মার্কসবাদী মরমি কথাকার ডোরিস লেসিং

মাসুদুজ্জামান
জন্মেছিলেন ইরানে, দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন আফ্রিকায়, এরপর শেষজীবনে থিতু হয়েছেন লন্ডনে। ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক হিসেবে তাই তাঁর খ্যাতি। ইংল্যান্ডে ও পশ্চিমা বিশ্বে বাম মতাদর্শ এবং দ্বিতীয় ধারার নারীবাদী লেখক হিসেবে পাঠকপ্রিয় ঔপন্যাসিক তিনি। প্রাথমিকভাবে নারী-পুরুষের সম্পর্কের পুনর্বিচার এবং শ্রেণী-অবস্থানকে নতুন করে চিনিয়ে দেওয়ার কারণে সাহিত্য সমালোচকদের আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছিলেন। ইংরেজ ভাষাভাষী পাঠকেরা এভাবেই গত শতকের পঞ্চম ও ষষ্ঠ দশকে উল্লেখযোগ্য একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে আবিষ্কার করেছেন তাঁকে। এরপর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির [২০০৭] মধ্য দিয়ে জুটেছে বিশ্বখ্যাতি।


২.
লেসিং প্রধানত ঔপন্যাসিক। কিন্তু অন্য নানা ধরনের রচনা, যেমন- অসংখ্য গল্প, স্মৃতিচারণা, প্রামাণ্যগদ্য, প্রবন্ধ, নাটক, কবিতা, এমনকি গ্রন্থ সমালোচনায়ও সিদ্ধহস্ত ছিলেন এ ব্রিটিশ লেখক। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হচ্ছে 'দ্য গ্রাস ইজ সিংগিং', 'মার্থা কোয়েস্ট', 'দ্য গোল্ডেন নোটবুক', 'শিকাস্তা', 'দ্য ম্যারেজ বিটুইন জোনস থ্রি', 'ফোর, অ্যান্ড ফাইভ', 'দ্য ডায়েরি অব আ গুড নেইবার', 'দ্য গুড টেররিস্ট', 'লাভ এগেইন', 'বেন, ইন দ্য ওয়ার্ল্ড' ইত্যাদি।
বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যেসব ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিকের রচনা ব্যাপকভাবে পঠিত হয়েছে বা হচ্ছে, লেসিংয়ের অবস্থান তাঁদের শীর্ষে। পৃথিবীর বহু ভাষায় তাঁর উপন্যাস অনূদিত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে সমালোচকদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছেন তিনি। তাঁর উপন্যাসের বিষয়-আশয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর গভীর। লেখালেখির ভেতর দিয়ে তিনি এ কথাটিই বারবার বলতে চেয়েছেন, মানবজাতিকে এমন তীব্র মানবিক সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে, যাতে মানবিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের অবসান ঘটে। লেসিংকে যদিও চরম বাস্তববাদী একজন লেখক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তবু তিনি ছিলেন নিরীক্ষাপ্রিয় ঔপন্যাসিক, জাদুবাস্তবতারও উদ্ভাস ঘটেছে তাঁর কোনো কোনো রচনায়। কল্পবিজ্ঞানধর্মী লেখাগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন ফ্যান্টাসির। বিষয়-আশয়ের উদ্ভাবনে মাক্সবাদ ও বিশ্ব রাজনীতির দ্বারা যেমন তিনি প্রভাবিত হয়েছেন, তেমনি সুফি ভাবাদর্শের দ্বারাও বিভাবিত ছিলেন এ ঔপন্যাসিক। বৈশ্বিক রাজনীতির ব্যাপ্ত পরিসর থেকে ব্যক্তিজীবনের ছোট ছোট অনুষঙ্গকে নিজের লেখায় স্থান করে দিয়েছেন তিনি।
পারিবারিক পরিচয় অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁর বাবা আলফ্রেড কুক এবং মা এমিলি টেইলার পারস্যে [পরবর্তীকালে ইরান] চলে আসেন। এই পারস্যের কেরমানশাহে মা-বাবার প্রথম সন্তান হিসেবে ১৯১৯ সালে লেসিং জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৫ সালে ইরান ছেড়ে তাঁরা চলে আসেন দক্ষিণ রোডেশিয়ায় [বর্তমানে জিম্বাবুয়ে]। স্বাপি্নক বাবা অর্থনৈতিক দিক থেকে কখনোই সফল হতে পারেননি। আফ্রিকার ভূপ্রকৃতি লেসিংয়ের খুবই প্রিয় ছিল। একটি ক্যাথলিক কনভেন্ট স্কুলে পড়তেন তিনি; কিন্তু মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাঁকে আফ্রিকা ছেড়ে আসতে হয়। সেবিকা হিসেবে মাত্র ১৫ বছর বয়সে কর্মজীবন শুরু করেন। দুইবার বিয়ে হয়; কিন্তু দুইবারই বিচ্ছেদ ঘটে যায়। এরপর ১৯৪৭ সালে লন্ডনে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। ইংল্যান্ডে আসার পরই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস। লেখালেখিকেই জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি। গণমাধ্যমে লিখতে থাকেন নানা ধরনের রচনা, বই-সমালোচনা, বিচিত্র ধরনের গদ্য; একই সঙ্গে লিখছিলেন উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক ও কবিতা।
রোডেশিয়া থাকাকালে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি ঝুঁকে পড়েন লেসিং। রোডেশিয়ার একটি মাক্সবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে, ইংল্যান্ডে এসে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। ১৯৫৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করেন। ১৯৫০-এর দশকে পারমাণবিক অস্ত্রনিরোধ বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৮ সালে এ রকম একটা সমাবেশে বক্তব্যও দেন লেসিং। ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে নাটকের প্রতি তাঁর অনুরাগ জন্মে, তিনি থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এ সময়েই 'সেন্টার ৪২' নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সহায়তা করেন লেসিং। তবে ১৯৬০-এর শেষদিকে সুফিবাদের প্রভাবে তাঁর মধ্যে যে মতাদর্শিক রূপান্তর ঘটে যায়, পরে সেই ভাবনাই তাঁর লেখালেখিতে তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রখ্যাত সুফি দার্শনিক ইদ্রিস শাহের সাহচর্যে লেসিংয়ের মধ্যে ঘটে যায় এ মতাদর্শিক ভাবান্তর। সুফিবাদই লেসিংকে এ দীক্ষাই দিয়েছিল যে আত্মসত্তার সঙ্গে মনের এবং মনের সঙ্গে অন্যদের সমন্বয় ঘটিয়ে মানুষকে জীবন যাপন করতে হয়। লন্ডনে নিভৃতেই জীবন যাপন করতেন লেসিং, জনসমক্ষে খুব একটা বের হতেন না। কিন্তু গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি বিভিন্ন সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যিক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর আত্মজীবনী পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

৩.
সমালোচকরা এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন যে লেসিং ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী একজন ঔপন্যাসিক। মানবিক সংবেদনা ও সচেতনতাকে উন্নত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। তাঁর উপন্যাসে যে ন্যারেটিভ কণ্ঠস্বরকে আমরা আবিষ্কার করি, সে একজন গভীর চিন্তাশীল মানুষ- প্রধানত নারী। এই চরিত্র বা বয়ানদাতার ভূমিকাও যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, তা আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। উপন্যাসের এ চিন্তাশীল চরিত্রটি চারপাশে কী ঘটছে সেটা পর্যবেক্ষণ করে, আবিষ্কার করে এবং সমকালীন পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করে। কিন্তু এটাই তাঁর অন্তিম অভিপ্রায় নয়, তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে মানবিক জীবন- ব্যক্তিমানুষ ও মানবজাতির সামগ্রিক অবস্থাকে উপজীব্য করে তোলা। অনুভূত বাস্তবতার ভেতর দিয়ে মানবিক অভিজ্ঞানকে এভাবেই উপন্যাসের বিষয় করে তুলেছেন লেসিং। এই হচ্ছে ডোরিস লেসিংয়ের উপন্যাসের বিষয়-আশয়। তাঁর প্রধান চরিত্রগুলো বারবার এ কথাই বলতে চেয়েছে যে মানুষ কিভাবে নিজেকে দেখে, বিশ্বকে অনুভব করে, কিভাবে অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে- এসবের ওপরই তাঁর অস্তিত্ব নির্ভরশীল।

জীবনকে এভাবেই ব্যাপক পরিসরে উপলব্ধি ও ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন লেসিং। তাঁর উপন্যাসে চরিত্রগুলোর অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ পাওয়া যায়- ব্যক্তিক ভীতি, আসক্তি, দ্বন্দ্ব, অনুরাগের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে মানুষ। কিন্তু ব্যক্তিজীবনের মধ্যেই মানবিক অভিযাত্রা নিঃশেষ হয়ে যায় না। বৈশ্বিক যে আর্থরাজনৈতিক কাঠামো আছে এর সঙ্গে জড়িয়েই মানুষের চলা। আর্থরাজনৈতিক অভিযানও আবার শেষ কথা নয়। মানবিক অস্তিত্বের পরাতাত্তি্বক বা আধিবৈদিক দিকটিও অস্বীকার করা যাবে না। লেসিংয়ের উপন্যাসের অর্থ বা বয়ানস্তর তাই একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক। এতে বিভিন্ন অনুষঙ্গ এমনভাবে পরম্পরিত হয়ে থাকে যে একক কোনো দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণতা পায় না। বর্ণনার বৈচিত্র্যও পাঠককে নানা দিকে চালিত করে। লেসিংয়ের উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে রয়েছে বর্ণনার নানা স্তর- বাস্তববাদ, যথাস্থিতবাদ, কল্পবিজ্ঞান, ইউটোপীয় ধরন, ফ্যান্টাসি, লোকগল্প, উত্তর-আধুনিকতাবাদী বিশ্বপরম্পরা, নিরীক্ষা প্রবণতা- সব অবিমিশ্র হয়ে গেছে তাঁর লেখায়। বিষয় বা থিমের বহুমাত্রিকতা, শৈলী, পটভূমি এমনভাবে তাঁর উপন্যাসে মিশে থাকে যে কোনো একটি বিশেষ ছাঁচে ফেলে তাঁর রচনাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। অস্তিত্ব তাঁর উপন্যাসে সব সময়ই সক্রিয় একটি বিষয়, চলিষ্ণুতাই চরিত্রের স্বধর্ম।

তাঁর জন্মের পটভূমি, বেড়ে ওঠার বিশেষ ভূপ্রকৃতি, মহাদেশীয় সঞ্চরণশীলতা- মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। ইংরেজ এক পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি, কৈশোর কেটেছে রোডেশিয়ায়, কালোদের সঙ্গে মিশেছেন, দেখেছেন অভিজাত শ্বেতাঙ্গদের, কাটিয়েছেন পারিবারিক ও একক বিচ্ছিন্ন জীবন, নগরে মুখোমুখি হয়েছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির- এর সবই মূলত তাঁর উপন্যাসে নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সমৃদ্ধ করেছে তাঁর লেখালেখিকে। এবার সেই লেখালেখির কিছু প্রবণতার কথা এখানে উল্লেখ করছি।

৪.
রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন ডরিস লেসিং। তাঁর লেখালেখিতেও এর প্রতিফলন লক্ষ করা যাবে। 'গোয়িং হোম' উপন্যাসের মাধ্যমে এর শুরু। লেখকের দায়বোধ থেকে তিনি সব সময় ভেবেছেন, রাজনীতির সঙ্গে আমাদের যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। এই ভাবনা থেকেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। 'ইচ হিজ ওন ওয়াইল্ডারনেস' নাটকেও তাঁর এই রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা পাওয়া যাবে। নাটকটির শেষে ব্যক্তিক দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক সংঘাতের কথা এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যে, রাজনৈতিক অঙ্গীকারই শেষ অব্দি প্রধান হয়ে ওঠে। শুধু নাটক নয়, উপন্যাসেরও বিষয়-আশয় হয়ে উঠেছে এই রাজনীতি। 'মার্থা কোয়েস্ট', 'আ প্রোপার ম্যারেজ', 'আ রিপল ফ্রম দি স্টর্ম' আখ্যানগুলোতেও রাজনৈতিক মতাদর্শের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। এর প্রধান নারী চরিত্রগুলো সমাজ বদলের জন্য উদগ্রীব, পৃথিবীকে বদলে ফেলার জন্য সচেষ্ট। মার্থা কোয়েস্টের নায়িকা মার্থা আফ্রিকার ঔপনিবেশিক সমাজের মধ্যে বাস করে, নিজেকে সে এই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যাখ্যা করে, নিজের কথা ভাবে। এই উপন্যাসে তাই বর্ণভেদের পরিবর্তে সমাজতন্ত্র ও অর্থনীতির কথাই প্রধান হয়ে উঠেছে। মায়ের সঙ্গে কন্যার যে দ্বন্দ্বের কথা এই উপন্যাসে উপজীব্য হয়েছে, রাজনৈতিক ও যৌনদ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটেও তা ব্যাখ্যা করা যায়। এই একই বিষয়ের উপস্থাপনা ঘটেছে 'ইচ হিজ ওন ওয়াইল্ডারনেস' নাটকেও।

মার্থা কোয়েস্টে লক্ষ করি, উপনিবেশবাদের দ্বারা জর্জরিত সমাজের নিপীড়িত নারী মার্থা জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়। কিন্তু আফ্রিকার বৈরী ঔপনিবেশিক সমাজের কোনো পরিবর্তনের সূচনা সে করতে পারে না। কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের জীবন বদলে দিতে পারে না। কিন্তু এই ব্যর্থতার পরও তার আদর্শচ্যুতি ঘটেনি। রাজনৈতিকভাবেই সে নিজেকে খুঁজে ফিরেছে, যা যে বিশ্বাস করে তার জন্য লড়ে গেছে।

'রিট্রিট টু ইনোসেন্স' উপন্যাসের তরুণী নায়িকা জুলিয়া বার মার্থার তুলনায় কিছুটা জটিল চরিত্র। অভিজাত উদার এক পরিবারে তার জন্ম, সেও খুঁজে ফেরে জীবনের অর্থ। এভাবেই জীবনের অর্থ খুঁজতে গিয়ে প্রেমে পড়ে উদ্বাস্তু কমিউনিস্ট নেতা জান ব্রডের। ব্রড জুলিয়ার তুলনায় বয়সে দ্বিগুণ বড়। জুলিয়া রাজনীতি নিয়ে ব্রডের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেয় আর কমিউনিস্ট রাজনীতি সম্পর্কে তাকে সচেতন করে দেয়। জুলিয়া বুঝতে পারে, কমিউনিস্ট মতাদর্শ নিয়ে ব্রডের আবেগ কতটা তীব্র। এই তীব্রতাই অসম বয়সী দুজন মানুষকে অনেক নিবিড় করে পেতে সহায়তা করে। লেসিংয়ের অনেক নায়িকা মূলত এভাবেই সমাজের দ্বারা পীড়িত হয়ে বয়স্ক আদর্শবাদী মানুষের মাঝে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। তবে শুধু রাজনীতি নয়, লেসিংয়ের নারী চরিত্রগুলো নিজেদের অবস্থাকে উপলব্ধি করে যৌন সম্পর্কের নিরিখে। বুদ্ধিদীপ্ত পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে এসে এভাবেই জুলিয়া, মার্থা তাদের ঔপনিবেশিক সমাজকে অস্বীকার করে। খুঁজে পেতে চায় আত্মমুক্তি। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই লেসিং মূলত এই ধরনের চরিত্র নির্মাণ করেছেন। ঔপনিবেশিক আফ্রিকা এভাবেই তাঁর কথাসাহিত্যের বিষয় হয়ে ওঠে।

বেশ কয়েকটি ছোট উপন্যাসে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যকার পার্থক্যের কথাও বিষয় হয়ে উঠেছে। এভাবেই স্থানিকতা, সামাজিক শ্রেণী, প্রজন্মের ব্যবধান, ঐতিহাসিক সংকট ইত্যাদি বিষয়কে ঘিরেই গড়ে উঠেছে তাঁর উপন্যাসের কাহিনী। কাহিনী গড়ে তুলতে গিয়ে লেসিং আশ্রয় নিয়েছেন সাংবাদিকধর্মী বয়ানরীতির। সংবাদ পরিবেশনের মতো করে এভাবেই তিনি চরিত্রগুলোর সামাজিক পটভূমি এবং স্থান ও পরিবেশের বর্ণনা দিয়েছেন। উপন্যাসের ভাষাশৈলীতে নিরীক্ষার ছোঁয়া লেগেছে।

'দি গোল্ডেন নোটবুকে'র জন্যই সবচেয়ে খ্যাতিমান লেসিং। উপন্যাস রচনার পুরনো রীতি-পদ্ধতি অনুসরণ করেই তিনি উপন্যাস লিখেছেন। সনাতন ধারারই লেখক তিনি। বাস্তববাদী কথাসাহিত্যিক বলে যাঁদের চিহ্নিত করা হয়, লেসিং ছিলেন সেই ধারারই লেখক, তবে সমকালীন জীবনের কথা হয়ে উঠেছিল তাঁর উপন্যাসের প্রধান বিষয়-আশয়।
নানা কারণে তিনি একজন বহুল পঠিত কথাসাহিত্যিক। এর একটি প্রধান কারণ হলো তাঁর নায়িকারা। এরা যেমন বুদ্ধিদীপ্ত, তেমনি প্রাণবন্ত, এই নায়িকারা সহজেই তাদের পাঠকদের আকৃষ্ট করতে পারে। সমকালের ব্রিটিশ পুরুষ ঔপন্যাসিকরা যেখানে দুর্বিনীত, ভ্রষ্ট, পুরুষ-ভোলানো নায়িকার ছবি এঁকেছেন, লেসিং সেখানে বাস্তবে দেখা যায় এমন নারী চরিত্রকেই উপন্যাসের চরিত্র করে তুলেছেন।

'আমার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা মানুষজনের কথাই আমি সব সময় লিখি।' ১৯৮০ সালে একটা সাক্ষাৎকারে এমন কথাই বলেছিলেন লেসিং। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে যখন তিনি লেখালেখি শুরু করেন তখনো বলেছিলেন, 'যৌথজীবনের সঙ্গে ব্যক্তিসম্পর্কের সচেতন সম্পর্ক স্থাপনই হচ্ছে উপন্যাস।' ব্যক্তিমানুষের যৌথ অভিজ্ঞান থেকে ব্যক্তিক জীবনের দিকে এভাবেই ফিরে এসেছিলেন লেসিং। লক্ষ করলে দেখা যাবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অন্তর্গত জীবন সম্পর্কে তিনি অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। মানুষকে তিনি সমাজবাস্তবতার বিচূর্ণ অংশ বলে মনে করেছেন। খণ্ডিত, ধ্বস্ত, আক্রান্ত, পীড়িত মানুষের কথাই বারবার এভাবে উপজীব্য হয়েছে তাঁর লেখায়। তাঁর ধারণায় ব্যক্তিমানুষ হচ্ছে খণ্ডিত সমাজ বাস্তবতার নির্যাতিত অংশ। কিন্তু মানুষের এই ধ্বস্ত রূপ নয়, ব্যক্তি কিভাবে তার অন্তর্লোককে উপলব্ধি করার মধ্য দিয়ে সমষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে, সে কথাও ভেবেছেন। লিখেছেন এই ধরনের উপন্যাস। সমালোচকরা লেসিংয়ের এই ধরনের উপন্যাসকে সুফি মরমিবাদের দ্বারা প্রভাবিত বলে চিহ্নিত করেছেন। প্রখ্যাত মনোবিশ্লেষক য়ুংয়ের যৌথনির্জ্ঞান বা জাতিগত আর্কিটাইপেরও প্রভাব পড়েছে এই ধরনের লেখায়। 'দি ম্যারেজ বিটুইন জোনস থ্রি', 'ফোর, অ্যান্ড ফাইভ' এবং 'ক্যানোপাস' সিরিজের দ্বিতীয় খণ্ডটি এরই অনুপ্রাণনায় লেখা। একদিকে মার্কসীয় নারীবাদী অনুষঙ্গ, অন্যদিকে মনোবিশ্লেষণ- এই দুইয়ের সমন্বয়েই লেসিং লিখেছেন তাঁর মধ্য ও শেষ জীবনের কয়েকটি উপন্যাস ও গল্প। মরমিপথের প্রতি ঝুঁকে পড়ার ফল হিসেবেই আমরা পেয়েছি 'ম্যারেজ' শীর্ষক উপন্যাসটি।

কিন্তু কিভাবে ঘটল লেসিংয়ের এই রূপান্তর? খুবই কৌতূহলোদ্দীপক এই প্রশ্ন। প্রধানত সুফি মরমিবাদের অন্যতম প্রবক্তা ইদ্রিস শাহের সাহচর্যে এসে লেসিং এই জীবনভাবনার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। 'ম্যারেজে'ই তিনি দেখান যে সাইকি বা মনের বাইরেও অন্য কোনো শক্তির অধিষ্ঠান হয়তো আছে। অনেকেই লক্ষ করেছেন, লেসিংয়ের এই ধরনের লেখায় মানসিক অনুষঙ্গের সঙ্গে বিমিশ্র হয়ে গেছে বাস্তব জীবন। 'এটা এ রকম বা ওরকম নয়, এটা এবং এটা এটাই সব কিছু ... তোমার স্বপ্ন, তোমার জীবন'- এ রকমই একবার বলেছিলেন লেসিং। স্বপ্ন বা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মিথই উপজীব্য হয়েছে 'ম্যারেজ' উপন্যাসে। একই সঙ্গে এতে মিশেছে মন, সমাজ ও মরমি অনুষঙ্গ, ব্যক্তি ও সমাজ। 'চিলড্রেন অব ভায়োলেন্সে'ও আমরা এই দার্শনিক-ব্যক্তিক অনুভবের প্রতিফলন লক্ষ করেছি। মার্থা কোয়েস্টেও এটা লক্ষ করা যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হচ্ছে, মার্থা চরমপন্থী রাজনীতির প্রতি ঝুঁকছে। খুঁজে পাচ্ছে নতুন আত্মপরিচয়। নিজেকে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত করে দায়বদ্ধ করে তুলছে। বিয়ে করছে বয়স্ক এমন একজন নেতাকে, যাঁর ভেতরে সে নিজের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত দেখছে। একই সঙ্গে ব্যক্তিক অনুভূতি, রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং ব্যক্তিক আচরণ মিলেমিশে আত্ম অনুভবকে তীব্রতর করে তুলছে। দি গোল্ডেন নোটবুকের নায়ক আরো গভীরে ডুবে গেছে। তাঁর উপলব্ধি জাগে, বাইরের বিচূর্ণ পৃথিবীতে কোনো প্রতিষেধক নেই, নেই মুক্তি। লেসিংয়ের উপন্যাসের এটাই মূলসূত্র- বিচূর্ণতার বিপরীতে অন্তর্গত ঐক্যের প্রতিষেধক দিয়েই চরিত্রগুলো নিজেদের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করে। দি ফোরগেটেড সিটি, চিলড্রেন অব ভায়োলেন্সে আমরা এ ভাবনারই প্রকাশ লক্ষ করি। তবে ব্যক্তির অন্তর্লোক ও বহির্জগতকে তিনি পৃথক রাখেন না, এক ধরনের ঐক্য সাধনের মধ্য দিয়ে চরিত্রগুলোকে অস্তিত্ববান করে তোলেন। ঔপনিবেশ কালের মানুষ এভাবেই লেসিংয়ের উপন্যাসে মুক্তি খুঁজে পেয়েছে।

পরিশেষে বলা প্রয়োজন, ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা করলেও লেসিং মূলত প্রাচ্যের ভাবনাকেই তাঁর উপন্যাসে উপজীব্য করেছেন। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য তাঁর উপন্যাসে অবিমিশ্র অভিজ্ঞানে তাই খুবই উজ্জ্বল। জন্মই আসলে তাঁর এই সৃজনশীল ভবিতব্যকে নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ব্রিটিশ লেখকদের মধ্যে তাঁর স্থান তাই অনন্য হয়ে থাকবে। বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অভূতপূর্ব রচনাশৈলীর কারণে বিশ্বসাহিত্যেও তিনি আলোচিত হবেন বহুকাল। তাঁর মৃত্যুতে শোকাভিভূত একজন পাঠক হিসেবে এই লেখাটি তাঁকে নিবেদন করছি।



লেখকপরিচিতি
মাসুদুজ্জামান
পিএইচডি

অধ্যাপক
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট

সর্বশেষ প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ :
প্রবন্ধ--
কাফকার প্রেম [অবসর প্রকশনী],
নারী যৌনতা রাজনীতি [বেঙ্গল পাবলিকেসন্স] 
দেবদূত পুরুষ ও যৌনরাজনীতি [শুদ্ধস্বর প্রকাশনী], 

অনুবাদ--
টমাস ট্রান্সট্রোমারের কবিতা 
আত্মস্মৃতি সাক্ষাৎকার [অঙ্কুর প্রকাশনী]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ