
যান্ত্রিক কোন শব্দে অভ্যস্ত নয় এ গ্রামের লোকজন। যান্ত্রিক শব্দ তাদের কাছে গহীন জঙ্গলে বাঘের গর্জনের মতোই ভীতিকর মনে হয়। মাঝে মাঝে ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা দিয়ে প্রশাসনের দু একটা গাড়ী বা মোটর সাইকেলের শব্দ তারা শুনতে পায়, তা আসে কোন কেসের আসামী ধরতে বা লোনের টাকা আদায় করতে। সে বাহনের ধুলোয় ঢাকা পড়ে যায় গ্রামের লোকগুলোর আত্নবিশ্বাস। গ্রামের লোকগুলো ভয়ে কুঁকড়ে থাকে এসব বাহন ও তার যাত্রীর দিকে তাকিয়ে। আর গ্রামের মারামারি কিংবা জমি দখলের কাজে প্রায়ই ব্যবহার করা হয় লাঠি, বর্ষা, বল্লম। জমি দখলের কাজে টোটা বন্দুকের ব্যবহার হয়েছিল বছর তিনেক আগে। গ্রামের বাদশা মিয়া ব্যবহার করেছিল সে বন্দুক। বন্দুকের সে শব্দের ভীতি নিয়ে এখনও আলোচনা চলে অলস মুহুর্তে গাছের নীচের কোন বৈঠকি আলোচনায়। তবে গত দু তিন মাস থেকে চারিদিকে গুলির মিলিয়ে যাওয়া শব্দে সন্ত্রস্ত এ জনপদ। দুরে পলাশবাড়ি কিংবা বকসিগঞ্জে ঠুসঠাস মিলিয়ে যাওয়া গুলির শব্দ আর আকাশে কুন্ডলি পাকিয়ে ওঠা ধোঁয়া দেখে যুদ্ধ ভীতির মাঝে রাত কাটাচ্ছে সবাই।
রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো না থাকার কারনে এখন পর্যন্ত এ এলাকার লোকজন খাকি শাটর্ প্যান্টের দর্শন কিংবা লেফট রাইট শব্দ তাদের কর্নকুহরে প্রবেশ করে নি তবে মাঝে মাঝে তাড়া খাওয়া লোকজনের ভয়ার্ত মুখের উচ্চারণ " আর্মি আজ এ রাস্তা দিয়েই ছুটছে" শুনে নারী পুরুষ সকলেই নৌকা করে পিছনের বিল পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নেয় কুটি পাড়ায়। চারিদিকে নদী ঘেরা দ্বীপের মতো এ এলাকাকে মনে করা হয় সবচেয়ে নিরাপদ। তখন শুধু বুড়ো দু একজন লোক থাকে বাড়ি পাহারায়। গত তিনমাসে এরুপ গুজবে কতশতবার যে নদী পাড়ি দিতে হয়েছে এ গ্রামের লোকজনকে তার কোন লেখাজোখা নেই। এমন একটি সময়ে খুব কাছেই তাজা গুলির শব্দ শুনে সবাই দৌড় দেয় বাড়ির পিছনের দিকে নৌকায় করে কুটিপাড়ায় যাওয়ার জন্য। এর মাঝেই দাত কেলানো হাসি দিয়ে পথ আগলে দাড়ায় মইদাল-
-ভাইজান কৈ যান, ভয় পাইলেন নাকি? মুই না রাইফেল দিয়া পাখি মারবার নাকছোম।
চিকন বুদ্ধির মইদাল অনেকটা বাইম মাছের মতো। সার্বক্ষনিক কাদার মধ্যে থাকলেও যখন বেরিয়ে আসে তখন তার গায়ে কাদার কোন চিহ্ন থাকে না ! নাটের গুরু হয়েও সে কারও ক্ষতি করেছে এমন কোন বড় প্রমান গ্রামে নেই। মাস দুয়েক আগে রটে যায় মইদাল থানা সদরে গিয়ে রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়েছে। এ নিয়ে গ্রামের বয়স্ক লোকেরা আল্লার কাছে শুকরিয়া আদায় করে। তাদের ধারণা এ গ্রামে এখনও পাক বাহিনী আসে নাই মইদালের কারনে, আর গ্রামের উঠতি বয়সের ছেলেরা যারা লাঠি নিয়ে চুপি চুপি স্কুল মাঠে যুদ্ধের ট্রেনিং নেয়, তারা ঘোষণা দিয়ে রেখেছে- মইদালকে যেখানে পাবে সেখানেই লাঠির আঘাতে তার মাথা দু ফাক করে দিবে। গ্রামের দু প্রজন্মের মাঝে এ নিয়ে কানাঘুষা আছে, এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মকে চুপিসারে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করছে। গ্রামের এ অস্থির বিষয়টি মইদালের কান পর্যন্ত গিয়েছে। যে কারনে সে দুমাস পর গ্রামে এসেছে কাধে রাইফেল নিয়ে। তার কাছে রাইফেল আছে বিষয়টি জানান দেয়ার জন্য সে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার মোড়ে এসে আকাশে উড়ে যাওয়া পাখির দিকে তাক করে গুলি ছুড়ছে। মইদালের হাতে রাইফেল দেখে গ্রামের নেংটো ছেলে মেয়েরা তার পিছনে ধুলো উড়িয়ে দল বেঁধে ঘুরছে। মনে হয় সে যেন হ্যামিলনের সেই বাঁশি ওয়ালা। দু একজন বয়োজেষ্ঠ্য লোকের সাথে দেখা হলে সে উদর্ুতে বলছে-
-চাচা, কুচ পরোয়া নেহি।
মইদালের এ আন্তরিক সম্ভাষনে বয়স্ক লোক ভীতির চোখে তাকিয়ে তার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করতে চায় কিন্তু রাইফেলের ভয়ে সে পথে পা না বাড়িয়ে বরং " ভালো থাকো বাবা ভালো থাকো " বলতে বলতে রাস্তা থেকে জমির আইলে নেমে পাট ক্ষেতের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যায়। মইদাল এ বিষয়টি বেশ উপভোগ করে। গ্রামের যে লোকেরা পান থেকে চুন খসলে তাকে শাসিয়ে কথা বলতো, গরীব ঘরের সন্তান বলে তুই তুকারি করতো, তারাই এখন বাবা ছাড়া কথা বলে না। এ দুদিনে মিয়া বাড়ী আর মোল্লা বাড়ী তাকে দাওয়াত করে খাইয়েছে। মোল্লা বাড়ির ত্রয়োদশী মেয়ে যার সাথে কথা বলার স্বপ্ন দেখতো, সেই মরিয়ম তাকে ভাত বেড়ে খাইয়েছে। রাতের বেলা ঘরে ফিরে মইদাল রাইফেলের গায়ে হাত ঘসতে ঘসতে আপন মনে বলে-
"তুই যদি আমার সাথে থাকিস রে রাইফেল তবে তোকে এক পাশে আর মরিয়মকে একপাশে রেখে এ ঘরেই সুখের সংসার শুরু করবো।"
জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে আমুল পাল্টে যায় গ্রামের পরিবেশ আর মানুষের জীবন। কী হবে না হবে তা নিয়ে ধনী গরিব, শিক্ষিত অশিক্ষিত সবার মাঝেই চাপা অস্থিরতা। সন্ধ্যা হলেই লোকজন কানে রেডিও লাগিয়ে খবর শোনার চেষ্টা করে। যাদের রেডিও নেই তারা যায় হাটে,গন্জে। রেডিও তখন হয়ে যায় জনসভার মাইক। পিনপতন নিঃস্তব্দতায় খবর শুনে ঘরে ফিরে একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে ঘুমুতে যায়। খাকি পোষাকের আর্মি জলপাই রংয়ের যান্ত্রিক বাহনে করে যে কোন দিন ঢুকে পড়বে গ্রামে এমনটি খবর আসছে চতুর্দিক থেকে। ঘরবাড়ি হারিয়ে উদভ্রান্ত মানুষগুলো যখন বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে পিপিলিকার মতো দল বেধে ছুটে চলে তখন তারা এমন তথ্যই দিচ্ছে। মিলিয়ে যাওয়া গুলির শব্দ আরও স্পষ্ট হয়েছে যা উঠোনে বাশের গাইট ফাটানো শব্দের মতোই মনে হয় আর ধুঁয়োর কুন্ডলি তো পাশের ইউনিয়নের বুক চিরে অনিশ্চিত আকাশের দিকে উঠে যায়।
কুটি পাড়ার রহিম গাজী এর মাঝে শুরু করেছে আরেক কারবার। বর্ষার পানিতে টইটুম্বুর চারদিক। পোগাইল বিলের পানি পূবালী বাতাসে তোলা ঢেউ নিয়ে আছড়ে পড়ছে বাড়ির সামনের রাস্তায়। পানি এতোটাই বেড়েছে যে ঢেউয়ের তালে রাস্তায় মাঝে মাঝে কচুরি পানা উঠে পড়ছে। ঢেউয়ের তালে তালে নৌকা বাইয়ে বিলের ওপারের ধোঁয়া ওঠা হিন্দু বাড়ির সমল্ত মালামাল জড়ো করছে এবাড়ির উঠোনে। কাসার প্লেট বাটি, হাড়ি পাতিল, ঘর গেরস্থালির প্রায় সব জিনিসপত্র থরে থরে উঠোনে সাজিয়ে রাখছে। রহীম গাজির ভেজা কাপড়ের পোটলার মাঝে সোনা দানা থাকা অস্বাভাবিক নয় কারন এগুলো সে বিশেষ যত্ন সহকারে বাড়িতে রেখে আসছে। লুটপাটের এসব মালামালের কথা জিঞ্জেস করলে এমনভাবে তাকায় যে বাড়ির সব মানুষের অন্তরাত্তা শুকিয়ে যায়। যারা এর প্রতিবাদ করার সাহস রাখতো তারা বন্দুক নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন এলাকায়। শোনা যায় কেউ কেউ সীমানা পাড়ি দিয়ে চলে গেছে ওপাড়ে।
গ্রামে শুরু হয়েছে ডাকাতের উপদ্রূপ। এর মাঝে তিনচারটি বাড়ি ডাকাতি করে কোন প্রতিরোধ না পেয়ে তাদের সাহস গেছে বেড়ে। সবাই বলাবলি করছে এবার ডাকাতি হবে মোল্লা বাড়িতে। ডাকাতির ভীতি পৌঁছে গেছে মোল্লাবাড়ির অন্দর মহল পর্যন্ত। তিল তিল করে জমানো গহনা রক্ষায় অন্দর মহল তৎপর। এ ভীতি স্পশর্ করে আফসার মোল্লাকে, তিনি শরণাপন্ন হন মইদালের। যদিও রাজাকার মইদালকে তার পছন্দ না। সুযোগ পেলেই এখন সে সদর মহল অন্দর মহলে ঘোরাঘুরি করে, যা আগে কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু সময় খারাপ তাই সে নিজেই মইদালকে প্রস্তাব দেয় রাইফেলসহ স্থায়ীভাবে বৈঠকখানায় থাকার জন্য। মইদালও কথা না বাড়িয়ে লুফে নেয় সে প্রস্তাব। দিনকাল যা পড়েছে তাতে তার রাইফেলটি রক্ষা করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তার বাড়িঘরের যে অবস্থা সে ঘর থেকে যে কেউ চুরি করে নিতে পারে তার রাইফেল আর তা যদি হয় সে হয়ে যাবে সম্পদ হারানো লোকের মতো দেউলিয়া। আফসার মোল্লাসহ কেউ তখন আর তাকে পাত্তাই দিবে না। যে মরিয়ম এখন তার সাথে কথা বলার জন্য সুযোগ পেলেই কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে সেও হয়ে যাবে আগের মতো। বছর তিনেক আগে বইয়ের মধ্যে করে একটা চিরকুট দিয়েছিল মরিয়মকে। সে চিরকুট পেয়ে তা তুলে দিয়েছিল তার বড় ভাইয়ের হাতে। ষন্ডামার্কা বড় ভাই তাকে ডেকে নিয়ে পুল থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল খালে। গভীর খালের স্রোতের টানে পানি খেতে খেতে সে চলে গিয়েছিল অনেকদুর।
মইদালের কাজ এখন মোল্লা বাড়ি পাহারা দেয়া। দিনের বেলা বৈঠকখানায় শুয়ে বসে থাকা আর রাতের বেলা রাইফেল নিয়ে বাড়ির এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্তে হেটে বেড়ানোই তার কাজ। মাঝে মাঝে হাকডাক করে, উঠোনের বারান্দায় কেউ আসলে তার সাথে গল্প করেই কেটে যায় তার রাত। বাড়ির মসজিদে হুজুর আজান দিতে উঠলে সে চলে যায় বিছানায়। এসবের কারনে আশেপাশের সকল অবস্থাপন্ন বাড়িতে ডাকাতি হলেও মোল্লা বাড়িতে তার সামান্য আচড়ও পড়ে নি। এ নিয়ে অন্দর মহলে মইদালের কদর বেড়ে গেছে। বাড়িতে মাছ রান্না হলে তার মুড়োটা এসে পড়ে মইদালের বৈঠকখানার ঘরে, মইদালের জন্য নতুন তোষক চাদর মশারী বানিয়ে আনা হয় হাট থেকে, না চাইতেই সকাল বিকেলে চা পানি এসে পড়ে তার ঘরে। আড়ালে থেকে এ সবের তদারকি যে মরিয়ম করে তা সে বুঝতে পারে।
মাঝে মাঝে রাতের বেলা মোল্লা বাড়িতে আসে চেয়ারম্যানের ভাই ফরিদ। সে মুক্তিযুদ্ধে যায় নি, কেন যায় নি তার কোন ব্যাখ্যাও তার কাছে নেই। তবে মাঝে মাঝেই বলে- সবাই যুদ্ধে গেলে ইউনিয়ন দেখে শুনে রাখবে কে। তবে নিজের ইউনিয়ন দেখে শুনে রাখার পাশাপাশি অন্য ইউনিয়নের অবস্থাপন্ন লোকজনের অশান্তির কারন যে সে তা এ ইউনিয়েনর কেউ না বললেও পাশের ইউনিয়নের লোকজন তা অবলিলায় বলে ফেলে। মইদাল যখন বাড়ির উঠোনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে হাঁটা হাঁটি করে তখন কোন কোন দিন ফরিদ এসে তার সাথে গল্প শুরু করে দেয়। মইদালের সাথে ফরিদের সামাজিক অবস্থানের বিস্তর ফারাক, সে থানা সদরে গিয়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে নামও লেখায় নি তারপরও কেন সে আসে মইদাল তা বুঝতে পারে না। গত সপ্তাহে এসে সে বলে-
"আমার খুব শখ রাইফেল চালানো শিখি,
-শিখে কী করবা, মুক্তি বাহিনীতে নাম লেখাবা?
-তা না, একটা বিদ্যা জানা থাকলো, আর রাতের বেলা রাইফেলটা চালানো শিখে ভোরে তোকে দিয়ে যাব। এতে তোরও লাভ হবে!
লাভের কথা শুনে তার চোখ চিকচিক করে ওঠে তবুও "চেয়ারম্যানের নিষেধ আছে হাতিয়ার হাতছাড়া না করার" বলে ফরিদকে সে নিবৃত করার চেষ্টা করে। অবশ্য শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান তাকে বারবার বলে দিয়েছে অস্ত্র হাতছাড়া না করতে। দিনকাল যা পড়েছে তাতে এ অস্ত্র দিয়ে যে কোন কাজ করা সম্ভব। তারপরও চেয়ারম্যানের ভাই বলে কথা। শুধুমাত্র রাতের কিছুটা সময়ের জন্য সে যেভাবে চাইছে তাতে আর না করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া ফরিদের আশ্বাসে চকচকে কিছু টাকা তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে, বিনা ঝুকিতে এমন সম্পদ সে পায়ে ঠেলতে চায় না । এভাবে গত দু সপ্তাহে তিনবার তার কাছ থেকে রাইফেল নিয়ে ভোরের আগেই তা ফেরৎ দিয়েছেI প্রতিবার রাইফেল ফেরত পাওয়ার পর মইদালের মনে হয়েছে রাইফেলটি আসলে সোনার ডিম পাড়া হাস।
এর মাঝে হাটে গ্রামে গঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা বেড়ে যায়। এখন তারা প্রায় প্রকাশ্যে চলাফেরা করে। গত সপ্তাহে যখন মাসিক হাজিরা দিতে থানা সদরে গিয়েছিল, তখন সে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের মাঝেও সাবধানী ও শঙ্কার ভাব লক্ষ্য করেছিল। অস্ত্র সাবধানে রেখে নিজেকে বাঁচিয়ে চলারও পরামর্শ দিয়েছিল সে। পাক সেনারা থানা সদর থেকে তাদের ক্যাম্প গুটিয়ে নিয়ে চলে গেছে জেলা সদরে। থানা সদর থেকে আসার সময় সে লক্ষ্য করেছে যে সকল বাড়ির চালে বা গাছের উপর চাঁদ তারা পতাকা উড়তো সে সকল গাছে বা চালে এখন পতপত করে উড়ছে লাল সবুজ পতাকা। রাস্তার ধারে জটলা বেঁধে মানুষ যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করছে, তাদের চোখেমুখে এখন উৎকন্ঠার পরিবর্তে ঠাই পেয়েছে আনন্দ উল্লাস, তা যেন সকালের সোনা রোদে বর্ষার টইটুম্বুর বিলের পানির উপর আলোর ঝলকানি।। এসব জটলা যখন সে অতিক্রম করে তখন তার ভিতর একটা ভীতি কাজ করে যে কারনে মাঝে মাঝে তার সাইকেলের হ্যান্ডেল বাঁকা হয়ে তা জটলার মধ্যে ঢুকে পড়তে চায়। অগত্যা সে সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে সে জটলা পার হয়।
যুদ্ধ প্রায় শেষ। পাক বাহিনীর অবিরাম ঠুসঠাস মিলিয়ে যাওয়া গুলির শব্দ আর শোনা যায় না। তার পরিবর্তে রাত্রীর অন্ধকার ভেদ করে হঠাৎ হঠাৎ গর্জে ওঠে রাইফেল। সকালের আলো ফোটার সাথে সাথে সবাই ভীড় করে গর্জনের উৎসস্থলে। দেখা যায় তা হয়তো জমি সংক্রান্ত বা এলাকার প্রভাব বিস্তারে কোন প্রতিপক্ষ পড়ে আছে রাইফেলের পিতলের বিচি বুকে নিয়ে।। এ প্রতিহিংসার আতঙ্কে আছে মইদাল। পাক বাহিনী বা রাজাকার বাহিনীর পরাজয় বা মুক্তিবাহিনীর বিজয় নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই, তার ভীতি আছে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে। এলাকার ছেলেরা যারা যুদ্ধ থেকে সবে ফিরতে শুরু করেছে তারা শাসিয়ে গেছে আফসার মোল্লাকে, মইদালকে যেন বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। আফসার মোল্লাও কাল বিলম্ব না করে বের করে দিয়েছে তাকে। মইদাল এখন থাকে ভাঙ্গা বেড়ার খড়ের ঘরে রাইফেলকে আকড়ে ধরে।
আফসার মোল্লা তার মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। মইদাল গত পাঁচ ছয় মাসে যে উপকার করেছে তার প্রতিদানতো সে চাইতে পারে; প্রতিদানের হাত যেন তার মেয়ে পর্যন্ত না আসে সেজন্যই এ তড়িঘড়ি উদ্যোগ। অবশ্য মইদালকে নিয়ে সে চিন্তিত নয়, মইদালের নিজেরই এখন ত্রাহী অবস্থা, যে কোন দিন রাত্রীর অন্ধকার ভেদ করে রাইফেলের গর্জনে সে নাই হয়ে যেতে পারে। হাত যদি সে তার মেয়ে পর্যন্ত বাড়ায় তাহলে সেই এমন উদ্যোগ নিবে নাই করার জন্য। এখন তো আর এমন অবস্থা নেই যে এর জন্য থানা পুলিশ সামলাতে হবে।
মরিয়মের বিয়ে ঠিক হয়ে যায়, পাত্র কুটি পাড়ার রহীম গাজীর ছেলে। রহীম গাজী এখন কুটিপাড়ার অবস্থাপন্ন গেরস্থ। বিলের ওপাড়ের হিন্দু পাড়ার সমস্ত ধন সম্পদ যে এখন তার হাতে এটা সকলেই জানে। তাই আফসার মোল্লার প্রস্তাব যখন রহীম গাজী গ্রহণ করে তখন সে আল্লার কাছে শুকরিয়া আদায় করে বিয়ের আয়োজনে তড়িঘড়ি শুরু করে দেয়।
বিয়ে হবে শুক্রবার বাদ জুম্মা। তার আগে থেকেই শুরু হয় অনুষ্ঠানাদি। রাস্তার মোড়ে বের হয়ে মইদাল শীতল চোখে দেখে বিয়ের সকল আয়োজন। জুম্মার নামাজের পর আফসার মোল্লা তার মেয়ের বিয়ের কথা এই প্রথম জনসমুক্ষে ঘোষণা করে তাতে সামিল হওয়ার জন্য সকলকে আমন্ত্রন জানায়। সবার সাথে মইদালও পায় সে আমন্ত্রন। নামাজ শেষে বাড়িতে এসে রাইফেল কাধে নিয়ে দাড়ায় রাস্তার মাথায়। রাইফেল দেখে রাস্তার নেংটো ছেলেরা তার পিছু নেয়। খোলা আকাশের দিকে লক্ষ্য করে পাঁচ সাতটি গুলি ছোড়ে সে। আকাশ বিদীণর্ করা সে শব্দে বাড়ীর ঝোপঝাড় থেকে ঝাকে ঝাকে উড়ে যায় পাখি আর মোল্লা বাড়ির বিয়েতে আসা লোকজন ভয়ে দিকবিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। মইদাল মাথা নীচু করে ঢুকে পড়ে ভাঙ্গা বেড়ার ঘরে।
পরেরদিন সকালে স্কুলমাঠে গ্রামের শান্তি ভঙ্গের অপরাধে মইদালের বিচার শুরু হয়। রাতেই এ বিচারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে আফসার মোল্লা। অনেক অভিযোগের সাথে যখন বলা হয় মইদালের কাছে থাকা রাইফেল দিয়ে ডাকাতিসহ সে অনেক অপকর্ম করছে; তখন সে তার মৃদু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে কিন্তু বিচারে আসা লোকজনের সোরগোলে সে প্রতিবাদ বিচারের সভাপতি এলাকার চেয়ারম্যানের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। সভাশেষে চেয়ারম্যান একক সিদ্ধান্তে বলে দেন যেহেতু রাইফেল বিপদজনক অস্ত্র তাই এটি অল্পশিক্ষিত কারো হাতে থাকা ঠিক না। পরবর্তি সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত এটি থাকবে ফরিদের হেফাজতে। এলাকার দু একজন যুদ্ধ ফেরৎ ছোকরা ফরিদের ব্যাপারে প্রতিবাদ করলেও তা ধোপে টিকলো না।
বিচার কাজ শেষ, চেয়ারম্যান গ্রামের গণ্যমান্য কিছু লোক নিয়ে চলে গেছেন কাচারি ঘরে। তাদের জন্য সামান্য চা নাস্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিচারে আসা লোকজন দীর্ঘক্ষন বসে থাকার পর উঠে আড়মোড়া ভেঙ্গে বিচারের পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা করছে, সে আলোচনায় গমগম করছে চেয়ারম্যান বাড়ী। বিচারকাজে ব্যস্ত থাকায় কেউই খেয়াল করনি পুরো বাড়ী ঘিরে রেখেছে থানার পুলিশ। পুলিশের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত লোকজন ছোটাছুটি করছে, কেউবা পুকুরে পড়ে তার জলে হাবুডুবু খাচ্ছে, কেউ আধাপাকা ধানের আইলে মাথা গুজে নিজেকে লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। চেয়ারম্যান বাড়ীর অন্দরমহল থেকে আসছে চাপা কান্নার আওয়াজ। পুলিশ যাকে পায় তাকে ধরেই জিঞ্জেস করছে-ফরিদকে দেখেছো? চেয়ারম্যানের ভাই ফরিদ!
-ভাইজান কৈ যান, ভয় পাইলেন নাকি? মুই না রাইফেল দিয়া পাখি মারবার নাকছোম।
চিকন বুদ্ধির মইদাল অনেকটা বাইম মাছের মতো। সার্বক্ষনিক কাদার মধ্যে থাকলেও যখন বেরিয়ে আসে তখন তার গায়ে কাদার কোন চিহ্ন থাকে না ! নাটের গুরু হয়েও সে কারও ক্ষতি করেছে এমন কোন বড় প্রমান গ্রামে নেই। মাস দুয়েক আগে রটে যায় মইদাল থানা সদরে গিয়ে রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়েছে। এ নিয়ে গ্রামের বয়স্ক লোকেরা আল্লার কাছে শুকরিয়া আদায় করে। তাদের ধারণা এ গ্রামে এখনও পাক বাহিনী আসে নাই মইদালের কারনে, আর গ্রামের উঠতি বয়সের ছেলেরা যারা লাঠি নিয়ে চুপি চুপি স্কুল মাঠে যুদ্ধের ট্রেনিং নেয়, তারা ঘোষণা দিয়ে রেখেছে- মইদালকে যেখানে পাবে সেখানেই লাঠির আঘাতে তার মাথা দু ফাক করে দিবে। গ্রামের দু প্রজন্মের মাঝে এ নিয়ে কানাঘুষা আছে, এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মকে চুপিসারে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করছে। গ্রামের এ অস্থির বিষয়টি মইদালের কান পর্যন্ত গিয়েছে। যে কারনে সে দুমাস পর গ্রামে এসেছে কাধে রাইফেল নিয়ে। তার কাছে রাইফেল আছে বিষয়টি জানান দেয়ার জন্য সে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার মোড়ে এসে আকাশে উড়ে যাওয়া পাখির দিকে তাক করে গুলি ছুড়ছে। মইদালের হাতে রাইফেল দেখে গ্রামের নেংটো ছেলে মেয়েরা তার পিছনে ধুলো উড়িয়ে দল বেঁধে ঘুরছে। মনে হয় সে যেন হ্যামিলনের সেই বাঁশি ওয়ালা। দু একজন বয়োজেষ্ঠ্য লোকের সাথে দেখা হলে সে উদর্ুতে বলছে-
-চাচা, কুচ পরোয়া নেহি।
মইদালের এ আন্তরিক সম্ভাষনে বয়স্ক লোক ভীতির চোখে তাকিয়ে তার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করতে চায় কিন্তু রাইফেলের ভয়ে সে পথে পা না বাড়িয়ে বরং " ভালো থাকো বাবা ভালো থাকো " বলতে বলতে রাস্তা থেকে জমির আইলে নেমে পাট ক্ষেতের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যায়। মইদাল এ বিষয়টি বেশ উপভোগ করে। গ্রামের যে লোকেরা পান থেকে চুন খসলে তাকে শাসিয়ে কথা বলতো, গরীব ঘরের সন্তান বলে তুই তুকারি করতো, তারাই এখন বাবা ছাড়া কথা বলে না। এ দুদিনে মিয়া বাড়ী আর মোল্লা বাড়ী তাকে দাওয়াত করে খাইয়েছে। মোল্লা বাড়ির ত্রয়োদশী মেয়ে যার সাথে কথা বলার স্বপ্ন দেখতো, সেই মরিয়ম তাকে ভাত বেড়ে খাইয়েছে। রাতের বেলা ঘরে ফিরে মইদাল রাইফেলের গায়ে হাত ঘসতে ঘসতে আপন মনে বলে-
"তুই যদি আমার সাথে থাকিস রে রাইফেল তবে তোকে এক পাশে আর মরিয়মকে একপাশে রেখে এ ঘরেই সুখের সংসার শুরু করবো।"
জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে আমুল পাল্টে যায় গ্রামের পরিবেশ আর মানুষের জীবন। কী হবে না হবে তা নিয়ে ধনী গরিব, শিক্ষিত অশিক্ষিত সবার মাঝেই চাপা অস্থিরতা। সন্ধ্যা হলেই লোকজন কানে রেডিও লাগিয়ে খবর শোনার চেষ্টা করে। যাদের রেডিও নেই তারা যায় হাটে,গন্জে। রেডিও তখন হয়ে যায় জনসভার মাইক। পিনপতন নিঃস্তব্দতায় খবর শুনে ঘরে ফিরে একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে ঘুমুতে যায়। খাকি পোষাকের আর্মি জলপাই রংয়ের যান্ত্রিক বাহনে করে যে কোন দিন ঢুকে পড়বে গ্রামে এমনটি খবর আসছে চতুর্দিক থেকে। ঘরবাড়ি হারিয়ে উদভ্রান্ত মানুষগুলো যখন বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে পিপিলিকার মতো দল বেধে ছুটে চলে তখন তারা এমন তথ্যই দিচ্ছে। মিলিয়ে যাওয়া গুলির শব্দ আরও স্পষ্ট হয়েছে যা উঠোনে বাশের গাইট ফাটানো শব্দের মতোই মনে হয় আর ধুঁয়োর কুন্ডলি তো পাশের ইউনিয়নের বুক চিরে অনিশ্চিত আকাশের দিকে উঠে যায়।
কুটি পাড়ার রহিম গাজী এর মাঝে শুরু করেছে আরেক কারবার। বর্ষার পানিতে টইটুম্বুর চারদিক। পোগাইল বিলের পানি পূবালী বাতাসে তোলা ঢেউ নিয়ে আছড়ে পড়ছে বাড়ির সামনের রাস্তায়। পানি এতোটাই বেড়েছে যে ঢেউয়ের তালে রাস্তায় মাঝে মাঝে কচুরি পানা উঠে পড়ছে। ঢেউয়ের তালে তালে নৌকা বাইয়ে বিলের ওপারের ধোঁয়া ওঠা হিন্দু বাড়ির সমল্ত মালামাল জড়ো করছে এবাড়ির উঠোনে। কাসার প্লেট বাটি, হাড়ি পাতিল, ঘর গেরস্থালির প্রায় সব জিনিসপত্র থরে থরে উঠোনে সাজিয়ে রাখছে। রহীম গাজির ভেজা কাপড়ের পোটলার মাঝে সোনা দানা থাকা অস্বাভাবিক নয় কারন এগুলো সে বিশেষ যত্ন সহকারে বাড়িতে রেখে আসছে। লুটপাটের এসব মালামালের কথা জিঞ্জেস করলে এমনভাবে তাকায় যে বাড়ির সব মানুষের অন্তরাত্তা শুকিয়ে যায়। যারা এর প্রতিবাদ করার সাহস রাখতো তারা বন্দুক নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন এলাকায়। শোনা যায় কেউ কেউ সীমানা পাড়ি দিয়ে চলে গেছে ওপাড়ে।
গ্রামে শুরু হয়েছে ডাকাতের উপদ্রূপ। এর মাঝে তিনচারটি বাড়ি ডাকাতি করে কোন প্রতিরোধ না পেয়ে তাদের সাহস গেছে বেড়ে। সবাই বলাবলি করছে এবার ডাকাতি হবে মোল্লা বাড়িতে। ডাকাতির ভীতি পৌঁছে গেছে মোল্লাবাড়ির অন্দর মহল পর্যন্ত। তিল তিল করে জমানো গহনা রক্ষায় অন্দর মহল তৎপর। এ ভীতি স্পশর্ করে আফসার মোল্লাকে, তিনি শরণাপন্ন হন মইদালের। যদিও রাজাকার মইদালকে তার পছন্দ না। সুযোগ পেলেই এখন সে সদর মহল অন্দর মহলে ঘোরাঘুরি করে, যা আগে কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু সময় খারাপ তাই সে নিজেই মইদালকে প্রস্তাব দেয় রাইফেলসহ স্থায়ীভাবে বৈঠকখানায় থাকার জন্য। মইদালও কথা না বাড়িয়ে লুফে নেয় সে প্রস্তাব। দিনকাল যা পড়েছে তাতে তার রাইফেলটি রক্ষা করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তার বাড়িঘরের যে অবস্থা সে ঘর থেকে যে কেউ চুরি করে নিতে পারে তার রাইফেল আর তা যদি হয় সে হয়ে যাবে সম্পদ হারানো লোকের মতো দেউলিয়া। আফসার মোল্লাসহ কেউ তখন আর তাকে পাত্তাই দিবে না। যে মরিয়ম এখন তার সাথে কথা বলার জন্য সুযোগ পেলেই কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে সেও হয়ে যাবে আগের মতো। বছর তিনেক আগে বইয়ের মধ্যে করে একটা চিরকুট দিয়েছিল মরিয়মকে। সে চিরকুট পেয়ে তা তুলে দিয়েছিল তার বড় ভাইয়ের হাতে। ষন্ডামার্কা বড় ভাই তাকে ডেকে নিয়ে পুল থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল খালে। গভীর খালের স্রোতের টানে পানি খেতে খেতে সে চলে গিয়েছিল অনেকদুর।
মইদালের কাজ এখন মোল্লা বাড়ি পাহারা দেয়া। দিনের বেলা বৈঠকখানায় শুয়ে বসে থাকা আর রাতের বেলা রাইফেল নিয়ে বাড়ির এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্তে হেটে বেড়ানোই তার কাজ। মাঝে মাঝে হাকডাক করে, উঠোনের বারান্দায় কেউ আসলে তার সাথে গল্প করেই কেটে যায় তার রাত। বাড়ির মসজিদে হুজুর আজান দিতে উঠলে সে চলে যায় বিছানায়। এসবের কারনে আশেপাশের সকল অবস্থাপন্ন বাড়িতে ডাকাতি হলেও মোল্লা বাড়িতে তার সামান্য আচড়ও পড়ে নি। এ নিয়ে অন্দর মহলে মইদালের কদর বেড়ে গেছে। বাড়িতে মাছ রান্না হলে তার মুড়োটা এসে পড়ে মইদালের বৈঠকখানার ঘরে, মইদালের জন্য নতুন তোষক চাদর মশারী বানিয়ে আনা হয় হাট থেকে, না চাইতেই সকাল বিকেলে চা পানি এসে পড়ে তার ঘরে। আড়ালে থেকে এ সবের তদারকি যে মরিয়ম করে তা সে বুঝতে পারে।
মাঝে মাঝে রাতের বেলা মোল্লা বাড়িতে আসে চেয়ারম্যানের ভাই ফরিদ। সে মুক্তিযুদ্ধে যায় নি, কেন যায় নি তার কোন ব্যাখ্যাও তার কাছে নেই। তবে মাঝে মাঝেই বলে- সবাই যুদ্ধে গেলে ইউনিয়ন দেখে শুনে রাখবে কে। তবে নিজের ইউনিয়ন দেখে শুনে রাখার পাশাপাশি অন্য ইউনিয়নের অবস্থাপন্ন লোকজনের অশান্তির কারন যে সে তা এ ইউনিয়েনর কেউ না বললেও পাশের ইউনিয়নের লোকজন তা অবলিলায় বলে ফেলে। মইদাল যখন বাড়ির উঠোনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে হাঁটা হাঁটি করে তখন কোন কোন দিন ফরিদ এসে তার সাথে গল্প শুরু করে দেয়। মইদালের সাথে ফরিদের সামাজিক অবস্থানের বিস্তর ফারাক, সে থানা সদরে গিয়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে নামও লেখায় নি তারপরও কেন সে আসে মইদাল তা বুঝতে পারে না। গত সপ্তাহে এসে সে বলে-
"আমার খুব শখ রাইফেল চালানো শিখি,
-শিখে কী করবা, মুক্তি বাহিনীতে নাম লেখাবা?
-তা না, একটা বিদ্যা জানা থাকলো, আর রাতের বেলা রাইফেলটা চালানো শিখে ভোরে তোকে দিয়ে যাব। এতে তোরও লাভ হবে!
লাভের কথা শুনে তার চোখ চিকচিক করে ওঠে তবুও "চেয়ারম্যানের নিষেধ আছে হাতিয়ার হাতছাড়া না করার" বলে ফরিদকে সে নিবৃত করার চেষ্টা করে। অবশ্য শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান তাকে বারবার বলে দিয়েছে অস্ত্র হাতছাড়া না করতে। দিনকাল যা পড়েছে তাতে এ অস্ত্র দিয়ে যে কোন কাজ করা সম্ভব। তারপরও চেয়ারম্যানের ভাই বলে কথা। শুধুমাত্র রাতের কিছুটা সময়ের জন্য সে যেভাবে চাইছে তাতে আর না করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া ফরিদের আশ্বাসে চকচকে কিছু টাকা তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে, বিনা ঝুকিতে এমন সম্পদ সে পায়ে ঠেলতে চায় না । এভাবে গত দু সপ্তাহে তিনবার তার কাছ থেকে রাইফেল নিয়ে ভোরের আগেই তা ফেরৎ দিয়েছেI প্রতিবার রাইফেল ফেরত পাওয়ার পর মইদালের মনে হয়েছে রাইফেলটি আসলে সোনার ডিম পাড়া হাস।
এর মাঝে হাটে গ্রামে গঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা বেড়ে যায়। এখন তারা প্রায় প্রকাশ্যে চলাফেরা করে। গত সপ্তাহে যখন মাসিক হাজিরা দিতে থানা সদরে গিয়েছিল, তখন সে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের মাঝেও সাবধানী ও শঙ্কার ভাব লক্ষ্য করেছিল। অস্ত্র সাবধানে রেখে নিজেকে বাঁচিয়ে চলারও পরামর্শ দিয়েছিল সে। পাক সেনারা থানা সদর থেকে তাদের ক্যাম্প গুটিয়ে নিয়ে চলে গেছে জেলা সদরে। থানা সদর থেকে আসার সময় সে লক্ষ্য করেছে যে সকল বাড়ির চালে বা গাছের উপর চাঁদ তারা পতাকা উড়তো সে সকল গাছে বা চালে এখন পতপত করে উড়ছে লাল সবুজ পতাকা। রাস্তার ধারে জটলা বেঁধে মানুষ যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করছে, তাদের চোখেমুখে এখন উৎকন্ঠার পরিবর্তে ঠাই পেয়েছে আনন্দ উল্লাস, তা যেন সকালের সোনা রোদে বর্ষার টইটুম্বুর বিলের পানির উপর আলোর ঝলকানি।। এসব জটলা যখন সে অতিক্রম করে তখন তার ভিতর একটা ভীতি কাজ করে যে কারনে মাঝে মাঝে তার সাইকেলের হ্যান্ডেল বাঁকা হয়ে তা জটলার মধ্যে ঢুকে পড়তে চায়। অগত্যা সে সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে সে জটলা পার হয়।
যুদ্ধ প্রায় শেষ। পাক বাহিনীর অবিরাম ঠুসঠাস মিলিয়ে যাওয়া গুলির শব্দ আর শোনা যায় না। তার পরিবর্তে রাত্রীর অন্ধকার ভেদ করে হঠাৎ হঠাৎ গর্জে ওঠে রাইফেল। সকালের আলো ফোটার সাথে সাথে সবাই ভীড় করে গর্জনের উৎসস্থলে। দেখা যায় তা হয়তো জমি সংক্রান্ত বা এলাকার প্রভাব বিস্তারে কোন প্রতিপক্ষ পড়ে আছে রাইফেলের পিতলের বিচি বুকে নিয়ে।। এ প্রতিহিংসার আতঙ্কে আছে মইদাল। পাক বাহিনী বা রাজাকার বাহিনীর পরাজয় বা মুক্তিবাহিনীর বিজয় নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই, তার ভীতি আছে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে। এলাকার ছেলেরা যারা যুদ্ধ থেকে সবে ফিরতে শুরু করেছে তারা শাসিয়ে গেছে আফসার মোল্লাকে, মইদালকে যেন বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। আফসার মোল্লাও কাল বিলম্ব না করে বের করে দিয়েছে তাকে। মইদাল এখন থাকে ভাঙ্গা বেড়ার খড়ের ঘরে রাইফেলকে আকড়ে ধরে।
আফসার মোল্লা তার মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। মইদাল গত পাঁচ ছয় মাসে যে উপকার করেছে তার প্রতিদানতো সে চাইতে পারে; প্রতিদানের হাত যেন তার মেয়ে পর্যন্ত না আসে সেজন্যই এ তড়িঘড়ি উদ্যোগ। অবশ্য মইদালকে নিয়ে সে চিন্তিত নয়, মইদালের নিজেরই এখন ত্রাহী অবস্থা, যে কোন দিন রাত্রীর অন্ধকার ভেদ করে রাইফেলের গর্জনে সে নাই হয়ে যেতে পারে। হাত যদি সে তার মেয়ে পর্যন্ত বাড়ায় তাহলে সেই এমন উদ্যোগ নিবে নাই করার জন্য। এখন তো আর এমন অবস্থা নেই যে এর জন্য থানা পুলিশ সামলাতে হবে।
মরিয়মের বিয়ে ঠিক হয়ে যায়, পাত্র কুটি পাড়ার রহীম গাজীর ছেলে। রহীম গাজী এখন কুটিপাড়ার অবস্থাপন্ন গেরস্থ। বিলের ওপাড়ের হিন্দু পাড়ার সমস্ত ধন সম্পদ যে এখন তার হাতে এটা সকলেই জানে। তাই আফসার মোল্লার প্রস্তাব যখন রহীম গাজী গ্রহণ করে তখন সে আল্লার কাছে শুকরিয়া আদায় করে বিয়ের আয়োজনে তড়িঘড়ি শুরু করে দেয়।
বিয়ে হবে শুক্রবার বাদ জুম্মা। তার আগে থেকেই শুরু হয় অনুষ্ঠানাদি। রাস্তার মোড়ে বের হয়ে মইদাল শীতল চোখে দেখে বিয়ের সকল আয়োজন। জুম্মার নামাজের পর আফসার মোল্লা তার মেয়ের বিয়ের কথা এই প্রথম জনসমুক্ষে ঘোষণা করে তাতে সামিল হওয়ার জন্য সকলকে আমন্ত্রন জানায়। সবার সাথে মইদালও পায় সে আমন্ত্রন। নামাজ শেষে বাড়িতে এসে রাইফেল কাধে নিয়ে দাড়ায় রাস্তার মাথায়। রাইফেল দেখে রাস্তার নেংটো ছেলেরা তার পিছু নেয়। খোলা আকাশের দিকে লক্ষ্য করে পাঁচ সাতটি গুলি ছোড়ে সে। আকাশ বিদীণর্ করা সে শব্দে বাড়ীর ঝোপঝাড় থেকে ঝাকে ঝাকে উড়ে যায় পাখি আর মোল্লা বাড়ির বিয়েতে আসা লোকজন ভয়ে দিকবিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। মইদাল মাথা নীচু করে ঢুকে পড়ে ভাঙ্গা বেড়ার ঘরে।
পরেরদিন সকালে স্কুলমাঠে গ্রামের শান্তি ভঙ্গের অপরাধে মইদালের বিচার শুরু হয়। রাতেই এ বিচারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে আফসার মোল্লা। অনেক অভিযোগের সাথে যখন বলা হয় মইদালের কাছে থাকা রাইফেল দিয়ে ডাকাতিসহ সে অনেক অপকর্ম করছে; তখন সে তার মৃদু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে কিন্তু বিচারে আসা লোকজনের সোরগোলে সে প্রতিবাদ বিচারের সভাপতি এলাকার চেয়ারম্যানের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। সভাশেষে চেয়ারম্যান একক সিদ্ধান্তে বলে দেন যেহেতু রাইফেল বিপদজনক অস্ত্র তাই এটি অল্পশিক্ষিত কারো হাতে থাকা ঠিক না। পরবর্তি সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত এটি থাকবে ফরিদের হেফাজতে। এলাকার দু একজন যুদ্ধ ফেরৎ ছোকরা ফরিদের ব্যাপারে প্রতিবাদ করলেও তা ধোপে টিকলো না।
বিচার কাজ শেষ, চেয়ারম্যান গ্রামের গণ্যমান্য কিছু লোক নিয়ে চলে গেছেন কাচারি ঘরে। তাদের জন্য সামান্য চা নাস্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিচারে আসা লোকজন দীর্ঘক্ষন বসে থাকার পর উঠে আড়মোড়া ভেঙ্গে বিচারের পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা করছে, সে আলোচনায় গমগম করছে চেয়ারম্যান বাড়ী। বিচারকাজে ব্যস্ত থাকায় কেউই খেয়াল করনি পুরো বাড়ী ঘিরে রেখেছে থানার পুলিশ। পুলিশের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত লোকজন ছোটাছুটি করছে, কেউবা পুকুরে পড়ে তার জলে হাবুডুবু খাচ্ছে, কেউ আধাপাকা ধানের আইলে মাথা গুজে নিজেকে লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। চেয়ারম্যান বাড়ীর অন্দরমহল থেকে আসছে চাপা কান্নার আওয়াজ। পুলিশ যাকে পায় তাকে ধরেই জিঞ্জেস করছে-ফরিদকে দেখেছো? চেয়ারম্যানের ভাই ফরিদ!
লেখক পরিচিতি
মোমিনুল আজম
মোমিনুল আজম
জন্মেছেন - ১৯৬৫ সালে, গাইবান্ধায়
পড়াশুনা করেছেন- শের ই বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে
কাজ করেন- বাংলাদেশ ডাক বিভাগে
বর্তমানে- কানাডায় থাকেন
ফিলাটেলি- ডাকটিকিট সংগ্রহের শখ নামে একটি প্রকাশনা আছে।
0 মন্তব্যসমূহ