শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি' পড়ছি আর ভাবছি, সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোরের হুমায়ুন আজাদ গিলে খাওয়াটা উচিৎ হয়নি, একদম না। হয়ত, সেই কৈশোরেই জীবন ও চারপাশকে নির্মোহ ভাবে দেখাতে সাহায্য করেছিলেন তিনি, কিন্তু কৈশোরটা রঙ্গিন হয়ে ওঠে নি ঠিক সেই কারণেই! ততোদিনে জেনে গেছি, বাবুদের দীঘি পাড়ে জ্যোৎস্না নামলেই পরী নামক অত্যাশ্চর্য অপরূপ রূপসীরা নামে না, আসলে নামেই নি কোনোদিন; সব শালা চাষা-মূর্খ বলদদের বোগাস!
তখন ভূতে ভরা অদ্ভুত শ্রীকান্তের লেখক শরৎচন্দ্রকে মনে হতে থাকে কুসংস্কারাচ্ছ অসামাজিক আবেগের লেখক! [এবং, ততোদিনে শিখে গেছি বাংলার সিংহভাগ সাহিত্যকে পরিহাস আর অবজ্ঞা করার কৌশল; গুরু যখন বললেন যে, সে লেখকই না— সেখানে তার মত নিকৃষ্ট লেখকই হয় না! হুমায়ুন আজাদ পশ্চিমবাংলার বর্তমান সময়ের কোনো লেখককেই মূল্য দিতেন না, সব সময় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেন; মাহমুদুল হক, শহিদুল জহির কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিল তার কাছে অনুল্লেখযোগ্য বাংলার স্থানীয় লেখক। কেননা, তিনি বাংলা সাহিত্যকে পরিমাপ করতেন পাশ্চাত্য নিক্তিতে। পশ্চিমা সভ্যতা যে পথে এগিয়েছে, সেপথকেই স্ট্যান্ডার্ড ধরে বিচার করতেন পবের প্রতিটা জ্ঞান আর অর্জনের শাখা-প্রশাখাকে। পশ্চিমের দেখানো পথে নয়, পুবের নিজস্ব পথে পুবের নিজস্ব সভ্যতা যে এগোতে পারে— তা বিশ্বাস করতেন না। সেই অর্থে তিনি ‘হীনমন্যতায় ভোগা উন্নাসিক পশ্চিমের' ভাবধারার নয় কি?]
ধান ভানতে গিয়ে অনেক খানি শিবের গীত গেয়ে ফেললাম! এবার আসি পয়েন্টে। আমার কৈশোর যেখানে জাফর ইকবাল, শীর্ষেন্দু কিংবা সমরেশদের তৈরি করা মায়াবী জগতে ডুব দিয়ে হয়ে ওঠতে পারত জ্বলমলে বহুবর্ণিল, সেখানে শিখে গিয়েছিলাম ঠোঁট গোল করে তাঁদের অবজ্ঞা করতে। মহাভারতের মত মহান পুরাণকে মনে করেছিলাম কিছু ধর্ম উন্মাদদের কাজ! পৃথিবীর কোনো শিল্পকেই ঘোরলাগা চোখে পড়ে ফেলার মত বিস্মিত হবার শক্তি হারিয়ে ফেলি তখনি। ফলে চারপাশে ঘিরে ধরে শূন্যতা। তিন গোয়েন্দাকে লাগতে থাকে ভীষণ বাজে আর খেলো! সমরেশ বা মিলনদের রহস্য উপন্যাস গল্পগুলো মনে জাগায় না আর কোনো আবেদন।
ভাগ্যিস, তখনই ডিজনি ওয়ার্ল্ডের বইগুলোর কিংবা হ্যান্স এন্ডারসনের রূপকথাগুলোর শক্তি টের পেয়েছিলাম অন্যভাবে! কিন্তু বুঝতে চেষ্টা করিনি অন্যের মতবাদগুলোও! নিজের সামান্য বোধবুদ্ধি দিয়ে যদি চেখে দেখতাম যে, 'গুরু যাহা বলিলেন তাহা' কতটুকু আমার জন্য প্রযোজ্য! নিজের মনেই স্থির করতে পারতাম, আমি সাহিত্য সমালোচক নই, সামান্য পাঠক— সুতরাং পাঠের আনন্দ নিয়েই থাকি; ব্যবচ্ছেদ করা যাবে পরে। তাহলে, কৈশোরের মুহূর্তগুলো এতো নীরস হয়ে ওঠত খুব সম্ভব। এইসবই বুঝেছি পরে, বেশ পরে— যখন, অকালেই পড়ে ফেলেছি ভারি ভারি সিরিয়াস বেশ কিছু বই-পত্র! ‘ফান'কে পেঁচার মত মুখ করে ফিরিয়ে দিয়েছি সিরিয়াসনেসের ঘোমটা পরে। এখন যখন পড়ছি সেইসব, টের পাচ্ছি সেইসব বইয়ের ইন্টারনাল শক্তি ঠিকই কিন্তু উপভোগ করতে পারছি না সেই প্রথম কৈশোরের মত মুগ্ধতা নিয়ে। আর আফসোস হচ্ছে ভেবে যে, কেন যে এগুলো পেলাম না প্রথম কৈশোরে! তাহলে সোনা হয়ে ফলত সময়টা।
সেই অভাব টা পূরণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছি, ডাউন করছি শিশু/কিশোর উপযোগী রাদুকা আর প্রগতি থেকে প্রকাশিত গাদা গাদা রাশিয়ান বই। পড়তে হয়ে আফসোসে ম্লান হয়ে যাচ্ছে মন বার বার; ইশ, এইসব পেতাম যদি আমার শৈশব-কৈশোরে! তাহলে শৈশব-কৈশোরের সেইসব বর্ণিল মুহূর্তগুলো হয়ে থাকত সমস্ত জীবনের অমূল্য নস্টালজিয়া! এখন জেনে গেছি সত্যটা, রহস্যে/রূপকথায় উত্তপ্ত হয়না কল্পনা! বুঁদ হয়ে থাকতে পারি না কোনো ‘শয়তানের চোখ' এ! এখন রোমান্সের চেয়ে ভাল লাগে জ্ঞানকে, বিস্মিত হইনা আর তেমন কিছুতেই— তাই এইসব পাঠের চেষ্টা যে, ব্যর্থ হবে, তাতে সন্দেহ নেই। তবুও করছি, কেননা, যা হারানোর তাতো হারিয়েছিই; এখন যতটুকু পাই ততোটুকু নিয়েই আঁকতে থাকি মুহূর্তগুলোঃ লাল-কালো হলুদ-সবুজ; তেল রং, জল রং, প্যাস্টেল; মূর্ত, বিমূর্ত!
এইসব হারিয়ে বুঝতে পারছি, পাঠের ক্ষেত্রে সব বয়সে সব বোধহয় মানায় না! শৈশবটা রোমান্সের জন্য, কৈশোরটা কবিতার (আক্ষরিক কবিতার কথা বলছি না, কবিতা কিংবা কবিতার মত রচনা) আর তারুণ্যটা জ্ঞানের। যে বয়সে যা মুহূর্তকে রাঙায়! শৈশবে রোমান্স, এই বয়সে আমি ছিলাম সবচেয়ে কল্পনাপ্রবণ, বিশ্বাসপ্রবণও; তাই। কৈশোরে স্বপ্ন দেখতাম প্রচুর, তা-ই কবিতার মত ঘোর দরকার ছিল। আর এখন যখন তরুণ বেলায়, হারিয়ে গেছে ছেলেবেলার বিস্মিত চোখের ঘোরলাগা মুগ্ধতা, এখন আমার জন্য দরকার জীবন সময় চারপাশ— সব বিষয়ে নির্মোহ হওয়া; অর্থাৎ, জ্ঞান। কিন্তু তা হয়নি ঠিকভাবে।
একটা শিশুকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করি না যে— ঈশ্বর বলে কিছু নেই; পরকাল এক মহাধাপ্পা; সামনে তাকালে যে আকাশকে মনে হয় নেমে গেছে আমাদের পরের গ্রামেই, তা একটা নির্জলা মিথ্যে; রূপকথার জগত বলে কিছু নেই— এইসব কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের আদিম কল্পনা! সে মেতে থাকুক একগাদা মিথ্যে আদিম কল্পনা নিয়ে। যে ছেলেটি সাত বছর বয়সেই মহাভারতের মায়াবি জগতের হাতছানিকে অবজ্ঞা করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা শিখে সেইসব তথাকথিত মিথ্যে কাহিনিকে, তাঁর কাছ থেকে আমি কিছুই আশা করি না! সে না পারবে নিজের জন্য মানবিক আর নিজস্ব কল্পনার একটা বর্ণিল জগত তৈরি করে নিতে, না পারবে একদিন আমাদের একদিন নতুন কিছু দিতে। বরং, যদি কোনো শিশু হয়ে ওঠে কাফকা, জয়েস, জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ কিংবা আইনস্টাইন— তবে শৈশব-কৈশোরে যেসব ছেলে আদিম কল্পনায় মেতে ছিল, তাদের ভেতর থেকেই হয়ে ওঠতে পারে কোন একজন যুগস্রষ্টা! যেছেলে ওয়ার্ল্ড ডিজনি, রাশিয়ান রূপকথা, ঠাকুর মার ঝুলি ইত্যাদি কাব্যিক ফ্যান্টাসি পড়ে পড়ে বড় হয়েছে, তারা যে একদিন রাসেল, আজাদ, ডকিন্স, ফুকো, চমস্কি প্রমুখ পড়ে আলোকিত হবে, তার বিশ্বাস আছে আমার তাদের ওপর। আর ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত মতামত, মানুষ হিসেবে একজন মানুষের প্রধান গুণ থাকা উচিৎ 'মানবিকতার ভিত্তিতে নৈতিক' হয়ে ওঠা। আর এটা একজন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী (কিন্তু ফ্যানাটিক নয়), এমন মানুষও হতে পারেন মানবিক।
আগের পয়েন্টে ফিরে যাই। হুমায়ুন আজাদ শিল্প-সাহিত্যে খুঁজতেন চেতনা; তাঁর প্রতিটা উপন্যাসে তিনি কাঁচের সিলিন্ডারে পরিমাপ করে ৭০ ভাগ দিতেন সবুজ রঙের প্রথাবিরোধী চেতনা, ২০ ভাগ হলুদ রঙের বিদ্রোহী যৌন চেতনা আর বাকি ১০ ভাগ রঙিন অন্যান্য চেতনা। তিনি সমাজের অন্যতম প্রধান হিপোক্রেসি ট্যাবু— যৌনতাকে নিয়ে প্রথাবিরোধী চেতনাধারী উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে সেইসব রচনাকে করে তুলেছিলেন অনেকাংশে ‘চটি'; আর দেশ এবং রাজনীতি নিয়ে প্রথাবিরোধী চেতনাধারী উপন্যাস লিখতে গিয়ে তাতে গ্যালনে গ্যালনে ভরে দিয়েছেন উপহাস আর বিদ্রুপ। এবং শিল্প তৈরি করতে গিয়ে লেপ্টে দিয়েছেন পশ্চিমা সভ্যতার আনুগত্যে লালিত উন্নাসিকতা!
তাঁর চেয়ে অনেক বেশি শিখছি শীর্ষেন্দুর এই কিশোর উপন্যাস, ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি' থেকে। ঘটনা ঠিক রেখে পরিস্থিতিকে কী করে উল্টে দেওয়া যায়, তা আজাদের কোনো উপন্যাস করে কখনো শিখতে পারিনি! হ্যাঁ, ক্লাশ সেভেনে থাকতে আমার উচিৎ হয়নি আজাদকে আকণ্ঠ পাঠ করা, তখন সমরেশ/শীর্ষেন্দু, অবনীন্দ্রনাথ কিংবা সুনীলেরা আমার জন্য অনেক সহায়ক হতেন।
তারচেয়ে বরং, তখন তাঁর কিশোরসাহিত্য কিংবা কবিতায় যদি পারতাম ডুবে থাকতে, তবুও কিছু হিস্যা শোধ করতে পারতাম আমার কৈশোরকে। তিনি আমাকে অল্প বয়সেই নির্মোহ হওয়ার পথ দেখিয়েছেন (যদিও স্থান বিশেষে তা ছিল ভুল পথ!), কিন্তু জীবনকে বহুবর্ণিল করে রাঙানোর পথ দেখান নি। এটা তাঁর উচিৎ হয়নি, একদম। কারণ, তাঁকে আমি 'তখন' অনেক ‘বিশ্বাস' করতাম!
লেখক পরিচিতি
কিঙ্কর আহসান
গল্পকার।
ব্লগার।
বাংলাদেশের জামালপুরে থাকেন।
তখন ভূতে ভরা অদ্ভুত শ্রীকান্তের লেখক শরৎচন্দ্রকে মনে হতে থাকে কুসংস্কারাচ্ছ অসামাজিক আবেগের লেখক! [এবং, ততোদিনে শিখে গেছি বাংলার সিংহভাগ সাহিত্যকে পরিহাস আর অবজ্ঞা করার কৌশল; গুরু যখন বললেন যে, সে লেখকই না— সেখানে তার মত নিকৃষ্ট লেখকই হয় না! হুমায়ুন আজাদ পশ্চিমবাংলার বর্তমান সময়ের কোনো লেখককেই মূল্য দিতেন না, সব সময় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেন; মাহমুদুল হক, শহিদুল জহির কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিল তার কাছে অনুল্লেখযোগ্য বাংলার স্থানীয় লেখক। কেননা, তিনি বাংলা সাহিত্যকে পরিমাপ করতেন পাশ্চাত্য নিক্তিতে। পশ্চিমা সভ্যতা যে পথে এগিয়েছে, সেপথকেই স্ট্যান্ডার্ড ধরে বিচার করতেন পবের প্রতিটা জ্ঞান আর অর্জনের শাখা-প্রশাখাকে। পশ্চিমের দেখানো পথে নয়, পুবের নিজস্ব পথে পুবের নিজস্ব সভ্যতা যে এগোতে পারে— তা বিশ্বাস করতেন না। সেই অর্থে তিনি ‘হীনমন্যতায় ভোগা উন্নাসিক পশ্চিমের' ভাবধারার নয় কি?]
ধান ভানতে গিয়ে অনেক খানি শিবের গীত গেয়ে ফেললাম! এবার আসি পয়েন্টে। আমার কৈশোর যেখানে জাফর ইকবাল, শীর্ষেন্দু কিংবা সমরেশদের তৈরি করা মায়াবী জগতে ডুব দিয়ে হয়ে ওঠতে পারত জ্বলমলে বহুবর্ণিল, সেখানে শিখে গিয়েছিলাম ঠোঁট গোল করে তাঁদের অবজ্ঞা করতে। মহাভারতের মত মহান পুরাণকে মনে করেছিলাম কিছু ধর্ম উন্মাদদের কাজ! পৃথিবীর কোনো শিল্পকেই ঘোরলাগা চোখে পড়ে ফেলার মত বিস্মিত হবার শক্তি হারিয়ে ফেলি তখনি। ফলে চারপাশে ঘিরে ধরে শূন্যতা। তিন গোয়েন্দাকে লাগতে থাকে ভীষণ বাজে আর খেলো! সমরেশ বা মিলনদের রহস্য উপন্যাস গল্পগুলো মনে জাগায় না আর কোনো আবেদন।
ভাগ্যিস, তখনই ডিজনি ওয়ার্ল্ডের বইগুলোর কিংবা হ্যান্স এন্ডারসনের রূপকথাগুলোর শক্তি টের পেয়েছিলাম অন্যভাবে! কিন্তু বুঝতে চেষ্টা করিনি অন্যের মতবাদগুলোও! নিজের সামান্য বোধবুদ্ধি দিয়ে যদি চেখে দেখতাম যে, 'গুরু যাহা বলিলেন তাহা' কতটুকু আমার জন্য প্রযোজ্য! নিজের মনেই স্থির করতে পারতাম, আমি সাহিত্য সমালোচক নই, সামান্য পাঠক— সুতরাং পাঠের আনন্দ নিয়েই থাকি; ব্যবচ্ছেদ করা যাবে পরে। তাহলে, কৈশোরের মুহূর্তগুলো এতো নীরস হয়ে ওঠত খুব সম্ভব। এইসবই বুঝেছি পরে, বেশ পরে— যখন, অকালেই পড়ে ফেলেছি ভারি ভারি সিরিয়াস বেশ কিছু বই-পত্র! ‘ফান'কে পেঁচার মত মুখ করে ফিরিয়ে দিয়েছি সিরিয়াসনেসের ঘোমটা পরে। এখন যখন পড়ছি সেইসব, টের পাচ্ছি সেইসব বইয়ের ইন্টারনাল শক্তি ঠিকই কিন্তু উপভোগ করতে পারছি না সেই প্রথম কৈশোরের মত মুগ্ধতা নিয়ে। আর আফসোস হচ্ছে ভেবে যে, কেন যে এগুলো পেলাম না প্রথম কৈশোরে! তাহলে সোনা হয়ে ফলত সময়টা।
সেই অভাব টা পূরণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছি, ডাউন করছি শিশু/কিশোর উপযোগী রাদুকা আর প্রগতি থেকে প্রকাশিত গাদা গাদা রাশিয়ান বই। পড়তে হয়ে আফসোসে ম্লান হয়ে যাচ্ছে মন বার বার; ইশ, এইসব পেতাম যদি আমার শৈশব-কৈশোরে! তাহলে শৈশব-কৈশোরের সেইসব বর্ণিল মুহূর্তগুলো হয়ে থাকত সমস্ত জীবনের অমূল্য নস্টালজিয়া! এখন জেনে গেছি সত্যটা, রহস্যে/রূপকথায় উত্তপ্ত হয়না কল্পনা! বুঁদ হয়ে থাকতে পারি না কোনো ‘শয়তানের চোখ' এ! এখন রোমান্সের চেয়ে ভাল লাগে জ্ঞানকে, বিস্মিত হইনা আর তেমন কিছুতেই— তাই এইসব পাঠের চেষ্টা যে, ব্যর্থ হবে, তাতে সন্দেহ নেই। তবুও করছি, কেননা, যা হারানোর তাতো হারিয়েছিই; এখন যতটুকু পাই ততোটুকু নিয়েই আঁকতে থাকি মুহূর্তগুলোঃ লাল-কালো হলুদ-সবুজ; তেল রং, জল রং, প্যাস্টেল; মূর্ত, বিমূর্ত!
এইসব হারিয়ে বুঝতে পারছি, পাঠের ক্ষেত্রে সব বয়সে সব বোধহয় মানায় না! শৈশবটা রোমান্সের জন্য, কৈশোরটা কবিতার (আক্ষরিক কবিতার কথা বলছি না, কবিতা কিংবা কবিতার মত রচনা) আর তারুণ্যটা জ্ঞানের। যে বয়সে যা মুহূর্তকে রাঙায়! শৈশবে রোমান্স, এই বয়সে আমি ছিলাম সবচেয়ে কল্পনাপ্রবণ, বিশ্বাসপ্রবণও; তাই। কৈশোরে স্বপ্ন দেখতাম প্রচুর, তা-ই কবিতার মত ঘোর দরকার ছিল। আর এখন যখন তরুণ বেলায়, হারিয়ে গেছে ছেলেবেলার বিস্মিত চোখের ঘোরলাগা মুগ্ধতা, এখন আমার জন্য দরকার জীবন সময় চারপাশ— সব বিষয়ে নির্মোহ হওয়া; অর্থাৎ, জ্ঞান। কিন্তু তা হয়নি ঠিকভাবে।
একটা শিশুকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করি না যে— ঈশ্বর বলে কিছু নেই; পরকাল এক মহাধাপ্পা; সামনে তাকালে যে আকাশকে মনে হয় নেমে গেছে আমাদের পরের গ্রামেই, তা একটা নির্জলা মিথ্যে; রূপকথার জগত বলে কিছু নেই— এইসব কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের আদিম কল্পনা! সে মেতে থাকুক একগাদা মিথ্যে আদিম কল্পনা নিয়ে। যে ছেলেটি সাত বছর বয়সেই মহাভারতের মায়াবি জগতের হাতছানিকে অবজ্ঞা করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা শিখে সেইসব তথাকথিত মিথ্যে কাহিনিকে, তাঁর কাছ থেকে আমি কিছুই আশা করি না! সে না পারবে নিজের জন্য মানবিক আর নিজস্ব কল্পনার একটা বর্ণিল জগত তৈরি করে নিতে, না পারবে একদিন আমাদের একদিন নতুন কিছু দিতে। বরং, যদি কোনো শিশু হয়ে ওঠে কাফকা, জয়েস, জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ কিংবা আইনস্টাইন— তবে শৈশব-কৈশোরে যেসব ছেলে আদিম কল্পনায় মেতে ছিল, তাদের ভেতর থেকেই হয়ে ওঠতে পারে কোন একজন যুগস্রষ্টা! যেছেলে ওয়ার্ল্ড ডিজনি, রাশিয়ান রূপকথা, ঠাকুর মার ঝুলি ইত্যাদি কাব্যিক ফ্যান্টাসি পড়ে পড়ে বড় হয়েছে, তারা যে একদিন রাসেল, আজাদ, ডকিন্স, ফুকো, চমস্কি প্রমুখ পড়ে আলোকিত হবে, তার বিশ্বাস আছে আমার তাদের ওপর। আর ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত মতামত, মানুষ হিসেবে একজন মানুষের প্রধান গুণ থাকা উচিৎ 'মানবিকতার ভিত্তিতে নৈতিক' হয়ে ওঠা। আর এটা একজন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী (কিন্তু ফ্যানাটিক নয়), এমন মানুষও হতে পারেন মানবিক।
আগের পয়েন্টে ফিরে যাই। হুমায়ুন আজাদ শিল্প-সাহিত্যে খুঁজতেন চেতনা; তাঁর প্রতিটা উপন্যাসে তিনি কাঁচের সিলিন্ডারে পরিমাপ করে ৭০ ভাগ দিতেন সবুজ রঙের প্রথাবিরোধী চেতনা, ২০ ভাগ হলুদ রঙের বিদ্রোহী যৌন চেতনা আর বাকি ১০ ভাগ রঙিন অন্যান্য চেতনা। তিনি সমাজের অন্যতম প্রধান হিপোক্রেসি ট্যাবু— যৌনতাকে নিয়ে প্রথাবিরোধী চেতনাধারী উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে সেইসব রচনাকে করে তুলেছিলেন অনেকাংশে ‘চটি'; আর দেশ এবং রাজনীতি নিয়ে প্রথাবিরোধী চেতনাধারী উপন্যাস লিখতে গিয়ে তাতে গ্যালনে গ্যালনে ভরে দিয়েছেন উপহাস আর বিদ্রুপ। এবং শিল্প তৈরি করতে গিয়ে লেপ্টে দিয়েছেন পশ্চিমা সভ্যতার আনুগত্যে লালিত উন্নাসিকতা!
তাঁর চেয়ে অনেক বেশি শিখছি শীর্ষেন্দুর এই কিশোর উপন্যাস, ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি' থেকে। ঘটনা ঠিক রেখে পরিস্থিতিকে কী করে উল্টে দেওয়া যায়, তা আজাদের কোনো উপন্যাস করে কখনো শিখতে পারিনি! হ্যাঁ, ক্লাশ সেভেনে থাকতে আমার উচিৎ হয়নি আজাদকে আকণ্ঠ পাঠ করা, তখন সমরেশ/শীর্ষেন্দু, অবনীন্দ্রনাথ কিংবা সুনীলেরা আমার জন্য অনেক সহায়ক হতেন।
তারচেয়ে বরং, তখন তাঁর কিশোরসাহিত্য কিংবা কবিতায় যদি পারতাম ডুবে থাকতে, তবুও কিছু হিস্যা শোধ করতে পারতাম আমার কৈশোরকে। তিনি আমাকে অল্প বয়সেই নির্মোহ হওয়ার পথ দেখিয়েছেন (যদিও স্থান বিশেষে তা ছিল ভুল পথ!), কিন্তু জীবনকে বহুবর্ণিল করে রাঙানোর পথ দেখান নি। এটা তাঁর উচিৎ হয়নি, একদম। কারণ, তাঁকে আমি 'তখন' অনেক ‘বিশ্বাস' করতাম!
![]() |
লেখক পরিচিতি
কিঙ্কর আহসান
গল্পকার।
ব্লগার।
বাংলাদেশের জামালপুরে থাকেন।
1 মন্তব্যসমূহ
কথায় কোথায় যেন অসামঞ্জস্য !
উত্তরমুছুন