মামাঙ দাই'এর গল্প : ডিমের মত

অনুবাদ  :  এমদাদ রহমান

[গল্পটি সংগৃহীত হয়েছে ভারতের নর্থ-ইস্ট রাইটার্স ফোরাম থেকে প্রকাশিত নিউ ফ্রন্টিয়ার্স পত্রিকা থেকে। প্রকাশ সাল ২০০১। পত্রিকাটি ভারতের মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মিজোরাম, মণিপুর প্রভৃতি রাজ্যের লেখক-কবিদের বাছাই করা গল্পের সংকলন; যাদের লেখা সংকলিত হয়েছে এরা প্রত্যেকেই ইংরেজি ভাষায় লেখেন। অরুণাচল প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ লেখক মামাঙ দাই। নিউ ফ্রন্টিয়ার্স পত্রিকায় তার গল্পটির নাম ‘লাইক অ্যান এগ’। লেখক সম্পর্কে পত্রিকাটিতে তেমন কোনো তথ্য নেই। শুধু এটুকু মাত্র বলা হয়েছে-- মামাঙ দাইয়ের চরিত্রগুলো প্রচণ্ডভাবে-- জীবনবাদী। জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েও তারা জীবনের দিকে ফিরতে চায়, ফিরে আসতে সর্বদা উন্মুখ থাকে। সম্পর্কের সূক্ষ্মতার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ঠিক কেমন হতে পারে বা হওয়া উচিত, মামাঙ দাই তার সমস্ত লেখায় তারই বর্ণনা দিয়েছেন।]


বড় জানালার পাশে আমরা বসেছিলাম। বন্ধুটি বলছিল--আমরা যা কিছু পেতে চাই, তার অনেককিছুই পাই না, কিন্তু তার প্রায় কাছাকাছি অন্তত যেতে পারি। জীবন কি এটাই আমাদের দেখায় না? আসলে জীবন একটা ডিমের মত।


সন্ধ্যাটি ছিল বিবর্ণ আর যেন শেষ হতে চাইছে না। আমি তার বুনো চুল আর ঘন চোখের কথা ভাবছিলাম, টানা সূক্ষ্ম রেখাগুলো যাদের ক্ষয়িষ্ণু করেছিল আর পাতায় লাগানো প্রসাধন তাতে লেপ্টে গিয়েছিল যাচ্ছেতাইভাবে। বন্ধুটি শুধু হাসছিল আর অভিশাপ দিচ্ছিল।

তো কী হয়েছে? পূর্ব নির্ধারিত থাকে খুবই কম। আমরা কখনোই জানতে পারি না কী ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু, কিছু মনে কর না, আমরা সবকিছুকেই বিস্ময়করভাবে অনুকূলে আনতে পারি।

আমরা মিলিত হয়েছিলাম বার বছর পর। পুরোনো বাড়িতেই আমাদের এই মহিমাময় পুনর্মিলনকে ওয়াইন আর কথার পর কথা দিয়ে উদযাপন করছিলাম। বছরগুলো আমাদের যা যা দিয়েছে আর যা কিছু কেড়ে নিয়েছে, সেসব কথাই বলছিলাম আমরা। আজকের এই সন্ধ্যায় আমরা দুজন এই অনুভবে পৌঁছালাম যে, দীর্ঘ সময়েও কোথাও কোনও পরিবর্তন আসেনি।

আমরা এখনও সেখানে আছি, পথ যেভাবে আড়াআড়ি চলে ভিন্ন পথের বুকের ওপর। আছি পথগুলোর সংযোগস্থলে, যেখানে আমরাও একদিন আশা ও দুঃসাহস নিয়ে প্রাণখোলা হাসি হেসেছিলাম। তবে, অন্তর্বর্তী বছরগুলো আমাদের হতবাক করে দিয়েছিল। আজ আমরা আবার মুখোমুখি, তবু মনে হল পরস্পরকে শুনছি যেন বহু দূর থেকে! পরস্পর মুখোমুখি দুই বন্ধু কথা বলছি হারিয়ে যাওয়া বছরগুলোর সংক্ষিপ্তসার নিয়ে, আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে একদিন যা ছিল নিরেট কঠিন। আমরা যাদের ভালোবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম যাদের, তারা কখনোই মুখ ফেরায় নি। ভালোবাসার প্রতিদান দেবার সময় তাদের করোরই ছিল না।

আমি অবশ্যই নিজেকে সব বন্ধন থেকে মুক্ত করেছিলাম। আমার যে ভাবমূর্তি দাঁড়িয়েছিল, তাকে কোনোভাবেই আর বহন করতে পারছিলাম না। এবং আমি জানি যে, নিজেকে উপলব্ধি করারও কোনো পথ সামনে খোলা ছিল না। পৃথিবীর কোনো-এক জায়গায় আমি একদিন জীবনের আলো আর মায়া খুঁজে পেয়েছিলাম। বুঝেছিলাম নিজের জন্য, শুধু নিজের জন্য এই বিশ্বাসটাকে আমার আঁকড়ে ধরা চাই। আমি ফিরে এসেছিলাম বিধবা মায়ের কাছে। খুব কম শব্দ ব্যবহার করে এবং দৃঢ় কণ্ঠে তাকে বলেছিলাম--আমি শাস্তি ভোগ করছি, যার মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি।

বাস্তবিকপক্ষে, অনেকটা অনাকাঙ্ক্ষিতের মত, যখন আমার বন্ধুটি এখানে বেড়াতে এল, তাকে খুব সহজভাবেই গ্রহণ করলাম, আমার শান্তিকে যা বিপর্যন্ত করল।

সমস্যাটা এখানেই যে, যে-কোন ব্যাপারেই আমরা খুব শান্ত থাকি--সে বলছিল--বিনা প্রতিবাদে আমরা সব কিছুকেই মেনে নিই। ভালোবাসলেও প্রচণ্ডভাবে বাসি, কিন্তু কারো মনেই স্থান পাই না। বিস্ময়কর না ব্যাপারটা? আমরা কখনোই কোনওকিছু গড়তে পারি না। তবে, এখনও আমাদের হাতে পয়সা বানাবার মত সময় আছে। জীবনটাকে আচ্ছামত যাপন করবার সময় আছে। যেকোনও একটা কাজে আমরা লেগে যেতে পারি আর নিজেদের জন্য একটা পথ তৈরি করে নিতে পারি। তাতে কী ঘটবে? বিস্ময়কর ব্যাপারটাই ঘটবে। কেন যেন মনে হয় আমাদের আনন্দিত হবার মত দিনগুলো নিশ্চিতভাবে আসছে। আমি বললাম, টাকাপয়সার কথা আমাকে বলবা না আর ব্যবসা-ট্যাবসা নিয়ে আমার যে কোনো আগ্রহ নেই আশা করি এটা তুমি জান।

ঠিক আছে। কিন্তু তুমি জানো যে তুমি ভাগ্যবান। তুমি তোমার সঙ্গেই আছ। সবশেষে মা ছাড়া আর কেউই থাকে না! সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মাথাটা নাড়তে থাকল।

সে তার পোশাকগুলো ঘরের ভেতর ইতস্তত ছুঁড়ে ফেলছিল। কার্ডবোর্ডের বাক্সগুলোকে পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে ঘরের কোণায় নিয়ে যাচ্ছিল। আমি তার কাণ্ডকীর্তি দেখে সত্যি সত্যি হতবাক হচ্ছিলাম যে কীভাবে একা একা রাতের বাস আর লক্কড়ঝক্কড় কারগুলোয় চড়ে অবতারসুলভ খুচরোবিক্রেতার মহান কাজটি সে করছিল। বড় শহরগুলোয় সে চলে যাচ্ছিল খুব দ্রুত আর ট্র্যাভেল ব্রুশিয়ারে যেসব হোটেলের উল্লেখ থাকে না, সেগুলোয় রুম বুক করছিল। মালপত্র কেনা হচ্ছিল বেশ আগ্রহের সঙ্গে। মাঝে মাঝেই ঝগড়া করতে হচ্ছিল শুল্ক-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আর মধ্যসারির কর্মকর্তা ও দালালদের এড়িয়ে ঠিকই সে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।


একসময় সে সৌন্দর্যের অধিকারী ছিল। তার এখনকার হিংসুটে রাগী মুখ আর বিদ্রুপমাখা হাসি দেখে লোকে তাকে এড়াতে শুরু করেছে, যেন এই কুৎসিত খুচরোবিক্রেতাটির সামনে থেকে পালাতে পারলেই রক্ষা। অবস্থা সুবিধার নয় বুঝতে পেরে আমার বন্ধুটা সেইসব এলাকায় ফেরি করতে এলো, ঠিক যে ধরনের এলাকায় আমি থাকি--একটা ছোট্ট শহর। যার আছে একটা মাত্র সড়ক, যে-সড়কটি শেষ হয়েছে দুই পাহাড়ের মাঝখানে। শহরের মহিলারা আমার ফেরিওয়ালা বন্ধুর কাপড়ের গাঁটরিগুলো দেখল। সূক্ষ্ম আর উজ্জ্বল কাপড়, নানান ভেজষ দ্রব্য ইত্যাদির দ্বারা তারা যেন বশীভূত হয়ে গেল। মুখে মুখে খবর রটে গেলে মহিলারা ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা করতে লাগল তার সঙ্গে। এইসব আমদানি করা জিনিসগুলো তাদের জাদু করেছিল।

সে মহিলাদের বলল—এই কাপড় তোমাদের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলবে।

এইভাবে আমার বন্ধু নিজেকে যেন খুব হালকাভাবে জাগিয়ে রাখতে চাইল, যেন আবার চাইল জ্বলে উঠতে, যেভাবে আগের দিনগুলোয় আমরা জ্বলে উঠতাম। সে ঘরের ভিতর পায়চারী করছিল এমনভাবে যেন সে এই মহাবিশ্বের মত প্রসারমান একটা কিছু। তারপর একসময় সে তার ঢোলা ট্র্যাকস্যুটের ভেতর নিজেকে লুকিয়ে ফেলল আর শুনতে পেলাম ঘুমের ভেতর বিড়বিড় করে কী যেন বলছে!

কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। আহ্, মা! সে-ই একমাত্র মানুষ যে দীর্ঘ দীর্ঘ সব স্বপ্ন দেখে ক্ষতবিক্ষত হয় আর প্রতিটি দিনের শুরুতেই থাকে বিস্ময়কর মায়াভরা কণ্ঠে স্বপ্নগুলোর অনুপুঙ্খ বিবরণ। মা স্বপ্নগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রাণখুলে হাসত, কারণ সে ছিল মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া একজন মানুষ। প্রতিরাতের সেইসব স্বপ্নে থাকতাম আমি। নদীর উত্তাল জলরাশি চারপাশ থেকে আমাকে ঘিরে ফেলেছে। একদিন সে স্বপ্ন দেখল আমি খাড়া উঁচু পাহাড় থেকে ভারী পাথরের মতো দ্রুতগতিতে অথৈ জলে পড়ে যাচ্ছি!

হ্যাঁ, এটাই আমার জীবন। একজন সুখী নারী হতে হলে আমার মত ভাগ্য নিয়েই তাকে জন্মাতে হবে। স্বপ্ন-বর্ণনার শেষে মায়ের বলার মত কথা ছিল এটা।

এইসব আমার ভেতর অজানা আতঙ্ক আর অন্ধ-সংস্কার জন্ম দিয়েছিল, তবু আমি কিন্তু কিছুতেই সাহস হারাই নি। আবার এটাও ভাবতাম যে, ভয় থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কত কিছুই তো রয়েছে। কত কিছু--অজস্র বই। চিত্রকলা। লেখালেখি আর কাজ। ভাবতাম মা অবশ্যই তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবে। নিজের ভাগ্যকে সে আর অপরাধী করবে না।

মা বলে-শিক্ষার কোনোই মূল্য নেই। তুমি প্রচুর জ্ঞানের অধিকারী হলে, তাতে তোমার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল। তুমি কোনও গভীর উপলব্ধিতে পৌঁছতে পারলে? এটা কিছুতেই কোনও কাজে আসল না। তুমি জীবনে ফুল ফোটাবার আনন্দটুকুও হারিয়ে ফেলেছ। এরকম কথাবার্তা আমি না শোনার ভান করি। নিজেকে সামলে নিয়ে তাকিয়ে থাকি মায়ের গড়া বাগানটার দিকে। দেখতে থাকি সন্ধ্যা-ঘনায়মান আকাশ। প্রার্থনা করি--আমাকে সামান্য কিছু সময় দান কর, তাহলেই আমি টিকে থাকতে পারব। নিজেকে বলতে থাকি--আমার বন্ধু এই ধরনের টিকে থাকবার উপায়কে একদম পছন্দ করে না। এক মৃত জায়গা থেকে পালিয়ে যাওয়ার উপায়গুলো নিয়ে আমি ভাবিত হই আর সে প্রকাশ্যে লড়াই করবার কথা বলে এবং সব কিছুকে হারানোর জন্য নিজেকে সে প্রস্তুত করেই রাখে।

সে চিৎকার করে--তাতে কী হয়েছে, হ্যাঁ? সবকিছুর শেষে কী হবে এটা যেমন বলতে পারি, যা করতে চাই, তা-ও আমি ঠিকমত করতে পারি। আমার প্রিয় কাছের মানুষগুলো মারা গেছে। হ্যাঁ, তারা সবাই খুব ভালো মানুষই ছিল। এখন আমি কোনোকিছুর জন্য আর লজ্জিত নই। কথাগুলোর সঙ্গে সে এটাও জুড়ে দেয়: আসলে বিষয়টা হচ্ছে আমি খুবই ক্ষুদ্র একটা সত্তা। বলেই সে জোরে হেসে হেসে উঠে।

মা তার উপস্থিতি বেশ উপভোগ করে। তারা বিশ্বাস করে যে তারাই দুনিয়ার সবচেয়ে শুভ এবং সবচেয়ে অশুভ সত্তা। তারা দুজনেই যে-কোনও অবস্থায় স্পষ্টবাদীতায় বিশ্বাসী। তারা যুদ্ধ করে টিকে থাকতে চায়। রান্না করতে করতে তারা নানান বিষয়ের আলোচনায় দারুণ উৎসাহী, যেন রান্নাঘর দুই নারীর এক ব্যস্তসমস্ত কুঠুরি। মা সারারাত আমাদের সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনতে বেশ আগ্রহী।

বন্ধুটির তার নিজের এবং আমার জীবন নিয়ে প্রচণ্ড আতঙ্কে থাকত। তার চরম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় এই আতঙ্ক যেন দূরবর্তী সংকেতের মত হঠাৎ জেগে উঠত। বন্ধুটি তার ঘরের দরোজা হাট করে খুলে রাখত আর আমার বন্ধ ঘরের দরোজার কাছে রাগে ক্ষোভে গজগজ করত, কারণ সে দেখতে পেয়েছে আমি ঘরের বদ্ধতার ভেতর বসে আছি।

তাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা আমার ছিল না। কিছু করারও ছিল না। ঘরের ভেতর নিজেকে নিয়ে শক্ত হয়ে বসে থাকতাম। চারপাশে কী যেন হাতড়ে বেড়াতাম--অন্ধের মত। মাঝে মাঝে ভাবতাম আমি খুব নিরাপদ, যেভাবে একটা আদল নিজেকে পুনর্গঠিত করে। বিষয়টা আমার কাছে ছিল ঘষে ঘষে আকাশটাকে মসৃণ করার মত অথবা দুটো মানুষকে আয়নায় যেরকম দেখে নেয়া যায়,- জীবন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যাতে তারা জ্বলে উঠতে পারে--ঠিক তেমন। সেই দুটো শরীরের একটা হচ্ছে পুরুষের আর অন্যটি নারীর। যারা পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসে এমন করে, যেমন ভালো আগে কেউ কাউকে বাসেনি। পুরুষ নারীশরীরের গোপন রহস্যগুলো অলিগলি খুঁড়ে আবিষ্কার করতে করতে ঈর্ষাকাতর হয়ে ভাবে--আমার আগে কেউ কি এই রহস্যের জট খুলেছিল? নারী পুরুষটির কাছে দস্যুতার প্রার্থনা করতে গিয়ে চিরদিন ভালোবাসবার প্রতিজ্ঞা করে। তারপর তারা দুজনের শরীর মন্থনে আনন্দিত হয়। বারবার। তারপর, এক সময় আছে, যখন খেলা শেষে নারীশরীর বিছানায় পড়ে থাকে, যেন পরিত্যক্ত। তারপর পুরুষটি আবার নিজেকে খেলায় ফিরিয়ে আনে। নারীর নিস্তেজ বাহুমূলে শরীর নেতিয়ে পড়লে ফিসফিস করে বলে--এবার আমাদের নিয়ে একটা গল্প লেখা হোক। চল, সন্তান নিই।

তারপর তারা স্বামী আর স্ত্রীতে পরিণত হয়। তারপর বছরগুলো আসে আর হারিয়ে যায়। তাদের অজান্তেই একসময় পরস্পরের বলা কথাগুলো হয়ে পড়ে তিতকুটে। সম্পর্কে তৈরি হয় হরেকরকম ফাটল। নিঃশব্দ টানাপোড়েন। যে-ছোট্ট শহরে তারা তাদের দিনগুলো কাটায়, সেখানে যতক্ষণ না বাতাসের ধাক্কায় গাছগুলো শো শো শব্দে বেজে ওঠে, ততক্ষণ এই ফাটল আর টানাপোড়েন বড় উচ্চকিত থাকে। তখন সূর্যালোকের মানে পাল্টে যায়। বদলে যায় ভেতরকার ল্যান্ডস্ক্যাপ। গ্রীষ্মকালে, প্রকৃতি যখন ভিন্নমূর্তি ধারণ করল, তাতে তারা যেন নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলল চিরদিনের জন্য।

ভাবনার এরকম পর্যায়ে আমার আকাঙ্ক্ষা এত তীব্র হয়ে উঠে যে, মনে হয় চিৎকার করতে করতে বাইরে বের হয়ে পড়ি, খুন করে ফেলি কাউকে অথবা নিজেকেই। তা না করে আমি স্থির অনড় বসে থাকি লজ্জা আর আতঙ্কে কুঁকড়ে গিয়ে। নিজের সঙ্গে চূড়ান্ত কথোপকথনের পর পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারি। তাতে কী আর হবে! মানুষ প্রতিমুহূর্তেই আরেক মানুষকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। নিজেকে বলতে হল কথাটা।

আমার ক্ষুব্ধ বন্ধুটি বলতে থাকে: তুমি সবসময় তাদের খুঁতগুলো ধরবার চেষ্টা করবে, ঠিক আছে? কোনও কিছুকেই তাহলে ছাড়তে হবে না। সবকিছুর গোড়ায় গিয়ে বর্শার মত গেঁথে ফেল তাদের। আগেই হোক বা পরে, তুমি জানতে পারবেই। তারপর বিষয়টাকে টেনে টেনে পেছনে একেবারে শুরুর দিকে নিয়ে আস। দোহাই, চোখের পানি ফেল না। তারপর তুমি তোমার দাবিটি তোল। অধিকারের দাবি তোল! শুধু জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলবার অভিপ্রায় নিয়ে তীব্রভাবে টিকে থাকবার চেষ্টা কর। হাহ্।

তার কথায় আমি হাসতে পারতে পারলাম না কোনওভাবেই। অথচ সে অপরিণামদর্শীদের মত হাসিতে ভেঙে পড়ল।

তোমার সমস্যাটা কী, খুলে বল, তাকে বললাম।

সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সে সোজাসাপ্টা বলতে শুরু করল: সে আমার পুরো জীবনটাকেই খেয়ে ফেলেছে। আমি কঠোর পরিশ্রম করছি। শুধু নিজের জন্য এই পরিশ্রম নয়, দুজনের সুখের জন্য। কথাগুলো মন দিয়ে শুনছ তো? সে ছিল সেই মানুষ যাকে আমি পাগলের মত ভালোবাসতাম। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে দাম্পত্য জীবনকে টিকিয়ে রাখতে চাইছিলাম। কিন্তু তার সামনে তখন অন্য দরোজা খুলে গেছে। এখন সে এক তরুণীকে নিয়ে বাস করছে। দীর্ঘদিন ধরে তার সঙ্গে আমার কোনো ধরনের যোগাযোগ কিংবা কথাবার্তা নেই।

কত দিন ধরে?

যেদিন বিষয়টাকে আবিষ্কার করলাম এবং ঝগড়া করলাম। তার মাথায় পাগলের মত হিট করতে লাগলাম। কথা বলতে বলতে সে আবার হাসতে শুরু করল। আমার ভেতর জন্ম নিল ভয়াবহ যন্ত্রণা। যে-যন্ত্রণা আমার অন্তরকে স্পর্শ করল।

কী করব এখন, সে বলল, আমার জন্য এখন যা স্বাভাবিক তা হল-- হয় বিশ্বাস কর, না হয় তো অবিশ্বাস। আমি বিশ্বাস করাকেই বেছে নিলাম। ভুলটা হল সেখানেই। তাতেই বা কী হল, হ্যাঁ? আমি তার দিকে ভাবলেশহীন চোখে তাকালাম। সে তার দৃষ্টিকে আমাকে ছাড়িয়ে যেন অন্য কোনোখানে নিয়ে গেছে। কারো কোনও জিজ্ঞাসা নেই--এটাই যেন সবকিছুর গূঢ় অর্থ। আমি যখন, ‘এটা কারো জন্যই ভালো হবে না’ বলে ক্ষেপে উঠলাম, সে বলল--হয়ত এটা আমার জন্য ভালো কিছু হবে না। তবে জেনে রেখ, ক্ষতিকরও হবে না। হয়েছিল কী, আমি কোনোভাবেই নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি। তার সঙ্গে প্রচণ্ড ধ্বস্তাধ্বস্তি হল। এখন যা-ই হোক, আমি পরোয়া করি না।

অবেশেষে সেই দীর্ঘ নিষ্ঠুর শীতকাল আসে। অশরীরী আর প্রেত্মাতারা হেঁটে বেড়ায় নদীর তীর ধরে আর ঈর্ষাকাতর চোখে জঙ্গলের ভেতর থেকে তারা চেয়ে থাকে। তারা খুব নিবিড়ভাবে লক্ষ করতে থাকে যে তাদের প্রলোভনে বশীভূত হয়ে কারো পক্ষে অসম্ভব হবে তাদের চালচলন এবং গতিবিধি বুঝতে পারা। কমবয়েসী এক নারী নিঃসাড় পড়ে রয়েছে তপ্ত পাথরের ওপর। সে জেগে উঠেছে তখন, ঠিক যখন সূর্যটা পুরোপুরি ডুবে গেছে পাহাড়ের পেছনে। দিনলিপির খাতায় বিষয়টিকে আমি নোট করলাম ঠিক এভাবে: এই অবস্থাটিকে বিবেচনা করা যায় সূর্য ডোবার পর খরস্রোতা নদীর জলপ্রবাহে একটি সমাধি থেকে নারীর দেহটি ভেসে এসেছে। নারীটির পৃথিবী ভরা ছিল অবিরত অদ্ভুত সব স্বপ্নে। পরের দিনটি নারী নিঃসাড় শুয়ে ছিল প্রকাণ্ড একটা পাথরের ওপর এবং এক সময় সে চিৎকারে চিৎকারে জানান দিয়েছিল তার পেটের যন্ত্রণাময় ব্যথা। কিছু একটা অবশ্যই ঘটেছিল। মহিলাটির শরীরে ঢুকে পড়েছিল কোনও এক প্রেতাত্মা এবং এক বয়স্ক মহিলা বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল। মহিলাটি ধরে নিয়েছিল যে মন্ত্রশক্তির মাধ্যমেই পাথরে শুয়ে থাকা যন্ত্রণাবিদ্ধ নারীটিকে সে উদ্ধার করবে।

দিনলিপিতে লিখলাম: একজন শামান ডাকা হল এবং অবশ্যপালনীয় আচারের মাধ্যমে ডেকে আনা হল অশুভ আত্মাটিকে। আত্মাটির কাছে জানতে চাওয়া হল যে সে কী চায়। বুঝতে পারলাম যে এটা হচ্ছে আত্মার সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়া। পারস্পরিক সংলাপ বিনিময়। আমরা তোমার জন্য বধ করব মুরগি আর পাথরের ওপর রেখে দেব আঙুরের রস থেকে তৈরি মদ। বাতাসে ভাসবে আদা আর রক্তের গন্ধ। আর, তারপর আমরা তাকিয়ে থাকব ট্যাবুর দিকে। প্রতিষ্ঠা করব আমাদের মধ্যে শান্তি।

আমার মা সবকিছু সম্পর্কে অবগত ছিলেন। রাজিও ছিলেন সমস্ত দায়িত্ব পালন করার। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তার বিশ্বাস ছিল যে খুব কঠিন নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। ব্যাপক লোক সমাগম হয়েছিল আর তারা শোরগোল করছিল খুব। আমার মনে হল এরকম না হলেই বরং তোমার সমস্ত চেতনশক্তি চুরি হয়ে যেত। মা প্রার্থনা আর উপবাসের মধ্য দিয়ে নিশিপালন করছিল। আমরা দেখছিলাম শ্রদ্ধেয় শামান মৃদু গুঞ্জন করছিল আর গান গাইছিল। ঢুকে পড়ছিল আত্মাদের জগতে এবং এই শামানের মাধ্যমে সমাগত আত্মীয়স্বজনেরা শুনতে পাচ্ছিল অল্পবয়স্ক এক নারীর শোকার্ত বিলাপ। তার শোকার্ত কান্নাকে মনে হচ্ছিল যেন কণ্ঠনালী দিয়ে ঘ্যাসঘ্যাস শব্দে বাতাস বেরুচ্ছে। হঠাৎ শ্বাসে বুক ভরে সে বলতে শুরু করল: আমি বিরাট এক সেতু থেকে পড়ে অগাধ জলে ডুবে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে আমার গর্ভস্থ শিশুটিও মরে গেছে। গত গ্রীষ্মে এই মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটেছে। উফ্, তোমরা আমাকে সাহায্য কর। আমি যে বেঁচে থাকতে চাই। আমি বেঁচে থাকতে চাই!

দিনলিপিতে ‘কীভাবে আমরা জলের ভেতর যাতায়াত করি’ প্রসঙ্গে আমি লিখলাম: জলের সঙ্গে আমাদের কী অদ্ভুত যোগাযোগ। জল সব সময় আমাদের বেঁচে থাকার তৃষ্ণা মিটিয়ে জীবনকে শুষে নেয়। জল লোভাতুর হয়ে ওঠে। হাত বাড়িয়ে ছিন্ন করে সব মায়াজাল। জীবনের ধারাল যত তীক্ষ্ণতা থাকে, তাকে ভোঁতা করে দেয়। মুছে ফেলে ঝাপসা সব দাগ। আমাদেরকে তার অতলে ডুবিয়ে দিয়ে ভেঙে-পড়া তীরকে মিশিয়ে দেয় ধুলায়।

আমি আমার ধৈর্যে অবিচল থাকলাম। আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম জীবন নিয়ে। আমি সম্ভবত আশার ভেতর জীবিত ছিলাম, কারণ আমি প্রাচুর্যপূর্ণ নোটগুলো নিয়মিতই লিখছিলাম এবং এটা সত্যি যে একজন কোনওভাবেই কোনোকিছু লিখতে পারে না যদি তার কোনও আশা আর অবিশিষ্ট না থাকে। সবকিছুর শেষ কথা হিসেবে আমি এই বিষয়টাই নিজেকে বারবার বোঝাতে চাইছিলাম। কিন্তু এটা যে কীসের আশা এ সম্পর্কে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু আমার মত একজন মানুষের পক্ষে লেখা চালিয়ে যাওয়াটাকে মনে হচ্ছিল নিতান্তই প্রয়োজনীয়। আমি বুঝতে পারছিলাম জীবন কী বিস্ময়করভাবেই-না জমে উঠে, এক পথের ওপর দিয়ে যেভাবে আরেকটি পথ আড়াআড়ি চলে যায়; এক তারার সঙ্গে আরেক তারার সংঘর্ষ হয়। এমনকি অবিরাম ঘুরপাক খেতে খেতে অনেকটা নিয়মিতই আমরা আমাদের কাঁধের দিকে মুখ ফেরাই যেন জীবনের সঙ্গে জীবনের অবিরাম বিরোধ। কী রোমাঞ্চকর! আমি হৃদয়ের বন্ধ তালাগুলো খুলে ফেলবার প্রচণ্ড তাড়নায় স্বপ্ন দেখেই যাই, শুধু স্বপ্নই দেখি।

আমি এত বেশি নিজের ভেতর মগ্ন ছিলাম যে ভুলেই গিয়েছিলাম কখন পাতিহাঁসগুলো ডিম পাড়তে শুরু করেছে আর কীভাবেই বা আমার মা তাদের চোখে চোখে রাখছেন। হিসেব রাখছেন কখন, ঠিক কখন তা দেয়া ডিম থেকে বাচ্চারা বের হবে। একটানা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শহরটাকে কুয়াশার মতো ঢেকে ফেলছিল আর প্রায়ই আমি দেখছিলাম বাগানে চারা লাগানোর জন্য মা’র অস্থির ছুটাছুটি। কাণ্ড, অঙ্কুর আর কন্দগুলোকে জোড়া লাগানোর জন্য তার চঞ্চলতা। আমি মাঝেমাঝেই চিৎকার করছিলাম--তুমি ভিজে যাবে মা।

মা তার দুষ্টুমিভরা গলায় উত্তর দিচ্ছিল--এখন এগুলি করা না হলে তো দেরি হয়ে যাবে। আমি দেখছিলাম পুরোনো পোশাকের ভেতর তার দেহটা কেমন অগোছালো হয়ে পড়েছে, যেন এখনই ছড়িয়ে পড়বে বাগানময়।

মা একদিন তার পা-দুটি’র নিঃসাড় হয়ে যাবার কথা বলল।

বললাম, মা, নিঃসাড় বলতে তুমি কী বোঝাচ্ছ?

কোনো চেতনা নাই মনে হয়। অসাড়। মৃতদের এরকম হয়।


আমি তার অনাবৃত পা আলতো স্পর্শ করলাম। অনুভব করলাম কতোদিন পর মায়ের কাছে ঘনিষ্ট হয়ে এসেছি। এই ঘনিষ্টতায় আমার হৃৎস্পন্দন হচ্ছিল খুব দ্রুত। আমি বিস্মিত হচ্ছিলাম এটা ভেবে যে কী একটা যেন ঘটতে যাচ্ছে। আমার অস্বস্তি বুঝতে পেরে রসিকতা করে সে বলল--হট ওয়াটার ব্যাগ দিয়ে এখন তোমার মনটাকে উষ্ণ করে তোল। বলেই আমার হাতে মুখে আলতো করে হাত ঘষতে শুরু করল। ভাবলাম এর ফলে আমি একটু স্বাভাবিক হতে পারব।

সারারাত আমরা এক সঙ্গে বসেছিলাম। আমি ঘরের চারপাশে তাকাচ্ছিলাম। পুরোনো ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠছিলাম, চমকে উঠছিলাম কেমন করে আমরা সবাই একসঙ্গে একদিন হেসে উঠেছিলাম।

একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে আমি বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে আছি। আমার স্কুলে পরে যাবার ব্লেজারটা কেমন আনন্দের ভঙ্গিতে গেঁথে আছে মায়ের গেঁথে রাখা পিনের সঙ্গে।

আমি ঘরে আর থাকতে পারছিলাম না। বারবার ঘর থেকে চলে যাচ্ছিলাম। অনুভব করছিলাম যে আমার পা দুটো ভারী হয়ে কোথাও আটকে যাচ্ছে আর আমি তৈরি হচ্ছি কেঁদে উঠার জন্য। বাড়ির কাজের মহিলাটি আর মা কথা বলল এক মুহূর্তের জন্য। মা যখন ঘুমে অচেতন, কাজের মহিলাটি মা ঠিকমত শ্বাস নিতে পারছে না বলে সতর্ক সঙ্কেত দিল। আমি তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম এবং প্রথমবারের মতো অনুভব করলাম প্রচণ্ড ভয়। মহিলাটি মায়ের বুকের ওপর হাত রাখল, আমাকেও ইশারায় তা করতে বলল। এটা ছিল খুব অদ্ভুত আর বেদনাদায়ক অনুভূতি।

আমি স্থির দৃষ্টিতে মায়ের সুধাময় মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছি কী গভীরভাবেই না অসংখ্য রেখা কুঞ্চিত চামড়ায় জেগে উঠেছে। তার চোখের পাতলা পাতাগুলো যেন তার আয়ুর মতোই প্রসারিত হয়ে আছে। নাকের ওপর শুধু একটা আঁচড়ের হালকা দাগ, খুব সম্ভবত গোলাপের ঝাড়ে লেগে দাগটা হয়েছে।

সেইরাতে স্বপ্নে আমি গোলাপ দেখলাম। বুঝতেও পারলাম না ঠিক কখন আমি আমার মাকে হারিয়ে ফেলেছি। সে ডুবে ছিল প্রশান্তিময় ঘুমের ভেতর। আমি এমন এক আতঙ্ক আর যন্ত্রণায় জেগে উঠলাম, যা এর আগে আমার অভিজ্ঞতাতেই ছিল না। যারা তাকে জানত আর ভালোবাসত, তারা সবাই ছুটে এসেছিল। কাঁদছিল। তারা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছিল, কী ভাল মানুষটাই না ছিল তোমার মা। তারা বলছিল কীভাবে আমার মা তার সারাজীবনের ইচ্ছাগুলোকে পূরণ করতে পেরেছিল আর আমাকে কী ভালোই না সে বাসতো।

এই যন্ত্রণার বিবরণ অসম্ভব। প্রবল বিতৃষ্ণার সঙ্গে আমি আর পেরে উঠতে পারছিলাম না। আমার বন্ধুটি নানান কথা বলে আরো তীব্র আঘাত করছিল। তুমি খুবই ভাগ্যবান যে তোমার মায়ের পাশে ছিলে। বন্ধুটি বলছিল, মায়ের মতো আপন আর কেউ নেই।

আহ্ মা! মাগো!! কোনোদিনই আমি তার ইচ্ছা অনিচ্ছার খোঁজ করিনি। সেইসব শব্দ আর বইগুলো, যা সে কখনোই বুঝতে পারেনি, পড়েওনি কোনোদিন; তার স্থির হয়ে যাওয়ার ভেতর আমি যেন সেইসব নিয়ে এখন বর্ম আচ্ছাদিত!

সে সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে ধৈর্য ধরেছে, ভালোবেসেছে। তাকে যে ভালোবাসি এই বিষয়টা আমি কখনোই তাকে বোঝাতে পারিনি। আমি ভাবছিলাম আমিও মরে যাব। বারবার মনে হচ্ছিল যে মা স্থির হয়ে থেকেও দেখতে পাচ্ছে সেই শব্দরাশি, যা আমার বইগুলোর ভেতর ঘুমিয়ে রয়েছে।

সন্ধ্যায় চুলার প্রাত্যহিক আগুন ঘরটিকে কেমন আলোকময় করে তুলেছে। সে-আলোয় দেখছিলাম মা প্রতিদিনের মতো খবরের কাগজ পড়ছে দীর্ঘ সময় ধরে এবং খুব ধৈর্যের সঙ্গে। যা দেখে মাঝেমাঝেই ভাবতাম স্রেফ সময় কাটানোর জন্যই মা কাগজগুলো নিয়ে বসে রয়েছে। নিষ্ঠুর নিঃস্পৃহতা আমাকে যেন আঘাতের-পর-আঘাতে সংজ্ঞাহীন করে ফেলছিল। কী বলছিলাম আমি? ছিলামই-বা কোথায়? হঠাৎ মাসিমার ধাক্কায় আমি যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়লাম। দুমড়ানো কণ্ঠে আমি কাঁদতে শুরু করলাম। জীবনে এই প্রথমবার আমি মাকে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরলাম। অনুভব করলাম তার কোমল আর সিক্ত গালের মৃত্যুহীম শীতলতা। হাত রাখলাম তার জীবন থেকে ফিরিয়ে নেয়া হাতের ওপর, যেন আমার পুরো জীবনটা এখন তারই ছায়ায় আশ্রিত। মাসিমা ফিসফিসিয়ে বললেন--তোমার অশ্রু যেন তাকে কোনোভাবেই স্পর্শ না করে।

শেষকৃত্যের আচারগুলো এমনভাবে করা হচ্ছিল যেন স্বপ্নের ভেতর ঘটছে। প্রার্থনা ও উপবাসের জন্য দীর্ঘ রাত্রি জাগরণ আমার যন্ত্রণাগুলোকে ধীরে ধীরে উপশম করছিল। মায়ের পুরোনো বন্ধুরা তার মরদেহের পাশেই বসেছিল। তারা এমনভাবে কথা বলছিল যেন মা ও তাদের মধ্যে সংলাপ হচ্ছে। তারা তাকে সেইসব সুখী দিনগুলোর কথা বলছিল। বলছিল যে, গৃহস্থালীর কাজে সে কতই নিপুণা ছিল। তারা বলছিল--তোমার ঘরে খাবার থাকত সব সময়। যখন সে অন্যভুবনে গিয়ে পৌঁছাবে, পূর্বপুরুষেরা তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে আসবে। যখন সে স্বর্গের বড় গাছটির তলে গিয়ে দাঁড়াবে, গাছের পাতাগুলো ঈশ্বরের পবিত্র ইচ্ছায় তার ওপর ঝরে পড়বে এমনভাবে যেন মুকুট পরিয়ে বরণ করে নিচ্ছে... তীব্র শোকে সান্ত্বনা দেওয়ার কী আপ্রাণ চেষ্টা। জীবন আর ডিমকে একাকার করে আমার বন্ধুর বলা কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করলাম। প্রতিটি মুহূর্ত কী অচেনাই না ছিল। আসলে অভিজ্ঞতাই সবকিছু নয়। অতি সতর্কতার সঙ্গে নিজেকে তৈরি করে নেওয়ার পরও জীবন তার বিস্ময়কর খেলাটি খেলতে শুরু করে আর তোমাকে সব সময় সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হয়।

আমি বিশ্বাস করতাম যে আমার জীবনে মায়ের উপস্থিতি হচ্ছে স্রেফ একটা কবচের মতো, যে-কবচ কখনোই তার জাদুশক্তি হারিয়ে ফেলবে না। হৃদয়ের একেবারে অতল থেকে আমি এটা জানতাম যে আমার সম্পর্কে মায়ের উদ্বেগ ছিল একটা ঐশ্বরিক সম্মোহনের মতো। মা যেন জীবনের এক জাল। জীবনের চারপাশে মায়ের মতো এক জালের বিস্তার, চারপাশ থেকে সে-জাল আমাকে ঘিরে রেখেছে। আজ যখন সেই জাল আর নেই তখন আমি শুধু প্রার্থনা করছিলাম, এটা হবে এমন এক অপরাজেয় শক্তি, যা আমাকে আগের মতোই বাঁচিয়ে রাখবে।

বন্ধুটি আমাকে একা ফেলে চলে যায় নি। শেকড়সুদ্ধ চলে এসেছিল আমার কাছে। এইবার সে কোনও ধরনের মালপত্র নিয়ে আসেনি। সে কেবল বিড়বিড় করছিল-- আহ্, কী বিষাদ! কী দুর্বিষহ যন্ত্রণা!

আমি কায়মনে চাচ্ছিলাম সে আমার সঙ্গে থাকুক। চিরস্থায়ীভাবেই থাকুক। সে অতিথিদের দেখাশোনা করছিল আর মাঝে মাঝে বাগানে এসে আমার সঙ্গে হাঁটছিল। মায়ের বড় যত্নে গড়া এই বাগান।

বাতাস বইছিল সবকিছুকে এলোমেলো করে দিয়ে আর নিজেকে যেন অবগুণ্ঠিত করে ফেলছিল আমাদের নগ্ন গোড়ালির কাছে। বন্ধুর উদ্দাম চুলগুলো উড়ছিল আর বাগানের গুচ্ছের ফুলগুলো এমনভাবে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল যেন উচ্ছৃঙ্খল এক বালিকা সমস্ত ফুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে খোঁপায় পরে নিচ্ছে।

যদিও হাঁটছি বাগানের ভেতর, তবু বারবার কেন যেন মনে হচ্ছে হাঁটছি মাইন-পুতে-রাখা-কোনও-যুদ্ধক্ষেত্রের ভেতর দিয়ে। জায়গাটা মায়ের হাতে লাগান গাছে ভর্তি। গাছগুলোকে দু’হাতে না সরিয়ে যদি কেউ কখনো বাগানে ঢুকে পড়ে তো সে ফিরে আসবে এক আশ্চর্য অনুভূতি সঙ্গে করে। মনে হবে সবুজ ধারালো ব্লেড কেটে ফেলেছে তার সারা শরীর!... ছোট্ট পলকা ডালগুলো হঠাৎ ভরে যায় সদ্যজন্মানো অসংখ্য চোখে এবং গোলাপের পাপড়িগুলোকে তছনছ করে দেয় দমকা হাওয়া, আর ঝুপ করে নামা বৃষ্টির অঝোর ধারায় তারা অবিরাম উড়ে যেতে থাকে!

বাঁচ, বেঁচে থাকো। মা বলতেন। আমি জানতাম সে এখানেই আশেপাশে কোথাও সবসময়ই থাকবে, দেখতে থাকবে নির্দয়, বিষণ্ণ উঁচু পাহাড়গুলো। বাঁচ! বেঁচে থাকো!

মাটি খুব নরম আর সূক্ষ্ম ছিদ্রবহুল। আমি দেখেছি এর মধ্যে কীভাবে চারপাশের কঠিনতাকে অগ্রাহ্য করে লিলি ফুলের চারাগুলো ভাঁজ করা পাতা নিয়ে মাটি ভেদ করে একদিন দাঁড়িয়ে যায়, বিকশিত সৌন্দর্যের প্রকাশ কোনও অপরাধ নয়—এমন ভঙ্গিতে; স্বয়ং পৃথিবীই তার জন্য এত উর্বর!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ