট হলে কাউকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কান্না করা যায় না। এই শহরের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মরা জানছে স্বামী স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিয়েই পরিবার। সেই পরিবারের বাইরে সব সম্পর্ক তুচ্ছ, লোক দেখানো, কখনো কখনো পাপময়ও বটে। আর এটা অগ্রজদের কাছ থেকেই শেখা। তাই এর দায় কোন না কোনভাবে অগ্রজদেরকেই নিতে হবে।

এখন এ থেকে উত্তরনের কি উপায়? উপায় আমি জানি না। তবে আমি জানি আমার দেশের অনেক গান, কবিতা, ছবির কথা। ছোটবেলায় স্কুলে একটি জারিগানে বলতাম --৬৮ হাজার গ্রাম নিয়া সোনার বাংলাদেশ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া রূপের নাইকো শেষ, দোয়েল শ্যামা ঘুঘু পাখি নিত্য করে গান মন্দিরেতে ঘন্টা বাজে মসজিদে আযান। সেই গ্রামঘেরা দেশে আমার জন্ম। তাই সুযোগ পেলেই গ্রামে যাই। গ্রামের পথে পথে মায়া আর মায়া। কখনো অভ্যাসের চেয়ে বেশি হাঁটতে হয়। ক্লান্ত হই। কিন্তু শারীরিকভাবে ক্লান্ত হলেও কখনো মানসিক ভাবে ক্লান্তবোধ করি না। বড় সরল সে জীবন। মাঠের পর মাঠ সবুজ আর সবুজ। ধুলো থাকলেও সেখানে জল আছে। কষ্ট থাকলেও সেখানে সুখ আছে। সেখানে এখনো অচেনা জনকেও পিড়ি পেতে বসতে দেয়। মাটির কলসে রাখা জল থেকে এক গ্লাস জল এনে দেয় বুক জুড়ানোর জন্যে। পান খাবার অভ্যাস আছে কিনা জানতে চায়।

আমার পান খাবার অভ্যাস নেই। তবু আমি ওদের আদর মাখা পান খাই। আদর শব্দটি নিকানো উঠোনের মতো, গাছের মতো, জলের মত, বৃষ্টির মতো, গাছভরা শেফালি, একঝাঁক পাখী, পালতোলা নৌকা, পুকুরভরা শ্যাওলার মতো মায়াময়। গ্রামের পথে পথে কয়েকদিন ঘুরে বেড়াই সেই আদরের জন্যে। কখনো কখনো পাগলের মতো অপরিচিত মানুষের ঘরে থেকে যাই। ওরা বলে দিদি একটা চকিতে মেয়েদের সাথে থাকতে হবে। আমি বলি থাকবো। ওরা আমার জন্যে তাদের সাথে বিছানা পাতে, ওদের সাথে আর একটি বেশি খাবারের থালা রাখে। আমি বুঝি এই চালটা ওদের বেশি গেলো। কিন্তু এতে আমার মন খারাপ হয় না। কারণ এই দেশের মানুষ অতিথিকে শত কষ্টের মধ্যেও একবেলা খাওয়াবে, থাকতে দেবে, সুখ দুঃখের কথা বলবে সেই তো শুনে এসেছি ছোটবেলা থেকে। দেখে এসেছি-- আমার মা বিশাল হাড়ি নামাতো চুলা থেকে। কীর্ত্তন বা পাল-পরবে গ্রাম থেকে আসা আত্মীয় স্বজনদের চৌকিতে থাকতে দিয়ে আমাদের জন্যে মাটিতে বিছানা করা হতো। তাই ওদের আপ্যায়ন আমাকে আনন্দিত করে। আমার উচ্ছলতার রস সঞ্চার করে। আমি সেই টানেই বারাবর গ্রামের পথে মাঠে ঘুরি আর মায়া কুঁড়াই। কুঁড়াই আদর। আদর এবং মায়া আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুস্তক। সেই পুস্তক ছাড়া আর কিচ্ছু পড়তে চাইনা আমি। সে যত মূর্খ্য অজ্ঞানতার নিদর্শনই হোক না কেনো।

ঘন ঘোর অন্ধকার আসছে ধেয়ে। প্রিয় অগ্রজরা সবার হাতে আপনাদের এমনই একটি পুস্তক তুলে দেবার সময় এসেছে। অনেক পথ মত তো আসছে কোন আধাঁর কিন্তু কাটছে না। এখন অস্ত্র হতে পারে একটিই। সেটি হলো আদর-মায়া-বন্ধন। তাই গোল হয়ে আসুন সকলে, ঘন হয়ে আসুন সকলে।


লেখক পরিচিতি
জয়শ্রী সরকার
বাড়ি নেত্রকোনায়। 

সংস্কৃতি কর্মী।
বাংলাদেশ উদিচী শিল্পী গোষ্ঠীর সংগঠক।
পেশাগতভাবে উন্নয়ন কর্মী।
লেখেন কবিতা আর গল্প।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. Protibidhan ache ki kichu ?
    Fire jawato jay na sudhu lalon kora jay monon ar achare.
    Amader harano monimukta amaderi khuje ante hobe.
    Apnar ei anudhabon onek mulloban. Ei obosor ar agrohotukuo nai amader.
    Bastobota obosso ashabadi korena...
    Jodi lorai kore bastobota bodle deya jeto; palte deya jeto agamir digantarekha ...Kotoi na valo hoto!!!

    উত্তরমুছুন
  2. 'এখানে মানুষ এক পলক হেসে কথা কয়, আদর করে ডাকে আবার মূহূর্তেই অপরিচিত হয়ে যায়।' লাইনটা আমার খুব ভালো লাগসে জয়শ্রী দি।

    উত্তরমুছুন