“Always eyes watching you and the voice enveloping you. Asleep or awake, indoors or out of doors, in the bath or bed- no escape. Nothing was your own except the few cubic centimeters in your skull.” ― George Orwell, 1984
গুলশান লিংক রোডের লেকের পাশে লেগুনাটা থামে। রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। সিগন্যাল ছাড়তে কতক্ষণ লাগে কে জানে। লেকের শরীর ছুঁয়ে ওঠে আসছে শীতল হাওয়া। ঘামে ভেজা শরীর, শির শির করে শীতল অনুভূতি জাগে। গায়ের সঙ্গে লেগে থাকা শার্ট আলগা হতে থাকে। একপ্রান্ত বেঁধে বাতাসে উড়ানো পলিথিন ব্যাগের মতো দোল খায়। রোড ডিভাইডারে দাঁড়িয়ে আছে লিকলিকে সাবালক মেহগনি গাছ। আর ফাঁকে ফাঁকে সোডিয়াম লাইট। আমার কোল থেকে আজানু লেপটে আছে স্টিট লাইটের আবছা আলো। সে আলোয় আমার মুখের আদল খানিকটা বোঝা যায়। তবে সামনে বসা লোকটার মুখ কখনো দেখা যায়, কখনো যায় না।
হঠাৎ একরাশ লেজার লাইটের উজ্জ্বলতা নিয়ে জ্বলে ওঠে তার হাতের দামি মুঠোফোনের মনিটর। তিনি কিছু একটা দেখছেন। এখন তার মুখ দেখা যায়, স্পষ্ট। তার ফুরফুরে মুখ। হয়তো কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর থেকে বেরিয়েই লেগুনায় ওঠেছেন। গায়ে কেমন যেন একটা ঠাণ্ড ঘ্রাণ লেগে আছে এখনো। আমি উঠেছি আরো দুই কিলোমিটার পেছন থেকে। পাঁচজন বসার যোগ্য লেগুনার সিট। কিন্তু ছয়জন বসার গাদাগাদিতে বেশ নাকাল। মানুষের শরীরের তাপে বেশ ভেঁপে উঠেছি। আমিও মুঠোফোনের মনিটর জ্বেলে নিজের মুখটাকে স্পষ্ট করি। লোকটা মুখ তুলে তাকান, স্মিত হাসিমাখা মুখ, ঝুলে আছে একটা হলদেটে বাতাবি লেবুর মতো। আমিও মুখ টিপে হাসি।
কোথায় যাবেন?- তিনি জিজ্ঞেস করেন।
মোহাম্মদপুর- ছোট উত্তর আমার।
প্রায় প্রতিদিন একসঙ্গে আসা হয় আমাদের। যাওয়াটা এক সঙ্গে হয় না। আমি উঠি, যেখান থেকে লেগুনাগুলো ছাড়ে-মোহাম্মদপুর টেম্পুস্ট্যান্ড; তিনি ওঠেন আসাদগেট স্টপিস থেকে। তিনি নামেন গুলশান গোল চত্বরে, আমি আরো দুই কিলোমিটার এগিয়ে, বাড্ডায়। এমন কি যেদিন বাসে যাই, সেদিনও তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, কাকতালীয় ভাবে। তাই তার সঙ্গে আমার মুখ চেনাচিনি সম্পর্ক, খানিকটা হৃদ্যও বটে। শহর এমনই, এভাবেই পরিচয় হয়। এখানে ঘরের মানুষ পর, আর পর মানুষকেই আপন ভাবতে হয়। নইলে কোথাও কারো স্বজন নেই। কোনো কোনো দিন তার সঙ্গে থাকে তিন বছরের মেয়ে রাথী। খুব ছটফটে, একদণ্ড স্বস্থি নেই। এটা কি, ওটা কি, ও দিয়ে কি হয়- ইত্যাদি সব প্রশ্নে মাতিয়ে রাখে সবটুকু সময়। লেগুনায় আমরা খুব চুপচাপ, সুবোধ যাতায়াত করি। মেয়েটা আমাদের এই ভাঁজ পড়া চলাচলকে ভেঙ্গে খান খান করে দেয়। কেউ কেউ বিরক্ত হয়। রাথী মাঝে মাঝে গাড়ির বাইরে হাত দিয়ে রোড ডিভাইডারের বনসাই কৃষ্ণচূড়া, খেজুর, কড়ই গাছের পাতা ছুঁতে চায়। তখনই বিপদ, দ্রুত সামলে নিতে হয়। ঝাপাঝাপি করে কোলে আসে কখনো। অনেক দিন বাড়ি যাওয়া হয় না। রাথীর ঝাপাঝাপিতে বাড়ির শিশুদের মুখগুলো মনে পড়ে।
আপনার মেয়ে কেমন আছে- আমি জিজ্ঞেস করি।
ভাল-একটু থেমে আবার-ভাল আছে। বলতে বলতে তার চোখে মুখে লেগে থাকে পিতৃত্বের গর্বিত আভা।
আপনার হাতে ওটা কী বই-তিনি জিজ্ঞেস করেন, আন্তরিক ও আগ্রহী স্বরে।
উপন্যাস, ওয়ান্ কিউ এইটি ফোর(1Q84), হারুকি মুরাকামির; জাপানি লেখক। লোকটা পাঠ প্রিয় অন্তত, আমি ভাবি।-পড়েছেন?
হ্যাঁ, তবে প্রথমখণ্ড। আপনি জর্জ অরওয়েলের নাইনটিন এইটি ফোর (1984) পড়েছেন নিশ্চয়ই?-তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন।
হ্যাঁ, এটা তো একই থিমের, ট্রিওলজি। সেই বিগ ব্রাদার, লিটল পিপলের ব্যাপার-স্যাপার। বিগ ব্রাদার আমাদের ওপর নজর রাখছে, আর লিটল পিপল অরাজতা করেই যাচ্ছে, মাঝখানে মারের ভাগে আমরা-আমি বিস্তারিত করি।
তিনি স্মিত হাসেন- ‘Big brother is watching you.’
আমি হাসি-
‘Under the spreading chestnut tree
I sold you and you sold me’
এবার দু’জনেই হাসি, হো হো করে। তিনি বলেন-ব্যাপারটা কি রকম উল্টে গেছে, অরওয়েল সেই ১৯৪৯ সালে আমেরিকানদের চোখে স্ট্যালিন-কে নিয়ে লিখলেন নাইনটিন এইটি ফোর (1984), মানে স্ট্যালিন ইজ আ বিগ ব্রাদার। কমিউনিজমকে ট্রিট করে লিখলেন দ্য এনিমেল ফার্ম। মানে একটা ইতর প্রাণিদের আখড়া। যেখানে কোনো দিনও সাম্যের আশা করা কেবল ভুলই নয়, সম্ভবও। এখন, সেই আমেরিকাই বৈষম্যের কারণে হয়ে গেছে সবচেয়ে বড় ‘বিগ ব্রাদার’, নজরদারি আর সন্দেহের জায়গা। তারপরও সেখানেই Occupy Movement-এর মতো একটা বিরাট Movement ঘটে গেল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। মানে অরওয়েলের যুক্তির ঠিক উল্টো। তাই না?
মুরাকমিই মনে হয় সেরাটা দেখিয়েছেন-আমি তার কথায় যোগ করি-এই বিগ ব্রাদার-লিটল পিওপল ব্যাপারটাই চিরন্তন হয়ে গেছে। অরওয়েল সোভিয়েতকে দেখিয়েছিল একটা ইতর প্রাণির আখড়া হিসেবে; আর এখন, পশ্চিমবঙ্গের মাওবাদীরা সংসদকে বলছে- শুয়োরের খোয়ার। কমপ্লিটলি রিভার্স।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তাই- তিনি সমর্থন জানান।
ইতিমধ্যে লেগুনার যাত্রীরা জ্যামে অতিষ্ট হয়ে ওঠেছেন। লেকের তিরতিরে হাওয়া একটা বিশাল ভবনের আড়াল পড়ে গেছে। কপাল জুড়ে বিনবিনে ঘাম। ঘামের একটা চিকন রেখা ঘাড় থেকে শিরদাঁড় বেয়ে নেমে যাচ্ছে ঠিক পায়ু বরাবর, আন্ডার ওয়্যার-প্যান্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে।
একজন যাত্রী বিরক্তির সঙ্গে বলে ওঠেলেন- শালার ট্রাফিক করেটা কি? সব দিকের রাস্তা ছাড়ছে, আর এই সাইডটাই ছাড়ার নাম নাই।
আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে, সব সময়ই এমনটা ঘটে। সবার কাছে মনে হয়, আর সব রাস্তার ছাড়লেও তার পাশটা ছাড়তেই ট্রাফিকের যত গড়িমসি। অবশ্য রাস্তা আটকে রেখে তাদের ব্যবসা যে নেই, তা নয়।
চুদির পোলা ঘুমাইছে নাকি? নাকি বালের ভিআইপি যাইবো এদিক দিয়া?-আরেকজন যাত্রী কথাটা বলেই কপাল কাচেন। গাড়ির সংকীর্ণ প্যাসেজে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম পড়ে।
বেশ ক্ষুব্ধ, বিদগ্ধ ভাবে অপর একজন যাত্রী বলেন- সবগুলারে একচোট পিটাতে পারলে ঠিক হতো, দেখতেন রাস্তা কেমন ফাঁকা হয়ে যায় মুহূর্তেই।
দেখেন নাই- বলে ওঠেন আরো একজন, স্টিট লাইটের আলোয় তার হাত ঘড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল- ’০৬ থেকে ’১০ পর্যন্ত সব মানুষ কি রকম ঠিক ছিল। মামুগো আবার নামিয়ে দিলে দুইদিনেই পিটিয়ে একদম ঠিক করে দিত। সব টনটনা সোজা।
লেগুনার ঠিক কোণায়, বাতির অন্ধকারে খেয়াল করিনি, একজন যাত্রী বলে ওঠেন- সবাই তখন তো খালি খেইল দেখছে, রাস্তায় বিএমডাব্লিউ গাড়ি ফেলে দৌড়েছে। বাঙালির তো ভাল জিনিস সহ্য হয় না। চিল্লা-চিল্লি শুরু করে দেয়। এদের একমাত্র তারাই ঠিক করতে পারে।- খুব ভাঁজ করে কথা বলেন তিনি।
এ সবরে মধ্যে আমার পরিচিত লোকের সম্বন্ধে যা যা জেনেছি তা হল- তিনি একটি রিয়্যাল স্টেট কোম্পানির জুনিয়র একাউনটেন্ট। পড়ালেখা করেছেন ইংরেজি সাহিত্যে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুনে আমি অবশ্য হাসলাম না। পাঠ্য বইয়ের বাইরে তার পড়াশুনা ভাল- তা বিলক্ষণ বোঝা যায়। তার স্ত্রী একটি এনজিও’র প্রোগ্রাম অফিসার। যেদিন তার স্ত্রীর জোনাল অফিস ট্যুর বা ফিল্ড ভিজিট থাকে সেদিন তিনি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন- হ, তাই তো, ’০৬-এর আগে পনে দুই পয়েন্ট পেয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, আর মামুগো বছরগুলোতে প্রায় আড়াই পয়েন্ট নিয়েও সেকেন্ড প্লেসে থাকতে হয়েছে। তাহলে ভাল না? কত্ত ভাল। মাঝখান থেকে ঘুষের একটা রেট বাড়েছে, আর কী?
তার কথাগুলো সবাইকে কাঠ গড়ায় দাঁড় করে দিয়েছে। কেউ কিছু বলে না। কেউ কেউ নিজের মতো গজগজ করছিল।
আমি নিজের সম্বন্ধে যে যৎসামান্য ফিরিস্তি তুলে ধরেছি, তা এরকম- বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। রেজাল্টও ভাল ছিল। এ বিষয়ে বিদেশে স্কলারশিপ একেবারে দুর্লভ, নাই বলতে নাই। তাই বিদেশে যাওয়া হয়নি। ২০০৬-’১০, টানা চার-চারবার বিসিএস পরীক্ষায় ভাইবা বোর্ড থেকে বাদ পরেছি। পরে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স করে এখন বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করি। টুকটাক লেখালেখির ঝোঁক আছে। আমি বললাম- হ, এমনই ভাল যে এখন ডাক্তারখানা থেকে পায়গানার মাতর মামুরা। তখন মানুষজন রাস্তার পাড়ে প্রশ্রাবের ভয়ে বাসা থেকে করে বের হতো, নয়তো ভয়ে টাকা দিয়ে পাবলিক টয়লেটে হাগু করে আসতো। আর কয়দিন থাকলে মানুষ আগা-মুতা সব প্যান্টে করতো, আর দফতরে গিয়ে টাকা দিয়ে আসতো।
সবার ভেতর কেমন যেন অস্বস্থি। গুয়ের গন্ধ ছড়াচ্ছে যেনবা। আমার পরিচিতজন বলেন- সত্যিই, তাই হতো।
আলো-আঁধারিতে থাকা লোকটা আদিষ্ট স্বরে বলেন- ভাই রাখেন তো এইসব। খানিকটা স্বগোক্তির মতো বলেন-খালি প্যাঁচাল। তারপর মহাবিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকান।
আমাদের গাড়ি ততক্ষণে সিগন্যাল পেরিয়ে চলতে শুরু করেছে। গুলশান লেক-টিভি গেট-তিতুমীর কলেজ পেরিয়ে মহাখালী। হেলপার ছোকড়াটা একে একে সবগুলো স্টেশনের নাম বলে হাঁক দিচ্ছে।
মহাখালী রেল ক্রসিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে কোণায় বসা লোকটাকে আবার দেখলাম, আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একবার ভ্রু নাচাই। প্রচলিত অর্থে এর মানে দাঁড়ায়-কি, কিছু বলবেন? তিনি বিরবির করে ওঠেন। কিন্তু উত্তর পাওয়ার আগেই ঝাকুনি দিয়ে গাড়ি ক্রসিং পার হয়। আমার আমাদের জায়গায় একঝলক উছলে ওঠে নড়ে বসি, কোমড় নাড়িরে জায়গা ঠিক করি। আলো-আঁধারিতে লোকটার চেহারা তলিয়ে যায়। আমি পরিচিত লোকটার সঙ্গে অন্য আলাপে মত্ত হই। প্রতিদিন কয়টায় আসতে হয়, গ্রামে যান কিনা, মোইবাল ফোনের বাজার মূল্য, ঢাকায় একখণ্ড জমিরই বা কি দাম ইত্যাদি। গাড়ির দুলনির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গলার স্বরও ওঠা-নামা করে।
লেগুনাটা বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ জাহাংগীর গেটের কাছে পৌঁছে। এখানে এলে মনের ভেতর যুগপদ শ্রদ্ধা, গর্ব এবং ভয় জেগে ওঠে। হঠাৎ এক প্রচণ্ড ধাক্কা আমাদের শরীর ঝাঁকিয়ে দিল। প্রথমে মনে হয়েছিল, এ্যাকসিডেন্ট। আসলে, গাড়িটি স্থানুবর্তী হয়ে থামলো। আমার পরিচিতজন তাঁতিয়ে ওঠেন- এই মিয়া! বন গরুর মতো কোথায় পাড়া দেন? নন সেন্স! আলো-আঁধারির লোকটা পা ঠেলে বেরুতে বেরুতে আমাদের দু’জনের পা মাড়িয়ে দিয়ে গেছেন। লোকটা গজ গজ করে ওঠেন- শুয়োরের বাচ্চা, বাস্টার্ড সিভিলিয়ান। রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আমাদের দিকে, সাপের মতো পটতুলে।
আমি নিজেকে সামলে নিতে নিতে খেয়াল করি, লোকটার পায়ে বুট, প্যান্টের প্রান্ত বুটের ভেতর প্রবেশ করানো। বুটের ফিতা টাকনুর ওপরে উপর পেঁচিয়ে বাঁধা। তিনি গট গট করে হেঁটে গিয়ে ট্যাংকের পাশে দাঁড়ান। তারপর গেট দিয়ে প্রবেশ করেন।
বিজয় সরণী মোড় পার হতেই আমাদের কানে ভেসে আসে একটা পরিচিত গানের দুই লাইন , একজন ভিখারী গাইছেন-
‘আমি দেখি নাই শুনি নাই তারে
মাইনসে শুনে মাইনসের কথা রে...’
পরিচিত লোকটা বলেন- শুনলেন, ‘আমি দেখি নাই শুনি নাই তারে...’ ইজ ইনডিগেট ইউর বিগ ব্রাদারনেস অলসো?
আমরা আবার নিজেদের স্বাভাবিক কথায় ফিরলাম। হুমমম-আমি বলি- স্র্রষ্টা নিজেই একজন বিগ ব্রাদার। আফটার অল, নিজের কারিশমা আর প্রেরিত পুরুষ রক্ষায়। কেন, তিনি কি মানুষকে লিটল পিপল বানিয়ে বিগ ব্রাদারগিরি করছে না? অফ কোর্স করেছেন। যদিও তিনি মহতি ইমেজ রক্ষায় সদা তৎপর।
আমরা খুব দ্রুতই পরের পথটুকু পেরিয়ে এলাম। তিনি আসাদে গেটে নামলেন, সৌজন্য শুভেচ্ছা বিনিয়ম করেই।
পরের দিন শুক্রবার, আমার ছুটি। শনিবার আমার ক্লাস ছিল না বলে কলেজে যাইনি। রবিবার কলেজে শেষে একটু আগে রওনা দিলাম, ডাবল ডেকারে। সপ্তাহের প্রথম পূর্ণদিবসে রাস্তায় একটু ভীড় থাকবে, এই ভেবে। ফিরতি পথে লেকের ধারে এসেই বাস ব্রেক কষলো। একটু একটু করে এগুতে এগুতে একটা ব্যানার সংবলিত ভবনের পাশে এসে থামলাল। প্রথমে খেয়াল করিনি। একটা কালো ব্যানারে একজনে ছবি। নিচে লেখা- রাফিন আহমেদের অকাল প্রয়াণে আমরা শোকাহত। কর্তৃপক্ষ। আমি চমকে উঠলাম। আতিবাতি করে দেখছিলাম। ছবির লোকটা আমার পরিচিত। দু’দিন যার সঙ্গে লেগুনায় আলাপ হচ্ছিল। ইতোমধ্যে টিকিট চেকার কয়েকবার ডেকেছেন। খেয়াল করিনি। তিনি একবার উঁকি দিয়ে বলেন- পরশুদিন নাকি লোকটাকে বাড়ি থেকে কারা তুলে নিয়েগিয়েছি। কালকে এই লেকের পানিতেই তার লাশ পাওয়া গেছে। শরীর একদম ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল! আমি তার দিকে হতবিহ্বলের মতো তাকাই। যেন কিছু শুনিনি, কিংবা তার মানে হতে পারে-কৈ! পত্রপত্রিকায় কোথাও তো দেখলাম না! পত্রিকায় কি আর সব দেখা যায়-আমি মনে মনে ভাবি। আর উদাস হই। তার সেই কথাটা মনে পড়ে-‘Big brother is watching you.’
গাড়ি পেরিয়ে চলে টিভিগেট-তিতুমীর কলেজ-মহাখালী-রেল ক্রসিং হয়ে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ জাহাংগীর গেট। সেই ট্যাংকটা, সেখানেই দাঁড়িয়ে। তার নলের ভেতরে আরো কিছু অন্ধকার, জমাট বেঁধে আছে।
জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। পদ্মার পাড় ঘেঁষে গ্রামের অবস্থান। গহীন গ্রাম। এখানে প্রধানত কলু, কাহার, জেলে, মুচি, তাঁতী, নিম্নবর্গে মানুষেরা বসত করে। প্রতিবছর পদ্মায় ভাঙে। অজস্র মানুষ স্বপ্নভাঙ্গা স্মৃতি নিয়ে শহরমুখী হয়। অধিকাংশ তরুণ জীবিকার প্রয়োজনে পাড়ি জমায় বিদেশে। এটাই যেন নিয়তি। এসবের ভেতরেও থাকে ঘটনা, নানা ঘটনা। এইসব জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। গুলতির বোবা রেখা তাক করে জঙ্গলে জঙ্গলে কেটেছে শৈশব। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন ঢাকা কলেজ থেকে। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত। alatehasan@yahoo.com
গুলশান লিংক রোডের লেকের পাশে লেগুনাটা থামে। রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। সিগন্যাল ছাড়তে কতক্ষণ লাগে কে জানে। লেকের শরীর ছুঁয়ে ওঠে আসছে শীতল হাওয়া। ঘামে ভেজা শরীর, শির শির করে শীতল অনুভূতি জাগে। গায়ের সঙ্গে লেগে থাকা শার্ট আলগা হতে থাকে। একপ্রান্ত বেঁধে বাতাসে উড়ানো পলিথিন ব্যাগের মতো দোল খায়। রোড ডিভাইডারে দাঁড়িয়ে আছে লিকলিকে সাবালক মেহগনি গাছ। আর ফাঁকে ফাঁকে সোডিয়াম লাইট। আমার কোল থেকে আজানু লেপটে আছে স্টিট লাইটের আবছা আলো। সে আলোয় আমার মুখের আদল খানিকটা বোঝা যায়। তবে সামনে বসা লোকটার মুখ কখনো দেখা যায়, কখনো যায় না।
হঠাৎ একরাশ লেজার লাইটের উজ্জ্বলতা নিয়ে জ্বলে ওঠে তার হাতের দামি মুঠোফোনের মনিটর। তিনি কিছু একটা দেখছেন। এখন তার মুখ দেখা যায়, স্পষ্ট। তার ফুরফুরে মুখ। হয়তো কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর থেকে বেরিয়েই লেগুনায় ওঠেছেন। গায়ে কেমন যেন একটা ঠাণ্ড ঘ্রাণ লেগে আছে এখনো। আমি উঠেছি আরো দুই কিলোমিটার পেছন থেকে। পাঁচজন বসার যোগ্য লেগুনার সিট। কিন্তু ছয়জন বসার গাদাগাদিতে বেশ নাকাল। মানুষের শরীরের তাপে বেশ ভেঁপে উঠেছি। আমিও মুঠোফোনের মনিটর জ্বেলে নিজের মুখটাকে স্পষ্ট করি। লোকটা মুখ তুলে তাকান, স্মিত হাসিমাখা মুখ, ঝুলে আছে একটা হলদেটে বাতাবি লেবুর মতো। আমিও মুখ টিপে হাসি।
কোথায় যাবেন?- তিনি জিজ্ঞেস করেন।
মোহাম্মদপুর- ছোট উত্তর আমার।
প্রায় প্রতিদিন একসঙ্গে আসা হয় আমাদের। যাওয়াটা এক সঙ্গে হয় না। আমি উঠি, যেখান থেকে লেগুনাগুলো ছাড়ে-মোহাম্মদপুর টেম্পুস্ট্যান্ড; তিনি ওঠেন আসাদগেট স্টপিস থেকে। তিনি নামেন গুলশান গোল চত্বরে, আমি আরো দুই কিলোমিটার এগিয়ে, বাড্ডায়। এমন কি যেদিন বাসে যাই, সেদিনও তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, কাকতালীয় ভাবে। তাই তার সঙ্গে আমার মুখ চেনাচিনি সম্পর্ক, খানিকটা হৃদ্যও বটে। শহর এমনই, এভাবেই পরিচয় হয়। এখানে ঘরের মানুষ পর, আর পর মানুষকেই আপন ভাবতে হয়। নইলে কোথাও কারো স্বজন নেই। কোনো কোনো দিন তার সঙ্গে থাকে তিন বছরের মেয়ে রাথী। খুব ছটফটে, একদণ্ড স্বস্থি নেই। এটা কি, ওটা কি, ও দিয়ে কি হয়- ইত্যাদি সব প্রশ্নে মাতিয়ে রাখে সবটুকু সময়। লেগুনায় আমরা খুব চুপচাপ, সুবোধ যাতায়াত করি। মেয়েটা আমাদের এই ভাঁজ পড়া চলাচলকে ভেঙ্গে খান খান করে দেয়। কেউ কেউ বিরক্ত হয়। রাথী মাঝে মাঝে গাড়ির বাইরে হাত দিয়ে রোড ডিভাইডারের বনসাই কৃষ্ণচূড়া, খেজুর, কড়ই গাছের পাতা ছুঁতে চায়। তখনই বিপদ, দ্রুত সামলে নিতে হয়। ঝাপাঝাপি করে কোলে আসে কখনো। অনেক দিন বাড়ি যাওয়া হয় না। রাথীর ঝাপাঝাপিতে বাড়ির শিশুদের মুখগুলো মনে পড়ে।
আপনার মেয়ে কেমন আছে- আমি জিজ্ঞেস করি।
ভাল-একটু থেমে আবার-ভাল আছে। বলতে বলতে তার চোখে মুখে লেগে থাকে পিতৃত্বের গর্বিত আভা।
আপনার হাতে ওটা কী বই-তিনি জিজ্ঞেস করেন, আন্তরিক ও আগ্রহী স্বরে।
উপন্যাস, ওয়ান্ কিউ এইটি ফোর(1Q84), হারুকি মুরাকামির; জাপানি লেখক। লোকটা পাঠ প্রিয় অন্তত, আমি ভাবি।-পড়েছেন?
হ্যাঁ, তবে প্রথমখণ্ড। আপনি জর্জ অরওয়েলের নাইনটিন এইটি ফোর (1984) পড়েছেন নিশ্চয়ই?-তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন।
হ্যাঁ, এটা তো একই থিমের, ট্রিওলজি। সেই বিগ ব্রাদার, লিটল পিপলের ব্যাপার-স্যাপার। বিগ ব্রাদার আমাদের ওপর নজর রাখছে, আর লিটল পিপল অরাজতা করেই যাচ্ছে, মাঝখানে মারের ভাগে আমরা-আমি বিস্তারিত করি।
তিনি স্মিত হাসেন- ‘Big brother is watching you.’
আমি হাসি-
‘Under the spreading chestnut tree
I sold you and you sold me’
এবার দু’জনেই হাসি, হো হো করে। তিনি বলেন-ব্যাপারটা কি রকম উল্টে গেছে, অরওয়েল সেই ১৯৪৯ সালে আমেরিকানদের চোখে স্ট্যালিন-কে নিয়ে লিখলেন নাইনটিন এইটি ফোর (1984), মানে স্ট্যালিন ইজ আ বিগ ব্রাদার। কমিউনিজমকে ট্রিট করে লিখলেন দ্য এনিমেল ফার্ম। মানে একটা ইতর প্রাণিদের আখড়া। যেখানে কোনো দিনও সাম্যের আশা করা কেবল ভুলই নয়, সম্ভবও। এখন, সেই আমেরিকাই বৈষম্যের কারণে হয়ে গেছে সবচেয়ে বড় ‘বিগ ব্রাদার’, নজরদারি আর সন্দেহের জায়গা। তারপরও সেখানেই Occupy Movement-এর মতো একটা বিরাট Movement ঘটে গেল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। মানে অরওয়েলের যুক্তির ঠিক উল্টো। তাই না?
মুরাকমিই মনে হয় সেরাটা দেখিয়েছেন-আমি তার কথায় যোগ করি-এই বিগ ব্রাদার-লিটল পিওপল ব্যাপারটাই চিরন্তন হয়ে গেছে। অরওয়েল সোভিয়েতকে দেখিয়েছিল একটা ইতর প্রাণির আখড়া হিসেবে; আর এখন, পশ্চিমবঙ্গের মাওবাদীরা সংসদকে বলছে- শুয়োরের খোয়ার। কমপ্লিটলি রিভার্স।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তাই- তিনি সমর্থন জানান।
ইতিমধ্যে লেগুনার যাত্রীরা জ্যামে অতিষ্ট হয়ে ওঠেছেন। লেকের তিরতিরে হাওয়া একটা বিশাল ভবনের আড়াল পড়ে গেছে। কপাল জুড়ে বিনবিনে ঘাম। ঘামের একটা চিকন রেখা ঘাড় থেকে শিরদাঁড় বেয়ে নেমে যাচ্ছে ঠিক পায়ু বরাবর, আন্ডার ওয়্যার-প্যান্ট ভিজিয়ে দিচ্ছে।
একজন যাত্রী বিরক্তির সঙ্গে বলে ওঠেলেন- শালার ট্রাফিক করেটা কি? সব দিকের রাস্তা ছাড়ছে, আর এই সাইডটাই ছাড়ার নাম নাই।
আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে, সব সময়ই এমনটা ঘটে। সবার কাছে মনে হয়, আর সব রাস্তার ছাড়লেও তার পাশটা ছাড়তেই ট্রাফিকের যত গড়িমসি। অবশ্য রাস্তা আটকে রেখে তাদের ব্যবসা যে নেই, তা নয়।
চুদির পোলা ঘুমাইছে নাকি? নাকি বালের ভিআইপি যাইবো এদিক দিয়া?-আরেকজন যাত্রী কথাটা বলেই কপাল কাচেন। গাড়ির সংকীর্ণ প্যাসেজে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম পড়ে।
বেশ ক্ষুব্ধ, বিদগ্ধ ভাবে অপর একজন যাত্রী বলেন- সবগুলারে একচোট পিটাতে পারলে ঠিক হতো, দেখতেন রাস্তা কেমন ফাঁকা হয়ে যায় মুহূর্তেই।
দেখেন নাই- বলে ওঠেন আরো একজন, স্টিট লাইটের আলোয় তার হাত ঘড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল- ’০৬ থেকে ’১০ পর্যন্ত সব মানুষ কি রকম ঠিক ছিল। মামুগো আবার নামিয়ে দিলে দুইদিনেই পিটিয়ে একদম ঠিক করে দিত। সব টনটনা সোজা।
লেগুনার ঠিক কোণায়, বাতির অন্ধকারে খেয়াল করিনি, একজন যাত্রী বলে ওঠেন- সবাই তখন তো খালি খেইল দেখছে, রাস্তায় বিএমডাব্লিউ গাড়ি ফেলে দৌড়েছে। বাঙালির তো ভাল জিনিস সহ্য হয় না। চিল্লা-চিল্লি শুরু করে দেয়। এদের একমাত্র তারাই ঠিক করতে পারে।- খুব ভাঁজ করে কথা বলেন তিনি।
এ সবরে মধ্যে আমার পরিচিত লোকের সম্বন্ধে যা যা জেনেছি তা হল- তিনি একটি রিয়্যাল স্টেট কোম্পানির জুনিয়র একাউনটেন্ট। পড়ালেখা করেছেন ইংরেজি সাহিত্যে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুনে আমি অবশ্য হাসলাম না। পাঠ্য বইয়ের বাইরে তার পড়াশুনা ভাল- তা বিলক্ষণ বোঝা যায়। তার স্ত্রী একটি এনজিও’র প্রোগ্রাম অফিসার। যেদিন তার স্ত্রীর জোনাল অফিস ট্যুর বা ফিল্ড ভিজিট থাকে সেদিন তিনি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন- হ, তাই তো, ’০৬-এর আগে পনে দুই পয়েন্ট পেয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, আর মামুগো বছরগুলোতে প্রায় আড়াই পয়েন্ট নিয়েও সেকেন্ড প্লেসে থাকতে হয়েছে। তাহলে ভাল না? কত্ত ভাল। মাঝখান থেকে ঘুষের একটা রেট বাড়েছে, আর কী?
তার কথাগুলো সবাইকে কাঠ গড়ায় দাঁড় করে দিয়েছে। কেউ কিছু বলে না। কেউ কেউ নিজের মতো গজগজ করছিল।
আমি নিজের সম্বন্ধে যে যৎসামান্য ফিরিস্তি তুলে ধরেছি, তা এরকম- বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। রেজাল্টও ভাল ছিল। এ বিষয়ে বিদেশে স্কলারশিপ একেবারে দুর্লভ, নাই বলতে নাই। তাই বিদেশে যাওয়া হয়নি। ২০০৬-’১০, টানা চার-চারবার বিসিএস পরীক্ষায় ভাইবা বোর্ড থেকে বাদ পরেছি। পরে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স করে এখন বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করি। টুকটাক লেখালেখির ঝোঁক আছে। আমি বললাম- হ, এমনই ভাল যে এখন ডাক্তারখানা থেকে পায়গানার মাতর মামুরা। তখন মানুষজন রাস্তার পাড়ে প্রশ্রাবের ভয়ে বাসা থেকে করে বের হতো, নয়তো ভয়ে টাকা দিয়ে পাবলিক টয়লেটে হাগু করে আসতো। আর কয়দিন থাকলে মানুষ আগা-মুতা সব প্যান্টে করতো, আর দফতরে গিয়ে টাকা দিয়ে আসতো।
সবার ভেতর কেমন যেন অস্বস্থি। গুয়ের গন্ধ ছড়াচ্ছে যেনবা। আমার পরিচিতজন বলেন- সত্যিই, তাই হতো।
আলো-আঁধারিতে থাকা লোকটা আদিষ্ট স্বরে বলেন- ভাই রাখেন তো এইসব। খানিকটা স্বগোক্তির মতো বলেন-খালি প্যাঁচাল। তারপর মহাবিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকান।
আমাদের গাড়ি ততক্ষণে সিগন্যাল পেরিয়ে চলতে শুরু করেছে। গুলশান লেক-টিভি গেট-তিতুমীর কলেজ পেরিয়ে মহাখালী। হেলপার ছোকড়াটা একে একে সবগুলো স্টেশনের নাম বলে হাঁক দিচ্ছে।
মহাখালী রেল ক্রসিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে কোণায় বসা লোকটাকে আবার দেখলাম, আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একবার ভ্রু নাচাই। প্রচলিত অর্থে এর মানে দাঁড়ায়-কি, কিছু বলবেন? তিনি বিরবির করে ওঠেন। কিন্তু উত্তর পাওয়ার আগেই ঝাকুনি দিয়ে গাড়ি ক্রসিং পার হয়। আমার আমাদের জায়গায় একঝলক উছলে ওঠে নড়ে বসি, কোমড় নাড়িরে জায়গা ঠিক করি। আলো-আঁধারিতে লোকটার চেহারা তলিয়ে যায়। আমি পরিচিত লোকটার সঙ্গে অন্য আলাপে মত্ত হই। প্রতিদিন কয়টায় আসতে হয়, গ্রামে যান কিনা, মোইবাল ফোনের বাজার মূল্য, ঢাকায় একখণ্ড জমিরই বা কি দাম ইত্যাদি। গাড়ির দুলনির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গলার স্বরও ওঠা-নামা করে।
লেগুনাটা বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ জাহাংগীর গেটের কাছে পৌঁছে। এখানে এলে মনের ভেতর যুগপদ শ্রদ্ধা, গর্ব এবং ভয় জেগে ওঠে। হঠাৎ এক প্রচণ্ড ধাক্কা আমাদের শরীর ঝাঁকিয়ে দিল। প্রথমে মনে হয়েছিল, এ্যাকসিডেন্ট। আসলে, গাড়িটি স্থানুবর্তী হয়ে থামলো। আমার পরিচিতজন তাঁতিয়ে ওঠেন- এই মিয়া! বন গরুর মতো কোথায় পাড়া দেন? নন সেন্স! আলো-আঁধারির লোকটা পা ঠেলে বেরুতে বেরুতে আমাদের দু’জনের পা মাড়িয়ে দিয়ে গেছেন। লোকটা গজ গজ করে ওঠেন- শুয়োরের বাচ্চা, বাস্টার্ড সিভিলিয়ান। রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আমাদের দিকে, সাপের মতো পটতুলে।
আমি নিজেকে সামলে নিতে নিতে খেয়াল করি, লোকটার পায়ে বুট, প্যান্টের প্রান্ত বুটের ভেতর প্রবেশ করানো। বুটের ফিতা টাকনুর ওপরে উপর পেঁচিয়ে বাঁধা। তিনি গট গট করে হেঁটে গিয়ে ট্যাংকের পাশে দাঁড়ান। তারপর গেট দিয়ে প্রবেশ করেন।
বিজয় সরণী মোড় পার হতেই আমাদের কানে ভেসে আসে একটা পরিচিত গানের দুই লাইন , একজন ভিখারী গাইছেন-
‘আমি দেখি নাই শুনি নাই তারে
মাইনসে শুনে মাইনসের কথা রে...’
পরিচিত লোকটা বলেন- শুনলেন, ‘আমি দেখি নাই শুনি নাই তারে...’ ইজ ইনডিগেট ইউর বিগ ব্রাদারনেস অলসো?
আমরা আবার নিজেদের স্বাভাবিক কথায় ফিরলাম। হুমমম-আমি বলি- স্র্রষ্টা নিজেই একজন বিগ ব্রাদার। আফটার অল, নিজের কারিশমা আর প্রেরিত পুরুষ রক্ষায়। কেন, তিনি কি মানুষকে লিটল পিপল বানিয়ে বিগ ব্রাদারগিরি করছে না? অফ কোর্স করেছেন। যদিও তিনি মহতি ইমেজ রক্ষায় সদা তৎপর।
আমরা খুব দ্রুতই পরের পথটুকু পেরিয়ে এলাম। তিনি আসাদে গেটে নামলেন, সৌজন্য শুভেচ্ছা বিনিয়ম করেই।
পরের দিন শুক্রবার, আমার ছুটি। শনিবার আমার ক্লাস ছিল না বলে কলেজে যাইনি। রবিবার কলেজে শেষে একটু আগে রওনা দিলাম, ডাবল ডেকারে। সপ্তাহের প্রথম পূর্ণদিবসে রাস্তায় একটু ভীড় থাকবে, এই ভেবে। ফিরতি পথে লেকের ধারে এসেই বাস ব্রেক কষলো। একটু একটু করে এগুতে এগুতে একটা ব্যানার সংবলিত ভবনের পাশে এসে থামলাল। প্রথমে খেয়াল করিনি। একটা কালো ব্যানারে একজনে ছবি। নিচে লেখা- রাফিন আহমেদের অকাল প্রয়াণে আমরা শোকাহত। কর্তৃপক্ষ। আমি চমকে উঠলাম। আতিবাতি করে দেখছিলাম। ছবির লোকটা আমার পরিচিত। দু’দিন যার সঙ্গে লেগুনায় আলাপ হচ্ছিল। ইতোমধ্যে টিকিট চেকার কয়েকবার ডেকেছেন। খেয়াল করিনি। তিনি একবার উঁকি দিয়ে বলেন- পরশুদিন নাকি লোকটাকে বাড়ি থেকে কারা তুলে নিয়েগিয়েছি। কালকে এই লেকের পানিতেই তার লাশ পাওয়া গেছে। শরীর একদম ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল! আমি তার দিকে হতবিহ্বলের মতো তাকাই। যেন কিছু শুনিনি, কিংবা তার মানে হতে পারে-কৈ! পত্রপত্রিকায় কোথাও তো দেখলাম না! পত্রিকায় কি আর সব দেখা যায়-আমি মনে মনে ভাবি। আর উদাস হই। তার সেই কথাটা মনে পড়ে-‘Big brother is watching you.’
গাড়ি পেরিয়ে চলে টিভিগেট-তিতুমীর কলেজ-মহাখালী-রেল ক্রসিং হয়ে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ জাহাংগীর গেট। সেই ট্যাংকটা, সেখানেই দাঁড়িয়ে। তার নলের ভেতরে আরো কিছু অন্ধকার, জমাট বেঁধে আছে।
লেখক পরিচিতি
অলাত এহসান
জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আরো ভেতরে, বারুয়াখালী গ্রামে। পদ্মার পাড় ঘেঁষে গ্রামের অবস্থান। গহীন গ্রাম। এখানে প্রধানত কলু, কাহার, জেলে, মুচি, তাঁতী, নিম্নবর্গে মানুষেরা বসত করে। প্রতিবছর পদ্মায় ভাঙে। অজস্র মানুষ স্বপ্নভাঙ্গা স্মৃতি নিয়ে শহরমুখী হয়। অধিকাংশ তরুণ জীবিকার প্রয়োজনে পাড়ি জমায় বিদেশে। এটাই যেন নিয়তি। এসবের ভেতরেও থাকে ঘটনা, নানা ঘটনা। এইসব জীবন বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। গুলতির বোবা রেখা তাক করে জঙ্গলে জঙ্গলে কেটেছে শৈশব। পারিবারিক দরিদ্রতা ও নিম্নবিত্ত অচ্ছ্যুত শ্রেণীর মধ্যে বসত, জীবনকে দেখিয়েছে কাছ থেকে। পড়াশুনা করেছেন ঢাকা কলেজ থেকে। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও মূলত গল্পকার। প্রবন্ধ লিখেন। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ ‘পুরো ব্যাপারটাই প্রায়শ্চিত্ব ছিল’। প্রবন্ধের বই প্রকাশের কাজ চলছে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত। alatehasan@yahoo.com
1 মন্তব্যসমূহ
লেখাটি পরে ভাল লাগল ।
উত্তরমুছুনআশা করি আরও ভাল লিখবেন ।