অস্থির সময়ের গল্প নিয়ে আলাপ : এমদাদ রহমান--সাম্প্রদায়িকতা বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হবার দরকার

কুলদা রায় : সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী-দাঙ্গা বিরোধী  কোন কোন বা কার গল্প পড়েছেন?

এমদাদ রহমান : সাম্প্রদায়িকতা! দাঙ্গা! ভয়ানক দুটি শব্দ। শব্দ নয়, শকুন। শব্দ নয়, প্রতারণা। লিখিত গল্প কেন, একেবারে সংবাদপত্রের পাতা থেকে এই সময়ের একটি রক্ত হিম করা সংলাপ এখানে তুলে দিতে ইচ্ছা করছেঃ

‘বাবারা, আমার মাইয়াটা ছোট, তোমরা একজন একজন কইরা আসো।’ বংলাদেশের কত যুগ লাগবে, কত শতাব্দি লাগবে এই একটি সংলাপের অভিঘাত ভুলে যেতে? ভুলে যাওয়া সম্ভব? না, সম্ভব নয়। এই হল, বিষ। সাম্প্রদায়িকতার ছোবল। কিন্তু দাঙ্গা এটা নয়। দাঙ্গার গল্প পড়েছিলাম দেবেশ রায়ের লেখায়। লেখাটির নাম দাঙ্গার প্রতিবেদন। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময়টাকে দেবেশ ধরতে চেয়েছেন। মসজিদের একেকটি ইট খসে পড়ছে আর দুই দেশের দুই সম্প্রদায় খালি লাশ হচ্ছে। ভয়ানক প্রতিবেদন ছিল সেটা।


হ্যাঁ, আমি পড়েছি আরেকটি মহামূল্যবান লেখা। প্রশান্ত মৃধা’র একটি গল্প। গল্পটা এমন-

কচুররিপানা ভরতি পুকুরে আমার চারজন। এটা নিরাপদ জায়গা। বয়স্করা এখানে পালাতে বলেছে। আমরা নিরাপদ! মাথা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
একটু বাদে, আমাদের দুধের ও কোলের বাচ্চাসহ আসে আটজন। আমাদের ডাঙায় উঠতে বলে। না-উঠলে বাচ্চাগুলোকে জলে ফেলে দেবে।
এখন আমরা কী করি?
উঠে, পুকুরের পাড়ে চারজনই পাশাপাশি কাপড় খুলে শুয়ে পড়ি।
আমাদের গায়ের ওপর, চারজন।
পাশে দাঁড়িয়ে, চারজন।
চারটি বাচ্চা পাশে কাঁদে আর গড়াগড়ি খায়।
খাক, জলে তো পড়েনি।
ছাড়লে আমরা ওদের দুধ দিতে পারব।
: বাদলা-বদলি, ‘শারদোৎসব’ (গল্পগ্রন্থ), জয়তী প্রকাশন (দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০১১)।

নির্বাচন-উত্তর বাংলাদেশের এক খণ্ডছবি, এই তীব্র গল্পটি। গভীর মনোযোগ দাবি করে এই গল্পের প্রতিটি শব্দ। সাম্প্রদায়িক হানাহানির আর কোন গল্প পড়তে হয়? সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় নাকি কামুর আউটসাইডার পড়ে বেশ কিছুদিন অস্বাভাবিক ছিলেন, তবে, আমাদের এই গল্পগুলো আর এই সংলাপ পড়ে কি খুব স্বাভাবিক থাকতে পারা যাবে? এই গল্পের কাছে তো কামুর উপন্যাসও হালকা লাগছে। নিজের দিকে ভাল করে তাকানোর পরই না বিশ্বভিখারি হবো।

একেবারে নিরেট বাস্তব জীবনের এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই চলুন। কথাসাহিত্যিক প্রশান্ত মৃধা’র বন্ধু ভাস্কর আবেদীনের ফেইসবুক স্ট্যাটাস এরকম ছিলঃ ‘নব্বই দশকের মাঝামাঝি আলী রিয়াজের ভয়ের সংস্কৃতি বইটা পড়ে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লাম; তখন সক্রিয় রাজনীতির সাথে থাকায় অন্যায় মোকাবেলার একমাত্র উপায় ভাবতাম প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ গড়ে তোলাকে| সেই বইতেই পড়েছিলাম এইদেশে মন্দির ভাঙার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস শুরু হয় ১৯৭৪ এ, তৎকালের আওয়ামী নেতা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে পাবনায় এই আগ্রাসন চালানো হয়েছিলো... তো এইসব নিয়ে বন্ধু প্রশান্ত’র সাথে আলোচনা করতে গিয়ে এইদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মাইনরিটি কমপ্লেক্স বিষয়ে এক বিশাল লেকচার দিয়ে যখন প্রগতিশীলতার জাবর কাটতে শুরু করেছি তখনই সে মুখ খুললো নীচু গলায়, ‘বন্ধু তোরে তো মালু ডাক শুনতে শুনতে ইশকুল পার করতে হয় নাই! পড়া না পারলে আকাটা গালি শুনতে হয় নাই শিক্ষিত মাস্টারের কাছে... তগো প্রতিবাদে চ্যাট হয়! বাড়ার আন্দোলন বুঝাইস না! তর তো জীবনে ভাবতে হয় নাই এইদেশে হিন্দু ঘরে জন্ম নিয়া পাপ করছি!’ সেইদিনের মতো আজো মাথা হেট করে থাকি এই প্রসঙ্গ মনে পড়লে...’।

আসুন তবে, জীবনকে নমস্কার করি। আসুন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একখানা চিঠি পড়ে ফেলি।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১০ জানুয়ারি ১৯৯৩ তারিখে ওমর শামসকে:
[...] আজকাল মন খারাপ থাকে বলে দুটো লেখার প্রতিই যথাযথ মনোযোগ দিতে পারি না। এখানে চারিদিকের অবস্থা দিনদিন অসহ্য হয়ে উঠছে। এখানকার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত খুব দ্রুত বর্বরতার দিকে যে গতিতে দৌড়াচ্ছে তাতে আগামী শতাব্দী আসতে আসতে এখানে পাথর যুগের সূত্রপাত ঘটবে নিশ্চিত থাকতে পারো। মৌলবাদী কুত্তার বাচ্চারা দিনরাত ঘেউ ঘেউ করে চলেছে, শিল্পচর্চা বন্ধ করে দিয়ে এরা মানুষের জীবন যাপনের সমস্ত বিকাশ বন্ধ করে দেওয়ার চক্রান্তে লিপ্ত। বিজ্ঞান চর্চা যারা করে তারাও বিজ্ঞান মনস্কতা থেকে বেরিয়ে পড়ার কাজে তৎপর। কল্পনা মানে এদের কাছে মিথ্যাচার, বাস্তবকে তুলে ধরা এদের কাছে অশ্লীলতা। শিক্ষিত মানুষ এদের খপ্পরে পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। শিল্প-সাহিত্য দূরের কথা, যে কোনো ধরণের বিদ্যা চর্চাই এদের কাছে উপহাস ও সন্দেহের বস্তু।
এর প্রভাবে অমৌলবাদী যারা, যাদের অনেকে এমন কি মৌলবাদের বিরোধী বলে নিজেদের জাহির করে, তারাও শিল্পচর্চাকে শাসন করার লাঠি হাতে তুলে নিয়েছে। সৃজনশীলতাকে রুদ্ধ করার ফন্দি এঁটে চলেছে এরা। এর মধ্যে লেখার কাজ করা শারীরিকভাবেই কঠিন কাজ। কিন্তু এও জানি যে, লেখাই আমার প্রধান কাজ। এই বৈরী পরিবেশে বাঁচতে হলে লেখা অব্যাহত রাখা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। সারা দুনিয়া জুড়ে এদের দাপট ক্রমে বেড়েই চলেছে। ভারতে এদেরই দোসররা বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে এখানকার পরিবেশ নষ্ট করে দ্যায়, আমরা অন্তত কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে পড়ি।
দিন-দিন যে হতাশ হয়ে পড়ছি তা বুঝি যখন দেখি যে আগের মতো রাগে জ্বলে উঠিতে পারি না, বরং মনটা খারাপ হয়ে যায়, ভয় হয় জীবিত থাকতে বোধ হয় অবস্থা আর ভালো হবে না। আগামী ১২ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আমার বয়স ৫০ বছর। একটি শতাব্দীর অর্ধেক তো কাটিয়েই দিলাম, আর কতোকাল যে বাঁচতে হবে কে জানে? আজকাল মানুষের আয়ু তো বেড়েছে, মনে হয় আরো ২০ বছর যদি না মরি তো কি দেখে যেতে হবে বুঝতে পারি না। যেটুকু আঁচ করি তাতে মোটেই স্বস্তি পাই না। বাঁচার ইচ্ছাও আমার ষোল আনার জায়গায় আঠারো আনা বলতে পারো, কিছু দায়িত্বও আছে যেগুলো পালন না করলেই নয়। এই দায়িত্ব আর বন্দিত্বর মধ্যে ফারাক নেই। [...]


শরীর অবশ হয়ে আসে। মানুষের মনের ভিতরে এত বিষ। এত চাকু। এত চাপাতি। বিশ্বজিৎ ছেলেটাকে কত লোকের সাংবাদিকের ক্যামেরার সামনে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলা হল! হায়, দেশ। অনেকে লেখকের লেখা গল্পেই সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারটি গুরুত্ব্যের সঙ্গেই এসেছে। সবচে বেশি সম্ভবত এসেছে, হাসান আজিজুল হকের গল্পে। পরবাসী, খাঁচা, উত্তর বসন্ত- এই গল্পগুলোয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোঁয়াড়ি গল্পের কি এরকম কিছু আছে? মাহমুদুল হকের গল্পেও ব্যাপারগুলো এসেছে। লিখেছেন প্রশান্ত মৃধা। অদিতি ফাল্গুনী।

Top of Form



কুলদা রায় : আপনি কি মনে করেন এ ধরনের অস্থির সময় নিয়ে গল্প খুব কম লেখা হচ্ছে?

এমদাদ রহমান :সেই দেশভাগের আগ থেকেই এ অঞ্চলের মানুষের মনে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢুকে ছিল বলে মনে হয়। এই বিষ না থাকলে দেশভাগ হতোই না। তা যতই বাস্তবতা, যতই সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক কারণ থাকুক না কেন। হ্যাঁ, অস্থির সময়ের কথা বলছেন? হুম, সময় বড়ই বলবান, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন; সময়, বিশেষ করে এই সময়টা বড় অস্থির! তাই কি? স্থির তবে ছিল কখন? কোন দশকে সময় আজকের চেয়ে স্থির ছিল? পৃথিবীতে কোথাও কখনও সময় স্থির ছিল না। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে হাসান আজিজুল হকের একটি গল্পের কথা। বইটি, মানে এই গল্পটি এখন আমার হাতের কাছে নাই। দেশে রেখে এসেছি। ইংল্যান্ডে হাসানের আগুনপাখি আর দুই একটা স্মৃতিকথা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। তো, এখন মনে-পড়া গল্পটির নাম ঘরগেরস্থি। কুবের? কুবের ছিল? না, না, মনে পড়েছে লোকটার নাম রামশরণ। রামশরন স্বাধীন দেশে ফিরে এসেছিল। নয় মাস পর। যারা গল্পটি পড়েছেন, তাদের পক্ষে এই গল্পটিকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না। এই গল্পের অভিঘাত যুগ যুগ মানুষের মনের ভিতরে থেকে যাবার কথা! যখন সব হারানো রামশরন মৃত সন্তানের পাশে শুয়ে থাকা বউকে আদিম তাড়নায় কাছে টানতে উদ্যত হয়, বউ তখন পাগলের মতো চিৎকার করে উঠে। গল্পের রামশরন সংখ্যালঘু ছিল। মিলিটারিরা এসে তার ভিটেবাড়িসহ হিন্দু পাড়াটিকে জ্বালিয়ে দেয়। তার আগে দুধের গাভীটি নিয়ে যায় ওপাড়ার রশীদ। চেনা-অচেনা কিছু যুবক এসে নিয়ে যায় কাঁসার থালাবাটি। এই সময়ের লেখক এই বিশয়গুলোর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখুক।


কুলদা রায় : একজন গল্পকার হিসেবে সাম্প্রদায়িকতা বিষয় নিয়ে লেখাকে কি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন? করলে কেনো মনে? আর না মনে করলে--কেনো করেন না?


এমদাদ রহমান : সাম্প্রদায়িকতা বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হবার দরকার। আমার কাছে এই বিষয়ের ওপর লেখালেখির গুরুত্বটা অনেক বেশি। মানুষের মনের ভিতর এখনও অন্ধকার। এখনও উপনিবেশ। মানুষ বিভক্ত। মানুষ শোষক। মানুষ ক্ষমতালোভী। তাই দরকার রয়েছে এই বিষয়টা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার। পরিস্থিতির কারণে কী করে যেন মানুষ হঠাৎ করে হিংস্র হয়ে ওঠে! কোন ভয়, কোন আতংকের কারণে যে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে দাঙ্গার সৃষ্টি হয়! আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু অন্যরকম কথা বলি। একেবারেই অন্যরকম। আমার জন্ম গ্রামে হলেও ছেলেবেলার বেশিরভাগ কেটেছে চা বাগানে। মৌলভীবাজার আর শ্রীমঙ্গলের মাঝামাঝি গিয়াশনগরের কাছে মৌলভী চা বাগানে। একসঙ্গে দু’টি, মানে দুই রকমের জীবনের অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। চা বাগানে ঢুকলেই চারপাশের চেনা পৃথিবী বদলে যেত। চা বাগানকে মনে হতো দেশের ভিতর দেশ। সবকিছুই ভিন্ন লাগে চা বাগানে। অন্যরকম পরিবেশ। ঠিক বাঙালি সমাজের নিত্যদিনের চেনা ছবি এখানে একদম নাই। এখানে সব অন্য মানুষ। অন্যরকম জীবনযাপন। চা শ্রমিকদের সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। বাঙালি হিন্দুদের থেকেও তারা অনেক ভিন্ন। সুখি, উল্লসিত, বেদনায় নীল, শোষিত, বুভুক্ষু, ক্লান্ত, বিবর্ণ, নেশায় চূর। যখন তারা কথা বলে, যেন মাটি কথা বলছে, যেন ভূমিপুত্রেরা ভূমিকন্যারা আড়মোড়া ভেঙে জাগছে। অথবা যেন লাল ধুলাবালি আর কাঁকড়ের ভিতর থেকে শুধু কংকালটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! কী আশ্চর্য সুন্দর নাম তাদের—রবিলাল, হরেকরাম, নিতাই, গোপাল, কিশনো, দেবু, বিমল, রাধানাথ, কানাই, রামচিজ, রিকিয়াশন, জ্যোতি, কানুবাবু, কুবের, শ্যামল, অনিতা, মালতি, ফুলকুমারি, মাধুরী, গীতা, বনমালী, সীতারাম, কুন্তি, বিদ্যাধর, রতন, ইন্দ্রজিৎ, শ্যামলা, পূর্ণিমা, অমর, রাখাল, মাধব, জগাই... আমার স্মৃতিতে সবকিছু, প্রতিটি মানুষই বেঁচে আছে। তো, এই যে এই কথাগুলো বলছি, তার কারণ, আমি আসলে একটি দৃশ্যের কাছে পৌঁছাতে চাইছি। টেলিভিশন। ছেলেবেলায়, মৌলভি চা বাগানের স্টাফদের মধ্যে শুধু আমাদের বাসাতেই একটা চৌদ্দ ইঞ্চি নিপ্পন টেলিভিশন ছিল। শাদাকালো। ছেলেবেলার সেই শাদাকালো নিপ্পনে রামায়ন দেখাতো। তখন কী-ই বা আর বয়স! তখন মুসলিম ঘরের ছেলে রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, বনবাস, রাবণ, অপহরণ, মেঘনাদ, হনুমান ইত্যাদি শিখছি আর দেবতাদের ছুঁড়ে মারা তীরের অলৌকিক দৃশ্যে হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি। এই যে একটু আগে যাদের নাম বললাম, সকাল থেকেই, হ্যাঁ, প্রতি সাপ্তার রোববারে চা বাগান ছুটি থাকত, সকালে আট’টা থেকেই বুড়া-বুড়ি, শাঁখাসিঁদুর-পরা নয়া-বউ, কালোবউ, কপিলা, দুর্গা, অপু, হেমন্ত, কিশোর, শিবাজি আর অঞ্জনরা; আমাদের বাসায় আসতে শুরু করত। তারা রান্নাঘরে ঢুকে বড় পাতিলে চা বানাত। মা’কে প্রণাম করত তারা। মা মাথায় ঘোমটা টেনে দিতেন আর পুরনো মানুষগুলোকে দেখতেন, নতুন বৌগুলিকে দেখতেন, পেটে বাচ্চাওয়ালা মেয়েটিকে সাবধানে চলাফেরা করতে বলতেন। শাদা, জর্দা, চুন, খয়ের, পান, মৌরি আর স্পিরিটের ঝাঁঝালো গন্ধে আমাদের ঘরগুলো ভরে যেত। ঠিক ন’টায় শুরু হতো রামায়ন আর সম্মিলিত রাম রাম শব্দে ভরে যেত আমাদের ঘর আমাদের মন। ধর্ম নষ্ট হতো না। টেলিভিশনের পাশেই লালসালুতে পেঁচিয়ে রেহেল মা কোরানশরিফ রাখতেন। বার বার শুধু রাম রাম—এই প্রেম অ পূজার কোরাসেও কোরানের পবিত্রতা নষ্ট হতে দেখিনি কখনও। এই অদ্ভুত মিলন সম্ভবত একমাত্র চা বাগানগুলোতেই সম্ভব ছিল। আর কোথাও না। বিশ্বের আর কোথাও এমনটি ঘটবে না। এই আমার নিজস্ব অঞ্চল। অসাম্প্রদায়িক। আজ সত্যিই মনে হয়, বাংলাদেশ থেকে এই সাম্প্রদায়িকতার বিষ নামাতে হলে লেখকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। এটাই জরুরি এখন। সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।




অনুবাদক পরিচিতি
এমদাদ রহমান 

গল্পকার
অনুবাদক।
জন্ম সিলেট, বাংলাদেশ।
বর্তমানে ইংলন্ডে থাকেন। 
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : পাতালভূমি ও অন্যান্য গল্প।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. বর্তমানের বনিকী সংষ্কৃতি শদ্বটার ব্যাহারিক অর্থ অনেক খেলো করে দিলেও এই সাক্ষাৎকার পাঠের পর প্রথম সে শব্দটাই আমার মাথায় আসল " উপস্থাপন"; যে বিষয় নিয়ে আলাপ, তার উপস্থাপনটা খুব ভাল হয়েছে। প্রথম পাঠে একটু দূর সম্পর্কিত এমনকি অনেকটা অসংলগ্ন সঙলাপের মত লাগে কিন্তু ভাবায়। শেষে ধীরে সংযুক্তির সুত্রগুলো দেখা যায়, আর পড়তে পড়তেই শরীরে কাঁপুনি লাগে। এই বিষয়টা আসলে আরো আলাপ হওয়া দরকার, গভীরে এবং ব্যাপ্তিতে দুই মাত্রাতেই আরো ছড়িয়ে দেয়া দরকার। প্রশ্নটা জোরেশোরেই ওঠা দরকার যে, শুধু সাহিত্যের দিকটা বিবেচনায় বলছি, প্রজন্মান্তরে চলা, পুরো মহাদেশকেই পুড়িয়ে যাওয়া, এমনকি এখনো প্রতিদিন কোথাও কেউ পুড়ছে এই যঞ্জে, এমন বৃহৎ আর সর্বগ্রাসী সংকট আমাদের গল্পে কতটা আসল? আরো আসে নাই কেন? বর্তমানের বা ভবিষ্যতের গল্পকার এটা কিভাবে আনবে বা আনার প্রাসঙ্গিকতাই ফুরিয়ে যাবে কি না? গল্পপাঠকে এবং এমদাদ রহমানকে ধন্যবাদ ।

    উত্তরমুছুন
  2. প্রথমে ইমদাদ রহমান ও কুলদা রায়কে ধন্যবাদ জানাই।
    যে দাঙ্গার কথা উঠে এসেছে এই আলোচনায় তা তো আমাদের চোখের সামনে এখনও ঘটে চলেছে অবিরত। আমরা কেউ এর প্রতিবাদ করতে পারছি না বা করছি না। এক দল জ্ঞানীদের ধ্বংস করার খেলায় নেমেছে অন্য দল চুপ করে আছে নিজের স্বার্থে। ৭১ এর ঘটনা হয়ত আমরা দেখি নি। তবে এখন যা দেখছি তার চেয়ে কম নয়। সব কিছু জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সবাই আমরা চুপমেরে বসে আছি। কিসের ভয়ে? জানি প্রাণের ভয়ে। কিছু বলতে গেলেই হয় মাথা থাকবে না নয়ত গুলি করা হবে। না এই সব নিয়ে কিছু লেখা যায়। হয়ত গল্পে লেখা যায়। কিন্তু গল্প লিখে তো আর এইসব কিছু নির্মুল করা সম্ভব নয়। তাই গল্প লিখে কি লাভ। প্রশ্ন করে গেলাম?

    উত্তরমুছুন