‘দ্য ন্যারো
রোড টু দ্যা ডিপ নর্থ’
যুদ্ধের
সংকীর্ণ পথ থেকে জীবনের হাই ওয়ে
অলাত এহ্সান
সময়টা ১৯৪২ থেকে ১৯৪৩ সাল। তখন পর্যন্ত ‘লিটল বয়’, ‘ফ্যাট বয়’ নামক দুই মহাবিষ্ফোরক আমেরিকা হিমাগারে রক্ষিত। তাই বিদীর্ণ চিৎকারে বিভৎস ধংসযজ্ঞে পরিণত হয়নি হিরোশিমা-নাগাসাকি। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে বিশ্ব। বিশ্বজুড়েই সে যুদ্ধ। সবাই বলছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। গড়ে ওঠেছে ‘মিত্র বাহিনী’ ও ‘শত্রু বাহিনী’ নামক যুদ্ধ প্রকরণ। দুইটি যুদ্ধ শিবির। পরস্পর পরস্পরের শত্রু। বিভিন্ন দেশ সমবেত হচ্ছে এই দুই শিবিরে।
নিঃসংশ আক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছে দেশ। দখলের সীমা-পরিসীমা বৃদ্ধি হচ্ছে ক্রমেই। হিটলার-মুসিলিনের শত্রু বাহিনীর অন্যতম সেনা নায়ক জাপান। অবশ্য সাম্যের ঝাণ্ডাউঁচিয়ে রাখা সোভিয়েত ইউনিয়ন তখনো যোগ দেয়নি কোথাও। তার ছোঁয়া লেগেছে ভারতবর্ষেও। ভারতবর্ষ তখন টালমাটাল। একদিকে স্বাধীনতা, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভেদ রেখে ক্রমেই পরিষ্কার হচ্ছে। অনৈক্যের ভূমিতে দাঁড়িয়েও বিপ্লবী মাস্টার দা, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরাম অগ্নিযুগের স্ফুলিক ছড়াচ্ছেন। মনন্তরের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে চারদিকে। বিশেষত বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চলে। চট্টগ্রামে নির্মিত হচ্ছে মিত্র বাহিনীর জন্য হাই ওয়ে, যুদ্ধের কৌশল হিসেবে। একই সময়ে আজকের থাইল্যান্ড (তৎকালীন শ্যাম দেশ) থেকে মায়ানমার (তৎকালীন বার্মা) অবধি নির্মিত হচ্ছে দীর্ঘ এক রেলপথ। দৈর্ঘ্য ৪১৫ কিলোমিটার। এর আরেক নাম Death Road বা ‘মৃত্যুর রেল(পথ)’। জাপান সাম্র্রাজ্যের জন্য তৈরি হচ্ছিল এটা। এখানের শ্রমিকরা সব যুদ্ধবন্দী। এদের মধ্যে প্রায় আড়াই লক্ষ এশীয় শ্রমিক এবং একষট্টি হাজার যুদ্ধবন্দি বৃটিশ অস্ট্রেলিয় মার্কিনীসহ বিভিন্ন দেশের সৈনিক। কাজের পরিবেশের নিদারুণ অবস্থায়ও শ্রম দিতে বাধ্য করা হচ্ছিলো তাদের। মুটোমুটি দাস-শ্রমিকদের জীবনযাপন করতো তারা। টানা উপোস, নির্মম অত্যাচার, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পশুর মতো অমানুষিক শ্রমের সঙ্গে সঙ্গে তারা নানা রকম ক্রান্তীয় রোগে আক্রান্ত হচ্ছিলেন। ফলে আনুমানিক নব্বই হাজার এশীয় শ্রমিক এবং ষোলো হাজার যুদ্ধবন্দি রেলপথ নির্মাণকালে মারা যান। কিন্তু সীমাহীন যন্ত্রণা সয়ে যারা বেঁচে ছিলেন তাদের একজনের জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘The Narrow Road to the Deep North’। বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘গহিন উত্তরের সংকীর্ণ পথ’। লেখক রিচার্ড ফ্ল্যানাগান। শ্রমিকদেরই যে একজন ব্যক্তির জীবন কাহিনী নিয়েই তার উপন্যাস। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া এই মানুষটা তার বাবা। বাবার সেই অভিজ্ঞতায় অনুপ্রাণিত হয়েই প্রায় এক যুগ ধরে উপন্যাসটি লিখেছেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভালবাসার বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা এই ‘দ্য ন্যারো রোড টু দ্যা ডিপ নর্থ’ উপন্যাসটি এ বছরের ম্যান অফ বুকার পুরস্কার জয় করে নিয়েছে। প্রসঙ্গ ক্রমে উল্লেখ্য যে, এ বছরের সাহিত্যের নোবেল জয়ি প্যাত্রিক মোদিয়ানোর বিখ্যাত উপন্যাস ‘The Missing Persion’ একই সময়ের আবহে লেখা।সাহিত্যের উপর বিশ্বে যে সকল পুরস্কার আছে তার মধ্যে ১. লেখক এবং ২. গ্রন্থ-ই প্রধান। ম্যান অফ বুকার পুরষ্কার গ্রন্থ ভিত্তিক একটি পুরষ্কার। প্রতি বছর ইংরেজি ভাষায় রচিত শ্রেষ্ঠ মৌলিক উপন্যাসের স্বীকৃতি স্বরূপ এ পুরস্কার দেয়া হয়। এর মোট অর্থমূল্য ৫০০০০ পাউন্ড। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। টাকার অংকে এর অবস্থান বিশ্বে ৩৮তম। কিন্তু এর পুরষ্কারের জন্য বিচার বিশ্লেষণ ও নির্বাচন পদ্ধতি একে বিশিষ্ট্যতা দান করেছে। ১৯৬৯ সালে পুরষ্কারটি প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে আজ অবধি সামান্য কিছু বিচ্যুতি ছাড়া একে নিয়ে তেমন কোনো বিতর্ক নেই। বিভিন্ন কারণেই এবছরের বুকার পুরষ্কার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে। ম্যান অফ বুকার প্রাইজ পাওয়ার পর সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারের সর্ট লিস্টে স্থান করে নেয়া বা নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন, এমন সাহিত্যিকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। একসময় ডগমাটিক ভাবেই বলা হতো, বুকার পুরষ্কার হচ্ছে নোবেল পুরষ্কারের ইশারা।
২০১৪ সালের আগে বৃটেন, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ, জিম্বাবুয়ে ও আয়ারল্যান্ডের লেখকরা এ পুরস্কার পেতেন। এই পুরস্কারের ৪৬ বছরের ইতিহাসে এ বছরই প্রথমবারের মতো সাহিত্যিকের জাতীয়তা বিবেচনা করা হয়নি। বরং, সব দেশের লেখকদের জন্য এটি উন্মুক্ত ছিল। শর্ত শুধু, উপন্যাসটি অবশ্যই ইংরেজি ভাষায় রচিত ও যুক্তরাজ্যে প্রকাশিত হতে হবে। নতুন নিয়ম প্রবর্তনের সময় থেকেই এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ছিল। বিশ্বের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় লেখক-সমালোচক এর ফলে মার্কিন লেখকদের আধিপত্য দেখা যেতে পারে বলে শঙ্কাপ্রকাশ করেছেন। ২০১৪ সালের ম্যান বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত ঔপন্যাসিকের দিকে তাকালে এটা আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। এ বছর যে ৬ ঔপন্যাসিক চূড়ান্ত বাছাইয়ে মনোনিত হয়েছিলেন এর মধ্যে ৩ জন বৃটিশ, ২ জন মার্কিন ও একজন অস্ট্রেলিয় নাগরিক। অর্থাৎ প্রথম বছরেই মার্কিন লেখদের পদভার শোনা যাচ্ছে। যাই হোক, সাহিত্যিকদের সেই শঙ্কা আপাত পাশকাটিয়ে এবার বুকার জয় করলো ৫৩ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়ান লেখক রিচার্ড ফ্ল্যানাগান। লন্ডনের গিল্ডহলে ১৪ অক্টোবর রাতে পুরস্কার বিজয়ী সাহিত্যিক হিসেবে তার নাম ঘোষণা করে জুরি বোর্ড। ফ্ল্যানাগানের হাতে পুরস্কারের অর্থ ও ট্রফি তুলেদেন যুক্তরাজ্যের প্রিন্স চার্লসের স্ত্রী ডাচেস অব কর্নওয়েল ক্যামিলা। এ পর্যন্ত তিনি তৃতীয় অস্ট্রেলিয় যিনি ম্যান অফ বুকার পুরষ্কার পেলেন। এর পূর্বে তার স্বদেশি থমাস কেনিলি ‘শিন্ডলার্স আর্ক’ উপন্যাসের জন্য ১৯৮২ সালে এবং পিটার ক্যারি ‘দি হিস্টরি অভ দ্য কেলি গ্যাং’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সালে এ পুরষ্কার পান। ‘দ্য ন্যারো রোড টু দ্যা ডিপ নর্থ’ উপন্যাসকে তুলনাহীন বলে বর্ণনা করেছেন তার দেশের সাহিত্য সমালোচকরা। অনেকের মতে তিনি অস্ট্রেলিয়ার সেরা ঔপন্যাসিক।
বুকার বিচারকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান এসি গ্রেলিং, লেখকের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার সময় বলেন, ‘এই উপন্যাস লেখার জন্যই রিচার্ড ফ্ল্যানাগানের জন্ম হয়েছিল। এটি যুদ্ধ ও প্রেমের এক অনন্য আখ্যান।’
আগেই উল্লেখ করেছি, ‘দ্য ন্যারো রোড টু দ্যা ডিপ নর্থ’ ফ্ল্যানাগান জন্মের ১৯ বছর আগে ঘটে যাওয়া তার বাবা জীবন অবলম্বনে লিখা। অর্থাৎ পিতার কঠিন জীবন সংগ্রামকে উপজীব্য করতে গিয়ে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে মানসচক্ষে অবলোকন করতে হয়েছে। অবলোকন করতে হয়েছে যুদ্ধবন্দী ও শ্রমদাসদের উপর চালানো সীমাহীন নির্যাতনকে। এই অবলোকন তার জীবন থেকেও এসেছে। রিচার্ড ফ্ল্যানাগানের জন্ম তাসমানিয়ার লংফোর্ডে। তাসমানিয়ার পশ্চিম উপকূলীয় খনির শহর রোজবেরিতে ফ্ল্যানাগানের শিশু ও কৈশোরকাল কেটেছে। এখানে তিনি খনি শ্রমিকদের জীবন সংগ্রাম খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। যা তাকে পরবর্তীকে জীবনের সেরা সাহিত্যটাই রচনা করতে সাহায্য করেছে। তবে এ বিষয়েই তার পূর্বে সাহিত্য রচিত হয়েছে। শ্রম বন্দিশিবিরের ঘটনা নিয়ে ১৯৫২ সালে ফ্রান্সের পিয়েরে বুলে ‘দ্য ব্রিজ ওভার দি রিভার কাওয়াই’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন। এর ওপর ভিত্তি করে ডেভিড লেন ১৯৫৭ সালে একই নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। উইলিয়াম হোলডেন, এ্যালেন গিননেস, সেস্যু হাকাওয়া, জ্যাক হকিন জিওফ্রেরি হর্ণে মতো শক্তিশালী সব অভিনেতা অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়। একাডেমি এওয়ার্ড তথা অস্কার দৌড়ে চলচ্চিত্রটি ৭টি ক্যাটেগরিতে পুরষ্কার লাভ করে। ফ্ল্যানাগানের সুবিধা হলো, তার আগের চলচ্চিত্র বা সাহিত্যের কেউ তার বাবার মতো জীবন্ত উৎসের ঘনিষ্টতা পাননি। বরং উত্তর প্রজন্ম হিসেবে তার সম্ভব হয়েছে আগেকার সাহিত্য ও চলচ্চিত্রকে স্পর্শ করার। ফলে তিনি পিয়েরে বুলেকেও তিনি স্পর্শ করেছেন। তবে সন্দেহ নেই, এর মধ্য দিয়ে তার এই বিষয়টি উপর নতুন আলো ফেলেছেন। যা বিষয়টি নিয়ে বিশ্বকে আবার ভাবাতে সাহায্য করবে। তিনি তার উপন্যাসের নামটিও নিয়েছে, জাপানি মহান হাইকু কবি বাশো-র লেখা একটি বিখ্যাত বইয়ের শিরোনাম থেকে। তাছাড়া শিক্ষাজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ফ্ল্যানাগানের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠের বিষয়ও ছিল ইতিহাস। তিনি অক্সফোর্ডের ওরচেস্টার কলেজ থেকে রোডস স্কলারশীপ পেয়ে ইতিহাস শাস্ত্রে মাস্টার্স করেন। এই ইতিহাস পাঠও তাকে এ উপন্যাস লেখার রসদ ও উৎসাহ যুগিয়েছে, তা বলা যা। এটি তার ষষ্ঠ উপন্যাস। জীবনের সেরা সাহিত্যকর্মটি শেষ করতে তিনি সময় নিয়েছেন ১২ বছর।
‘দ্য ন্যারো রোড টু দ্যা ডিপ নর্থ’ উপন্যাসের কাহিনী শেষ থেকে শুরু হয়ে আবার শেষে গিয়ে সমাপ্ত হয়েছে। উপন্যাসের মূল সুর প্রেমকাহিনী হলেও নায়কের স্মৃতি চারণ ও অবস্থা বর্ণনার মধ্যদিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিভৎসতার চিত্র এঁকেছেন লেখক। উপন্যাসটি অস্ট্রেলিয় সেনাবাহিনীর এক ডাক্তার আর তার ‘মামার স্ত্রী’র প্রেমকাহিনীর মধ্যদিয়ে এগিয়েছে। সামাজিক ভাবে মামীর সঙ্গে প্রেমেরস্বীকৃতি নেই। কিন্তু যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তাদের এই সম্পর্কের বৈধতা দিয়েছে।
উপন্যাসের নায়ক ডোরিগো ইভান্স একজন অস্ট্রেলিয়। পেশায় সার্জন। যুদ্ধ শেষে তিনি আবিষ্কার করেন যে, অস্ট্রেলিয়ায় তিনি রীতিমতো কিংবদন্তি। একজন জাতীয় বীর। জীবনের মাঝ বয়স তার। তার নামে স্মারক মুদ্রা, দাতব্য কাজের প্রচারপত্রও তৈরি করা হচ্ছে। তিনি যারপরনাই অবাক হন। কারণ তখনো তার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং যুদ্ধের মায়দান থেকে জীবন যুদ্ধে সমর্পিত হয়েছেন। তাছাড়া ডোরিগোর বাল্যকাল কেটেছে বিশ্বের সুখ-দুঃখ থেকে দূরে, অজ পাড়া গাঁয়ে। যেখানে বিদ্যুৎ নেই, পৌঁছায়নি। দিন কাটে ছিন্ন বসনে। আর ঘুমাতেন ফাঁদ পেতে ধরা ‘পোসাম’-এর চামড়া গায়ে দিয়ে। একটা শিক্ষা বৃত্তির টাকায় সে ডাক্তারি পড়েন এবং একটা বইয়ের দোকানে কাজ করেন। ভাগ্য ক্রমে সেনাবাহিনীতে ডাক্তারের চাকরি পান তিনি। চাকুরি পাওয়ার পর তার পরিচয় হয় অ্যামি নামে এক ছোটোখাটো মহিলার সঙ্গে। যিনি সম্পর্কে তার মামার স্ত্রী। তিনি এই উপন্যাসের নায়িকা। এ পর্যায় তারা প্রণয় সম্পর্কে আবদ্ধ হলেও তাদের জীবনটা খুব একঘেয়ে ও মুক্তিহীন। তবু তা ‘অভিজ্ঞতার এক ষড়যন্ত্রে’ টিকে থাকেন।
একসময় ডোরিগো থাই রেলওয়ে ক্যাম্পের জাপানি কমান্ডার নাকামুরা-র বন্দিশিবিরে বন্দি হন। সার্জন হিসেবে তিনি এখনে এক হাজার বন্দীর নেতা। এই নেতৃত্ব তাকে বন্দীদের আকাক্সক্ষার রূপে শক্তিশালী। তিনি এক দল যুবকে সঙ্গে পরিচিত হন যারা ক্রমেই মরতে বসেছে। কিন্তু তারা টিকে থাকার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। এই ক্ষমতা দেখে ডোরিগোর চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা করে, হতাশাকে বাধ্য করবে তাদের নিশ্চিত জীবনে বার্তবহ মুখ বয়ে বেড়াতে। উন্যাসের এ পর্বে ডোরিগো আর নাকামুরার দগদগে জীবনের কাহিনী, বন্দিশিবিরে সার্জনের কাটাকুটির বর্ণনা পাঠককে আচ্ছন্ন করে।
ডোরিগোর যুদ্ধের পর দেশে ফিরে। নাকামুরাও ফিরে। তারা রাজধানীতে ক্লান্তি আর নোংরার মধ্যে ভিড় ঠেলছে। নাকামুরা তখন যুদ্ধাপরাধের বিচার এড়িয়ে চলছে। ডোরিগো জীবনের স্থিতি খুঁজেন। কিন্তু পান না। তাই যুদ্ধের প্রতিঘৃণা থাকলেও যুদ্ধ শেষে ফিরে ডোরিগো অস্ট্রেলিয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। এমনকি সে আর অ্যামির কাছে ফিরে যায় না, যায় অন্য এক মেয়ের কাছে, মেলবোর্নে। এক অফিসার তাকে বলে ‘এই প্রতিদিনের বেঁচে থাকাই আমাদের শেষ করে দেয়।’ ফলে অন্যদের কাছে ডোরিগো এবং নাকামুরা দুজনকেই অভিনেতা মনে হয়। তারা বন্দি শিবিরটার বাইরের জগতটাতে অভিনেতা। কিন্তু যুদ্ধ ক্ষেত্রের স্মৃতিই তাদেরকে শাসন করে। তাদের ক্ষয় করে, তিলে তিলে নিঃশেষ করে। এসবের মধ্যদিয়ে উন্মোচিত হয় উন্যাসের আসল সত্য-একই মানুষের একই সাথে ভালো এবং খারাপ হওয়াটা কেমন। সবচেয়ে বড়ো কথা, মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসে বেঁচে থাকাটা কত কঠিন।
প্রসঙ্গটা অধিকাংশ দেশের জন্যই সত্য। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থার মধ্যদিয়েও পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ তাদের পক্ষে যুদ্ধ জয় সম্ভব হলেও জীবন জয় ভার। ফ্ল্যানাগান বর্ণময় বিন্যাশ, কাহিনীর তোড় পাঠকে সহজের ভাসিয়ে নেয়। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর বর্ণনা, বিরতি, কাহিনীর এগিয়ে চলা, সময়ের খেলা-সবকিছু সু-সমন্বিত। গল্প বলার মুন্সিয়ানা ফ্ল্যানাগানের নিজস্ব। কখনো কখনো দার্শনিকতা ও শক্তিশাল বক্তব্য পাঠকে মোহিত করে। উপন্যাসে ফ্ল্যানাগান মূলত মানুষের সংগ্রাম যুদ্ধের সংকীর্ণ পথ থেকে জীবনের হাই ওয়েতে এনেই ঠেকিয়েছেন।
কথা সাহিত্যে হাতেখড়ির আগে ফ্ল্যানাগানের আরো ৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গ্রন্থ ‘এ টেরিবল বিউটি: হিস্ট্রি অব দি গর্ডন রিভার কান্ট্রি।’ প্রথম বইটি অস্ট্রেলিয়দের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়। ননফিকশন অন্য বইগুলো হচ্ছেÑ দ্য রেস্ট অব দি ওয়ার্ল্ড ইজ ওয়াচিং (১৯৯০), কোডনেম লোগো (১৯৯১) ও পেরিস ফেড বাস্টার্ড (১৯৯১), এন্ড হোয়াট ডো ইউ ডো, মিস্টার গাবলে?(২০১১)।
১৯৯৪ সালে লিখেন ‘ডেথ অব এ রিভার গাইড’ উপন্যাসের মাধ্যমেই কথাসাহিত্যের অঙ্গনে পা রাখেন ফ্ল্যানাগান। নদী পথের একজন গাইডের জীবনকে নিয়ে লেখা এটি। এর বইটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। ফলে ফ্ল্যানাগানকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। স্লোভেনিয়ার এক ইমিগ্রান্টকে নিয়ে লিখেন ‘দ্য সাউন্ড অব ওয়ান হ্যান্ড ক্ল্যাপিং’। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত এই বইটি অস্ট্রেলিয়ায় বেস্ট সেলার হয়েছে। প্রথম দুটি উপন্যাসই সমালোচদের দ্বারা প্রশংসিত হয়। তার তৃতীয় উপন্যাস ‘গোল্ডস বুক অব ফিস’। প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। এটি একজন শিল্পীর কাহিনী এ উপন্যাস। যেখানে শিল্পী একটা কালো রমনীর প্রেমে পড়েছেন। বইটি তাকে ২০০২ সালে কমনওয়েলথ রাইটার্স প্রাইজ এনে দেয়। ২০০১ সালের ৯/১১ ঘটনার প্রেক্ষাপটে রচিত ‘আননোন টেররিস্ট’ প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। ২০০৮ সালে প্রকাশ পায় ‘ওয়ান্টিং’। এ দুটি বইও নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। তার সাম্প্রতিক বই ‘ন্যারো রোড টু দি ডিপ নর্থ’। ২০১৩ প্রকাশিত এই বইটি তাকে সাহিত্য জীবনের সবচেয়ে বড় পুরষ্কার ‘ম্যান অফ বুকার প্রাইজ’ এনে দিল। এছাড়াও সাহিত্যের জন্য প্রাপ্ত পুরষ্কারের জন্য মনোনিত হয়েছিলেন। এরমধ্যে ২০০৮ সালে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ান প্রিমিয়ার্স লিটারেরি ফর ফিকশন, ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাইলস্ ফ্রাংলিন এ্যাওয়ার্ড (সংক্ষিপ্ত তালিকা) এবং ২০১১ সালে তাসমিয়ানিয়া বুক প্রাইজ উল্লেখযোগ্য।
আপাদমস্তক সাহিত্যের মানুষ ফ্ল্যানাগান সাহিত্য ছাড়া সিনেমার সঙ্গে যুক্ত। তিনি সিনেমার পরিচালক ও স্ক্রিপ্ট লেখক। ১৯৯৮ সালে তার চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় মুক্তিপায় ‘দ্য সাউন্ড অফ ওয়ান হ্যান্ড ক্ল্যাপিং’। সিনেমাটি ওই বছর বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন বেয়ার পুরষ্কারের জন্য মনোনিত হয়েছি। বাজ লেহম্যাননের সঙ্গে ২০০৮ সালের ‘অস্ট্রেলিয়া’ সিনেমায় সহ-লেখক ছিলেন তিনি। তাছাড়া ফ্ল্যানাগানের উপর আঁকা জিওফ্রে দ্যার একটি পেইন্টিং ২০০৩ সালে আরচিবাল্দ প্রাইজ জয় করে।
রিচার্ড ফ্ল্যানাগানের জন্ম ১৯৬১ সালে। পুরো নাম রিচার্ড মিলার ফ্ল্যানাগান। তিনি ছিলেন তার পিতার ৬ সন্তানের মধ্যে ৫ম। ছাত্র জীবনে মেধাবী ছাত্র ফ্ল্যানাগান তাসমানিয়া ভার্সিটিতে পড়ার সময় স্টুডেন্ট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ‘ভয়েসলেস, দ্য এনিমাল প্রোটেকশন ইন্সটিটিউট’ এর কাউন্সিলিং মেম্বার তিনি। তার এক ভাই মার্টিন ফ্ল্যানাগান অস্ট্রেলিয়ার একজন গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিক। ‘সেটারডে এজ’ পত্রিকায় লেখা তার কলাম ও সাংস্কৃতি বিষয়ক মতামত অত্যান্ত গুরুত্বে সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। রিচার্ড ফ্ল্যানাগান ও স্ত্রী মাজদা’র পরিবারে তিনটি কন্য সন্তান রয়েছে। নাম- রোজি, জেন এবং এলিযা।
চলতি বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত ম্যান বুকারের পুরস্কারের জন্য মনোনীত ১৩টি উপন্যাসের তালিকায় ব্রিটেনের বাইরে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন ফ্ল্যানাগান। দীর্ঘ তালিকা থেকে বাছাই শেষে গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত তালিকায় ৬টি উপন্যাস ও তাদের লেখকের নাম রাখা হয়। ফ্ল্যানাগান ছাড়াও এই তালিকায় ছিলেন দুই মার্কিন লেখক যশুয়া ফেরিস(টু রাইস এগেইন এ্যাট এ ডিসেন্ট আওয়ার) ও কারেন জয় ফওলার (উই আর অল কমপ্লিটলি বিসাইড আওয়ার সেলফ্) এবং তিন বৃটিশ হাওয়ার্ড জ্যাকবসন (জে), নীল মুখার্জী (দ্য লাইভস অফ আদারস) এবং আলী স্মিথ (হাউ টু বি বোথ)। পুরষ্কার গ্রহণ করতে এসে লেখক বক্তৃতায় রিচার্ড ফ্ল্যানাগান বলেন,‘আপনাদের সামনে উপন্যাস বিষয়ে যুগের দুঃখবাদ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। এগুলো আমাদের আধ্যাত্মিক, নান্দনিক ও মেধাবী গল্পগুলোর অন্যতম। এই গল্পগুলো এমন যা আমাদেরস্বতন্ত্র করে তুলেছে। এই গল্পগুলোর যে কোনোটির চূড়ান্ত প্রকাশই উপন্যাস। বিষয়ই উপন্যাস নয়। উপন্যাস জীবনের দর্পণও নয়, নয় জীবনের দিক-নির্দেশক। উপন্যাসই জীবন অথবা তা কিছুই নয়।’ ০

লেখক পরিচিতি
অলাত এহ্সান
জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। পদ্মার পাড় ঘেঁষে গ্রামের অবস্থান। গহীন গ্রাম। এখানে প্রধানত কলু, কাহার, জেলে, মুচি, তাঁতী, নিম্নবর্গে মানুষেরা বসত করে। প্রতিবছর পদ্মায় ভাঙে। অজস্র মানুষ স্বপ্নভাঙ্গা স্মৃতি নিয়ে শহরমুখী হয়। অধিকাংশ তরুণ জীবিকার প্রয়োজনে পাড়ি জমায় বিদেশে। এটাই যেন নিয়তি। এসবের ভেতরেও থাকে ঘটনা, নানা ঘটনা। এইসব জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। গুলতির বোবা রেখা তাক করে জঙ্গলে জঙ্গলে কেটেছে শৈশব। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন ঢাকা কলেজ থেকে। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত।
alatehasan@yahoo.com
অলাত এহ্সান
জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। পদ্মার পাড় ঘেঁষে গ্রামের অবস্থান। গহীন গ্রাম। এখানে প্রধানত কলু, কাহার, জেলে, মুচি, তাঁতী, নিম্নবর্গে মানুষেরা বসত করে। প্রতিবছর পদ্মায় ভাঙে। অজস্র মানুষ স্বপ্নভাঙ্গা স্মৃতি নিয়ে শহরমুখী হয়। অধিকাংশ তরুণ জীবিকার প্রয়োজনে পাড়ি জমায় বিদেশে। এটাই যেন নিয়তি। এসবের ভেতরেও থাকে ঘটনা, নানা ঘটনা। এইসব জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। গুলতির বোবা রেখা তাক করে জঙ্গলে জঙ্গলে কেটেছে শৈশব। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন ঢাকা কলেজ থেকে। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত।
alatehasan@yahoo.com
0 মন্তব্যসমূহ