অমর মিত্রের গল্প : হারু ও মারিতেস

সলোকটা থাকে ফুটপাথে আর মেয়েটা থাকে কম্পিউটারে। মেয়েটাকেও সব সময় দেখা যায় না, লোকটাকেও না। লোকটা আগে ডাকুর দোকানে জামাকাপড় ইস্তিরি করত। কিন্তু মাঝে মাঝেই জ্বর, কাশি, কাজে কামাই---ফলে ডাকু বাধ্য হয়ে আর একটা আধ-বুড়োকে জোগাড় করল। তার নাম নয়িম। আগে ফুল ব্যবসা করত, কিন্তু তা চৌপাট হল হাবড়ার ফুলওয়ালি বুড়ি জবা লোকের কানে কানে কী বলে দিতে। তখন বেস্পতিবারের ফুল নানান পুজোর ফুল আর তার কাছে কেনে না পাবলিক। আর ওইসব দিনের ফুল, বেস্পতির ফুল না বেচা হলে ও কারবার করে কী হবে ? কবে একটা লোক মরবে আর তার খাট সাজাতে ফুলের রিং দরকার হবে, ওই জন্য তো আর সারা বছর বসে থাকা যায় না। সে বসেই ছিল কবে হারু বুড়ো জ্বরে পড়বে কিংবা সে পুরোপুরি অকেজো হবে। তখন সে সকালটায় এসে ডাকুর দোকানে ইস্তিরি চালাবে। ভোরে এসে আঁচ দেবে আর আর বেলা সাড়ে ন’টার ভিতর কাম শেষ করে অন্য কাজে যাবে। সে কাজ হল লরির টাকা আদায়। মোড়ের ট্রাফিক পুলিশ এই কাজ দিয়েছে তাকে। কিন্তু হারু আজ আবার যাবে ডাকুর কাছে, তার আর জ্বর নেই, নিজের কাজটা ফেরত চায়, সে পারবে, খুব পারবে।


লোকটা মানে হারু বসে আছে ডাকুর ইস্তিরির গুমটির উলটো দিকে গেঞ্জি বাড়ির দেওয়ালে। এই বাড়িতে গেঞ্জির কল আছে। কদিন অন্তরই ম্যাটাডরে করে মাল যায় কলকাতা না মফস্বলের কোথায় না কোথায়। লোকটা জানে এখনো অনেকদিন বাঁচতে হবে। সে যদি গেঞ্জির কোলে একটা কাজ পেত? কিন্তু পাবে না জানে। মালিক লোকটা মানে সাহাবাবুর নাগাল পাওয়াই কঠিন। তার কাজের লোক বালাশোরের হরিদাস বলে, কাম খালি নাই, খালি হলে মোর বেটা ঢুকবে, বুড়াকে নিবে কেনে ?

লোকটা মানে বুড়ো হারু তবু গেঞ্জিবাড়ির দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছে। তাতে যদি সাহাবাবু টের পায় ? সিমেন্টের দেওয়াল ফুঁড়ে যদি তার কথা বাবুর কাছে পৌঁছে যায়। যেতেই পারে। জগতে কত কিছু অবাক করা কান্ড হয়। তিন মাথাওয়ালা বাছুর জন্মায়, তিন মাথাওয়ালা খেজুরগাছ। সেই সব খবর জানে নয়িম। তার বাড়ি সুন্দরবনের দিকে। লোকে লটারিতে লাখের উপর টাকা পায়, নয়িমের ফুফুর বেটা পেয়েছে, সুতরাং সে আচমকা গেঞ্জি কলে কাজ পেতেই পারে। সে গুটসুটি মেরে বসে আছে। ভয় হচ্ছে আবার কি ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে গাটা ?



মেয়েটার নাম ইভলিন মিতর। সে মুনতিনলুপা ফিলিপাইনসের মেয়ে। সে একটা হোটেলের কুক। হাস্যমুখী বছর বত্রিশ বয়সের স্বাস্থ্যবতী তরুণী।।চোখদুটি ছোটছোট, যেন কাজলে আঁকা। তার মুখের ছবি কম্পিউটারে আছে। আছে বছর দশ এগারর মেয়ের সঙ্গে তার ছবি। আছে আরো দুই বন্ধুর সঙ্গে তার ছবি। সব মোবাইল ফোনে তোলা। তার সঙ্গে এক প্রবীনের বন্ধুতা হয়েছিল। সে নিজেই এসে বন্ধুতা করেছিল। কেন না প্রবীনের নামের ভিতরে মিত্র ছিল। ইংরিজি বানানটা এক। সে ভেবেছিল প্রবীন লোকটাও তার মতো ফিলিপিনি। কিন্তু ইন্ডিয়ান জেনেও সে রয়ে গেছে বন্ধুতায়। ভাঙা ভাঙা ইংরিজিতে কথা হয়। তার মেয়ের কথা বলে সে। ফেসবুকে এসে সেই ইভলিন তার মেয়ের সঙ্গেও নাকি কথা বলে। মেয়ে সপ্তাহে একদিন একটি সময়ে তাকে ডাক দেয়, মম, হাউ আর উ?

মেয়ে থাকে কোথায় ? ভাইয়ের কাছে। হোটেলওয়ালা চায় না তার মেয়ে এসে থাকুক তার কাছে। তার মালিক চায় সে অ্যাবসলিউটলি সিঙ্গল থাকুক, নো চাইলড। কিন্তু এ সব তো অনেকদিনের কথা। তাকে তার স্বামী ত্যাগ করেছে। হোটেলে রান্না করে সে পেট চালায়। মেয়ের জন্য ভাইয়ের কাছে টাকা পাঠায়। মেয়েকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায় ফেস বুকে। একটুখানি কথা বলে ফোনে। সেই হাস্যমুখী ইভলিন আচমকা আর আসে না ফেসবুকে। তার গোলগাল মুখ, সদাহাস্য প্রোফাইল মুছে গেছে অনেক দিন। মোছার আগে তার অনেক সমস্যা ছিল। সে বলল, দিয়ার , হোটেল মালিক আমার সঙ্গে শুতে চায়।

একদিন বলল, আয়াম সারচিং ফর আ নিউ জব।

একদিন বলল, ও গদ, বস নকদ মাই দোর লাস্ট নাইত।

ওইটাই ছিল শেষ কথা। সে ভ্যানিশ হয়ে গেল ওই কথা বলে। যেমনি ভ্যানিশ হয় মাঝেমধ্যে কোনো কোনো মেয়ে। সকালে বই খাতা ব্যাগ জল, টিফিন নিয়ে বেরলো কলেজে, আর বাড়ি ফিরল না। তার কোনো খোঁজই নেই। থানা পুলিশ, মন্ত্রী কত কিছু করেও তার খোঁজ নেই। আবার এমন ও হতে পারে তার ক্ষতবিক্ষত দেহ পড়ে আছে পাটক্ষেতে কিংবা নদীর চড়ায়, বাড়ির কাছেই পাঁচিল ঘেরা কারখানা চত্বরে। বাড়ির কাছ থেকেই তাকে টেনে নিয়েছিল বিকট এক অন্ধকার---এক কৃষ্ণ গহ্বর।

প্রবীন লোকটির নাম গুণেন মিত্তির। স্যার গুণেন। অবসর নেওয়া পেনশন ভোগী। বুড়ো বয়সে খাওয়ার চিন্তা ঘুমের চিন্তা নেই। সুদেও টাকা খাটায় ব্যাংকে রেখে। লোকটি একটু রাগী রাগী আবার কোনো কোনো সময়ে নরমও। কথা বলে। তাকে হারু চেনে। সকালে হাঁটতে বেরোয় কটন প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে। এই স্যার গুণেনের নানা রঙের পাঞ্জাবি আছে। এত যে রঙ হতে পারে তা গুণেন মিত্তিরের পাঞ্জাবি না দেখলে হারু জানত না। সব পাঞ্জাবিগুলোকে হারু চেনে, সে তো গরম ইস্তিরি চাপিয়েছে ওর উপরে। হারু জানে কার ঘরে কী পোশাক আছে। জিনস, শার্ট, শালোয়ার কামিজ, শাড়ি, ফ্রক। গুনেন এক একদিন জোড় হস্তে নমস্কার করে তাকে বলে, গুড মর্নিং।

আজও বলেছিল। সে উত্তরে হেসে বলেছিল আজ সে ডাকুর কাছে আসবে, তার আর জ্বর আসে না। সে তার শরীরের বলও ফিরে পেয়েছে। ভাগ্না বউ যত্ন করে। ডিম দেয়, দুধ দেয়। সে আবার তার কাজটা ফেরত চায়।



নয়িম বলল, তুই এখেনে বসে কী করবি, আমি কাজ ছাড়ব না।

বুড়ো হারু বলল, আমি তো কাজের জন্য বসে নেই।

তাহলে কেন আছিস ?

এমনি, আমি আর কাজ করব না।

উফ, তালি করবি কী ?

খাবদাব আর ঘুমোব, আরাম করব।

ইস, নবাব পুত্তুর, যাহ, এখেন থেকে যা। নয়িম ধমকে ওঠে।

কেন রে তোর জায়গা ?

নয়িম চুপ করে থাকে। সে জানে তাকে অনেকে পছন্দ করে না তার মেজাজের জন্য। আর সে পুলিশের টাকা তোলে বলে। বাবুরা সবাই প্রায় ডান হাত বাম হাত করে, কিন্তু পুলিশ টাকা নেবে কেন এই নিয়ে গলা তোলে। হারুকে দেখলে ডাকুরও না মন নরম হয়ে যায়। কিন্তু নয়িমের বড় সহায় পুলিশ। সে টাকা আদায়ে দড় বলে তার নাম হয়েছে খুব। এমন কি ট্রাফিক সারজেন্ট এসে বলে গেছে তাকে বড় বাজারে বদলি করে দেবে তার নিজের বদলির সঙ্গে সঙ্গে। তবু তো একটা ভয় আছে। তার কোনও কিছুই টিকে থাকে না, ফুল ব্যবসা নিয়ে এপাড়ায় ঢুকেছিল, সেই রমরমা ব্যবসা গেল শুধু নামটার জন্য। তার আর এক নাম তো কুমার। নামটা তার আব্বার দেওয়া। আব্বা নিয়েছিল হেড মাস্টারের ছেলের কাছ থেকে, কুমার সিংহ, মোহম্মদ কুমার সিং। কিন্তু মসজিদের খাদেম বলল, ওতা চলবে না, হিঁদু নাম, ও হল মোহম্মদ নয়িম।

বিড়বিড় করছে হারু, আমার ছেলে ডাকছে, বুন যেতি দেবে না, মেয়ে বলে বাপ আমার কাছে এসে থাক, আমার যাবার জায়গার অভাব!

উরে আমার বুড়ো রে, তালি সেখেনে না গে ফুটপথে শুয়ে থাকিস কেন ?

আমার নিজির বাড়ি আছে বেলেঘাটার কাদাপাড়ার কাছে।

তারপর ? নয়িম গায়ে গামছার বাতাস দিতে দিতে বলে।

সে বাড়ি আমি ছেড়ে দিইছি, যাবনি, আমারে কত ডাকে দুই জেঠার তিন ছেলে।

ও, সেই গপ্পো তো, কতবার শুনোবি, এখনো কি তোর মরার বয়স হয় নি?

গরগর করে ওঠে হারু, তুই মরগা না।

আমার তো কবর গুছোন নেই তোর মতো, গিয়ে শুলিই মরণ।

চুপ করে যায় হারু। মুখের উপর কাল ছায়া ঘনায়। তার বাপ চোদ্দপুরুষের যে বাড়ির কথা বলে সেখান থেকে সে কবে চলে এসেছে। ওই বাড়িতে তার মেয়েটা মরল ভুগে ভুগে। ওই বাড়িতে কত যে মরেছে। তার জেঠা, জেঠি, বাবা মা, বিধবা পিসি গলায় দড় দিল, জেঠার মেয়ে বিষ খেল একটা, আর একটা বিয়ের পর ফিরে এল শ্বশুরবাড়ি থেকে, তারা বলল, মেয়ে রোগের ডিপো, বুকের দোষ আছে। বুকের দোষ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। অপয়া। শোনা কথা বাড়ি তৈরির সময় ভিতের নিচে একটা কালো বেড়াল পুতে দিয়েছিল কেউ শ্ত্রুতা করে। সেই থেকে মানুষ টেকে না ওখেনে। তার মেয়ে মরেছে, বউ রোগ বাঁধালে ওখেন থেকে সে বেরুল, দিদির বাড়ি এল বউকে কারমাইকেল হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে। হাসপাতালে বউ মলো। রইল বাকি দুই। সে আর তার ছেলে গুরু। তারপর কতদিন গেল। কী করে গেল তার নিজেরও মনে নেই। দিনের পর দিন। কত বর্ষা গিয়ে কত বর্ষা। কত শীত গিয়ে কত শীত। সে পড়েই থাকল দিদির বাড়ি। বুড়ো হল। মরেনি তো। কাদাপাড়ার বাড়িতে থাকলে মরত ঠিক। দিদি বুড়ি হয়ে কদিন ভুগে হাসপাতালে গিয়ে মরেছে। দুটো ঘর সেই শরিকি পুরনো বাড়ির। স্যাতলা দেওয়াল, ছাদ চুঁইয়ে জল নামে দেওয়ালের গা বেয়ে বেয়ে হেলে সাপের মতো। সেই বাড়িতে দুই ভাগ্নে দুটো বউ এনে তুলেছে, আর এক ভাগ্নে বারান্দা ঘিরে নিয়ে বিয়ের তোড়জোড় করছে। সে ফুটপথে এসে শুচ্ছে। ভাগ্নেরা বলেছে, মা’র সোদর তুমি, ফেলব না, খেয়ে যেও, শুয়াটা অন্য জায়গায় ঠিক করো, আর কাজটাজ দেখ, নইলে অকেজো হয়ে পড়বা, বিনি পয়সায় কতদিন খাবা ?

নয়িম বলল, বেটার কাছে যা।

আমি কুথায় যাব আমি জানি। বিড়বিড় করে হারু বুড়ো। তার যেন জ্বর আসছে আবার। গাটা আনচান করছে। ঘুসঘুসে এই জ্বর সেই কাদাপাড়া থেকে পাওয়া। সারাজীবন যেন সঙ্গে আছে।

নয়িম বলল, ফুটপথে শুস, তোর ভাগ্নেরা ঘরে বউ নিয়ে শোয় ?

হারু বলল, তোর কী, তোর কাজ তুই কর।

নয়িম বুড়োকে দেখে খুব ক্ষেপে গেছে। আসলে ডাকুর এক রকম পক্ষপাত আছে এই বুড়োর উপর। এখনই ভাগানো দরকার। নয়িম ছাড়বে না এই কাজ। আসলে তার খুব ভাল লাগে। কী ভাল লাগে তা নয়িম জানে। মনে মনে জানে। মেয়েমানুষের পোশাক ইস্তিরি করতে তার কী যে সুখ হয়। শালোয়ার কামিজ, জিনস, টপ, টি-শারট, শাড়ি, ব্লাউজ। নেড়ে চেড়ে দ্যাখে, তারপর হাত ঘষে ঘষে ভাঁজগুলি সমান করে, তারপর গরম লোহার ইস্তিরি চাপায় তার উপর। তার কোনো মেয়ে মানুষ নেই। তাকে কেউ পছন্দ করে না। কোনো মেয়েমানুষই না। কেন তা জানে না নয়িম। তার বউও তাকে দেখতে পারে না। পারে না বলেই তো শালতি ঘাটা ছেড়ে কলকাতায় এসে পড়ে আছে। নয়িম গরম চোখে বুড়োকে দেখল, চার নম্বর বাড়ির সাত নম্বর ফ্ল্যাটের সেই কলেজ যাওয়া জিনস টপ পরা বছর ২৩-২৪ এর ঝলমলে মেয়েটা বুড়োর সঙ্গে কথা বলছে। তার খোঁজ নিচ্ছে। কী হয়েছিল গো তোমার হারুদা, জ্বর গেছে, ভাইরাল হবে, তুমি কবে থেকে আবার কাজ করবে গো ?



এই যে গুণেন মিত্তির। স্যার গুণেন। স্যার দেখল আচমকা তার মনিটরের কোনে ভেসে উঠেছে সে। ইভলিন মিতর। মিত্র। মিত্তির। ছ’মাস বাদে সেই ফিলিপিনি বন্ধু। সে। সে-ই তো। হেল্লো ইভলিন, হাও আর ইউ, আমি তোমার কথা কত ভেবেছি, ভাল আছ তো?

ফাইন দিয়ার অ্যান্ড ইউ?

ইভলিন আগে ছিল মোটা সোটা একটি বেড়ালের মতো। মুখখানি হাসিতে ভরা সেই ইভলিনের প্রোফাইল ফোটো বদলে গেছে। মনে পড়ে সে হাস্যমুখী আনন্দময়ী তাকে ডাক দিত, হাই দিয়ার, হাউ আর উ?

এখন ইভলিন শীর্ণকায়। খুব রোগা হয়ে গেছে। রোগা হওয়া একটা ফ্যাশন। ইভলিন সেই পথে গেছে। হয়তো তার ভালবাসার মানুষ আবার জুটেছে। তার কথায় নিজেকে ঝরিয়ে দিয়েছে। সে বলত, তেমনি যদি কেউ আসে জীবনে, যে তাকে আর তার সন্তানটিকে ভালবাসবে, সে হাত বাড়াবে। তেমনি হয় তো এসেছে কেউ।

হেল্লো ইভলিন, হোয়াট আর ইউ ডুইং নাউ?

নাউ আয়াম ইন মালয়েশিয়া, হাই ফ্রেন্দ, আই গত নিউ জব হিয়ার।

ইভলিন এখন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর। কী করে ? না সে চাইলড কেয়ারের কাজ করে ? সেই কাজটা কী কাজ, কোনো এন,জি,ও-তে ? না, এক গৃহস্তের বাড়িতে। ডোমেস্টিক হেলপার। মানে লোকের বাড়িতে সারদিনের কাজের মেয়ে। রাতেও সেখানে থাকে। যেমন গুণেনের বাড়িতে থাকত কাজের মাসি। গুনেন মাথা নামিয়ে বসে থাকল। না, ইভলিনের তেমন কেউ হয় নি। সে বলল, ভয় পায়, তার মেয়ে সাইলাকে সে বড় করছে, আর কিছু চাই না তার। কোনো ভালবাসা চাই না।

হুম। গুণেন মিত্তির কম্পিউটার বন্ধ করে গুড নাইট বলে। তার এখানে রাত দশটা, ওই দেশে রাত সাড়ে বারো। গভীর রাতে জেগে আছে মেয়েটা তার মোবাইল ফোন নিয়ে। ফিলিপিন থেকে মালয়েশিয়া এসে গেছে কাজ খুঁজতে খুঁজতে। এক দেশ থেকে আর এক দেশে। এমন হয়েই থাকে। কাজের জন্য দেশে দেশে পাড়ি দেয় লোকে। সে ইঞ্জিনিয়ার হোক বা রাজ মিস্ত্রি হোক, রিকশা চালক বা ক্ষেতমজুর হোক। গুণেন শুয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি, ওঠে তাড়াতাড়ি। অনেকদিন বাদে ইভলিনের সঙ্গে কথা বলে সে কেমন নিশ্চিন্ত হয়েছে যেন। মেয়েটা ভ্যানিশ হয়ে যায়নি বারাসত বা জয়নগরের মেয়েটার মতো। তালতলার পিঙ্কির মতো। শোনা যাচ্ছে সে নাকি মুম্বইয়ে চালান হয়ে গেছে। খবরের কাগজের সংবাদ। ইভলিন আছে, ফিরেও এসেছে। আরব দেশে চাল গমের মতো বস্তাবন্দী হয়ে চলে যায়নি। গুড নাইট বলছে তাকে তার ঘুমের আগে।

গুণেন এক অদ্ভূত মানুষ। কে এই ইভলিন ? তাকে কি সে চেনে না জানে ? দেখেছে কোনোদিন ? দেখবে এ জীবনে ? সে কি সত্য, নাকি মিথ্যা কেউ ? তার নাম কি আসলে ওইটা, নাকি নাম লুকিয়েছে সে ? ছবিতে কি সে? না অন্য কারোর ছবি ? কম্পিউটার, ফেসবুক সবই অলীক হয়ে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। ইভলিন যদি বলে সে আসলে সে নয়, তাবে তাইই মেনে নিতে হবে। অথচ ইভলিনের জন্য তার বুকের কোণে একটু জায়গা হয়েছে।

পরদিন ভোরে বেরিয়ে টালা পার্কের ধারে ফুটপাথে বসা হারুর সঙ্গে গুণেনের দেখা, সে হাত জোড় করে নমস্কার করে, বলে শুভ সকাল।

বুড়ো বলে, কাল ডাকুর ওখেনে গিয়েছিলাম সার, নয়িম বসতেই দিল না।

হুম, তুমি ভাল আছ, রোগা হয়ে গেছ।

আমার ভাগ্না বউ বলে সার রোগা হওয়া ভাল, শরীর ভাল থাকে।

তুমি কি গায়ে জোর পাও ?

ভাগ্না বলে, বুড়া বয়সে জোর কিসে হবে।

ভারি লোহার ইস্তিরি কি টানতে পার না ?

ছার ভাগ্না বলে, খুব পারব, ওই তো ল’র ইস্তিরি, তবে ইলেক্টিরি ইস্তিরির ওজন কম, ডাকু করবে বলছে ইলেক্টিরি।

গুণেন মিত্তির পুব আকাশে রঙের ছটা দেখল, বলল, তুমি নাকি ইস্তিরি তুলতে হাসফাঁস কর ?

পরীক্ষা করে দেখুক ডাকু, ওটা নয়িমের কথা।

খুব রোগা হয়ে গেছ কিন্তু।

বুড়ো তার হাতের রেক্সিন ব্যাগ খুলে ওষুধ বের করে, হাসপাতালে দেখাই, তারা বলছে আমি ভাল, রুগা হওয়া ভাল, এই যে দেখুন ভিটামিন বড়ি দেছে, আর বুকির ছবি করতি বলেছে।

করেছ বুকের ছবি ?

না, করব, ভাগ্নার সময় হচ্ছে না, আবার বেটার ঘর যেতিও দেচ্ছে না, এদিকি ভাগ্না বউ পুয়াতি, কোন দিকি যাই, তবে ইস্তিরি আমি তুলতি পারি, যা শুনেছ ছার সব মিথ্যে।

স্যার গুণেন মিত্তির প্রাতঃভ্রমণ সেরে এলেন। চা খেলেন। খবরের কাগজ পড়লেন। কাগজ জুড়ে একটি মেয়ের আর্তনাদ। দু পা দুদিকে টেনে ছিড়ে ফেলার খবর। স্যার গুণেন মাথা নামিয়ে বসে থাকলেন। বাস্তবের পৃথিবী ছেড়ে ভারচুয়াল ওয়ার্ল্ডে গেলে যেন নিশ্চিন্ত থাকা যায়। তাই তিনি একসময় কম্পিউটারে গিয়ে বসলেন। শীর্ণকায় ইভলিন গুড মর্নিং জানায়।

হেল্লো, তুমি কি আমাকে বলবে, এত রোগা হয়ে গেলে কী করে, ডায়েট কন্ট্রোল কী ভাবে করেছ, আমি দিন দিন হেভি হয়ে যাচ্ছি, এত হাঁটি, ফ্যাট কমে না।

অনেকটা সময় বাদে ইভলিন বলে, আমার এমপ্লয়ার জানে না আমি ফেস বুক করি, জানলে আমার ট্রাবল হবে, শুধু জানে আমার একটি মোবাইল ফোন আছে।

আহা, ওই কথা নয়, বলছি......।

ফ্রেন্দ, আই গেত নট এনাফ ফুদ ফর মাই হাঙ্গার, মাই এমপ্লয়ার গিভস আ লিতল ফুদ হিয়ার, আই ইউজ স্লিমার, স্লিমার রিদিউসেস মাই হাঙ্গার, অল ফর মাই চাইল্ড।

বুঝতে চাইলেন স্যার গুণেন মিত্তির। তার খিদে মেটানর মতো খাদ্য দেয় না তার মালয়েশিয়ান এমপ্লয়ার, তাই সে স্লিমার নেয়। ওষুধে ক্ষিদে কমায়। খিদে এখন কত কম। শরীর থেকে ঝরে যাচ্ছে সব। এরপর কী হবে তা ইভলিন জানে না। হাউ এভার আয়াম ফাইন ফ্রেন্দ। বলতে বলতে সে অফ লাইন। ইভলিন আর নেই। তার কথাগুলো হ্যাং করে গেল। অলীক ব্রহ্মান্ডে ভেসে থাকল।

পরদিন তিনি, স্যার গুণেন সেই বুড়োকে পথের ধারে আর বসে থাকতে দেখলেন না। সে ভ্যানিশ। হয় দমদম গেছে না হয় বেলেঘাটা কিংবা কুয়ালালামপুর বা মুনতিনলুপা। কাজের খোঁজে। হ্যাঁ, লোকটা থাকে ফুটপাথে আর মেয়েটা থাকে কম্পিউটারে। আর গুণেন থাকেন তাঁর ফ্ল্যাটে। কম্পিউটার ফেসবুক টুইটার ব্লগ নিয়ে।

ক্যাপশন যুক্ত করুন

লেখক পরিচিতি
অমর মিত্র
জন্ম :৩০ আগস্ট১৯৫১

বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কাছে ধুলিহর গ্রামে | বিজ্ঞানের ছাত্র | কর্ম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক দপ্তরে | তিনি ২০০৬ সালে ধ্রুবপুত্রউপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন।]
প্রকাশিত বই : পাহাড়ের মত মানুষ, অমর মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প, অর্ধেক রাত্রি, ডানা নেই উড়ে যায়, ধুলোগ্রাম, অশ্বচরিত, আগুনের গাড়ী,ধ্রুবপুত্র, নদীবসত, কৃষ্ণগহ্বর, আসনবনি, নিস্তব্দ নগর, প্রান্তরের অন্ধকার, ভি আই পি রোড, শ্যাম মিস্ত্রী কেমন ছিলেন, গজেন ভূঁইয়ার ফেরা, জনসমুদ্র, সবুজ রঙের শহর, সমাবেশ, সারিঘর, সুবর্ণরেখা, সোনাই ছিলো নদীর নাম, হাঁসপাহাড়ি।
পুরস্কার : সাহিত্য একাডেমী।













একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ