অনুবাদ ও প্রাককথন : মুহিত হাসান
[ প্রাককথন : রে ব্র্যাডবেরি জন্ম নেন ১৯২০ সালের আগস্ট মাসের বাইশ তারিখে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের ওয়াকেগান শহরে। পেশায় একজন টেলিফোন লাইনম্যান হলেও তাঁর বাবার বই পড়ার খুব নেশা ছিল । যে নেশা কিনা ছোটবেলাতেই রে ব্র্যাডবেরির মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। কিশোর বয়স থেকেই তিনি লেখালেখি করতে শুরু করেন। আঠারো বছর বয়সে তাঁর প্রথম সায়েন্স-ফিকশন গল্প প্রকাশিত হয় একটি পত্রিকায়।
বাইশ বছর বয়স পেরুতে না পেরুতেই তিনি সম্পূর্ণরূপে নিজেকে লেখালেখির কাজে নিয়োজিত করেন। সাতাশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম গ্রন্থ, Dark Carnival প্রকাশিত হয়― যেটি ছিল একটি গল্পসংকলন। মূলত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লিখলেও ব্র্যাডবেরি একইসাথে বহু ভৌতিক, ফ্যান্টাসি ও রহস্য গল্প লিখে গিয়েছেন। কবিতাও লিখতেন তিনি। প্রাজ্ঞজনের ধারণা ― বিশ্বসাহিত্যে রে ব্র্যাডবেরির সবচেয়ে বড় অবদান এটাই যে, তিনি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি রচনার বাঁধা গৎটিকে পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছিলেন। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার মতে, ব্র্যাডবেরিই প্রথম দেখিয়েছিলেন, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিও মূলধারার সাহিত্যের মতো গভীর ও জীবনঘনিষ্ঠ। কথাসাহিত্যের এই নবতর ধারাটিকে নিছক জনপ্রিয়তার বদ্ধগলি থেকে বের করে এনে মূলধারার সাথে সংযুক্ত করার প্রকৃত কৃতিত্বও তাই তাঁকেই দিয়েছেন আলোচকেরা। চটকদার কাহিনি ও নেহাতই গাঁজাখুরি বিষয়-আশয় মিশিয়ে বৈজ্ঞানিক-কল্পকাহিনি লেখার প্রচলিত ক্লিশে ছক থেকে বেরিয়ে গিয়ে তিনি একে একে রচনা করেছিলেন এগারোটি উপন্যাস ও শতাধিক ছোটগল্প। কাব্যিকতা, দুর্লভ সাবলীল গদ্য, কাহিনির অদ্বিতীয় বুনোট ও চরিত্র-অঙ্কনের অভিনব ক্ষমতার জন্য তাঁর বেশিরভাগ লেখাই দারুণ সুখপাঠ্য। ডিসটোপিয়ান ঘরানার উপন্যাস ফারেনহাইট ৪৫১-কে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ও মহৎ রচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই উপন্যাসটি প্রকাশের পর গোটা বিশ্ব জুড়ে তাঁর খ্যাতি সহসাই ছড়িয়ে পড়ে; সাহিত্য-সমালোচকদের কাছেও বইটি আদরণীয় হয়েছিল। বাংলা ভাষার প্রখ্যাত লেখক ও চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ও তাঁর লেখার একজন ভক্ত ছিলেন― এমনকি তিনি রে ব্র্যাডবেরির একটি গল্পের অনুবাদ পর্যন্ত করেছিলেন সন্দেশ পত্রিকার জন্য। দীর্ঘদিন নানাবিধ রোগে ভোগার পর রে ব্র্যাডবেরি একানব্বই বছর বয়সে ২০১২ সালের পাঁচই জুন মৃত্যুবরণ করেন।
এখানে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পগ্রন্থগুলোর একটি, The Illustrated Man থেকে ‘Marionettes, Inc.শীর্ষক গল্পটির অনুবাদ করা হয়েছে। এই সংলাপ-প্রধান গল্পটিতে লেখক চিত্রিত করতে চেয়েছেন মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যেকার সংঘাতের দৃশ্যাবলি। দেখিয়েছেন, প্রযুক্তির ওপর মানবসমাজের মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতায় কীরকম ভয়ানক অস্থির অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। সমালোচকদের মতে, উক্ত গল্পটিকে যন্ত্রনির্ভর কৃত্রিম সমাজজীবনের উদ্দেশ্যে যুগপৎ যৌক্তিক ও তীক্ষè একটি সতর্কবার্তা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বিমানবিকীকরণের প্রক্রিয়াকে এখানে প্রচণ্ড তীর্যকভাবে অঙ্কিত করেছেন ব্র্যাডবেরি। মানবসমাজের ভেতরে তিলে তিলে বেড়ে ওঠা আসন্ন ভয়ানক বিপদের পূর্বাভাসই তিনি যেন সৃষ্টি করেছেন অসামান্য এক আখ্যান-বর্ণনার মাধ্যমে। এ কারণেই প্রায় ষাট বছর আগে প্রকাশিত হওয়া গল্পটির গুরুত্ব এবং প্রাসঙ্গিকতা এখনও ফুরিয়ে যায়নি বলে মনে করা হয়। তাই এই অনুবাদ-প্রচেষ্টা। ]
তারা দুজন আস্তে আস্তে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল রাত দশটার দিকে, কথা বলছে চাপা গলায়। দুজনের বয়স হয়তোবা প্রায় পঁয়ত্রিশ হবে, প্রত্যেকেই খুব সংযত ও স্থিরচিত্ত।
“এত তাড়াহুড়ো কেন করছো ?” স্মিথ বললো।
“কারণটা সম্পর্কে তুমি আগে থেকেই জানো,” ব্রিলিং উত্তর করলো।
“এতদিন পর এই প্রথম কোনো রাতে বাইরে বেরুলে, আর মাত্র দশটা বাজতে না বাজতেই বাড়ি ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়লে।”
“বোধহয় আমি দুশ্চিন্তায় ভুগছি বলেই এমনটা...”
“তুমি কী উপায়ে বিষয়টা সামাল দিলে চিন্তা করছি। আমি তোমার সাথে একদিন বসে চুপিচুপি মদ খাওয়ার একটা সুযোগ পাবার জন্য দশ দশখানা বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম — আর তুমি কিনা মাত্র এক নিশিথে বাইরে বের হয়েই হুটহাট বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছো।”
“ আমি আমার সৌভাগ্যটাকে ভুলে জলে ভাসিয়ে দিতে চাইছি না।”
“ কী করেছিলে তুমি, তোমার স্ত্রী’র কফিতে স্লিপিং-পাউডার মিশিয়ে দিয়েছিলে নাকি?”
“ নাহ, ওই কাজটা নেহাতই অনৈতিক হয়ে যেত। আসল ব্যাপারটা তুমি শীঘ্রই দেখতে পাবে।”
তারা একটা মোড় নিলো রাস্তায়।
“ কসম খেয়ে বলছি, ভায়া ব্রিলিং, আমার এটা দেখতে মোটেও ভাল লাগে না, কিন্তু তুমি তোমার স্ত্রী’র সাথে বড্ড ধীরস্থির আচরণ করো। তুমি হয়তো এটা মুখে কবুল করতে চাইবে না, কিন্তু আদতে এই দাম্পত্য জীবনটা তোমার জন্য ভয়ানক বিচ্ছিরি রকমের হয়ে উঠেছে, তাই নয় কি?”
“ আমি এরকম কোনো কথা কখনো বলিনি।”
“এরকম কথা চারপাশে রটে যায়— যেনতেন প্রকারেণ, ওখানে আর এখানে— কী করে সে তোমার সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছিল। সেই সময়ে, ১৯৭৯ সালে, যখন তুমি রিও-র পথে যাত্রা শুরু করেছিলে...”
“সেই রিও, এত্তসব পরিকল্পনা করেও যাকে শেষতক দেখা হয়নি আমার।”
“এবং সে নাকি নিজের জামা-কাপড় ছিঁড়ে ও চুল-টুল এলোমেলো করে ফেলে তোমাকে হুমকি দিয়েছিল যে তাকে বিয়ে না করলে সে পুলিশকে টেলিফোন করে খবর দেবে।”
“ভাই স্মিথ, ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো, সে সবসময়ই ওরকম উত্তেজিত স্বভাবের মেয়ে ছিল।”
“এটা আর কিছু ছিল না, স্রেফ একটা কুকর্ম । তুমি তাকে জীবনেও ভালবাসোনি, এ কথাটাও তাকে তো অনেকবার বলেছো— নাকি বলোনি?”
“ এটা যদিও ঠিকই, এ কথাটা আমি তাকে বহুবার বলেছি।”
“ তবুও তুমি ওকেই শেষমেশ বিয়ে করেছিলে...”
“ আমি তখন ব্যবসা করতাম, আর আমার বুড়ো বাবা-মা-কেও দেখাশোনা করতে হতো। আমি ওরকম কোনো কেলেংকারিতে ফেঁসে গেলে ব্যবসাও লাটে উঠতো, বাবা-মাও মনে ধাক্কা খেয়ে হয়তো মরে যেতেন। কাজেই ইজ্জতের খাতিরে বিয়েটা করে ফেলতে হলো আমাকে।”
“ এবং তারপর দেখতে দেখতে দশ বছর কেটে গেছে।”
“হুম,” ব্রিলিং বলে উঠলো, তার ধূসর চোখজোড়া যেন অনড়। “ কিন্তু আমি মনে করি পরিস্থিতি খুব সম্ভবত এখন খানিকটা পাল্টে গেছে । আমি এতদিন ধরে যে জিনিসটার জন্য প্রতীক্ষা করছিলাম, সেটা আমার হাতে এসে পড়েছে— এদিকে তাকাও।”
সে একটা লম্বাটে নীল টিকেট বের করে দেখালো।
“ কী হে, এ যে দেখছি বৃহস্পতিবারে রিওগামী রকেটের টিকেট!”
“ হ্যাঁ, শেষ অব্দি আমি ওখানে যাচ্ছিই।”
“বাব্বাহ, দারুণ! এটা তোমার অবশ্যই প্রাপ্য! কিন্তু তোমার স্ত্রী বাগড়া দেবে না তো আবার? গোলমাল করবে না?”
ব্রিলিং ঈষৎ দুশ্চিন্তার হাসি হাসলো। “আমি যে ওখানে গিয়েছি তা সে জানতেই পারবে না। আমি এক মাস পরেই ফিরে আসবো, শুধু তুমি ছাড়া কোনো এলাকার একটা কাকপক্ষীও কিছু জানতে পারবে না ।”
স্মিথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “যদি আমিও তোমার সাথে যেতে পারতাম...”
“আহারে দুর্ভাগা স্মিথ, তোমার সংসারটাও নিশ্চয়ই কোনো পুস্পশয্যা ছিল না?”
“ ঠিকই বলেছো, সেরকমটি ছিল না। আমিও এমন এক মহিলাকে বিয়ে করেছি যার সবকিছুতেই বেশি বেশি। মানে, সবকিছুর পরও— বিয়ের দশ বছর পার হবার পর তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না যে প্রতি সন্ধ্যায় তোমার সহধর্মিনী পাক্কা দুই ঘণ্টার জন্য কোলে এসে বসে থাকুক। বা, অফিসে তোমাকে দিনে ডজনবার ফোন করে বাচ্চাদের মতো ন্যাকা ন্যাকা কথা বলতে থাকুক। এবং গত মাস থেকে আমার আবার মনে হচ্ছে তার হাল আরও খারাপের দিকে গিয়েছে। বারবার এটাই ভাবছি, কেন সে এতটা সরলপনা ছাড়তে পারছে না এখনও।”
“নাহ স্মিথ, আজতক তুমি সেই গোঁড়াই থেকে গেলে। আচ্ছা ওসব কথা বরং থাক, আমরা বাড়ির সামনে চলে এসেছি। এখন তুমি নিশ্চয়ই আমার গোপন কথাটা জানতে আগ্রহী? কোন উপায়ে আমি এই সন্ধ্যায় বাইরে বেরুতে পেরেছি?”
“ তুমি সত্যি সত্যি বলবে?”
“ এদিকে দেখো!” ব্রিলিং বলে উঠলো।
তারা দুজনেই অন্ধকারের ভেতর দিয়ে তাকালো।
দোতলার জানালার কোণে একটা ছায়ামূর্তির হঠাৎ আবির্ভাব ঘটলো। একজন পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী লোক, চুলে হালকা পাক ধরেছে, ধূসর চোখ দুটোতেও দুঃখী দুঃখী ভাব, একটা ক্ষুদে পাতলা গোঁফও রয়েছে। সে আবার ওদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।
“ এ কী? এ যে তুমিই!” স্মিথ চিল্লিয়ে উঠলো।
“ শ্-শ্-শ্, এত জোরে চিৎকার করো না!” ব্রিলিং ওপরের দিকে হাত নাড়লো। জানালার ধারে দাঁড়ানো মানুষটা একটা ইঙ্গিতময় অঙ্গভঙ্গি করে ওখান থেকে তখনই উধাও হয়ে গেলো।
“ আমি নির্ঘাত পাগল-টাগল হয়ে গেছি,” স্মিথ নিজে থেকেই কথাটা বলে উঠলো।
“ সামান্য অপেক্ষা করো।”
ওরা দুজন দাঁড়িয়ে রইলো।
অ্যাপার্টমেন্টের সদর দরজা খুলে গেল, সাথে সেই ক্ষুদে গোঁফওলা ও ধূসর চোখের লম্বা রোগাপাতলা ভদ্রলোকটি বেরিয়ে এসে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো।
“ হ্যালো, ব্রিলিং, ” সে সম্ভাষণ জানালো।
“ হ্যালো, ব্রিলিং,” ব্রিলিংও যেন প্রতিধ্বনি করলো কথাটার।
তাদের দুজনের চেহারাই অবিকল একরকম।
স্মিথ বড় বড় চোখে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। “ ও কি তোমার যমজ ভাই? আমি তো কখনোই জানতাম না...”
“ আরে না না,” হালকা গলায় ব্রিলিং বললো। “ সামনে এসো, দুই নম্বর ব্রিলিংয়ের বুকে তোমার কান পাতো।”
স্মিথ হালকা দোনামোনা করার পরও অবশেষে এগিয়ে এসে দুই নম্বর ব্রিলিংয়ের বুকের খাঁচার ওপর কান পাতলো―
টিক-টিক-টিক-টিক-টিক-টিক-টিক...।
“ না! এটা কী করে সম্ভব হতে পারে!”
“হ্যাঁ,এটা সম্ভব।”
“ আবার শুনে দেখি তো।”
টিক-টিক-টিক-টিক-টিক-টিক-টিক...।
স্মিথ টলতে টলতে পিছিয়ে গেল, চোখের মনিদুটো বিস্ফারিত, কিঞ্চিৎ শঙ্কিতও সে। পরে আবার সামনে এসে জিনিসটার উষ্ণ হাত এবং গাল ছুঁয়ে দেখলো।
“ একে তুমি কোথা থেকে পেলে?”
“ ও বেশ কেতাদুরস্ত, তাই না?”
“ অবিশ্বাস্য। কোথায় পেলে একে বলো না?”
“ এই ভদ্রলোককে তোমার ভিজিটিং-কার্ডটা দাও, ব্রিলিং নাম্বার দুই।”
ব্রিলিং-দুই একরকমের হাতসাফাই করেই যেন একটা সাদা রঙের কার্ড বের করে আনলো, তাতে লেখা :
নাচিয়ে-পুতুল কোম্পানি
আপনার নিজের কিংবা বন্ধুগণের নকল নতুন হিউম্যানেড প্লাষ্টিক ১৯৯০ মডেল সবরকমের শারীরিক চেহারা প্রদানের নিশ্চয়তাসমেত প্রস্তুত করা হয়। দাম : মাত্র সাত হাজার ছয়শত ডলার থেকে শুরু করে পনেরো হাজার ডলারে আমাদের বিশেষ ডিলাক্স মডেল বিক্রয় করা হয়ে থাকে।
“না, এটা হতে পারে না।” স্মিথ বললো
“ হ্যাঁ, হতে পারে।” ব্রিলিং বলে উঠলো।
“ এটা তো অতি স্বাভাবিক ঘটনা।” এবার কথা বললো ব্রিলিং-দুই।
“ কতদিন হলো ওকে তুমি সংগ্রহ করেছো?”
“ মাসখানেক হলো। ওকে আমি বাড়ির মাটির নিচের ভাঁড়ারঘরের একটা টুলবক্সে রেখে দিয়েছি। আমার স্ত্রী কখনোই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে না। আর শুধু আমার কাছেই ওই বাক্সের তালা-চাবি গচ্ছিত আছে। আজ রাতে আমি ওকে বলেছিলাম সিগারেট কেনার জন্য একটু বাইরে যাবো। আমি ভাঁড়ারঘরে গিয়ে ব্রিলিং-দুইকে বাক্স থেকে বের করে তাকে আমার স্ত্রী’র কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এই কায়দা করেই আমি তোমার সাথে দেখা করতে চলে এসেছিলাম, স্মিথ।”
“ দারুণ! ওর শরীর থেকে তো তোমার পছন্দের বন্ড-স্ট্রিট ও মেলাক্রিনোস ব্র্যান্ডের সেন্টের গন্ধই ভাসছে!”
“ এটাকে নিয়ে চুলচেরা বিচার চলতে পারে, তবে আমি মনে করি একে ব্যবহার করাটা খুবই নৈতিক কিছু। সবকিছুর পরও, আমার স্ত্রী সবচেয়ে বেশি করে চায় আমার সঙ্গই। এই নাচিয়ে-পুতুলটা আমার সব সূক্ষ্মতম বৈশিষ্ট্যই ধারণ করেছে। আজকে ব্রিলিং-দুই পুরোটা সন্ধ্যা বাসায় আমার স্ত্রী’র সাথে থেকেছে। এবং সে আগামী একমাস আমার স্ত্রী’র সঙ্গেই বাড়িতে সময় কাটবে। ওই একই সময়ে আরেকজন ভদ্রলোক―অর্থাৎ আমি, রিওতে বেড়াতে যাবো দীর্ঘ দশ বছরের অপেক্ষা শেষে। যখন আমি রিও থেকে ফিরে আসবো, তখন ব্রিলিং-দুইকে আবার তার আপন বাক্সে ভরে রেখে দেবো।”
স্মিথ এক কি দুই মিনিট ভাবলো। “ ও এই একমাস ধরে নির্জল উপবাসে থেকে হাঁটাচলা করবে নাকি?” শেষ অব্দি সে জিজ্ঞেস করেই বসলো।
“দরকার পড়লে সে ছয় মাস উপবাসে থাকতে পারে। এবং তাকে একদম খাঁটি মানুষের মতো করেই বানানো হয়েছে — খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো, ঘেমে-নেয়ে সারা হওয়া―মানুষোচিত সব কাজকর্মই সে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে করতে পারে। তুমি নিশ্চয়ই ভালো করে আমার স্ত্রী’র যতœআত্তি করবে, করবে না ব্রিলিং-দুই?”
“ আপনার স্ত্রী বড়ই ভালো।” ব্রিলিং-দুই বলে উঠলো। “ আমি তাকে ভারি পছন্দ করে ফেলেছি।”
স্মিথ উত্তেজনায় দুলতে আরম্ভ করে দিয়েছিল। “ কতদিন ধরে নাচিয়ে-পুতুল কোম্পানি তাদের ব্যবসা আরম্ভ করেছে?”
“ গোপনীয়ভাবে দুই বছর ধরে চলছে।”
“ আমি যদি— আমি বলতে চাচ্ছি, এখানে কি কোনো সুযোগ—” স্মিথ তার বন্ধুর কনুই আঁকড়ে ধরলো আন্তরিকভাবে― “তুমি বলো তো, কোথায় গেলে আমি এমন একটা রোবট, একটা পুতুল জোগাড় করতে পারি নিজের জন্য? আমাকে ওদের ঠিকানাটা দাও না ভাই?”
“এই যে নাও।”
স্মিথ কার্ডটা নিয়ে কয়েকবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলো। “ ধন্যবাদ,” বললো সে। “ তুমি জানো না এটার দাম এখন আমার কাছে কতখানি। শুধু একটু বিশ্রাম চাই আমি—একটা সকাল বা রাতের জন্য , প্রতি মাসে মাত্র একবার অবসর পেলেই আমি সন্তুষ্ট। আমার স্ত্রী আমাকে এতটাই ভালোবাসে যে সে আমাকে এক ঘণ্টার জন্যও কোথায় বেরুতে দেয় না। আমিও যে ওকে খুব ভালোবাসি তা তুমি নিশ্চয়ই জানো, কিন্তু সেই পুরোনো কবিতাটাই ফের মনে করো: “ ধরলে আলতো করে, প্রেম যাবে উড়ে।/ বাঁধলে কঠিনভাবে, প্রেম যাবে মরে।” আমি ওর ভালোবাসার বন্ধন থেকে একটু ছাড়া পেতে চাই, একটু অবসর নিতে চাই।”
“ শেষমেশ তুমি ভাগ্যবানই, তোমার স্ত্রী তো তোমায় ভালোবাসে। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা খুবই বিদ্বেষময়, এবং মোটেও সহজ নয়।”
“ আহা, নেটি আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। এখন আমার কাজ হবে ওর ভালোবাসাকে দিব্যি স্বাচ্ছন্দ্যময় অবস্থায় নিয়ে আসা।”
“ শুভকামনা রইলো, স্মিথ। আমি যখন রিওতে থাকবো তখন আমার বাড়িতে যখন-তখন চলে এসো। তুমি যদি হুটহাট আসা-যাওয়া বন্ধ করে দাও তাহলে আমার স্ত্রী কিছু না কিছু সন্দেহ করে বসতে পারে। তুমি আমার সাথে স্বাভাবিকভাবে ঠিক যেমনটি করে থাকো, ব্রিলিং-দুইয়ের সাথে সেরকম আচরণই করবে।”
“ ঠিক আছে! বিদায়, ধন্যবাদ তোমাকে।”
হাসিমুখে স্মিথ রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করলো। ব্রিলিং ও ব্রিলিং-দুই ঘুরে অ্যাপার্টমেন্ট হলের দিকে হাঁটা দিলো।
ক্রসটাউনগামী বাসে উঠে স্মিথ মৃদুস্বরে শিস বাজাতে বাজাতে সাদা কার্ডটা আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করছিল :
গ্রাহকদের অবশ্যই বিষয়টি গোপন রাখতে অনুরোধ করা হচ্ছে। কারণ নাচিয়ে-পুতুল কোম্পানিকে বৈধতা দেবার জন্য একটি আইন এখনও সংসদে পাস হয়নি। ফলে আমদের তৈরি পুতুল ব্যবহার করা আজ পর্যন্ত আইনের চোখে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এজন্য যে কেউ তা ব্যবহার করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির নিকট ধরা পড়লে দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন।
“আচ্ছা আচ্ছা।” স্মিথ আপনমনে বলে উঠলো।
গ্রাহকদের অবশ্যই নিজের শরীরের মাংস দিয়ে একটা ছাঁচ ও কালার-ইনডেক্স তৈরি করতে দিতে হবে, যাতে তাদের চোখ, ঠোঁট, চুল, চামড়া ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্তর্ভুক্ত থাকবে । গ্রাহকদের অবশ্যই তাদের মডেল সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত অবস্থায় পাবার জন্য দুই মাস অপেক্ষা করতে হবে।
খুব বেশি সময় নয়, স্মিথ ভাবলো। দুই মাসের মধ্যেই ভেঙে নেওয়া পাঁজর জোড়া লাগার একটা সুযোগ পেয়ে যাবে। ক্ষতগুলো সেরে গিয়ে হাত দুটো সর্বদা যেমন ছিল ফের তেমনই হয়ে উঠবে। চোট লাগা বা কালশিটে পড়া ঠোঁটজোড়াও কদিন পর আপনা-আপনিই দেখতে আগের মতোন হয়ে যাবে। অতএব এরা যে নিমকহারাম তা আমি বলতে পারবো না...সে আপন মনে কথাগুলো আউরে কার্ডটা ওল্টালো:
নাচিয়ে-পুতুল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা হবার দুই বছরের মধ্যেই এর আড়ালে থাকা ক্রেতাদের সন্তুষ্টি অর্জনে নিপুণভাবে সক্ষম হয়েছে। আমাদের শ্লোগান হলো : “ কোনো সুতোর বাঁধন নয়”। ঠিকানা : ৪৩ সাউথ ওয়েসলি ড্রাইভ।
বাসটা তার নির্দিষ্ট স্টপেজে এসে দাঁড়ালো। স্মিথ নেমে পড়লো। যখন বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে সে উঠছে, তখন ভাবলো : নেটি ও আমার জয়েন্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পঞ্চাশ হাজার ডলার জমা রাখা আছে। আমি ব্যবসা সংক্রান্ত একটা কাজের অজুহাত দেখিয়ে ওখান থেকে মাত্র আট হাজার ডলার তুলে নেবো। খুব সম্ভবত নাচিয়ে-পুতুল কোম্পানি আমার টাকাটাও সুদে-মূলে ফেরিয়ে দেবে নানা আকারে-প্রকারে। নেটি জীবনেও জানতে পারবে না। স্মিথ দরজাটা খুলে দ্রুত শোবার ঘরে ঢুকলো। সেখানে নেটি শুয়ে আছে, নিস্প্রভ ও স্থূল― ঘুমোচ্ছে সন্ন্যাসিনীর মতো।
“প্রিয়তমা নেটি।” আধো অন্ধকারে তার সরল-পবিত্র মুখটা দেখে প্রবল মমতায় আবেগবিহ্বল হয়ে উঠলো স্মিথ। “তুমি যদি এখন জেগে থাকতে তাহলে নিশ্চয়ই তুমি আমাকে চুম্বনে চুম্বনে পূর্ণ করে দিতে, আমার কানের কাছে এসে আলতো স্বরে বলতে সোহাগমাখা কথা। সত্যি বলছি, তোমার কাছে এলে নিজেকে যেন একটা অপরাধী বলে মনে হয় আমার। তুমি আসলেই খুব ভালো ও প্রেমময়ী একজন স্ত্রী। মাঝে মধ্যে এটা আমি বিশ্বাস করতে পারি না যে তুমি তোমার সেই দীর্ঘদিনের প্রেমিক ব্রড চ্যাপম্যানের বদলে শেষ পর্যন্ত আমাকেই বিয়ে করেছিলে। স্মৃতি বলছে. গতমাসে তুমি আমাকে প্রচণ্ড বন্যভাবে ভালোবেসেছিলে― যা কিনা তুমি এর আগে কখনোই করোনি। ”
স্মিথের চোখে জল চলে এলো। আকস্মিকভাবে ওকে চুমু খাওয়ার ইচ্ছা হলো, ইচ্ছে হলো ওকে নিজের ভালোবাসার কথাটা বর্ণনা করতে, সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে অতীতকে ভুলে যেতে। কিন্তু সে এটা করতে গিয়েও ফিরে এলো, ওর হাতে হঠাৎই ব্যথা করে উঠলো। মনে হলো, যেন পাঁজরের হাড়গুলো মটমট করে ভেঙে যেতে শুরু করেছে― অস্ফূট আর্তনাদ করে উঠলো স্মিথ। থেমে সটান দাঁড়িয়ে গেল, তার চোখে কেমন এক ব্যথামাখা দৃষ্টি খেলা করছে― অতঃপর সে ঘুরে দাঁড়ালো। অন্ধকার ঘরগুলো পেরিয়ে হলরুমে এলো। তারপর লাইব্রেরীর ডেস্ক থেকে ব্যাংকের চেকবইটা বের করে নিলো চুপিচুপি। “মোটমাট আট হাজার ডলার শুধু নাও,” স্মিথ নিজেকেই নিজে বললো। “এর চেয়ে একটুও বেশি নয়।” থামলো হুট করে। “এক মিনিট অপেক্ষা করো”। আবার উন্মাদের মতো মরিয়া হয়ে চেকবইটা ভালোমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলো। “এখানেই তো রাখা ছিল!” সে চমকে উঠলো। “দশ হাজার ডলার খোয়া গেছে!” নড়েচড়ে বসলো স্মিথ। “মাত্র পাঁচ হাজার ডলার অবশিষ্ট পড়ে আছে! নেটি করেছেটা কী? সে এই টাকা দিয়ে কী করতে পারে? আরো কয়েকটা হ্যাট, আরো অনেকগুলো জামাকাপড়, আরো কয়েক শিশি দামী পারফিউম কিনেছে নির্ঘাত! অথবা, দাঁড়াও― আমি জানি! সে নিশ্চয়ই গত কয়েকমাস ধরে হাডসনের যে ছোট্ট বাড়িটার কথা বলছিল সেটাই কিনে ফেলেছে― এবং আমাকে তা বিন্দুমাত্র না জানিয়েই!”
দমকা হাওয়ার বেগে সে শোবার ঘরে এসে ঢুকলো, ক্রোধান্বিত ও ভয়ানকভাবে রুষ্ট। কী ভেবেছে নেটি― এভাবে তাদের টাকাগুলো নির্দ্বিধায় তুলে নেওয়াটা বুঝি খুব ভালো কাজ হয়েছে? কত বড় স্পর্ধা ওর! স্মিথ তার স্ত্রী’র ওপর ঝুঁকলো। “নেটি!” চিৎকার করে উঠলো সে। “নেটি, ওঠো বলছি!”
নেটি কোনো সাড়া শব্দ দিলো না। “তুমি আমার টাকাগুলো নিয়ে কী করেছো!” ষাঁড়ের মতো হেঁকে উঠলো স্মিথ।
সে এবার একটু কেঁপে উঠলো অস্থিরভাবে। রাস্তার বাতির আলো তার অনিন্দ্যসুন্দর নরম সফেদ গালে এসে পড়েছে। নির্ঘাত ওর কিছু একটা হয়ে গেছে। স্মিথের বুক ধড়ফড় করতে লাগলো, মুখও খটখটে শুকনো, সে রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে। আচম্বিতে সে হাঁটুতে শক্তি হারিয়ে ফেলে মাটিতে প্রায় বসে পড়েছে ― “নেটি, ও নেটি !” স্মিথ কেঁদেই ফেললো। “ তুমি আমার টাকাগুলো দিয়ে কী করেছো বলো না!”
আর তখনই, সেই ভয়ানক চিন্তাটা ওর মনে আঘাত করে বসলো। এবং সাথে সাথেই আতঙ্ক ও একাকীত্ব তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরলো। পরে যেন ওর গায়ে জ্বর এলো কাঁপুনি দিয়ে, সব ঘোরও নিমিষে কেটে গেল। মন সায় না দিলেও সামনে ঝুঁকলো স্মিথ, জ্বরগ্রস্ত অবস্থাতেই সে মনে মনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেটির বৃত্তাকৃতির গোলাপি বুকে কান পাতলো শক্তভাবে। “নেটি!” স্মিথ ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলো। কারণ, সে নেটির বুকে কান পেতে শুনতে পেয়েছিল :
টিক-টিক-টিক-টিক-টিক-টিক-টিক...।
স্মিথ যখন রাতের বেলা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, তখন ব্রিলিং ও ব্রিলিং-দুই অ্যাপার্টমেন্টের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। “আমার এটা ভেবে ভালো লাগছে যে, স্মিথও খুব সুখি হবে,” বললো ব্রিলিং।
“আজ্ঞে,” উদাস গলায় বললো ব্রিলিং-দুই।
“বেশ, একটু দেখো― নিচের ভাঁড়ারঘরে এই বাক্সের মধ্যেই তুমি থাকবে।” ব্রিলিং নাম্বার দুইয়ের হাত ধরে নিচ তলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো ব্রিলিং।
“ এই বিষয় নিয়েই আপনার সাথে আমি কিছু কথা বলতে চাই,” ব্রিলিং-দুই বলে উঠলো, ততক্ষণে তারা ভাঁড়ারঘরের কংক্রিট-মেঝের ওপর দিয়ে হাঁটা শুরু করেছে। “এই তলকুঠুরীখানা আমার মোটেও পছন্দ নয়, এমনকি এই টুলবক্সটাও আমার ভাল লাগে না একদম।”
“ আমি জায়গাটাকে আরো আরামদায়ক করে তোলার চেষ্টা করবো।”
“পুতুলদের তৈরিই করা হয় নড়াচড়া করার জন্য, শক্ত হয়ে শুয়ে থাকার জন্য নয়। আপনার একটা সংকীর্ণ বাক্সের মধ্যে দিনের অধিকাংশ সময় শুয়ে থাকতে কেমন লাগবে নিজেই বলুন?”
“ হুম―”
“আপনারও ওভাবে শুয়ে থাকতে মোটেও ভালো লাগবে না। আমি হেঁটে-দৌড়ে বেড়াবোই। আমাকে আটকে রাখার কোনো উপায় নেই। আমি নিঁখুতভাবে জীবন্ত ও আমারও আবেগ-অনুভূতি রয়েছে।”
“ এই অবস্থায় তো মাত্র কয়েকদিনের জন্য থাকবে। আমি রিওতে চলে গেলে তোমাকে আর বাক্সবন্দি হয়ে থাকতে হবে না। তুমি সে সময়ে চাইলে ওপরতলায়ও থাকতে পারবে।”
রগচটার মতো ফুঁসে উঠলো ব্রিলিং-দুই, “এবং যখন আপনি খুব দারুণ একটা সময় কাটিয়ে রিও থেকে ফিরে আসবেন, তখন আমি আবার সেই বাক্সে ফিরে যাবো।”
আসল ব্রিলিং বললো, “দোকান থেকে তো এটা কস্মিনকালেও বলা হয়নি যে তারা আমার কাছে একটি বেয়াড়া-পুতুল গছিয়ে দিয়েছে।”
“ আমাদের সম্পর্কে অনেক কিছুই ওরা জানে না।” ব্রিলিং-দুই বলে উঠলো। “ আমরা এখন একইসাথে আবেগী ও অনুভূতিপ্রবণ। আপনি রিওতে গিয়ে আরামসে হাসবেন আর সূর্যের তাপে গা জুড়াবেন, আর আমরা এখানে ঠাণ্ডার মাঝে পড়ে কাঁপতে থাকবো― এরকমটা চিন্তা করতেই আমার মহা ঘেন্না হয়।”
“ কিন্তু রিওতে ভ্রমণের আকাঙ্খা তো আমার গোটা জীবনের,” হালকা গলায় বললো ব্রিলিং। সে তৎক্ষণাৎ চোখ বুজতেই যেন দেখতে পেলো অথই সাগর, পর্বতমালা ও হলুদাভ রঙের বালু। মনে মনে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ শুনতে খুব ভালোই লাগছিল তার। ব্রিলিংয়ের আরো মনে হলো, সূর্যকিরণে তার কাঁধ চকচক করে উঠছে― খাসা এক পেয়ালা ওয়াইনে চুমুক দিচ্ছে একটু একটু করে।
“ আমি যে কখনোই রিওতে যেতে পারবো না,” আরেক ব্রিলিং বলে উঠলো। “ সে বিষয়ে আপনি কি কখনো কিছু ভেবেছেন?”
“উহু, আমি―”
“ এবং আরেকটা বিষয়, আপনার স্ত্রী।”
“ ওকে নিয়ে আবার কী হলো?” দরজার দিকে ধীরগতিতে এগোতে এগোতে ব্রিলিং জিজ্ঞেস করলো।
“ আমি তাকে বড্ড পছন্দ করতে আরম্ভ করে দিয়েছি।”
“ বাহ, তুমি নিজের কাজে আনন্দ পাচ্ছো জেনে মহা পরিতুষ্ট হলাম।” বিচলিত ভঙ্গিতে নিজের ঠোঁট চাটলো ব্রিলিং।
“ আপনি মনে হয় আসল কথাটা বুঝতে পারেননি। আমার মনে হচ্ছে― আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি।”
ব্রিলিং মাত্র এক পা এগিয়েই যেন জমে বরফ হয়ে গেলা। “এটা কী বললে তুমি?”
“আর আমি এটাও ভাবছি যে,” ব্রিলিং-দুই বললো, “রিও এত মনোহর একটা শহর এবং আমিও সেখানে কখনো যাইনি। এর সঙ্গে আমি তোমার স্ত্রী’র কথাও ভাবছি― আমি মনে করি যে আমরা প্রচণ্ড সুখি হতে পারবো।”
“খু-খুবই দারুণ,” সহজিয়া ভঙ্গিতে ঘুরে ব্রিলিং ভাঁড়ারঘরের সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো, “এখন একটু দাঁড়াতে বললে নিশ্চয়ই তুমি কিছু মনে করবে না, তাই নয় কি? আমার একটা ফোনকল করা দরকার।”
“ কাকে করবেন?” ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করলো ব্রিলিং-দুই।
“ তেমন হোমড়াচোমড়া কাউকে নয়।”
“ নাচিয়ে-পুতুল কোম্পানির কাছে ফোন করবেন নিশ্চয়ই? ওদেরকে বলবেন যাতে আমাকে এসে ফেরত নিয়ে যায়?”
“ আরে নাহ, ওরকম কিছু নয়!” দরজা দিয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করলো ব্রিলিং।
মুহূর্তেই একটা ভয়ানক শক্ত ধাতব-নির্মিত হাত তার বাহু জড়িয়ে ধরলো। “ খবরদার দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করবেন না!”
“ তোমার হাতজোড়া উঠিয়ে নাও!”
“না।”
“ আমার স্ত্রী কি তোমাকে এটা করতে শিখিয়ে দিয়েছে?”
“না।”
“ সে কি কিছু টের পেয়ে গেছে? সে তোমার সাথে কথা বলেছে নাকি? সে এতসব কাণ্ড আদৌ জানে? এই ঘটনাটা?” আর্তনাদ করে উঠলো ব্রিলিং। একটা হাত তখনই খুব জোরে তার মুখটা চেপে ধরলো।
“ আপনি সেটা কোনোদিনও জানতে পারবেন না, কোনোদিনও না।” মুচকি হাসলো ব্রিলিং-দুই।
ভয়ে খুব ছটফট করছে ব্রিলিং। “সে নির্ঘাত ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল, আর সে নিশ্চিতভাবেই তোমাকে এটা করার জন্য বাধ্য করেছে!”
ব্রিলিং-দুই জবাব না দিয়ে বললো, “ আমি এখন আপনাকে এই বাক্সে বন্দি করে রাখবো। বাক্সটা তালা দিয়ে আটকে দেবো। অবশেষে তালার একমাত্র চাবিটাও হারিয়ে ফেলবো। তারপর আপনার স্ত্রী’র জন্য রিওর আরেকটা টিকেট কিনবো।”
“একটু, একটুখানি অপেক্ষা করতে পারো তো তুমি ভাই, দাঁড়াও খানিকক্ষণ। হুড়োহুড়ি কোরো না। দয়া করে এসো এটা নিয়ে আলাপ করি!”
“চিরবিদায়, ব্রিলিং।”
এবার এক্কেবারে থমকে গেল ব্রিলিং, “চিরবিদায়? চিরবিদায় শব্দটা দিয়ে তুমি কী বোঝাতে চাইছ?”
মিনিট দশেক পর, মিসেস ব্রিলিং ঘুম থেকে উঠলেন। তিনি তার নিজের কোমল গালে হাত রাখলেন। টের পেলেন, কেউ সেখানে একটু আগেই চুমু খেয়েছে। হালকা শঙ্কিত হয়ে তিনি মুখ তুলে তাকালেন। “ওহ, তুমি এই কাজটা পুরো এক বছর পর করলে,” মৃদু গজগজ করে উঠলেন মিসেস ব্রিলিং। “আমরা এ ব্যাপারে যে আরো কী কী করতে পারি তা শীঘ্রই দেখতে পাবে,” কেউ একজন কথাটা বলে গেল বিনা সংকোচে।
[ প্রাককথন : রে ব্র্যাডবেরি জন্ম নেন ১৯২০ সালের আগস্ট মাসের বাইশ তারিখে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের ওয়াকেগান শহরে। পেশায় একজন টেলিফোন লাইনম্যান হলেও তাঁর বাবার বই পড়ার খুব নেশা ছিল । যে নেশা কিনা ছোটবেলাতেই রে ব্র্যাডবেরির মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। কিশোর বয়স থেকেই তিনি লেখালেখি করতে শুরু করেন। আঠারো বছর বয়সে তাঁর প্রথম সায়েন্স-ফিকশন গল্প প্রকাশিত হয় একটি পত্রিকায়।
বাইশ বছর বয়স পেরুতে না পেরুতেই তিনি সম্পূর্ণরূপে নিজেকে লেখালেখির কাজে নিয়োজিত করেন। সাতাশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম গ্রন্থ, Dark Carnival প্রকাশিত হয়― যেটি ছিল একটি গল্পসংকলন। মূলত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লিখলেও ব্র্যাডবেরি একইসাথে বহু ভৌতিক, ফ্যান্টাসি ও রহস্য গল্প লিখে গিয়েছেন। কবিতাও লিখতেন তিনি। প্রাজ্ঞজনের ধারণা ― বিশ্বসাহিত্যে রে ব্র্যাডবেরির সবচেয়ে বড় অবদান এটাই যে, তিনি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি রচনার বাঁধা গৎটিকে পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছিলেন। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার মতে, ব্র্যাডবেরিই প্রথম দেখিয়েছিলেন, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিও মূলধারার সাহিত্যের মতো গভীর ও জীবনঘনিষ্ঠ। কথাসাহিত্যের এই নবতর ধারাটিকে নিছক জনপ্রিয়তার বদ্ধগলি থেকে বের করে এনে মূলধারার সাথে সংযুক্ত করার প্রকৃত কৃতিত্বও তাই তাঁকেই দিয়েছেন আলোচকেরা। চটকদার কাহিনি ও নেহাতই গাঁজাখুরি বিষয়-আশয় মিশিয়ে বৈজ্ঞানিক-কল্পকাহিনি লেখার প্রচলিত ক্লিশে ছক থেকে বেরিয়ে গিয়ে তিনি একে একে রচনা করেছিলেন এগারোটি উপন্যাস ও শতাধিক ছোটগল্প। কাব্যিকতা, দুর্লভ সাবলীল গদ্য, কাহিনির অদ্বিতীয় বুনোট ও চরিত্র-অঙ্কনের অভিনব ক্ষমতার জন্য তাঁর বেশিরভাগ লেখাই দারুণ সুখপাঠ্য। ডিসটোপিয়ান ঘরানার উপন্যাস ফারেনহাইট ৪৫১-কে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ও মহৎ রচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই উপন্যাসটি প্রকাশের পর গোটা বিশ্ব জুড়ে তাঁর খ্যাতি সহসাই ছড়িয়ে পড়ে; সাহিত্য-সমালোচকদের কাছেও বইটি আদরণীয় হয়েছিল। বাংলা ভাষার প্রখ্যাত লেখক ও চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ও তাঁর লেখার একজন ভক্ত ছিলেন― এমনকি তিনি রে ব্র্যাডবেরির একটি গল্পের অনুবাদ পর্যন্ত করেছিলেন সন্দেশ পত্রিকার জন্য। দীর্ঘদিন নানাবিধ রোগে ভোগার পর রে ব্র্যাডবেরি একানব্বই বছর বয়সে ২০১২ সালের পাঁচই জুন মৃত্যুবরণ করেন।
এখানে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পগ্রন্থগুলোর একটি, The Illustrated Man থেকে ‘Marionettes, Inc.শীর্ষক গল্পটির অনুবাদ করা হয়েছে। এই সংলাপ-প্রধান গল্পটিতে লেখক চিত্রিত করতে চেয়েছেন মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যেকার সংঘাতের দৃশ্যাবলি। দেখিয়েছেন, প্রযুক্তির ওপর মানবসমাজের মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতায় কীরকম ভয়ানক অস্থির অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। সমালোচকদের মতে, উক্ত গল্পটিকে যন্ত্রনির্ভর কৃত্রিম সমাজজীবনের উদ্দেশ্যে যুগপৎ যৌক্তিক ও তীক্ষè একটি সতর্কবার্তা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বিমানবিকীকরণের প্রক্রিয়াকে এখানে প্রচণ্ড তীর্যকভাবে অঙ্কিত করেছেন ব্র্যাডবেরি। মানবসমাজের ভেতরে তিলে তিলে বেড়ে ওঠা আসন্ন ভয়ানক বিপদের পূর্বাভাসই তিনি যেন সৃষ্টি করেছেন অসামান্য এক আখ্যান-বর্ণনার মাধ্যমে। এ কারণেই প্রায় ষাট বছর আগে প্রকাশিত হওয়া গল্পটির গুরুত্ব এবং প্রাসঙ্গিকতা এখনও ফুরিয়ে যায়নি বলে মনে করা হয়। তাই এই অনুবাদ-প্রচেষ্টা। ]
তারা দুজন আস্তে আস্তে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল রাত দশটার দিকে, কথা বলছে চাপা গলায়। দুজনের বয়স হয়তোবা প্রায় পঁয়ত্রিশ হবে, প্রত্যেকেই খুব সংযত ও স্থিরচিত্ত।
“এত তাড়াহুড়ো কেন করছো ?” স্মিথ বললো।
“কারণটা সম্পর্কে তুমি আগে থেকেই জানো,” ব্রিলিং উত্তর করলো।
“এতদিন পর এই প্রথম কোনো রাতে বাইরে বেরুলে, আর মাত্র দশটা বাজতে না বাজতেই বাড়ি ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়লে।”
“বোধহয় আমি দুশ্চিন্তায় ভুগছি বলেই এমনটা...”
“তুমি কী উপায়ে বিষয়টা সামাল দিলে চিন্তা করছি। আমি তোমার সাথে একদিন বসে চুপিচুপি মদ খাওয়ার একটা সুযোগ পাবার জন্য দশ দশখানা বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম — আর তুমি কিনা মাত্র এক নিশিথে বাইরে বের হয়েই হুটহাট বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছো।”
“ আমি আমার সৌভাগ্যটাকে ভুলে জলে ভাসিয়ে দিতে চাইছি না।”
“ কী করেছিলে তুমি, তোমার স্ত্রী’র কফিতে স্লিপিং-পাউডার মিশিয়ে দিয়েছিলে নাকি?”
“ নাহ, ওই কাজটা নেহাতই অনৈতিক হয়ে যেত। আসল ব্যাপারটা তুমি শীঘ্রই দেখতে পাবে।”
তারা একটা মোড় নিলো রাস্তায়।
“ কসম খেয়ে বলছি, ভায়া ব্রিলিং, আমার এটা দেখতে মোটেও ভাল লাগে না, কিন্তু তুমি তোমার স্ত্রী’র সাথে বড্ড ধীরস্থির আচরণ করো। তুমি হয়তো এটা মুখে কবুল করতে চাইবে না, কিন্তু আদতে এই দাম্পত্য জীবনটা তোমার জন্য ভয়ানক বিচ্ছিরি রকমের হয়ে উঠেছে, তাই নয় কি?”
“ আমি এরকম কোনো কথা কখনো বলিনি।”
“এরকম কথা চারপাশে রটে যায়— যেনতেন প্রকারেণ, ওখানে আর এখানে— কী করে সে তোমার সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছিল। সেই সময়ে, ১৯৭৯ সালে, যখন তুমি রিও-র পথে যাত্রা শুরু করেছিলে...”
“সেই রিও, এত্তসব পরিকল্পনা করেও যাকে শেষতক দেখা হয়নি আমার।”
“এবং সে নাকি নিজের জামা-কাপড় ছিঁড়ে ও চুল-টুল এলোমেলো করে ফেলে তোমাকে হুমকি দিয়েছিল যে তাকে বিয়ে না করলে সে পুলিশকে টেলিফোন করে খবর দেবে।”
“ভাই স্মিথ, ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো, সে সবসময়ই ওরকম উত্তেজিত স্বভাবের মেয়ে ছিল।”
“এটা আর কিছু ছিল না, স্রেফ একটা কুকর্ম । তুমি তাকে জীবনেও ভালবাসোনি, এ কথাটাও তাকে তো অনেকবার বলেছো— নাকি বলোনি?”
“ এটা যদিও ঠিকই, এ কথাটা আমি তাকে বহুবার বলেছি।”
“ তবুও তুমি ওকেই শেষমেশ বিয়ে করেছিলে...”
“ আমি তখন ব্যবসা করতাম, আর আমার বুড়ো বাবা-মা-কেও দেখাশোনা করতে হতো। আমি ওরকম কোনো কেলেংকারিতে ফেঁসে গেলে ব্যবসাও লাটে উঠতো, বাবা-মাও মনে ধাক্কা খেয়ে হয়তো মরে যেতেন। কাজেই ইজ্জতের খাতিরে বিয়েটা করে ফেলতে হলো আমাকে।”
“ এবং তারপর দেখতে দেখতে দশ বছর কেটে গেছে।”
“হুম,” ব্রিলিং বলে উঠলো, তার ধূসর চোখজোড়া যেন অনড়। “ কিন্তু আমি মনে করি পরিস্থিতি খুব সম্ভবত এখন খানিকটা পাল্টে গেছে । আমি এতদিন ধরে যে জিনিসটার জন্য প্রতীক্ষা করছিলাম, সেটা আমার হাতে এসে পড়েছে— এদিকে তাকাও।”
সে একটা লম্বাটে নীল টিকেট বের করে দেখালো।
“ কী হে, এ যে দেখছি বৃহস্পতিবারে রিওগামী রকেটের টিকেট!”
“ হ্যাঁ, শেষ অব্দি আমি ওখানে যাচ্ছিই।”
“বাব্বাহ, দারুণ! এটা তোমার অবশ্যই প্রাপ্য! কিন্তু তোমার স্ত্রী বাগড়া দেবে না তো আবার? গোলমাল করবে না?”
ব্রিলিং ঈষৎ দুশ্চিন্তার হাসি হাসলো। “আমি যে ওখানে গিয়েছি তা সে জানতেই পারবে না। আমি এক মাস পরেই ফিরে আসবো, শুধু তুমি ছাড়া কোনো এলাকার একটা কাকপক্ষীও কিছু জানতে পারবে না ।”
স্মিথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “যদি আমিও তোমার সাথে যেতে পারতাম...”
“আহারে দুর্ভাগা স্মিথ, তোমার সংসারটাও নিশ্চয়ই কোনো পুস্পশয্যা ছিল না?”
“ ঠিকই বলেছো, সেরকমটি ছিল না। আমিও এমন এক মহিলাকে বিয়ে করেছি যার সবকিছুতেই বেশি বেশি। মানে, সবকিছুর পরও— বিয়ের দশ বছর পার হবার পর তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না যে প্রতি সন্ধ্যায় তোমার সহধর্মিনী পাক্কা দুই ঘণ্টার জন্য কোলে এসে বসে থাকুক। বা, অফিসে তোমাকে দিনে ডজনবার ফোন করে বাচ্চাদের মতো ন্যাকা ন্যাকা কথা বলতে থাকুক। এবং গত মাস থেকে আমার আবার মনে হচ্ছে তার হাল আরও খারাপের দিকে গিয়েছে। বারবার এটাই ভাবছি, কেন সে এতটা সরলপনা ছাড়তে পারছে না এখনও।”
“নাহ স্মিথ, আজতক তুমি সেই গোঁড়াই থেকে গেলে। আচ্ছা ওসব কথা বরং থাক, আমরা বাড়ির সামনে চলে এসেছি। এখন তুমি নিশ্চয়ই আমার গোপন কথাটা জানতে আগ্রহী? কোন উপায়ে আমি এই সন্ধ্যায় বাইরে বেরুতে পেরেছি?”
“ তুমি সত্যি সত্যি বলবে?”
“ এদিকে দেখো!” ব্রিলিং বলে উঠলো।
তারা দুজনেই অন্ধকারের ভেতর দিয়ে তাকালো।
দোতলার জানালার কোণে একটা ছায়ামূর্তির হঠাৎ আবির্ভাব ঘটলো। একজন পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী লোক, চুলে হালকা পাক ধরেছে, ধূসর চোখ দুটোতেও দুঃখী দুঃখী ভাব, একটা ক্ষুদে পাতলা গোঁফও রয়েছে। সে আবার ওদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।
“ এ কী? এ যে তুমিই!” স্মিথ চিল্লিয়ে উঠলো।
“ শ্-শ্-শ্, এত জোরে চিৎকার করো না!” ব্রিলিং ওপরের দিকে হাত নাড়লো। জানালার ধারে দাঁড়ানো মানুষটা একটা ইঙ্গিতময় অঙ্গভঙ্গি করে ওখান থেকে তখনই উধাও হয়ে গেলো।
“ আমি নির্ঘাত পাগল-টাগল হয়ে গেছি,” স্মিথ নিজে থেকেই কথাটা বলে উঠলো।
“ সামান্য অপেক্ষা করো।”
ওরা দুজন দাঁড়িয়ে রইলো।
অ্যাপার্টমেন্টের সদর দরজা খুলে গেল, সাথে সেই ক্ষুদে গোঁফওলা ও ধূসর চোখের লম্বা রোগাপাতলা ভদ্রলোকটি বেরিয়ে এসে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো।
“ হ্যালো, ব্রিলিং, ” সে সম্ভাষণ জানালো।
“ হ্যালো, ব্রিলিং,” ব্রিলিংও যেন প্রতিধ্বনি করলো কথাটার।
তাদের দুজনের চেহারাই অবিকল একরকম।
স্মিথ বড় বড় চোখে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। “ ও কি তোমার যমজ ভাই? আমি তো কখনোই জানতাম না...”
“ আরে না না,” হালকা গলায় ব্রিলিং বললো। “ সামনে এসো, দুই নম্বর ব্রিলিংয়ের বুকে তোমার কান পাতো।”
স্মিথ হালকা দোনামোনা করার পরও অবশেষে এগিয়ে এসে দুই নম্বর ব্রিলিংয়ের বুকের খাঁচার ওপর কান পাতলো―
টিক-টিক-টিক-টিক-টিক-টিক-টিক...।
“ না! এটা কী করে সম্ভব হতে পারে!”
“হ্যাঁ,এটা সম্ভব।”
“ আবার শুনে দেখি তো।”
টিক-টিক-টিক-টিক-টিক-টিক-টিক...।
স্মিথ টলতে টলতে পিছিয়ে গেল, চোখের মনিদুটো বিস্ফারিত, কিঞ্চিৎ শঙ্কিতও সে। পরে আবার সামনে এসে জিনিসটার উষ্ণ হাত এবং গাল ছুঁয়ে দেখলো।
“ একে তুমি কোথা থেকে পেলে?”
“ ও বেশ কেতাদুরস্ত, তাই না?”
“ অবিশ্বাস্য। কোথায় পেলে একে বলো না?”
“ এই ভদ্রলোককে তোমার ভিজিটিং-কার্ডটা দাও, ব্রিলিং নাম্বার দুই।”
ব্রিলিং-দুই একরকমের হাতসাফাই করেই যেন একটা সাদা রঙের কার্ড বের করে আনলো, তাতে লেখা :
নাচিয়ে-পুতুল কোম্পানি
আপনার নিজের কিংবা বন্ধুগণের নকল নতুন হিউম্যানেড প্লাষ্টিক ১৯৯০ মডেল সবরকমের শারীরিক চেহারা প্রদানের নিশ্চয়তাসমেত প্রস্তুত করা হয়। দাম : মাত্র সাত হাজার ছয়শত ডলার থেকে শুরু করে পনেরো হাজার ডলারে আমাদের বিশেষ ডিলাক্স মডেল বিক্রয় করা হয়ে থাকে।
“না, এটা হতে পারে না।” স্মিথ বললো
“ হ্যাঁ, হতে পারে।” ব্রিলিং বলে উঠলো।
“ এটা তো অতি স্বাভাবিক ঘটনা।” এবার কথা বললো ব্রিলিং-দুই।
“ কতদিন হলো ওকে তুমি সংগ্রহ করেছো?”
“ মাসখানেক হলো। ওকে আমি বাড়ির মাটির নিচের ভাঁড়ারঘরের একটা টুলবক্সে রেখে দিয়েছি। আমার স্ত্রী কখনোই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে না। আর শুধু আমার কাছেই ওই বাক্সের তালা-চাবি গচ্ছিত আছে। আজ রাতে আমি ওকে বলেছিলাম সিগারেট কেনার জন্য একটু বাইরে যাবো। আমি ভাঁড়ারঘরে গিয়ে ব্রিলিং-দুইকে বাক্স থেকে বের করে তাকে আমার স্ত্রী’র কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এই কায়দা করেই আমি তোমার সাথে দেখা করতে চলে এসেছিলাম, স্মিথ।”
“ দারুণ! ওর শরীর থেকে তো তোমার পছন্দের বন্ড-স্ট্রিট ও মেলাক্রিনোস ব্র্যান্ডের সেন্টের গন্ধই ভাসছে!”
“ এটাকে নিয়ে চুলচেরা বিচার চলতে পারে, তবে আমি মনে করি একে ব্যবহার করাটা খুবই নৈতিক কিছু। সবকিছুর পরও, আমার স্ত্রী সবচেয়ে বেশি করে চায় আমার সঙ্গই। এই নাচিয়ে-পুতুলটা আমার সব সূক্ষ্মতম বৈশিষ্ট্যই ধারণ করেছে। আজকে ব্রিলিং-দুই পুরোটা সন্ধ্যা বাসায় আমার স্ত্রী’র সাথে থেকেছে। এবং সে আগামী একমাস আমার স্ত্রী’র সঙ্গেই বাড়িতে সময় কাটবে। ওই একই সময়ে আরেকজন ভদ্রলোক―অর্থাৎ আমি, রিওতে বেড়াতে যাবো দীর্ঘ দশ বছরের অপেক্ষা শেষে। যখন আমি রিও থেকে ফিরে আসবো, তখন ব্রিলিং-দুইকে আবার তার আপন বাক্সে ভরে রেখে দেবো।”
স্মিথ এক কি দুই মিনিট ভাবলো। “ ও এই একমাস ধরে নির্জল উপবাসে থেকে হাঁটাচলা করবে নাকি?” শেষ অব্দি সে জিজ্ঞেস করেই বসলো।
“দরকার পড়লে সে ছয় মাস উপবাসে থাকতে পারে। এবং তাকে একদম খাঁটি মানুষের মতো করেই বানানো হয়েছে — খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো, ঘেমে-নেয়ে সারা হওয়া―মানুষোচিত সব কাজকর্মই সে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে করতে পারে। তুমি নিশ্চয়ই ভালো করে আমার স্ত্রী’র যতœআত্তি করবে, করবে না ব্রিলিং-দুই?”
“ আপনার স্ত্রী বড়ই ভালো।” ব্রিলিং-দুই বলে উঠলো। “ আমি তাকে ভারি পছন্দ করে ফেলেছি।”
স্মিথ উত্তেজনায় দুলতে আরম্ভ করে দিয়েছিল। “ কতদিন ধরে নাচিয়ে-পুতুল কোম্পানি তাদের ব্যবসা আরম্ভ করেছে?”
“ গোপনীয়ভাবে দুই বছর ধরে চলছে।”
“ আমি যদি— আমি বলতে চাচ্ছি, এখানে কি কোনো সুযোগ—” স্মিথ তার বন্ধুর কনুই আঁকড়ে ধরলো আন্তরিকভাবে― “তুমি বলো তো, কোথায় গেলে আমি এমন একটা রোবট, একটা পুতুল জোগাড় করতে পারি নিজের জন্য? আমাকে ওদের ঠিকানাটা দাও না ভাই?”
“এই যে নাও।”
স্মিথ কার্ডটা নিয়ে কয়েকবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলো। “ ধন্যবাদ,” বললো সে। “ তুমি জানো না এটার দাম এখন আমার কাছে কতখানি। শুধু একটু বিশ্রাম চাই আমি—একটা সকাল বা রাতের জন্য , প্রতি মাসে মাত্র একবার অবসর পেলেই আমি সন্তুষ্ট। আমার স্ত্রী আমাকে এতটাই ভালোবাসে যে সে আমাকে এক ঘণ্টার জন্যও কোথায় বেরুতে দেয় না। আমিও যে ওকে খুব ভালোবাসি তা তুমি নিশ্চয়ই জানো, কিন্তু সেই পুরোনো কবিতাটাই ফের মনে করো: “ ধরলে আলতো করে, প্রেম যাবে উড়ে।/ বাঁধলে কঠিনভাবে, প্রেম যাবে মরে।” আমি ওর ভালোবাসার বন্ধন থেকে একটু ছাড়া পেতে চাই, একটু অবসর নিতে চাই।”
“ শেষমেশ তুমি ভাগ্যবানই, তোমার স্ত্রী তো তোমায় ভালোবাসে। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা খুবই বিদ্বেষময়, এবং মোটেও সহজ নয়।”
“ আহা, নেটি আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। এখন আমার কাজ হবে ওর ভালোবাসাকে দিব্যি স্বাচ্ছন্দ্যময় অবস্থায় নিয়ে আসা।”
“ শুভকামনা রইলো, স্মিথ। আমি যখন রিওতে থাকবো তখন আমার বাড়িতে যখন-তখন চলে এসো। তুমি যদি হুটহাট আসা-যাওয়া বন্ধ করে দাও তাহলে আমার স্ত্রী কিছু না কিছু সন্দেহ করে বসতে পারে। তুমি আমার সাথে স্বাভাবিকভাবে ঠিক যেমনটি করে থাকো, ব্রিলিং-দুইয়ের সাথে সেরকম আচরণই করবে।”
“ ঠিক আছে! বিদায়, ধন্যবাদ তোমাকে।”
হাসিমুখে স্মিথ রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করলো। ব্রিলিং ও ব্রিলিং-দুই ঘুরে অ্যাপার্টমেন্ট হলের দিকে হাঁটা দিলো।
ক্রসটাউনগামী বাসে উঠে স্মিথ মৃদুস্বরে শিস বাজাতে বাজাতে সাদা কার্ডটা আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করছিল :
গ্রাহকদের অবশ্যই বিষয়টি গোপন রাখতে অনুরোধ করা হচ্ছে। কারণ নাচিয়ে-পুতুল কোম্পানিকে বৈধতা দেবার জন্য একটি আইন এখনও সংসদে পাস হয়নি। ফলে আমদের তৈরি পুতুল ব্যবহার করা আজ পর্যন্ত আইনের চোখে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এজন্য যে কেউ তা ব্যবহার করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির নিকট ধরা পড়লে দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন।
“আচ্ছা আচ্ছা।” স্মিথ আপনমনে বলে উঠলো।
গ্রাহকদের অবশ্যই নিজের শরীরের মাংস দিয়ে একটা ছাঁচ ও কালার-ইনডেক্স তৈরি করতে দিতে হবে, যাতে তাদের চোখ, ঠোঁট, চুল, চামড়া ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্তর্ভুক্ত থাকবে । গ্রাহকদের অবশ্যই তাদের মডেল সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত অবস্থায় পাবার জন্য দুই মাস অপেক্ষা করতে হবে।
খুব বেশি সময় নয়, স্মিথ ভাবলো। দুই মাসের মধ্যেই ভেঙে নেওয়া পাঁজর জোড়া লাগার একটা সুযোগ পেয়ে যাবে। ক্ষতগুলো সেরে গিয়ে হাত দুটো সর্বদা যেমন ছিল ফের তেমনই হয়ে উঠবে। চোট লাগা বা কালশিটে পড়া ঠোঁটজোড়াও কদিন পর আপনা-আপনিই দেখতে আগের মতোন হয়ে যাবে। অতএব এরা যে নিমকহারাম তা আমি বলতে পারবো না...সে আপন মনে কথাগুলো আউরে কার্ডটা ওল্টালো:
নাচিয়ে-পুতুল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা হবার দুই বছরের মধ্যেই এর আড়ালে থাকা ক্রেতাদের সন্তুষ্টি অর্জনে নিপুণভাবে সক্ষম হয়েছে। আমাদের শ্লোগান হলো : “ কোনো সুতোর বাঁধন নয়”। ঠিকানা : ৪৩ সাউথ ওয়েসলি ড্রাইভ।
বাসটা তার নির্দিষ্ট স্টপেজে এসে দাঁড়ালো। স্মিথ নেমে পড়লো। যখন বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে সে উঠছে, তখন ভাবলো : নেটি ও আমার জয়েন্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পঞ্চাশ হাজার ডলার জমা রাখা আছে। আমি ব্যবসা সংক্রান্ত একটা কাজের অজুহাত দেখিয়ে ওখান থেকে মাত্র আট হাজার ডলার তুলে নেবো। খুব সম্ভবত নাচিয়ে-পুতুল কোম্পানি আমার টাকাটাও সুদে-মূলে ফেরিয়ে দেবে নানা আকারে-প্রকারে। নেটি জীবনেও জানতে পারবে না। স্মিথ দরজাটা খুলে দ্রুত শোবার ঘরে ঢুকলো। সেখানে নেটি শুয়ে আছে, নিস্প্রভ ও স্থূল― ঘুমোচ্ছে সন্ন্যাসিনীর মতো।
“প্রিয়তমা নেটি।” আধো অন্ধকারে তার সরল-পবিত্র মুখটা দেখে প্রবল মমতায় আবেগবিহ্বল হয়ে উঠলো স্মিথ। “তুমি যদি এখন জেগে থাকতে তাহলে নিশ্চয়ই তুমি আমাকে চুম্বনে চুম্বনে পূর্ণ করে দিতে, আমার কানের কাছে এসে আলতো স্বরে বলতে সোহাগমাখা কথা। সত্যি বলছি, তোমার কাছে এলে নিজেকে যেন একটা অপরাধী বলে মনে হয় আমার। তুমি আসলেই খুব ভালো ও প্রেমময়ী একজন স্ত্রী। মাঝে মধ্যে এটা আমি বিশ্বাস করতে পারি না যে তুমি তোমার সেই দীর্ঘদিনের প্রেমিক ব্রড চ্যাপম্যানের বদলে শেষ পর্যন্ত আমাকেই বিয়ে করেছিলে। স্মৃতি বলছে. গতমাসে তুমি আমাকে প্রচণ্ড বন্যভাবে ভালোবেসেছিলে― যা কিনা তুমি এর আগে কখনোই করোনি। ”
স্মিথের চোখে জল চলে এলো। আকস্মিকভাবে ওকে চুমু খাওয়ার ইচ্ছা হলো, ইচ্ছে হলো ওকে নিজের ভালোবাসার কথাটা বর্ণনা করতে, সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে অতীতকে ভুলে যেতে। কিন্তু সে এটা করতে গিয়েও ফিরে এলো, ওর হাতে হঠাৎই ব্যথা করে উঠলো। মনে হলো, যেন পাঁজরের হাড়গুলো মটমট করে ভেঙে যেতে শুরু করেছে― অস্ফূট আর্তনাদ করে উঠলো স্মিথ। থেমে সটান দাঁড়িয়ে গেল, তার চোখে কেমন এক ব্যথামাখা দৃষ্টি খেলা করছে― অতঃপর সে ঘুরে দাঁড়ালো। অন্ধকার ঘরগুলো পেরিয়ে হলরুমে এলো। তারপর লাইব্রেরীর ডেস্ক থেকে ব্যাংকের চেকবইটা বের করে নিলো চুপিচুপি। “মোটমাট আট হাজার ডলার শুধু নাও,” স্মিথ নিজেকেই নিজে বললো। “এর চেয়ে একটুও বেশি নয়।” থামলো হুট করে। “এক মিনিট অপেক্ষা করো”। আবার উন্মাদের মতো মরিয়া হয়ে চেকবইটা ভালোমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলো। “এখানেই তো রাখা ছিল!” সে চমকে উঠলো। “দশ হাজার ডলার খোয়া গেছে!” নড়েচড়ে বসলো স্মিথ। “মাত্র পাঁচ হাজার ডলার অবশিষ্ট পড়ে আছে! নেটি করেছেটা কী? সে এই টাকা দিয়ে কী করতে পারে? আরো কয়েকটা হ্যাট, আরো অনেকগুলো জামাকাপড়, আরো কয়েক শিশি দামী পারফিউম কিনেছে নির্ঘাত! অথবা, দাঁড়াও― আমি জানি! সে নিশ্চয়ই গত কয়েকমাস ধরে হাডসনের যে ছোট্ট বাড়িটার কথা বলছিল সেটাই কিনে ফেলেছে― এবং আমাকে তা বিন্দুমাত্র না জানিয়েই!”
দমকা হাওয়ার বেগে সে শোবার ঘরে এসে ঢুকলো, ক্রোধান্বিত ও ভয়ানকভাবে রুষ্ট। কী ভেবেছে নেটি― এভাবে তাদের টাকাগুলো নির্দ্বিধায় তুলে নেওয়াটা বুঝি খুব ভালো কাজ হয়েছে? কত বড় স্পর্ধা ওর! স্মিথ তার স্ত্রী’র ওপর ঝুঁকলো। “নেটি!” চিৎকার করে উঠলো সে। “নেটি, ওঠো বলছি!”
নেটি কোনো সাড়া শব্দ দিলো না। “তুমি আমার টাকাগুলো নিয়ে কী করেছো!” ষাঁড়ের মতো হেঁকে উঠলো স্মিথ।
সে এবার একটু কেঁপে উঠলো অস্থিরভাবে। রাস্তার বাতির আলো তার অনিন্দ্যসুন্দর নরম সফেদ গালে এসে পড়েছে। নির্ঘাত ওর কিছু একটা হয়ে গেছে। স্মিথের বুক ধড়ফড় করতে লাগলো, মুখও খটখটে শুকনো, সে রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে। আচম্বিতে সে হাঁটুতে শক্তি হারিয়ে ফেলে মাটিতে প্রায় বসে পড়েছে ― “নেটি, ও নেটি !” স্মিথ কেঁদেই ফেললো। “ তুমি আমার টাকাগুলো দিয়ে কী করেছো বলো না!”
আর তখনই, সেই ভয়ানক চিন্তাটা ওর মনে আঘাত করে বসলো। এবং সাথে সাথেই আতঙ্ক ও একাকীত্ব তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরলো। পরে যেন ওর গায়ে জ্বর এলো কাঁপুনি দিয়ে, সব ঘোরও নিমিষে কেটে গেল। মন সায় না দিলেও সামনে ঝুঁকলো স্মিথ, জ্বরগ্রস্ত অবস্থাতেই সে মনে মনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেটির বৃত্তাকৃতির গোলাপি বুকে কান পাতলো শক্তভাবে। “নেটি!” স্মিথ ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলো। কারণ, সে নেটির বুকে কান পেতে শুনতে পেয়েছিল :
টিক-টিক-টিক-টিক-টিক-টিক-টিক...।
স্মিথ যখন রাতের বেলা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, তখন ব্রিলিং ও ব্রিলিং-দুই অ্যাপার্টমেন্টের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। “আমার এটা ভেবে ভালো লাগছে যে, স্মিথও খুব সুখি হবে,” বললো ব্রিলিং।
“আজ্ঞে,” উদাস গলায় বললো ব্রিলিং-দুই।
“বেশ, একটু দেখো― নিচের ভাঁড়ারঘরে এই বাক্সের মধ্যেই তুমি থাকবে।” ব্রিলিং নাম্বার দুইয়ের হাত ধরে নিচ তলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো ব্রিলিং।
“ এই বিষয় নিয়েই আপনার সাথে আমি কিছু কথা বলতে চাই,” ব্রিলিং-দুই বলে উঠলো, ততক্ষণে তারা ভাঁড়ারঘরের কংক্রিট-মেঝের ওপর দিয়ে হাঁটা শুরু করেছে। “এই তলকুঠুরীখানা আমার মোটেও পছন্দ নয়, এমনকি এই টুলবক্সটাও আমার ভাল লাগে না একদম।”
“ আমি জায়গাটাকে আরো আরামদায়ক করে তোলার চেষ্টা করবো।”
“পুতুলদের তৈরিই করা হয় নড়াচড়া করার জন্য, শক্ত হয়ে শুয়ে থাকার জন্য নয়। আপনার একটা সংকীর্ণ বাক্সের মধ্যে দিনের অধিকাংশ সময় শুয়ে থাকতে কেমন লাগবে নিজেই বলুন?”
“ হুম―”
“আপনারও ওভাবে শুয়ে থাকতে মোটেও ভালো লাগবে না। আমি হেঁটে-দৌড়ে বেড়াবোই। আমাকে আটকে রাখার কোনো উপায় নেই। আমি নিঁখুতভাবে জীবন্ত ও আমারও আবেগ-অনুভূতি রয়েছে।”
“ এই অবস্থায় তো মাত্র কয়েকদিনের জন্য থাকবে। আমি রিওতে চলে গেলে তোমাকে আর বাক্সবন্দি হয়ে থাকতে হবে না। তুমি সে সময়ে চাইলে ওপরতলায়ও থাকতে পারবে।”
রগচটার মতো ফুঁসে উঠলো ব্রিলিং-দুই, “এবং যখন আপনি খুব দারুণ একটা সময় কাটিয়ে রিও থেকে ফিরে আসবেন, তখন আমি আবার সেই বাক্সে ফিরে যাবো।”
আসল ব্রিলিং বললো, “দোকান থেকে তো এটা কস্মিনকালেও বলা হয়নি যে তারা আমার কাছে একটি বেয়াড়া-পুতুল গছিয়ে দিয়েছে।”
“ আমাদের সম্পর্কে অনেক কিছুই ওরা জানে না।” ব্রিলিং-দুই বলে উঠলো। “ আমরা এখন একইসাথে আবেগী ও অনুভূতিপ্রবণ। আপনি রিওতে গিয়ে আরামসে হাসবেন আর সূর্যের তাপে গা জুড়াবেন, আর আমরা এখানে ঠাণ্ডার মাঝে পড়ে কাঁপতে থাকবো― এরকমটা চিন্তা করতেই আমার মহা ঘেন্না হয়।”
“ কিন্তু রিওতে ভ্রমণের আকাঙ্খা তো আমার গোটা জীবনের,” হালকা গলায় বললো ব্রিলিং। সে তৎক্ষণাৎ চোখ বুজতেই যেন দেখতে পেলো অথই সাগর, পর্বতমালা ও হলুদাভ রঙের বালু। মনে মনে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ শুনতে খুব ভালোই লাগছিল তার। ব্রিলিংয়ের আরো মনে হলো, সূর্যকিরণে তার কাঁধ চকচক করে উঠছে― খাসা এক পেয়ালা ওয়াইনে চুমুক দিচ্ছে একটু একটু করে।
“ আমি যে কখনোই রিওতে যেতে পারবো না,” আরেক ব্রিলিং বলে উঠলো। “ সে বিষয়ে আপনি কি কখনো কিছু ভেবেছেন?”
“উহু, আমি―”
“ এবং আরেকটা বিষয়, আপনার স্ত্রী।”
“ ওকে নিয়ে আবার কী হলো?” দরজার দিকে ধীরগতিতে এগোতে এগোতে ব্রিলিং জিজ্ঞেস করলো।
“ আমি তাকে বড্ড পছন্দ করতে আরম্ভ করে দিয়েছি।”
“ বাহ, তুমি নিজের কাজে আনন্দ পাচ্ছো জেনে মহা পরিতুষ্ট হলাম।” বিচলিত ভঙ্গিতে নিজের ঠোঁট চাটলো ব্রিলিং।
“ আপনি মনে হয় আসল কথাটা বুঝতে পারেননি। আমার মনে হচ্ছে― আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি।”
ব্রিলিং মাত্র এক পা এগিয়েই যেন জমে বরফ হয়ে গেলা। “এটা কী বললে তুমি?”
“আর আমি এটাও ভাবছি যে,” ব্রিলিং-দুই বললো, “রিও এত মনোহর একটা শহর এবং আমিও সেখানে কখনো যাইনি। এর সঙ্গে আমি তোমার স্ত্রী’র কথাও ভাবছি― আমি মনে করি যে আমরা প্রচণ্ড সুখি হতে পারবো।”
“খু-খুবই দারুণ,” সহজিয়া ভঙ্গিতে ঘুরে ব্রিলিং ভাঁড়ারঘরের সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো, “এখন একটু দাঁড়াতে বললে নিশ্চয়ই তুমি কিছু মনে করবে না, তাই নয় কি? আমার একটা ফোনকল করা দরকার।”
“ কাকে করবেন?” ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করলো ব্রিলিং-দুই।
“ তেমন হোমড়াচোমড়া কাউকে নয়।”
“ নাচিয়ে-পুতুল কোম্পানির কাছে ফোন করবেন নিশ্চয়ই? ওদেরকে বলবেন যাতে আমাকে এসে ফেরত নিয়ে যায়?”
“ আরে নাহ, ওরকম কিছু নয়!” দরজা দিয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করলো ব্রিলিং।
মুহূর্তেই একটা ভয়ানক শক্ত ধাতব-নির্মিত হাত তার বাহু জড়িয়ে ধরলো। “ খবরদার দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করবেন না!”
“ তোমার হাতজোড়া উঠিয়ে নাও!”
“না।”
“ আমার স্ত্রী কি তোমাকে এটা করতে শিখিয়ে দিয়েছে?”
“না।”
“ সে কি কিছু টের পেয়ে গেছে? সে তোমার সাথে কথা বলেছে নাকি? সে এতসব কাণ্ড আদৌ জানে? এই ঘটনাটা?” আর্তনাদ করে উঠলো ব্রিলিং। একটা হাত তখনই খুব জোরে তার মুখটা চেপে ধরলো।
“ আপনি সেটা কোনোদিনও জানতে পারবেন না, কোনোদিনও না।” মুচকি হাসলো ব্রিলিং-দুই।
ভয়ে খুব ছটফট করছে ব্রিলিং। “সে নির্ঘাত ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল, আর সে নিশ্চিতভাবেই তোমাকে এটা করার জন্য বাধ্য করেছে!”
ব্রিলিং-দুই জবাব না দিয়ে বললো, “ আমি এখন আপনাকে এই বাক্সে বন্দি করে রাখবো। বাক্সটা তালা দিয়ে আটকে দেবো। অবশেষে তালার একমাত্র চাবিটাও হারিয়ে ফেলবো। তারপর আপনার স্ত্রী’র জন্য রিওর আরেকটা টিকেট কিনবো।”
“একটু, একটুখানি অপেক্ষা করতে পারো তো তুমি ভাই, দাঁড়াও খানিকক্ষণ। হুড়োহুড়ি কোরো না। দয়া করে এসো এটা নিয়ে আলাপ করি!”
“চিরবিদায়, ব্রিলিং।”
এবার এক্কেবারে থমকে গেল ব্রিলিং, “চিরবিদায়? চিরবিদায় শব্দটা দিয়ে তুমি কী বোঝাতে চাইছ?”
মিনিট দশেক পর, মিসেস ব্রিলিং ঘুম থেকে উঠলেন। তিনি তার নিজের কোমল গালে হাত রাখলেন। টের পেলেন, কেউ সেখানে একটু আগেই চুমু খেয়েছে। হালকা শঙ্কিত হয়ে তিনি মুখ তুলে তাকালেন। “ওহ, তুমি এই কাজটা পুরো এক বছর পর করলে,” মৃদু গজগজ করে উঠলেন মিসেস ব্রিলিং। “আমরা এ ব্যাপারে যে আরো কী কী করতে পারি তা শীঘ্রই দেখতে পাবে,” কেউ একজন কথাটা বলে গেল বিনা সংকোচে।
0 মন্তব্যসমূহ