বিদায় নবারুণ ভট্টাচার্য
গৌতম গুহ রায়
বাংলা সাহিত্যের বিকল্প গদ্য আখ্যানের অনন্য স্থপতি বিদায় নিলেন, চলে গেলেন নবারুণ ভট্টাচার্য। এক আধুনিক সৃষ্টিশীল লেখক ও কবি, যিনি মেইন স্ট্রিম ধারার একদম বিপরীত বিন্দু থেকে ক্রমাগত বিস্ফোরক নির্মাণ করে গেছেন গতানুগতিক শ্লথতার বিরুদ্ধে।
তার সহযাত্রীদের প্রতি আমন্ত্রণ ছিলো_
'আগ্নেয়গিরির মুখে/ একটা টেবিল বসানো আছে/ সেখানে আজ আমার/ চা খাওয়ার নেমন্তন্ন।/ হে লেখক, প্রবল পরাক্রান্ত কলমজীবী/আপনি যাবেন?' সেই নবারুণ ভট্টাচার্য নিজেই আজ চলে গেলেন, যাওয়ার আগে ভাষা উপত্যকায় কিছুটা লাভা উদগীরণ করে গেলেন। 'ফ্যাতাড়ু'র স্রষ্টা 'হারবার্ট'-এর জনক এক স্বতন্ত্র উচ্চতা থেকে তার আখ্যান বিন্যাসের মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করালেন ভিন্ন ভাষিক ও আঙ্গিক নির্মাণকে। সাম্যবাদে বিশ্বাসী কবি নিজেকে পরিচয় দিতেন মানবতাবাদী হিসেবে, স্বভূমির প্রতি তীব্র ভালোবাসার যন্ত্রণায় লিখেছিলেন কবিতা 'এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না'। সেই কষ্টকে বহন করেই মাত্র ৬৬ বছর বয়সে চলে গেলেন। কর্কট রোগ তাঁকে শয্যাশায়ী করেছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। তবুও, তাঁর সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি জগতের দৈনন্দিন সম্পর্কে ভাটা পড়েনি। অসুস্থ অবস্থাতেও তারুণ্যের সঙ্গে যুক্ত রেখেছিলেন তিনি নিজেকে।
প্রান্তিক বাংলার সঙ্গেও একটা নিবিড় আত্মীয়তা ছিল নবারুণ ভট্টাচার্যের। চূড়ান্ত অসুস্থ হওয়ার আগেও টেলিফোন সংলাপে তাঁর আকুতি স্পর্শ করত, 'এদিকে আর ভালো লাগে না রে, আমাকে তোদের ওদিকে থাকতে দিবি?' এই টানে তাই সুযোগ পেলেই চলে আসতেন। গত জানুয়ারিতে যখন তাঁকে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। চরম দুঃখ ও হতাশায় জানিয়েছিলেন, 'ডাক্তার আর অনুমতি দিচ্ছে না রে, একটু সুস্থ হয়ে নি।' না, আর এদিকে আসার আর কোনো সুযোগ পেলেন না নবারুণ দা। ১৯৯৬-এর মাঝামাঝি তাঁর প্রথম জলপাইগুড়ি আসা, 'দ্যোতনা'-র আমন্ত্রণে তাকে ঘিরে সাহিত্যের আড্ডা। সাহিত্য ও রাজনীতি ছিল সেদিনের আলোচ্য। স্পষ্ট করে সেদিন নবারুণ দা বলেছিলেন_ 'কোনো শিল্পী বা লেখক নিজেকে অরাজনৈতিক বললে সে মিথ্যাচার করে এবং একটা পক্ষ সে নেয় চতুরভাবে। রাজনীতির বিরোধিতার নামে আদর্শহীনতা বিস্তারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।'
সেদিন তিনি তার স্বচক্ষে দেখা সোভিয়েত পতন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, রাশিয়ার বিপ্লব পরবর্তীতে যে নতুন প্রজন্ম জন্ম নেয় তাদের মধ্যে আদর্শবাদের স্খলন ও ভোগবাদের বিস্তারই সোভিয়েত পতনের ভিত্তি রচনা করেছিল। যন্ত্রণার সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন, 'যে শতাব্দীর সূচনা হয়েছিল মানবসমাজের মুক্তির বার্তা দিয়ে তার শেষ হলো কোক-পেপসির বাজার দখলের বিজয় কেতন উড়িয়ে। বরাবরই দারুণ আড্ডাবাজ ছিলেন তিনি। চোখে হাইপাওয়ার চশমা, মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি, ঘন ঘন ধূমপানে অভ্যস্ত নবারুণদার স্বাভাবিক বন্ধু ছিল তরুণ থেকে তরুণতর কবি-সাহিত্যিকরা। বাবা 'নবান্ন' স্রষ্টা বিজন ভট্টাচার্য, মা মহাশ্বেতা দেবী, মামা যুবনাশ্ব বা মনিষ ঘটক; স্বাভাবিকভাবেই উভয়দিক থেকেই সাম্যবাদী চেতনায় লালিত হয়েছেন। সত্তরের উদ্দাম সময়ে নকশাল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন 'হাজার চুরাশির মা'-এর সন্তান। তবে কখনও নিজেকে দলদাস করে ফেলেননি, প্রতিবাদে, সৃজনে ছিলেন স্পষ্টবাদী। সুগার আক্রান্ত ছিলেন, ২০০৫-এ তার সেরিব্যাল স্ট্রোক হয়, এরপর থেকে বাউন্ডুলেপনাকে ছেঁটে ফেলে জীবনযাপনে সাবধানী হন। সব সময় তাঁর সঙ্গে ছায়াসঙ্গীর মত থাকতেন জীবনসঙ্গিনী প্রণতি ভট্টাচার্য। আশ্চর্য গভীর, সখ্য ও নির্ভরতা ছিল দু'জনায়। শেষ যেবার এলেন শিলিগুড়িতে, গত ২০১১-তে, সঙ্গে বৌদি, স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল যে শরীর দুর্বল হয়েছে। বক্তব্যে তবুও তীব্র কৌতুক ও রহস্যের মোড়ক ভেঙে ভেঙে এগিয়েছেন দৃঢ় নবারুণ। নবারুণদার স্বপ্নের ফসল ছিল 'ভাষাবন্ধন' কাগজটি। জলপাইগুড়িতে তার পাঠক তৈরির জন্য আমাকে বলেছিলেন। উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষার মধ্যে সেতুবন্ধন ছিল কাগজের লক্ষ্য। আক্ষেপ করতেন যে আমরা আমাদের প্রতিবেশী ভাষার সৃজনসম্পদ সম্পর্কে উদাসীন বলে। 'ভাষাবন্ধন'কে ঘিরে তৈরি হয়েছিল তরুণ লেখকগোষ্ঠী। অসুস্থ নবারুণদাও শেষদিকে যদিও এর হাল ছেড়ে দেন, মাসিক 'ভাষাবন্ধন' ক্রমশ ত্রৈমাসিক হয়ে গেল। মনে পড়ে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর তার সোভিয়েত কনসুলেটের চাকরিটাও চলে যায়। এটা ছিল তার কাছে একটা বড় ধাক্কা। নবারুণ-পুত্র তথাগতর ভাষায় : তখন বাবা খুব ফবঢ়ৎবংংবফ হয়ে পড়েছিল। মতাদর্শের দিক থেকে আঘাত ছাড়াও অর্থনৈতিক দিক থেকেও ধাক্কা এসেছিল।
মা কলেজে পড়াত। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি।... যাই হোক তখন বাবার সামনে একটা কঠিন লড়াই উপস্থিত হয়। লড়াইটা খুব ব্যক্তিগত। এবং সেই লড়াইতে বাবা তার প্রতিপক্ষ ধষড়পড়যড়ষরংস-কে পরাজিত করে।... 'হারবার্ট' সেই সমাজের লেখা। হারবার্ট বাবাকে ধষড়পড়যড়ষরংস কে হারাতে সাহায্য করেছিল। হারবার্ট লেখায় শব্দের ফাঁকে ফাঁকে এই যে গধৎমরহধষরংবফ কান্না, ব্যথা ছিলো। যেটা একদিকে খুব ব্যক্তিগত, আবার অন্যদিকটা বিশ্বায়ন।... হারবার্ট বাবাকে বাঁচিয়েছিল। হারবার্ট হতে দেয়নি।'
নবারুণ ভট্টাচার্যের সাহিত্যের ভাষার প্রসঙ্গে বিতর্ক বারংবার মাথাচাড়া দিয়েছে। মৃত ও সৃজনে রক্ষণশীলতার বপুটি নাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। পুঁজি বিশ্বের বেনিয়া লালিত সাহিত্যকে আঘাত করা ছিলো তার অভিষ্ট, নগর জীবনের ব্যভিচারী লাম্পট্যকে র্যাশনালিজম আর রেনেসাঁর রাংতা ছিঁড়ে এবং মানবতার পলেস্তারা চটিয়ে প্রকাশ্যে এনেছেন তিনি। তাঁর অধিকাংশ গল্প-উপন্যাসের চরিত্ররা হারবার্ট, বোকা, মদনা, সুরপতি সারিক বা মদন, ডিএম, ওদি, পুরন্দরেরা চলতি হাওয়ার পন্থী নয় কেউ, কিন্তু চলতি সময় সম্পর্কে তীব্র সচেতন; সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মুখে ঝামা ঘষে দেবার তৎপরতা তাদের শিরায় শিরায়। নবারুণের ফ্যাতাড়ুদের লক্ষ্য ছিলো এদের পি-ি চটকানো। 'হারবার্ট'-এর বিনু ১৯৬৯-এ আশুতোষ কলেজে জিওলজি নিয়ে পড়তে আসে, সে তার আধখ্যাপা কাকা' 'হারবার্ট'কে বুঝিয়েছিলো_ 'যতদিন হাতেগোনা কয়েকটা লোক লাখ লাখ মানুষকে বোকা বানিয়ে খাটিয়ে মারবে, তাদের ঠকাবে, ততদিন ভূত, তারপর তোমার গিয়ে ঠাকুর-দেবতা-ধর্ম-এই সবই চলবে।' এই বিনু নকশালি আন্দোলনের বলি হয় পুলিশের গুলিতে, এলগিন রোডের একটি দেওয়ালে স্টেল মিল থেকে মাও-সেতুং-এর মুখ আঁকার সময় পুলিশের গুলিতে 'লাংফিন্ড পাঙচার' হয়ে যায় বিনুর। মৃত্যুর মুহূর্তে সে পিজির কেবিনে শুয়ে আবৃত্তি করে সমীর মিত্রর কবিতা_ 'আমি দেখতে পাচ্ছি, / আমার চোখের সামনে, আমার এতকালের দেখা/ পুরনো দুনিয়াটা পাল্টে যাচ্ছে, / ভেঙেচুরে, তছনছ হয়ে, গুঁড়ো গুঁড়ো/ হয়ে ঝরে পড়ছে/ পুরোনো দিনগুলো। / ঝড় আসছে একটা। কিন্তু ঝড় আসেনি। এসেছিল 'পচা, বদ্ধ, অকিঞ্চিৎকর' এক চালপর্ব। ঝড় না এলেও হারবার্ট এক আশ্চর্য বুদ্ধি জাগরণে বিনুর ঘরে সজ্জিত গোপন নিষিদ্ধ কাগজ বই ইস্তাহার চিলছাদের নির্জনতায় পুড়িয়ে এবং কিছুদিন পরে অলৌকিক স্বপ্নের দৌলতে ঝড়জাগানিয়া মন্ত্র পেয়ে যায়_ 'হারবার্ট হদিস পাচ্ছে। এবার তাকে ছাপাতে হবে। বিনুর সময় এসেছিল। এবার তার সময়। সব ল-ভ- করে দিতে হবে। নকড়াছকড়া করে ফাঁৎরাফাঁট করে বিশ্ব সংসারে একটা তা-ব লাগিয়ে দিতে হবে।' এই 'হারবার্ট' ১৯৯৬-তে বঙ্কিম পুরস্কার পায় এবং ১৯৯৭-তে পায় সাহিত্য আকাডেমী পুরস্কার। ২০০৬-এ সুমন মুখোপাধ্যায় একে নিয়ে ফিল্ম তৈরি করেন।
১৯৯৫-তে নবারুণের ফ্যাতাড়ুর আবির্ভাব। ২০০৪-তে এটি ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক ও অন্যান্য নামে বাজারজাত হয়। এই ফ্যাতাড়ুদের অভীষ্ট অন্তর্ঘাতী অভিযান, ছেলে, তঙ্গি ও সংস্কৃতি সচেতন পোয়ারে কিছু বিশিষ্ট ও আমূল সংস্কারমুখী অন্তর্ঘাতী অভিযান। কেন এই অন্তর্ঘাত তা স্রষ্টার ভাগ্যে নিরন্তর যে প্রতিহিংসার আগুন আমাদের মধ্যে কখনো ধিকি ধিকি, কখনো ধুঁক ধুঁক করেই জ্বলেছে, যা কেলিয়ে পড়লেও নিভতে পারে না, তা অনেকটাই চরিতার্থ করার পথ ফ্যাতাড়ুরা আমাদের দেখিয়েছে। ফ্যাতাড়ু কি সে ইঙ্গিত রয়েছে_ 'ইতিহাসে দেখবে কত মহাপুরুষ মানুষকে নতুন করে বানাবার জন্যে কত ফন্দি বাতলেছে। আমার তো মনে হয় অনেক খেঁটেখুটে শেষশেষ এই ফ্যাতাড়ু তৈরি হয়েছে। ফ্যাতাড়ু মদন একজন সঙ্গী জোগাড় করে যার নামের আদ্যাক্ষর হল ডি এবং এস। এই ডিএসকে মদন শেখায় কেমন করে ফ্যাঁৎ ফ্যাঁৎ সাই সাই... ফ্যাঁৎ ফ্যাঁৎ সাই সাই বলে আকাশে ওড়া যায়। একবার ঘুরে আসে নতুন হাওড়াপুলের চূড়ায় যেখানে 'হঠাৎ মেঘ ফুঁড়ে চাঁদমুখ' বেরোয় এবং 'তলায় খোপ খোপ অন্ধকার'। এভাবেই শুরু হয় ভ-ুলের নানা কথা। হয় কথা 'ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক', 'বোম্বাচাক' মানে ক্যাচাল লাগানো। পরের কথা বইমেলার ফ্যাতাড়ু এই সেই পোড়া বইমেলা, যেখানে 'বানচোৎরা আড়ালে আবডালে গাদাগুচ্ছের খাবারের দোকান' বসিয়েছিল। এভাবেই নানা পর্বের পর কবি সম্মেলনে ফ্যাঁতাড়ু। এই পর্বে নবারুণের আর এক সৃষ্টি কবি পুরুন্দর ভাটের সঙ্গে যোগাযোগ হয় মদন ডিএস জুটির। পুরন্দরের আক্ষেপ সে কবি সম্মেলনে ডাক পায় না, অথচ কবি হিসাবে দারুণ ক্ষমতাবান পুরন্দরের কবিতা। এহেন তিন মূর্তির শেষ কীর্তি সাধু সমাগমে ফ্যাতাড়ু কুইজের 'লক' করাকে নিয়ে পুরন্দরের কীর্তি_ 'দু দুখানি নিতম্ব দুরু দুরু কাঁপে। পিঁপিড়া কামড় দিয়া যায় কোন ফাঁকে। লাল আছে, ডোঁয়া আছে, আরো আছে হায়। ঠাকুরের নামে পোদ লক কিয়া যায়''। এভাবেই নবারুণ শ্লেষে ও ব্যঙ্গে তীব্র সন্ত্রাসী, ভাষাকে মিষ্টি মোড়ক ভেঙে পাঠকের জিবে দেন প্রকৃত বাস্তবতার স্বাদ, দৈনন্দিনের উচ্ছল সংলাপ জেগে ওঠে। উদ্ভট কৌতুকের মাধ্যমে সে সমকালে উপনীত হন এক ধরনের মাত্রায়নের বহুস্বরীয় ভাষ্যে। হারবার্ট থেকে ফ্যাতাড়ু বাংলা উপন্যাসের ছকে বাঁধা সংজ্ঞা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নবারুণের পাঠককে আগাপাশতলা এলোমেলো ও বিশৃঙ্খল বয়ানের প্রতিন্যাশ থেকে অজস্র গলিঘুঁজির মধ্যদিয়ে ঠিক পথ বের করে এগিয়ে যাওয়া।
লেখালিখিতে জীবনযাপনের থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে পারতেন না তিনি। স্বগতোক্তির মত তাই লিখেছেন_ 'দু'দুটো কবিতা লিখেছি। আমার অনিয়ন্ত্রিত, অবিন্যস্ত, অসভ্য জীবনেও। এটা কম কথা নয়। রিকেট রোগে আক্রান্ত পায়ে (আমার ছোটবেলায় ছিল, আমি গরিব কমিউনিস্ট পরিবারের ছেলে) এর চেয়ে বেশি দৌড়ানো সম্ভব নয়। এসব নিয়েও ভাবছি। ভাবছি নশ্বরতা ইত্যাদি নিয়ে, তৎসহ ভাবছি এমনকি কিছু তুলকালাম ঘটবে; যেখানে আমি খেতাবের বদলে বুলেট খেতে যাবো। বুলেট মানুষই তৈরি করে। আমার খেতেও আপত্তি নেই। এটা কথা দেওয়া লেখা নয়, লিখে দেওয়া কথা...।'
নবারুণাদার এমন অনেক লিখে দেওয়া কথা আজ গুন গুন করছে, চিৎকার করছে, ফিস ফিস করছে। ভাষার ব্যবহারে নবারুণ ভট্টাচার্য ছিলেন স্বতন্ত্র ও সরাসরি। বক্তব্যেও ছিলেন তেমনি, সরাসরি ও ভনিতামুক্ত। 'মহা প-িতদের ফুঁৎকারে মান্যভাষা না মেনে চলার অপরাধে, কত সাহিত্যকর্মী যে উড়ে গেছে তা গুনে শেষ করা যাবে না। কিন্তু উড়ে যেতে যেতে তারা সকলেই বলেছে 'অনেক ভাটিয়েছেন, এবার ফুটুন'। হাংগ্রিরা থাকলে অবশ্যই বলতেন, যেমন তারা বলেওছিলেন 'এবার তবে মুখের মধ্যে লাগিয়ে নিন লুপ'। বাংলায় মানেটা এই যে ভাষাকে রক্তহীন, অযৌন, প্লাস্টিকগন্ধী ও ঢ্যামনা করে দেওয়ার একটা চেষ্টা আছেই। আমাদের কাজ হল এইসব সচেষ্টদের বাংলামতে ক্যালানো। আগে তেরপল চাপা। তারপর খেটো বাঁশ। (ভাষা : জনৈক সাহিত্য কর্মীর উপলব্ধি : নবারুণ ভট্টাচার্য) নবারুণদা বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগে ভাষাকে সজীব করার কাজকে এভাবেই চাঙ্গা রেখে নতুন প্রজন্মের হাতে ব্যাটন দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তার শেষতম আলোচনার দুটি কথা আজ নবারুণবিহীন সময়ে খুব মনে পড়ছে আমি লেখার ব্যাপারটা যেভাবে বুঝি সেটা নিছক আনন্দ দেওয়া বা নেওয়া নয়। আরও গভীর এক স্যালকেমি যেখানে বিস্ফোরণের ঝুঁকি রয়েছে।
সংযোজন_
১৯৮৩, সময়টা সাম্যবাদী জোটেরও বিপন্নতার সময়। এর পরবর্তী একদশকে কবিতা থেকে প্রবলভাবে চলে আসেন গদ্যে। ১৯৯২-তে 'প্রমা'-র শারদ সংখ্যায় বের হয় 'হারবার্ট' উপন্যাস। চমকিত বাংলা ভাষায় সংবেদনশীল পাঠককুল। এরপর ১৯৯৫-তে 'যুদ্ধপরিস্থিতি', ২০০৪-তে 'খেলনানগর', ২ বছর পর 'লুব্ধক'। ২০০৩-তে কাঙ্গাল মালসাট-এর ২ বছর পরে মসোলিয়াম_ একের পর এক পাঠকের চিরাচরিত পাঠাভ্যাসের ওপর বোমাবর্ষণ ঘটিয়ে অবশেষে যুদ্ধভূমি থেকে বিদায় নিলেন, কিন্তু ততদিনে উজ্জীবনী মন্ত্রে জাগিয়ে তুলেছেন বাংলাভাষার তারুণ্যকে, যারা আজ স্বজন হারানো কষ্টে মূক।
উল্লেখযোগ্র গ্রন্থপঞ্জী :
উপন্যাস
১। হারবার্ট। ১৯৯৩ প্রমা প্রকাশনী।
২। ভোগী 'অটো' ২০০৭ দেশজ প্রকাশনী।
৩। যুদ্ধ পরিস্থিতি ১৯৯৫, 'প্রতিক্ষণ' শারদ সংখ্যা।
৪। খেলনানগর ২০০৪, সপ্তর্ষি প্রকাশন।
৫। লুব্ধক ২০০৬, অভিযান পাবলিশার্স।
৬। কাঙ্গাল মালসাট ২০০৩, সপ্তর্ষি প্রকাশন।
৭। মসোলিয়াম ২০০৬, দেশজ পাবলিশিং।
গল্প সংকলন
১। হালাল আন্ডা, প্রমা প্রকাশনী ১৯৮৭।
২। অন্ধ বেড়াল, সৃষ্টি প্রকাশন ২০০১।
৩। ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক, ২০০১ প্রমা।
৪। ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক ও অন্যান্য ২০০৪, সপ্তর্ষি প্রকাশন।
আরও অনেক গ্রন্থ।
গৌতম গুহ রায়
বাংলা সাহিত্যের বিকল্প গদ্য আখ্যানের অনন্য স্থপতি বিদায় নিলেন, চলে গেলেন নবারুণ ভট্টাচার্য। এক আধুনিক সৃষ্টিশীল লেখক ও কবি, যিনি মেইন স্ট্রিম ধারার একদম বিপরীত বিন্দু থেকে ক্রমাগত বিস্ফোরক নির্মাণ করে গেছেন গতানুগতিক শ্লথতার বিরুদ্ধে।
তার সহযাত্রীদের প্রতি আমন্ত্রণ ছিলো_
'আগ্নেয়গিরির মুখে/ একটা টেবিল বসানো আছে/ সেখানে আজ আমার/ চা খাওয়ার নেমন্তন্ন।/ হে লেখক, প্রবল পরাক্রান্ত কলমজীবী/আপনি যাবেন?' সেই নবারুণ ভট্টাচার্য নিজেই আজ চলে গেলেন, যাওয়ার আগে ভাষা উপত্যকায় কিছুটা লাভা উদগীরণ করে গেলেন। 'ফ্যাতাড়ু'র স্রষ্টা 'হারবার্ট'-এর জনক এক স্বতন্ত্র উচ্চতা থেকে তার আখ্যান বিন্যাসের মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করালেন ভিন্ন ভাষিক ও আঙ্গিক নির্মাণকে। সাম্যবাদে বিশ্বাসী কবি নিজেকে পরিচয় দিতেন মানবতাবাদী হিসেবে, স্বভূমির প্রতি তীব্র ভালোবাসার যন্ত্রণায় লিখেছিলেন কবিতা 'এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না'। সেই কষ্টকে বহন করেই মাত্র ৬৬ বছর বয়সে চলে গেলেন। কর্কট রোগ তাঁকে শয্যাশায়ী করেছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। তবুও, তাঁর সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি জগতের দৈনন্দিন সম্পর্কে ভাটা পড়েনি। অসুস্থ অবস্থাতেও তারুণ্যের সঙ্গে যুক্ত রেখেছিলেন তিনি নিজেকে।
প্রান্তিক বাংলার সঙ্গেও একটা নিবিড় আত্মীয়তা ছিল নবারুণ ভট্টাচার্যের। চূড়ান্ত অসুস্থ হওয়ার আগেও টেলিফোন সংলাপে তাঁর আকুতি স্পর্শ করত, 'এদিকে আর ভালো লাগে না রে, আমাকে তোদের ওদিকে থাকতে দিবি?' এই টানে তাই সুযোগ পেলেই চলে আসতেন। গত জানুয়ারিতে যখন তাঁকে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। চরম দুঃখ ও হতাশায় জানিয়েছিলেন, 'ডাক্তার আর অনুমতি দিচ্ছে না রে, একটু সুস্থ হয়ে নি।' না, আর এদিকে আসার আর কোনো সুযোগ পেলেন না নবারুণ দা। ১৯৯৬-এর মাঝামাঝি তাঁর প্রথম জলপাইগুড়ি আসা, 'দ্যোতনা'-র আমন্ত্রণে তাকে ঘিরে সাহিত্যের আড্ডা। সাহিত্য ও রাজনীতি ছিল সেদিনের আলোচ্য। স্পষ্ট করে সেদিন নবারুণ দা বলেছিলেন_ 'কোনো শিল্পী বা লেখক নিজেকে অরাজনৈতিক বললে সে মিথ্যাচার করে এবং একটা পক্ষ সে নেয় চতুরভাবে। রাজনীতির বিরোধিতার নামে আদর্শহীনতা বিস্তারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।'
সেদিন তিনি তার স্বচক্ষে দেখা সোভিয়েত পতন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, রাশিয়ার বিপ্লব পরবর্তীতে যে নতুন প্রজন্ম জন্ম নেয় তাদের মধ্যে আদর্শবাদের স্খলন ও ভোগবাদের বিস্তারই সোভিয়েত পতনের ভিত্তি রচনা করেছিল। যন্ত্রণার সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন, 'যে শতাব্দীর সূচনা হয়েছিল মানবসমাজের মুক্তির বার্তা দিয়ে তার শেষ হলো কোক-পেপসির বাজার দখলের বিজয় কেতন উড়িয়ে। বরাবরই দারুণ আড্ডাবাজ ছিলেন তিনি। চোখে হাইপাওয়ার চশমা, মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি, ঘন ঘন ধূমপানে অভ্যস্ত নবারুণদার স্বাভাবিক বন্ধু ছিল তরুণ থেকে তরুণতর কবি-সাহিত্যিকরা। বাবা 'নবান্ন' স্রষ্টা বিজন ভট্টাচার্য, মা মহাশ্বেতা দেবী, মামা যুবনাশ্ব বা মনিষ ঘটক; স্বাভাবিকভাবেই উভয়দিক থেকেই সাম্যবাদী চেতনায় লালিত হয়েছেন। সত্তরের উদ্দাম সময়ে নকশাল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন 'হাজার চুরাশির মা'-এর সন্তান। তবে কখনও নিজেকে দলদাস করে ফেলেননি, প্রতিবাদে, সৃজনে ছিলেন স্পষ্টবাদী। সুগার আক্রান্ত ছিলেন, ২০০৫-এ তার সেরিব্যাল স্ট্রোক হয়, এরপর থেকে বাউন্ডুলেপনাকে ছেঁটে ফেলে জীবনযাপনে সাবধানী হন। সব সময় তাঁর সঙ্গে ছায়াসঙ্গীর মত থাকতেন জীবনসঙ্গিনী প্রণতি ভট্টাচার্য। আশ্চর্য গভীর, সখ্য ও নির্ভরতা ছিল দু'জনায়। শেষ যেবার এলেন শিলিগুড়িতে, গত ২০১১-তে, সঙ্গে বৌদি, স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল যে শরীর দুর্বল হয়েছে। বক্তব্যে তবুও তীব্র কৌতুক ও রহস্যের মোড়ক ভেঙে ভেঙে এগিয়েছেন দৃঢ় নবারুণ। নবারুণদার স্বপ্নের ফসল ছিল 'ভাষাবন্ধন' কাগজটি। জলপাইগুড়িতে তার পাঠক তৈরির জন্য আমাকে বলেছিলেন। উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষার মধ্যে সেতুবন্ধন ছিল কাগজের লক্ষ্য। আক্ষেপ করতেন যে আমরা আমাদের প্রতিবেশী ভাষার সৃজনসম্পদ সম্পর্কে উদাসীন বলে। 'ভাষাবন্ধন'কে ঘিরে তৈরি হয়েছিল তরুণ লেখকগোষ্ঠী। অসুস্থ নবারুণদাও শেষদিকে যদিও এর হাল ছেড়ে দেন, মাসিক 'ভাষাবন্ধন' ক্রমশ ত্রৈমাসিক হয়ে গেল। মনে পড়ে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর তার সোভিয়েত কনসুলেটের চাকরিটাও চলে যায়। এটা ছিল তার কাছে একটা বড় ধাক্কা। নবারুণ-পুত্র তথাগতর ভাষায় : তখন বাবা খুব ফবঢ়ৎবংংবফ হয়ে পড়েছিল। মতাদর্শের দিক থেকে আঘাত ছাড়াও অর্থনৈতিক দিক থেকেও ধাক্কা এসেছিল।
মা কলেজে পড়াত। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি।... যাই হোক তখন বাবার সামনে একটা কঠিন লড়াই উপস্থিত হয়। লড়াইটা খুব ব্যক্তিগত। এবং সেই লড়াইতে বাবা তার প্রতিপক্ষ ধষড়পড়যড়ষরংস-কে পরাজিত করে।... 'হারবার্ট' সেই সমাজের লেখা। হারবার্ট বাবাকে ধষড়পড়যড়ষরংস কে হারাতে সাহায্য করেছিল। হারবার্ট লেখায় শব্দের ফাঁকে ফাঁকে এই যে গধৎমরহধষরংবফ কান্না, ব্যথা ছিলো। যেটা একদিকে খুব ব্যক্তিগত, আবার অন্যদিকটা বিশ্বায়ন।... হারবার্ট বাবাকে বাঁচিয়েছিল। হারবার্ট হতে দেয়নি।'
নবারুণ ভট্টাচার্যের সাহিত্যের ভাষার প্রসঙ্গে বিতর্ক বারংবার মাথাচাড়া দিয়েছে। মৃত ও সৃজনে রক্ষণশীলতার বপুটি নাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। পুঁজি বিশ্বের বেনিয়া লালিত সাহিত্যকে আঘাত করা ছিলো তার অভিষ্ট, নগর জীবনের ব্যভিচারী লাম্পট্যকে র্যাশনালিজম আর রেনেসাঁর রাংতা ছিঁড়ে এবং মানবতার পলেস্তারা চটিয়ে প্রকাশ্যে এনেছেন তিনি। তাঁর অধিকাংশ গল্প-উপন্যাসের চরিত্ররা হারবার্ট, বোকা, মদনা, সুরপতি সারিক বা মদন, ডিএম, ওদি, পুরন্দরেরা চলতি হাওয়ার পন্থী নয় কেউ, কিন্তু চলতি সময় সম্পর্কে তীব্র সচেতন; সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মুখে ঝামা ঘষে দেবার তৎপরতা তাদের শিরায় শিরায়। নবারুণের ফ্যাতাড়ুদের লক্ষ্য ছিলো এদের পি-ি চটকানো। 'হারবার্ট'-এর বিনু ১৯৬৯-এ আশুতোষ কলেজে জিওলজি নিয়ে পড়তে আসে, সে তার আধখ্যাপা কাকা' 'হারবার্ট'কে বুঝিয়েছিলো_ 'যতদিন হাতেগোনা কয়েকটা লোক লাখ লাখ মানুষকে বোকা বানিয়ে খাটিয়ে মারবে, তাদের ঠকাবে, ততদিন ভূত, তারপর তোমার গিয়ে ঠাকুর-দেবতা-ধর্ম-এই সবই চলবে।' এই বিনু নকশালি আন্দোলনের বলি হয় পুলিশের গুলিতে, এলগিন রোডের একটি দেওয়ালে স্টেল মিল থেকে মাও-সেতুং-এর মুখ আঁকার সময় পুলিশের গুলিতে 'লাংফিন্ড পাঙচার' হয়ে যায় বিনুর। মৃত্যুর মুহূর্তে সে পিজির কেবিনে শুয়ে আবৃত্তি করে সমীর মিত্রর কবিতা_ 'আমি দেখতে পাচ্ছি, / আমার চোখের সামনে, আমার এতকালের দেখা/ পুরনো দুনিয়াটা পাল্টে যাচ্ছে, / ভেঙেচুরে, তছনছ হয়ে, গুঁড়ো গুঁড়ো/ হয়ে ঝরে পড়ছে/ পুরোনো দিনগুলো। / ঝড় আসছে একটা। কিন্তু ঝড় আসেনি। এসেছিল 'পচা, বদ্ধ, অকিঞ্চিৎকর' এক চালপর্ব। ঝড় না এলেও হারবার্ট এক আশ্চর্য বুদ্ধি জাগরণে বিনুর ঘরে সজ্জিত গোপন নিষিদ্ধ কাগজ বই ইস্তাহার চিলছাদের নির্জনতায় পুড়িয়ে এবং কিছুদিন পরে অলৌকিক স্বপ্নের দৌলতে ঝড়জাগানিয়া মন্ত্র পেয়ে যায়_ 'হারবার্ট হদিস পাচ্ছে। এবার তাকে ছাপাতে হবে। বিনুর সময় এসেছিল। এবার তার সময়। সব ল-ভ- করে দিতে হবে। নকড়াছকড়া করে ফাঁৎরাফাঁট করে বিশ্ব সংসারে একটা তা-ব লাগিয়ে দিতে হবে।' এই 'হারবার্ট' ১৯৯৬-তে বঙ্কিম পুরস্কার পায় এবং ১৯৯৭-তে পায় সাহিত্য আকাডেমী পুরস্কার। ২০০৬-এ সুমন মুখোপাধ্যায় একে নিয়ে ফিল্ম তৈরি করেন।
১৯৯৫-তে নবারুণের ফ্যাতাড়ুর আবির্ভাব। ২০০৪-তে এটি ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক ও অন্যান্য নামে বাজারজাত হয়। এই ফ্যাতাড়ুদের অভীষ্ট অন্তর্ঘাতী অভিযান, ছেলে, তঙ্গি ও সংস্কৃতি সচেতন পোয়ারে কিছু বিশিষ্ট ও আমূল সংস্কারমুখী অন্তর্ঘাতী অভিযান। কেন এই অন্তর্ঘাত তা স্রষ্টার ভাগ্যে নিরন্তর যে প্রতিহিংসার আগুন আমাদের মধ্যে কখনো ধিকি ধিকি, কখনো ধুঁক ধুঁক করেই জ্বলেছে, যা কেলিয়ে পড়লেও নিভতে পারে না, তা অনেকটাই চরিতার্থ করার পথ ফ্যাতাড়ুরা আমাদের দেখিয়েছে। ফ্যাতাড়ু কি সে ইঙ্গিত রয়েছে_ 'ইতিহাসে দেখবে কত মহাপুরুষ মানুষকে নতুন করে বানাবার জন্যে কত ফন্দি বাতলেছে। আমার তো মনে হয় অনেক খেঁটেখুটে শেষশেষ এই ফ্যাতাড়ু তৈরি হয়েছে। ফ্যাতাড়ু মদন একজন সঙ্গী জোগাড় করে যার নামের আদ্যাক্ষর হল ডি এবং এস। এই ডিএসকে মদন শেখায় কেমন করে ফ্যাঁৎ ফ্যাঁৎ সাই সাই... ফ্যাঁৎ ফ্যাঁৎ সাই সাই বলে আকাশে ওড়া যায়। একবার ঘুরে আসে নতুন হাওড়াপুলের চূড়ায় যেখানে 'হঠাৎ মেঘ ফুঁড়ে চাঁদমুখ' বেরোয় এবং 'তলায় খোপ খোপ অন্ধকার'। এভাবেই শুরু হয় ভ-ুলের নানা কথা। হয় কথা 'ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক', 'বোম্বাচাক' মানে ক্যাচাল লাগানো। পরের কথা বইমেলার ফ্যাতাড়ু এই সেই পোড়া বইমেলা, যেখানে 'বানচোৎরা আড়ালে আবডালে গাদাগুচ্ছের খাবারের দোকান' বসিয়েছিল। এভাবেই নানা পর্বের পর কবি সম্মেলনে ফ্যাঁতাড়ু। এই পর্বে নবারুণের আর এক সৃষ্টি কবি পুরুন্দর ভাটের সঙ্গে যোগাযোগ হয় মদন ডিএস জুটির। পুরন্দরের আক্ষেপ সে কবি সম্মেলনে ডাক পায় না, অথচ কবি হিসাবে দারুণ ক্ষমতাবান পুরন্দরের কবিতা। এহেন তিন মূর্তির শেষ কীর্তি সাধু সমাগমে ফ্যাতাড়ু কুইজের 'লক' করাকে নিয়ে পুরন্দরের কীর্তি_ 'দু দুখানি নিতম্ব দুরু দুরু কাঁপে। পিঁপিড়া কামড় দিয়া যায় কোন ফাঁকে। লাল আছে, ডোঁয়া আছে, আরো আছে হায়। ঠাকুরের নামে পোদ লক কিয়া যায়''। এভাবেই নবারুণ শ্লেষে ও ব্যঙ্গে তীব্র সন্ত্রাসী, ভাষাকে মিষ্টি মোড়ক ভেঙে পাঠকের জিবে দেন প্রকৃত বাস্তবতার স্বাদ, দৈনন্দিনের উচ্ছল সংলাপ জেগে ওঠে। উদ্ভট কৌতুকের মাধ্যমে সে সমকালে উপনীত হন এক ধরনের মাত্রায়নের বহুস্বরীয় ভাষ্যে। হারবার্ট থেকে ফ্যাতাড়ু বাংলা উপন্যাসের ছকে বাঁধা সংজ্ঞা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নবারুণের পাঠককে আগাপাশতলা এলোমেলো ও বিশৃঙ্খল বয়ানের প্রতিন্যাশ থেকে অজস্র গলিঘুঁজির মধ্যদিয়ে ঠিক পথ বের করে এগিয়ে যাওয়া।
লেখালিখিতে জীবনযাপনের থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে পারতেন না তিনি। স্বগতোক্তির মত তাই লিখেছেন_ 'দু'দুটো কবিতা লিখেছি। আমার অনিয়ন্ত্রিত, অবিন্যস্ত, অসভ্য জীবনেও। এটা কম কথা নয়। রিকেট রোগে আক্রান্ত পায়ে (আমার ছোটবেলায় ছিল, আমি গরিব কমিউনিস্ট পরিবারের ছেলে) এর চেয়ে বেশি দৌড়ানো সম্ভব নয়। এসব নিয়েও ভাবছি। ভাবছি নশ্বরতা ইত্যাদি নিয়ে, তৎসহ ভাবছি এমনকি কিছু তুলকালাম ঘটবে; যেখানে আমি খেতাবের বদলে বুলেট খেতে যাবো। বুলেট মানুষই তৈরি করে। আমার খেতেও আপত্তি নেই। এটা কথা দেওয়া লেখা নয়, লিখে দেওয়া কথা...।'
নবারুণাদার এমন অনেক লিখে দেওয়া কথা আজ গুন গুন করছে, চিৎকার করছে, ফিস ফিস করছে। ভাষার ব্যবহারে নবারুণ ভট্টাচার্য ছিলেন স্বতন্ত্র ও সরাসরি। বক্তব্যেও ছিলেন তেমনি, সরাসরি ও ভনিতামুক্ত। 'মহা প-িতদের ফুঁৎকারে মান্যভাষা না মেনে চলার অপরাধে, কত সাহিত্যকর্মী যে উড়ে গেছে তা গুনে শেষ করা যাবে না। কিন্তু উড়ে যেতে যেতে তারা সকলেই বলেছে 'অনেক ভাটিয়েছেন, এবার ফুটুন'। হাংগ্রিরা থাকলে অবশ্যই বলতেন, যেমন তারা বলেওছিলেন 'এবার তবে মুখের মধ্যে লাগিয়ে নিন লুপ'। বাংলায় মানেটা এই যে ভাষাকে রক্তহীন, অযৌন, প্লাস্টিকগন্ধী ও ঢ্যামনা করে দেওয়ার একটা চেষ্টা আছেই। আমাদের কাজ হল এইসব সচেষ্টদের বাংলামতে ক্যালানো। আগে তেরপল চাপা। তারপর খেটো বাঁশ। (ভাষা : জনৈক সাহিত্য কর্মীর উপলব্ধি : নবারুণ ভট্টাচার্য) নবারুণদা বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগে ভাষাকে সজীব করার কাজকে এভাবেই চাঙ্গা রেখে নতুন প্রজন্মের হাতে ব্যাটন দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তার শেষতম আলোচনার দুটি কথা আজ নবারুণবিহীন সময়ে খুব মনে পড়ছে আমি লেখার ব্যাপারটা যেভাবে বুঝি সেটা নিছক আনন্দ দেওয়া বা নেওয়া নয়। আরও গভীর এক স্যালকেমি যেখানে বিস্ফোরণের ঝুঁকি রয়েছে।
সংযোজন_
১৯৮৩, সময়টা সাম্যবাদী জোটেরও বিপন্নতার সময়। এর পরবর্তী একদশকে কবিতা থেকে প্রবলভাবে চলে আসেন গদ্যে। ১৯৯২-তে 'প্রমা'-র শারদ সংখ্যায় বের হয় 'হারবার্ট' উপন্যাস। চমকিত বাংলা ভাষায় সংবেদনশীল পাঠককুল। এরপর ১৯৯৫-তে 'যুদ্ধপরিস্থিতি', ২০০৪-তে 'খেলনানগর', ২ বছর পর 'লুব্ধক'। ২০০৩-তে কাঙ্গাল মালসাট-এর ২ বছর পরে মসোলিয়াম_ একের পর এক পাঠকের চিরাচরিত পাঠাভ্যাসের ওপর বোমাবর্ষণ ঘটিয়ে অবশেষে যুদ্ধভূমি থেকে বিদায় নিলেন, কিন্তু ততদিনে উজ্জীবনী মন্ত্রে জাগিয়ে তুলেছেন বাংলাভাষার তারুণ্যকে, যারা আজ স্বজন হারানো কষ্টে মূক।
উল্লেখযোগ্র গ্রন্থপঞ্জী :
উপন্যাস
১। হারবার্ট। ১৯৯৩ প্রমা প্রকাশনী।
২। ভোগী 'অটো' ২০০৭ দেশজ প্রকাশনী।
৩। যুদ্ধ পরিস্থিতি ১৯৯৫, 'প্রতিক্ষণ' শারদ সংখ্যা।
৪। খেলনানগর ২০০৪, সপ্তর্ষি প্রকাশন।
৫। লুব্ধক ২০০৬, অভিযান পাবলিশার্স।
৬। কাঙ্গাল মালসাট ২০০৩, সপ্তর্ষি প্রকাশন।
৭। মসোলিয়াম ২০০৬, দেশজ পাবলিশিং।
গল্প সংকলন
১। হালাল আন্ডা, প্রমা প্রকাশনী ১৯৮৭।
২। অন্ধ বেড়াল, সৃষ্টি প্রকাশন ২০০১।
৩। ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক, ২০০১ প্রমা।
৪। ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক ও অন্যান্য ২০০৪, সপ্তর্ষি প্রকাশন।
আরও অনেক গ্রন্থ।
0 মন্তব্যসমূহ