‘জীবনের জটিল ঘটনাবলী-সম্পৃক্ত রাজনীতির কথা বাদ দিলেও আন্দোলন-কেন্দ্রিক সমসাময়িক সমাজের আলোড়ন বিক্ষোভ ইত্যাদি, প্রচলিত তরল ও সীমিত অর্থে রাজনীতির ব্যবহার, সাহিত্যে সুপ্রাচীন। অন্তত মহৎ লেখকেরা এ বিষয়ে আমাদের অনেকের মতো ছুৎমার্গী ছিলেন না-- ইস্কাইলাস, ভার্জিল, দান্তে, মিলটন, গেটে, রবীন্দ্রনাথের রচনাবলী তার প্রমাণ।” (কার্তিক লাহিড়ী, বাস্তবতা ও বাংলা উপন্যাস)
সরাসরি রাজনীতির ব্যবহার সাহিত্যকে দুর্বল করতে পারে। একথা বহুবার আমরা শুনেছি। কিন্তু সতীনাথ সাহিত্যে একথা মেনেও ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকে। কারণ ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে সতীনাথ ভাদুড়ীর (১৯০৬-৬৫) জন্ম। উপন্যাসকার হিসেবে খ্যাত এই কথাশিল্পীর গল্প যেন উপন্যাসেরই এক সুসংহত রূপ। তবুও তাঁর গল্প মানবজীবনের বিচিত্র মাত্রা-চিহ্নিত। তাঁর গল্পে আছে রাজনৈতিক হঠকারি চরিত্র; আবার অবজ্ঞাত অবাঞ্ছিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উপস্থাপনে বহুমাত্রিক। বাংলার বাইরে বিহারে বাস করেছেন তিনি। তাঁর গল্পের মানুষও অঞ্চলের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের ধারক। কিন্তু মানুষের জটিল-কুটিল ভঙ্গি ও অমার্জিত ত্রুটি তাঁর ক্ষমার অধীন নয়। প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ তাঁকে দ-মুণ্ডের বিধানকর্তাদের মুখোশ খুলে দেয়। সুতীক্ষ্ণ বিদ্রুপের ছুড়ি চালিয়ে তিনি তাদের চরিত্র সংশোধনের পথ বাতলান। তাঁর গল্পের চরিত্রগুলো যেন এক দুঃসহ কালের অভিযাত্রী। তারা অতিক্রম করে জটিল বন্ধুর রাষ্ট্র-সমাজের প্রদোষলগ্ন। বিষয়ের বক্তব্যধর্মিতাকে তিনি অতিক্রম করেন অভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতায়। ফলে গল্পকে শৈলী বিবেচনার পাশ কাটিয়ে তাঁকে দায়িত্বশীল কথাশিল্পীর তকমা এঁটে দিতে হয়।
সতীনাথ ভাদুড়ীর খ্যাতি ঘটেছে উপন্যাসের শিল্পী হিসেবে। ঢোঁড়াই চরিতমানস কিংবা জাগরির লেখক হিসেবে তিনি সর্বজনমান্য। সে তুলনায় গল্পের সতীনাথ কমই আলোচিত। তাঁর গল্পে চরিত্র, বৈচিত্র্য, চরিত্র বনাম সমাজ বৈপরীত্য, এমনকি রাজনৈতিক প্রসঙ্গের বিবেচনা খুবই আবশ্যিক। উপন্যাসের ঢোঁড়াই-এর ছায়া গল্পের বহু অপাংক্তেয় চরিত্রে অন্বিষ্ট; জাগরীর নিলু বিলু কিংবা তাদের নৈঃসঙ্গ্যকও বিবেচ্য। প্রকৃতপক্ষে সতীনাথ ভাদুড়ীর সাহিত্য সমকালীন ভারতের সমাজ-রাষ্ট্রিক দর্শন। ‘তিনি রাজনীতির ফিতে দিয়ে মাপতে চেয়েছেন ভারতবর্ষকে।’ হিমবন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক ভারতবর্ষের সাহিত্যিক বিবর্তন তুলে ধরেন। সেখানে স্পষ্ট যে, বাংলা সাহিত্যে সতীনাথ ভারতবর্ষের দরিদ্র শ্রেণির মানুষকে তুলে এনেছেন ভিন্নতর এক শৈলীতে। তিনি বলেন :
“মধুসূদন পুরাণের পুনর্মূল্যায়ন করতে চেয়েছিলেন তাঁর দীপ্তিমান সমকালে দাঁড়িয়ে ; সেখানে ফর্মের মতো কন্টেন্টটাও মূলত ধার করা, নতুন শুধু কবির রেনেশাঁসরঞ্জিত ইন্টারপ্রেটেশনটাই-- যা নাকি পুরণো রামকথার গতি এবং গন্তব্য, লক্ষ্য আর অভিমুখ বিলকুল বদলে দিয়েছিল, হয়ে উঠেছিল নবজাগ্রত বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইস্তাহার। আরো শতবর্ষ পরে, সতীনাথ মূলত সংগৃহীত একটি পৌরাণিক ফিতে দিয়ে মাপতে চাইলেন খেটে খাওয়া ভারতবর্ষের মারখাওয়া মুখচ্ছবি, তার ক্লেশ এবং কন্ট্রাডিকশনের রাজনৈতিক কারণগুলি, এবং মাপতে গিয়ে দেখলেন তাঁর মাপকাঠি ছিঁড়ে গেছে ;” (হিমবন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, বিংশ শতাব্দীর সমাজ বিবর্তন : বাংলা উপন্যাস)
আঞ্চলিকতায়, ভৌগলিক অবস্থানে, আর্থ-সামাজিক বিন্যাসে সতীনাথ সাহিত্য পূর্ণিয়াকেন্দ্রিক। কিন্তু এই পূর্ণিয়ার মধ্যেই যেন সন্ধান করা যায় এক অখ- ভারতবর্ষ। কৃত্যানন্দনগর, তাৎমাটুলি, জিরানিয়া, ভীমভার, প্ল্যান্টার্স ক্লাব, আরুয়াখোয়া, ধামধাহা হাট, হরদা হাট, নাগরনদী, কুশী-- পূর্ণিয়া জেলার আঞ্চলিকতা বা নিসর্গ কেবল নয়, পূর্ণিয়ার মানুষ তাঁর সাহিত্যে অঙ্কিত হয়েছে গভীর আন্তরিকতায়। মুনীমজী, গুলটেন, বীরসা ওরাওঁ, মিনাকুমারী, দুবে দুবেনী, পণ্ডিতজী, সৌখি, মুনাফা ঠাকরুণ, কোয়লজী, মনচনিয়া, হাসানু, চরণদাস প্রমুখ চরিত্র লেখক সতীনাথের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল। বোধ হয়, বৃহৎ মেট্রোপলিসের মধ্যে সতীনাথ তাঁর সাহিত্যের উপকরণ খুঁজতে চাননি। বরং তাঁর বিশ্বতত্ত্বে তো’ট্রাডিশনের’ই নিরীক্ষা।
“চড়ষরপব’ থেকে দূরে জেলা শহর তাঁর মফস্বলীয় মন্থরতায় যেখানে ট্রাডিশনকে বিদায় দিতে পারেনি কিন্তু নানা দিক থেকে অথবা ভিতর থেকেই এদিকে ওদিকে মুচড়ে গেছে-- সেখানকার সামাজিক স্তরবিন্যাস ও পরিবার জীবন সতীনাথের নিরীক্ষার বিষয় হয়েছে।” (ধীমান দাশগুপ্ত, সতীনাথ ভাদুড়ী জন্মশতবার্ষিকী সংকলন)
গণনায়ক (১৯৪৮), অপরিচিতা (১৯৫৪), চকাচকি (১৯৫৬), পত্রলেখার বাবা (১৯৫৯), জলভ্রমি (১৯৬২), অলোকদৃষ্টি (১৯৬৩)-- ছটি গল্প সংকলনে ষোল বছরে মাত্র ৬২টি গল্প সতীনাথের। প্রথম গল্প ‘জামাইবাবু’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ১৯৩১ সালে। সতীনাথ গল্প লিখেছেন ৩৫ বছর ধরে প্রায়। তবুও তাঁর গল্পের এই স্বল্পতম সংখ্যা পাঠককে বিস্মিত করে। কিন্তু এর মধ্যেই তিনি তাঁর রচনায় বৈচিত্র্য এনেছেন, রেখেছেন প্রতিভার সাক্ষর। জাগরী উপন্যাস লেখা ও প্রকাশের পর সাহিত্যই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র আশ্রয়। তার পূর্বে তিনি ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৮-এর মধ্যে লেখা গল্প নিয়ে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গল্পসংকলন গণনায়ক। তাঁর উপন্যাস নিয়ে সমালোচক মহলে যত উচ্চবাচ্য শোনা গেছে, গল্প নিয়ে তা ছিল সীমিত। এর কারণ কী?
‘চল্লিশোর্ধ তিনি তখন। স্পষ্টতই তাঁর সব গল্প-ই রচিত হয় অরাজনৈতিক জীবনে। একারণেই সম্ভবত রাজনৈতিক উপন্যাসের জন্য যে অসাধারণ জনপ্রিয়তা তিনি লাভ করেছিলেন, গল্পের জন্য সেই পরিমাণ নয়।’ (জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত অগ্রবীজ, তৃতীয় বর্ষ, ১ম সংখ্যা)
সতীনাথ আবির্ভূত হলেন কিন্তু বাংলা ছোটগল্পে এর মধ্যেই পালাবদল ঘটে গেছে। দ্বিতীয় মহাসমর থেকে পরবর্তী বিশ বছর (১৯৩৯--১৯৫৯) বলা যায়-- বাংলা গল্পের রূপ ও চরিত্র তৈরির কাল। আজকের পৃথিবীতেও রয়েছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অভিঘাত। সতীনাথ এক বিক্ষুব্ধ সময়ের লেখক। অন্যদিকে তাঁর কথাসাহিত্যে অগ্নিগর্ভা হয়ে উঠছিল সমকালীন রাজনীতি। রাষ্ট্রিক দুরাচার, পার্টি প্রতারণা, সাধারণ মানুষকে ¯্রফে ধোকা-- রাজনীতির মাঠে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি বাহ্যিক তথ্য সংগ্রাহক নন বরং ভেতর-জাত ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডের প্রত্যক্ষ সাক্ষী গণনায়ক’,’বন্যা’,’আন্টা বাংলা’,’চরণদাস এম.এল.এ’,’পরকীয়া সন-ইন-ল’,’রথের তলে’ প্রভৃতি গল্প তো তারই প্রমাণ। নিম্নজীবী মানুষ, তাদের হাহাকার, কলরোল সমস্তই সতীনাথ তাঁর নির্লিপ্ত মনের আলোয় বিচার করতে চেয়েছেন। তিনি ভাবতে চেয়েছিলেন মানুষের কথা। তাদের আন্তরিক বেদনার সঙ্গে তাই তিনি নিজেকে সমীকৃত করেছিলেন। সমকালীন আর দশজন রাজনৈতিক কর্মীর চেয়ে তিনি আলাদা।
“গান্ধীবাদী রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন তিনি কিন্তু রাজনীতি ও দলকে কখনো নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন না যাঁরা তিনি সেই বিরল ভারতবাসীদের একজন। বারবার তিনি সমালোচনা করেছেন দলের অক্ষমতা, ভ্রান্তি ও অন্যায়ের।” (সুমিতা চক্রবর্তী, উপন্যাসের বর্ণমালা)
রাজনীতির মাঠে তিনি দেখেছেন বড়লোকদের ভীড়, বাগাড়ম্বর। সতীনাথ তাই রাজনীতি পরিত্যাগ করেছিলেন। নিঃসঙ্গতা ছিল তাঁর শেষ জীবনের সঙ্গী। বিষয় প্রতিপত্তি দূরের কথা তিনি অকৃতদারই থাকলেন শেষপর্যন্ত। আসলে তিনি সমাজে খাপ না খাওয়া এক মানুষ। তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোও যেন কথা বলে ওঠে খাপছাড়া ধরণে।
রাজনৈতিক হঠকারিতা ও প্রবঞ্চনা সতীনাথের মনে এক গভীর নিরাশার জন্ম দেয়। নিজ দল কংগ্রেস সম্পর্কে তাঁর সংশায়ত্মক জিজ্ঞাসা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়। ১৯৩৪ সালে রাজনীতিতে যোগ দেয়া থেকে’আর্থকোয়েক রিলিফ সংগঠন’ করার ব্যাপারে তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে সরেজমিনে গ্রামাঞ্চলের কায়েমি স্বার্থের সঙ্গে কংগ্রেসের গভীর বন্ধন লক্ষ করেন। তিনি দেখেছেন রিলিফের পাওনা সেখানে পৌঁছায় না। অদৃষ্টের পথে চেয়ে থাকা কংগ্রেসি মন্ত্রীসভার আমলেও সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে না। তবে “নানা অসংগতি দেখতে দেখতে সতীনাথের রাজনৈতিক বিশ্বাসের রূপান্তর অনিবার্য হয়ে ওঠে।” (সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী)
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় সমাজের ত্রুটি, নীচতা, স্বার্থপরতা, আত্মরম্ভিতা, দেশ শাসনে বিশৃঙ্খলা, আমলাতন্ত্রের কর্মশৈথিল্য, দায়িত্বহীনতা ও অর্থলোলুপতা, সরকারী অব্যবস্থা, রাজনীতিকদের নীতিহীনতা, পুরাতন রাজনৈতিক কর্মীদের সরকারী অনুগ্রহ লাভের প্রয়াস, রাজপূত-ভূমিহার, কায়স্থ-হরিজন সমস্যা-- নানাকিছুই তাঁর গল্পের উপজীব্য। সতীনাথ অভিজ্ঞতার পৃথিবীকেই ব্যবহার করেছেন তাঁর গল্পে। যে-অভিজ্ঞতা বিচিত্র, অন্তর্মুখি, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশীল, বিচিত্র মানুষের সমাহারে গড়া এক রাজনৈতিক ভারতবর্ষ।
বহুমাত্রিক জীবনাভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করেছিলেন সতীনাথ। তাঁর সরল-সহজ প্রকাশের ভাষাও পাঠককে মুগ্ধ করে। গণনায়ক গ্রন্থভুক্ত প্রথম পর্বের রচনাগুলো দেশবিভাগ, রাজনীতি ও পরিবেশ সচেতন। সেখানে নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষের অপূর্ব মিশ্রণ। তিনি গল্পে বিচিত্র পটভুমি ব্যবহার করেছেন। এমনকি মানুষের অন্তর্লোক উন্মোচনে জগদীশগুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুলসহ দ্বিতীয় সমরকালের কোনো লেখক থেকেই তিনি পিছিয়ে নন। সমাজ সচেতন গল্পকার হিসেবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বনফুল কিংবা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় মধ্যবিত্তের ভাঙনকে অনুপুঙ্খভাবে উপস্থাপন করছিলেন। সতীনাথও জীবনের নানা ভণ্ডামি, ফাঁকি বা অসঙ্গতির কলাকৌশলগুলো চিনতে চেয়েছিলেন। কালোবাজারি আর দারিদ্র্য মধ্যবিত্তের শিকড় ধরে টান দেয়। কিন্তু শত বিনষ্টি আর যুগযন্ত্রণার অসহায়ত্বের প্রতিকার খোঁজেন সতীনাথ।
প্রত্যক্ষ রাজনীতির সংস্পর্শ সাহিত্যমানকে দুর্বল করে। তবে এর প্রয়োগ দক্ষতা লেখকের সাহিত্যমানকে উঁচু করে। বাংলাসাহিত্যের কতিপয় কথাশিল্পী রাজনীতিকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও কখনও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথাশিল্প নির্মাণ করেছেন। কিন্তু রাজনীতিমুখ্য হয়ে ওঠেনি তাঁদের রচনা। সতীনাথ ভাদুড়ীর চরিত্রসমূহ অনেকখানিই প্রত্যক্ষত রাজনৈতিক নির্মাণ। কিন্তু রাজনীতির ভেতর-বাইরের মানুষকে খতিয়ে দেখতে আগ্রহী তিনি। আর এ-কারণেই তাঁর রচনায় ঘটেছে মানবিক বাস্তবের দগদগে প্রতিফলন। কতিপয় গল্পের রাজনৈতিক প্রসঙ্গ উপস্থাপন করলে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
‘গণনায়ক’ : রাজনৈতিক শঠতার আখ্যান
‘গণনায়ক’ গল্পটি প্রথমে প্রকাশিত হয় ১৩৫৪ সালে দৈনিক কৃষক, শারদীয় সংখ্যায়।’গণনায়ক’ অর্থাৎ জনগণের নায়ক যিনি রাজনৈতিক ঝা-া উঁচিয়ে রাখেন জনস্বার্থে। সতীনাথের গল্পের গণনায়ক সে-প্রকৃতির ধারক-বাহক নয়। তৃতীয় বিশ্বের প্রবঞ্চনা ও জনস্বার্থবিচ্ছিন্ন হতচ্ছাড়া পরিবেশ-পরিস্থিতিরই নির্দেশক এই গণনায়ক। ব্রিটিশ উপনিবেশের পাকচক্রে পড়া ভারত রাজনীতির সত্যিকার মুক্তি ঘটত যদি রাজনৈতিক শঠতা না থাকত। কিন্তু দুর্ভাগা দেশে এরাই ঠেকিয়ে রাখে মুক্তি-সম্ভাবনাকে। তৃণমূল পর্যায়ে এই শোষণ আরো মারাত্মক। খুবই সামান্য দামে বিক্রি হয় এখানকার রাজনীতির মানুষ।
হিন্দুস্তান-পাকিস্তান ভাগাভাগির কোলাহলে গণনায়ক মুনীমজী গরীব সাধারণের ভয়ভীতিকে বাড়িয়ে তুলে মুনাফা লোটেন। তিনি কংগ্রেসী রাজনীতির ধ্বজাধারী কিন্তু চোরা কারবারের অর্থে ফুলেফেঁপে ওঠেন। তিনি নির্বিঘ্নে তার ব্যবসাটি চালিয়ে যান। কারণ তিনি জানেন,’গায়ের সেক্রেটারির দাম গড়ে টাকা দশেক। মীরপুরেরটা কিনতে টাকা পঞ্চাশের কম লাগবে না।’ (গল্পসমগ্র-১) এভাবেই দেশভাগের ডামাডোলে পড়া হিন্দু-মুসলমানের আবেগ-সঙ্কটকে পুঁজি করে টুপাইস কামিয়ে নেয় রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা কর্মী পুলিশ আমলা সরকারি চাকুরে সবাই। মহাত্মা গান্ধীর বরাত দিয়ে শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়।
মুনীমজী তাঁর নিজেরই বিলি করা এই ফ্ল্যাগ ফেরত নিয়ে পুনরায় বিক্রি করার মতলব আটেন।’একই জিনিস দু’দুবার করে বেঁচবেন। তিনি হিসেব করেন সব মিলিয়ে তাঁর কত হল।’ (গল্পসমগ্র-১) এই বাস্তবতার মধ্যে ঘুরপাক খায় ভারতীয় রাজনীতি ও মানুষ। সাধারণ মানুষ কি হিন্দু কি মুসলমান তাদের খেলার ঘুটি। স্বাধীন দু দেশের মধ্যে হঠাৎ সীমান্ত রেখা পড়লে তারা প্রাণান্তকরভাবে যে যার লক্ষ্যস্থলে ছোটে। সতীনাথ সময়ের জটিল এক আবর্তকে ধরেন। ব্রিটিশ রাজের পতাকা তারা একদিনেই নামিয়ে ফেলে। কিন্তু তিনদিনও সময় লাগে না নিজস্ব ঝা-া সরাতে। বস্তুত বিভাজিত রাষ্ট্রের অগণিত মানুষের নিরাপত্তার ভার নিতে ব্যর্থ হয় রাজনীতি। আরুয়াখোয়ার জটিলতা তৃণমূলের সেই সঙ্কটেরই নজির। বাড়িঘর ছাড়া দিশেহারা মানুষ কম দরে গোলার ধান পর্যন্ত বিক্রি করে চলে যায়।
“অছিমদ্দী কেঁদে পড়ে।--‘গাঁ থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলাম হরিপুরের দিকে। মীরপুর হিন্দুস্তান হয়ে গিয়েছে পরশু থেকে শুনছি পুর্বদিকে মুখ করিয়ে নামাজ পড়াবে। মুরগী জবাই করতে দেবে না। তাই এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েছি।” (গল্পসমগ্র-১)
প্রকৃতঅর্থে’গণনায়ক’ শুধু মুনীমজীর কীর্তি নয় বরং সমগ্র ভারত-রাজনীতির গভীর প্রেক্ষাপট। একটি পরিহাসের ভঙ্গির মধ্যেই সতীনাথ সমকালকে ধারণ করেন। পূর্ণিয়ার বর্ডারে হিন্দু-মুসলমান দু সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ী দেশভাগের অনিশ্চয়তা আর বিশৃঙ্খলার মধ্যে ব্যক্তিগত স্বার্থকে খুঁজে নেয়। সেই স্বার্থেই সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ান হয়। জননায়ক নিজের বিস্তার ঘটাতে চান। নিজেকেও ছড়িয়ে দেন কালোবাজার আর মুনাফার রাজত্বে। এ-গল্প সম্পর্কে উদ্ধৃত করা যায় :
“বলা বাহুল্য, বাংলা ছোটগল্পে’গণনায়ক’ একবারেই স্বতন্ত্র সংযোজন। দেশকাল এ গল্পে যে-পটভূমি তৈরি করেছে, তার ধারণা ব্যতিরেকে এ গল্প তৈরি হতে পারে না। দেশভাগের বেদনায় অনেক অনুভূতিপ্রবণ গল্প লেখা হয়েছে, কিন্তু সতীনাথ শুধু সেই আকুলতার গল্প লিখতে চাননি, দেখিয়েছেন সাধারণ’অশিক্ষিত’ মানুষগুলির অনুভূতি নিয়ে কী অসাধারণ কৌশলে পরিত্রাতার ভূমিকায়’অবতীর্ণ’ হলেন মুনীমজী।” (শ্রাবণী পাল, কোরক)
‘বন্যা’ : এক বিপর্যস্ত সংকীর্ণতা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দাবানল, মন্বন্তর, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, কালোবাজারি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, রক্তাক্ত স্বাধীনতা, ছিন্নমূল মানুষের স্রোট-- সমস্তই মধ্যবিত্ত মনকে প্রভাবিত করে। মূল্যবোধের দিক থেকে তখন যেমন চরম নৈরাজ্য তেমনি নিদারুণ অর্থ-সঙ্কট। অশিক্ষিত দরিদ্র মানুষের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ চরম অভিশাপ।’বন্যা’ গল্পে কুশীতে বান এলে তারা একে ভগবানের শাস্তি বলে ভাবে। যার যার তল্পিতল্পা নিয়ে তারা যায় গঞ্জের উচু বাজারে একটা নড়বড়ে’রিফিউঝি ক্যাম্প’-এ। মুসলমানরা স্থান নেয় মসজিদে, অধিকাংশই শীর্ষবাদিয়া মুসলমান। হিন্দু উচ্চবর্ণেরা আশ্রয় নেয় সম্পন্ন নৌখে ঝার বাড়ি আর নিম্নশ্রেণি সুমৃত তিয়রের বাড়ি। কিন্তু দু পরিবারের মধ্যে তীব্র রেষারেষি। পিতৃপুরুষের ব্যক্তিগত লড়াই জাতপাতের দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয়। তিয়র, মুসহর, ঝা, ধাঙর, বাঁতার, তাতমা, মুসলমান-- সবজাতের লোক রেস্কু পার্টির নৌকায় স্থলভাগে আশ্রয় নেয়। সুমৃত তিয়র, নৌখে ঝা, গেনুয়া মুসহর, ঝা, ধাঙর, বাঁতার, তাতমা, তুরিয়া বাঁতার, তিয়র ঝা বাড়ির মেয়ে-বৌরা, সাঁওতালরা, মুনিরুদ্দি বাধিয়া প্রমুখ শীর্ষাবাদিয়া মুসলমান সকলেই জাতের বিরোধ ভুলে এক হয়।
বন্যার একটি সামগ্রিক চিত্র অঙ্কন করেছেন সতীনাথ ভাদুড়ী। নানা শ্রেণির মানুষ, আশ্রয় জটিলতা, প্রবৃত্তি, সঙ্কট এমনকি প্রাণিজগৎ নিয়ে ঝামেলা-- বিচিত্র বিষয় উঠে আসে গল্পে। রিলিফ বাবুদের নিয়মকানুন, চালচলনে অতীষ্ঠ তারা। অন্যদিকে বন্যা তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়। আঁতুড়ে শিশুর কাপড় পর্যন্ত মেলে না। বন্যার পানি একসময় কমে যায়। পলি পড়া মাটির জন্য আবার আশায় বুক বাঁধে মানুষ। বিপর্যস্ত সংকীর্ণ মানুষের চিত্র আঁকেন লেখক :
“...সকলের মধ্যে আগামীর সমৃদ্ধ ছবি; বাড়ি গিয়া কী দেখিব, এই উৎকণ্ঠার মধ্যেও অতীতের ক্ষতি অনায়াসে ভুলিবার প্রয়াস।
তুচ্ছ জিনিস লইয়া ছোটখাটো ঝগড়া লাগিয়াই আছে। হাতগজ, চেন, লগা, বিঘা কাঠার দ্বারা সীমায়িত, সংকীর্ণ জমির মালিক। উদারতা আসিবে কোথা হইতে?” (গল্পসমগ্র-১)
‘আন্টা-বাংলা’ : সাহেবি ছাপের দেশী শাসক
সতীনাথ ভাদুড়ী তাঁর সমকালের জনপ্রিয় গল্পকার নন। আবার ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি যতটা স্বীকৃত, গল্পকার হিসেবে ততটাই অপরিচিত। তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিভূমি পূর্ণিয়া, পূর্ণিয়ার মানুষ-- সেকথা আগেই বলা। দু চারটি ভ্রমণকাহিনিতে তিনি বৈদেশিক মানুষের প্রসঙ্গ এনেছেন। তাই আঞ্চলিক ভাবনায় পূর্ণিয়া-বৃত্তের বাইরে তিনি যাননি। তবে সৎ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সতীনাথের বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা ও নিরাসক্ত শিল্পীমন অখ- ভারতবর্ষের আচার-সংস্কৃতি ধরতে সক্ষম। উপনিবেশের প্রায় অন্তিমলগ্ন তখন। তবুও উপনিবেশকদের শক্ত কালো হাত যেন প্রসারিত।
এ-গল্পে’আন্টাবাংলা’ ঔপনিবেশিক ভারতের একটি দুষ্টক্ষত। ইংরেজ শাসক ক দিনের জন্য এখানে অতিথি হয়ে আসে। কিন্তু তারা তৈরি করে কষ্টের ইতিবৃত্ত। বলাবাহুল্য তা সাধারণ মানুষকে করে অবহেলিত, অবজ্ঞাত। আন্টাবাংলার প্রকৃত নাম’প্ল্যান্টার্স ক্লাব’। প্রায় উপন্যাসের মতো বিস্তৃতি সত্ত্বেও’আন্টা-বাংলা’ এক বিলীয়মান যুগের করুণ মর্মস্পর্শী কাহিনি। গল্পটির বিষয় ও আঙ্গিক অসামান্য। ঐতিহাসিক সত্যের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে সতীনাথ আন্টা-বাংলার বাস্তব চিত্র এঁকেছেন নিখুঁতভাবে। সেইসঙ্গে আন্টা-বাংলার’প্ল্যান্টার্স মহিমা’ও। এই ক্লাবের উল্লেখ আছে জাগরী উপন্যাসেও।
এ-গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য চরিত্র সৃষ্টির অনন্যতা। বোটরা, তার মা, ঠাকুর্দা বিরসার চরিত্রের অসহায়তা, মানসিক টানাপড়েন, শোষণের আর্তি নানা প্রসঙ্গই সতীনাথ গল্পে তুলে ধরেছেন। নীলকর সাহেবদের একচ্ছত্র আধিপত্য, ক্লাবকেন্দ্রিক সাহেব-মেমদের ভোগবিলাসী জীবন, প্রাচুর্য, ফূর্তি, ধ্বংস, কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া-- সবই মুন্সিয়ানার সঙ্গে অঙ্কিত। তবে অত্যাচারিত জনগণের প্রতিবাদ প্রতিরোধের ভাষা এ-গল্পে নেই। নীরেন্দ্রনাথ রায়’পরিচয়’ পত্রিকায় তাই বিরূপ সমালোচনা করেছেন :
“নূতন ঊষার সন্ধিক্ষণে দাঁড়াইয়া সতীনাথবাবু অতীতের দিকে চাহিয়া দেখিতেছেন আন্টা-বাংলার যুগের স্মৃতি অবশেষ, কিন্তু ইহাতে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের আভাস দেখিতে পাইলেন না। ... দেখিলেন শুধু নৈসর্গিক ও সাময়িক কারণে আন্টা-বাংলার অবসান।” (উদ্ধৃত: দীলিপ সাহা, কোরক)
তবে এ-অভিযোগের অনেকখানিই সত্য নয়। কারণ’দুর্বার শ্রেণিসংগ্রাম’ বা’শোষণ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিরাট গণঅভ্যুত্থান’ দেখানো সতীনাথের উদ্দেশ্য ছিল না। বিষয়বস্তুর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি আসলে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক সত্যের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।’আন্ট-বাংলা’ পাঠের পর জনৈক সমাজকর্মী আপ্লুত হয়েছিলেন। তিনি অনুপ্রাণিত বোধ করেছিলেন এবং উপনিবেশে যন্ত্রশিল্পের বিকাশ, কংগ্রেস নেতাদের দখলদারিত্ব অপকর্ম প্রভৃতি নিয়ে লিখতে অনুরোধও করেছিলেন।’আন্টা-বাংলা’ পড়ে হিন্দু কিষাণ পঞ্চায়েতের জনৈক সমাজকর্মী তাঁকে চিঠি লিখে যা জানান :
“I have been highly impressed by Anta Bangla. I wish you could write the second chapter of this story depicting the rise of Mill Farms and congress leaders’ landgrabbing. I am herewith enclosing a chapter from the unpublished Champaran Commission Report for your information. ” (সতীনাথ ভাদুড়ী রচনা সমগ্র-২)
এটা ঠিক যে, আন্টা-বাংলার অবসানে সতীনাথ অতীতের প্রতি এক বিষণ্ন মহিমা অনুভব করেছেন। কিন্তু নিম্নশ্রেণির মানুষের স্বপ্নভঙ্গের কথাও তিনি ব্যক্ত করেন। নিস্পন্দ অসার বোটরার লুটিত দেহ সেই ভাঙনের ইঙ্গিত। যে-স্বপ্ন চুরমার করা বাস্তবতার সঙ্গী তিনি নিজেও। প্রত্যক্ষ চোখ দিয়ে তিনি ঔপনিবেশিক মানুষ এবং তাদের তৈরি ও ভাঙনের যাবতীয় বিষয়কে প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর কথাশিল্প তাই বাস্তবের ভূমি স্পর্শ করেই এগিয়ে যায়।
‘রথের তলে’ : নাট-নাট্টিন বিপর্যয় ও মহাত্মাজীর চেলা
সুধীমহলে যেমন আড্ডা ও চলাফেরা ছিল সতীনাথ ভাদুড়ীর তেমনি পূর্ণিয়ার ভাট্টাবাজার সংলগ্ন এলাকার সাধারণ মানুষের সাহচর্য পাবার সৌভাগ্যও তাঁর কম হয়নি। শৈশব থেকেই তাঁর কৌতূহল ছিল নিজ বাড়ির অদূরে ভাট্টাবাজারের জনগোষ্ঠীর প্রতি। পরিণত যৌবনে মূলত তিনি এই কৌতূহল মেটাবার সুযোগ পান। পূর্ণিয়া কংগ্রেসের আদর্শবাদী নেতা বিদ্যানাথ চৌধুরীর টিকাপট্টি গান্ধী আশ্রমে তিনি যোগ দেন ১৯৩৯ সালে। এই তেত্রিশ বছর বয়সে সতীনাথ প্রকৃত অর্থে জনতার মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। তিনি প্রাণভরে দেখলেন পূর্ণিয়া ও সেখানকার মানুষদের অন্তর্জীবন-- যারা তাৎমা, কোয়েরি কিংবা ধাঙর। গ্রাম-গ্রামান্তর ঘুরে তিনি লোকায়ত জীবন, রীতি-নীতি, ধর্ম-সংস্কার, বিশ্বাস-অবিশ্বাস সম্বন্ধে লাভ করলেন গভীর জ্ঞান। অনুসন্ধানী সতীনাথ মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখলেন, বুঝতে চেষ্টা করলেন। এই অভিজ্ঞান থেকেই জন্ম ঢোঁড়াই চরিতমানস-এর মতো উপন্যাস।’রথের তলে’ গল্পটির প্রেক্ষাপটও এভাবে তৈরি।
একজন ভৈরোনাটের মধ্য দিয়ে রচিত হয় ক্ষয়িষ্ণু অবহেলিত নাট-সম্প্রদায়ের কাহিনি। সতীনাথ দেখেছেন বিহারের ব্যাপক গ্রামাঞ্চলের নিরক্ষর মানুষ বিশ শতকের উত্তর-তিরিশে কীভাবে বদলে যাচ্ছে, কীভাবে ভুলভ্রান্তির মধ্যে দিয়ে মানুষ হিসেবে গোষ্ঠীচেতনা থেকে বেরিয়ে আসছে, কীভাবে তারা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হচ্ছে। ভুটনীর কাছে নাটদের ভৈরো সর্দার জানতে পারে সমাজের রক্তাক্ত পরিবর্তন। নাট-নাট্টিনদের নাচগানের কদর আর নেই, তাদের সমাজের সবাই ছত্রভঙ্গ, হয়ে গেছে দেশভাগ। অভাবের তাড়নায় মুহ্যমান নাটসমাজ। ভুটনীর জন্য কেনা সর্দারের শাড়িখানা ভিজে চুপসে যায়-- এর সঙ্গে যেন তার চোদ্দ বছরের স্বপভঙ্গের ঐক্য। আমজাদ আলীর সঙ্গে ভুটনীর চলে যাওয়া দেখে ভৈরো সর্দার জ্বলে ওঠে। কিন্তু ভুটনীর মুখনিসৃত তাদের দুঃখের কথায় অশ্রুবাষ্প হয় দু চোখ।
ভুট্নী কাঁদতে কাঁদতে বলে যায় নাট্টিনদের দুঃখের কাহিনী ; নাচগান... মহাত্মাজীর চেলারা-- কালেক্টর সাহেব--নাগড়া মেলা--ধরমগঞ্জের মেলা।
ভৈরোর চোদ্দ বছর ধরে গড়ে তোলা সৌধের পাথর শাবল দিয়ে খুঁড়ে খসিয়ে ফেলেছে একখান একখান করে।” (গল্পসমগ্র-১)
‘চরণদাস এম-এল-এ’ ও ‘পরকীয় সন-ইন-ল’ :
রাজনীতির হালে মরুভূমি ও ছাগলের হাল-বাওয়া
‘গান্ধীজির নাম নিয়ে সুযোগ সন্ধানী মানুষের নগ্ন লোভ দেখে সতীনাথ রাজনীতিতে বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর গল্পের ‘হিসাবী নায়কের’ মধ্যে সতীনাথ স্বাধীনতা উত্তর রাজনীতির চিত্র তুলে ধরেছিলেন।’ (অরূপকুমার ভট্টাচার্য, সতীনাথ ভাদুড়ী জীবন ও সাহিত্য)
স্বাধীনতা ভারতকে আলাদা রাষ্ট্র দেয়। গড়ে ওঠে নতুন রাজনীতি। সমকালের অন্তঃসারশূন্য নীতিভ্রষ্ট রাজনীতিকদের নিয়ে লেখা’চরণদাস-এম-এল-এ’। স্বাধীনতাত্তোর ভারতের চরিত্রগুলো লেখকের পর্যবেক্ষণ ও উপস্থাপনার গুণে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। নবীন গণনায়কের প্রতি লেখকের চাপা ক্ষোভ ও বিদ্রুপ রূপায়িত। ভারত-রাজনীতিতে জ্ঞান বা প্রজ্ঞার বদলে কা-জ্ঞানহীনরা শাসক হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক পরিহাসের অপূর্ব চিত্রায়ণ ঘটেছে’পরকীয় সন-ইন-ল
‘ গল্পে। ক্লাস এইট্ পর্যন্ত পড়া শ্রীসাহেবরাম এম-এল-এ হন কো-অর্ডিনেশন বিভাগের উপমন্ত্রী। সতীনাথ তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ-কৌতুকের খোঁচায় রাজনৈতিক বাস্তবতার এই চরিত্রটি তুলে ধরেন। ভারতবর্ষীয় মাকাল ফল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অবয়ব চিহ্নিত করার উপযুক্ত কৌশল তিনি অবলম্বন করেন। গল্পে আপাত-গম্ভীর প্রচ্ছন্ন কৌতুকের ভঙ্গি অবশ্য পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না।
এই বিদ্রুপের উপাখ্যানই গড়ে ওঠে ঢোঁড়াই চরিতমানসের লাডলী বাবু ও বচ্চনসিং-এর মধ্যে। তখন দেশ সেবার নামে অযোগ্য ব্যক্তিদেরই প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ঘটছিল নির্বিচারে। সতীনাথ তাদেরকে কখনোই আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি।’ছাগল দিয়ে অন্য কাজ হতে পারে কিন্তু হাল বাওয়ানো যায় না’-- এই চিরাচরিত সত্যটা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন চাক্ষুষ রাজনীতির ময়দান থেকে।
সত্যি ভ্রমণকাহিনীর দেশ ও তুলনামূলক রাজনীতি
সতীনাথের ভ্রমণ বিষয়ক টুকরো কাহিনিগুলোকে গল্পই বলা যায়। কারণ গল্পের মানুষ ও তাদের হৃদয়ের খবর তিনি হাজির করেন। পাশ্চাত্যের যেকোনো দেশের তুলনায় ফরাসি ভাষা, সাহিত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য আমাদের মনে একটু বেশিই প্রভাব ফেলে। কিন্তু সতীনাথের সত্যি ভ্রমণকাহিনি বাঙালির সেই চিরাচরিত ফরাসি-প্রীতি ও অভিভূত হবার বার্তা শোনায়নি। সতীনাথের ভাষাভঙ্গিও এখানে ব্যতিক্রমী বলে মনে হয়েছে। শানিত অথচ স্বাদু, আপাত সরল অথচ প্রদীপ্ত, নিরাভরণ অথচ অর্থপূর্ণ এক গদ্যনির্মাণশৈলীতে তিনি ফরাসি জীবনকে ধরেছেন। তাদের সীমাবদ্ধতা, তঞ্চকতা, বদভ্যাস, চালিয়াতি সবকিছুই তিনি সূক্ষ্মভাবে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
দ্বিতীয় মহাসমর সদ্য সমাপ্ত এমন একটি সময়ে সতীনাথ প্যারিস ভ্রমণ করেন। মহাযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সামলাতে ব্যস্ত সমগ্র ইউরোপ। ফ্রান্স কীভাবে নিজের ক্ষমতা, শ্রেষ্ঠত্ব, প্রভুত্ব প্রকাশ করছে, বিশেষত: অন্যবিশ্ব বিস্তারে কতটা মরিয়া তাও লেখকের সচেতন নজর এড়ায়নি। স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতি-সচেতন লেখক ভাববিহ্বল হয়ে ফ্রান্সকে গ্রহণ করেননি। তিনি একান্ত সৎ, যথার্থ আধুনিক ও স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে ফরাসিদের উৎকট সমাজ ও রাষ্ট্রনীতির কথা বলেন :
“গত তিন বছরের মধ্যে ফরাসীরা এক ডজন মন্ত্রিত্বের অবসান দেখেছে। ফরাসী বিপ্লবের পর এরা চারটে রিপাবলিক আর তিনবার রাজা বদলান দেখেছে। গভর্নমেন্টের ওপর এদের বিশ্বাস থাকে কি করে! রাজনীতির লোকদের এরা চেনে পুরানো ইতিহাস থেকেও। যার হাতে একবার ক্ষমতা গিয়েছে সে আর সেটাকে ছাড়তে চায় না, অনবরত বাড়াতে চায়, উত্তরাধিকারসূত্রে ছেলেকে দিয়ে যেতে চায়। তাই ফ্রান্সের শাসনবিধান বিশদ, আর নিশ্চিতভাবে লেখা, প্রত্যেকের ক্ষমতার চারিদিকে গণ্ডি টেনে দেওয়া।” (সতীনাথ ভাদুড়ীর নির্বাচিত রচনা)
সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্পের চরিত্র ও রাজনীতি বিশ্লেষণে লক্ষ করা যায় যে, দেশকালের অভিজ্ঞতার শিল্পিত রূপায়ণ ঘটেছে সেখানে। সতীনাথের নিজস্ব জীবনজিজ্ঞাসা, চারপাশের সময় ও সমাজই তাঁর গল্পে উপজীব্য। সতীনাথ সারাজীবন আপাত-সুখি স্বচ্ছল একটি পরিবার নিয়ে জীবনপাত করতে পারতেন। কিন্তু বিয়াল্লিশের আন্দোলন, গোপন সংগ্রাম আর শ্বাসরোধী রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতকে অস্বীকার করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। এর আগে ১৯৩০-৩২ লবণ সত্যাগ্রহ কিংবা ভারতবর্ষের উত্তাল সময়েও রাজনীতিতে সতীনাথের আগ্রহ দেখা যায়নি। ১৯৩৫ সালে পূর্ণিয়ার মহিলা সমিতির উদ্যোগ কিংবা ভাট্টাবাজারে মদের দোকানে পিকেটিং এটুকুই ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবন।
কেন তিনি কৃচ্ছ্রতাসাধন করলেন সারাটা জীবন? কেন অকৃতদার জীবন বেছে নিয়েছিলেন? কেনই বা ছাড়লেন রাজনীতি?-- এসবের সুস্পষ্ট জবাব সতীনাথ দিয়ে যাননি। বরং’স্বাধীনতা অর্জনের পর কংগ্রেসের দায়িত্ব শেষ-- এমন কথাই তিনি বলেন। কারণ সতীনাথ জানতেন-- এরপর রাজকাজ ছাড়া বিশেষ আর কিছু নেই। তিনি নিত্যদিনের গতানুগতিকতার মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করতে চাননি। আত্মার অপমৃত্যু কিংবা পরিপূর্ণ রাজনৈতিক হতাশা আসার আগেই তিনি পার্টি ছেড়েছেন। জাগরী, ঢোঁড়াই চরিতমানস, চিত্রগুপ্তের ফাইল, সঙ্কট ইত্যাদি উপন্যাসে কিংবা’গণনায়ক’,’চরণদাস এম.এল.এ’ অথবা আলোচিত গল্পগুলোতে রাজনীতির অশুভ দিকগুলোই যেন ধরা পড়েছে। দেশ সেবার সদর্থক দিকটি যেমন তাঁকে রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশের প্রণোদনা যুগিয়েছিল। কিন্তু রাজনীতির ফাঁকি তাঁকে চরমভাবে ব্যথিত করেছে। তাঁর গল্পে যেখানেই রাজনৈতিক প্রসঙ্গ সেখানেই একেকটি চরিত্র তাঁর বাস্তবপ্রসূত অভিজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে এসেছে। শঙ্খ ঘোষের বলেন :
“বড়ো বড়ো নেতাদের কথা নয়, জটিল কোনো রাজনীতির বিশ্লেষণ নয়, আগস্ট আন্দোলনের সেই দিনগুলোতে ছোট ছোট সাধারণ মানুষের জীবনও কীভাবে হয়ে উঠছিল রাজনীতি ঘেষা, কতটা সই ছিলেন তাঁরা, গোটা জীবনযাপনের মধ্যে কীভাবে মিশে যাচ্ছিল দেশের স্পন্দন,-- তারই একটা ছবি তৈরি করছিলেন তিনি পূর্ণিয়ার জেলের ভিতরে বসে।”( সতীনাথ গ্রন্থাবলী-১)
বিদেশী শাসন-অবসানে ক্ষমতা বর্তায় দেশীয় শাসকের ওপর। কিন্তু দেশে চলে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস, ভোগদখল। লোভী সুবিধাবাদী মুনাফাখোররাই চলে আসে রাজনীতির পুরোভাগে। এদের আত্মকেন্দ্রিক নির্লজ্জ মুখচ্ছবি সতীনাথের কাছে স্পষ্ট। তিনি বলেন, “সত্যই তো কংগ্রেস সংগঠন, সম্পূর্ণ ধনী কিষাণদের হাতে জমিদারের শোষণ হইতে তাহারা মুক্ত হইতে চায় ; কিন্তু নিজেরা তাহাদের সীমিত ক্ষেত্রে আধিয়াদার, বটাইদরি বা নিঃসম্বল ক্ষেতমজুরদের উপর শোষণ বন্ধ করিতে চায় না ; কংগ্রেস মিনিস্ট্রির সময় নিঃস্ব রায়তের জন্য যতগুলি আইন তৈয়ারি হইয়াছিল, সবগুলিই ইহারা কূটকৌশলে ব্যর্থ করিয়া দিয়াছে।”(সতীনাথ গ্রন্থাবলী-১)
প্রকৃতপক্ষে পরোপকারের এই মুখোশধারীদের কা-জ্ঞানহীন খেমটা নৃত্য সতীনাথ মেনে নিতে পারেননি। রাজনৈতিক দলাদলি, স্বার্থপরতা ও নিচতা থেকে নিজেকে তিনি যেন বাঁচালেন একাকী নিঃসঙ্গ জীবন গ্রহণ করে।
সহায়কপঞ্জি
অরূপকুমার ভট্টাচার্য, ১৩৯১, সতীনাথ ভাদুড়ী জীবন ও সাহিত্য, পুস্তক বিপণি, কলকাতা।
উদয়চাঁদ দাশ,’কথকতায় অন্য স্বর : ছোটগল্পের সতীনাথ’ কোরক, মঞ্জুভাষ মিত্র (সম্পা.), ১৬ বর্ষ, সেপ্টেম্বর-
ডিসেম্বর, সতীনাথ সংখ্যা, বইমেলা ২০০৬, দেশবন্ধুনগর, বাগুইহাটি, কলকাতা।
কার্তিক লাহিড়ী, ১৯৭৪, বাস্তবতা ও বাংলা উপন্যাস, প্রথম প্রকাশ, অরুণা প্রকাশনী, কলকাতা।
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, ২০০৯, অগ্রবীজ, চৌধুরী সালাউদ্দীন মাহমুদ (সম্পা.), তৃতীয় বর্ষ, ১ম সংখ্যা, যুক্তরাষ্ট্র।
ধীমান দাশগুপ্ত, ১৪১৪, সতীনাথ ভাদুড়ী জন্মশতবার্ষিকী সংকলন, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স,’বিহারী বাঙ্গালী সমিতি’ পূর্ণিয়া শাখা কর্তৃক প্রকাশিত।
মৈত্রেয়ী ঘোষ, আধুনিক বাংলা উপন্যাসের একটি অধ্যায়, এম সি মডার্ন কলাম, এপ্রিল ১৯৮৫, টেমারলেন, কলকাতা
শ্রাবণী পাল, ২০০৬, কোরক, পূর্বোক্ত।
সতীনাথ ভাদুড়ী, ১৯৭৩, সতীনাথ গ্রন্থাবলী-১, সম্পা : শঙ্খঘোষ ও নির্মাল্য আচার্য, অরুণা প্রকাশনী, চতুর্থ মুদ্রণ,
কলকাতা-৬।
১৯৯০, সতীনাথ ভাদুড়ীর নির্বাচিত রচনা, বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা
১৯৯৫, সতীনাথ ভাদুড়ী গল্পসমগ্র-১, সম্পা : নিরঞ্জন চক্রবর্তী, দেবব্রত ভট্টাচার্য, গ্রন্থালয় প্রাইভেট
লিমিটেড, কলকাতা।
১৯৯৫, সতীনাথ ভাদুড়ী গল্পসমগ্র-২, প্রাগুক্ত।
১৯৯৯, সতীনাথ গ্রন্থাবলী-২, সম্পা : শঙ্খঘোষ, নির্মাল্য আচার্য, প্রাগুক্ত।
সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, জানুয়ারি ১৯৯৭, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা ৭০০০২০।
সুমিতা চক্রবর্তী, ১৯৯৮, উপন্যাসের বর্ণমালা, প্রথমপ্রকাশ আগস্ট, পুস্তক বিপণী, কলকাতা।
হিমবন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০০২,’ঢোঁড়াইচরিত মানস অনন্যতার সন্ধানে’, বিংশ শতাব্দীর সমাজ বিবর্তন : বাংলা উপন্যাস, সম্পা. দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়, দেজ কলকাতা।
লেখক পরিচিতি :
খোরশেদ আলম, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক
পেশা : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল : কযড়ৎংযবফ.লঁ.নহমষ@মসধরষ.পড়স
2 মন্তব্যসমূহ
কম চেনা বড় মানুষ সম্পর্কে জানলাম। এ বিষয়ে আরো বিশদ জানতে চাই।
উত্তরমুছুনভাল লাগলো আপনার আগ্রহ।
উত্তরমুছুন