তপন বাগচী
‘অলীক মানুষ’ এবং ‘অমর্ত্য প্রেমকথা’ উপন্যাস দুটি তার কথাসাহিত্যিক জীবনের সবচেয়ে নন্দিত সৃষ্টি হলেও একজন পূর্ণাঙ্গ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে চিনতে ‘স্বর্ণচাঁপার উপাখ্যান’, ‘বসন্ত তৃষ্ণা’, ‘মায়ামৃদঙ্গ’, ‘তৃণভূমি’, ‘বিবাদী রাগ’ প্রভৃতি উপন্যাসও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এমনকি অনেক আগে পড়া নাতিদীর্ঘ ‘অজ্ঞাতবাস’ উপন্যাস থেকেও তার শিল্পসিদ্ধি সম্পর্কে ধারণা নিতে পারি। শিশুসাহিত্যিক হিসেবে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সাফল্য ঈর্ষণীয়। বিশেষ করে তার সৃষ্টচরিত্র কর্নেল নীলাদ্রী সরকারও বাংলা সাহিত্যের বড় অর্জন বটে!
‘অজ্ঞাতবাস’ উপন্যাসটি মাত্র দুইরাতের কাহিনি। বড় কোনো ক্যানভাস ব্যবহার না করেও যে বড় ছবি আঁকা যায়, এই উপন্যাস তার নমুনা হতে পারে। কোন জাতের উপন্যাস বলব একে? সংগীতগুরুর আত্মজৈবনিক উপন্যাস? বহুগামী প্রেমের উপন্যাস? খুনীসন্ধানী গোয়েন্দা উপন্যাস? বিপ্লবপ্রত্যাশী রাজনৈতিক উপন্যাস? লোকসংস্কৃতির উপাদানঋদ্ধ সামাজিক উপন্যাস? গ্রামীণ পটভূমির এক পারিবারিক উপন্যাস? যে-কোনো জাতেই তাকে বিচার করা যায়! কিংবা জাতবিচার না করেও তার সফলতা ও শিল্পকুশলতা নির্ণয় করা যায়।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ যে একদা আলকাপ তথা লোকসংগীতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, উপন্যাসটি পড়ার সময় সেই চেহারাটি ভেসে ওঠে। উত্তমপুরুষে রচিত উপন্যাসটিতে কি লেখকের সংগীতজীবনের ছায়া আছে? অন্তত সংগীতাভিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে কাহিনির ভাঁজে-ভাঁজে।
ঈশানপুর গ্রামের জোতদার সদাব্রতের মেয়ে শ্রীকে গান শেখাতে এলেন মিহির। তাকে সবাই মাস্টারমশাই বলে ডাকে। গানের ভাল গলা তার। চেহারায় সন্ন্যাসী ভাব। গ্রামের আইবুড়ো মেয়দের গান শেখানোই তার পেশা এখন। একদা বিপ্লবী। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কিংবা প্রেমিকাকে বিপ্লবী বন্ধুর কাছ থেকে ফিরে না পেয়ে বিপ্লবী দল ছেড়ে জীবন বাঁচাতে এই স্বেচ্ছা ছদ্মবেদশ, এই অজ্ঞাতবাস। গান শেখানোর সুযোগে অনেক মেয়ের সম্পর্কে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে মিহির। শ্রীর স্বামী নিখোঁজ। তার প্রতিও দুর্বলতা পোষণ করে মিহির। একরাতে গ্রামের মেলায় পলিশ খুন হয়। খুনী বিপ্লবী শচীন এসে আশ্রয় নিল মাস্টামশাইয়ের ঘরে। সদাব্রত রাতে এলেন মাস্টারমশাইয়ের ঘরে, তাকে সতর্ক করতে। ঘরে তখন খাটের তলায় লুকিয়ে ছিল। গভীর রাতে পুলিশ আসার বিষয় টের পেয়ে সে বের হয়ে যায়। পরের দিন শ্রীর মাধমে চিরকুট পাঠিয়ে মিহিরকে দেখা করতে বলে গ্রামের জোড়া তেঁতুল তলায়। মিহির যায়, সঙ্গে শ্রীও যায়। তারা কথা বলা শুরু করতেই পুলিস এসে পড়ে। পুলিস আসার খবর দেয় শ্রীদের বাগানের মালিক বেগু। তারা পালিয়ে যায়। শ্রী এসে মিহিরের ঘরে বসে। তখন অনেক রাত। পিতা উঠোনে পায়চারি করছে বলে মেয়ে নিজের ঘরে যেতে পারে না। তাই মিহির তাকে এই ঘরেই শুয়ে থাকতে বলে। কিন্তু মিহিরের জবানিতে ‘এত কাছে এই নিষ্ঠুর সৌন্দর্য আমার সইছিল না।’ তাই হুলস্থূল ঘটে যায় তার মধ্যে। মিহির উন্মাদ হয়ে পড়ে। ‘সারা শরীর দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলে যেন। শ্রী-র উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শ্রী নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়! একটানে শ্রীর ব্লাউজ ছিঁড়ে ফেলে মিহির। তারপর শ্রী ছুটে চলে যায় বাইরে। গিয়ে বাইরে ঘাটের বেদিতে গিয়ে বসে থাকে। আর লজ্জার অপমানের গ্লানিতে মিহির এ বাড়ি থেকে পালানোর উদ্যোগ নেয়। সাধের তানপুরাটা ছুরি দিয়ে কেটে ফেলে। সুটকেসে টুকিটাকি জিনিস নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পথে মেলার মাঠে ধরা খায় গোয়েন্দা পুলিসের হাতে। নির্যাতনের তোড়ে সে বলে দেয় শচীনের অবস্থান। পুলিশ গিয়ে শচীনকে ধরে আনে আর মিহিরকে ছেড়ে দেয়। মিহির কলকাতার জনারণ্যে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার জন্য রেলস্টেশনের দিকে যায়। তখন স্টেশেনে ভিড় শুরু হয়নি। এমন সময় শ্রী আসে শচীনের ফেলে রাখা পিস্তল নিয়ে মিহিরকে খুন করতে। কিন্তু মিহির পিস্তল কেড়ে নিয়ে দেখে তাতে গুলি নেই। শ্রী পিস্তলটি মিহিরের হাতে আর বলে দিল যে শচীন এলে যেন তাকে ফেরত দেয়। যাওয়ার আগে শ্রী দীর্ঘ প্রণাম করে মিহিরের পায়ে। কিন্তু কাকে প্রণাম করল তারে গানের গুরুকে নাকি প্রেমিককে! এই প্রশ্নের অমীমাংসিত থেকে যায় মিহিরের মনে। এই হচ্ছে ‘অজ্ঞাতবাস’ উপন্যাসের কাহিনি।
উপন্যাস শুরু হয়েছে একটি সংস্কার কিংবা লোকবিশ্বাসের অবতারণার পাশাপাশি আধুনিক সংস্কার চিন্তার সংযোগ ঘটিয়ে। ‘ঈশানদেবের মন্দিরের সামনে তোরো একর বাঁজা ডাঙায় কেউ কেউ ফসল ফলাবার চেষ্টা করেছিল। পারেনি। খরচায় পোষাত না। পাশের দীঘির জল পাম্পে তুলে ওই রুক্ষ্ম কাঁকুরে জমিকে রসবতী করা রীতিমতো একটা সরকারি প্রকল্পের কাজ। ওদিকে সারের দাম যা বেড়েছে, তাতে উর্বরতা শেষঅব্দি স্বপ্নই হয়ে ওঠে।’ এখানে ‘বাঁজা ডাঙা’ যেমন কুসংস্কার, ‘সরকারি প্রকল্প’ তেমন সংস্কার। কিন্তু এর পরেই যুক্ত হয়েছে আরও এক লোকবিশ্বাস— ‘জমিটা দেবতার। চষতে গেলেই অভিশাপ লাগে। সংসারে অনর্থ ঘটে যায়।’ এ ধরনের লোকবিশ্বাস ও লোকসংস্কৃতির প্রকাশ রয়েছে এই উপন্যাসে। লোকভাষার ক্ষেত্রে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ খুবই মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। গ্রামের লোকমেলায় ঢুকে গেছে আধুনিকতার ছাপ, তা সিরাজের চোখ এড়ায়নি। তার বর্ণনায় ফুটে উঠে আধুনিকতার ছোঁয়া বিবর্তিত এক গ্রাম্য মেলা—
‘সেই সময় জাতীয় সড়কের ধারে ঈশানদেবের সেই বিশাল চত্বরে বসল সরকারি মেলা। মেলা— তাই সার্কাস এল, ম্যাজিক এল, ভ্যারাইটি শো-পার্টি এল, এল অজস্র দোকানপাট। পাঞ্জাবিরা এল তাদের চাদর নিয়ে। এল পাহাড় এলাকা থেকে আদিবাসী বা উপজাতীয় লোকেরা— মরা গিরিগিটি শিলাজুত, লালনীল পাথরের মালা, শঙ্খচূড় সাপ নিয়ে। এল বিস্তর শহুরে মাস্তান। জুটল চারপাশের মাতাল সম্প্রদায়। এল কপাটওয়ালা, তক্তপোষওয়ালা। লোহালক্কড় নিয়ে এল শহরের হার্ডওয়ার স্টোর্স। এল গাধার পিঠে জাঁতা নিয়ে পাহাড়ী জাঁতাওয়ালা। মেলা— তাই সব পণ্য আসে। এল।’
গ্রাম্য মেলার নিজস্ব সংস্কৃতি এভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। সিরাজ তা-ই তুলে ধরলেন। মেলায় এখন খুনখারাবি হয়। মেলা অনেক রঙিন। কিন্তু আগের মতো সেই প্রাণ নেই। তবু লোকসংস্কৃতির এই উৎসবের আমেজ আমরা ভুলতে পারি না। লেখক সেই কথাটি মনে করিয়ে দিয়েছেন। কেবল মেলার কথা নয়, পুজোর বাজনা আর শিবের গাজনের কথাও এসেছে ছোট পরিসের এই উপন্যাসে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিবেচনায়।
‘পাড়াগাঁয়ে আমার জন্ম হয়েছিল। সেই গাঁয়ে প্রচুর নিমবন ছিল। এমনি চৈত্রে নিমফুলের মিঠে গন্ধে ভরে যেত চারদিক। আর আকাশ কোনোদিন মেঘলা থাকত। নিমফুলে ভরা ডাল ভেঙে আমরা নাচতুম— পুজোর বাজনা বাজাতুম। গাজনের খুব ধুম পড়ে যেত গাঁয়ে। সংক্রান্তির দিন শিবের চেলারা দল বেঁধে চেঁচাত— শিবো নামে পুণ্য হবো বোল— শিবো বো-ও-ওল! ঈশানপুরেও জোর ধুম লাগে সংক্রান্তিতে। হোম হয় প্রথমদিন। পরের দিন চড়ক।’
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখা ভালো লাগার একটা কারণ ভাষার কারুকাজ। ভাষার অলঙ্কারের সাজিয়ে প্রকাশ করেছেন তার কথকতা—
১. তার শ্বাসপ্রশ্বাসে শিশুর হাইতোলার সুগন্ধ পাই।
২. বাগানে ঘন ছায়ার পায়ের কাছে অনেক জ্যোৎস্না পড়ে আছে প্রণতা দেবদাসীর মতো!
৩. অস্পষ্ট, জীর্ণ, নষ্ট স্মৃতির পাহাড় সামেন দাঁড়িয়ে— আবর্জনার মতোন।
৪. চঞ্চল সুন্দর সাহসী মেয়ে বেদানা— যে প্রকৃতির বহতা স্বাধীনতায় ঝাঁপ দিতে পারত।
৫. বাইরে ভোরের ভ্রমে কোকিল আর কাকেরা ডেকে উঠল এতক্ষণে।
৬. স্বাধীনতা আছে নারীর প্রতি প্রেমে, সৌন্দর্যের প্রতি আনুগত্যে।
৭. এই গোপন কথাগুলো তার বুকে আটকেপড়া পাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছিল কতদিন থেকে।
৮. নারী যখন নেই, প্রেম যখন নিষ্ফল— তখন সংগীত তো এক ব্যর্থতা। তা শ্মশানের প্রান্তে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণতার দীর্ঘশ্বাসমাত্র।
৯. যে যোদ্ধার পোশাক বানায় সে-ও যুদ্ধ করে।
১০. প্রেমে ব্যর্থ মানুষের জীবন সত্যি মরুভূমি হয় না।
১১. প্রেম ঘৃণায় শেষ হয়ে যেতে পারে, অনেক শ্রেষ্ঠ আকাক্সক্ষাও একসময় ফিকে হয়ে যায়— কিন্তু প্রতিহিংসা? সে অমর।
উদাহরণ আর না বাড়ালেও চলে! এইসব চকিত চরণ উপন্যাসের শিল্পরূপকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। এর কিছু কিছু বাক্য প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে এ-সকল কথা চিরন্তন বাণী হয়ে ফুটে থাকতে পারে। একটি উপন্যাসের এও এক সার্থকতা বটে!
অজ্ঞাতবাসে যাওয়া একটি মানুষ তার স্বাভাবিক জীবন সরিয়ে যে জীবন বেছে নিয়েছে তাও শিল্পময়, সংগীতময়। তাই সংগীতশিষ্যা শ্রীর সংগীত জ্ঞান বোঝাতে লেখক যে বিবরণ দেন, তাতে লেখককের সংগীতভাবনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মিহিরের উপলব্ধি—
শ্রী তার অশিক্ষিত পটুত্বের জোরে রেডিও থেকে শুনে-শুনে অনেক রাগিণী আয়ত্ত করেছিল ইতিমধ্যে। কিন্তু স্বরের সূক্ষ্ম পার্থক্য বা রাগিণীর গভীর ভেদাভেদ সে বুঝত না। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষকের বড্ড ঝামেলা হয়। বাদী বিাদী সম্বাদী স্বরের হেরফের একই সুরে বৈচিত্র্য ও নানা রাগ হয়ে ওঠে সে বোঝে না। আমার কষ্ট হয় সে বড় সহজেই ইমনকল্যাণের সঙ্গে ভৈরব আর মোহিনী একাকার করে দিয়ে সুর ছড়ায়। পূরবী-পুরিয়া মিশিয়ে ফেলে। দেশ কাফী ওতপ্রোত জড়িয়ে দেয়।
সংগীতে ভাল দখল না থাকলে এই বর্ণনা সৃষ্টি করা যায় না। বিপ্লবের পক্ষে-বিপক্ষে নানান যুক্তিতর্কের অবতারণা করতে লেখক ভোলেননি। গ্রামের এক জোতদারের মেয়ে গোপনে বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, তার চমৎকার ছবি এঁকেছেন লেখক। আবার মিহিরের প্রেম টের পেয়ে সাড়া না দিয়েও ভেতরে ভেতরে গলে যেতে থাকে। তার পরিণত অবস্থা দেখা যায় শেষ দৃশ্যে গীভর প্রণাম করার মাধ্যমে। কিন্তু সেই প্রণামের উদ্দেশ্যও রহস্যমুক্ত নয়, তার কারণও থেকে যায় অজ্ঞাত। এক অজ্ঞাতবাস থেকে আবার মিহির ছোটে আরেক অজ্ঞাতবাসে। মাঝখানে দুইরাতে অংকিত হয়ে যায় অজ্ঞাতবাসের শিল্পকলা। সৈয়দ মুস্তাফা হয়ে ওঠেন এক যথার্থ কথাশিল্পী। আর তার গল্পপ্রতিম উপন্যাস ‘অজ্ঞাতবাস’কে মনে হয় হয় উপভোগ্য এক শিল্পকলা।
‘অলীক মানুষ’ এবং ‘অমর্ত্য প্রেমকথা’ উপন্যাস দুটি তার কথাসাহিত্যিক জীবনের সবচেয়ে নন্দিত সৃষ্টি হলেও একজন পূর্ণাঙ্গ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে চিনতে ‘স্বর্ণচাঁপার উপাখ্যান’, ‘বসন্ত তৃষ্ণা’, ‘মায়ামৃদঙ্গ’, ‘তৃণভূমি’, ‘বিবাদী রাগ’ প্রভৃতি উপন্যাসও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এমনকি অনেক আগে পড়া নাতিদীর্ঘ ‘অজ্ঞাতবাস’ উপন্যাস থেকেও তার শিল্পসিদ্ধি সম্পর্কে ধারণা নিতে পারি। শিশুসাহিত্যিক হিসেবে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সাফল্য ঈর্ষণীয়। বিশেষ করে তার সৃষ্টচরিত্র কর্নেল নীলাদ্রী সরকারও বাংলা সাহিত্যের বড় অর্জন বটে!
‘অজ্ঞাতবাস’ উপন্যাসটি মাত্র দুইরাতের কাহিনি। বড় কোনো ক্যানভাস ব্যবহার না করেও যে বড় ছবি আঁকা যায়, এই উপন্যাস তার নমুনা হতে পারে। কোন জাতের উপন্যাস বলব একে? সংগীতগুরুর আত্মজৈবনিক উপন্যাস? বহুগামী প্রেমের উপন্যাস? খুনীসন্ধানী গোয়েন্দা উপন্যাস? বিপ্লবপ্রত্যাশী রাজনৈতিক উপন্যাস? লোকসংস্কৃতির উপাদানঋদ্ধ সামাজিক উপন্যাস? গ্রামীণ পটভূমির এক পারিবারিক উপন্যাস? যে-কোনো জাতেই তাকে বিচার করা যায়! কিংবা জাতবিচার না করেও তার সফলতা ও শিল্পকুশলতা নির্ণয় করা যায়।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ যে একদা আলকাপ তথা লোকসংগীতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, উপন্যাসটি পড়ার সময় সেই চেহারাটি ভেসে ওঠে। উত্তমপুরুষে রচিত উপন্যাসটিতে কি লেখকের সংগীতজীবনের ছায়া আছে? অন্তত সংগীতাভিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে কাহিনির ভাঁজে-ভাঁজে।
ঈশানপুর গ্রামের জোতদার সদাব্রতের মেয়ে শ্রীকে গান শেখাতে এলেন মিহির। তাকে সবাই মাস্টারমশাই বলে ডাকে। গানের ভাল গলা তার। চেহারায় সন্ন্যাসী ভাব। গ্রামের আইবুড়ো মেয়দের গান শেখানোই তার পেশা এখন। একদা বিপ্লবী। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কিংবা প্রেমিকাকে বিপ্লবী বন্ধুর কাছ থেকে ফিরে না পেয়ে বিপ্লবী দল ছেড়ে জীবন বাঁচাতে এই স্বেচ্ছা ছদ্মবেদশ, এই অজ্ঞাতবাস। গান শেখানোর সুযোগে অনেক মেয়ের সম্পর্কে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে মিহির। শ্রীর স্বামী নিখোঁজ। তার প্রতিও দুর্বলতা পোষণ করে মিহির। একরাতে গ্রামের মেলায় পলিশ খুন হয়। খুনী বিপ্লবী শচীন এসে আশ্রয় নিল মাস্টামশাইয়ের ঘরে। সদাব্রত রাতে এলেন মাস্টারমশাইয়ের ঘরে, তাকে সতর্ক করতে। ঘরে তখন খাটের তলায় লুকিয়ে ছিল। গভীর রাতে পুলিশ আসার বিষয় টের পেয়ে সে বের হয়ে যায়। পরের দিন শ্রীর মাধমে চিরকুট পাঠিয়ে মিহিরকে দেখা করতে বলে গ্রামের জোড়া তেঁতুল তলায়। মিহির যায়, সঙ্গে শ্রীও যায়। তারা কথা বলা শুরু করতেই পুলিস এসে পড়ে। পুলিস আসার খবর দেয় শ্রীদের বাগানের মালিক বেগু। তারা পালিয়ে যায়। শ্রী এসে মিহিরের ঘরে বসে। তখন অনেক রাত। পিতা উঠোনে পায়চারি করছে বলে মেয়ে নিজের ঘরে যেতে পারে না। তাই মিহির তাকে এই ঘরেই শুয়ে থাকতে বলে। কিন্তু মিহিরের জবানিতে ‘এত কাছে এই নিষ্ঠুর সৌন্দর্য আমার সইছিল না।’ তাই হুলস্থূল ঘটে যায় তার মধ্যে। মিহির উন্মাদ হয়ে পড়ে। ‘সারা শরীর দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলে যেন। শ্রী-র উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শ্রী নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়! একটানে শ্রীর ব্লাউজ ছিঁড়ে ফেলে মিহির। তারপর শ্রী ছুটে চলে যায় বাইরে। গিয়ে বাইরে ঘাটের বেদিতে গিয়ে বসে থাকে। আর লজ্জার অপমানের গ্লানিতে মিহির এ বাড়ি থেকে পালানোর উদ্যোগ নেয়। সাধের তানপুরাটা ছুরি দিয়ে কেটে ফেলে। সুটকেসে টুকিটাকি জিনিস নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পথে মেলার মাঠে ধরা খায় গোয়েন্দা পুলিসের হাতে। নির্যাতনের তোড়ে সে বলে দেয় শচীনের অবস্থান। পুলিশ গিয়ে শচীনকে ধরে আনে আর মিহিরকে ছেড়ে দেয়। মিহির কলকাতার জনারণ্যে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার জন্য রেলস্টেশনের দিকে যায়। তখন স্টেশেনে ভিড় শুরু হয়নি। এমন সময় শ্রী আসে শচীনের ফেলে রাখা পিস্তল নিয়ে মিহিরকে খুন করতে। কিন্তু মিহির পিস্তল কেড়ে নিয়ে দেখে তাতে গুলি নেই। শ্রী পিস্তলটি মিহিরের হাতে আর বলে দিল যে শচীন এলে যেন তাকে ফেরত দেয়। যাওয়ার আগে শ্রী দীর্ঘ প্রণাম করে মিহিরের পায়ে। কিন্তু কাকে প্রণাম করল তারে গানের গুরুকে নাকি প্রেমিককে! এই প্রশ্নের অমীমাংসিত থেকে যায় মিহিরের মনে। এই হচ্ছে ‘অজ্ঞাতবাস’ উপন্যাসের কাহিনি।
উপন্যাস শুরু হয়েছে একটি সংস্কার কিংবা লোকবিশ্বাসের অবতারণার পাশাপাশি আধুনিক সংস্কার চিন্তার সংযোগ ঘটিয়ে। ‘ঈশানদেবের মন্দিরের সামনে তোরো একর বাঁজা ডাঙায় কেউ কেউ ফসল ফলাবার চেষ্টা করেছিল। পারেনি। খরচায় পোষাত না। পাশের দীঘির জল পাম্পে তুলে ওই রুক্ষ্ম কাঁকুরে জমিকে রসবতী করা রীতিমতো একটা সরকারি প্রকল্পের কাজ। ওদিকে সারের দাম যা বেড়েছে, তাতে উর্বরতা শেষঅব্দি স্বপ্নই হয়ে ওঠে।’ এখানে ‘বাঁজা ডাঙা’ যেমন কুসংস্কার, ‘সরকারি প্রকল্প’ তেমন সংস্কার। কিন্তু এর পরেই যুক্ত হয়েছে আরও এক লোকবিশ্বাস— ‘জমিটা দেবতার। চষতে গেলেই অভিশাপ লাগে। সংসারে অনর্থ ঘটে যায়।’ এ ধরনের লোকবিশ্বাস ও লোকসংস্কৃতির প্রকাশ রয়েছে এই উপন্যাসে। লোকভাষার ক্ষেত্রে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ খুবই মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। গ্রামের লোকমেলায় ঢুকে গেছে আধুনিকতার ছাপ, তা সিরাজের চোখ এড়ায়নি। তার বর্ণনায় ফুটে উঠে আধুনিকতার ছোঁয়া বিবর্তিত এক গ্রাম্য মেলা—
‘সেই সময় জাতীয় সড়কের ধারে ঈশানদেবের সেই বিশাল চত্বরে বসল সরকারি মেলা। মেলা— তাই সার্কাস এল, ম্যাজিক এল, ভ্যারাইটি শো-পার্টি এল, এল অজস্র দোকানপাট। পাঞ্জাবিরা এল তাদের চাদর নিয়ে। এল পাহাড় এলাকা থেকে আদিবাসী বা উপজাতীয় লোকেরা— মরা গিরিগিটি শিলাজুত, লালনীল পাথরের মালা, শঙ্খচূড় সাপ নিয়ে। এল বিস্তর শহুরে মাস্তান। জুটল চারপাশের মাতাল সম্প্রদায়। এল কপাটওয়ালা, তক্তপোষওয়ালা। লোহালক্কড় নিয়ে এল শহরের হার্ডওয়ার স্টোর্স। এল গাধার পিঠে জাঁতা নিয়ে পাহাড়ী জাঁতাওয়ালা। মেলা— তাই সব পণ্য আসে। এল।’
গ্রাম্য মেলার নিজস্ব সংস্কৃতি এভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। সিরাজ তা-ই তুলে ধরলেন। মেলায় এখন খুনখারাবি হয়। মেলা অনেক রঙিন। কিন্তু আগের মতো সেই প্রাণ নেই। তবু লোকসংস্কৃতির এই উৎসবের আমেজ আমরা ভুলতে পারি না। লেখক সেই কথাটি মনে করিয়ে দিয়েছেন। কেবল মেলার কথা নয়, পুজোর বাজনা আর শিবের গাজনের কথাও এসেছে ছোট পরিসের এই উপন্যাসে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিবেচনায়।
‘পাড়াগাঁয়ে আমার জন্ম হয়েছিল। সেই গাঁয়ে প্রচুর নিমবন ছিল। এমনি চৈত্রে নিমফুলের মিঠে গন্ধে ভরে যেত চারদিক। আর আকাশ কোনোদিন মেঘলা থাকত। নিমফুলে ভরা ডাল ভেঙে আমরা নাচতুম— পুজোর বাজনা বাজাতুম। গাজনের খুব ধুম পড়ে যেত গাঁয়ে। সংক্রান্তির দিন শিবের চেলারা দল বেঁধে চেঁচাত— শিবো নামে পুণ্য হবো বোল— শিবো বো-ও-ওল! ঈশানপুরেও জোর ধুম লাগে সংক্রান্তিতে। হোম হয় প্রথমদিন। পরের দিন চড়ক।’
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখা ভালো লাগার একটা কারণ ভাষার কারুকাজ। ভাষার অলঙ্কারের সাজিয়ে প্রকাশ করেছেন তার কথকতা—
১. তার শ্বাসপ্রশ্বাসে শিশুর হাইতোলার সুগন্ধ পাই।
২. বাগানে ঘন ছায়ার পায়ের কাছে অনেক জ্যোৎস্না পড়ে আছে প্রণতা দেবদাসীর মতো!
৩. অস্পষ্ট, জীর্ণ, নষ্ট স্মৃতির পাহাড় সামেন দাঁড়িয়ে— আবর্জনার মতোন।
৪. চঞ্চল সুন্দর সাহসী মেয়ে বেদানা— যে প্রকৃতির বহতা স্বাধীনতায় ঝাঁপ দিতে পারত।
৫. বাইরে ভোরের ভ্রমে কোকিল আর কাকেরা ডেকে উঠল এতক্ষণে।
৬. স্বাধীনতা আছে নারীর প্রতি প্রেমে, সৌন্দর্যের প্রতি আনুগত্যে।
৭. এই গোপন কথাগুলো তার বুকে আটকেপড়া পাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছিল কতদিন থেকে।
৮. নারী যখন নেই, প্রেম যখন নিষ্ফল— তখন সংগীত তো এক ব্যর্থতা। তা শ্মশানের প্রান্তে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণতার দীর্ঘশ্বাসমাত্র।
৯. যে যোদ্ধার পোশাক বানায় সে-ও যুদ্ধ করে।
১০. প্রেমে ব্যর্থ মানুষের জীবন সত্যি মরুভূমি হয় না।
১১. প্রেম ঘৃণায় শেষ হয়ে যেতে পারে, অনেক শ্রেষ্ঠ আকাক্সক্ষাও একসময় ফিকে হয়ে যায়— কিন্তু প্রতিহিংসা? সে অমর।
উদাহরণ আর না বাড়ালেও চলে! এইসব চকিত চরণ উপন্যাসের শিল্পরূপকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। এর কিছু কিছু বাক্য প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে এ-সকল কথা চিরন্তন বাণী হয়ে ফুটে থাকতে পারে। একটি উপন্যাসের এও এক সার্থকতা বটে!
অজ্ঞাতবাসে যাওয়া একটি মানুষ তার স্বাভাবিক জীবন সরিয়ে যে জীবন বেছে নিয়েছে তাও শিল্পময়, সংগীতময়। তাই সংগীতশিষ্যা শ্রীর সংগীত জ্ঞান বোঝাতে লেখক যে বিবরণ দেন, তাতে লেখককের সংগীতভাবনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মিহিরের উপলব্ধি—
শ্রী তার অশিক্ষিত পটুত্বের জোরে রেডিও থেকে শুনে-শুনে অনেক রাগিণী আয়ত্ত করেছিল ইতিমধ্যে। কিন্তু স্বরের সূক্ষ্ম পার্থক্য বা রাগিণীর গভীর ভেদাভেদ সে বুঝত না। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষকের বড্ড ঝামেলা হয়। বাদী বিাদী সম্বাদী স্বরের হেরফের একই সুরে বৈচিত্র্য ও নানা রাগ হয়ে ওঠে সে বোঝে না। আমার কষ্ট হয় সে বড় সহজেই ইমনকল্যাণের সঙ্গে ভৈরব আর মোহিনী একাকার করে দিয়ে সুর ছড়ায়। পূরবী-পুরিয়া মিশিয়ে ফেলে। দেশ কাফী ওতপ্রোত জড়িয়ে দেয়।
সংগীতে ভাল দখল না থাকলে এই বর্ণনা সৃষ্টি করা যায় না। বিপ্লবের পক্ষে-বিপক্ষে নানান যুক্তিতর্কের অবতারণা করতে লেখক ভোলেননি। গ্রামের এক জোতদারের মেয়ে গোপনে বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, তার চমৎকার ছবি এঁকেছেন লেখক। আবার মিহিরের প্রেম টের পেয়ে সাড়া না দিয়েও ভেতরে ভেতরে গলে যেতে থাকে। তার পরিণত অবস্থা দেখা যায় শেষ দৃশ্যে গীভর প্রণাম করার মাধ্যমে। কিন্তু সেই প্রণামের উদ্দেশ্যও রহস্যমুক্ত নয়, তার কারণও থেকে যায় অজ্ঞাত। এক অজ্ঞাতবাস থেকে আবার মিহির ছোটে আরেক অজ্ঞাতবাসে। মাঝখানে দুইরাতে অংকিত হয়ে যায় অজ্ঞাতবাসের শিল্পকলা। সৈয়দ মুস্তাফা হয়ে ওঠেন এক যথার্থ কথাশিল্পী। আর তার গল্পপ্রতিম উপন্যাস ‘অজ্ঞাতবাস’কে মনে হয় হয় উপভোগ্য এক শিল্পকলা।
![]() লেখক পরিচিতি তপন বাগচী। উপপরিচালক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা। কবি। প্রবন্ধকার। গবেষক। |
ক্যাপশন যুক্ত করুন |
0 মন্তব্যসমূহ