গল্পের আলোচনা: ‘একটি হাসপাতালের জন্ম ও মৃত্যু’

কাল্পনিক নির্মাণে বাস্তবতাকে আত্মস্থ করার চেষ্টা

অলাত এহ্সান


প্রত্যেক লেখকের বুনিয়াদ হলো তার কাল। লেখক হবেন তার কালের সব চেয়ে ভাল বুঝদার ব্যক্তি। এই বোঝাপড়ার মধ্যদিয়ে তিনি সমাজের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বকে আবিষ্কার করেন। দ্বন্দ্বের এই আবিষ্কার, মননশীল উপস্থাপন ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি কালকে অতিক্রম করেন। রমাপদ চৌধুরী হচ্ছেন তার সময়ে সেই অগ্রবর্তী মানুষ, যিনি তার কালের সময় ও মানুষে দ্বন্দ্বকে দেখেছেন এবং বিশ্লেষণ করেছেন। আপাত বাস্তবতার ভেতরে যে ‘প্রকৃত বাস্তব’, যে বাস্তব ভবিষ্যৎ বস্তবতা নির্মাণ করে, তিনি তাকে উপস্থিত করেছেন। গল্পের আলোচনায় প্রবেশের আগে রমাপদ চৌধুরীর সাধারণ কিছু প্রবণতা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন।


একটা সমাজ দ্বি-স্তর বিশিষ্ট্য। অর্থাৎ এর আছে উপর কাঠামো ও ভেতর কাঠামো। দ্বন্দ্ব-এই দুই কাঠামোর ভেতরই ঘটে। যা প্রকাশ পায় সমাজের ব্যক্তির ক্রিয়া কলাপের ভেতর দিয়ে। ব্যক্তির কার্যকলাপের ভেতরে যেমন দ্বন্দ্ব থাকে, তার মনের ভেতরও দ্বন্দ্ব চলতে থাকে অবিরত। রমাপদ চৌধুরীর চোখ এই ব্যক্তির দিকেই। তিনি ব্যক্তির বাহ্যিক দ্বন্দ্বের দিকে নজর দেন বটে। তবে বাহ্যিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যদিয়ে মানসিক দ্বন্দ্বের দিকটি উন্মোচনেই তিনি বেশি আগ্রহী। এই মানসিক দ্বন্দ্ব ব্যক্তি চরিত্রের প্রকৃত পরিচায় বহন করে। যেকারণে মন:সমীক্ষকের মতো পাঠকেও গল্পের তাৎপর্য উদ্ধারের জন্য কাহিনীর উৎস ভূমিতে চলে যেতে হয়, কার্যকারণ এবং বিভিন্ন সম্পর্ক খুঁজে বের করার জন্য। রমাপদ চৌধুরীর প্র্রতিটি গল্প-উপন্যাসে এই চিন্তা-প্রকরণের ব্যবহার দেখা যায়। এটা তার সময়কার গল্পকারদের সাধারণ প্রবণতা ছিল। তবে তিনি এটাকে সবচেয়ে ভালো ও বুদ্ধিদীপ্তভাবে ব্যবহার করেছেন, তা বলা যায়। তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘খারিজ’ বা ‘বাড়ি বদলে যায়’-এর ক্ষেত্রে এ কথাটি। তার বিখ্যাত গল্প ‘আমি, আমার স্বামী ও একটি নুলিয়া’, ‘ফ্রীজ’, ‘বসার ঘর’ থেকে আমাদের আলোচ্য ‘একটি হাসপাতলের জন্ম ও মৃত্যু’র ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।

রমাপদ চৌধুরী নিছক কাহিনী বর্ণনা করেন না। রমাপদ’র পাঠক সক্রীয়। তিনি পাঠককে সক্রীয় রাখেন। ভাবার সুযোগ করে দেন। এই সক্রীয়তার ভেতর দিয়ে পাঠক নিজেকে আবিস্কার করেন, সমাজ ও রাষ্ট্র দেহের সঙ্গে দ্বন্দ্বকে আবিষ্কার করেন। ভবিষ্যৎ বাস্তবতাকে নির্ধারণ করতে চাওয়ার একটা আকাঙ্ক্ষা এর মধ্যে নিহিত থাকে।


ভারতীয় উপমহাদেশে পত্রের প্রচলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। বাংলা কথাসাহিত্যে পত্রের ব্যবহার অনেক যথেষ্ট দেখা যায়। কিন্তু সাহিত্যের প্রকরণ হিসেবে পত্রের ব্যবহার তেমন দেখা যায় না। পত্রোপন্যাস হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাঁধনহারা’ কিংবা নিমাই ভট্টাচার্য়ের ‘মেমসাহেব’ ছাড়া উল্লেখ যোগ্য উপন্যাস নেই বললেই চলে। আবার বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্পের নানা রকম রূপ আছে, এগুলির মধ্যে পত্রগল্প বেশ অপ্রচলিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্প বাদে আর তেমন উল্লেখযোগ্য গল্প পাওয়া যায় না। এর কারণ, পত্রে প্রবন্ধ লেখা সহজ(এক্ষেত্রে জহরলাল নেহেরু’র ‘বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গ’, ‘মা-মনিকে বাবা চিঠি’ উল্লেখ যোগ্য)। কিন্তু পত্রের ভাব অক্ষুণ্ণ রেখে পত্রের মধ্যে গল্প বসানো বেশ জটিল। রমাপদ চৌধুরী গল্পটি লিখছেন রবীন্দ্র-নজরুল সময়ে। গল্পের প্রকরণ যথেষ্ট বদলে গেছে। যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবেও পত্র একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। একটা কদর ছিল। আজকে যা আর নেই। অনেক মানুষ তখন লিখতে, পড়তে পারতেন না-তবুও। তাই গল্পের বাহির-কাঠামো হিসেবে পত্রকে বেছে নেয়া কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো বিষয় ছিল না। তবে পত্রের যথাপোযুক্ত ব্যবহারে প্রসঙ্গ সব সময়ই ছিল। এখনো আছে। কথাসাহিত্যে পত্রের ব্যবহার রমাপদ’র আগেও ছিল। তাছাড়া একটি গল্পে এক বা একাধিক পত্রের ব্যবহার এখনো আছে। তবে পুরো গল্পই পত্রের মধ্যদিয়ের প্রকাশের অভিনবত্ব রমাপদ চৌধুরীই স্বার্থক ভাবে দেখিয়েছেন। গল্পের জন্য এর আলংকারিক মূল্য যেমন গুরুত্ববহ, তেমনি মার্গীয়। রমাপদ চোধুরীর ‘একটি হাসপাতালের জন্ম ও মৃত্যু’ গল্পটি বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে পত্র বিষয়টি বুঝতে হবে। পত্রগুলোর এখানে প্রতীকি তাৎপর্যও আছে।

পত্র বলতে আমরা মূলত কোনো পত্রের লিখিত বা মুদ্রিত চরিত্রকে বুঝি। বৃক্ষ বলতে আমরা যেমন শাখা-কাণ্ড-পাতা শোভিত রূপকে বুঝি, তেমন। পত্র মানুষের ভাষার লিখিত রূপ। যে ভাষা বা বিষয় বক্তব্যের মধ্যদিয়ে সময় ও চিন্তা প্রবাহিত হয়। মূর্ত লাভ করে। পত্র একটি লিখিত রূপ হিসেবে বা বস্তুগত উপস্থিতর জন্য ভবিষ্যতের সাক্ষ্য হয়ে থাকে। তাছাড়া গল্পের বিষয় উপস্থাপনের জন্য যেটা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল- দূরত্ব। পত্র আসলে দূরত্বেরও প্রতীক। পত্র লেখক ও প্রাপক কখনোই মুখোমুখি হন না। ফলে শরীরি উপস্থিতির মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান, আবেগ তাড়িত হওয়া, স্পর্শে শিহরিত হওয়া-তা তারা কখনোই হন না। তাই কেউ কারো অনুভূতি মূল্যায়নের দায় থেকে বিরত থাকেন। নিরাবেগ বিষয় বক্তব্য প্রদানে তারা কুণ্ঠা বোধ করেন না। আবার কপটতারও সুযোগ থাকে। মোটকথা, এই দূরত্বের মধ্যদিয়ে আমাদের সমাজে যে বিচ্ছিন্নতা, দায়হীন পরিবেশ তৈরি হয়েছে গল্পকার রমাপদ চৌধুরী আমাদের সেই দিকেই দৃষ্টি ফেরান।

গল্পে পত্রের দূরত্ব বহুমাত্রিক। দূরত্ব রচয়িতা ও পাঠকে, চরিত্র ও কথকে, বিষয় ও কাঠামোয়। রমাপদ চৌধুরী রচয়িতা ও চরিত্রের দূরত্ব সৃষ্টি করেছেন, এর মধ্যদিয়ে নিয়ে পাঠক সরাসরি বিষয় বক্তব্যে প্রবেশ করেন। লেখক আমাদের সেই সুযোগটা করে দেন। অর্থাৎ লেখক আমাদের বিভিন্ন বাহ্যিক অনুভূতির মাধ্যমে বিভ্রান্ত বা আচ্ছন্ন না করে উদ্দিষ্ট বিষয়ে ভাবনার পাটাতন তৈরি করে দেন।

পত্র এই গল্পের অলংকার, আকর হচ্ছে বক্তব্য। বক্তব্যের উপস্থাপন শৈলী আবার নির্ধারিত হয় ব্যক্তি ও আকাঙ্ক্ষা দ্বারা। ফলে চিঠির খণ্ড খণ্ড বক্তব্য একই শরে বা শিকলে গাঁথা পরে। আমরা একটু খেয়াল করলেই দেখবো, প্রতিটি চিঠিই ত্রি-মাত্রিক ব্যঞ্জন বহন করে। অর্থাৎ চিঠিতে গুণময় সেন, প্রাপক ও বিষয় বক্তব্য-এই তিন ব্যঞ্জন আছে। এই পুনঃপুনিকতা দ্বারা লেখক বিষয় বক্তব্য স্পষ্ট করার চেষ্টা করেন।


এবার গল্পের চরিত্রগুলোর দিকে চোখ ফেরানো যাক। চরিত্র সৃষ্টি ও তার মনের গলি-রন্ধ্র আবিস্কার-রমাপদ চৌধুরির গল্পের প্রধান অঞ্চল। এই গল্পে চরিত্র আপাত নয়টি। সরকার দলীয় মন্ত্রী নুটুদা, বিরোধী দলীয় নেতা নিশাবাবু, সরকারি ইঞ্জিনিয়ার দাশগুপ্ত, ফিন্যান্স বিভাগের আমলা বসন্তবাবু, গুণময়ের প্রতিষ্ঠানের বয়োজেষ্ঠ্য কর্মচারি যতীনবাবু, অল্পবয়স্ক কর্মচারী শিবেন, গ্রামে উদ্যোমী যুবক অনন্ত এবং গুণময় সেন। গল্প পড়তে পড়তে মনে হয়, কখনো কখনো হাসপাতাল নিজেই এটা চরিত্র। গল্পের প্রধান চরিত্র-গুণময়। বিভিন্ন জনের নিকট লেখা গুণময়ের পত্রের মধ্যদিয়ে এই গল্পের কাহিনী বিন্যাস ঘটেছে। এই পত্রের মধ্য দিয়ে গুণময় একাই যেন কয়েকটা চরিত্রে রূপায়িত হয়েছেন। যেমন-অনন্তর কাছে তিনি গুণময়দা, মন্ত্রীর নিকট গুণময়, কর্মচারীর নিকট গুণময় সেন এবং ইঞ্জিনিয়ারের কাছে সেন। এদের সঙ্গে সম্পর্কের ধরনও আলাদা। গল্পে গুণময় সর্বোপরি একজন সাচ্চা ব্যবসায়ি। তার চোখ মুনাফার দিকে। তিনি সেদিকেই চলেন। তাই সামান্য সম্ভাবনার মধ্যদিয়ে ক্ষণে ক্ষণে তার চরিত্রের, বক্তব্যের বদল হয়। রমাপদ চৌধুরী এভাবে চরিত্রকে বহুমাত্রিক করেছেন। আবার গুণময় হয়ে ওঠেছেন তার শ্রেণীর ও গোত্রের বহু চরিত্রের একটি মূর্ত রূপ।

রমাপদ চৌধুরী গল্প বলতে গিয়ে কোনো ন্যারেটিভ তৈরি করেননি। গল্প এগিয়েছে পারস্পারিক দ্বন্দ্বের মধ্যদিয়ে। এই দ্বন্দ্ব-চরিত্রগুলোর মধ্যে, একটা চিঠির সঙ্গে আরেকটা চিঠির বক্তব্যের মধ্যে। কখনো কখনো একই চিঠির বক্তব্যের মধ্যে। আখেরে যা পুঁজির সঙ্গে মানবতাবাদের দ্বন্দ্বে পর্যবসিত হয়ছে। এবার দ্বন্দ্ব নিয়ে কথা বলা যাক।

এক. আমরা দেখি প্রথম চিঠিতে গুণময় বলছেন,‘গ্রামের ও আশেপাশের বড় জোতদার বা ব্যবসাদারদের দানে কোনও কিছু গড়ে তোলার দিন কি এখন আর আছে? সেসব এখন আর সম্ভব নয়। সরকার যদি এদিকে মন না দেয়, তা হলে কিছুই হবার নয়।’ আবার ১৮ নং চিঠিতে এসে বলছেন,‘ আমরা কন্ট্রাক্টররা চেষ্টা করি বলেই সেগুলো নড়াচড়া করে। এ-দেশে যদি কিছু কাজ হয়ে থাকে তা আমাদেরই চেষ্টায়।’ আবার বলছেন ‘তারপর আমি তো আছিই’, ৩২ নং চিঠিতে গিয়ে বলছেন,‘এ ব্যাপারে আমার কিছুই করার নেই’।

দুই. ভবন নির্মাণ ও কোয়ালিটি সম্পর্কে ১৮ নং চিঠিতে যে গুণময়কে আমরা বলতে শুনি ‘ইটের কোয়ালিটি, দারজা-জানালার কাঠ ইত্যাদি নিয়ে তাদের বাজে প্রশ্ন করার কোনও মানে হয় না। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, মিস্ত্রীরাই যদি জানত, তা হলে তারাই তো কনট্রাক্টর হয়ে যেত। বিশ্বাস রেখো, আমার গ্রামকে অন্তত আমি ঠকাব না।’ সেই গুণময় ২৬ নং চিঠিতে এসে বলছে, ‘হাসপাতালের জানালা-দরজাগুলো তাড়াতাড়ি রং করিয়ে দিয়ো, আর চুনকাম। কে কখন এসে দেখে যাবে, শেষে কাঠের কোয়ালিটি নিয়ে গোলমাল করবে।’

তিন. গুণময় সবসময়ই নিজেকে খেলাই গ্রামের মানুষ পরিচয় দিয়ে। দিয়েছে কাজে প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশের জন্য। আসলে এই পরিচয়ে মধ্য গুণময় তার অনান্তরিকতাকে ঢাকতে চেয়েছে। সে এতটাই আত্মগ্ন, সমাজ বিচ্ছিন্ন যে, শেষ পর্যন্ত দাবি করেছেন দেশের উন্নয়নের কাণ্ডারি আসলে তারাই। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাকে তারাই সুমতি দান করেন। ১৮ নং চিঠিতে গুণময়ের খরচের হিসেবে যেমন একদিকে তাকে যেমন ধামকির রসদ যোগাচ্ছে, অন্যদিকে পরবর্তীতে লুটপাটের বৈধতাও দিচ্ছে। এটা একধরনের ‘উন্নয়নের রাজনীতি’। এ রাজনীতিতে কিছু একটা নির্মাণকে যেমন মহত্ব হিসেবে, ঠিক তেমনি উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবেও হাজির করা হয়। এই উন্নয়নের রাজনীতি এখনো আমাদের দেশে আছে। তাছাড়া (২০ নং চিঠিতে)‘উন্নয়নের রাজনীতি’তে ভবন নির্মাণে বিরোধিতা যেমন উন্নয়নের বিরোধীতা হয়ে দাঁড়ায়, আবার বিরোধীকারীরা অবলীলা ক্রমে ‘বিরোধী দল’ হয়ে যায়। গুণময় নিশা ভট্চাযকে দোষারোপের মধ্যদিয়ে এখানে সেই নীচ চেষ্টা করেছেন। অবশ্য গুণময় এর আগে নিশাবাবুকে চিংড়ি উপঠৌকন পাঠানো ও কথার ফুলঝুড়ির মাধ্যমে বসে রাখার চেষ্টার কোনো কসুর করেননি। আমরা আগেই দেখেছি, নিশা ভট্চার্যের স্পষ্টভাষিতাকে প্রশংসা করা হচ্ছে। যার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে চড়-মাড়ার একটা বাসনা লুকিয়ে থাকছে। পরবর্তীতে দেখি একই ভাবে তাকে বশীকরণের চেষ্টা হচ্ছে। তার বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত হচ্ছে। এমনকি নির্বাচনে সহযোগিতার ইঙ্গিত দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ও ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার প্রচেষ্টা পোক্ত করা হচ্ছে। সেও একধরণের বিনিয়োগ। পুঁজিবাদ তার মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য বরাবরই যা করে আসছে। যে ভাবে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে বাণিজ্য করতে এসে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল। অর্থাৎ এদিক দিয়ে ব্রিটিশ পুঁজি ও দেশি পুঁজির চরিত্র একই।

চার. আধুনিক ব্যবসায়িদের মতো ২১ নং চিঠিতে গুণময়ের রাষ্ট্র সমালোচনা করেন। এটা একধরনের জিঘাংসা থেকে উৎসারিত। ট্রাক্স, ঘুষের ফলে মুনাফার অংশ কমে যাওয়া, তার মোটেই পছন্দ নয়। আবার পাঁচ শো টাকা চাঁদার স্থলে এক হাজার টাকা দিয়ে সে আগামীতে ট্যাক্স ফ্রি, প্রতিবন্ধক, নির্বিঘ্ন বাণিজ্যের পথ প্রসারিত করতে চায়। অন্যদিকে নিশাবাবু গুণময়ের কাছ থেকে ঘুষ-চাঁদা নেয়ার মাধ্যমে সেই আকাঙ্ক্ষাকে বৈধতা দিচ্ছে।

পাঁচ. গ্রামের কাজ বলে গুণময়ের যে ভাল মানুষিতা আছে ২৩নং চিঠিতে সেই উদ্যোমের চেয়ে ব্যবসায়িক হিসেব-কেতাব পরিস্কার হয়ে যায়। কাজ বন্ধ রাখার ‘বাধ্য হওয়া’ প্রথম কিস্তির টাকা না পাওয়ার সঙ্গে গভীর ভাবে যুক্ত। এতে তার টাকার তাগাদা যেমন তৈরি হয়, একই সঙ্গে তার আন্তরিকতার অভাবটাকে আড়াল করে দায়মুক্তি দেয়। তবে টাকার অভাব দেখানো যে একেবারেই ব্যবসায়িক বক্তব্য, তা চিঠির শেষ করে পুনশ্চে মন্ত্রিকে জমি কেনার তাগাদা ও বাড়ি নির্মাণ প্রসঙ্গে অভয় দানের মধ্যে প্রকাশিত হয়। মনে পড়ে, হাসপাতাল তৈরির সময় একই রকম বক্তব্য লিখেছিলেন গুণময়। লক্ষ্যণীয় যে, পুরো গল্পজুড়ে চিঠির মধ্যে বক্তব্য গল্পকারকেও একধরনের আড়াল দিয়ে রেখেছে। আসলে এই দূরত্ব পাঠককে গল্পের বিষয় বক্তব্যে হেঁদিয়ে দেন।

ছয়. প্রথম থেকেই খেলাইকে ‘আমার গ্রাম’ বলে যে আন্তরিকতা জাহির করতে চেয়েছে ২৯নং চিঠিতে দেখি তার উল্টো। তিনি খেলাই বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। একজন কন্ট্রাক্টর বা ব্যবাসায়ি হিসেবে গুণময়ের উদ্যোগ ওই ভবন নির্মাণ পর্যায় পর্যন্তই। একটি ভবনের মহত্ব যে তার উদ্দেশ্য ও ব্যবহারের মধ্যে নিহিত, তা কোনো কন্ট্রাক্টরের জন্য উপলব্ধির বিষয় নয়। আগের লাইনে ‘উনি যদি কিছু করতে পারেন’ এবং পরের বাক্যে ‘উনিই বা কি করবেন।’ এর মধ্যে গুণময় মন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ও দায় স্বীকার করলেও গ্রামবাসীর প্রতি কোনো দায় প্রকাশ পায় না। শেষ পর্যন্ত তা হয়ে দাঁড়ায়ে ‘সরকারী বিষয়’। অনন্তর পরপর তিনটি চিঠি পাওয়ার উত্তর না দেয়ার মধ্যে তা আরো প্রকট হয়। তখন পর্যন্ত গুণময়ের যে কথাবার্তা তার আটকে থাকা বিলের কারণেই। এমন কি ‘দেশের সমস্ত কাজের মূলে কোনো না কোনো কন্ট্রাক্টরের’ বলে হাসপাতাল নির্মাণে গ্রামের মানুষের উদ্যোগ টুকুও মাটিতে পিশে দেয়।



মোট ৩৩টি চিঠিতে উপস্থাপিত হয়েছে গল্প। আসলে একটি হাসপাতালের পোস্টমোর্টেম করা হয়েছে এখানে। আগেই বলা হয়েছে গুণময় একজন ব্যবসায়ি এবং অবশ্যই মুনাফা লোভী। সেজন্য তিনি ধূর্ত ও কৌশলি। তার চিঠির ভাষা কপট, অনান্তরিক, নির্দেশ মূলক ও দূরত্বের। তবে চিঠিগুলোতে গল্পকার অস্তিত্ববাদ, প্রকৃতিবাদ, অভিজ্ঞতাবাদ সহ একাধিক চিন্তার ব্যবহার ঘটিয়েছে। চিঠিতে গ্রামের প্রতি স্মৃতি কাতর অসহাত্বের মধ্যদিয়ে অস্তিত্ববাদ এসেছে। সরকারি অফিস ও বিভিন্ন ব্যক্তি সম্পর্কে বক্তব্যের মধ্যদিয়ে অভিজ্ঞতাবাদের ব্যবহার দেখা যায়। কাজের সম্ভাবনা, পেমেন্টগুলো প্রাপ্তি পরবর্তী মনোভাব এবং অনন্তর সঙ্গে গুণময়ের দ্বন্দ্বের মধ্যদিয়ে প্রকৃতিবাদ পরিষ্কার হয়েছে।

এ গল্পে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অলংকার হচ্ছে ‘পুঃ’ অর্থাৎ ‘পুনশ্চ’ ব্যবহার। পুনশ্চ ব্যবহার করে চিঠির বিষয় বক্তব্যকে জোরদার করার চেষ্টা করা হয়েছে। এটা চিঠির খোলা সমাপ্তিকে নির্দেশ করে। একটি বিষয় হলো, তার কোনো চিঠিতেই তারিখ নেই। ফলে গল্পের দ্বন্দ্ব ও বিষয়বস্তু পরিবর্তীতেও প্রাসঙ্গিক থাকে। এমনকি তা আজকের দিনেও। বিষয়বস্তুর প্রতি জোরারোপের আরো একটি দিক হলো, প্রত্যয়ের ব্যবহার। রমাপদ চৌধুরী গল্পের অনেক জায়গায় ই, ও প্রত্যয় ব্যবহার করেছেন। এমনকি একই লাইনে একাধিক বার ব্যবহার করেছেন। এই দিকটি ব্যাকরণ শুদ্ধ না হলেও তা বিষয় বক্তব্যে জোর দেয়ার জন্য তা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রথম চিঠি থেকে একটি বাক্য উদ্বৃত করছি, যেখানে দেখা যাচ্ছে একই বাক্য তিনি দুইয়ের অধিক প্রত্যয় ব্যবহার করেছেন।‘শহরে বড় বড় বাড়ি বানানো আমার কাজ হলেও খেলাই গ্রামের সেই মাটির ঘরের স্মৃতি কোনওদিনই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।’


‘একটি হাসপাতালের জন্ম ও মৃত্যু’ গল্পের চিঠিগুলোর ভাষা খেয়াল করলে দেখা যায়, সেগুলোয় স্তুতি বা প্রশংসার ছলে নিন্দা বা সমালোচনা করা হচ্ছে কিংবা নিন্দা বা সমালোচনার ছলে প্রশংসা করা হচ্ছে। এটা কোনো ‘প্যারাডক্স’(অপ্রিয় সত্য কথা) নয়। সাহিত্যের আলংকরিক ভাষায় একে বলে ‘ব্যাজস্তুতি’ বা কপট প্রশংসা। রমাপদ চৌধুরী গুণময়ের মাধ্যমে অনেক চিঠিতেই এই ব্যাজস্তুতি করেছেন। বিশেষত মন্ত্রী নুটুদা, বিরোধী দলের নেতা নিশাবাবু এবং সরকারি আমলার বসন্তবাবুকে লেখা চিঠিতে এর ব্যবহার দেখা যায়। কর্মচারী যতীনবাবু ও শিবেনকে কখনো কখনো ব্যাজস্তুতির মাধ্যমে ওই সব ব্যক্তিদের সম্বন্ধে সচেতন করে দিচ্ছেন। ব্যাজস্তুতি এই ব্যবহারে একধরণের আভাষ বা কূটাভাষ লুকায়িত থাকে।

যুদ্ধপূর্ব (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) ইংল্যান্ডে আই এ রিচার্ড ও টি এস এলিয়ট সাহিত্য সমালোচনার নতুন তত্ত্ব-‘নতুন সমালোচনা’ (New Critism) প্রবর্তন করেন। চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আমেরিকান (উত্তর আমেরিকা) তাত্ত্বিকেরা একে আরো বিকশিত করেন। এদের মধ্যে ডব্লিউ কে উইমসাট ও ক্লিনথ ব্রুকসের কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। তাদের বিচারে সাহিত্যের উপাদানগুলোর মধ্যে ব্যাজস্তুতি ও কূটাভাষ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত ব্যাজস্তুতি (Irony) কবিতার মৌলিক বৈশিষ্ট্য। তাদের মতে, ব্যাজস্তুতি হলো একটি জ্ঞানগত নীতি, যা কূটাভাষের মাধ্যমে অলংকারের সাধারণনীতির মধ্যে মিলিয়ে যায়। এটা সেই ১৯৫৭-৫৮ সালের কথা। যখন রমাপদ চৌধুরী আনন্দবাজার পত্রিকার মতো একটি প্রভাবশালী পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। তখন তিনি বিশ্বের যেকোনো আধুনিক সাহিত্য তত্বের সঙ্গেই পরিচিত হচ্ছেন। সাহিত্যে প্রয়োগও করছেন। আমাদের আলোচ্য গল্পটি ১৯৬৪ সালে লেখা। শারদীয় ‘বসুমতি’তে প্রকাশিত হয়েছিল। এই তথ্যসূত্র থেকে ধরে নেয়া যায়, রমাপদ চৌধুরী নতুন সমালোচনা’র এই তত্ত¡টি ব্যবহার করেছেন। বলতে গেলে সফল ব্যবহার ঘটিয়েছেন। সাহিত্যে ব্যাজস্তুতি ব্যবহারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এর ফলে পাঠক স্বক্রিয় হন।

ব্যাজস্তুতি-ব্যবহৃত-সাহিত্য-পাঠের সময় পাঠক রচয়িতার মনোভাবের বিপরীত মনোভাব যুক্ত করেন। অথবা ওই বক্তব্যের বিপরীত মনোভাবের কারণগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকেন। এভাবে ওই বর্ণনার বক্তব্যকে বিশিষ্টগুণযুক্ত করে তোলেন। ফলে ব্যাজস্তুতি পরবর্তীতে কূটাভাষের সঙ্গে সম্পর্কিত বা রূপন্তরিত হয়। খেয়াল করলে দেখা যায়, প্রতিটি চিঠিই যেন এক-একটি চিরকুট। যেখানে বহুবিষয়ের ভেতর দিয়ে একটি বিষয়ই উপস্থাপিত হচ্ছে। এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, গল্পের অলংকরণে রমাপদ চৌধুরী ব্যাজস্তুতি ব্যবহারে যে কূটাভাষ উহ্য রাখেন, তা কি? এ জন্য আমাদের সেই সময়ের দিকে তাকাতে হবে।

সময়ের সূত্র ধরে তৎকালীন পশ্চিম বঙ্গের দিকে তাকালে দেখা যায়, স্বাধীনতা উত্তর সময়ে সারা ভারতই বেশ টালমাটাল। রাষ্ট্রের সঙ্গে পুঁজিমালিকদের দ্বন্দ্ব, শেষ পর্যন্ত যা পুজিবাদের সঙ্গে মানবিকতার দ্বন্দ্ব চলছে। আমলাতান্ত্রিকতা থেকে তখনো বের হতে পারেনি তারা। সংবিধান প্রয়োগে ব্যস্ত রাষ্ট্র। দূর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে সর্বত্র। রাষ্ট্রে অযোগ্যতার মধ্যদিয়ে বিকশিত হচ্ছে নকশালবাড়ি আন্দোলন। অর্থাৎ একটা আমূল পরিবর্তন। এর পরই পশ্চিম বঙ্গে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে অবস্থার কতটুকু পরিবর্তন করেছে, তা এখানে বিবেচ্য নয়। তবে গল্পে যে আমূল পরিবর্তন নির্দেশ করেছে তা কয়েক বছর পরে পশ্চিম বঙ্গে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার মধ্য প্রস্ফুটিত হয়। গল্পের কাল্পনিক নির্মাণের মধ্যদিয়ে রমাপদ চৌধুরী এই বাস্তবতাকে আত্মস্থ করার চেষ্টাটাই করেছেন।০


*রমাপদ চৌধুরীর গল্পের লিঙ্ক-- ‘একটি হাসপাতালের জন্ম ও মৃত্যু’

লেখক পরিচিতি
অলাত এহ্সান

জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। পদ্মার পাড় ঘেঁষে গ্রামের অবস্থান। গহীন গ্রাম। এখানে প্রধানত কলু, কাহার, জেলে, মুচি, তাঁতী, নিম্নবর্গে মানুষেরা বসত করে। প্রতিবছর পদ্মায় ভাঙে। অজস্র মানুষ স্বপ্নভাঙ্গা স্মৃতি নিয়ে শহরমুখী হয়। অধিকাংশ তরুণ জীবিকার প্রয়োজনে পাড়ি জমায় বিদেশে। এটাই যেন নিয়তি। এসবের ভেতরেও থাকে ঘটনা, নানা ঘটনা। এইসব জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। গুলতির বোবা রেখা তাক করে জঙ্গলে জঙ্গলে কেটেছে শৈশব। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন ঢাকা কলেজ থেকে। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত।



alatehasan@yahoo.com, +88 01714 784 385

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ