কুলদা রায় : অঙ্কুর গল্প--হিজলগাছটির নিচে ঠুক ঠুক

আমার ছোটো পিসে মশাই ছিলেন নৌকার মিস্ত্রী। ছোটো খাটো লোকটি। এক বাক্স যন্ত্রপাতি মাথায় করে কাজে যেতেন। কোনো বাড়ির পাশে, রাস্তার একধারে, খালের পশ্চিমে--হিজলগাছটির নিচে ঠুক ঠুক করে নৌকা গড়তেন। বড় নৌকা নয়। ছোটো ছোটো নৌকা। ধান বাইতে লাগে। বড় নৌকা গড়ার সামর্থ্য ছিল না।
পরে, বহুদিন পরে বুঝতে পেরেছি--পিসে মশাই হরিদাস মজুমদার হয়তো বড় নৌকা গড়তে জানতেন না। জানলেও সে সামর্থ্য প্রকাশের কোনো সুযোগ তিনি পাননি। পেলে হয়তো বানিয়ে দেখাতে পারতেন। কিন্তু বড় নৌকা বানানোর কোনো সামর্থ্য ছিল না এলাকার লোকদেরই। তারা গ্রামের ছোটো কৃষক। অথবা বর্গাদার। অথবা ক্ষেত মজুর। ধান কাটতেই এই নৌকাটি তাদের দরকার। দরকার না হলে তারা নৌকা বানাতেনই না। মাথায় চেপে বাড়ি বয়ে নিয়ে আসতেন। এই গরীব কৃষকদের জন্যই আমার পিসে মশাই মিস্ত্রী ছিলেন।

দিনের শেষে বাড়ি ফিরে গান গাইতেন পিসেমশাই। বিজয় সরকারের গান--পোষা পাখি উড়ে যাবে একদিন--ভাই নাই তো মনে ও সজনী। তার সঙ্গে রান্না করতে করতে গলা মেলাত আমার ছোটো পিসি। ঘরের বারান্দায় তখন নিভু নিভু পিদিম। তিলকী বিড়ালটি হাই তুলছে। ভুলু কুকুরটি থাবার উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে। হাওয়ায় নটে শাকের ঘ্রাণ আসছে। আজ টাকি মাছ দিয়ে বেনুন রান্না হয়েছে। তার মধ্যে উঁকি দিচ্ছে কয়েকটি রসুন। গান শেষে তারা চারজন খাবে। এই চারজন মানে--আমার কাঠমিস্ত্রী পিসেমশাই, ছোটো পিসি, তিলকী বিড়াল আর ভুলু কুকুরটি। এসময় আর সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।

বহুদিন পরে আবিস্কার করি যে গ্রামটিতে আমার পিসেমশাই আর পিসিমা শুয়ে আসেন--সেটা তাদের বাড়ি নয়। তাদের কোনোকালে বাড়ি ছিল না। থাকার মত সামর্থ্য থাকার কথা নয়। গ্রামের একটি পোড়ো ভিটে। তার দাবীদার কেউ নেই। থাকলেও কেউ কখনো বলার চেষ্টাও করেনি। ছাড়া-বাড়ি।

এই ছাড়া-বাড়িতেই এই চারজন আছেন। পিসে মশাই, পিসি, তিলকী বিড়াল আর ভুলু কুকুরটি। আর বিজয় সরকারের গানটি--ও সজনী, একদিন ভাবি নাই তো মনে--পোষাপাখি উড়ে যাবে...

আমি আর কিছু জানি না। এই গানটিই জানতে চাইছি। তার জন্যই এইসব।



লেখক পরিচিতি
কুলদা রায়
বরিশাল। নিউ ইয়র্কে থাকেন।

কৃষিবিদ
গল্পকার। ব্লগার। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ