একসময় প্রগতিশীল কি বামপন্থী রাজনীতিতে শিক্ষাগ্রহণকালে কিছু কিছু গ্রন্থের পাঠ আবশ্যিক ছিল। অতিক্রান্ত কৈশোর কি সদ্য-তরুণ মানবমুক্তির ব্রতী সকলে রেবতী বর্মন কি চিন্মোহন সেহানবীশ-এর মার্কস-এ্যাংগেলস-এর তত্ত্বালোচনার সঙ্গে সতীনাথ ভাদুড়ীর দু'টি উপন্যাস পড়বার জন্যেও প্রণোদিত হতেন। রুশ ভাষা, কি ইউরোপীয় কিছু ভাষার সাহিত্য অনুবাদ পাঠান্তে কোমলমতি রংরুটেরা জনকল্যাণে আরো দৃঢ়সংকল্প হতেন নিঃসন্দেহে, যদিও সঙ্গে কিছু ভারতীয় ভাষার গ্রন্থাদিও পাঠ্য ছিল, দ্রুত বোধসঞ্চারে সক্ষম বলে। 'জাগরী' ও 'ঢোঁড়াই চরিত মানস' অমন দু'টি গ্রন্থ। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছিল।
'জাগরী' ও 'ঢোঁড়াই চরিত মানস', পাঠক জানেন, বঙ্গদেশে তৎকালে প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে স্পষ্ট পরিচয়ে চিহ্নিত। রাজনৈতিক কারণে কারাগার বাসকালে রচিত জাগরী কারাকক্ষে বাসের-ই অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। রাজনৈতিক জাগৃতির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের সংঘাত যে 'তরঙ্গ বিক্ষোভ' সৃষ্টি করে এবং সেটি যে পারিবারিক ভিত্তিকেও আঘাত করে, সতীনাথ সর্বপ্রথমেই পাঠককে তা জানিয়ে দেন, এবং গ্রন্থটি উৎসর্গও করেন 'যে সকল অখ্যাতনামা রাজনৈতিক কর্মীর কর্মনিষ্ঠা ও স্বার্থত্যাগের বিবরণ জাতীয় ইতিহাসে কোনদিন-ই লিখিত হইবে না, তাহাদের স্মৃতির উদ্দেশে।' 'ঢোঁড়াই চরিত মানস' বিহারের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাৎমাদের জীবনের অস্তিত্বের সংগ্রাম। ঢোঁড়াই চরিত্রটিকে তিনি নির্মাণ করেছেন এক-ই সঙ্গে যন্ত্রণা, বঞ্চনা ও সংগ্রামের মানবিক প্রতিনিধি হিসেবে। 'জাগরী' যদি রাজনীতি-আক্রান্ত তৎকালীন মধ্যবিত্ত জীবনের আখ্যান হয়, 'ঢোঁড়াই' প্রান্তিক জীবনের। 'জাগরী' যদি গান্ধীবাদ ও আগস্ট আন্দোলনের সহাবস্থানের ইঙ্গিত দিয়ে থাকে তো 'ঢোঁড়াই' ঐ আগস্ট আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে টংক বিদ্রোহ-জাতীয় কোন অভ্যুত্থানের আগাম দলিল হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
সতীনাথের অবিস্মরণীয় এই দু'টি উপন্যাসের মধ্যে আরো কিছু যোগাযোগ আছে। জাগরী-র প্রকাশকাল ১৯৪৫, যদিও রচনাকাল, বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, তারও আগের। ঢোঁড়াই-এর প্রকাশকাল ১৯৫১-১৯৫৩। সতীনাথ ভারতীয় কংগ্রেস দল থেকে বেরিয়ে আসেন '৪৮-এর প্রথম দিকেই। যোগ দেন কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টিতে একই সময়ে। ভারতীয় কংগ্রেসের সংগ্রাম ও আদর্শ যদি মূর্ত হয় 'জাগরী'-তে, তো ভারতীয় বাম-রাজনীতির আসন্ন দিনের সমস্ত ইঙ্গিতও রয়েছে 'ঢোঁড়াই'-এ।
'জাগরী' ও 'ঢোঁড়াই চরিত মানস'-এর উপর্যুক্ত উল্লেখ এইজন্যে যে, বাঙালি পাঠক সতীনাথ ভাদুড়ীকে জানেন মূলত তাঁর এই উপন্যাস-দুটির সুবাদেই। আরও চারটি উপন্যাস ও সাতটি গল্পগ্রন্থের কথা মনে পড়ে না কারো। যদিও অনেকে বলেন, সতীনাথ ভাদুড়ী তাঁর সাতটি গল্পগ্রন্থের বাষট্টিটি গল্পের জন্যেও সম্ভবত অধিকতর স্মরণীয় হতে পারতেন। হননি যে, তার প্রধান কারণ, আমার অনুমান, বাঙালি পাঠকের সুশীল সমাজের সমকালীন রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ এবং পঞ্চাশ-ষাটের যুগে (চাই কি সত্তরেও), বিশ্বরাজনীতিতে বামাদর্শ সমাদৃত হলে, ভারতীয় বুদ্ধিজীবী, বিশেষত বাঙালি বুদ্ধিজীবী, সমপ্রদায় বামাদর্শে দীক্ষিত রচনাবলীকেই মানুষের জীবনে প্রয়োজনীয় ও শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করতে থাকেন। ভারতীয় স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে রচিত 'জাগরী' তাই সতীনাথের অন্য সব রচনার গুণাবলীকেই মস্নান করে দেয়।
সতীনাথের প্রথম রচনা প্রকাশিত হয় ১৯৩২-এ 'বিচিত্রা'য়, এমন উল্লেখ আছে। অর্থাৎ তাঁর ছাবি্বশ বছর বয়সে। 'জাগরী'-র প্রকাশকাল ১৯৪৫, প্রথম রচনা প্রকাশের প্রায় বার-তের বছর পরে। 'ঢোঁড়াই'-এর প্রকাশকাল ১৯৪৮। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ 'গণনায়ক'-এর প্রথম গল্পটির প্রকাশকালও ঐ। চলি্লশোর্ধ তিনি তখন। সক্রিয় রাজনীতিকের জীবনও প্রায় শেষ। স্পষ্টতই তাঁর সব গল্প-ই রচিত তাঁর অরাজনৈতিক জীবনে। এ-কারণেই সম্ভবত রাজনৈতিক উপন্যাসের জন্যে যে অসাধারণ জনপ্রিয়তা তিনি লাভ করেছিলেন, গল্পের জন্য সেই পরিমাণ নয়। বিদ্বজ্জন এমন বলেন যে, 'সতীনাথ ভাদুড়ী বাংলা উপন্যাসে সৃষ্টির ধ্যানে, বোধে, শিল্পিত সাধনায়, এবং নিজেকে সাহিত্য সাধনায় প্রস্তুত করবার জন্য যেভাবে পঠনপাঠনে নিমগ্ন হয়েছিলেন, তার কোন তুলনা নেই। উপন্যাসের নতুন প্রকরণ নির্মাণ করেছেন তিনি। প্রচলিত ধারা থেকে সরে এসে অসাধারণ দু'টি উপন্যাসে যে-জীবনকে উপজীব্য করেছেন, বাংলা সাহিত্যে তা বিশিষ্ট হয়ে আছে।'
সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্প সম্পর্কে এমন কথা খুব বেশি শোনা যায় না। গল্প সংখ্যা যথেষ্ট নয় এজন্যে পাঠক তাঁর গল্পের কথা জানে না, নাকি সমালোচক তার গল্পের দিকে নজর দেন না এমন কথা তোলা যায়-ই, তবে সেটি শক্ত ভিতে বসানো নয়; উপন্যাস সংখ্যাও তাঁর সাতটি-ই, 'ঢোঁড়াই চরিত মানস'-এর দু'টি চরণকে দু'টি গ্রন্থ হিসেবে ধরলেও।
দুই
আবারও উল্লেখ করা যাক, সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্প-সংখ্যা বাষট্টিটি; সাতটি গল্পগ্রন্থে সংগৃহীত। প্রথম গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্পটি আর তাঁর নিজ বিচারে শ্রেষ্ঠ উপন্যাস 'ঢোঁড়াই চরিত মানস'-এর রচনাকাল এক। একটু ভেবে নিয়ে বলা যায়, তাঁর সব গল্পই, নিঃসন্দেহে তার মধ্যে 'শ্রেষ্ঠ' গল্পও অনেকই, তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস রচনার পরবর্তী কালের। আরও একটু ভেবে নিয়ে বলা যায়, যেহেতু তাঁর গল্পসমূহ শ্রেষ্ঠ উপন্যাসদ্বয় রচনার পরের, এ-কারণেই তাঁর গল্পসমূহ উচ্চতর বলে বিবেচিত হয় না। আর একটি কথাও বলা যায়। 'জাগরী' উপন্যাসের জন্যে যখন তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন, তখন তিনি প্যারিসে। ইউরোপ ভ্রমণরত। স্পষ্টতই তাঁর অধিকাংশ গল্পই বিদেশবাস পরবর্তী। এমনকি ভাবাই যায় না যে, বিদেশী সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি, মানুষ, তাঁর চিন্তায় কিছু প্রভাব ফেলে থাকবেই, এবং সেটিই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গল্পে? তাই কি কংগ্রেস ও বামাদর্শ এই দুই ধারা থেকেই সরে যাওয়া লেখক পঞ্চাশ-ষাটের বাম-রাজনীতিবিশ্বাসী সমালোচকবর্গের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন? দেখা যায়, ঐ-কালে প্রকাশিত গল্পসমূহের অধিকাংশই প্রকাশিত হয় 'দেশ', 'আনন্দবাজার'-এর মতো অভিজাত পত্র-পত্রিকায়। দু'টি মাত্র গল্প প্রকাশিত হয়েছিল 'পরিচয়'-এ, যা স্পষ্ট বামধারার সাহিত্যপত্র। 'চতুরঙ্গ'-এ প্রকাশিত হয়েছিল একটি গল্প, ১৯৫৫-এ। আমাদের কৈশোরকালেই প্রায়।
সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্প পড়েছি আমার মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবার পরে, ষাটের শুরুতে। পঞ্চাশের মধ্যপাদে 'জাগরী' ও 'ঢোঁড়াই'-এর বাধ্যতামূলক পাঠ তখন স্মৃতি। 'নতুন সাহিত্য', 'বিংশ শতাব্দী', 'দেশ' প্রভৃতি অত্যাধুনিক কালের সাহিত্যপত্র আমাদের মতো তরুণ পাঠককে যে সাহিত্যধারার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, সেখানে 'জাগরী' কি 'ঢোঁড়াই'-এর খুব বড় জায়গা ছিলও না। তবু সতীনাথের গল্প যে পড়েছি তা ঐ 'দেশ' কি 'আনন্দবাজার'-এর জন্যেই। ঐ সময়ে 'উল্টোরথ', 'সিনেমা জগৎ' নামে দু'টি বিনোদন পত্রিকা প্রকাশিত হতো। বিশেষত উল্টোরথ শারদীয় সংখ্যায় সে-সময়ের সব বড় লেখকের রচনাই প্রকাশিত হতো। বুদ্ধদেব বসুর 'বিপন্ন বিস্ময়' নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল উল্টোরথ-এ (পঞ্চাশের শেষে? ষাটের প্রথমে?) যেটি পড়ে মনে হয়েছিল আধুনিক বাংলা উপন্যাসের জগৎ উন্মোচিত হচ্ছে। 'সমকাল'-এ সৈয়দ সামসুল হক-এর 'কোথাও আলো নেই' গল্পটি পড়ে যেমন আধুনিক বাংলা গল্পের জগতে প্রবেশ করার কথা মনে হয়েছিল। কাম্যু, কাফকা, সার্ত্র্, হেমিংওয়ে, ফোকনার, মোরাভিয়া ইত্যাকার লেখকের রচনার সঙ্গে পরিচয়ের জন্যেও সম্ভবত ঐকালে সতীনাথ ভাদুড়ীর রচনা সংগ্রহের দিকে কোন বিশেষ আগ্রহ ছিল না। অনুমান করি, এ কারণেই আমার মতো অনেকেই সতীনাথ-এর প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন না। প্রায় কুড়ি বছর সময় কালে রচিত বাষট্টিটি গল্পই তো! তাঁর শেষ গল্পগ্রন্থ 'সতীনাথ বিচিত্রা' প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর কিছুকাল পরে, ১৯৬৫-তে। তাঁর অন্যান্য গল্পগ্রন্থের পুনর্মুদ্রণের কোন তথ্য আমার জানা নেই। কেবল দেখি যে 'সতীনাথ ভাদুড়ীর শ্রেষ্ঠগল্প' প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮২-তে। এই পনেরো-কুড়ি বছরে সতীনাথ পাঠে কোন উৎসাহের খবর তেমন পাওয়া যায় না। পঞ্চাশের কালে মিত্র ও ঘোষ যেমন বিভিন্ন গল্পকারের 'শ্রেষ্ঠ গল্প' প্রকাশ করে ও পরে 'স্বনির্বাচিত গল্প'-ও, সতীনাথ ঐসব লেখক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। তখনও গল্পকার হিসেবে নন, উপন্যাস রচয়িতা হিসেবেই তিনি পরিচিত। আবার তাঁর উপন্যাসাবলী, 'জাগরী' ও 'ঢোঁড়াই' ব্যতীত, 'চিত্রগুপ্তের ফাইল', 'অচিন রাগিণী', 'সংকট' এবং 'দিগ্ভ্রান্ত' পঞ্চাশ-পরবর্তী পাঠকের পাঠ্য তালিকার শীর্ষে ছিল না। এইরকম নানা সূত্র থেকে পাওয়া নানা তথ্য মেলালে দেখা যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী যে মধ্য-ষাট থেকে প্রায় মধ্য-আশি পর্যন্ত বিস্মৃত ছিলেন (এবং পরবর্তী কুড়ি বছরেও যে আবার সব পাঠকের কাছেই ফিরে এসেছেন এমন নয়) তার একরকম হিসাব পাওয়া যায়ই।
আর একটি বিষয়ও সম্ভবত সতীনাথের রচনার সঙ্গে তাঁর বাঙালি পাঠককুলের সম্পর্ককে কিয়ৎপরিমাণে নিয়ন্ত্রণ করেছে- সেটি তাঁর রচনার ভৌগোলিক জগৎ। উপন্যাস রচনায় তো অবশ্যই, গল্প রচনার কালেও তাঁর গল্পের স্থান মূলত বিহার অঞ্চল। তাঁর বাসও ছিল পূর্ণিয়াতেই। বাঙালি পাঠক, তাঁর রচনার নিষ্ঠাবান পাঠক হলেও, ঐ স্থান ও চরিত্রের জগৎ যে তাঁর নিজের নয় এই কথা সর্বদা ভুলে যেত এমন নাও হতে পারে। তৎকালে বাংলা সাহিত্য তথা প্রকাশনা ইত্যাদির কেন্দ্র কলকাতার বাইরে তাঁর বাসও একরকম আড়াল সৃষ্টি করেছিল নিশ্চয়ই। অনেক লেখকের ক্ষেত্রেই অবশ্য এমন ঘটেছে, এটি এমনকিছু নতুন নয়।
তিন
সতীনাথ ভাদুড়ী ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে পার হয়ে গেল। মানিকের জন্ম-শতবার্ষিকী পালনের কথা একরকম জানা গেছে, সতীনাথের নয়। সম্ভবত পালিত হয়নি বলেই। পশ্চিম বাংলায় বাম ঘরানা ক্ষমতায়, এ-কারণে মানিককে তাঁরা ছুড়ে ফেলে দিতে পারেননি। কিন্তু সতীনাথের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা ছিল কিনা এ কথা জিজ্ঞাসা করলে পশ্চিম বাংলার বামীরা কি বলেছিলেন, বরং কংগ্রেসীদের কাছে যান? আমি জানি না।
বাংলাদেশে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়েছে একাধিক স্থানে। বাংলা একাডেমী তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহদাকার একটি বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করেছে 'উত্তরাধিকার'-এর। সতীনাথ ভাদুড়ীর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তেমন কোন প্রকাশনার কি অনুষ্ঠানের খবর আমি জানি না। কেবল 'কালী ও কলম'-এর ২০০৭ জুন সংখ্যায় মাহমুদ আল জামান একটি রচনায় সতীনাথ ভাদুড়ী এককালে বাংলা সাহিত্য-জগতে যে আশ্চর্য সাড়া জাগিয়েছিলেন এবং সেই তুলনায় পরবর্তী কালে পাঠকেরা তাঁকে মনে রাখেনি বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তাঁর রচনাটিও মূলত 'জাগরী' ও 'ঢোঁড়াই চরিত মানস'-এর আলোচনাই। গল্পের তেমন উল্লেখ নেই। এই কালে অন্য কোথাও তাঁর গল্প কি উপন্যাস নিয়ে এক বা একাধিক আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে কিনা আমি জানি না।
সতীনাথ ভাদুড়ীর আলোচনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখ খুব প্রয়োজনীয় নয়, আবার সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকও হয়তো নয়। সতীনাথ মানিক অপেক্ষা বয়সে মাত্র দু'বছরের বড় হলেও তাঁর সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় মানিকের পরে। তাঁর মৃত্যুও মানিকের পরেই। 'পদ্মা নদীর মাঝি' ও 'পুতুল নাচের ইতিকথা' মানিকের দুই চিরস্মরণীয় উপন্যাস, 'জাগরী' ও 'ঢোঁড়াই রচিত মানস'-ও তেমনি সতীনাথের, যদিও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসদ্বয় সতীনাথের উপন্যাস-দু'টির অনেক পূর্বেই রচিত ও প্রকাশিত। ভাবলে কিঞ্চিৎ বিস্মিতই হতে হয় যে পদ্মানদীপারের সংগ্রামী ধীবরকুলের জীবনগাথা বিহার অঞ্চলের এক মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক পরিবারের অস্তিত্ব, রাজনৈতিক বিশ্বাস ও সংগ্রামী জীবনের কাহিনীর সঙ্গে একত্রে পঠিত হয় না। একত্র উল্লেখও খুব বেশি দেখা যায় না। 'পদ্মা নদীর মাঝি' প্রকাশের প্রায় দশ বছর পরে 'জাগরী' প্রকাশিত হলেও 'জাগরী' যেমন তার রচয়িতাকে মুহূর্তে খ্যাতির শীর্ষে তুলে দিয়েছিল, 'পদ্মা নদীর মাঝি' তেমন দেয়নি তার রচয়িতাকে। যদিও পদ্মা উপন্যাসের ব্যাপ্তি, জীবনবোধ, মানবিক প্রবৃত্তির টানাপোড়েন, জীবনধারণের বাস্তবতা, শিল্পগুণ 'জাগরী' অপেক্ষা শ্রেয়স্তর, সমালোচকেরা এ-কথা বলতে পারেনই। তৎকালে প্রচলিত ও সর্বত্রগৃহীত রাজনৈতিক বিশ্বাস 'জাগরী'তে অতি সহজেই সকলের কাছে স্পষ্ট হয়, পক্ষান্তরে 'পদ্মা নদীর মাঝি'র সুখ-দুঃখ-সংগ্রামের গাথা শিল্পাশ্রয়ে ধীরে রাজনৈতিক বোধে সঞ্চারিত হয়। সম্ভবত এ-কারণেই 'জাগরী' ও 'ঢোঁড়াই চরিত মানস' তার প্রকাশ কালের পনেরো-কুড়ি বছর পরে পাঠকের পাঠ্যতালিকায় সর্বদা স্থান না পেলেও, 'পদ্মা নদীর মাঝি' সর্বদাই এর শীর্ষে থাকে। কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের সঙ্গে পাঠক আরো লক্ষ করেন যে, সতীনাথ যে-কালে চিহ্নিত রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দল ছেড়ে দূরে সরে যাচ্ছেন, মানিক তখন-ই বিশেষ এক রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ছেন।
সতীনাথ ও মানিকের গল্প সম্বন্ধেও দু'একটি মন্তব্য করা এই মুহূর্তে সম্ভবত খুব অসমীচীন হবে না। ঔপন্যাসিক অপেক্ষা গল্পরচয়িতা হিসেবে সতীনাথকে উচ্চাসনে বসালেও মানিকের সঙ্গে এই ক্ষেত্রে তাঁর তুলনা করা যায় না। কেবল যে বাষট্টিটি গল্পের সঙ্গে প্রায় দ্বিশতাধিক গল্পের তুলনা বৃথা তাই নয়, পাঠক নিজেও 'গণনায়ক', 'আণ্টাবাংলা', 'চকাচকি', 'চরণদাস এম.এল.এ.' ইত্যাদি গল্পের কথা স্মরণ করেন না যখন তাঁর 'প্রাগৈতিহাসিক', 'আত্মহত্যার অধিকার', 'সরীসৃপ', 'হারানের নাতজামাই', 'ছোট বকুলপুরের যাত্রী' প্রভৃতি গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। সন্দেহ করাই চলে যে, সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্পের কথা প্রায় কখনোই বাংলা গল্পপাঠকের চিত্তে ধরা থাকে না, যেমন থাকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের কথা, সর্বদা। তাই সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্পের আলোচনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখ যথার্থ নয়।
সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্পের আলোচনা অনেক পাওয়া যায় না, অবশ্য উপন্যাসেরও নয়। তাঁর শেষ গল্পগ্রন্থ 'সতীনাথ বিচিত্রা' প্রকাশের প্রায় সতেরো বছর পরে 'সতীনাথ ভাদুড়ীর শ্রেষ্ঠ গল্প' প্রকাশিত হয়। একত্রে তাঁর বেশ কিছু গল্প সংকলিত না হওয়ায় বিস্তৃত আলোচনাও সম্ভব হয়নি এমন ভাবাই চলে। 'সতীনাথ ভাদুড়ীর শ্রেষ্ঠ গল্প' সংকলনে যে কুড়িটি গল্প স্থান পেয়েছে সে-কটি বাছবার জন্যে সম্পাদক বারিদবরণ ঘোষ অনেক বইপত্র-প্রবন্ধ ইত্যাদি খুঁজে দেখবার সুযোগ পাননি। নির্বাচনে তিনি সতীনাথের বিভিন্ন গল্প সংকলন ছাড়া সতীনাথ গ্রন্থাবলীর সম্পাদকযুগল; গোপাল হালদারের চমৎকার বইখানি ('সতীনাথ ভাদুড়ী ঃ সাহিত্য ও সাধনা', অয়ন, কলকাতা, ১৯৭৮), সুবল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সতীনাথ স্মরণে' এবং অন্যান্য নানা টুকরা রচনার সাহায্য-ই পেয়েছেন কেবল। এ-কারণে গ্রন্থের ভূমিকায় সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্প সম্পর্কে তিনি যা বলেন, তা নিতান্তই সংক্ষিপ্ত। সাহিত্য আকাদেমীর নির্দেশনায় স্বস্তি ম-ল সতীনাথ ভাদুড়ীর জীবন ও কর্মাদি রচনাকালে 'সৃষ্টিধারার অন্য স্রোত ঃ গল্প-ছোটগল্প' বলে যে অংশটুকু যোগ করেন সেটিও আট-দশ পৃষ্ঠার একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনাই।
'শ্রেষ্ঠগল্প' সংকলনে এই গল্প স্থান পেয়েছে : 'গণনায়ক', 'বন্যা', 'আণ্টাবাংলা', 'যড়যন্ত্র মামলার রায়', 'চকাচকি', 'বৈয়াকরণ', 'ডাকাতের বৌ', 'মুনাফা ঠাকরুণ', 'পত্রলেখার বাবা', 'বাহাত্তরে', 'অভিজ্ঞতা', 'চরণদাস এম.এল.এ.', 'দাম্পত্যসীমান্তে', 'অলোকদৃষ্টি', 'জোড়-কলম', 'বয়কমি', 'জামাইবাবু', 'ওয়ার কোয়ালিটি', 'দিগ্ভ্রান্ত' ও 'বমি-কপালিয়া'। এই গল্পসমূহের বাইরে অন্যান্য আরো কিছু গল্পের উল্লেখ স্বস্তি ম-লের রচনায় পাওয়া যায়। উৎসাহী পাঠক সতীনাথ গ্রন্থাবলীতে সবই পাবেন, কিন্তু এই মুহূর্তে আমি কেবল ঐ কুড়িটি গল্পই পড়ে দেখি।
'গণনায়ক' সতীনাথ ভাদুড়ীর প্রথম গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প। সতীনাথের বহু-আলোচিত গল্পগুলির অন্যতম। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ তথা গণনায়কদের চেহারা কী হতে চলেছে, কংগ্রেসী রাজনীতির খেলায় স্বাধীনতাও যে আসলে মুনাফা অর্জনের উপায় হয়ে উঠেছে, সতীনাথ এ-কথাই বলেন তাঁর গল্পের শরীরে। ছোটগল্পের স্বাভাবিক ইঙ্গিতধর্মিতা, তির্যক বিদ্রূপ কি পরিহাসের মিশ্রণে। স্বাধীনতার পরেপরেই কংগ্রেসের ক্ষমতাদখল, উদ্বাস্তু সমস্যা, ব্যবসায়ীদের ধূর্তামি, আমলাতন্ত্র কীভাবে বিস্তৃত হয়ে চলেছে, তাই নিয়ে লিখেছেন গল্প 'বন্যা', 'ষড়যন্ত্র মামলার রায়', 'মুনাফা ঠাকরুণ', 'চরণদাস এম.এল.এ.' 'ওয়ার কোয়ালিটি' প্রভৃতি। 'শ্রেষ্ঠগল্প'-এ অন্তর্ভুক্ত না হলেও দেখি 'পরকীয়া-সন-ইন-ল', 'করদাতা সংঘ জিন্দাবাদ', 'তিলোত্তমা সংস্কৃতি সংঘ', 'অনাবশ্যক', 'মা আম্রফলেষু' প্রভৃতি গল্পেও তিনি কর ফাঁকি দেয়ার কৌশল, নেতৃত্ব লাভের নানা উপায়, দুর্গতদের সাহায্যকল্পে সংগৃহীত চাঁদা আত্মসাৎ, ইত্যাকার প্রক্রিয়ার বর্ণনা করেন। রাজনৈতিক নেতা, সমাজসেবী, কি নীতিবাদী চরিত্রের নানা বিচ্যুতির বর্ণনা করার পাশাপাশি সরকারি আমলাদের অকর্মণ্যতা, সরকারি দপ্তরে নানা বিশৃঙ্খলা বিবাদও তাঁর গল্পের বিষয়।
অপরাজনীতি, অপসরকারিনীতির আখ্যান বর্ণনার পাশাপাশি 'চকাচকি', বৈয়াকরণ', 'অলোকদৃষ্টি', 'জামাইবাবু', 'পত্রলেখার বাবা'-র মতো সাধারণ মানুষের জীবনের গল্পও তিনি লেখেন। প্রেমের গল্প প্রায় কখনই রচনা করেননি তিনি, যদি 'চকাচকি' কি 'অপরিচিতা'কে প্রেমের গল্প হিসেবে চিহ্নিত না-করা যায়।সতীনাথের গল্প সম্পর্কে আলোচকেরা বলেন, 'তাঁর প্রতিটি গল্পে নতুনত্বের সন্ধান, সচেতনতার স্বাক্ষর ছড়িয়ে আছে। বিন্দুর মধ্যে তিনি সিন্ধুর গর্জন শোনাতে চেয়েছেন। খ-ের মধ্যে অখ-ের উদ্ভাস জানানোই তাঁর লক্ষ্য। মানুষ ও সমাজকে তিনি দ্বন্দ্বমুখর ও নিয়ত-পরিবর্তনশীল-রূপে দেখাতে চেয়েছেন। অভিজ্ঞতার আলোকে দেশকালের আধারে বিধৃত চারপাশের চেনা-শোনা সহজ সাধারণ নির্বোধ অশিক্ষিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত চরিত্র নিয়েই তিনি অধিকাংশ গল্প লিখেছেন। এদের আচার-আচরণের মধ্যে থেকেই ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের বহমান স্রোতের রূপরেখা আঁকাই তাঁর উদ্দেশ্য' (স্বস্তি ম-ল)। দাঙ্গা, দেশভাগ, সদ্য-স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারতবর্ষের দ্রুত পরিবর্তিত সামাজিক-রাজনৈতিক-পারিপাশ্বর্িক সমস্যা নিয়েও একাধিক গল্প লিখেছেন সতীনাথ, বলেন তাঁরা।
সতীনাথের গল্পের জগতে স্পষ্টতই কোন আলোড়ন সৃষ্টিকারী সত্য, তথ্য, কি তত্ত্ব্বের সন্ধান পাওয়া যায় না। তাঁর সময়ের কি পরের অন্যান্য গল্পকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জগদীশ গুপ্ত, অমিয়ভূষণ মজুমদার, সন্তোষ কুমার ঘোষ, বিমল কর, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের কথা স্মরণ রেখেই এ কথা বলা চলে। ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই প্রভৃতি দশকে দুই বাংলায় যে গল্প রচনার স্রোত প্রবাহিত হয়েছে, সতীনাথের গল্প সেই স্রোতের পাশাপাশিও চলে না। এইকালে ছোটগল্পের পরিশীলিত, বুদ্ধিদীপ্ত, মনোজাগতিক যে রূপ সমকালীন রাজনীতি ও সমাজকে অবলম্বন করে ভিন্ন গল্পের ভুবন তৈরি করে, সতীনাথ সেখানেও প্রবেশ করেননি। এমনকি ফরাসি সাহিত্য পাঠে উদ্দীপ্ত সতীনাথ তাঁর রচনায় সেই পরিমাণে ফরাসি সাহিত্যের রসও যে সিঞ্চন করেছেন, এ-কথাও বলা যাবে না। তবুও সতীনাথ ভাদুড়ীর জন্মশতবর্ষ পার হয়ে যাবারও পরে কেন তাঁর প্রতি এই পুনরাগ্রহ?
চার
শিক্ষাগ্রহণ, জীবিকার্জন, রাজনীতির পাঠগ্রহণ ও শেষে সমকালীন রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণে কাটে সতীনাথের জীবনের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ। শেষ এক-চতুর্থাংশই বলা যায় সাহিত্যসৃষ্টির কাল তাঁর। 'জাগরী' কি 'ঢোঁড়াই চরিত মানস' তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি নিঃসন্দেহে। কিন্তু সেই বিবেচনাও রাজনৈতিক চিন্তাসঞ্জাত। তাঁর প্রকৃত সাহিত্যসৃষ্টি গল্প, যা রাজনীতির বাইরে নিয়ে গিয়ে তাঁকে মুক্ত করেছে।
শারদীয় দেশ কি আনন্দবাজারে পঞ্চাশের শেষে কি ষাটের প্রথমে যখন তাঁর গল্প খুঁজে নিয়ে পড়তাম, তখন 'জাগরী'র কথা মনেও পড়ত না। তাঁর গল্প-সংগ্রহও পড়া ছিল না কোন; এ-কারণে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রচনাতেই তাঁকে খুঁজতাম আমরা। তাঁর কিঞ্চিৎ পরিহাসমুখর, কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গপ্রবণ, বুদ্ধিদীপ্ত পরিণত রচনা অন্যসকলের চাইতে আলাদা নিঃসন্দেহে নয়, কিন্তু তার-ই মধ্যে খুঁজে নেয়ার মতো।
সতীনাথের জনপ্রিয়তা হরাস পায়নি, প্রায় কখনই, অন্তত তাঁর কালে নয়। উনিশশো তেরানব্বুইয়ে 'জাগরী'র বিংশতম সংস্করণ-ই তার সাক্ষ্য দেয়। 'শ্রেষ্ঠ গল্প'-এরও পঞ্চম মুদ্রণ বাজারে আসে প্রথম প্রকাশের দশ বছরের মধ্যেই। তবুও যে সতীনাথ-এ আমাদের 'পুনরাগ্রহ' জন্মেছে, এ-কথা আমরা বলি এই বিশ্বাসে যে সম্ভবত তাঁর রচনাবলীর মূলত রাজনৈতিক বিবেচনা তাঁর সাহিত্যকীর্তির মূল সুরটি আমাদের কাছে স্পষ্ট করেনি। তাঁর শেষ জীবনের রচনা তারই সাক্ষ্য দেয়। 'শ্রেষ্ঠ গল্প'-এর কুড়িটি গল্পই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সব-ক'টি গল্পই পড়ার, এবং প্রয়োজন বাকি চারটি উপন্যাসও।
'জাগরী' ও 'ঢোঁড়াই চরিত মানস', পাঠক জানেন, বঙ্গদেশে তৎকালে প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে স্পষ্ট পরিচয়ে চিহ্নিত। রাজনৈতিক কারণে কারাগার বাসকালে রচিত জাগরী কারাকক্ষে বাসের-ই অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। রাজনৈতিক জাগৃতির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের সংঘাত যে 'তরঙ্গ বিক্ষোভ' সৃষ্টি করে এবং সেটি যে পারিবারিক ভিত্তিকেও আঘাত করে, সতীনাথ সর্বপ্রথমেই পাঠককে তা জানিয়ে দেন, এবং গ্রন্থটি উৎসর্গও করেন 'যে সকল অখ্যাতনামা রাজনৈতিক কর্মীর কর্মনিষ্ঠা ও স্বার্থত্যাগের বিবরণ জাতীয় ইতিহাসে কোনদিন-ই লিখিত হইবে না, তাহাদের স্মৃতির উদ্দেশে।' 'ঢোঁড়াই চরিত মানস' বিহারের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাৎমাদের জীবনের অস্তিত্বের সংগ্রাম। ঢোঁড়াই চরিত্রটিকে তিনি নির্মাণ করেছেন এক-ই সঙ্গে যন্ত্রণা, বঞ্চনা ও সংগ্রামের মানবিক প্রতিনিধি হিসেবে। 'জাগরী' যদি রাজনীতি-আক্রান্ত তৎকালীন মধ্যবিত্ত জীবনের আখ্যান হয়, 'ঢোঁড়াই' প্রান্তিক জীবনের। 'জাগরী' যদি গান্ধীবাদ ও আগস্ট আন্দোলনের সহাবস্থানের ইঙ্গিত দিয়ে থাকে তো 'ঢোঁড়াই' ঐ আগস্ট আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে টংক বিদ্রোহ-জাতীয় কোন অভ্যুত্থানের আগাম দলিল হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
সতীনাথের অবিস্মরণীয় এই দু'টি উপন্যাসের মধ্যে আরো কিছু যোগাযোগ আছে। জাগরী-র প্রকাশকাল ১৯৪৫, যদিও রচনাকাল, বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, তারও আগের। ঢোঁড়াই-এর প্রকাশকাল ১৯৫১-১৯৫৩। সতীনাথ ভারতীয় কংগ্রেস দল থেকে বেরিয়ে আসেন '৪৮-এর প্রথম দিকেই। যোগ দেন কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টিতে একই সময়ে। ভারতীয় কংগ্রেসের সংগ্রাম ও আদর্শ যদি মূর্ত হয় 'জাগরী'-তে, তো ভারতীয় বাম-রাজনীতির আসন্ন দিনের সমস্ত ইঙ্গিতও রয়েছে 'ঢোঁড়াই'-এ।
'জাগরী' ও 'ঢোঁড়াই চরিত মানস'-এর উপর্যুক্ত উল্লেখ এইজন্যে যে, বাঙালি পাঠক সতীনাথ ভাদুড়ীকে জানেন মূলত তাঁর এই উপন্যাস-দুটির সুবাদেই। আরও চারটি উপন্যাস ও সাতটি গল্পগ্রন্থের কথা মনে পড়ে না কারো। যদিও অনেকে বলেন, সতীনাথ ভাদুড়ী তাঁর সাতটি গল্পগ্রন্থের বাষট্টিটি গল্পের জন্যেও সম্ভবত অধিকতর স্মরণীয় হতে পারতেন। হননি যে, তার প্রধান কারণ, আমার অনুমান, বাঙালি পাঠকের সুশীল সমাজের সমকালীন রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ এবং পঞ্চাশ-ষাটের যুগে (চাই কি সত্তরেও), বিশ্বরাজনীতিতে বামাদর্শ সমাদৃত হলে, ভারতীয় বুদ্ধিজীবী, বিশেষত বাঙালি বুদ্ধিজীবী, সমপ্রদায় বামাদর্শে দীক্ষিত রচনাবলীকেই মানুষের জীবনে প্রয়োজনীয় ও শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করতে থাকেন। ভারতীয় স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে রচিত 'জাগরী' তাই সতীনাথের অন্য সব রচনার গুণাবলীকেই মস্নান করে দেয়।
সতীনাথের প্রথম রচনা প্রকাশিত হয় ১৯৩২-এ 'বিচিত্রা'য়, এমন উল্লেখ আছে। অর্থাৎ তাঁর ছাবি্বশ বছর বয়সে। 'জাগরী'-র প্রকাশকাল ১৯৪৫, প্রথম রচনা প্রকাশের প্রায় বার-তের বছর পরে। 'ঢোঁড়াই'-এর প্রকাশকাল ১৯৪৮। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ 'গণনায়ক'-এর প্রথম গল্পটির প্রকাশকালও ঐ। চলি্লশোর্ধ তিনি তখন। সক্রিয় রাজনীতিকের জীবনও প্রায় শেষ। স্পষ্টতই তাঁর সব গল্প-ই রচিত তাঁর অরাজনৈতিক জীবনে। এ-কারণেই সম্ভবত রাজনৈতিক উপন্যাসের জন্যে যে অসাধারণ জনপ্রিয়তা তিনি লাভ করেছিলেন, গল্পের জন্য সেই পরিমাণ নয়। বিদ্বজ্জন এমন বলেন যে, 'সতীনাথ ভাদুড়ী বাংলা উপন্যাসে সৃষ্টির ধ্যানে, বোধে, শিল্পিত সাধনায়, এবং নিজেকে সাহিত্য সাধনায় প্রস্তুত করবার জন্য যেভাবে পঠনপাঠনে নিমগ্ন হয়েছিলেন, তার কোন তুলনা নেই। উপন্যাসের নতুন প্রকরণ নির্মাণ করেছেন তিনি। প্রচলিত ধারা থেকে সরে এসে অসাধারণ দু'টি উপন্যাসে যে-জীবনকে উপজীব্য করেছেন, বাংলা সাহিত্যে তা বিশিষ্ট হয়ে আছে।'
সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্প সম্পর্কে এমন কথা খুব বেশি শোনা যায় না। গল্প সংখ্যা যথেষ্ট নয় এজন্যে পাঠক তাঁর গল্পের কথা জানে না, নাকি সমালোচক তার গল্পের দিকে নজর দেন না এমন কথা তোলা যায়-ই, তবে সেটি শক্ত ভিতে বসানো নয়; উপন্যাস সংখ্যাও তাঁর সাতটি-ই, 'ঢোঁড়াই চরিত মানস'-এর দু'টি চরণকে দু'টি গ্রন্থ হিসেবে ধরলেও।
দুই
আবারও উল্লেখ করা যাক, সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্প-সংখ্যা বাষট্টিটি; সাতটি গল্পগ্রন্থে সংগৃহীত। প্রথম গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্পটি আর তাঁর নিজ বিচারে শ্রেষ্ঠ উপন্যাস 'ঢোঁড়াই চরিত মানস'-এর রচনাকাল এক। একটু ভেবে নিয়ে বলা যায়, তাঁর সব গল্পই, নিঃসন্দেহে তার মধ্যে 'শ্রেষ্ঠ' গল্পও অনেকই, তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস রচনার পরবর্তী কালের। আরও একটু ভেবে নিয়ে বলা যায়, যেহেতু তাঁর গল্পসমূহ শ্রেষ্ঠ উপন্যাসদ্বয় রচনার পরের, এ-কারণেই তাঁর গল্পসমূহ উচ্চতর বলে বিবেচিত হয় না। আর একটি কথাও বলা যায়। 'জাগরী' উপন্যাসের জন্যে যখন তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন, তখন তিনি প্যারিসে। ইউরোপ ভ্রমণরত। স্পষ্টতই তাঁর অধিকাংশ গল্পই বিদেশবাস পরবর্তী। এমনকি ভাবাই যায় না যে, বিদেশী সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি, মানুষ, তাঁর চিন্তায় কিছু প্রভাব ফেলে থাকবেই, এবং সেটিই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গল্পে? তাই কি কংগ্রেস ও বামাদর্শ এই দুই ধারা থেকেই সরে যাওয়া লেখক পঞ্চাশ-ষাটের বাম-রাজনীতিবিশ্বাসী সমালোচকবর্গের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন? দেখা যায়, ঐ-কালে প্রকাশিত গল্পসমূহের অধিকাংশই প্রকাশিত হয় 'দেশ', 'আনন্দবাজার'-এর মতো অভিজাত পত্র-পত্রিকায়। দু'টি মাত্র গল্প প্রকাশিত হয়েছিল 'পরিচয়'-এ, যা স্পষ্ট বামধারার সাহিত্যপত্র। 'চতুরঙ্গ'-এ প্রকাশিত হয়েছিল একটি গল্প, ১৯৫৫-এ। আমাদের কৈশোরকালেই প্রায়।
সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্প পড়েছি আমার মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবার পরে, ষাটের শুরুতে। পঞ্চাশের মধ্যপাদে 'জাগরী' ও 'ঢোঁড়াই'-এর বাধ্যতামূলক পাঠ তখন স্মৃতি। 'নতুন সাহিত্য', 'বিংশ শতাব্দী', 'দেশ' প্রভৃতি অত্যাধুনিক কালের সাহিত্যপত্র আমাদের মতো তরুণ পাঠককে যে সাহিত্যধারার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, সেখানে 'জাগরী' কি 'ঢোঁড়াই'-এর খুব বড় জায়গা ছিলও না। তবু সতীনাথের গল্প যে পড়েছি তা ঐ 'দেশ' কি 'আনন্দবাজার'-এর জন্যেই। ঐ সময়ে 'উল্টোরথ', 'সিনেমা জগৎ' নামে দু'টি বিনোদন পত্রিকা প্রকাশিত হতো। বিশেষত উল্টোরথ শারদীয় সংখ্যায় সে-সময়ের সব বড় লেখকের রচনাই প্রকাশিত হতো। বুদ্ধদেব বসুর 'বিপন্ন বিস্ময়' নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল উল্টোরথ-এ (পঞ্চাশের শেষে? ষাটের প্রথমে?) যেটি পড়ে মনে হয়েছিল আধুনিক বাংলা উপন্যাসের জগৎ উন্মোচিত হচ্ছে। 'সমকাল'-এ সৈয়দ সামসুল হক-এর 'কোথাও আলো নেই' গল্পটি পড়ে যেমন আধুনিক বাংলা গল্পের জগতে প্রবেশ করার কথা মনে হয়েছিল। কাম্যু, কাফকা, সার্ত্র্, হেমিংওয়ে, ফোকনার, মোরাভিয়া ইত্যাকার লেখকের রচনার সঙ্গে পরিচয়ের জন্যেও সম্ভবত ঐকালে সতীনাথ ভাদুড়ীর রচনা সংগ্রহের দিকে কোন বিশেষ আগ্রহ ছিল না। অনুমান করি, এ কারণেই আমার মতো অনেকেই সতীনাথ-এর প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন না। প্রায় কুড়ি বছর সময় কালে রচিত বাষট্টিটি গল্পই তো! তাঁর শেষ গল্পগ্রন্থ 'সতীনাথ বিচিত্রা' প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর কিছুকাল পরে, ১৯৬৫-তে। তাঁর অন্যান্য গল্পগ্রন্থের পুনর্মুদ্রণের কোন তথ্য আমার জানা নেই। কেবল দেখি যে 'সতীনাথ ভাদুড়ীর শ্রেষ্ঠগল্প' প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮২-তে। এই পনেরো-কুড়ি বছরে সতীনাথ পাঠে কোন উৎসাহের খবর তেমন পাওয়া যায় না। পঞ্চাশের কালে মিত্র ও ঘোষ যেমন বিভিন্ন গল্পকারের 'শ্রেষ্ঠ গল্প' প্রকাশ করে ও পরে 'স্বনির্বাচিত গল্প'-ও, সতীনাথ ঐসব লেখক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। তখনও গল্পকার হিসেবে নন, উপন্যাস রচয়িতা হিসেবেই তিনি পরিচিত। আবার তাঁর উপন্যাসাবলী, 'জাগরী' ও 'ঢোঁড়াই' ব্যতীত, 'চিত্রগুপ্তের ফাইল', 'অচিন রাগিণী', 'সংকট' এবং 'দিগ্ভ্রান্ত' পঞ্চাশ-পরবর্তী পাঠকের পাঠ্য তালিকার শীর্ষে ছিল না। এইরকম নানা সূত্র থেকে পাওয়া নানা তথ্য মেলালে দেখা যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী যে মধ্য-ষাট থেকে প্রায় মধ্য-আশি পর্যন্ত বিস্মৃত ছিলেন (এবং পরবর্তী কুড়ি বছরেও যে আবার সব পাঠকের কাছেই ফিরে এসেছেন এমন নয়) তার একরকম হিসাব পাওয়া যায়ই।
আর একটি বিষয়ও সম্ভবত সতীনাথের রচনার সঙ্গে তাঁর বাঙালি পাঠককুলের সম্পর্ককে কিয়ৎপরিমাণে নিয়ন্ত্রণ করেছে- সেটি তাঁর রচনার ভৌগোলিক জগৎ। উপন্যাস রচনায় তো অবশ্যই, গল্প রচনার কালেও তাঁর গল্পের স্থান মূলত বিহার অঞ্চল। তাঁর বাসও ছিল পূর্ণিয়াতেই। বাঙালি পাঠক, তাঁর রচনার নিষ্ঠাবান পাঠক হলেও, ঐ স্থান ও চরিত্রের জগৎ যে তাঁর নিজের নয় এই কথা সর্বদা ভুলে যেত এমন নাও হতে পারে। তৎকালে বাংলা সাহিত্য তথা প্রকাশনা ইত্যাদির কেন্দ্র কলকাতার বাইরে তাঁর বাসও একরকম আড়াল সৃষ্টি করেছিল নিশ্চয়ই। অনেক লেখকের ক্ষেত্রেই অবশ্য এমন ঘটেছে, এটি এমনকিছু নতুন নয়।
তিন
সতীনাথ ভাদুড়ী ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে পার হয়ে গেল। মানিকের জন্ম-শতবার্ষিকী পালনের কথা একরকম জানা গেছে, সতীনাথের নয়। সম্ভবত পালিত হয়নি বলেই। পশ্চিম বাংলায় বাম ঘরানা ক্ষমতায়, এ-কারণে মানিককে তাঁরা ছুড়ে ফেলে দিতে পারেননি। কিন্তু সতীনাথের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা ছিল কিনা এ কথা জিজ্ঞাসা করলে পশ্চিম বাংলার বামীরা কি বলেছিলেন, বরং কংগ্রেসীদের কাছে যান? আমি জানি না।
বাংলাদেশে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়েছে একাধিক স্থানে। বাংলা একাডেমী তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহদাকার একটি বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করেছে 'উত্তরাধিকার'-এর। সতীনাথ ভাদুড়ীর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তেমন কোন প্রকাশনার কি অনুষ্ঠানের খবর আমি জানি না। কেবল 'কালী ও কলম'-এর ২০০৭ জুন সংখ্যায় মাহমুদ আল জামান একটি রচনায় সতীনাথ ভাদুড়ী এককালে বাংলা সাহিত্য-জগতে যে আশ্চর্য সাড়া জাগিয়েছিলেন এবং সেই তুলনায় পরবর্তী কালে পাঠকেরা তাঁকে মনে রাখেনি বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তাঁর রচনাটিও মূলত 'জাগরী' ও 'ঢোঁড়াই চরিত মানস'-এর আলোচনাই। গল্পের তেমন উল্লেখ নেই। এই কালে অন্য কোথাও তাঁর গল্প কি উপন্যাস নিয়ে এক বা একাধিক আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে কিনা আমি জানি না।
সতীনাথ ভাদুড়ীর আলোচনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখ খুব প্রয়োজনীয় নয়, আবার সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকও হয়তো নয়। সতীনাথ মানিক অপেক্ষা বয়সে মাত্র দু'বছরের বড় হলেও তাঁর সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় মানিকের পরে। তাঁর মৃত্যুও মানিকের পরেই। 'পদ্মা নদীর মাঝি' ও 'পুতুল নাচের ইতিকথা' মানিকের দুই চিরস্মরণীয় উপন্যাস, 'জাগরী' ও 'ঢোঁড়াই রচিত মানস'-ও তেমনি সতীনাথের, যদিও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসদ্বয় সতীনাথের উপন্যাস-দু'টির অনেক পূর্বেই রচিত ও প্রকাশিত। ভাবলে কিঞ্চিৎ বিস্মিতই হতে হয় যে পদ্মানদীপারের সংগ্রামী ধীবরকুলের জীবনগাথা বিহার অঞ্চলের এক মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক পরিবারের অস্তিত্ব, রাজনৈতিক বিশ্বাস ও সংগ্রামী জীবনের কাহিনীর সঙ্গে একত্রে পঠিত হয় না। একত্র উল্লেখও খুব বেশি দেখা যায় না। 'পদ্মা নদীর মাঝি' প্রকাশের প্রায় দশ বছর পরে 'জাগরী' প্রকাশিত হলেও 'জাগরী' যেমন তার রচয়িতাকে মুহূর্তে খ্যাতির শীর্ষে তুলে দিয়েছিল, 'পদ্মা নদীর মাঝি' তেমন দেয়নি তার রচয়িতাকে। যদিও পদ্মা উপন্যাসের ব্যাপ্তি, জীবনবোধ, মানবিক প্রবৃত্তির টানাপোড়েন, জীবনধারণের বাস্তবতা, শিল্পগুণ 'জাগরী' অপেক্ষা শ্রেয়স্তর, সমালোচকেরা এ-কথা বলতে পারেনই। তৎকালে প্রচলিত ও সর্বত্রগৃহীত রাজনৈতিক বিশ্বাস 'জাগরী'তে অতি সহজেই সকলের কাছে স্পষ্ট হয়, পক্ষান্তরে 'পদ্মা নদীর মাঝি'র সুখ-দুঃখ-সংগ্রামের গাথা শিল্পাশ্রয়ে ধীরে রাজনৈতিক বোধে সঞ্চারিত হয়। সম্ভবত এ-কারণেই 'জাগরী' ও 'ঢোঁড়াই চরিত মানস' তার প্রকাশ কালের পনেরো-কুড়ি বছর পরে পাঠকের পাঠ্যতালিকায় সর্বদা স্থান না পেলেও, 'পদ্মা নদীর মাঝি' সর্বদাই এর শীর্ষে থাকে। কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের সঙ্গে পাঠক আরো লক্ষ করেন যে, সতীনাথ যে-কালে চিহ্নিত রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দল ছেড়ে দূরে সরে যাচ্ছেন, মানিক তখন-ই বিশেষ এক রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ছেন।
সতীনাথ ও মানিকের গল্প সম্বন্ধেও দু'একটি মন্তব্য করা এই মুহূর্তে সম্ভবত খুব অসমীচীন হবে না। ঔপন্যাসিক অপেক্ষা গল্পরচয়িতা হিসেবে সতীনাথকে উচ্চাসনে বসালেও মানিকের সঙ্গে এই ক্ষেত্রে তাঁর তুলনা করা যায় না। কেবল যে বাষট্টিটি গল্পের সঙ্গে প্রায় দ্বিশতাধিক গল্পের তুলনা বৃথা তাই নয়, পাঠক নিজেও 'গণনায়ক', 'আণ্টাবাংলা', 'চকাচকি', 'চরণদাস এম.এল.এ.' ইত্যাদি গল্পের কথা স্মরণ করেন না যখন তাঁর 'প্রাগৈতিহাসিক', 'আত্মহত্যার অধিকার', 'সরীসৃপ', 'হারানের নাতজামাই', 'ছোট বকুলপুরের যাত্রী' প্রভৃতি গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। সন্দেহ করাই চলে যে, সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্পের কথা প্রায় কখনোই বাংলা গল্পপাঠকের চিত্তে ধরা থাকে না, যেমন থাকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের কথা, সর্বদা। তাই সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্পের আলোচনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখ যথার্থ নয়।
সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্পের আলোচনা অনেক পাওয়া যায় না, অবশ্য উপন্যাসেরও নয়। তাঁর শেষ গল্পগ্রন্থ 'সতীনাথ বিচিত্রা' প্রকাশের প্রায় সতেরো বছর পরে 'সতীনাথ ভাদুড়ীর শ্রেষ্ঠ গল্প' প্রকাশিত হয়। একত্রে তাঁর বেশ কিছু গল্প সংকলিত না হওয়ায় বিস্তৃত আলোচনাও সম্ভব হয়নি এমন ভাবাই চলে। 'সতীনাথ ভাদুড়ীর শ্রেষ্ঠ গল্প' সংকলনে যে কুড়িটি গল্প স্থান পেয়েছে সে-কটি বাছবার জন্যে সম্পাদক বারিদবরণ ঘোষ অনেক বইপত্র-প্রবন্ধ ইত্যাদি খুঁজে দেখবার সুযোগ পাননি। নির্বাচনে তিনি সতীনাথের বিভিন্ন গল্প সংকলন ছাড়া সতীনাথ গ্রন্থাবলীর সম্পাদকযুগল; গোপাল হালদারের চমৎকার বইখানি ('সতীনাথ ভাদুড়ী ঃ সাহিত্য ও সাধনা', অয়ন, কলকাতা, ১৯৭৮), সুবল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সতীনাথ স্মরণে' এবং অন্যান্য নানা টুকরা রচনার সাহায্য-ই পেয়েছেন কেবল। এ-কারণে গ্রন্থের ভূমিকায় সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্প সম্পর্কে তিনি যা বলেন, তা নিতান্তই সংক্ষিপ্ত। সাহিত্য আকাদেমীর নির্দেশনায় স্বস্তি ম-ল সতীনাথ ভাদুড়ীর জীবন ও কর্মাদি রচনাকালে 'সৃষ্টিধারার অন্য স্রোত ঃ গল্প-ছোটগল্প' বলে যে অংশটুকু যোগ করেন সেটিও আট-দশ পৃষ্ঠার একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনাই।
'শ্রেষ্ঠগল্প' সংকলনে এই গল্প স্থান পেয়েছে : 'গণনায়ক', 'বন্যা', 'আণ্টাবাংলা', 'যড়যন্ত্র মামলার রায়', 'চকাচকি', 'বৈয়াকরণ', 'ডাকাতের বৌ', 'মুনাফা ঠাকরুণ', 'পত্রলেখার বাবা', 'বাহাত্তরে', 'অভিজ্ঞতা', 'চরণদাস এম.এল.এ.', 'দাম্পত্যসীমান্তে', 'অলোকদৃষ্টি', 'জোড়-কলম', 'বয়কমি', 'জামাইবাবু', 'ওয়ার কোয়ালিটি', 'দিগ্ভ্রান্ত' ও 'বমি-কপালিয়া'। এই গল্পসমূহের বাইরে অন্যান্য আরো কিছু গল্পের উল্লেখ স্বস্তি ম-লের রচনায় পাওয়া যায়। উৎসাহী পাঠক সতীনাথ গ্রন্থাবলীতে সবই পাবেন, কিন্তু এই মুহূর্তে আমি কেবল ঐ কুড়িটি গল্পই পড়ে দেখি।
'গণনায়ক' সতীনাথ ভাদুড়ীর প্রথম গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প। সতীনাথের বহু-আলোচিত গল্পগুলির অন্যতম। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ তথা গণনায়কদের চেহারা কী হতে চলেছে, কংগ্রেসী রাজনীতির খেলায় স্বাধীনতাও যে আসলে মুনাফা অর্জনের উপায় হয়ে উঠেছে, সতীনাথ এ-কথাই বলেন তাঁর গল্পের শরীরে। ছোটগল্পের স্বাভাবিক ইঙ্গিতধর্মিতা, তির্যক বিদ্রূপ কি পরিহাসের মিশ্রণে। স্বাধীনতার পরেপরেই কংগ্রেসের ক্ষমতাদখল, উদ্বাস্তু সমস্যা, ব্যবসায়ীদের ধূর্তামি, আমলাতন্ত্র কীভাবে বিস্তৃত হয়ে চলেছে, তাই নিয়ে লিখেছেন গল্প 'বন্যা', 'ষড়যন্ত্র মামলার রায়', 'মুনাফা ঠাকরুণ', 'চরণদাস এম.এল.এ.' 'ওয়ার কোয়ালিটি' প্রভৃতি। 'শ্রেষ্ঠগল্প'-এ অন্তর্ভুক্ত না হলেও দেখি 'পরকীয়া-সন-ইন-ল', 'করদাতা সংঘ জিন্দাবাদ', 'তিলোত্তমা সংস্কৃতি সংঘ', 'অনাবশ্যক', 'মা আম্রফলেষু' প্রভৃতি গল্পেও তিনি কর ফাঁকি দেয়ার কৌশল, নেতৃত্ব লাভের নানা উপায়, দুর্গতদের সাহায্যকল্পে সংগৃহীত চাঁদা আত্মসাৎ, ইত্যাকার প্রক্রিয়ার বর্ণনা করেন। রাজনৈতিক নেতা, সমাজসেবী, কি নীতিবাদী চরিত্রের নানা বিচ্যুতির বর্ণনা করার পাশাপাশি সরকারি আমলাদের অকর্মণ্যতা, সরকারি দপ্তরে নানা বিশৃঙ্খলা বিবাদও তাঁর গল্পের বিষয়।
অপরাজনীতি, অপসরকারিনীতির আখ্যান বর্ণনার পাশাপাশি 'চকাচকি', বৈয়াকরণ', 'অলোকদৃষ্টি', 'জামাইবাবু', 'পত্রলেখার বাবা'-র মতো সাধারণ মানুষের জীবনের গল্পও তিনি লেখেন। প্রেমের গল্প প্রায় কখনই রচনা করেননি তিনি, যদি 'চকাচকি' কি 'অপরিচিতা'কে প্রেমের গল্প হিসেবে চিহ্নিত না-করা যায়।সতীনাথের গল্প সম্পর্কে আলোচকেরা বলেন, 'তাঁর প্রতিটি গল্পে নতুনত্বের সন্ধান, সচেতনতার স্বাক্ষর ছড়িয়ে আছে। বিন্দুর মধ্যে তিনি সিন্ধুর গর্জন শোনাতে চেয়েছেন। খ-ের মধ্যে অখ-ের উদ্ভাস জানানোই তাঁর লক্ষ্য। মানুষ ও সমাজকে তিনি দ্বন্দ্বমুখর ও নিয়ত-পরিবর্তনশীল-রূপে দেখাতে চেয়েছেন। অভিজ্ঞতার আলোকে দেশকালের আধারে বিধৃত চারপাশের চেনা-শোনা সহজ সাধারণ নির্বোধ অশিক্ষিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত চরিত্র নিয়েই তিনি অধিকাংশ গল্প লিখেছেন। এদের আচার-আচরণের মধ্যে থেকেই ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের বহমান স্রোতের রূপরেখা আঁকাই তাঁর উদ্দেশ্য' (স্বস্তি ম-ল)। দাঙ্গা, দেশভাগ, সদ্য-স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারতবর্ষের দ্রুত পরিবর্তিত সামাজিক-রাজনৈতিক-পারিপাশ্বর্িক সমস্যা নিয়েও একাধিক গল্প লিখেছেন সতীনাথ, বলেন তাঁরা।
সতীনাথের গল্পের জগতে স্পষ্টতই কোন আলোড়ন সৃষ্টিকারী সত্য, তথ্য, কি তত্ত্ব্বের সন্ধান পাওয়া যায় না। তাঁর সময়ের কি পরের অন্যান্য গল্পকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জগদীশ গুপ্ত, অমিয়ভূষণ মজুমদার, সন্তোষ কুমার ঘোষ, বিমল কর, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের কথা স্মরণ রেখেই এ কথা বলা চলে। ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই প্রভৃতি দশকে দুই বাংলায় যে গল্প রচনার স্রোত প্রবাহিত হয়েছে, সতীনাথের গল্প সেই স্রোতের পাশাপাশিও চলে না। এইকালে ছোটগল্পের পরিশীলিত, বুদ্ধিদীপ্ত, মনোজাগতিক যে রূপ সমকালীন রাজনীতি ও সমাজকে অবলম্বন করে ভিন্ন গল্পের ভুবন তৈরি করে, সতীনাথ সেখানেও প্রবেশ করেননি। এমনকি ফরাসি সাহিত্য পাঠে উদ্দীপ্ত সতীনাথ তাঁর রচনায় সেই পরিমাণে ফরাসি সাহিত্যের রসও যে সিঞ্চন করেছেন, এ-কথাও বলা যাবে না। তবুও সতীনাথ ভাদুড়ীর জন্মশতবর্ষ পার হয়ে যাবারও পরে কেন তাঁর প্রতি এই পুনরাগ্রহ?
চার
শিক্ষাগ্রহণ, জীবিকার্জন, রাজনীতির পাঠগ্রহণ ও শেষে সমকালীন রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণে কাটে সতীনাথের জীবনের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ। শেষ এক-চতুর্থাংশই বলা যায় সাহিত্যসৃষ্টির কাল তাঁর। 'জাগরী' কি 'ঢোঁড়াই চরিত মানস' তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি নিঃসন্দেহে। কিন্তু সেই বিবেচনাও রাজনৈতিক চিন্তাসঞ্জাত। তাঁর প্রকৃত সাহিত্যসৃষ্টি গল্প, যা রাজনীতির বাইরে নিয়ে গিয়ে তাঁকে মুক্ত করেছে।
শারদীয় দেশ কি আনন্দবাজারে পঞ্চাশের শেষে কি ষাটের প্রথমে যখন তাঁর গল্প খুঁজে নিয়ে পড়তাম, তখন 'জাগরী'র কথা মনেও পড়ত না। তাঁর গল্প-সংগ্রহও পড়া ছিল না কোন; এ-কারণে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রচনাতেই তাঁকে খুঁজতাম আমরা। তাঁর কিঞ্চিৎ পরিহাসমুখর, কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গপ্রবণ, বুদ্ধিদীপ্ত পরিণত রচনা অন্যসকলের চাইতে আলাদা নিঃসন্দেহে নয়, কিন্তু তার-ই মধ্যে খুঁজে নেয়ার মতো।
সতীনাথের জনপ্রিয়তা হরাস পায়নি, প্রায় কখনই, অন্তত তাঁর কালে নয়। উনিশশো তেরানব্বুইয়ে 'জাগরী'র বিংশতম সংস্করণ-ই তার সাক্ষ্য দেয়। 'শ্রেষ্ঠ গল্প'-এরও পঞ্চম মুদ্রণ বাজারে আসে প্রথম প্রকাশের দশ বছরের মধ্যেই। তবুও যে সতীনাথ-এ আমাদের 'পুনরাগ্রহ' জন্মেছে, এ-কথা আমরা বলি এই বিশ্বাসে যে সম্ভবত তাঁর রচনাবলীর মূলত রাজনৈতিক বিবেচনা তাঁর সাহিত্যকীর্তির মূল সুরটি আমাদের কাছে স্পষ্ট করেনি। তাঁর শেষ জীবনের রচনা তারই সাক্ষ্য দেয়। 'শ্রেষ্ঠ গল্প'-এর কুড়িটি গল্পই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সব-ক'টি গল্পই পড়ার, এবং প্রয়োজন বাকি চারটি উপন্যাসও।
0 মন্তব্যসমূহ