শেরউড অ্যান্ডারসন : মাতৃত্ব

ভাষান্তর : এমদাদ রহমান

১৮৭৬ সালে জন্ম নেয়া এই মাকির্ন লেখকের ছোটবেলা আর বয়োসন্ধি-র সময়টুকু কেটেছে নানান পারিবারিক যন্ত্রণা আর কষ্টকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে। চেখভ, ডিকেন্স, লুইসা মেই এ্যালকটের মতো লেখকদের মতো তিনিও জানেন পরিবারের দুঃসহ পরিস্থিতি, দুর্ভোগ কেমন হয়ে থাকে। একদিকে ব্যবসায় বাবার ভরাডুবি, অন্যদিকে হতবিহবল মা হয়ে পড়েছেন পানাসক্ত। ফলে জীববিদ্যা, গণিতবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা শেখার পথ তার বন্ধ হয়ে গেল। বিদ্যালয় ত্যাগ করলেন পয়সা বাঁচানোর জন্য। তিনি সারা বিশ্বে খ্যাতিমান ছোটগল্পকার হিসেবেই। ১৯৪২ সালের মার্চে মৃত্যু হয় তাঁর।


অ্যান্ডারসনের প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সমালোচকেরা বলেন-পাঠকরা যথেষ্ট সময় ব্যয় করেন তার সম্পর্কে ভাবনায়, যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো পাঠকরা ভাবছে কে এই গল্পগুলো লিখেছে। যখন আমরা অ্যান্ডারসনের মতো প্রতিভাবান লেখক সম্পর্কে অনেক কিছু জানবো না, তখন কীভাবে আমরা এ সম্পর্কে নিশ্চিত হবো যে তিনি এমন এক লেখক, যার রয়েছে কোনকিছু সম্পর্কে আত্মনিমগ্ন হয়ে যাবার মতো মহান ক্ষমতা।


মাতৃত্ব
পাহাড়ের তলার জলাভূমিতে-যা ছেয়ে গিয়েছিল উলুখাগড়া শো শো বাতাস আর পাহাড়চূড়ার আখরোট গাছগুলোর শুকনো পাতায়-শব্দ হচ্ছিল মর মর, খসখস।

সে গাছগুলো পেরিয়ে বেশ দূরে গিয়েছিল, যেখানে ঘাস যেমন খুব উঁচু আর জট পাকানো। খামার বাড়ির একটা দরোজা বাতাসের দাপুটে ধাক্কায় বারবার আন্দোলিত হচ্ছে এবং সামনের রাস্তার একটা কুকুর তারস্বরে চিৎকার করছে।

তারপর বেশ দীর্ঘ সময় আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। তারপর নৈঃশব্দ্যে জমে যাওয়া রাস্তায় একটা মালগাড়ি ঘড়ঘড় শব্দ তুলে ঝাঁকি খেতে খেতে আসতে থাকে। মালগাড়িটার শব্দ ধাবিত হয় সেইখানে, যেখানে ঘাসের ওপর সে শুয়ে আছে। ঘাসের ডগাগুলো কারো আঙুলের মতো খেলা করছে তার শরীরের ওপর। আঙুলের খেলায় শরীর থেকে বের হচ্ছে সুরভি। মালগাড়িটি চলে যাবার অনেকক্ষণ পরও শরীরের এই সৌরভ বাতাসে বাহিত হয়ে মিশে থাকে।

তারপর অন্য এক শব্দ যেন সমস্ত জমাট নৈঃশব্দ্য খানখান করে ভেঙে ফেলল। কাছেপিঠের কোনো খামার থেকে এক যুবক মাঠ ভেঙে এগিয়ে আসে, সে আসলে পাহাড়টার দিকেই এগিয়ে চলে, কিন্তু তখনও তাকে সে তার পায়ের কাছে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেনি। যুবকটি-খামার বাড়ির দিকে দৃষ্টি এগিয়ে দেয়, হাত দুটিকে পকেটে পুরে রাখে, হিম জমাট রাস্তার ওপর ঘোড়ার মতো জোরে আঘাত করে।

তারপর কাছেই কারো অস্তিত্ব টের পায় যুবকটি। শরীরের সৌরভ তাকে সচকিত করে তোলে।

শব্দহীন শরীরের কাছে সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। আজ যেন হঠাৎ সবকিছু বদলে গেছে। অম্যান্য দিনের সন্ধ্যাগুলোর মতো যখন তারা খুব-নিঃশব্দে পার হয়ে যেত পাহাড়টার চড়াই-উৎরাই-আজ যেন তার সবকিছুই বদলে গেছে। কথা বলবার আর অপেক্ষা করবার সময় যেন পার হয়ে গেছে। আজ সে-ও যেন অন্য কেউ। সে তার মুখের ওপর হাত রাখে, ঘাড়ে হাত রাখে, স্তনে হাত রাখে, ঠোঁটে হাত রাখে। আর তাতে তার ভেতর জন্ম নেয় এক বিস্ময়কর কাঠিন্য। যখন সে ঠোঁটে চুম্বন করে, তখন সে একচুলও নড়ল না। শুধু মুহূর্তের জন্য তার ভেতরে জেগে উঠল একটুখানি উৎকণ্ঠা। মুহূর্তের ভেতর উৎকণ্ঠা কেটে যায়। সে আরো সাহসী হয় আর তার পাশে শুয়ে পড়ে।

সে এক চাষাপুত্র, লাঙলের ফলায় সে চষে বেড়িয়েছে একরের পর একর উর্বর কালো মাটি।
আজীবন সে নিজের কাছে বিশ্বস্ত।

সে তার এক উত্তরাধিকারীর বীজ রোপন করেছে অন্ধ, কম্পিত, শিহরিত উর্বর মৃত্তিকায়।

সে তার ভেতর উত্তরাধিকারীর বীজ বহন করতে থাকে। শীতের সন্ধ্যাগুলোয় সে পায়ে হেঁটে চলে যায় ছোট পাহাড়টার কাছে, পাহাড়টা তখন গোলাবাড়ি। সর্বত্র শস্য আর শস্য। সেখানে সে দোহন করে। সে বিশাল আর খুব শক্তিশালী। তার পাগুলি অনবরত আন্দোলিত হয়। তার অন্তর্গত উত্তরাধিকারীটিও তার ছোট পাগুলিকে নাড়াতে থাকে।

সে শিখে ফেলে ছোট পাহাড়গুলির ছন্দ।
সে শিখে নেয় সমতলভূমির ছন্দ।
সে শিখে নেয় পায়ে পায়ে হেঁটে বেড়াবার ছন্দ।
সে শিখে ফেলে শক্ত হাতে গাভীর দুধ ধরে টান।

বিস্তৃত বন্ধ্যা মাঠ ভরে আছে পাথর আর পাহাড়ী বসন্তের রাতগুলি যখন উঞ্চতায় ভরে যায়, উঞ্চ রাতগুলি নেমে আসে তখন সে ধীরে ধীরে তার ভেতর বেড়ে ওঠে। তখন সে সেই বন্ধ্যা জায়গাটায় চলে যায়। পাথরগুলি শক্ত হয়ে এমনভাবে গেঁথে থাকে, যেন বের হয়ে আছে সব মৃত শিশুদের খুলি। মাঠটি জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হয়, ক্রমাগত ঢালু হতে হতে নেমে যায় জলপ্রবাহের দিকে। কয়েকটি ভেড়া পাথরের স্তূপে গজিয়ে ওঠা ঘাস খুঁটে খুঁটে খেতে থাকে।

অগণিত শিশুকে এই বন্ধ্যা জমিতে কবর দেয়া হয়েছে। তারা কঠিন পাথুরে মাটি ভেদ করে উঠে আসতে চাইছে। তারা তার কাছে ফিরে আসতে চাইছে। ঝিরিঝিরি জলপ্রবাহ পাহাড় উপচে বইতে শুরু করেছে। আর তার আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। দীর্ঘ, দীর্ঘকাল ধরে সে এই পাথরভর্তি মাঠটায় দাঁড়িয়ে থাকে। প্রচ- দুঃখ কিংবা বিষাদে কাঁপতে থাকে।

প্রকাণ্ড পাথরখণ্ড বসে থাকা শরীর, তাকে তুলে নিয়ে সে হাঁটতে থাকে খামার বাড়ির দিকে। আর যখন ছোট পথ ধরে নিঃস্তব্ধ গোলাঘর পেছনে ফেলে সে এগিয়ে যায়, তখন চরাচর ঢেকে-রাখা অন্ধকার হঠাৎ যেন চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।


তার ভেতরের সত্তাটি মুক্তির জন্য লড়াই করে প্রাণপণ। যুদ্ধ। যুদ্ধ। যখন সে ঘুমোতে যায়, তার পায়ের গোড়ালি দিয়ে কারাগারের দেয়ালে জোর আঘাত করে। সে ঘুমিয়ে থাকে।


অনুবাদক পরিচিতি
এমদাদ রহমান 

গল্পকার
অনুবাদক।
জন্ম সিলেট, বাংলাদেশ।
বর্তমানে ইংলন্ডে থাকেন। 
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : পাতালভূমি ও অন্যান্য গল্প।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ