আইএসসি পাস করার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় চলে আসেন কলকাতায়। গণিতে অর্নাস নিয়ে তিনি বিএসসিতে ভর্তি হয় কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেই কলেজ-জীবনেই বিরাট এক কণ্ড ঘটে যায়। বয়স তখন কতই বা, বড়োজোর কুড়ি। কোনো একদিন মানিক তার সহপাঠীদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল কলেজের ক্যান্টিনে বসে। এসময় এক বন্ধুর সাথে বাজি ধরে— তার গল্প সে ছাপাবে তখনকার সময়ের শ্রেষ্ঠ পত্রিকা ‘বিচিত্রিা’য়। সেসময় বিচিত্রা ছিল অত্যন্ত বিখ্যাত পত্রিকা। আর তাকে কেবল নামকরা লেখকেরাই লিখে থাকেন। মানিকের এমন প্রায় অসম্ভব বিষয়ের ওপর বাজি ধরাতে স্বাভাবিকভাবেই হাসাহাসি করেছিল বন্ধুরা। কিন্তু জেদি ও ব্যক্তিত্বপরায়ণ মানিক হারবার পাত্র নয়।
লিখে ফেলে প্রথম গল্প ‘অতসীমামী’। গল্পের নিচে লেখকের নাম হিসেবে স্বাক্ষর করেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তা পাঠিয়ে দেয় বিচিত্রা’র সম্পাদক বরাবর। নিজের ভালো নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ছেড়ে ডাকনামেই ছাপতে দেয় সেই গল্প। লেখা পাঠনোর প্রায় ৪ মাস পর ১৩৩৫ সনের পৌষ সংখ্যায় (ডিসেম্বর ১৯২৮) ছাপা হয় মানিকের সেই গল্প। প্রকাশের সাথে সাথেই গল্পটি সাড়া ফেলে পাঠক মহলে। সেই থেকে সাহিত্য জগতে প্রবেশ ঘটে মানিকের। এরপর থেকে নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠাতে থাকেন মানিক। সেই সাথে প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় নামটি চাপা পড়ে যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামের তলে।
ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন, যা মানিককে এতটা জেদি করে তুলেছিল? ঘটনাটি না-হয় একটু খতিয়ে দেখা যাক। ক্লাসের বন্ধুদের সাথে আড্ডার এক ফাঁকে এক সহপাঠী বলে উঠলেন, নামকরা লেখক বা দলের লেখক না হলে পত্রিকাওয়ালা লেখা ছাপায় না। আরেক সহপাঠীর লেখা গল্প বিভিন্ন কাগজ থেকে ফেরৎ এসেছে অমনোনীত হয়ে। এসময় সেই সহপাঠী গালিগালাজ করতে লাগলেন সম্পাদকদের উদ্দেশ্য করে। তখন মানিক বললেন, এমনটা বাজে বকছো কেন? নামকরা লেখক বা দলের লেখক না হলে লেখা ছাপা হয় না, এটা হতে পারে না। ভালো লেখা হলে কেন ছাপবে না, অবশ্যই ছাপবে। সহপাঠীর উত্তর, ‘আমারটা ছাপেনি তো।’ মানিকের পাল্টা জবাব, ‘তোমারটা ভালো হলে নিশ্চয়ই ছাপা হতো।’ এবার খেপে উঠলেন সহপাঠী। বললেন, ক্ষমতা থেকে তো একটা গল্প লিখে ছাপিয়ে দেখাও দেখি।’ মানিকেরও জেদ চেপে যায়। বললেন, ‘ঠিক আছে, তাই হবে। আমি গল্প লিখবো, এবং সেটি বিখ্যাত কোনো পত্রিকায় ছাপিয়ে প্রমাণ করবো তোমাদের ধারণা ভুল।’ সহপাঠীর চ্যালেঞ্জ, ‘তাহলে বাজি ধরো।’ মানিকের উত্তর, ‘বাজি।’ এই বাজিকে মাথায় রেখে মানিক লিখলেন গল্প ‘অতসীমামী’। আর তা লিখতে তিন মাস লাগেনি তার, তিন দিন লেগেছে মাত্র। জমা দিয়ে এলেন বিচিত্রা পত্রিকায়। সেই গল্প পড়ে পত্রিকার সম্পাদকের এতটাই ভালো লেগেগিয়েছিল যে, নিজেই চলে এলেন মানিকে কাছে। নগদ কুড়ি টাকা মানিকের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, আরো একটা গল্প চাই।
অনেকের কাছে প্রশ্ন, মাত্র ২০ বছর বয়সে বন্ধুর সাথে বাজি ধরে গল্প লেখা, বিচিত্রার মতো পত্রিকায় সেই গল্প প্রকাশ ইত্যাদি সমস্তই কি আকস্মিক বিষয়? হঠাৎ বাজিমাত করা ব্যাপার?— নাকি অনেক আগে থেকেই নিজেকে সাহিত্যিক হিসেবে প্রস্তুত করছিলেন মানিক। মাত্র ২০ বছর বয়সে একজন মানুষের জীবনে কী-ই বা এমন জীবনের অভিজ্ঞতা কিংবা উপলব্ধি থাকতে পারে? এ বিষয়ে মানিকের কথা হলো, “সাহিত্য জীবন আরম্ভ করার একটা গল্প আমি এখানে ওখানে বলেছি। ছাত্রজীবনে বিজ্ঞান শিখতে শিখতে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে ‘অতসীমামী’ গল্পটি লিখে বিচিত্রায় ছাপানো এবং হঠাৎ এভাবে সাহিত্য জীবন শুরু করে দেবার গল্প। কিন্তু একটা প্রশ্ন দাঁড়ায় এই: কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়াই কি একজন লেখকের সাহিত্য জীবন শুরু হয়ে যেতে পারে? আমি বলব, না, এ রকম হঠাৎ কোন লেখকই গজান না। রাতারাতি লেখকে পরিণত হওয়ার ম্যাজিকে আমি বিশ্বাস করি না। অনেক কাল আগে থেকেই তার প্রস্তুতি চলে। লেখক হবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসতে আসতেই কেবল একজনের পক্ষে হঠাৎ একদিন লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা সম্ভব।”
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকের গল্প-উপন্যাস গভীরভাবে পাঠ করেছে মানিক। আর সেই পাঠের মধ্য দিয়ে নিজেকে এমন এক জায়গা দাঁড় করাতে চেয়েছেন— যেখানে তাঁর আগের লেখকেরা পৌঁছাতে পারেননি। এ কথার প্রমাণ মেলে ‘গল্প লেখার গল্প’ প্রবন্ধে। সেখানে মানিক লিখেছেন, “বারো তেরো বছর বয়সের মধ্যে ‘বিষবৃক্ষ’, [বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়] ‘গোরা’ [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর], ‘চরিত্রহীন’ [শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়] পড়া হয়ে গিয়েছে। …বড়ো ঈর্ষা হতো বই যাঁরা লেখেন তাঁদের ওপর।” তবে মানিক তাঁর অগ্রজ লেখকদের প্রতি অশ্রদ্ধ ছিলেন না। বরং তাঁদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই কাজ করেছেন তিনি। তাঁর কথা হলো, পূর্বসূরি লেখকেরা জীবনের বাস্তবতার যে দাবি মেটাতে পারেননি, সেখানে তিনি তাঁর সাহিত্যে সেটার মীমাংসা করার প্রয়াস করেছেন মাত্র।
অঞ্জন আচার্য
‘অতসীমামী’ গল্প সম্পর্কে পরিণত বয়সে মানিক মূল্যায়ন করেছিলেন এভাবে, “রোমান্সে ঠাসা অবাস্তব কাহিনী। কিন্তু এ গল্প সাহিত্য করার জন্য লিখিনি— লিখেছিলাম বিখ্যাত মাসিকে গল্প ছাপানো নিয়ে তর্কে জিতবার জন্য। এ গল্পে তাই নিজের আসল নাম দিইনি, ডাক নাম ‘মানিক’ দিয়েছিলাম।” এ কথার আরো বিস্তারিত জানা যায় মানিকের ‘উপন্যাসের ধারা’ প্রবন্ধে। সেই প্রবন্ধের এক জায়গায় মানিক লিখেছেন, “প্রথম লিখলাম একটি গল্প— তাও লেখার খাতিরে নয়, কয়েকটি ছাত্রবন্ধুর সঙ্গে তর্কের ফলে সাধারণ একটা বাস্তব সত্যকে হাতে নাতে প্রমাণ করার জন্য। এ ঘটনার মধ্যেও প্রকাশ পেয়েছিল আমার ঔপন্যাসিকের ধাত, সাধারণ যুক্তিবোধ, বাস্তব-বোধ। তর্কটা ছিল মাসিকের সম্পাদক-মশাইদের অবিবেচনা, উদাসীনতা, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি দোষ নিয়ে। সম্পাদকেরা কিরকম জীব কিছুই জানতাম না, কিন্তু ভালো একটা লেখা হাতে পেলেও শুধু লেখকের নাম নেই বলেই লেখাটা তাঁরা বাতিল করে দিয়ে থাকেন, এটা কোনমতেই মানতে পারি নি। কোন যুক্তিই পাইনি সম্পাদকদের এই অর্থহীন অদ্ভুত আচরণের। ভালো লেখার কদর নেই কদর আছে শুধু নামকরা লেখকের এ তো স্রেফ পরস্পরবিরোধী কথা।
যদি ধরা যায় যে, ভালো গল্প লেখা অতি সহজ, গাদাগাদা ভালো গল্প তৈরি হওয়ায় সম্পাদকের কাছে তার বিশেষ কোন চাহিদা নেই— তা হলে নামকরা লেখকের নামেও কোন মানেই থাকে না। এত সোজা কাজ করার জন্য নাম হয় কিসে? ভালো লেখা অন্যান্য কারণে সম্পাদকীয় অবজ্ঞা লাভ করতে পারে, লেখক নতুন বলে কখনোই নয়! এই সত্যটা প্রমাণ করার জন্য নিজে একটি গল্প লিখেছিলাম। সাহিত্যজগতের সঙ্গে কোনরকম যোগাযোগ না থাকলেও উপলব্ধি করেছিলাম যে, সাহিত্যের জগৎও মানুষেরই জগৎ, সংসারে সাধারণ নিয়মকানুন সাহিত্যের জগতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে না। মোটামুটি ভালো এক গল্প লিখলে যে কোন সম্পাদক যে সেটা নিশ্চয় সাগ্রহে ছাপবেন এ বিষয়ে এমনই দৃঢ় ছিল আমার বিশ্বাস যে তখনকার সেরা তিনটি মাসিকের যে কোন একটিতে ছ’মাসের মধ্যে আমার গল্প বার করা নিয়ে বাজি রাখতে দ্বিধা জাগেনি। কবি মনের ঝোঁক নয়, ঔপন্যাসিকের প্রতীতি— যা আসে বাস্তব হিসাব নিকাশ থেকে। গল্পটা লেখার মধ্যে ছিল এই বাস্তব বিচারবিবেচনা, কি হয় আর কি না হয় তার হিসাব। এর মধ্যেও সন্ধান পাওয়া যাবে যে, ভবিষ্যৎ ঔপন্যাসিক একদিকে কি রকম নির্বিকার। নিরপেক্ষভাবে বাস্তবতার সমগ্রতাকে ধরবার চেষ্টা করেন, অন্যদিকে তারই মধ্যে বজায় রেখে বলেন আবেগ অনুভূতির সততা— মেদহীন, মমতাহীন বিশ্লেষণে সত্যকে যাচাই করে নিয়ে তার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করেন (যার যেমন বিশ্লেষণ ও যার যেমন প্রাণ!)। প্রথমে হিসাব করেছিলাম কি ধরণের গল্প লিখবো। সবদিক দিয়ে নতুন ধরনের নিশ্চয় নয়! একেবারে আনাড়ি, হঠাৎ একদিন কলম ধরে নতুন টেকনিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নতুন বিষয়ের গল্প খাড়া করা সম্ভবও নয়, বেশি ‘নতুনত্ব’ সম্পাদকের পছন্দ নাও হতে পারে। ভেবেচিন্তে স্থির করেছিলাম যে, রোমান্টিক গল্প লেখাই সবচেয়ে সহজ, এরকম গল্প জমে গেলে সম্পাদকেরও চট করে পছন্দ হয়ে যাবে।
আদর্শ অপার্থিব প্রেমের জমকালো গল্প ফাঁদতে হবে। কিন্তু সমস্তটাই আজগুবি কল্পনা হলে তো গল্প জমবে না, বাস্তবের ভিত্তিও থাকা চাই গল্পের। কি হবে এই ভিত্তি? কাহিনী যদি দাঁড় করাই প্রেমাত্মক অবাস্তব কল্পনার, গল্পের চরিত্রগুলিকে করতে হবে বাস্তব রক্ত-মাংসের মানুষ।
অতিজানা অতিচেনা মানুষকে তাই করেছিলাম ‘অতসীমামী’র নায়ক-নায়িকা। সত্যই চমৎকার বাঁশি বাজাতেন চেনা মানুষটি, বেশি বাজালে মাঝে মাঝে সত্যই তাঁর গলা দিয়ে রক্ত পড়তো এবং সত্যই তিনি ছিলেন আত্মভোলা খেয়ালি প্রকৃতির মানুষ। ভদ্রলোকের বাঁশি বাজানো সত্যই অপছন্দ করতেন তাঁর স্ত্রী, মাঝে মাঝে কেঁদে কেটে অনর্থ করতেন।
শুধু এটুকু নয়। সত্যই দুজনে তাঁরা একেবারে মশগুল ছিলেন পরস্পরকে নিয়ে। এঁদের দেখেছিলাম খুবই অল্প বয়সে, সেই বয়সেও শুধু এঁদের কথা বলা, চোখে চোখে চাওয়া দেখে টের পেতাম অন্যান্য অনেক জোড়া চেনা স্বামী-স্ত্রীর চেয়ে এঁদের মধ্যে বাঁধনটা ঢের বেশি জোরালো, সাধারণ রোগে ভুগে ভদ্রলোক মারা গেলে কিছুকালের জন্য তাঁর স্ত্রী পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।
‘অতসীমামী’ লিখবার সময় এঁদের দুজনকে আগাগোড়া মানস চোখের সামনে রেখেছিলাম। শুধু তাই নয়। সোজাসুজি কাহিনীটা লিখে না গিয়ে নিজে আমি অল্পবয়সী একটি ছেলে হয়ে গল্পের মধ্যে ঢুকে তার মুখ দিয়ে গল্পটা বলেছিলাম।”
১৯৪৫ সালে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে মানিক জানায় তার না-জানা কথা। সেই কথনটাই না-হয় জানা যাক এবার। প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘অতসীমামী’ গল্পের পটভূমি তুলে ধরেছিলেন পাঠকের কাছে তিনি। ‘আমার গল্প লেখা’ আলাপচারিতায় মানিক সেদিন বলেছিলেন, “ভাবলাম এই উচ্ছ্বাসময় গল্প [অতসীমামী] নিছক পাঠকের মনভুলানো গল্প, এতে নিজের নাম দেব না। পরে যখন নিজের নামে ভালো লেখা লিখব, তখন এই গল্পের কথা তুলে লোকে নিন্দে করবে। এই ভেবে বন্ধু কজনকে জানিয়ে গল্পে নাম দিলাম ডাকনাম মানিক।”
এ পর্যন্ত পড়ে জানা যায়, ‘অতসীমামী’ গল্পটিই মানিকের প্রথম প্রকাশিত গল্প। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি নতুন এক তথ্য নিয়ে হাজির হয়। প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-এর ১১ তম খণ্ডে (ডিসেম্বর ২০০৭) মুদ্রিত অগ্রন্থিত গল্পের তালিকায় ‘ম্যাজিক’ নামে একটি গল্প রয়েছে। গল্পটি ‘অতসীমামী’ গল্পের ৩ মাস আগে (আশ্বিন ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ, সেপ্টেম্বর ১৯২৮ সাল) প্রকাশিত হয় অশ্বিনীকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিক ‘গল্পগুচ্ছ’ পত্রিকায়। ধারণা করা হয়ে থাকে, ‘অতসীমামী’ গল্পটি লেখা ও পত্রিকায় পাঠানোর পরপরই এ ‘ম্যাজিক’ গল্পটি লেখা এবং পত্রিকায় পাঠানো হয়েছে। তবে সেটি মুদ্রিত হয় আগে। তবে এ তথ্যও পাওয়া যায়, ‘অতসীমামী’ গল্প লেখারও আগে ছাত্রজীবনে মানিক ‘জননী’ উপন্যাসটি লিখে মাত্র পঞ্চাশ টাকায় তাঁর এক বন্ধুর কাছে সেটি বেচে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে একই নামে সেই উপন্যাস লিখেন তিনি, তবে তা লেখেন সম্পূর্ণ স্মৃতি থেকে।
প্রাবন্ধিক শচীন দাশ তাঁর ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প : দুই পর্বের বাস্তবতা’ প্রবন্ধটিতে এ তথ্য জানিয়ে বলেন— “আশা বোধহয় এ-রকমই যে, দুটি উপন্যাসের মধ্যে ব্যবধান নিশ্চয়ই অনেকই। তবু ভাবতে অবাক লাগে, ওই বয়সে তিনি [মানিক] ‘জননী’-র মতো উপন্যাসের কথা ভেবেছিলেন এবং কী অনায়াসেই না লিখে ফেলে বন্ধুর কাছে বেচেও দিতে পেরেছিলেন।”
লিখে ফেলে প্রথম গল্প ‘অতসীমামী’। গল্পের নিচে লেখকের নাম হিসেবে স্বাক্ষর করেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তা পাঠিয়ে দেয় বিচিত্রা’র সম্পাদক বরাবর। নিজের ভালো নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ছেড়ে ডাকনামেই ছাপতে দেয় সেই গল্প। লেখা পাঠনোর প্রায় ৪ মাস পর ১৩৩৫ সনের পৌষ সংখ্যায় (ডিসেম্বর ১৯২৮) ছাপা হয় মানিকের সেই গল্প। প্রকাশের সাথে সাথেই গল্পটি সাড়া ফেলে পাঠক মহলে। সেই থেকে সাহিত্য জগতে প্রবেশ ঘটে মানিকের। এরপর থেকে নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠাতে থাকেন মানিক। সেই সাথে প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় নামটি চাপা পড়ে যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামের তলে।
ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন, যা মানিককে এতটা জেদি করে তুলেছিল? ঘটনাটি না-হয় একটু খতিয়ে দেখা যাক। ক্লাসের বন্ধুদের সাথে আড্ডার এক ফাঁকে এক সহপাঠী বলে উঠলেন, নামকরা লেখক বা দলের লেখক না হলে পত্রিকাওয়ালা লেখা ছাপায় না। আরেক সহপাঠীর লেখা গল্প বিভিন্ন কাগজ থেকে ফেরৎ এসেছে অমনোনীত হয়ে। এসময় সেই সহপাঠী গালিগালাজ করতে লাগলেন সম্পাদকদের উদ্দেশ্য করে। তখন মানিক বললেন, এমনটা বাজে বকছো কেন? নামকরা লেখক বা দলের লেখক না হলে লেখা ছাপা হয় না, এটা হতে পারে না। ভালো লেখা হলে কেন ছাপবে না, অবশ্যই ছাপবে। সহপাঠীর উত্তর, ‘আমারটা ছাপেনি তো।’ মানিকের পাল্টা জবাব, ‘তোমারটা ভালো হলে নিশ্চয়ই ছাপা হতো।’ এবার খেপে উঠলেন সহপাঠী। বললেন, ক্ষমতা থেকে তো একটা গল্প লিখে ছাপিয়ে দেখাও দেখি।’ মানিকেরও জেদ চেপে যায়। বললেন, ‘ঠিক আছে, তাই হবে। আমি গল্প লিখবো, এবং সেটি বিখ্যাত কোনো পত্রিকায় ছাপিয়ে প্রমাণ করবো তোমাদের ধারণা ভুল।’ সহপাঠীর চ্যালেঞ্জ, ‘তাহলে বাজি ধরো।’ মানিকের উত্তর, ‘বাজি।’ এই বাজিকে মাথায় রেখে মানিক লিখলেন গল্প ‘অতসীমামী’। আর তা লিখতে তিন মাস লাগেনি তার, তিন দিন লেগেছে মাত্র। জমা দিয়ে এলেন বিচিত্রা পত্রিকায়। সেই গল্প পড়ে পত্রিকার সম্পাদকের এতটাই ভালো লেগেগিয়েছিল যে, নিজেই চলে এলেন মানিকে কাছে। নগদ কুড়ি টাকা মানিকের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, আরো একটা গল্প চাই।
অনেকের কাছে প্রশ্ন, মাত্র ২০ বছর বয়সে বন্ধুর সাথে বাজি ধরে গল্প লেখা, বিচিত্রার মতো পত্রিকায় সেই গল্প প্রকাশ ইত্যাদি সমস্তই কি আকস্মিক বিষয়? হঠাৎ বাজিমাত করা ব্যাপার?— নাকি অনেক আগে থেকেই নিজেকে সাহিত্যিক হিসেবে প্রস্তুত করছিলেন মানিক। মাত্র ২০ বছর বয়সে একজন মানুষের জীবনে কী-ই বা এমন জীবনের অভিজ্ঞতা কিংবা উপলব্ধি থাকতে পারে? এ বিষয়ে মানিকের কথা হলো, “সাহিত্য জীবন আরম্ভ করার একটা গল্প আমি এখানে ওখানে বলেছি। ছাত্রজীবনে বিজ্ঞান শিখতে শিখতে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে ‘অতসীমামী’ গল্পটি লিখে বিচিত্রায় ছাপানো এবং হঠাৎ এভাবে সাহিত্য জীবন শুরু করে দেবার গল্প। কিন্তু একটা প্রশ্ন দাঁড়ায় এই: কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়াই কি একজন লেখকের সাহিত্য জীবন শুরু হয়ে যেতে পারে? আমি বলব, না, এ রকম হঠাৎ কোন লেখকই গজান না। রাতারাতি লেখকে পরিণত হওয়ার ম্যাজিকে আমি বিশ্বাস করি না। অনেক কাল আগে থেকেই তার প্রস্তুতি চলে। লেখক হবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসতে আসতেই কেবল একজনের পক্ষে হঠাৎ একদিন লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা সম্ভব।”
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকের গল্প-উপন্যাস গভীরভাবে পাঠ করেছে মানিক। আর সেই পাঠের মধ্য দিয়ে নিজেকে এমন এক জায়গা দাঁড় করাতে চেয়েছেন— যেখানে তাঁর আগের লেখকেরা পৌঁছাতে পারেননি। এ কথার প্রমাণ মেলে ‘গল্প লেখার গল্প’ প্রবন্ধে। সেখানে মানিক লিখেছেন, “বারো তেরো বছর বয়সের মধ্যে ‘বিষবৃক্ষ’, [বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়] ‘গোরা’ [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর], ‘চরিত্রহীন’ [শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়] পড়া হয়ে গিয়েছে। …বড়ো ঈর্ষা হতো বই যাঁরা লেখেন তাঁদের ওপর।” তবে মানিক তাঁর অগ্রজ লেখকদের প্রতি অশ্রদ্ধ ছিলেন না। বরং তাঁদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই কাজ করেছেন তিনি। তাঁর কথা হলো, পূর্বসূরি লেখকেরা জীবনের বাস্তবতার যে দাবি মেটাতে পারেননি, সেখানে তিনি তাঁর সাহিত্যে সেটার মীমাংসা করার প্রয়াস করেছেন মাত্র।
অঞ্জন আচার্য
‘অতসীমামী’ গল্প সম্পর্কে পরিণত বয়সে মানিক মূল্যায়ন করেছিলেন এভাবে, “রোমান্সে ঠাসা অবাস্তব কাহিনী। কিন্তু এ গল্প সাহিত্য করার জন্য লিখিনি— লিখেছিলাম বিখ্যাত মাসিকে গল্প ছাপানো নিয়ে তর্কে জিতবার জন্য। এ গল্পে তাই নিজের আসল নাম দিইনি, ডাক নাম ‘মানিক’ দিয়েছিলাম।” এ কথার আরো বিস্তারিত জানা যায় মানিকের ‘উপন্যাসের ধারা’ প্রবন্ধে। সেই প্রবন্ধের এক জায়গায় মানিক লিখেছেন, “প্রথম লিখলাম একটি গল্প— তাও লেখার খাতিরে নয়, কয়েকটি ছাত্রবন্ধুর সঙ্গে তর্কের ফলে সাধারণ একটা বাস্তব সত্যকে হাতে নাতে প্রমাণ করার জন্য। এ ঘটনার মধ্যেও প্রকাশ পেয়েছিল আমার ঔপন্যাসিকের ধাত, সাধারণ যুক্তিবোধ, বাস্তব-বোধ। তর্কটা ছিল মাসিকের সম্পাদক-মশাইদের অবিবেচনা, উদাসীনতা, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি দোষ নিয়ে। সম্পাদকেরা কিরকম জীব কিছুই জানতাম না, কিন্তু ভালো একটা লেখা হাতে পেলেও শুধু লেখকের নাম নেই বলেই লেখাটা তাঁরা বাতিল করে দিয়ে থাকেন, এটা কোনমতেই মানতে পারি নি। কোন যুক্তিই পাইনি সম্পাদকদের এই অর্থহীন অদ্ভুত আচরণের। ভালো লেখার কদর নেই কদর আছে শুধু নামকরা লেখকের এ তো স্রেফ পরস্পরবিরোধী কথা।
যদি ধরা যায় যে, ভালো গল্প লেখা অতি সহজ, গাদাগাদা ভালো গল্প তৈরি হওয়ায় সম্পাদকের কাছে তার বিশেষ কোন চাহিদা নেই— তা হলে নামকরা লেখকের নামেও কোন মানেই থাকে না। এত সোজা কাজ করার জন্য নাম হয় কিসে? ভালো লেখা অন্যান্য কারণে সম্পাদকীয় অবজ্ঞা লাভ করতে পারে, লেখক নতুন বলে কখনোই নয়! এই সত্যটা প্রমাণ করার জন্য নিজে একটি গল্প লিখেছিলাম। সাহিত্যজগতের সঙ্গে কোনরকম যোগাযোগ না থাকলেও উপলব্ধি করেছিলাম যে, সাহিত্যের জগৎও মানুষেরই জগৎ, সংসারে সাধারণ নিয়মকানুন সাহিত্যের জগতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে না। মোটামুটি ভালো এক গল্প লিখলে যে কোন সম্পাদক যে সেটা নিশ্চয় সাগ্রহে ছাপবেন এ বিষয়ে এমনই দৃঢ় ছিল আমার বিশ্বাস যে তখনকার সেরা তিনটি মাসিকের যে কোন একটিতে ছ’মাসের মধ্যে আমার গল্প বার করা নিয়ে বাজি রাখতে দ্বিধা জাগেনি। কবি মনের ঝোঁক নয়, ঔপন্যাসিকের প্রতীতি— যা আসে বাস্তব হিসাব নিকাশ থেকে। গল্পটা লেখার মধ্যে ছিল এই বাস্তব বিচারবিবেচনা, কি হয় আর কি না হয় তার হিসাব। এর মধ্যেও সন্ধান পাওয়া যাবে যে, ভবিষ্যৎ ঔপন্যাসিক একদিকে কি রকম নির্বিকার। নিরপেক্ষভাবে বাস্তবতার সমগ্রতাকে ধরবার চেষ্টা করেন, অন্যদিকে তারই মধ্যে বজায় রেখে বলেন আবেগ অনুভূতির সততা— মেদহীন, মমতাহীন বিশ্লেষণে সত্যকে যাচাই করে নিয়ে তার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করেন (যার যেমন বিশ্লেষণ ও যার যেমন প্রাণ!)। প্রথমে হিসাব করেছিলাম কি ধরণের গল্প লিখবো। সবদিক দিয়ে নতুন ধরনের নিশ্চয় নয়! একেবারে আনাড়ি, হঠাৎ একদিন কলম ধরে নতুন টেকনিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নতুন বিষয়ের গল্প খাড়া করা সম্ভবও নয়, বেশি ‘নতুনত্ব’ সম্পাদকের পছন্দ নাও হতে পারে। ভেবেচিন্তে স্থির করেছিলাম যে, রোমান্টিক গল্প লেখাই সবচেয়ে সহজ, এরকম গল্প জমে গেলে সম্পাদকেরও চট করে পছন্দ হয়ে যাবে।
আদর্শ অপার্থিব প্রেমের জমকালো গল্প ফাঁদতে হবে। কিন্তু সমস্তটাই আজগুবি কল্পনা হলে তো গল্প জমবে না, বাস্তবের ভিত্তিও থাকা চাই গল্পের। কি হবে এই ভিত্তি? কাহিনী যদি দাঁড় করাই প্রেমাত্মক অবাস্তব কল্পনার, গল্পের চরিত্রগুলিকে করতে হবে বাস্তব রক্ত-মাংসের মানুষ।
অতিজানা অতিচেনা মানুষকে তাই করেছিলাম ‘অতসীমামী’র নায়ক-নায়িকা। সত্যই চমৎকার বাঁশি বাজাতেন চেনা মানুষটি, বেশি বাজালে মাঝে মাঝে সত্যই তাঁর গলা দিয়ে রক্ত পড়তো এবং সত্যই তিনি ছিলেন আত্মভোলা খেয়ালি প্রকৃতির মানুষ। ভদ্রলোকের বাঁশি বাজানো সত্যই অপছন্দ করতেন তাঁর স্ত্রী, মাঝে মাঝে কেঁদে কেটে অনর্থ করতেন।
শুধু এটুকু নয়। সত্যই দুজনে তাঁরা একেবারে মশগুল ছিলেন পরস্পরকে নিয়ে। এঁদের দেখেছিলাম খুবই অল্প বয়সে, সেই বয়সেও শুধু এঁদের কথা বলা, চোখে চোখে চাওয়া দেখে টের পেতাম অন্যান্য অনেক জোড়া চেনা স্বামী-স্ত্রীর চেয়ে এঁদের মধ্যে বাঁধনটা ঢের বেশি জোরালো, সাধারণ রোগে ভুগে ভদ্রলোক মারা গেলে কিছুকালের জন্য তাঁর স্ত্রী পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।
‘অতসীমামী’ লিখবার সময় এঁদের দুজনকে আগাগোড়া মানস চোখের সামনে রেখেছিলাম। শুধু তাই নয়। সোজাসুজি কাহিনীটা লিখে না গিয়ে নিজে আমি অল্পবয়সী একটি ছেলে হয়ে গল্পের মধ্যে ঢুকে তার মুখ দিয়ে গল্পটা বলেছিলাম।”
১৯৪৫ সালে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে মানিক জানায় তার না-জানা কথা। সেই কথনটাই না-হয় জানা যাক এবার। প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘অতসীমামী’ গল্পের পটভূমি তুলে ধরেছিলেন পাঠকের কাছে তিনি। ‘আমার গল্প লেখা’ আলাপচারিতায় মানিক সেদিন বলেছিলেন, “ভাবলাম এই উচ্ছ্বাসময় গল্প [অতসীমামী] নিছক পাঠকের মনভুলানো গল্প, এতে নিজের নাম দেব না। পরে যখন নিজের নামে ভালো লেখা লিখব, তখন এই গল্পের কথা তুলে লোকে নিন্দে করবে। এই ভেবে বন্ধু কজনকে জানিয়ে গল্পে নাম দিলাম ডাকনাম মানিক।”
এ পর্যন্ত পড়ে জানা যায়, ‘অতসীমামী’ গল্পটিই মানিকের প্রথম প্রকাশিত গল্প। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি নতুন এক তথ্য নিয়ে হাজির হয়। প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-এর ১১ তম খণ্ডে (ডিসেম্বর ২০০৭) মুদ্রিত অগ্রন্থিত গল্পের তালিকায় ‘ম্যাজিক’ নামে একটি গল্প রয়েছে। গল্পটি ‘অতসীমামী’ গল্পের ৩ মাস আগে (আশ্বিন ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ, সেপ্টেম্বর ১৯২৮ সাল) প্রকাশিত হয় অশ্বিনীকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিক ‘গল্পগুচ্ছ’ পত্রিকায়। ধারণা করা হয়ে থাকে, ‘অতসীমামী’ গল্পটি লেখা ও পত্রিকায় পাঠানোর পরপরই এ ‘ম্যাজিক’ গল্পটি লেখা এবং পত্রিকায় পাঠানো হয়েছে। তবে সেটি মুদ্রিত হয় আগে। তবে এ তথ্যও পাওয়া যায়, ‘অতসীমামী’ গল্প লেখারও আগে ছাত্রজীবনে মানিক ‘জননী’ উপন্যাসটি লিখে মাত্র পঞ্চাশ টাকায় তাঁর এক বন্ধুর কাছে সেটি বেচে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে একই নামে সেই উপন্যাস লিখেন তিনি, তবে তা লেখেন সম্পূর্ণ স্মৃতি থেকে।
প্রাবন্ধিক শচীন দাশ তাঁর ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প : দুই পর্বের বাস্তবতা’ প্রবন্ধটিতে এ তথ্য জানিয়ে বলেন— “আশা বোধহয় এ-রকমই যে, দুটি উপন্যাসের মধ্যে ব্যবধান নিশ্চয়ই অনেকই। তবু ভাবতে অবাক লাগে, ওই বয়সে তিনি [মানিক] ‘জননী’-র মতো উপন্যাসের কথা ভেবেছিলেন এবং কী অনায়াসেই না লিখে ফেলে বন্ধুর কাছে বেচেও দিতে পেরেছিলেন।”
0 মন্তব্যসমূহ